যুদ্ধকাল

আজাদ
জাদুঘরের ওদিকটায় এসে রিকশাঅলা আমার দিকে মুখ ফিরাল। কী অইছে বাবা? কানবার লাগছেন ক্যালা?
লোকটার বয়স চল্লিশের ওপর। রোদে পোড়া কালো শরীর। শরীরের বাঁধ ভালো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-মোচ। নীল রঙের লুঙ্গি আর কোড়া রঙের গেঞ্জি পরা। গেঞ্জির হাতা কনুইয়ের কিছুটা ওপরে টাইট হয়ে লেগে আছে। ঘাড়ের কাছে গেঞ্জি একটু ছেঁড়া। কোমরে গামছা বাঁধা আছে। গেঞ্জি লুঙ্গি গামছা তিনটিই বেশ পুরানা।
লোকটার কথায় টের পেলাম, আমি কাঁদছি। গাল বেয়ে নেমেছে কান্না। হয়তো নাক টানার শব্দে সে বুঝেছে আমি কাঁদছি।
কথার জবাব না দিয়ে আমি চোখ মুছতে লাগলাম।
রিকশাঅলা অভিজ্ঞ ভঙ্গিতে রিকশা চালাচ্ছে। সকালবেলার রাস্তা একেবারেই ফাঁকা। দু-একটা রিকশা, বেবিট্যাক্সি, ঠেলাগাড়ি, গরুর গাড়ি, বাস, ট্যাক্সি হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায়। গুলিস্তানের দিকে যাচ্ছে রিকশা। এই এলাকা ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত এলাকা। এখন ব্যস্ততার কিছুই নেই। যেন মৃত শহর। যারা চলাফেরা করছে, পথচারী বা গাড়িঘোড়া, তারা যেন দায়ে পড়ে চলছে।
ঢাকা মেডিক্যাল থেকে বেরিয়ে, জাদুঘরের দিকে কিছুটা হেঁটে এসে রিকশাটা আমি পেয়েছিলাম। মতিঝিল যাব, এজিপি কলোনি। বাবুলদাদের বাসা। গুলিস্তানের ওদিক দিয়ে, ডিআইটি বিল্ডিং এক পাশে আরেক পাশে পল্টন ময়দান, স্টেডিয়াম, ওদিককার রাস্তায় যাবে রিকশা। নটর ডেম কলেজ ছাড়িয়ে আরামবাগের দিকে গিয়ে রিকশা যাবে পুব দিকে। কলোনির গেট, খোলা মাঠ আর হলুদ রঙের তিন-চারতলা বিল্ডিংগুলো। ও রকম একটা বিল্ডিংয়ের দোতলায় বাবুলদাদের বাসা। খালুজান এই বাসা অফিস থেকে পেয়েছেন। খালাম্মা বাবুলদা নিম্মি ওরা সবাই বিক্রমপুরের কান্দিপাড়া গ্রামে। বাসায় খালুজান একা আছেন দেখে হামেদ মামা আর নজুদা এসে থাকেন।
আমি যাচ্ছি তাঁদের খবর নিতে।
কথা বলছি না দেখে রিকশাঅলা আবার আমার মুখের দিকে তাকাল। মনে অইতাছে মেডিক্যাল থনে আইছেন। কেউ মইরা গেছে নিহি?
আমি মাথা নাড়লাম। হ, আমার আব্বা মারা গেছে।
কী অইছিল?
আমি কথা বলি না।
লোকটা একটু সহানুভূতিশীল। বলল, মা-বাপ মইরা যাওনের থিক্কা কষ্ট আর কিছুতে নাইক্কা।
একটু থেমে বলল, বাপের বছ অইছিল কিমুন?
চৌচল্লিশ পাঁচচল্লিশ অইব।
আয় হায়, কন কী? এই বছছে মইরা গেল? কী অইছিল? ওই ছালারা মারছে নিহি?
বুঝলাম, কাদের কথা সে বলছে। মিলিটারিরা ধরে নিয়ে মারল কি না, রাজাকার-আলবদররা মারল কি না। ওরা তো মানুষ মেরে সাফা করে দিচ্ছে। তবে মুক্তিযোদ্ধারাও ছাড়ছে না। সমানে মিলিটারি আর রাজাকার মারছে। ঢাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে গেরিলারা। আমাদের বিচ্ছুরা। দিনে রাতে সমানে চলছে গেরিলা অপারেসান। নাস্তানাবুদ হচ্ছে পাকিস্তানি কুত্তারা।
আমার আব্বাকে আসলে ওরাই মেরেছে। একটু অন্যভাবে মেরেছে। সরাসরি গুলি করেনি। ধরে নিয়ে টর্চার করে মারেনি। মেরেছে মানসিক চাপ দিয়ে। একটা বদমাশ কাবলিঅলা…
এসব কথা লোকটাকে আমি বলতে চাই না। বলা যায় না, লোকটা আসলেই রিকশাঅলা কি না। পাকিস্তানিদের চরও হতে পারে। ছদ্মবেশ নিয়ে আছে। এখন ছদ্মবেশীদের অভাব নেই। কে যে কোন মতলবে ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে! তার ওপর কথা বলছে ঢাকাইয়া ভাষায়। ঢাকাইয়া কুট্টি যে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ঢাকাইয়াদের সঙ্গে বিহারিদের সম্পর্ক ভালো। অনেক ঢাকাইয়া পাকিস্তানপন্থী। রাজাকার-আলবদর আছে অনেক ঢাকাইয়া। শান্তি বাহিনীর লোক আছে। গেণ্ডারিয়ার হাবিব ফকির আর রাজা যেমন।
ঢাকাইয়া পোলাপান আবার মুক্তিযোদ্ধাও আছে। বিচ্ছু একেকটা। দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা। জীবনের তোয়াক্কা না করে পাকিস্তানিদের মারছে। ক্র্যাক প্লাটুনে আছে পুরান ঢাকার বহুত ঢাকাইয়া পোলা।
রিকশাঅলা লোকটা মুক্তিযোদ্ধা না তো?
এই বয়সী মুক্তিযোদ্ধাও আছে। হয়তো রিকশাঅলার ছদ্মবেশ নিয়ে আছে। হয়তো তার রিকশার সিটের তলায় গ্রেনেড আছে। হয়তো তার কোমরে, গামছার আড়ালে আছে রিভলবার…
এই অবস্থায়ও আমার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। এমন একটা সময় চলছে দেশে, কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কে মুক্তিবাহিনীর লোক, কে পাকিস্তানিদের লোক বোঝা মুশকিল।
আমি সত্য কথা চেপে গেলাম। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলাম, নাক মুছলাম। না না, কান্নাকাটি করা যাবে না। রাস্তায় রাস্তায় মিলিটারির গাড়ি, রাজাকারদের গাড়ি। রিকশায় বসে এই বয়সী একটা ছেলে কাঁদছে দেখে কে কোন দিক দিয়ে রিকশা থামাবে, কোন প্রশ্ন করবে, কোথায় ধরে নিয়ে যাবে কোনো কিছুর কি ঠিক আছে!
আব্বা মারা গেছেন, এখন আমারও যদি কোনো বিপদ হয় তাহলে আমার ছোট ছোট নয়টা ভাই-বোনের কী হবে? মার কী হবে? এখন আমিই সংসারের একমাত্র ভরসা।
চোখ-নাক মুছে বললাম, না ভাই, তেমুন কিছু না। আব্বার গ্যাসটিক আছিল। গ্যাসটিকে মারা গেছে। লাশ বাসায় নিতে অইব, এর লেইগা আমি যাইতাছি আমার এক মামারে আর খালাতো ভাইরে খবর দিতে।
বুজবার পারছি। বাছা কই আপনেগো?
গেনডাইরা।
লোহারপোলের ওই মিহি?
হ।
চিনি, গেনডাইরার বেবাকই চিনি। রিচকা চালাই বহুত দিন ধইরা। কথা হুইনাই বুজবার পারছেন আমি ঢাকাইয়া। ছোট কাটারায় বাছা।
আমি আর কথা বলি না। একসঙ্গে কত চিন্তা যে মাথায় আসে! মিলুকে বসিয়ে রেখে আসছি আব্বার লাশের কাছে। কাশেম ভাই বলেছেন মেডিক্যালে আসবেন। নিশ্চয় লাশ নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। তাঁর সঙ্গে মেহেরুনের কোনো ভাইও আসতে পারে। অথবা কাশেম ভাইয়ের মেজো ভাই আবুলও আসতে পারে। তারপর কত কাজ। জানাজা, দাফন। টাকা-পয়সার একটা ব্যাপার আছে। মাসের প্রথম দিক। আব্বার আর আমার বেতনের টাকা কিছু আছে মার কাছে। বাড়িভাড়া আর মাসের বাজার সেরে, সপ্তাহের রেশন তুলে বাকি মাস চলার টাকা কিছু আছে। ওই টাকা আব্বার পিছনে খরচ হয়ে গেলে সংসার চলবে কী করে?
তারপর মনে হলো আরো ভয়ংকর কথা। এক বছর কয়েক মাস ধরে আব্বার আর আমার রোজগারে সংসার চলছিল। আব্বা তো গেলেন। এখন? এখন এতগুলো মানুষের সংসার চলবে কী করে? আমি বেতন পাই তিনশো আশি টাকা। বাড়িভাড়া দুশো টাকা। হাতে থাকবে একশো আশি টাকা…
আমি আর ভাবতে পারি না। আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। দেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আর আকাশবাণী কোলকাতার খবর শুনে বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে আর বেশি সময় লাগবে না। মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে সাঁড়াশি আক্রমণ চালাচ্ছে, একটা পাকিস্তানিও রেহাই পাবে না। রোজ রাতেই ধ্রুমধ্রুম শব্দ পাওয়া যাচ্ছে বোমার, গ্রেনেডের। হয়তো কিছুক্ষণ চলল এসএমজি বা এলএমজির ট্যা ট্যা ট্যা শব্দ। রাইফেলের শব্দ, স্টেনগানের শব্দ। তারপর থেমে গেল, কিছুক্ষণ পর আবার শুরু হলো। যুদ্ধ চলছে। ব্যাপক তত্পরতা মুক্তিবাহিনীর। পাকিস্তানিদের সময় ঘনিয়ে আসছে। এই অবস্থায় টঙ্গীর ওই অফিসে গিয়ে চাকরিটাই বা কত দিন করতে পারব কে জানে!
যদি সেটাও করতে না পারি তাহলে উপায় হবে কী? এতগুলো মানুষ আমরা না খেতে পেয়ে মরে যাব। কে দাঁড়াবে আমাদের পাশে? কে সাহায্য করবে দশটা টাকা দিয়ে?
ভাবতে পারি না। আমি আর ভাবতে পারি না। এমন অসহায় অবস্থাও হয় মানুষের?
আমার বয়সী কত ছেলে চলে গেছে মুক্তিযুদ্ধে। গেণ্ডারিয়ার কত পরিচিত ছেলে, কত বন্ধু। মেদিনীমণ্ডলের খানবাড়ির আতিক আমার বন্ধু। আতিকের ছোট ভাই নোনা মুক্তিযোদ্ধা। ওরা দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করছে। আর আমি?
আমিও যুদ্ধ করছি। আমার যুদ্ধ দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ না। আমার যুদ্ধ জীবনযুদ্ধ। খেয়েপরে বেঁচে থাকার যুদ্ধ। তা-ও শুধু আমার একার না, পুনুআম্মা আর রিনাকে নিয়ে তেরোজন মানুষের বেঁচে থাকার যুদ্ধ। এই যুদ্ধ আমি একা কিভাবে করব? আমার হাতিয়ার তো তিনশো আশি টাকার একটা চাকরি। দেশের এই পরিস্থিতিতে সেই চাকরিও কত দিন করতে পারব জানি না।
আমি আর ভাবতে পারি না। আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলব আমি।
বাবুলদাদের বাসায় ঢোকার দুটো দরজা। একটা বসার ঘরের আরেকটা রান্নাঘরের ওই দিকে। রিকশা ছেড়ে দিয়ে আমি লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙেছি। বসার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়তে লাগলাম। খট খটা খট, খটা খট।
একবার।
দুবার।
তিনবার।
কেউ দরজা খুলছে না কেন? এত দেরি করছে কেন?
আরেকবার কড়া ধরতে গেছি, দরজা খুললেন হামেদ মামা। চোখে ঘুম লেগে আছে। তার পরও একটু ভয় আতঙ্ক চেহারায়, একটু দিশাহারা ভাব। কখন মিলিটারি আসে কোন বাসায়! রাজাকাররা আসে। কাকে ধরে নিয়ে যায় অকারণে কিংবা সন্দেহ করে। এটা এজিপি কলোনি। সরকারি কর্মচারীদের বাসভবন। হলুদ রঙের বিল্ডিংগুলো এদিক-ওদিক ছড়ানো। কেমন চুপচাপ, নিঃসাড়। প্রাণের সাড়া নেই কোথাও। বহু বাসা খালি পড়ে আছে। বাসা ফেলে চলে গেছে মানুষজন।
বাবুলদাদের বাসাই তো বলতে গেলে খালি। শুধু খালুজান আছেন। অতি নিরীহ নরম ধরনের ভদ্রলোক মানুষ। অফিস করছেন নিয়মিত। তাঁর সঙ্গে এসে থাকছেন হামেদ মামা আর নজুদা। বিপদের দিনে একসঙ্গে থাকা ভালো।
হামেদ মামাকে দেখে আমি দুহাতে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরলাম। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম—মামা, মামাগো, আব্বায় মইরা গেছে। আমার আব্বায় মইরা গেছে, মামা।
হামেদ মামা আমাকে জড়িয়ে ধরে অস্থির গলায় বললেন, হায় হায়! কচ কী? কুনসুম মারা গেল? কেমনে মারা গেল? হায় হায়…
আমি কথা বলতে পারি না। ঙো ঙো করে কাঁদতেই থাকি।
আমার কান্না আর হামেদ মামার কথা পাশের ঘর থেকে শুনতে পেয়েছিলেন নজুদা। তিনিও উঠে এলেন। লুঙ্গি আর পুরানা স্যান্ডো গেঞ্জি পরা। নিচু গলায় কথা বলা মানুষ। এখন উত্তেজনায় গলা একটু চড়ল। কী অইছে রে আজাদ? কী অইছে? কান্দস ক্যা?
আমি না, কথা বলেন হামেদ মামা। সর্বনাশ হইয়া গেছে রে নজু। দুলাভাই মারা গেছে।
হায় হায়! কয় কী?
কাইল সন্ধ্যায় মোতালেব আইয়া কইয়া গেল না, দুলাভাইর অবস্থা খারাপ। তারে মেডিক্যালে লইয়া গেছে! তরে কইলাম না রাত্রে?
হ কইলি তো! তয় অবস্থা এত খারাপ আছিলো নি? মইরা যাওনের মতন অবস্থা তো আমি বুঝি নাই। হায় হায়, কোন সর্বনাশ হইল! আমার খালার এত বড় সংসার…
হামেদ মামা আর নজুদা দুজনেই কাঁদতে লাগলেন।
খালুজানকে দেখছি না। তিনি বোধ হয় বাসায় নেই। এত সকালে কোথায় গেছেন? বাসায় থাকলে নিশ্চয় আমাদের কথাবার্তা কান্নাকাটি শুনে এই ঘরে আসতেন।
আমাকে জড়িয়ে ধরে বেতের পুরানা লম্বা সোফাটায় বসলেন হামেদ মামা। এই ঘরে একটা চৌকি আছে। নজুদা বসলেন সেই চৌকিতে। দুজনেই চোখ মুছছেন।
হামেদ মামা জড়ানো গলায় বললেন, আহা রে, এত ভালো মানুষ আমার দুলাভাই। এই বয়সে মইরা গেল! কাইল বিকালে মোতালেব গেছিল গেনডাইরা। বুজির বাসায় গিয়া দেখে বুজি কান্দে, পোলাপানরা কান্দে। শুইনা আইলো দুলাভাইর অবস্থা খারাপ। গ্যাসটিকের চাপে বারবার বলে পায়খানায় যাইতাছিল। তারপর আর পারে নাই। নেতাইয়া গেছে। আথকা এই অবস্থা হইল ক্যান? ওই আজাদ…
নজুদা বললেন, এহন এত কথা ও কেমনে কইবো? লাশ আছে কই রে আজাদ?
মেডিক্যালে। মিলু আছে আব্বার লগে। রাইত্রেই বাড়িঅলার বাসায় ফোন করছি।
লাশ নেওনের বেবস্তা কী?
বাড়িঅলার বড় ছেলে কাসেম ভাই কইছে সে বেবস্তা করবো। আমি আপনেগো খবর দিতে আইছি। খালুজানে কো?
দেশে গেছে।
আমি চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালাম। তয় আমি যাই।
হামেদ মামা আর নজুদাও দাঁড়ালেন।
হামেদ মামা বললেন, কই যাবি? বাসায়?
না মামা। মেডিক্যালে যামু। আব্বারে লইয়া বাসায় যামু।
ল, আমরাও যাই। নজু, ল।
আমি বললাম, আপনেগো মেডিক্যালে যাওনের কাম নাই। আপনেরা গেনডাইরা যান গা। আমি মেডিক্যালে যাইতাছি। কাসেম ভাই আইলে আব্বারে বাসায় নেওনের বেবস্তা হইয়া যাইবো।
তয় যা তুই, যা। আমরা গেনডাইরা যাইতাছি।
নজুদা বললেন, তর কাছে টেকা-পয়সা আছে?
আছে।
খাড়া, ইকটু খাড়া ভাই।
নজুদাকে আমরা বলি ‘নোজদা’। নোজদা পাশের ঘরে চলে গেলেন। সামান্য মাত্র সময়। ফিরে এসে আমার হাতে কয়েকটা টাকা দিলেন। বড় নোট না, ভাংতি টাকা। রাখ তর কাছে। ভাড়াভোড়া লাগবো।
আমি টাকার দিকে তাকিয়েও দেখি না। প্যান্টের পকেটে টাকা কয়টা রেখে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাই। এখন একটা রিকশা নেব। রিকশা নিয়ে সোজা মেডিক্যালে।
নিচে নেমে একটু অবাকই হলাম। সেই রিকশাঅলাটা বসে আছে। আমাকে দেখে বলল, খবর দিবার পারছেন?
হ পারছি।
তয় লন যাইগা। রিচকায় ওডেন।
আমি একটু চিন্তিত। লোকটা কি আমার জন্যই বসে ছিল? কেন বসে থাকবে? আমি তো তাকে বসে থাকতে বলিনি! যে রিকশা নিয়ে এসেছি সেই রিকশা বসিয়ে রেখে তাকে নিয়েই যদি আবার যেতে হয় তাহলে ভাড়া বেশি দিতে হবে।
লোকটা আমাকে খেয়াল করল। কী চিন্তা করেন? আমি আপনের লেইগা বইয়া রইছি, পছা বেছি দিবার লাগবো, এই হগল চিন্তা করেন নি? চিন্তা কইরেন না। পছা আপনের থিকা বেছি লমু না। ওডেন, রিচকায় ওডেন…
ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলা লোকদের সব সময়ই একটু রুক্ষ মনে হয়। এই লোকটির কথায় তেমন মনে হচ্ছে না। কথার খুব ভিতরে কোথায় যেন একটা মায়া জড়িয়ে আছে।
আমি আর কথা বললাম না। রিকশায় উঠে বসলাম। রিকশাঅলা টুকটাক কথা বলতে লাগল। আপনের আব্বায় কী কাম করতো?
মিনিসপালটিতে চাকরি করতো।
বাছা কই আপনেগো? ও হেইডা তো একবার কইলেনঐ। গেনডাইরা। ভাই-বইন কয়জন?
মেডিক্যাল পর্যন্ত আসতে আসতে ছোট ছোট প্রশ্ন করে লোকটা আমাদের অবস্থা অনেকখানি জানল। এই অবস্থায় কথা বলতে খারাপ লাগছিল না আমার। কাল দুপুরের পর থেকে বুকটা যে রকম চাপ ধরে ছিল, তার পর থেকে যা যাচ্ছে, উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা, পরিস্থিতি সামাল দেওয়া, সংসারের ভবিষ্যৎ—সব মিলিয়ে আমি আর আমার মধ্যে নেই। লোকটার সঙ্গে টুকটাক কথা বলে বুকের ভার কমাচ্ছিলাম। লোকটা আমার নামও জেনে নিয়েছে এক ফাঁকে।
তার নামটাও তো আমার জানা উচিত।
জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, আপনের নাম কী?
হলালুদ্দিন। মহল্লার মাইনছে হেলু কইয়া ডাকে। রিচকাডা আমার নিজের। আমিই মাহাজন, আমিই ডেরাইভার। তয় রোজ রিচকা চালাই না। যেদিন মোন চায় চালাই, মোন না চাইলে চালাই না। ছংছারে এউগা মাইয়া আর বউ। নিজেগো বাইতে থাকি। আমার ভাইরা বি থাকে। আল্লায় ভালা রাকছে…
সময় বেশি লাগল না। ঢাকা মেডিক্যালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সিঁড়ির কাছে এনে রিকশা থামাল হেলু। এখান থেকেই মিলুকে দেখা যাওয়ার কথা। আব্বার লাশ রাখা স্ট্রেচার দেখা যাওয়ার কথা। মিলুও নেই, স্ট্রেচারও নেই। বুঝে গেলাম, কাসেম ভাই এসে আব্বার লাশ নিয়ে গেছেন।
নাকি অন্য কোনো ঝামেলা হলো?
আব্বার লাশ এখান থেকে কি আবার ওয়ার্ডে নিয়ে গেছে? বাসায় নিতে পারেনি?
হেলুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে এসেছি। বুকের ভার একটু কমেছিল। সেই ভার আবার ফিরে এলো। কী রকম দিশাহারা লাগছে। দৌড়ে নামলাম রিকশা থেকে। ভাড়া দেওয়ার কথা ভুলে ছুটে গেলাম ভিতরে।
এদিককার একটা রুমে একজন মোটামতন নার্স বসে আছে। মধ্যবয়সী মহিলা। গুরুগম্ভীর ধরনের চেহারা। একজন ওয়ার্ড বয় আছে। ওয়ার্ড বয় কথা বলছে। মহিলা গম্ভীর মুখে শুনছে। আমাকে দেখে চোখ তুলে তাকাল।
কী?
এখানে আমার আব্বার লাশ আর ছোট ভাইটা আছিল…
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ওয়ার্ড বয়টা বলল, গেনডাইরা লইয়া গেছে। অ্যাম্বুলেন্সে কইরা নিছে।
আপনে দেকছেন?
আমিই তো অ্যাম্বুলেন্সে তুইলা দিলাম।
ঠিক আছে, ঠিক আছে।
আমি দৌড়ে এসে রিকশায় উঠলাম।

হেলু বলল, কী অইলো? লাচ কো?

বাসায় লইয়া গেছে। হায় হায়, আপনেরে তো জিগাইলাম না। গেনডাইরা যাইবেন?

যামু না ক্যালা? লন যাই।

ভাড়াভোড়া তো কিছুই কইলেন না। মতিঝিল কলোনিতে গিয়া এক টেকা দিলাম, তা-ও কিছু কইলেন না। এক টেকা ভাড়া দিলাম, ভাড়া কম হইলো কি না সেইটাও কইলেন না। আমি তো পয়লাও ভাড়া ঠিক কইরা উঠি নাই।

এই হগল লইয়া অখন চিন্তা কইরেন না।

বাসার কাছে এসে রিকশা থেকে নামলাম। বাড়িঅলার দিককার গেটটা খোলা। ভিতরবাড়ি থেকে কান্নাকাটির শব্দ আসছে। আমাদের গলির ওদিককার গেটে আশপাশের বাড়ির লোকজন জটলা করে আছে। কেউ কেউ বাসায় ঢুকছে, কেউ বেরোচ্ছে। টুকটাক কথাবার্তা চলছে তাদের।

আমার বুকটা কাঁপতে লাগল।

বাসায় ঢোকামাত্রই, আমাকে দেখামাত্রই নতুন করে পড়বে কান্নার রোল। মা কী করবেন আমাকে দেখে, পুনুআম্মা কী করবেন, ভাই-বোনরা কী করবে—এসব ভেবে আমার চোখে আবার পানি এলো। এক হাতে চোখ মুছে পকেটে হাত দিলাম। কান্না জড়ানো গলায় বললাম, কন ভাই, কত দিমু?

এক পছাও দিবার লাগবো না।

এই অবস্থায়ও আমি অবাক। একটা ধাক্কাই যেন খেলাম। কী?

হ বাবা, আপনের কাছ থিকা পছা লিমু না।

কন কী? এত দূর থিকা আইলেন? মতিঝিল থিকা ঢাকা মেডিক্যাল, ঢাকা মেডিক্যাল থিকা গেনডাইরা…না না, ভাড়া নিবেন না ক্যা? কন, কত হইছে?

না বাবা, আমি আপনের কাছ থনে ভাড়া লিমু না। মতিঝিল গিয়া এক টেকা ভাড়া নিছিলাম, ওইটা বি ফিরত দিতাছি।

লুঙ্গির কোঁচড় থেকে একটা টাকা বের করল হেলু। টাকাটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, আল্লার ফজলে আমি বহুত ভালা আছি। হাপ্তায় দুই-চাইর দিন রিচকা চালাইয়া যা কামাই ওই পছায় ছংছার ভালা চইলা যায়। ভাড়া আপনের কাছ থনে আমি লিমু না। লন, আপনের আব্বারে ইকটু দেইখা যাই।

হেলু আমার সঙ্গে বাসায় ঢুকল।

মণি

আমার মা বিধবা হয়ে গেল।

মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে আমার মা বিধবা হয়ে গেল। রাত একটা পাঁচ মিনিটে চিরকালের মতো চলে গেলেন আব্বা। খানিক আগে তাঁর লাশ আনা হয়েছে বাসায়। কান্নাকাটির রোল চলছে। কারা যেন সাধনার বড় মসজিদ থেকে একটা খাট নিয়ে এসেছে। মুর্দার রাখার খাট, বহন করার খাট। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে সেই খাটে শোয়ানো হয়েছে আব্বাকে। ঢাকা মেডিক্যালের পুরনো সাদা চাদরে ঢাকা আছেন আব্বা। অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার চাদরটা নিতে ভুলে গেছে। অথবা ইচ্ছা করেই রেখে গেছে। সরকারি হাসপাতালের একটা পুরানা চাদর কোনো লাশের সঙ্গে থেকে গেলেই বা কী?

কাসেম ভাই আর বাসেত ভাই গিয়েছিলেন আব্বার লাশ আনতে। দাদা আর মিলু কাল সন্ধ্যা থেকে আব্বার সঙ্গে। কাল দুপুরের পর থেকে একফোঁটা পানিও পড়েনি ভাই দুটোর পেটে। মিলু এসেছে আব্বার লাশের সঙ্গে। উষ্কখুষ্ক চুল, পরনের জামাকাপড় নোংরা হয়ে গেছে। মুখটা ভেঙেচুরে গেছে গভীর ধকলে। চোখ দুটো ফুলে গেছে কাঁদতে কাঁদতে।

লাশ আসার পর কী যে হৃদয়বিদারক দৃশ্য এই বাসায়! আমাদের কান্নাকাটি, বিলাপ। মা কাঁদছেন না। সারা রাত বসে ছিলেন বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে। আব্বার লাশ আসার পর একবার গিয়ে চাদর সরিয়ে তাঁর মুখটা দেখলেন। চোখে পানি নেই, কান্না বিলাপ নেই। যেন একটা কাঠের পুতুল। আব্বার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। ডাক্তার খালেদা বারি, খালেদা আপা তাঁকে ধরে রাখলেন। আব্বাকে এভাবে দেখে মা আবার এসে বসলেন আগের জায়গায়।

আমাদের ভাই-বোন একেকজনকে সামলাচ্ছেন একেকজন। বাড়িঅলার ছোট মেয়ের আর আমার একই নাম। মণি। মণি আছে আমার সঙ্গে। পলি ডলিকে সামলাচ্ছে মেহেরুন। বাদল মুকুল উষা আছে আম্মার সঙ্গে। রিনা তো আছেই। খোকনকে জড়িয়ে রেখেছে বারেকের মা। ছয় বছরের ছেলে। অনেক কিছুই বোঝে না। সবার কান্নাকাটি দেখে খানিক কাঁদে, আবার থেমে যায়।

ঘুরেফিরেই আমরা কেউ না কেউ যাচ্ছি আব্বার লাশের সামনে। উষা কী রকম স্তব্ধ হয়ে আছে। বছর আটেক বয়স। এইটুকু মেয়েটির মধ্যে ঢুকে গেছে তীব্র অপরাধবোধ। কারণ আব্বার জন্য ‘খাবার সোডা’ আনতে উষাই গিয়েছিল কাসেমের দোকানে। এইতো আমাদের বাসা থেকে বেরিয়ে গলি ধরে দক্ষিণ দিকে গেলেই, লোহারপুল থেকে যে রাস্তাটা গেছে সাধনার দিকে, ওই রাস্তার নাম রজনী চৌধুরী রোড। রাস্তাটা গেছে পশ্চিম থেকে পুবে। আমাদের গলি থেকে বেরোলেই ওপাশে আরেক গলি, তার মুখে কাসেমের দোকান। সেই দোকানের পাশে সালামের ভাইয়ের দর্জি দোকান।

কাসেমের মুদি দোকান থেকেই আব্বার জন্য দৌড়ে গিয়ে খাবার সোডা এনেছিল উষা। সেই সোডা খাওয়ার পর থেকেই আব্বা পায়খানায় যেতে শুরু করলেন…

মিলু বসে আছে আব্বার খাট ধরে। ওর কান্না থামছেই না। অঝোর ধারায় কাঁদছে। মিলুর বন্ধু হামিদুল এসেছে। ফুটফুটে সুন্দর চেহারার হামিদুল। গায়ের রংটা খুব সুন্দর। এই বয়সেই নিয়মিত ব্যায়াম করে। স্বাস্থ্যও খুব ভালো। হামিদুলদের বাসা বানিয়ানগরে। খবর পেয়ে পাগলের মতো দৌড়ে এসেছে। এখন দাঁড়িয়ে আছে মিলুর পাশে। আসমা আছে হামিদুলের কোলে।

বুয়ার কোল থেকে কখন হামিদুলের কোলে গিয়েছে আসমা কে জানে। আমাদের যা অবস্থা, কে কার দিকে ফিরে তাকাবে। আসমাকে এক কোলে ধরে রেখেছে হামিদুল, অন্য হাত মিলুর কাঁধে। মিলুকে খুব ভালোবাসে ছেলেটা। আমাদের বিক্রমপুরেই বাড়ি হামিদুলদের। অবস্থা ভালো। বানিয়ানগরে নিজেদের বাড়ি। সদরঘাটে কাপড়ের দোকান আছে তিনটা। হামিদুলের বাবা আব্বার পরিচিত। আব্বার চেয়ে বয়সে বড়। আব্বা তাঁকে দাদা ডাকতেন।

আমাদের গেট খোলা। লোকজন আসছে যাচ্ছে। পাশের বাড়ির মোখতার ভাইয়ের আব্বার সঙ্গে আমার আব্বার খুবই খাতির ছিল। দুজন একসঙ্গে নামাজ পড়তে যেতেন। মোখতার ভাই জোয়ান তাগড়া ছেলে। বোধ হয় মুক্তিযুদ্ধে গেছেন। তাঁর আব্বা মাথায় টুপি দিয়ে ঘুরে বেড়ান। নিজেদের বাড়ি। ভদ্রলোক এসেছেন আব্বাকে শেষ দেখা দেখতে। লন্ড্রিকাকা এসেছেন, মুরগিটোলার মসজিদের ইমাম সাহেব এসেছেন, রশিদ ডাক্তার এসেছেন। কলুটোলার পীর সাহেবের ওখান থেকে এসেছেন কেউ কেউ। অনেককে আমি চিনি না।

দাদা এলো এইমাত্র। হাসপাতাল থেকে গিয়েছিল বাবুলদাদের বাসায়। হামেদ মামা আর নজুদাকে খবর দিয়ে এসেছে। সে ঢাকা মেডিক্যাল ঘুরে আসার আগেই হামেদ মামা আর নজুদা এসে পড়েছেন।

আব্বার দুজন বন্ধুর কথা আমরা ছোটবেলা থেকে শুনতাম। জিন্দাবাহারের বাসায়, মুরগিটোলার বাসায় তাঁরা অনেকবার এসেছেন। রাজ্জাক সাহেব আর সত্যবাবু। দুজনেই আব্বার সঙ্গে মিউনিসিপ্যালিটিতে চাকরি করতেন। রাজ্জাক কাকা পরে ডিআইটিতে গিয়ে চাকরি নেন। সত্য কাকা মিউনিসিপ্যালিটিতেই আছেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কোথায় কোন গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন, নাকি কোলকাতা বা আগরতলায় চলে গেছেন, কে জানে! আমার দুই চাচার খবরও কিছু জানি না।

আজিমপুরের ওই দিকে, রায়সাহেব বাজার না কোথায় যেন আব্বার এক চাচার বাড়ি আছে। বেশ কয়েকজন চাচাতো ভাই আছেন। বড়জনের নাম এমদাদ। ডাকনাম ফালান। আমরা বলি ফালান কাকা। তাঁরা ঢাকায় আছেন কি না জানি না। থাকলে, খবর পেলে নিশ্চয় আসবেন।

নদীর ওই পারে, মানে বুড়িগঙ্গার ওই পারে, কেরানীগঞ্জে আছেন আব্বার আরেক চাচাতো ভাই। আলাউদ্দিন কাকা। তাঁদের সঙ্গে আমাদের দেখাশোনা, যোগাযোগ বলতে গেলে নেই-ই। তবু খবর পেলে কেউ না কেউ আসবে।

আমার সেই চাচার বড় ছেলের নাম সালাউদ্দিন। মিলুর সঙ্গে কেমন কেমন করে যেন যোগাযোগ হয়েছিল সালাউদ্দিনের। মিলুর চেয়ে বড় বয়সে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে দু-চারবার আমাদের এই বাসায় আসছে। মিলুও এক-দুবার নদীর ওই পারে আলাউদ্দিন কাকার বাড়িতে গেছে। কাকি নাকি খুবই অগোছালো। ঘরদুয়ার নাকি খুবই নোংরা।

মিলু এসব বলেছে।

আলাউদ্দিন কাকা কোর্টে চাকরি করেন। টাকা-পয়সা আছে ভালোই। তবে ছেলে-মেয়েরা নাকি লেখাপড়া তেমন করে না।

টুনু মামাদের বাসার কেউ নেই ঢাকায়। মিনু খালার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আছে। দীননাথ সেন রোডে দাদার বন্ধুরা আছে। হালিম হান্নান সাঈদ ফুজুল। ওরা খবর পেয়ে এসেছে। মিলুর বন্ধু বেলাল মানবেন্দ্র মোহাম্মদ আলী মুকুল ওরা একজনও আসেনি। বেলাল মানবেন্দ্র মুকুল ঢাকায় নেই নিশ্চয়। থাকলে হামিদুলই তাদের খবর দিত। সবাই আসত।

মোহাম্মদ আলীর ডাকনাম বুলু। মিলু বলেছে, ওর বন্ধুদের মধ্যে বুলুই মুক্তিযুদ্ধে গেছে। এখন ঢাকায়ই আছে। খবর পেলে লুকিয়ে হয়তো আসবে।

তবে মিলুর বন্ধু জাহিদ এসেছে। সঙ্গে জাহিদের মা আর মেজো বোন নাজনীন। ওদের দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছে মিলু। কান্না আরো বেড়েছে তার। জাহিদ গম্ভীর হয়ে আছে। নাজনীন আপন বড় বোনের মতো বুকে জড়িয়ে ধরেছে মিলুকে। মিলুকে সান্ত্বনা দিতে দিতে নিজেও কাঁদছে।

জাহিদের মা এসে দাঁড়িয়েছেন মার সামনে। ভদ্রমহিলার ভাষা খুব সুন্দর। বললেন, আপা, এভাবে চুপচাপ থাকবেন না। কান্নাকাটি করুন। তাহলে কষ্ট কমবে। ছেলে-মেয়েদের কথা ভাবুন। তাদের দিকে তাকান। এখন আপনিই ওদের একমাত্র ভরসা…

মা তাঁর দিকে ফিরেও তাকালেন না।

দাদার সঙ্গে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা রিকশাঅলা ধরনের একজন লোকও ঢুকেছে বাসায়। লোকটা কে? আব্বার পরিচিত? আব্বাকে শেষ দেখা দেখতে এসেছে?

হতে পারে। আব্বার সঙ্গে কত মানুষের পরিচয় ছিল?

নাকি লোকটা দাদার পরিচিত? গেণ্ডারিয়ার লোক?

দাদা আসায় আবার নতুন করে কান্নাকাটি। নতুন করে বিলাপ। আমি পলি বাদল ডলি মুকুল এ কজন চারপাশ থেকে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলাম। আব্বা নেই। এখন দাদাই আমাদের আব্বা। সে-ই আমাদের ভরসা।

উষার অপরাধী মুখ, বুয়ার কোলে খোকন, আসমাকে কোলে নিয়ে হামিদুল আছে মিলুর কাছাকাছি, মিলুকে জড়িয়ে রেখেছে নাজনীন…

এ সময় রতন নামে এক ভদ্রলোক এলেন। তিনিও মিউনিসিপ্যালিটিতে চাকরি করেন। সাবেক শরাফতগঞ্জ লেনেই বাসা ছিল। কিছুদিন হলো মিলব্যারাকের দিকে চলে গেছেন। হামিদুলদের কেমন যেন ভাই হয়। তাঁর ছোট ভাইয়ের নাম শহীদ। খুব ভালো ছাত্র। গলাচিপায় থাকত। সেখানকার স্কুল থেকে ফার্স্ট ডিভিশনে এসএসসি পাস করেছে। মিলুর সঙ্গে খুবই খাতির। শহীদের কাছে মাঝে মাঝে অঙ্ক করতে যেত মিলু। আমাদের বাসার কাছে যখন ওদের বাসা ছিল, তখন।

রতন সাহেবের সঙ্গে শহীদও এসেছে। আব্বার লাশের পাশে লোকজন বাড়ছে।

লন্ড্রিকাকা আর মুরগিটোলা মসজিদের ইমাম সাহেব বললেন, বেলা হয়ে যাচ্ছে। মুদ্দার এইভাবে রাখা ঠিক হবে না। গোসল দিয়ে ফেলা উচিত। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানাজা দিয়ে দাফন করতে হবে। দাফন কোথায় হবে? জুরাইন কবরস্থানে, নাকি আজিমপুরে?

হামেদ মামা না নোজদা কে যেন বললেন, আজিমপুর অনেক দূর, জুরাইনে হওয়াই ভালো। কাছাকাছি আছে।

তাহলে গোসলের ব্যবস্থা করেন।

মরা বাড়িতে কাজের লোকের কমতি হয় না। দেশের এই পরিস্থিতিতেও লোকজন কম হয়নি আমাদের বাসায়। আব্বাকে গোসল দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেললেন হামেদ মামারা, নোজদারা। লন্ড্রিকাকাও আছেন তাঁদের সঙ্গে।

কোন ফাঁকে আমাদের ঘরে বসে কোরআন শরিফ পড়তে শুরু করেছেন বাড়িঅলার মেজো মেয়ে টুনি আপা আর মেহেরুনের বড় ভাবি। একটা অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসের গলা পর্যন্ত চাউল ভরে গুঁজে দেওয়া হয়েছে আগরবাতি। সাদা সরু ধোঁয়া উঠছে আগরবাতি থেকে। পবিত্র গন্ধে ভরে গেছে চারদিক। কোনো কোনো আগরবাতির মাথা পুড়ে লম্বা ছাই জমেছে। সেই ছাই ঝরে পড়েছে গ্লাসের চারদিকে।

এ সময় বাদল খাঁ খালুজান এসে হাজির। মিনু খালার জামাই। লঞ্চের ব্যবসা করে ধীরে ধীরে বড়লোক হচ্ছেন। বেশ দাপুটে ব্যক্তিত্ববান লোক। খুবই দায়িত্বশীল। তাঁর পরনে কালো প্যান্ট আর সাদা শার্ট। শার্ট প্যান্টের ভিতর ইন করানো। কোমরে বেল্ট। পায়ে জুতা। বাসায় ঢুকেই আব্বার খাটের সামনে দাঁড়ালেন। মিলুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপায় কো?

অর্থাৎ আমার মা কোথায় জানতে চাইলেন।

মিলু কথা বলার আগেই মাকে তিনি দেখতে পেলেন। মা-ও দেখলেন তাঁকে। বারান্দার দেয়ালে হেলান দেওয়া মা উঠে দাঁড়ালেন। সিঁড়ি ভেঙে নেমে আব্বার খাটের সামনে, বাদল খাঁ খালুজানের সামনে দাঁড়ালেন। দাদা আর মিলু আছে ওখানটায়। দাদা আর মিলুকে দুহাতে কাছে টানলেন মা। দুই ছেলের দুই ডান হাত নিয়ে রাখলেন খালুজানের ডান হাতে। আমার এই ছেলে দুইডা আপনের হাতে তুইলা দিলাম। আপনে অগো দেইখেন…

শেষ দিকে গলা ধরে এলো মার। এই প্রথম শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন মা।

দাদা আর মিলুও কাঁদছে। খালুজান ওদের দুজনকে দুহাতে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরলেন। মাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। কাইন্দেন না আপা, কাইন্দেন না। আমি আপনের দুই ছেলেরে দেখুম। কাইন্দেন না। আল্লার ওপরে ভরসা রাখেন…

এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা কথা ভেবে আমার বুক হিম হয়ে এলো। আজ এগারোটা সাড়ে এগারোটার দিকে কাবলিটা আবার আসবে। সঙ্গে থাকবে মিলিশিয়ারা। আব্বা মারা গেছেন জানার পর তারা কী করবে? মিলিশিয়ারা তো মানুষ না। জন্তু। পিশাচ। নরপশু। এই অবস্থায়ই হয়তো টাকার জন্য চাপ দেবে। দেখা গেল, এত এত লোকের মাঝখান থেকে আমার দুই ভাইকে ধরে নিয়ে গেল। বলে গেল, অমুক জায়গায় নিয়ে গেলাম। কাবলির পাওনা সাত হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হবে। অথবা দাদা আর মিলুকে ধূপখোলার দিকে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলল। ওদের পক্ষে সবই সম্ভব। ওরা পারে না এমন কাজ পৃথিবীতে নেই। যাকে ইচ্ছা তাকে যখন-তখন গুলি করে মারতে পারে পিশাচরা। মানুষ মারা ওদের কাছে পাখি শিকারের চেয়েও সহজ।

আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। যদি সেই অবস্থা হয়, তাহলে কী হবে আমাদের? আব্বা চলে গেছেন। এখন সংসারের এতগুলো মানুষের ভরসা দাদা আর মিলু। ওদের নিয়ে যদি ও রকম বিপদ হয়, তাহলে? সাত হাজার টাকাও অনেক টাকা। এত টাকা আমরা কোথায় পাব? আল্লাহ এ কোন বিপদে ফেললেন আমাদের? এত দিনকার চেনা কাবলিটা কেন এ রকম লোভে পড়ল? কেন মিথ্যা দাবি নিয়ে এলো? তার প্রতিটা পয়সা তো আব্বা মিটিয়ে দিয়েছিলেন। দুটো না তিনটা কিস্তিতে সুদে-আসলে সব টাকা দিয়ে দিয়েছেন। একটা পয়সাও কাবলি পায় না। সুযোগ পেয়ে, লোভে পড়ে আমাদের মতো একটা নিরীহ পরিবারের ওপর এ কোন চাপ সৃষ্টি করল? কাবলিরাও কেউ কেউ তাহলে নরপশু? লোভী কুকুর?

সালামকে আজ আর দেখছি না। সে ভয়ার্ত গলায় কাল বলে গেছে, তখনই সে পালিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে। নয়তো মিলিশিয়ারা তাকেও ধরবে। দোকানে গিয়ে তাকে না পেলে তার বড় ভাইকে ধরবে। ভাইকে সব খুলে বলবে সে। দোকান বন্ধ করে ভাইকে নিয়েই গ্রামে চলে যাবে।

নিশ্চয় সালাম কালই চলে গেছে। নয়তো আব্বা মারা গেছেন শুনলে একবার অন্তত আসত। মিলুকে খুবই ভালোবাসে। মিলুর জন্যই তো এসে বীরদর্পে চলে গিয়েছিল মিলিশিয়াদের সঙ্গে। আমরা খালেদা আপাদের দোতলা থেকে দেখেছি মিলিশিয়াদের সঙ্গে উর্দুতে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে সে। গেল বীরের মতো, ফিরে এলো ভয়ার্ত ভঙ্গিতে। রীতিমতো কাঁপছিল। শরীর ভর্তি লম্বা লম্বা লালচে দাগ। মোটা বেত দিয়ে বেদম পিটিয়েছে তাকে। মিলিশিয়াদের দলপতি জন্তুটির হাতে আড়াই তিন হাত পরিমাণ মোটা বেতের চকচকে একটা স্টিক ছিল। স্টিকের দুমাথায় পিতলের ক্যাপ পরানো। আমি দেখেছি।

আব্বার লাশ নিয়ে সবাই ব্যস্ত বলে কাবলি আর মিলিশিয়াদের কথা কারো মনে নেই। আমার মনে পড়ল আর ভয়ে আতঙ্কে ভিতরে ভিতরে আমি কাঁপতে লাগলাম।

পিশাচগুলো এলে কী হবে?

ওরা তো কারো তোয়াক্কা করবে না। সবার সামনে থেকে যদি দাদা আর মিলুকে ধরে নিয়ে যায়? হায় হায়, তাহলে কী হবে? একদিকে আব্বার মৃত্যু, আরেক দিকে যদি ঘটে এই বিপদ, তাহলে?

আব্বার কথা ভুলে আমি আমার দুই ভাইয়ের জন্য মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। আল্লাহ আমার ভাইদের রক্ষা করো। আল্লাহ, তুমি রহমানের রাহিম। এই বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করো। বিপদ সামলানোর তৌফিক দান করো।

শবেবরাতের নামাজ তাড়াতাড়ি শেষ করেছিলেন আব্বা। বারোটার দিকে। তারপর শুয়ে পড়েছিলেন। ফজরের ওয়াক্তে উঠে অজু করে আবার নামাজ পড়েছেন, আবার শুয়েছেন। উঠেছেন একটু বেলা করে। অফিস ছুটি ছিল। আর শবেবরাতের পরদিন নাশতা ভালোই ছিল বাসায়। রুটি হালুয়া। ওই দিয়ে নাশতা করেছি আমরা সবাই। আব্বা খেলেন চাউলের রুটি আর সুজির হালুয়া, বুট পেঁপের হালুয়া। দাদা বাজার নিয়ে এলো। তারপর সে চলে গেল এক দিকে, আব্বা চলে গেলেন আরেক দিকে। দাদার পরনে লুঙ্গি আর হাওয়াই শার্ট। আব্বার লুঙ্গি পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিটা খদ্দরের। গেরুয়া রং। দাদা প্রথম মাসের বেতন পেয়ে রেডিমেড খদ্দরের পাঞ্জাবিটা কিনে এনেছিল।

খদ্দরের কাপড় আব্বা পছন্দ করেন না। আমাদের সেই তীব্র অভাবের দিনেও খদ্দর কখনো পরেননি আব্বা। পুরানা ছেঁড়া শার্ট পাঞ্জাবি লুঙ্গি বা পায়জামা পরেছেন। দুটো প্যান্ট ছিল, ওগুলোই আমরা ধুয়ে দিতাম, আব্বা পরতেন। ইস্তিরি করার প্রশ্নই ওঠে না। ইস্তিরি করার পয়সা পাবেন কোথায়? তবে দু-একটা জামাকাপড় লন্ড্রিকাকা মাগনা ধুয়ে ইস্তিরি করে দিতেন।

আব্বা চাকরি ফিরে পেয়েছেন, দাদার চাকরি হয়েছে, অভাব-অনটন কাটিয়ে আমরা একটু স্বাভাবিক হয়েছি। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে ছেলেরা যা করে তা-ই করেছে দাদা। মার জন্য হালকা সবুজ রঙের একটা শাড়ি এনেছে। পাড়টা লাল। আর আব্বার জন্য খদ্দরের পাঞ্জাবি।

শাড়ি দেখে মা খুব খুশি। রংটা মার পছন্দ। আব্বা বেশির ভাগ সময় মার জন্য লাল শাড়ি কিনতেন আর মা খুব বিরক্ত হতেন। ওসব আমাদের সুসময়ের কথা। দুই ঈদে জামাকাপড় কেনা হতো আমাদের জন্য। একটানা চার বছর কোথায় ঈদ, কেমন ঈদ আমরা বুঝতেই পারিনি। সংসারই চলে না, তিন বেলার খাবারই নেই, নতুন জামাকাপড় আসবে কোত্থেকে!

সুসময়ে আব্বা যখন আমাদের জামাকাপড়, মা আম্মার শাড়ি কিনতেন, মার শাড়িটা কেমন কেমন করে যেন লালই হয়ে যেত। আর মা কী বিরক্ত! আপনে লাল রং ছাড়া কোনো রং চোক্কে দেখেন না?

আব্বা কী রকম একটু লজ্জা পেয়ে যেতেন।

ঠিক ও রকম লজ্জা দাদা সেদিন পেল। পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে আব্বা বললেন, শেষ পর্যন্ত খদ্দরও পরতে হইবো!

সেই খদ্দরের পাঞ্জাবি পরেই আব্বা কাল বেরিয়েছিলেন।

নাশতা করে অনেকক্ষণ ধরে তামাক টানলেন। আব্বা সিগ্রেটও খান। অফিসে বা বাইরে থাকলে সিগ্রেট, বাসায় তামাক। আব্বা তো অবশ্যই আনবেন, দাদা মিলু যে-ই বাজারে যাক, আব্বার জন্য তামাক আনবেই। সূত্রাপুর বাজারে বিশেষ একটা তামাকের দোকান দুই ছেলেকে বহু আগেই চিনিয়ে দিয়েছেন আব্বা। সেই দোকানের তামাকই বাজার থেকে আনা হয়।

তামাকের গন্ধটা খুব সুন্দর। আব্বা যখন তামাক টানেন, ধোঁয়ার যে গন্ধটা তখন বেরোয়, চারদিক ভরে যায় সেই গন্ধে। বহুদিন ধরে গন্ধটার সঙ্গে আমরা পরিচিত। এই গন্ধও আমাদের সংসারের অংশ হয়ে গেছে।

ছুটির দিন পেয়ে দাদা গেল দীননাথ সেন রোডের দিকে। বন্ধুদের সঙ্গে একটু আড্ডা দেবে আর কার কাছে মুক্তিযুদ্ধের কী খবর আছে, জানবে। কত দূর এগোল দেশের স্বাধীনতা, সেসব যতটা সম্ভব জেনে খুশি হয়ে বাসায় ফিরবে। আমাদের বলবে। শুনে আমরাও আনন্দে ফেটে পড়ব।

খবর আনবেন আব্বাও। যে যাঁর জায়গা থেকে খবর পাচ্ছেন। পাকিস্তানিদের এদেশি চাকরবাকর ছাড়া দেশের প্রতিটি মানুষই উদ্গ্রীব হয়ে আছে স্বাধীনতার জন্য।

আসছে, আমাদের স্বাধীনতা আসছে। তৈরি হতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। সামনেই বাঙালি জাতির সুখের দিন। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ হব আমরা।

ভাগ্যিস আব্বা আর দাদা কাল ও সময় বাসায় ছিল না। ভাগ্যিস মিলু আমাদের গেটটা খোলেনি। তাহলে যে কী হতো!

আব্বা বাসায় থাকলে নিশ্চয় গেট তাঁকে খুলতে হতো, বা সালাম যেভাবে বাড়িঅলাদের গেট দিয়ে বেরিয়ে মিলিশিয়াদের সঙ্গে গিয়েছিল, আব্বাকেও সেইভাবে যেতে হতো। বেত দিয়ে সালামকে যে মারটা জন্তুগুলো মেরেছে আব্বাকেও হয়তো সেইভাবে…আর নয়তো ধরে নিয়ে যেত। সাত হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হতো। সেই ফাঁকে আব্বার ওপর চলত অকথ্য নির্যাতন। সাত হাজার টাকাই বা আমরা কোথায় পেতাম! হয়তো ওই নরপশুদের নির্যাতনেই শেষ হয়ে যেতেন আমার আব্বা।

দাদাকে পেলেও তা-ই করত কুকুরগুলো। ধরে নিয়ে নির্যাতনের শেষ রাখত না। ছেলে-মেয়েরা হচ্ছে আব্বার জান। ছেলেকে ছাড়াতে আব্বা যেতেন। আব্বাকে আটকে রেখে দাদাকে হয়তো ওরা ছেড়ে দিত। নির্যাতন চালাত আব্বার ওপর।

সে রকম শারীরিক নির্যাতন আব্বার ওপর পড়ল না ঠিকই, পড়ল অন্য রকম এক নির্যাতন। মানসিক নির্যাতন। সেই নির্যাতনেই শেষ হয়ে গেলেন আব্বা। একজন কাবলিঅলা আর তিনজন মিলিশিয়া একটু অন্য রকম ভাবে আমার আব্বাকে হত্যা করল। খুন করল।

আব্বা বোধ হয় কলুটোলায় গিয়েছিলেন। তাঁর পীর সাহেবের ওখানে। সেখান থেকে একবারে জোহরের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরলেন। হাসি হাসি মুখ। দাদা তখনো ফেরেনি।

বাসায় ঢুকেছিলেন বাড়িঅলাদের গেট দিয়ে। বড় রুমটায় ঢুকে আমাদের দিশাহারা চেহারা দেখে অবাক। মার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী অইছে? তোমগো এমুন মনমরা অবস্তা ক্যা?

