সুদিনের আশায় সুসময়ের আশায়

শুনেছি ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ’। ২০১৪ এই কথা ভুল প্রমাণ করেছে। বছরটা খুব খারাপ কাটল। কত প্রিয় মুখ, কত আলোকিতজন চলে গেলেন। একেকজন কৃতী মানুষ একেকটি বৃক্ষের মতো। তাঁদের চলে যাওয়া মানে মাথার ওপর থেকে ছায়া সরে যাওয়া। ২০১৪ বহু ক্ষেত্রে আমাদেরকে ছায়াহীন করেছে। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ছিলেন এমন একজন। অন্যান্য বহু কীর্তির কথা বাদ দিয়ে আমি শুধু তাঁর

দু-চারটা বইয়ের কথা বলি। পবিত্র কোরআন-এর সহজতর অনুবাদ করেছিলেন তিনি। ‘কোরআন শরীফ : সরল বঙ্গানুবাদ’। এই অনুবাদের তুলনা বাংলা ভাষায় নেই। নেই ‘কোরআনসূত্র’ বইটির তুলনা। তাঁর ‘যথাশব্দ’ হাতে নিয়ে বিস্মিত হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। বলেছিলেন, ‘এত বড় মাপের কাজ বাংলা ভাষায় আর কেউ করেননি।’

দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম, ভাষা মতিন, কবি ও শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ইতিহাসবিদ সালাহউদ্দীন আহমদ, কবি ফজল শাহাবুদ্দীন, স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন, শহীদজায়া আয়েশা ফয়েজ, বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম, প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা, মাহবুবুল আলম, জগ্‌লুল আহ্‌মেদ চৌধূরী, নজরুলসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী ফিরোজা বেগম, অভিনেতা খলিলউল্লাহ খান আর কাইয়ুম চৌধুরীর মতো মহান শিল্পী, তাঁরা চলে গিয়ে আমাদের অনেকখানি নিঃস্ব করেছেন। এই প্রিয়জনদের প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গেই গভীর সম্পর্ক ছিল আমার। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর ‘চাঁদ ডুবে গেলে’ কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে একদিন অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম তাঁর সঙ্গে। তাঁর বিস্ময়কর পাণ্ডিত্যে অভিভূত হয়েছিলাম। ফিরোজা বেগম বলেছিলেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে রোজ বসবে। আমি বলব আর তুমি আমার আত্মজীবনী লিখবে।’ সেই লেখা আর হলো না। কালের কণ্ঠ’র সম্পাদক হওয়ার পর মূসা ভাই প্রায়ই ফোন করতেন। প্রকৃত অভিভাবকের মতো পরামর্শ দিতেন। জননী আয়েশা ফয়েজ তাঁর কৃতী সন্তানদের মতো এই অকৃতী সন্তানটিকেও খুব ভালোবাসতেন। বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের অনুজ মাহবুবুল আলম বাবু আমার প্রিয় বন্ধু। মাকসুদুল আলমের চলে যাওয়া মানে আমার এক ভাইয়ের চলে যাওয়া। কী মুগ্ধ হয়ে শুনেছি বশীর আহমেদের গান ‘যারে যাবি যদি যা, পিঞ্জর খুলে দিয়েছি’! বশীর ভাইও চলে গেলেন। ‘সংশপ্তক’-এর নাট্যরূপ দিয়েছিলাম। ‘মিয়ার বেটা’র চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করলেন খলিল ভাই। দেখা হলেই মজা করে বলতাম, ‘তোমার তুলনা তুমি’। কী যে বিনয়ের হাসি হাসতেন! সাংবাদিক জগ্‌লুল আহ্‌মেদ চৌধূরীর সঙ্গে দেখা হলে বন্ধু এবং স্নেহশীল বড় ভাইয়ের ভঙ্গিতে কাঁধে হাত রাখতেন। শিশুসাহিত্যিক এখ্‌লাসউদ্দিন আহমেদের মতো নিবেদিতপ্রাণ সাহিত্যপ্রেমীর সঙ্গে আর দেখা হবে না। দেখা হবে না প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর হাসিমুখের কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের সঙ্গে। কত আনন্দের দিন কাটিয়েছি তাঁর সঙ্গে!

