একজন বিশাল পরিমাপের মানুষ

ষাটের দশকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন অনেকের লেখা পড়তাম। তখন থেকেই হক ভাইকে লেখার মধ্য দিয়ে চিনি। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘তাস’-এর কথা শুনেছিলাম সেই সময়ে। একুশের সংকলনে প্রকাশিত তাঁর কবিতা পড়েছিলাম। তারপর পড়েছি ‘রক্তগোলাপ’, ‘আনন্দের মৃত্যু’ বইগুলো। হক ভাইকে দেখি স্বাধীন বাংলাদেশে। এর আগে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ই ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশে দেখা হয়, বাংলা একাডেমিতে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত। বাংলা একাডেমির বর্ধমান ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে বলেছিলেন, “তোমার ‘পরজন্ম’ গল্পটি আমার খুব ভালো লেগেছে।” মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা সেই গল্পটা। আর বাংলা একাডেমিতে তিনি যখনই আসতেন, আমাদের রুমে তাঁর আড্ডা হতো। রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, রশীদ হায়দার ছিলেন। জমিয়ে আড্ডা হতো। এটাও একটা বড় পরিসর ছিল। শিশু একাডেমিতে আসতেন। ওখানেও দেখা হয়েছে। তাঁর ছোটদের বই ছাপা হয়েছে। ওখানে আমি যখন চেয়ারম্যান হলাম, তখন ভাবলাম, শিশু একাডেমিতে হক ভাইয়ের একটা সংকলন থাকবে। এটার জন্য আমি একটা বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলাম। হক ভাই সেই সংকলনের জন্য কবিতাগুলো নির্বাচন করে দিয়েছিলেন। সেই বইটা বের করেছিলাম। খুশি হয়েছিলেন। ‘খেলারাম খেলে যা’ নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল একসময়। আমি তার বিরুদ্ধে ছিলাম। আমি বলেছি, সাহিত্যে এ ধরনের কোনো বিতর্ক হতে পারে না। পরবর্তী সময়ে দেখেছি, সেই বিতর্ক আর ধোপে টেকেনি। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আমার মেয়ে লারা যখন প্লেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল, সেদিনই প্রথম হক ভাই আমার বাড়িতে এসেছিলেন। অসংখ্য-অজস্র লোক ছিল। আমার তখন তাঁকে জানার সুযোগ ছিল না। কারণ তখন আমার জ্ঞানই ছিল না। পরে অনেকের কাছ থেকে শুনেছি, হক ভাই বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারেননি। তিনি বাড়ির গেটের বাইরে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর চলে গেছেন। আমার সঙ্গে দেখা করারও চেষ্টা করেননি। হক ভাইয়ের সঙ্গে বেশ কিছু স্মৃতি আছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলেন। তাঁর সঙ্গে আমরা চারজন সফরসঙ্গী হিসেবে নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলাম—সৈয়দ শামসুল হক, হাসান ইমাম, আমি ও লায়লা হাসান। এই চারজনকে সফরসঙ্গী করেছিলেন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে। আমরা কলকাতার একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমি, সৈয়দ হক, আনোয়ারা সৈয়দ হক, কামাল চৌধুরী—আরো দু-একজন ছিলেন। আমরা একটা গাড়ি ভাড়া করে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম। একটা রেস্টুরেন্টে আমরা খেতে নেমেছিলাম, তখন ভাবি হক ভাইকে বলছিলেন, খাবার নিয়ে বাছাবাছির দরকার নেই। একটু ভালো হলে, একটু স্বাস্থ্যসম্মত হলে সেটাই খেয়ে নেওয়া উচিত। আরেকবার গিয়েছিলাম ভুটানে। সেখানে একটা সাবকালচারাল সেন্টার ছিল। ওরা সেবার ভুটানে দাওয়াত করেছিল। বাংলাদেশ থেকে কয়েকজনকে পাঠাতে বলেছিল। আমি, সৈয়দ শামসুল হক ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গিয়েছিলাম। দুই কি তিন বছর আগে। ২০১৩ কি ১৪-তে হবে। তখন একটা রেস্টুরেন্টে আমাদের খেতে নিয়ে গেল ওরা। ওখানে যাওয়ার পর দেখা গেল, লিফট খারাপ। পাঁচতলায় উঠতে হবে। আমি প্রবল বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম—হক ভাই দমাদম পাঁচতলায় উঠে গেলেন, কোথাও দাঁড়ালেন না। আমরা দোতলা বা তিনতলায় উঠে দম নিয়েছি। হক ভাইয়ের এই প্রাণশক্তি, এই সঞ্জীবনী শক্তি, এই মেধা—এই সব মিলিয়ে তিনি ও তাঁর যে একটা বিশাল পরিমাপ, এই জিনিসটাও আমি দেখিছি এভাবে। এ বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর। আমি তাঁকে দেখতে ইউনাইটেড হাসপাতালে যাই। তিনি প্রথমেই হাতটা ধরে বললেন, ‘সেলিনা, তোমার অনেক চোখ আছে, আমি জানি।’ তারপর তিনি কবিতা শোনালেন। আমার হাজব্যান্ড আনোয়ারও গিয়েছিল। আনোয়ারের সঙ্গে তাঁর ভালো যোগাযোগ ছিল। হক ভাই কাজী নজরুলের ‘আনোয়ার আনোয়ার’ একটা কবিতা শোনালেন। আনোয়ারা আপা বললেন ছবি তুলতে। সবাই মিলে আমরা হক ভাইকে নিয়ে ছবি তুললাম। ফেরার পথে হক ভাই আমার হাতটা ধরে বললেন, ‘আবার এসো।’ আমরা যখন বারান্দাটা অতিক্রম করছিলাম, তখন আনোয়ার বারবার বলছিল, ‘হক ভাইকে একদম অসুস্থ মানুষ মনে হয়নি; এত প্রাণবন্ত, এত সজীব! তিনি নিশ্চিত সুস্থ হয়ে যাবেন।’ আমি বললাম, আবার এসো বলেছেন, আমি তাঁকে আবার দেখতে যাব। কিন্তু ভাবিনি, তাঁকে বাংলা একাডেমি বা শহীদ মিনারে দেখতে যাব। শ্রুতলিখন : চন্দন চৌধুরী –

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
সেলিনা হোসেন- র আরো পোষ্ট দেখুন