মিলু ছিল উত্তর দিককার জানালার কাছে। আব্বার কাছে ছুটে এসে ঘটনা বলল। কাবলি এসেছিল তিনজন মিলিশিয়া নিয়ে। সে দরজা খোলেনি। সালামকে ডেকে এনেছিল। ইত্যাদি ইত্যাদি। কাবলি নাকি সাত হাজার টাকা পায়। কাল সকালে আবার আসবে।

শুনে চারদিক থেকে মার খেতে থাকা বোবা প্রাণীর মতো দিশাহারা হয়ে গেলেন আব্বা। হায় হায়, কয় কী! কাবলি তো আমার কাছে কোনো টেকাই পায় না। তিন কিস্তিতে ওর পাই টু পাই আমি শোদ কইরা দিছি। সুদে-আসলে শোদ কইরা দিছি। আমার কাছে এক পয়সাও পাইবো না। মিছা কথা, পুরাডা মিছা কথা। ডাহা মিছা কথা।

মা বললেন, হেইডা আমিও জানি। তয় অহন কী করবেন? কাবলি বিরাট সুযোগ নিতাছে। টেকা না পাইলে আপনেরে ধইরা লইয়া যাইবো…

আব্বা চৌকিতে বসে পড়লেন। ভয়ে আতঙ্কে মুখটা একেবারেই অন্য রকম হয়ে গেছে। কী করুম এহন? কার কাছে যামু? কে সাহাইয্য করবো? পাকিস্তানিরা তো কেউর কথা শুনবো না। কাবলি মনে হয় মিলিশিয়াগো লগে চুক্তি করছে। চাপ দিয়া সাত হাজার ফাও তুলতে পারলে অর্দেক নিজে নিবো, অর্দেক মিলিশিয়াগো দিবো। লোকটা এত খারাপ আগে বুজি নাই। এত দিন ধইরা আমার লগে চিনপরিচয়। কী করুম অহন? বিয়ানে তো আমার অফিসে যাওন লাগবো। বাসায় আইয়া আমারে না পাইলে, বাসায় ঢোকলে…। আর যদি আমার অফিসে যায়, অফিস থিকা ধইরা লইয়া যাইবো আমারে…হায় হায়, আল্লায় আমারে আবার কোন বিপদে হালাইলো…

এ সময় দাদা এলো। সব শুনে সে-ও আব্বার মতোই ভয় পেল। ভয়ে আতঙ্কে আমাদের ঘরটা কবরস্থানের মতো নিঝুম হয়ে গেল।

দাদা একসময় বলল, আব্বা, আপনে লন্ড্রিকাকারে লইয়া গিয়াসুদ্দিন চেরম্যানের কাছে যান। তারে গিয়া বেবাক কথা কন। দেহেন হে কিছু করতে পারেনি। আমি যাই মবিনের কাছে। মবিনের পোলা সাঈদ আমার পরিচিত। দেহি মবিন কী বুদ্ধি দেয়। কী করতে কয়।

আব্বা যেন একটু ভরসা পেলেন। হ বাজান, এইডা ভালো কথা কইছস। আমি লন্ড্রিঅলার কাছে যাই। তারে লইয়া যাই চেরম্যান অফিসে।

এই টাইমে তারে অফিসে পাইবেন না। বাসায় যাইতে হইবো।

বাসায়ই যাই। তুই যা মবিনের কাছে।

আমরা কেউ কোনো কথা বলছি না। আব্বা আর দাদা দুজন একসঙ্গেই বেরিয়ে গেল। আমাদের দরজা আর খোলাই হচ্ছে না। বাড়িঅলার দরজা দিয়েই আসা-যাওয়া চলছে।

ততক্ষণে মেহেরুনরা জেনেছে এই ঘটনা, খালেদা আপারা সবাই জেনেছে। সবাই চিন্তিত। এই অবস্থায় কে কাকে সাহায্য করবে? কিভাবে সাহায্য করবে? যে যাকে নিয়ে, যে যার পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত কারো জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই, কারো মনে বা পরিবারে কোনো স্বস্তি নেই।

ঘণ্টাখানেক পর প্রথমে দাদা ফিরল। মবিনের ছেলে সাঈদকে পেয়েছিল। মবিনকে পায়নি। মবিন বাড়িতে নেই। হয়তো লালকুঠির মিলিটারি ক্যাম্পে গেছে প্রভুদের সঙ্গে মোলাকাত করতে। সাঈদকে সবই দাদা বলেছে। শুনে সাঈদ বলেছে তার বাবা বাড়ি ফিরলে তাকে সে ঘটনা বলবে। দাদা যেন বিকালে আবার যায়। তখন মবিন বাড়িতে থাকবে।

আমরা তেমন কোনো ভরসা পেলাম না। প্রায় তিনটা বাজে। একফাঁকে রান্নাবান্নাও হয়েছে বাসায়। ভাত ডাল আর আলু বেগুন দিয়ে শোল মাছের ঝোল।

নদীর মাছ বলতে ইলিশ ছাড়া অন্য মাছ এখন আর কেউ কেনে না। পঁচিশে মার্চের পর থেকে নদীতে পড়ছে শুধু মানুষের লাশ। পচেগলে মিশে যাচ্ছে নদীর পানিতে। ভাসমান লাশ খাচ্ছে কাক শকুনে। পানির তলা থেকে ওপর দিকে উঠে লাশ খাচ্ছে নদীর মাছ। ইলিশ মাছ কখনই পানির ওপর দিকে ওঠে না। ইলিশে খায় না মানুষের লাশ। এ জন্য ইলিশটা কেউ কেউ কেনে। নদীর অন্য মাছ কেনেই না। বিলের মাছ কেনা হয়।

আমাদের সংসারেও চলছে সেই নিয়ম।

বারেকের মা আর পুনুআম্মা ছোটদের একফাঁকে ভাত দিয়েছেন। খোকন নিজ হাতে খেতে পারে। আসমাকে বারেকের মা খাইয়ে দিয়েছে। বড়রা কেউ ভাত খায়নি। মা আম্মা বারেকের মা। আমি মিলু বাদল পলি ডলি। আব্বা খাননি, দাদা খায়নি।

আব্বা ফিরলেন সোয়া তিনটার দিকে। শুকনা উত্কণ্ঠিত মুখ। চোখে গভীর চিন্তার ছায়া।

মা বললেন, গেছিলেন চেরম্যানের কাছে?

আব্বা চৌকিতে বসলেন। হ, গেছিলাম।

পাইছেন?

পাইছি।

কী কইলো?

কইলো কাইল ওই টাইমে সে চেরম্যান অফিসে থাকবো। কাবলি আর মিলিশিয়ারা আইলে তাগো লইয়া চেরম্যান অফিসে য্যান আমি যাই। সে ফয়সালা কইরা দিব।

আমরা যেন একটু ভরসা পেলাম। একটু যেন সাহস পেলাম।

আব্বা বললেন, লন্ড্রিঅলাও আছিল আমার লগে। চেরম্যান সাবে তারে কইছে সে-ও য্যান ওই টাইমে আমগো বাসায় আইসা থাকে। দুইজনে মিল্লা কাবলিগো লইয়া য্যান চেরম্যান অফিসে যাই…

মা বললেন, কোন বিপদ যে কপালে আছে আল্লাই জানে।

দরজার সামনে আসমাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বারেকের মা। আমার মাকে সে মা ডাকে। সে বলল, ও মা, আপনেরা বেবাকতে এমুন হোতলাইয়া পড়লে কেমতে চলবো? আব্বারে ভাত দেন। ভাত পানি খান বেবাকতে। আল্লায় যা করে ওইডাই অইবো। অহন ভাত পানি খান।

মা উঠে দাঁড়ালেন। হ, ঠিকই কইছো। ভাত পানি এই ঘরে লইয়াহো। ভাত দেও মিলুর আব্বারে।

আমরা সবাই মিলেই খেলাম। কারো মুখে কোনো স্বস্তি নেই। খাওয়ার মজা আনন্দ কিচ্ছু নেই। কোনো রকমে খাওয়া আর কি! কেউ কোনো কথাও বলল না খাওয়ার সময়।

খাওয়া শেষ হতেই আব্বার জন্য তামাক সাজিয়ে আনল বারেকের মা। বারান্দায় বসে হতাশ চিন্তিত মুখে তামাক টানতে লাগলেন আব্বা। নারকেলের হুঁকায় গুড়গুড়, গুড়গুড় করে কয়েকটা টান দেন, তারপর কেমন একটু উদাস হয়ে যান।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিলাম আব্বার দিকে। মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম, তামাকে কোনো স্বাদ পাচ্ছেন না আব্বা। নিতান্তই অভ্যাসবশে খাচ্ছেন।

একসময় হুঁকাটা এক পাশে রেখে নিজের বুক আর পেট হাতাতে লাগলেন আব্বা। বাসায় ফিরে খদ্দরের পাঞ্জাবি খুলে রেখেছেন। এখন খালি গা। আব্বার শ্যামলা রঙের অতি সাধারণ মানুষের মতো শরীরে কী রকম যেন একটা অস্বস্তি।

আব্বা উঠে দাঁড়ালেন। নিজের স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা পরে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলেন। পায়খানায় গেলেন।

অল্প কিছুক্ষণ পর কলপার থেকে হাতটাত ধুয়ে বারান্দা পর্যন্ত এলেন। ঘরে মাত্র ঢুকবেন, আবার পেটে হাত দিলেন। ঘরে আর ঢুকলেন না। আবার গেলেন পায়খানায়।

এইভাবে আধাঘণ্টার মধ্যে পাঁচবার গেলেন। শেষ পর্যন্ত বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন। আমরা সবাই আব্বার পাশে। মা বললেন, এতবার পায়খানায় গেলেন ক্যা? পেট খারাপ হইলো নি?

আব্বা দুর্বল গলায় বললেন, গ্যাসটিকের বেদনা উটছে। ইকটু পানি দেও।

মা এক গ্লাস পানি দিলেন। পানিটা পুরো খেলেন আমরা সবাই মিলেই খেলাম। কারো মুখে কোনো স্বস্তি নেই। খাওয়ার মজা আনন্দ কিচ্ছু নেই। কোনো রকমে খাওয়া আর কি! কেউ কোনো কথাও বলল না খাওয়ার সময়।

খাওয়া শেষ হতেই আব্বার জন্য তামাক সাজিয়ে আনল বারেকের মা। বারান্দায় বসে হতাশ চিন্তিত মুখে তামাক টানতে লাগলেন আব্বা। নারকেলের হুঁকায় গুড়গুড়, গুড়গুড় করে কয়েকটা টান দেন, তারপর কেমন একটু উদাস হয়ে যান।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিলাম আব্বার দিকে। মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম, তামাকে কোনো স্বাদ পাচ্ছেন না আব্বা। নিতান্তই অভ্যাসবশে খাচ্ছেন।

একসময় হুঁকাটা এক পাশে রেখে নিজের বুক আর পেট হাতাতে লাগলেন আব্বা। বাসায় ফিরে খদ্দরের পাঞ্জাবি খুলে রেখেছেন। এখন খালি গা। আব্বার শ্যামলা রঙের অতি সাধারণ মানুষের মতো শরীরে কী রকম যেন একটা অস্বস্তি।

আব্বা উঠে দাঁড়ালেন। নিজের স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা পরে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলেন। পায়খানায় গেলেন।

অল্প কিছুক্ষণ পর কলপার থেকে হাতটাত ধুয়ে বারান্দা পর্যন্ত এলেন। ঘরে মাত্র ঢুকবেন, আবার পেটে হাত দিলেন। ঘরে আর ঢুকলেন না। আবার গেলেন পায়খানায়।

এইভাবে আধাঘণ্টার মধ্যে পাঁচবার গেলেন। শেষ পর্যন্ত বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন। আমরা সবাই আব্বার পাশে। মা বললেন, এতবার পায়খানায় গেলেন ক্যা? পেট খারাপ হইলো নি?

আব্বা দুর্বল গলায় বললেন, গ্যাসটিকের বেদনা উটছে। ইকটু পানি দেও।

মা এক গ্লাস পানি দিলেন। পানিটা পুরো খেলেন না আব্বা। এক চুমুক খেয়ে দুহাতে পেট চেপে ধরলেন। কেউরে কাসেমের দোকানে পাডাও। খাওনের সোডা লইয়াহুক।

উঠে আবার পায়খানায় গেলেন আব্বা। আব্বাকে ধরে ধরে নিয়ে গেল মিলু। আব্বা পায়খানায় ঢুকল, মিলু দাঁড়িয়ে রইল গোসলখানার সামনে।

মা চার আনা পয়সা দিয়েছেন উষার হাতে। উষা দৌড়ে চলে গেল কাসেমের দোকানে।

চাকরি চলে যাওয়ার পর থেকেই খাবারের সোডাটা ধরেছিলেন আব্বা। যখন-তখন গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা উঠত। সহ্য করতে পারতেন না আব্বা। খাবারের সোডা মুদি দোকানেও পাওয়া যায়। পাউডারের মতো এক পুরিয়া সোডা মুখে দিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কমে যেত ব্যথা। কিন্তু জিনিসটা খুব খারাপ। পাকস্থলী শেষ করে দেয়। মা এটা জানতেন। এ জন্য আব্বা যখনই সোডা খেতেন, মা গজগজ করতেন। এই জিনিস খাইয়াই আপনে একদিন মরবেন। এইডা অষইদ না, বিষ, বিষ।

আজ আর মা কোনো কথাই বললেন না।

পায়খানা থেকে বেরোনোর পর আব্বাকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে এলো মিলু। উষা ততক্ষণে সোডা নিয়ে ফিরেছে। দুর্বল হাতে আব্বা সেই জিনিস খেলেন। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম পানির গ্লাস নিয়ে। আব্বা দুই ঢোক পানি খেলেন।

এই প্রথম এত দিনকার কার্যকর খাবার সোডা আব্বার কোনো কাজ করল না। আব্বা আরো দু-তিনবার পায়খানায় গেলেন। দাদা আর মিলু ধরে ধরে নিয়ে যায়। আমরা সবাই গিয়ে দাঁড়িয়েছি রান্নাঘরের ওদিকটায়।

শেষবার কোনো রকমে পায়খানার দরজা খুললেন আব্বা। অসহায় শিশুর ভঙ্গিতে উষার দিকে দুহাত বাড়িয়ে বললেন, আমারে ধর মা, আমারে ধর।

দাদা আর মিলু সিঁড়ি ভেঙে পায়খানার দরজা পর্যন্ত উঠে আব্বাকে ধরে ধরে নামাল। বারান্দায় আসতে আসতে উষার দিকে তাকিয়ে আব্বা বললেন, আমারে তুই কী খাওয়াইলি মা? আমি তো মইরা যাইতাছি…

আব্বা দাঁড়াতে পারছিলেন না। টলে পড়ে যাচ্ছিলেন। দাদা মিলু ধরাধরি করে ঘরে এনে চৌকিতে শুইয়ে দিল। আব্বা চোখ বুজে পড়ে রইলেন। মা দিশাহারা গলায় বললেন, মণি, দোতালায় যা। খালেদারে ডাইক্কা আন। তর আব্বার অবস্তা খারাপ।

আমি দৌড়ে দোতালায় গিয়ে খালেদা আপাকে ডেকে আনলাম। তিনি ডাক্তার। কাবলি আর মিলিশিয়াদের ঘটনা শুনেছেন। বললেন, খালু খুবই নার্ভাস হয়েছেন। টেনশান থেকে এ রকম হচ্ছে। আমি দেখছি।

নিজেই দৌড়ে গেলেন দোতালায়। ডাক্তারি ব্যাগ এনে, ব্যাগের ভিতর থেকে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বের করলেন, সরু স্পুলের মাথা টোকা দিয়ে ভেঙে পানির মতো একটা অষুদ সিরিঞ্জে টেনে ইনজেকশন দিলেন আব্বাকে।

আব্বা চোখ বুজে আগের মতোই পড়ে আছেন। জোরে জোরে শ্বাস টানছেন। টুনি আপা আর মণি এসেছে আমাদের ঘরে। মেহেরুন মেহেরুনের বড় ভাবি এসেছেন। আব্বার চৌকির পাশে আমরা সবাই। মিলু থেকে থেকে চোখ মুছছে। দাদা চিন্তিত ভঙ্গিতে একবার বারান্দায় যাচ্ছে, আরেকবার ঘরে ঢুকছে। খুবই অস্থির সে।

খালেদা আপা একবার প্রেসার মাপলেন আব্বার। প্রেসার হাই। পালস দেখলেন। তাঁর মুখে চিন্তার ছায়া। বিকাল হয়ে গেছে। বোধ হয় সাড়ে চারটা পাঁচটা বাজে। আব্বা এখন আর কথা বলছেন না, নড়াচড়াও করছেন না। জোরে জোরে শুধু শ্বাস পড়ছে।

খালেদা আপা বললেন, সেন্সলেস হয়ে গেছে। হাসপাতালে নিতে হবে।

শুনে আমরা কান্নাকাটি শুরু করলাম। কেউ শব্দ করে কাঁদছি, কেউ নিঃশব্দে। খালেদা আপার আব্বা, আমাদের বাড়িঅলা নেমে এসেছেন, কাসেম ভাই আবুল ভাই অলিদ এসেছে। মেহেরুনের ভাই ভাবি মা এসেছেন।

কাসেম ভাই বললেন, দেরি করা ঠিক হবে না। আজাদ, তুমি একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে এসো। তুমি আর মিলু বেবিট্যাক্সিতে যাবে খালুকে নিয়ে। আমি ভ্যাসপা নিয়ে যাচ্ছি। ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাব।

দাদা কোনো রকমে একটা প্যান্ট পরল, শার্ট তো পরাই ছিল। কিন্তু সে বেবিট্যাক্সি আনতে গেল না। গেল মিলু। কোন ফাঁকে যে শার্ট প্যান্ট পরে নিয়েছে মিলু, আমরা কেউ বুঝতেই পারিনি।

আব্বা লুঙ্গি পরা ছিলেন। অচেতন মানুষটাকে কোনো রকমে ধরাধরি করে সেই খদ্দরের পাঞ্জাবিটা পরানো হলো। আবুল ভাই অলিদ মেহেরুনের দুই ভাই দাদা আর মিলু তো আছেই, বাড়িঅলার গেটের ওদিকটায় দাঁড়িয়ে আছে বেবিট্যাক্সি। প্রথমে দাদা আর মিলু উঠল, অন্যরা ধরাধরি করে অচেতন আব্বাকে লম্বা করে তুলে দিল দুই ছেলের কোলে। আমরা সবাই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছি। আশপাশের বাড়ির দু-চারজন লোক জড়ো হয়েছে রাস্তায়। আব্বাকে নিয়ে বেবিট্যাক্সি চলে গেল লোহারপুলের দিকে। কাসেম ভাই ভ্যাসপা নিয়ে চললেন আগে আগে।

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের বিকালবেলার রোদ ততক্ষণে সাবেক শরাফতগঞ্জ লেনের পুরানা একতলা দোতলা বাড়িগুলোর ছাদে উঠে গেছে।

মিলু

অপলক চোখে আব্বার মুখের দিকে আমি তাকিয়ে আছি। গাল বেয়ে নিঃশব্দে নেমেছে কান্না। আব্বার খাটের চারপাশে আমরা সব ভাই-বোন মা আম্মা বারেকের মা। হামেদ মামা নোজদা আছেন, বাদল খাঁ খালুজান আছেন। লন্ড্রিকাকা বাড়িঅলার পরিবার মেহেরুনদের পরিবার আব্বার কয়েকজন পীর ভাই। মিউনিসিপ্যালিটিতে কেমন কেমন করে পৌঁছেছে খবর। আব্বার অফিসের লোকজন এসেছে কয়েকজন। ফালান কাকা এসেছেন। আশপাশের বাড়িঘরের লোকজন আছে। আমার বন্ধুদের মধ্যে হামিদুল আর শহীদ ভাই আছে। আসমা এখনো হামিদুলের কোলে।

গোসল শেষে কাফন পরানো হয়েছে আব্বাকে। কাফনের কাপড় দিয়েছেন কাসেম ভাইয়ের আব্বা। আমাদের বাড়িঅলা। তিনি হজে গিয়েছিলেন। পবিত্র মক্কা নগরী থেকে এনেছিলেন পরিবারের জন্য কাফনের কাপড়। সেই কাপড় থেকে আব্বাকে দিয়েছেন। সাদা ধপধপে কাপড়ে মোড়া আব্বার শরীর। শেষ দেখা দেখার জন্য মুখটা খুলে দেওয়া হয়েছে। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা।

আব্বার সেই স্নিগ্ধ মুখ, মায়াবী মুখ। কোনো দিশাহারা ভাব নেই মুখে, উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা নেই। যেন অতি নিশ্চিন্তে গভীর ঘুম ঘুমাচ্ছেন। প্রশান্তি ভরা মুখখানি।

আব্বার নাকের ফুটোয় আতরমাখা তুলো গুঁজে রাখা হয়েছে। গোলাপ পানি ছিটানো হয়েছে। আগরবাতি জ্বলছে মাথার কাছে। বাড়ির বদ্ধ হাওয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে পবিত্র এক গন্ধ। এই গন্ধ আসলে শেষবিদায়ের গন্ধ। মৃত্যুর গন্ধ।

খানিক আগে কে যেন আমাদের ডাকল। এখনই জানাজার জন্য নেওয়া হবে লাশ। জানাজার পর বাসায় আনার নিয়ম নেই। সোজা নেওয়া হবে কবরস্থানে। আর আব্বার জানাজা হবে কলুটোলা মসজিদে। বাদ জোহর। ওই মসজিদের পাশেই আব্বার পীর সাহেবের বাড়ি। তিনি জানাজায় থাকবেন। জানাজা শেষ করে আব্বাকে নেওয়া হবে জুরাইন কবরস্থানে। সেখানে দাফন করা হবে।

কারা কারা কিভাবে যেন সব ব্যবস্থা করেছে। জুরাইনের কবরস্থানে চলে গেছে লোক। কবর খোঁড়ার কাজ করাচ্ছে। বাঁশ চাটাই যা যা লাগে কেনা হয়ে গেছে। তিনটনি একটা ট্রাক ভাড়া করা হয়েছে। ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে কাঠেরপুলের পুব দিকটায়। আমাদের গলিতে ট্রাক ঢুকবে না। এ জন্য ওখানে রাখা হয়েছে। সাবেক শরাফতগঞ্জ লেন থেকে কাঁধে করে আব্বার খাট নেওয়া হবে কলুটোলা মসজিদে। জানাজা শেষে পুল পার করে আনা হবে। ট্রাকে তুলে রওনা দিতে হবে জুরাইন।

আমরা সবাই আব্বাকে শেষ দেখা দেখার জন্য দাঁড়িয়েছি।

এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য এখন আমাদের বাসায়। ভাই-বোনরা শব্দ করে কাঁদছে কেউ, কেউ কাঁদছে নিঃশব্দে। ডলি ‘আব্বাগো, ও আব্বা’ বলে বিলাপ করছে। খালুজানের হাতে আমাকে আর দাদাকে তুলে দেওয়ার সময় কান্নার বাঁধটা ভেঙেছিল মার। তার পর থেকে শুধুই কাঁদছেন মা। আঁচলে মুখ চেপে কেঁদেই চলেছেন। এখন দেখছি চার সাড়ে চার বছরের আসমা কাঁদছে। হামিদুলের কোলেও হয়তো মাকে কাঁদতে দেখে কাঁদছে। খোকনও কাঁদছে। কোন ফাঁকে খোকন একটা শার্ট পরেছে। ওইটুকু ছেলেটির মাথায় সাদা গোল একটা টুপি। সে-ও যাবে আব্বার জানাজায়। সে-ও যাবে কবরস্থানে। কে একজন তাড়া দিল। দেরি হয়ে যাচ্ছে। এখনই জোহরের আজান পড়বে। লাশ বের করা দরকার।

সবার মধ্যে একটা সাড়া পড়ল। হামেদ মামা নোজদা খালুজান লন্ড্রিকাকা কাসেম ভাই বাসেত ভাই—সবাই তৈরি আব্বার খাট কাঁধে নেওয়ার জন্য।

মুহূর্তে আটজন মানুষের কাঁধে উঠে গেল আব্বার লাশ। তার আগে মুখ ঢেকে দেওয়া হলো। আব্বা চলে গেলেন কাফনের আড়ালে। যারা কাঁধে নিয়েছে তাদের মধ্যে দেখি দাদাও আছে। চোখের পানিতে গাল ভাসছে তার। বিড়বিড় করে বলছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্…

নিজের এত দিনকার পুরনো সংসার ছেড়ে, স্ত্রী আর দশটি অসহায় ছেলে-মেয়ে রেখে আব্বা চিরদিনের মতো তাঁর বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি চোখ মুছতে মুছতে যাচ্ছি পিছন পিছন। হামিদুলের হাত ধরে আছে খোকন। সে-ও যাচ্ছে। গেটের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন মা আম্মা বাড়ির অন্যান্য মহিলা আর মেয়েরা আর আমার বোনরা।

বাসায় কত কিছু পড়ে রইল আব্বার। তাঁর পুরানা লুঙ্গি গামছা প্যান্ট পায়জামা শার্ট আর বড় ছেলের দেওয়া খদ্দরের পাঞ্জাবি। অফিসে পরে যাওয়ার এক জোড়া পুরানা খয়েরি রঙের বাটার স্যান্ডেল। আঙুলের মতো মোটা একটা ফাউন্টেন পেন। পেনের নাম ‘প্রেসিডেন্ট’। অতি সস্তা কালো বেল্টের পুরানা একটা ঘড়ি। আলনায় ঝোলানো শার্টের বুকপকেটে একগাদা ভাঁজ করা কাগজ। কোড়া রঙের ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জিটা অনেক দিন ধরে পরছিলেন। সেই গেঞ্জি ধুতে গিয়ে মা গজগজ করতেন। আব্বা হয়তো বারান্দায় বসে তখন তামাক খাচ্ছেন। মা তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, গেঞ্জির দাম কত? দুইডা গেঞ্জি কিনেন না ক্যা?

আব্বা তামাক টানার ফাঁকে বললেন, এই মাসের বেতন পাইয়া কিনুম নে। একখান লুঙ্গিও কিনন লাগব।

বড় রুমের বারান্দা থেকে নামার সিঁড়িতে পড়ে রইল আব্বার পুরানা নীল বেল্টের স্পঞ্জের স্যান্ডেল জোড়া। স্যান্ডেলের মাথার কাছে পায়ের পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়ে গেছে। রান্নাঘরের কোণে দাঁড় করানো আব্বার প্রিয় নারকেলের হুঁকা, টিনের মুখ খোলা তামাকের দুমড়ানো কৌটা, টিকা আর নারকেলের ছোবড়া রাখার মালসা, সব ফেলে আমার মায়ের ‘গগনবাবু’ চলে গেলেন। পুনুআম্মার ‘দুলাভাই’ চলে গেলেন। বুজি আব্বাকে ডাকতেন ‘খোকার বাপ’ বলে। সেই খোকার বাপ আজ চলে যাচ্ছেন চিরতরে।

আমাদের পরিবারের অংশ হয়েছিল আব্বার তামাকের গন্ধটা। সেই গন্ধ আর কোনো দিন ফিরে আসবে না সংসারে। গরমের দিনে ঘামে ভেজা আব্বা বাসায় ফিরতেন। তাঁর গায়ের সেই গন্ধটা আর পাওয়া যাবে না। রাতে ঘুমের তালে বিড়বিড় করে কথা বলার স্বভাব ছিল। পাশে শুয়ে বিড়বিড়ানি শুনে আর কোনো দিন মাঝরাতে ঘুম ভাঙবে না আমার। ঘুম ভেঙে দেখব না এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে, গাছতলায় শুয়ে বই পড়ার ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছেন আমার আব্বা।

আজ থেকে কোনো দিনও আমি আর অপেক্ষা করব না, এতটা রাত হলো, আব্বা ফিরছেন না কেন? কোনো দিনও গিয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকব না বাড়ির কোণে কিংবা কাঠেরপুলের ওদিকটায়। একা একা রাস্তার আলো-অন্ধকারের ভিতর থেকে ক্লান্ত বিপর্যস্ত মানুষটা আর কোনো দিনও বেরিয়ে আসবেন না। মেজো ছেলেটাকে তাঁর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মায়াবী হাসিটি ফুটবে না আর মুখে। ছেলেকে বুকে টেনে বলবেন না, তুমি আমার লেইগা খাড়ায়া রইছো বাজান?

আহা রে আমার বাজান! তুমি আমার লেইগা এত কষ্ট করো ক্যান?

আব্বার লাশের পিছনে হাঁটতে হাঁটতে কত দিনকার কত কথা যে আমার মনে আসে। কত দুঃখ-বেদনার স্মৃতি। কত অপমান-অপদস্থের স্মৃতি। দুটো পাঁচটা টাকা জোগাড়ের আশায় মেজো ছেলেটাকে নিয়ে পথে নেমেছেন আব্বা। কোথায় যাবেন, কার কাছে যাবেন ঠিক নেই, তবু বেরিয়েছেন। সংসার চলে না। যদি কোনো আত্মীয়-পরিজনের কাছে গিয়ে দাঁড়ান। হয়তো বহুবার সেই আত্মীয়-পরিজনের কাছ থেকে ধারদেনা করেছেন। উপায় না দেখে আবার এসেছেন। তাঁকে দেখে না হোক, মেজো ছেলের মায়াবী মুখখানি দেখে আত্মীয় বন্ধু মানুষটির মন হয়তো নরম হলো। দিলেন হয়তো দুটো বা পাঁচটি টাকা।

ওই সব মুহূর্তে আমার খুব লজ্জা করত। আব্বার করুণ কণ্ঠের অনুনয়-বিনয়ে এমন মায়া লাগত আব্বার জন্য! আহা রে আমার অসহায় আব্বাটি! কেন তাঁর জীবনটা অন্য দশজন মানুষের মতো হয়নি? কেন তাঁর জীবনটা এমন কষ্টের জীবন হলো? এক জীবনে একই প্রতিষ্ঠান থেকে দুবার চাকরি গেল, দুবারই আবার সেই প্রতিষ্ঠানেই চাকরি ফিরে পেলেন! প্রথমবার জিন্দাবাহারের বাসায়। একষট্টি বাষট্টি সালের দিকে। নাকি তেষট্টি সাল? দ্বিতীয়বার সাতষষ্টি সাল। প্রথমবার বছর দুয়েক কাটল কষ্টে, দ্বিতীয়বার চার বছর। মোটমাট এই ছয় বছরের তীব্র অভাব-অনটন, অনাহার অপমান আর গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা পিছনে ফেলে আব্বা চলে গেলেন এমন এক জগতে, যেখানে শুধু যাওয়াই যায়, ফেরা যায় না।

আমাদের এখন কী হবে?

তেরোজন মানুষের সংসার কিভাবে চলবে?

দাদার ওইটুকু বেতন…

কলুটোলা মসজিদে এসে আব্বার লাশ রাখা হলো বারান্দার এক পাশে।

সবাই নামাজে দাঁড়াল। আমি আর হামিদুল দাঁড়িয়ে রইলাম আব্বার খাটের পাশে। হামিদুলের হাত ধরে আছে খোকন। আমি মাঝে মাঝে কাঁদছি, মাঝে মাঝে থামছি। হামিদুল পারলে আমাকে নিজের জানটা দিয়ে শোক ভোলায়। যেন সাধ্য থাকলে এখনই সে আমার আব্বাকে ফিরিয়ে এনে আমার হাতে তুলে দিত।

আমাদের লোকজন ছাড়া তেমন কেউ নেই মসজিদে। এইতো মসজিদের উল্টো দিকে, গলির ডান দিকে বেলালদের বাড়ি। কাজের লোকজন দু-একজন আছে হয়তো বাড়িতে। বেলালরা কেউ নেই। নবাবগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে আছে। বেলালের বড় ভাই মহিউদ্দিন ভাই মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার। ওদের পুরো পরিবার মুক্তিযুদ্ধ করছে। ওই বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে একটা বাড়ির পর বাদল খাঁ খালুজানের বাসা। তিনতলায়।

এই এলাকায় কত দিনকার কত স্মৃতি আমার!

মসজিদের ঠিক দক্ষিণ দিকটায়, পনেরো-ষোলো হাত চওড়া রাস্তার ওপাশের বাড়িটাই আব্বার পীর সাহেবের। রাস্তার সঙ্গে সরু বারান্দায় সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। তারপর লম্বামতন একটা রুমে সব সময় ফরাশের চাদর বিছানো। হুজুরের মুরিদরা টুপি মাথায় বসে হুজুরের বয়ান শোনেন। কী নুরানি চেহারা হুজুরের! কী সুন্দর করে কথা বলেন! একটু মোটার দিকে শরীর। গায়ের রং ধপধপা সাদা। মুখে চাপদাড়ি, মাথায় সাদা টুপি। পরনে আদ্দির সাদা পাঞ্জাবি আর মেয়েদের সালোয়ারের মতো পায়জামা।

এমন অনেক দিন গেছে পাওনাদারের ভয়ে বাসায় ফিরতে পারেননি আব্বা। হুজুরের এই রুমে ফরাশের ওপর ঘুমিয়ে থেকেছেন। কোনো কোনো দিন শুয়ে থেকেছেন এই মসজিদে। ভোরবেলা আব্বাকে খুঁজতে এসেছি আমি। আব্বা ফজরের নামাজ শেষ করে মসজিদে বসে আছেন আর নয়তো হুজুরের ওই রুমে। মাকে বলা আছে এই দুই জায়গার কোথাও তিনি থাকবেন। আমি এলে যা পারেন দেবেন। সংসারে হয়তো এক সের চাউল কিংবা আটা নেই আমাদের। সবাই না খাওয়া। আমি এসে দেখি আব্বা অসহায় মুখে মসজিদে বসে আছেন। কখনো আছেন হুজুরের বৈঠকখানায়। আমাকে দেখে ময়লা নোংরা শার্ট বা পাঞ্জাবির পকেট থেকে দুটো বা পাঁচটা টাকা বের করে দিলেন। তর মারে নিয়া দিছ বাজান।

তারপর গলিঘুঁজির ভিতর দিয়ে উধাও হয়ে গেলেন আব্বা। আমি ফিরে এলাম হয়তো মুরগিটোলার বাসায়। আফতাব মিয়ার বাড়িতে। নয়তো রজনী চৌধুরী রোডের, ১৪/১এ, রতন ভাইদের বাড়ির টিনের ঘরটায়। আফতাব মিয়ার বাড়ি থেকে ওই বাড়িটাতেই চলে গিয়েছিলাম আমরা।

ডিআইটি প্লটের বাসা থেকেও এই এতটা দূরে ভোররাতে উঠে আব্বাকে খুঁজতে এসেছি আমি। দীননাথ সেন রোডের নর্দমার ধারের বাড়ি থেকে এসেছি। গুমটিঘরের বস্তি থেকে এসেছি।

আব্বার অসহায় মুখ দেখে কী যে মায়া আমার লাগত!

কেন আমার আব্বার ভাগ্য বেলালের আব্বার মতো হয়নি? কেন হামিদুল বা মুকুলের আব্বার মতো হয়নি, মানবেন্দ্র কিংবা বুলুর আব্বার মতো হয়নি? কেন এত কষ্টের জীবন আমার আব্বার?

আমার হঠাৎ আফতাব মিয়ার কথা মনে পড়ল। তাঁকে তো দেখলাম না। খবর পাননি নাকি? একসময় খুবই খাতির তোয়াজ করতেন আব্বাকে। তারপর আমাদের দুঃসময়ে আব্বাকে আর পাত্তা দিতেন না। তিনি এখনো মিউনিসিপ্যালিটিতে কন্ট্রাক্টরি করেন। আব্বা নতুন করে হেড ক্লার্ক হওয়ার পর বিলপত্র ছাড়ানোর জন্য, টেন্ডার দেওয়ার জন্য আব্বাকে তাঁর দরকার পড়ত। আব্বা মারা গেছেন শুনে তিনি আসবেন না?

আমাদের পুরান ঢাকা, সূত্রাপুর গেণ্ডারিয়া লক্ষ্মীবাজার, এসব এলাকায় লোক গিজগিজ করত। এখন লোকজন সেই অর্থে নেই-ই। যে যেভাবে পারে ঢাকা ছেড়ে পালিয়েছে। গ্রামে চলে গেছে হাজার হাজার পরিবার। বর্ডার এলাকার লোকজন গেছে বর্ডার পেরিয়ে। ওপারে নিরাপদ জীবন। উদ্বাস্তু ক্যাম্পেও কষ্টের শেষ নেই। খাবারের টানাটানি, অষুদ পাওয়া যায় না ঠিকমতো। তা হোক। জীবনের নিরাপত্তা আছে। যখন-তখন গুলি করে মারতে পারবে না পাকিস্তানি কুত্তারা! জীবনের নিশ্চয়তা আছে! বেঁচে তো থাকা যাবে!

আমাদের মতো যারা অসহায়, শুধু সেই রকম মানুষগুলোই হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে থেকে গেছে ঢাকায়। যাদের আর কোনো উপায় নেই। যাওয়ার জায়গা নেই। চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে মিলিটারি জিপ, সাক্ষাৎ যমদূত। একটু সন্দেহ হলেই গুলি। কোনো বাছবিচার নেই। ইচ্ছা হলেই গুলি। ইচ্ছা হলেই জিপে তুলে নিয়ে যাওয়া। যাকে নেয়, তাদের দু-চারজন হয়তো বরাত জোরে ফিরে আসে। বাকিরা ফেরে না। কোথায় কোন নদী-খালের ধারে নিয়ে গুলি করে লাশ ফেলে দেয়। গণহত্যা চালিয়ে মাটিচাপা দেয় একসঙ্গে বিশ পঞ্চাশ একশো দুশোজন মানুষ।

দানব।

পিশাচ।

নরপশু।

এই জংলি শূকরদের সঙ্গে আছে এদেশীয় নফরগুলো।

রাজাকার।

আলবদর।

আলসামস।

সেগুলোও পাকিস্তানিদের চেয়ে কম না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। ওগুলোর উত্পাতে মানুষ আরো বেশি অতিষ্ঠ। ঢাকার পাড়া-মহল্লা ভরে গেছে ওই সব নরকের কীটে। পরিচিতদের মধ্যেই কত রাজাকার আলবদর। শান্তি বাহিনীর লোক তারা। পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। শান্তি কোথায় যাবে, টের পাবে দেশ স্বাধীন হলে।

এখনই কম টের পাচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধারা রোজই মিলিটারিদের সঙ্গে সমানে মারছে তাদের চাকরবাকরদের।

তার পরও ঢাকা খালি হয়ে গেছে, এ কথা ঠিক।

কয়েক দিন আগের একটি দিনের কথা মনে পড়ে। দুপুরের পর। তিনটা সোয়া তিনটা হবে। ভাত খেয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে বই পড়ার চেষ্টা করছি। পড়তে ভাল্লাগলো না। কারো সঙ্গে আড্ডা দিতে পারলে ভালো হতো। কোথাও যেতে পারলে ভাল্লাগতো।

কোথায় যাব?

কার কাছে যাব?

বাড়িঅলার ছোট ছেলে আছে অলিদ। আমার বয়সী। তবে একাই আমার পাঁচজনের সমান হবে। ভয়াবহ মোটা। ভারি আমুদে ছেলে। হাসি মজা আনন্দে মেতে আছে সারাক্ষণ।

এ সময় অলিদকে পাওয়া যাবে না। দুপুরের ভাত খেয়ে সে ঘুমায়।

আমাদের এই বাসার দক্ষিণ দিককার দেয়াল ঘেঁষে কবির ভাইদের বাড়ি। তাঁর ছোট ভাই বাবু আমার বন্ধু। বাবুরা কেউ ঢাকায় নেই। কবির ভাই মুক্তিযোদ্ধা। এই বাড়ির দিকে সারাক্ষণ নজর রাখে ইনফরমাররা। স্বস্তিতে ওরা থাকতেই পারছিল না। তারপর হঠাৎ একদিন বাড়ি ফেলে গ্রামে চলে গেছে পুরো পরিবার। বাড়িতে বুড়ো একজন কাজের লোক।

সালামদের দোকানে যাব?

সালামের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আসব?

দিনে দুবার তিনবার যাই সালামের কাছে। বেশিদিনের বন্ধুত্ব না। সালাম আমার চেয়ে বড়। মাস তিনেক হলো ঢাকায় এসেছে। যে সময় লোকে গ্রামে চলে যাচ্ছে, বিশেষ করে যুবক ছেলেরা, সেই সময় সালাম কেন ঢাকায়, সেই রহস্য আমার জানা হয়নি। ওরা সৈয়দপুরের লোক। সৈয়দপুর বিহারি অধ্যুষিত। এ জন্য সালাম খুব ভালো উর্দু জানে। হয়তো বিহারিদের উত্পাতেই ঢাকায় চলে এসেছে। ঢাকায় এসে ভাইয়ের কাছে দর্জি কাজ শিখছে। আমি ঘন ঘন যাই। ওর বড় ভাইটা তেমন কিছু বলে না, তবে বিরক্ত যে হয় বুঝতে পারি। আমি গেলেই বেরিয়ে আসে সালাম। কাজ শেখা ফেলে আমার সঙ্গে বাগিচার দিকে যায়। নানা গল্প করে।

না, সালামের ওখানে এখন যাব না। মুরগিটোলায় যাই। আলীদের বাসায়। আলীর সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয় না।

তার পরই মনে পড়ে, গিয়ে লাভ নেই। আলীরা ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে দাউদকান্দিতে। ওদের গ্রামের বাড়িতে। ঢাকায় আছে শুধু ওর বাবা।

তাহলে কি বানিয়ানগর যাব? হামিদুলদের বাসায়। হামিদুলের সঙ্গে একটু সময় কাটিয়ে আসি। হামিদুল নিশ্চয় চা খাওয়াবে। আট আনা এক টাকা ওর পকেটে থাকেই।

ছোট রুম থেকে বেরিয়ে বড় রুমের বারান্দায় এলাম। বারান্দায় খোকন আর আসমা ভাঙাচোরা পুরানা দুটো খেলনা নিয়ে খেলছে। দুজনেই চুপচাপ খেলা করছে। কোনো শব্দ নেই।

এইটুকু বাচ্চারাও দেশের এই পরিস্থিতিতে কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে।

চৌকিতে মা আম্মা মণি তিনজনেই একটু কাত হয়েছে। বাদল পলি ডলি রিনা মুকুল উষা মেঝেতে শুয়ে আছে। কোথায় যাচ্ছি—এ কথা জিজ্ঞেস করার কেউ নেই।

বাড়িঅলাদের গেট দিয়ে বেরিয়ে দেখি রাস্তায় কেউ নেই। না কোনো রিকশা, না কোনো লোক।

উত্তর দিকে হাঁটতে লাগলাম।

পাড়ার বাড়িগুলো নিঝুম হয়ে আছে। দিনের বেলা না, যেন এখন গভীর রাত, এমন চুপচাপ চারদিক। ধূপখোলা মাঠের কোনা পর্যন্ত হেঁটে এলাম, একজন লোকও চোখে পড়ল না।

আশ্চর্য ব্যাপার! এমন নীরব নিঝুম হয়ে গেছে এই এলাকা!

ধূপখোলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে দাঁড়িয়ে, মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখি মানুষ তো দূরের কথা, একটা কাক শালিকও নেই। বিশাল সবুজ ধূপখোলা মাঠ, ওদিকটায় তিন-চারটা ন্যাড়া শিমুলগাছ রোদ ভরা আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। হাওয়ার শব্দও নেই। এমন নৈঃশব্দ্য আমি আমার পনেরো ষোলো বছরের জীবনে কখনো দেখিনি। খাঁ খাঁ নির্জন ধূপখোলা মাঠ যেন ধূপখোলা মাঠ না, এ যেন রূপকথার তেপান্তরের মাঠ। আশপাশের দোকানপাট সব বন্ধ। একি অবস্থা!

সব মিলিয়ে আমি হয়তো মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপর কেমন ভয় করে উঠল, গা কাঁটা দিল। দ্রুত পা চালিয়ে আমি বাসায় ফিরে এলাম।

আব্বার জানাজা পড়ালেন তাঁর পীর সাহেব। জানাজা শেষ করে ধীরপায়ে চলে গেলেন তাঁর বাড়িতে। আব্বার খাট আবার উঠল আটজন মানুষের কাঁধে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্্…

কাঠেরপুলের পুবপারে দাঁড়িয়ে আছে ট্রাক। সেই ট্রাকে তোলা হলো খাট। তারপর একে একে উঠল সবাই। খোকনকে তুলে দিল হামিদুল, আমাকে উঠতে সাহায্য করল। ট্রাকে বসে আমি প্রথমে তাকালাম হাতের বাঁ দিকে, তেল মিলের দেয়ালের দিকে, তারপর তাকালাম ডান দিকে, বটগাছটার তলায়। টংঘরের দোকানটা এখনো আছে। পান বিড়ি সিগ্রেটের দোকান। মোটামতন ঢাকাইয়া এক মহিলা চালায়। দোকানটা এখন বন্ধ।

এই দোকানের সামনে আব্বাকে খুবই অপমান করেছিল ভাট্টিখানার সেলিম গুণ্ডা। বছর চারেক আগের ঘটনা।

সেই ঘটনার কথা ভেবে আমার বুকটা হু হু করে উঠল। চোখ ফেটে নামল কান্না।

চাকরি চলে যাওয়ার পর এতগুলো ছেলে-মেয়ে নিয়ে দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলেন আব্বা। আটষট্টি সালের মাঝামাঝি সময়। হাতে টাকা-পয়সা কোনো দিনও থাকত না। যা রোজগার করতেন সবই খরচ হয়ে যেত। বেতনের টাকায় হতো না বলে টুকটাক অনেক ধরনের কাজ করতেন। ইসলামপুরের বোম্বাইয়া কাপড়ের ব্যবসায়ীদের খাতা দেখার কাজ, মিউনিসিপ্যালিটিতে বিভিন্ন লাইসেন্স করে দেওয়ার কাজ, নানা রকম দরখাস্ত লিখে দেওয়ার কাজ। হাতের লেখা মুক্তার মতো। ড্রাফট করতেন অসাধারণ। এসব কাজে তাঁর একটা পরিচিতি ছিল। এসব করে কিছু বাড়তি টাকা তিনি রোজগার করতেন।

চাকরি চলে যাওয়ার পরও এই কাজগুলো আব্বার ছিল। ওতে কি আর সংসার চলে!

আব্বা ধার করতেন। পরিচিতজনদের কাছ থেকে তো করতেনই, সামান্য পরিচিত, অপরিচিত এমন লোকজনের কাছ থেকেও করতেন। অপরিচিত লোকগুলো ছিল সুদের কারবারি। সাদা কাগজে ‘হ্যান্ডনোট’ লিখে টাকা নিতে হতো। কবে শোধ করবেন, কিভাবে শোধ করবেন তার একটা ফিরিস্তি লেখা থাকত। লেখা থাকত ঠিকই কিন্তু আব্বা কি জানতেন কবে কিভাবে এইসব ঋণ শোধ হবে?

তবে আব্বা খুব আশাবাদী মানুষ। ধৈর্যশীল মানুষ। আশায় আশায় থাকতেন। চাকরি যাওয়ার কারণ তেমন কঠিন কিছু না। বলতে গেলে তুচ্ছ কারণে বা অকারণেই গেছে তাঁর চাকরি। তাঁর ওপর অবিচার করা হয়েছে। কোথায় যেন লিখিত আবেদনও জানিয়েছেন। আপিল করেছেন। চাকরি তিনি ফিরে পাবেনই। এই আশায় থাকতেন আর টাকা ধার করতেন। প্রতিদিনই মা আর আমরা, আব্বা বাসায় ফিরলেই জিজ্ঞেস করতাম, কত দূর কী হলো?

আব্বা আমাদের সান্ত্বনা দিতেন, আল্লাহ আল্লাহ করো। আল্লায় রহম করবো।

রোজই এক কথা শুনে মা খুবই বিরক্ত হতেন, হতাশ হতেন। আমাদের মুখ শুকিয়ে যেত। কোথাও কোনো আশার আলো আমরা দেখতে পেতাম না।

ভাট্টিখানার ওদিককার এক লোকের কাছ থেকে আটশো টাকা ধার নিয়েছিলেন আব্বা। ও রকম সাদা কাগজে ‘হ্যান্ডনোট’ লিখে। সেই টাকা আর দিতে পারেন না। কোত্থেকে দেবেন? কেমন করে দেবেন? সংসারে খাওয়া-পরাই চলে না। ধার শোধ করবেন কী করে?

সেই লোক প্রায়ই বাসায় এসে ধমকাধমকি করে। গালাগাল করে। আব্বা নানা রকমভাবে তাকে সামলান। সামনের মাসে দিয়া দিমু ভাই। আর কয়ডা দিন সবুর করেন…

আব্বা বাসায় না থাকলে আমরা একথা ওকথা বলে তাকে বিদায় করি।

এই লোক শেষ পর্যন্ত সেলিম গুণ্ডাকে ঠিক করল। সেলিম গুণ্ডা ঢাকাইয়া কুট্টি। ভাট্টিখানায়ই বাড়ি। তার ছোট ভাই গেণ্ডারিয়া হাই স্কুলে আমার সঙ্গে পড়ে। ইব্রাহিম নাম। মুখ চিনি কিন্তু কোনো ভাব নেই, বন্ধুত্ব নেই। ইব্রাহিমের বন্ধুরাও আমার বন্ধু না।

সেলিম গুণ্ডা টাকার বিনিময়ে কাজ করত। কেউ কারো পাওনা টাকা দিচ্ছে না, সেলিমের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করল, তোমাকে এত টাকা দেব, কাজটা করে দাও। সেলিম কাজে লেগে গেল।

কোনো বাড়িঅলা হয়তো বলত, আমার ভাড়াটে ভাড়াও দেয় না, বাসাও ছাড়ে না। ভাড়া আদায় করে তাকে তুলে দিতে হবে। দোকান খালি করতে হবে, দখল করা বাড়ি উদ্ধার করতে হবে, এ রকম সব কাজ করত সেলিম।

আব্বার কাছ থেকে টাকা আদায়ের দায়িত্বও নিয়েছিল।

আমার আব্বা নরম নিরীহ অসহায় মানুষ। সেলিম বাসায় আসছে দেখে খুবই ভয় পেয়েছিলেন। কয়েকবার তাকে অনুনয়-বিনয় করে সামাল দিলেন। একটা পর্যায়ে আর পারছিলেন না। সেলিমের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকতেন।

আব্বার সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও অসহায়ত্বের সীমা নেই।

সেলিম আড্ডা দিত ওই বটগাছটার তলায়, টংঘরের দোকানটায়। দোকানের মোটা মহিলাটাও ঢাকাইয়া। ভাট্টিখানায়ই থাকে। সেলিম ওই দোকানে বসে ফুকফুক করে সিগ্রেট টানত। সেলিমের ভয়ে ওই রাস্তায় আব্বা সাবধানে চলতেন। যখন ওই দোকানে সেলিমের থাকার সম্ভাবনা, সময়টা আব্বা এড়িয়ে চলতেন। সকাল দশটা এগারোটা বা বিকাল সন্ধ্যা।

একদিন ফজরের নামাজ পড়তে কলুটোলা মসজিদে গেছেন আব্বা। নামাজ শেষ করে পীর সাহেবের ওই রুমে বসে বয়ান শুনেছেন। বয়ান শেষে রোজই হুজুরকে বলেন তাঁর জন্য, তাঁর সংসার ছেলে-মেয়েদের জন্য দোয়া করতে। যে বিপদে তিনি আছেন এই বিপদ যেন কেটে যায়। আল্লাহপাক যেন রহম করেন।

হুজুর খুবই ভালোবাসেন আব্বাকে। তিনি প্রাণ খুলে দোয়া করতেন।

সেদিন হুজুরের ওখান থেকে ফিরতে আটটা সাড়ে আটটা বেজে গেছে। আব্বা যে ফজরের নামাজ পড়তে কলুটোলার মসজিদে যান, হুজুরের কাছে যান, সেলিম এটা জেনে গিয়েছিল। সেদিন সকালবেলাই আব্বাকে ধরার জন্য টংঘরের দোকানে এসে বসে আছে। আব্বা ওদিক দিয়ে পা চালিয়ে ফিরছিলেন। পরনে লুঙ্গি আর পুরানা সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি।

সেলিম আব্বাকে ধরল…

কেমন কেমন করে সেই খবর এলো আমাদের বাসায়। মুরগিটোলায় আমার বন্ধু আলী। আমাদের দেয়ালের পরই ওদের ঘর। আমি পড়ি ক্লাস এইটে। আলীও আমার সঙ্গেই পড়ে। ক্লাসের সব বই আমি কিনতে পারিনি। কোনো কোনোটা আলীর কাছ থেকে এনে পড়ি।

সেই সকালে আমি গিয়েছিলাম আলীর কাছে বই আনতে। বাসায় ফিরে শুনলাম আব্বাকে ওই দোকানে আটকে রেখেছে সেলিম গুণ্ডা। ডলি হচ্ছে আব্বার জন্য পাগল। বছর আটেক তার বয়স। কথাটা শুনেই সে পাগলের মতো দৌড়ে চলে গেছে আব্বার কাছে। আমি শুনে আমিও দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি আব্বা অসহায় ভঙ্গিতে, বিপর্যস্ত মুখে বসে আছেন ওই দোকানে। মোটা মহিলা পান বানিয়ে বানিয়ে রাখছে বিক্রির জন্য। সেলিম গুণ্ডা দোকানের সামনে পায়চারি করছে। টাকা না পেলে আব্বাকে ছাড়বে না। ডলি আব্বার হাত ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আমাকে দেখে বলল, আব্বারে ঘুষি মারছে…

মোটা মহিলাটি সহানুভূতির গলায় ফিসফিস করে বলল, তিন চাইরহান ঘুসসি ব্যাডারে মারছে। টুপিহান মাইত্তে পইড়া গেছিল…

আব্বা মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। আমাকে দেখে কাতর একটা শব্দ করে বললেন, আবতাব মিয়ারে ইকটু ডাইক্কা লইয়ায় বাজান।

আমি দৌড়ে গিয়ে আফতাব মিয়াকে ডেকে এনেছিলাম। সব শুনে সে আসতে চায়নি। খুবই বিরক্ত হয়েছিল। অথচ এই লোক একসময় আব্বার জুতা মুছে দিতেও তৈরি ছিল।

আফতাব মিয়া এসে সেলিমের সঙ্গে কী কী কথা বলে আব্বাকে ছাড়িয়ে নিল। দু-তিন দিন পর মা দেশে গিয়ে জমি বিক্রি করে কিছু টাকা আনলেন, সেলিম গুণ্ডাকে নিয়ে এসে পাওনা টাকা বুঝে নিয়ে গেল সেই লোক।

আব্বার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা আমার মনে হচ্ছে।

জুরাইন কবরস্থানের মাঝখান দিয়ে পুবে পশ্চিমে গেছে রাস্তা। দক্ষিণ দিককার কবরস্থানে জমি কিনে দাফন করতে হয়। উত্তর দিককারটায় জমি না কেনা মানুষের কবর হয়। বুজির কবর এদিকটায়। আব্বার কবরও এদিকটায়ই হচ্ছে।

এদিককার কবরস্থানে ঢুকে বিশ ত্রিশ কদম এগোলে, পশ্চিম দিকটায় একটা আমগাছ। সেই গাছের তলায় কবর খোঁড়া হয়েছে। লোকজন তৈরি। ট্রাক থেকে আব্বার লাশ নামিয়ে আনা হয়েছে। খোঁড়া কবরের পাশে রাখা হয়েছে খাট। কবরের ভিতরকার বাঁশ চাটাইয়ের কাজ করছে কবরস্থানের মধ্যবয়সী একটা লোক। তার কালো তাগড়া শরীর ঘামে ভেজা, লুঙ্গি কাছা মারা, মুখটা নির্বিকার। চারদিককার কবরের ওপর খাঁ খাঁ রোদ। একটা কাক ডাকছে আমগাছের ডালে বসে। আমার আর হামিদুলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট খোকন। বিস্কিট রঙের হাফপ্যান্ট আর চেকশার্ট পরা। মাথায় ছোট্ট টুপি। বোধ হয় কবরস্থানের গাছ থেকেই কয়েকটা গন্ধরাজ ফুল তাকে ছিঁড়ে দিয়েছে হামিদুল। দুহাতে ফুলগুলো বুকের কাছে ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। আব্বার কবরে ছড়িয়ে দেবে।

আব্বার কবরে নামলেন দাদা আর লন্ড্রিকাকা। আব্বাকে নামানো হলো কবরে। বাঁশ চাটাইয়ের ওপর আর আব্বার শরীরের ওপর পড়তে লাগল মাটি। চারপাশের সবাই দুহাতে ভুর করে রাখা কাঁচা মাটি তুলে ফেলতে লাগল আব্বার কবরে। আমিও ফেলছিলাম। মাটি ফেলতে ফেলতে কাঁদতে কাঁদতে আমার শুধু মনে হচ্ছিল আব্বার মায়াবী মুখখানি এই জীবনে আর কখনো দেখব না আমি। আব্বা চিরকালের জন্য চলে গেলেন চোখের আড়ালে।