মুক্তধারা থেকে আমার প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ বেরোবে। ‘৭৯ সালের কথা। চলে গেলাম জার্মানিতে। দুই বছর পর ফিরে এসে দেখি, তখনো কাভার করে দেননি কাইয়ুম ভাই। আরো ছয় মাস লেগে থেকে তাঁর কাছ থেকে কাভার আদায় করলাম। সেই কাভারের কোনো তুলনা হয় না। এই সূত্রে গভীর সম্পর্ক হলো আমাদের। দেখা হলে এত মিষ্টি করে হাসতেন কাইয়ুম ভাই, তাঁর হাসিতে খেলা করে যেত পৃথিবীর সব পবিত্র রং। কোথায় পাব এসব মানুষ?

২০১৪-র আর কোনো বেদনার কথা মনে করতে চাই না, আর কোনো শোকের কথা মনে করতে চাই না।

দুই

আমি খুব আশাবাদী মানুষ। হতাশা আর অশুভ চিন্তা আমার তেমন আসে না। প্রতি রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে মনে হয়, যে দিন পার করলাম, কালকের দিন হবে তার চেয়ে ভালো। আজ বছরের প্রথম দিন। কিন্তু প্রথম দিনটি কি ভালো কাটছে? বছর শুরু হলো হরতাল দিয়ে। মানুষের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনকে দুর্বিষহ করা, রাষ্ট্রকে বিপর্যস্ত করা আর অর্থনীতির কোমর ভেঙে দেওয়ার এই বিধ্বংসী হরতাল কেউ চায় না। আমি নিশ্চিত, যাঁরা হরতালের কর্মসূচি দিচ্ছেন, তাঁরাও ভেতরে ভেতরে হরতালবিরোধী। আমরা হরতাল চাই না। ২০১৫ হোক হরতালমুক্ত বছর। বছরের প্রথম দিনের হরতালটি যেন হয় এ বছরের শেষ হরতাল। হরতালের বিকল্প কোনো পথ যেন এ বছরই আমরা বের করতে পারি, যে পথে রাষ্ট্র, অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের জীবনব্যবস্থার কোনো রকম ক্ষতি না করে রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যাবে।

আমাদের গার্মেন্টশিল্প এ বছর আরো বহু উচ্চতায় যাবে, জনশক্তি রপ্তানিতে আগের বছরগুলোকে ছাড়িয়ে যাব আমরা, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কলঙ্ক থেকে মুক্ত হবে শিক্ষাব্যবস্থা, সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরবে না আর একটিও প্রাণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে দেশ আর খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে পুরো জাতিকে অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে যে দুর্বৃত্তরা, যেকোনো মূল্যে তাদের যেন আমরা প্রতিহত করতে পারি। দেশের মানুষ যেন ভেজালমুক্ত খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। ঢাকার যানজট যেন কমে আসে এ বছর। ঢাকা ঘিরে সরকারের যে পরিকল্পনা, তা যেন বাস্তবায়িত হয়। পদ্মা সেতুর কাজ যেন পরিকল্পনামতোই এগোয়। দুর্নীতি, সন্ত্রাস আর হত্যাকাণ্ড যেন বিলুপ্ত হয়। আর কোনো দুর্ঘটনায় যেন বিপর্যস্ত না হয় সুন্দরবন। আর কোনো জিয়াদের জন্য যেন চোখের জল ফেলতে না হয় দেশের মানুষের। এই তো আমার চাওয়া। ২০১৫ সুসময় বয়ে আনুক আমাদের জীবনে। প্রবাদ উল্টে এ বছর যেন আমরা বলতে পারি, ‘যায় দিন খারাপ, আসে দিন ভালো’। আমরা ভালো দিনের আশায় থাকব। সুসময়ের আশায় থাকব। সবাইকে খ্রিস্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা।