নিঃশব্দ কোমল হাহাকার

ফাল্গুন প্রকৃতির মাতাল যৌবন; উদ্দাম, উত্তাল, উন্মীলিত; বসন্তকে আবিষ্কার করেন কবি। এই বসন্ত, এই ফাল্গুন কবির প্রথম প্রেম। তার শিহরণের মধ্যে, তার স্পন্দনের মধ্যে, তার জাগরণের মধ্যে ফাল্গুন প্রত্যক্ষ করেন কবি। হয়তোবা এভাবেই মানুষের মনে বসন্তের জন্ম। বসন্ত ছিল স্বর্গের নন্দনকাননে, ফুলে ফুলে সুরভিত, পারিজাত, অশোক [স্বর্গে কি অশোক আছে?] আরও আরও অমর্ত্যলোকের ফুলে, অপ্সরীদের নূপুর নিকস্ফণে জেগে ওঠে বসন্ত। বসন্ত বিহার_ সে তো দেবলোকের আনন্দ উৎসব। মর্ত্যে কবে থেকে শুরু হলো এই বসন্ত উৎসব, কবে মানুষ বুঝল এই ফাল্গুন, এই গন্ধময় ঋতু, এই আলোকিত দীপ্র নিসর্গ, লাবণ্যময় মাধুর্যমণ্ডিত_ তা বলার উপায় নেই। কোন আদি কবির চোখে প্রথম ফুটে উঠেছিল বসন্ত, প্রথম ধরা দিয়েছিল ফাল্গুন; সে আখ্যান অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। বাল্মীকি ব্যাস, কালিদাস, জয়দেব_ না, ঠিক কারও মধ্যেই ফাল্গুনের রূপ খুব প্রত্যক্ষ করা যায় না। যায় বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথে। তবে কি রবীন্দ্রনাথই ফাল্গুনের প্রথম কবি? প্রথম না হলেও শ্রেষ্ঠ কবি। তিনিই ফাল্গুন বা বসন্তের পৃথিবীর সর্বোত্তম কবি। তার মধ্যেই উন্মোচিত হয়েছে ফাল্গুন, জাগ্রত হয়েছে বসন্ত। উপচে পড়েছে এই যৌবনময়ী, বসন্তের প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ, বসন্তের কবি রবীন্দ্রনাথ। কবে একদিন প্রেমিক-প্রেমিকার গাঢ় আলিঙ্গনে প্রকৃতি এমন পুষ্পময় হয়ে উঠেছিল, জেগে উঠেছিল লতা-গুল্ম, পাখি-প্রজাপতি, মত্ত হয়ে উঠেছিল মৌমাছি_ তা তো আর জানার উপায় নেই। জানতে চাইও না। চাইবোই বা কেন? আমার ফাল্গুন আছে, আমার পুষ্পবীথি আছে, আমার বসন্ত পূর্ণিমা আছে, আমার আবীর রাঙা ফাগুয়ার উৎসব আছে। পাহাড়ে পাহাড়ে রঙিন চেলি পরা সুন্দরীদের নৃত্য আছে, বংশীধ্বনি আছে, পাতায় পাতায় নীরব গুঞ্জন আছে। আমি বিমোহিত হয়ে যাই। আমি যখনই এই ফাল্গুনের চোখের দিকে তাকাই, তার রূপ দেখি, শোভা দেখি, হাতছানি দেখি; তখন ভাবি, ফাল্গুন ঈশ্বরের কী অপরূপ সৃষ্টি, কী অমর কবিতা! কবি, হ্যাঁ, কবিই কেবল, সব ভাষার কবি দিব্য চোখে এই বসন্তকে দেখেছেন। এই ফাল্গুন, এই বসন্ত, এই স্প্রিং না হলে শীতের অরণ্যে ফুল ফুটতে দেখে গ্যেটে কেন এমন করে বলে উঠবেন_ ‘আনন্দের মৃত্যু নেই’। সেই কি তবে গ্যেটের চোখে প্রথম বসন্ত দেখা, ফাল্গুন আবিষ্কার? কিন্তু এলিয়ট তো এই এপ্রিলকেই বলেছিলেন_ ‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রয়েলেস্ট মান্থ’, যদিও এই এপ্রিলেই শেকসপিয়রের জন্ম, এপ্রিলও তো বসন্তই; এই বাংলার বসন্ত অতুলনীয়া, অসামান্যা।
রকৃতির এই অনন্যসুন্দরী, যৌবনবতী ঋতুকে মনের মধ্যে যেদিন মানুষ প্রথম অনুভব করেছে, সেদিন সে হয়ে উঠেছে প্রেমিক। সেদিন তার বুকের মধ্যে জেগে উঠেছে এক অজানা ভালোবাসা, এক অজানা ভালো লাগার অনুভূতি; কী নিঃশব্দ, কোমল হাহাকার এই বসন্ত! কত সুন্দরীর চোখের জল, কত রূপসীর আলুথালু ক্রন্দন, কত প্রেমিক-প্রেমিকার চুম্বনের স্পর্শ, আমি কী আর তা জানি! ফাল্গুনের প্রকৃত রঙ হচ্ছে ভালোবাসা, ফাল্গুনের প্রকৃত গন্ধ হচ্ছে সুন্দরী নারীর হাতের কোমলতা, ফাল্গুনের রূপ হচ্ছে গন্ধর্ব্যলোকের উপচেপড়া সৌন্দর্য। ফাল্গুন এত মোহময়, এত সুরভিত, এত আর্দ্র, এত উন্মাতাল; কিন্তু পবিত্র, কিন্তু সে বিশুদ্ধ, সে শিল্পীত। এই ফাল্গুন হচ্ছে প্রকৃতির শিল্পকলা, এক অদৃশ্য বিশাল ক্যানভাসে কোনো অজ্ঞাত শিল্পী এই চিত্র রচনা করেছেন, তার সর্বাঙ্গে এত আলো, এত অন্ধকার, এত ছন্দ, এত নৃত্য, এত মাধুর্য! ফাল্গুন হচ্ছে পাগল করা এক ঋতু। ফাল্গুনকে ভালোবাসা নাম দিলে কী ক্ষতি হতো! আমাদের একটি বাংলা মাসের নাম ভালোবাসা, আর কোনো ভাষায় নেই, আর কোনো অভিধানে নেই, স্প্রিং বা ফাল্গুনের অনুবাদ ভালোবাসা। ফাল্গুনকে যদি আমরা ভালোবাসা নামে ডাকি, প্রেম নামে ডাকি, কিংবা বিরহ নামে ডাকি, সুখ নামে ডাকি, যৌবন নামে ডাকি, ক্ষতি কি হয় কিছু? আমার তো মনে হয় লাভই হয়। ফাল্গুন এত কাম-গন্ধহীন, এত কাম-গন্ধময়, এত হাস্যময়, এত বিষাদময়। ফাল্গুনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, ধরতে ইচ্ছে করেও না, এমনকি ছুঁতেও না, ফাল্গুনকে দেখতে ইচ্ছে করে, কখনও না দেখতে ইচ্ছে করে, ফাল্গুনকে দেখতে ইচ্ছে করে, দেখতে ইচ্ছে করেও না, দেখতে ইচ্ছে করে চোখ বুজে, ঘুমের মধ্যে, নিদ্রায়, স্বপ্নে, ধ্যানে।
ফাল্গুনই কি পৃথিবীর প্রথম যৌবনের শিহরণ, এই দুঃখ-তাপময় পৃথিবীর প্রথম আনন্দের অনুভূতি? মনে হয় ফাল্গুনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত কালের, কত অকথিত কাহিনী, অকথিত প্রেম, অকথিত বিরহ! ফাল্গুনই বোধ হয় বেহেস্তের সৌরভ, স্বর্গের সুগন্ধ। সমস্ত সুঘ্রাণ, সমস্ত সৌন্দর্য, সমস্ত রূপের মিলিত অবয়ব হচ্ছে ফাল্গুন। এই ফাল্গুন এত শারীরিক, এত শরীরহীনা, এত নগ্ন, এত আবৃতা; দুই চোখ ভরে যায়, দুই চোখ ভেসে যায় জলে, আমি মোহিত হয়ে উঠি, উন্মাতাল হয়ে উঠি, যেন যৌবন ফিরে পাই। আবার বাঁচতে ইচ্ছে করে। পৃথিবী যদি অনন্ত অনন্ত ফাল্গুনময় হতো, অনন্ত অনন্ত ভালোবাসাময় হতো, অনন্ত অনন্ত কবিতাময় হতো; হিংসা নেই, কলহ নেই, বিভেদ নেই, কপটতা নেই, কলুষতা নেই। যা কিছু ফেরেস্তাদের, যা কিছু দেবলোকের, যা কিছু স্বপ্নজগতের, তা-ই যদি হতো জীবনের সত্য, জীবনের বাস্তব; তাহলেই পূর্ণ হতো পৃথিবীর বসন্ত।
বসন্তকে যে কেন ঋতুরাজ বলা হয়, কেন নয় ঋতুরানী_ আমি বুঝি না। রানী-ই তো সে, অপরূপা, লাস্যময়ী, অনিন্দ্যসুন্দরী, উচ্ছ্বসিত, উদ্বেল। আমি যদি প্রেমিক হই তাহলে কেবলই ফাল্গুনের প্রেমিক। আমার প্রেমিকা কোনো নারী নয়_ এই ফাল্গুন, এই বসন্ত, এই পুষ্পবীথিকা। আমি আজন্ম তার প্রেমে, তার ভালোবাসায়, তার বাৎসল্যে, তার ঔদার্যে, তার মাতৃস্নেহে বিভোর হয়ে আছি। ফাল্গুনকে আমি এখনও চিনতে পারিনি। সে আমার কে? সে আমার সখি, সে আমার বন্ধু, সে আমার সহচরী, নাকি সে আমার জন্মদাত্রী? হয়তো এই ফাল্গুনের গন্ধেই জন্ম হয়েছে আমার, হয়তো এই ফাল্গুনের নিঃশ্বাসেই কবি হয়েছি আমি। ফাল্গুন আমার অলিখিত কবিতার নাম, অরচিত চিত্রকলার নাম। ফাল্গুনের কবিতা লেখার জন্য আরও জন্মজন্মান্তর অপেক্ষা করতে হবে আমাকে। আমি এই ফাল্গুন এত দেখেছি, আমি এই ফাল্গুন এতটুকুও দেখিনি, ফাল্গুন আমাকে ভাসিয়ে দিয়েছে, ফাল্গুন আমাকে জাগিয়ে দিয়েছে, ফাল্গুন আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে, ফাল্গুন আমার ভিতর-বাহির, ফাল্গুন আমার মেঘমহলের সন্ধ্যাদীপ, ফাল্গুন আমার প্রথম যৌবন, ফাল্গুন আমার যৌবন শেষের কবিতা, ফাল্গুন আমার প্রিয়তমা, ফাল্গুন আমার সুন্দরীতমা, ফাল্গুন আমার সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা, শব্দ, নৈঃশব্দ্য।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
মহাদেব সাহা- র আরো পোষ্ট দেখুন