বুবনা

বুবনার ভক্তরা, বলতে গেলে প্রায় সবাই বলল, ছি! পৃথিবীতে পুরুষ মানুষের এতই অভাব- বুবনা আর পুরুষ খুঁজে পেল না!

দু’একজন বলল, মনে হয় মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
দু’একজন বলল, তাবিজ-কবচও করতে পারে। ব্ল্যাক ম্যাজিক তো আর মিথ্যে কিছু নয়। চেহারা বোকাটে ধরনের হলেও মানুষটা ভারি ধুরন্ধর। এমন একটা মেয়েকে বাগাতে পারলে আর চাই কী! তার টাকায় বাকি জীবন পায়ের ওপর পা তুলে কাটিয়ে দেয়া যাবে।
অবশ্য বুবনা ফ্যান ক্লাবের একজন লিখেছে, লোকটার মধ্যে নিশ্চয়ই একটা ভালো কিছু বুবনা আবিষ্কার করেছে যা অন্য কোনো পুরুষের মধ্যে পায়নি। তাই, আমার মনে হয়, বুবনা ঠিকই করেছে।
বুবনার ছেলে ভক্তদের কেউ কেউ বলেছে, স্টান্ট। এটা বুবনার স্টান্টবাজি। শোবিজে স্টান্টবাজি দোষের নয়, বরং বাজার পড়ে গেলে খুব কাজে লাগে। মেরিলিন মনরো, লিজ টেলর, কিম কার্দাশিয়ান, লেডি গাগা এমন কি সানি লিওন- সবাই স্টান্ট মেরে কাগজের কাভার স্টোরি হচ্ছে। মিডিয়াতে টিকে থাকতে হলে মিডিয়াকে খাওয়াতে হবে। হায়েনার প্রিয় খাবার যেমন নিজের বমি, মিডিয়ার প্রিয় খাবারও বমনোদ্রেককর সংবাদ।
তাদের কেউ বলল, জাস্ট ওয়েট। ক’দিন টেকে দেখ।
এ কথাটা আমিও বলেছি, টিকবে না।
ধ্যাৎ বাজে কথা বলোনা, বুবনা এই জবাবই দিয়েছে।
আমি বলেছি, প্লিজ বুবনা, ভেবে দেখ। এটা টিকে থাকার কথা নয়।
বেস্ট চয়েস বিউটি কনটেস্টের পরপরই বুবনার বাজার যখন খুব গরম আবদুল টাইপের একজনকে বিয়ে করে ফেলায় খবরটা অনেকটা বিশ্ব সংবাদ হয়ে পড়ে।
বেস্ট চয়েস গ্রুপ ও কিউ ফিল্মস প্রডিউসার্স অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউটার্সের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সুন্দরী প্রতিযোগিতায় সোনার মুকুট মিস করে রুপার মুকুট মাথায় তুলে নেয়ায় বুবনার গুণমুগ্ধরা এমনিতে মনমরা হয়ে পড়েছিল। তারা মনে করে কিউ ফিল্মসের কদাকার মালিক কুদরত মল্লিকের প্রভাব সুন্দরী নির্বাচনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। বিচারকমণ্ডলীর তিন সদস্যের দু’জন তার কাছ থেকে মূল্যবান উপহার এবং …. প্রাথমিক বাছাইয়ে বাদ পড়া দু’জন সুন্দরী কবুল করে তারই ইশারায় শুরু থেকেই পিউ নামের ঠোঁটবাঁকা মেয়েটিকে বেশি বেশি নম্বর দিয়ে বেস্ট ফাইভে নিয়ে আসেন। তৃতীয় সদস্য ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করলে বেস্ট চয়েস গ্রুপের ডিরেক্টর পাবলিক রিলেশন্স লালরুখ গণিকে তার শূন্যপদে বসিয়ে পিউর এগিয়ে যাওয়াটা আরও সহজ করে দেয়া হয়।
লালারুখ অনেক বছর আগে এই গ্রুপের কর্পোরেট হেডকোয়ার্টার্সের রিসেপশনিস্ট হিসেবে কাজে যোগ দিলেও কুদরত মল্লিকের সানুগ্রহ ছোঁয়া তাকে দ্রুত উপরে ওঠার সিঁড়ি ভাঙতে সাহায্য করে। এক সময় মালিকের অন্য নারী-প্রীতি তাকে বিচলিত করত, এখন আর করে না। তাছাড়া তিনি তো তাকে বঞ্চিত করেননি। অনেক দিয়েছেন, অনেক ওপরে উঠিয়েছেন।
বুবনার ভক্তরা এটা মেনে নেয়নি। প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছে। ছোট একটি সংবাদ সম্মেলন করে বুবনাকে অপমানজনক রৌপ্য পদক প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানিয়েছে, … প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, এমনকি বহু বছর আগেরকার রিসেপশনিস্ট কেমন করে বিচারকের আসনে বসে তারও জবাব চেয়েছে। কিউ ফিল্মসের মালিক কুদরতও এক সময় ফুটপাতে ঘটিগরম চানাচুর বিক্রি করতেন, সে কথাও তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছে।
বুবনা ফ্যান পেজে পিউ ও কুদরত মল্লিকের বেঢপ যুগল ছবি পোস্ট করে ছবির নিচে লিখেছে : বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট। শালীন বাংলায় পিউকে বলেছে, দেহপশারিনী।
… প্রতিবাদে ফ্যান ক্লাবের আহ্বায়ক সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর মাধ্যমে বুবনার ভক্তদের কালো পোশাক পরে প্রেস ক্লাবের সামনে জমায়েত হতে বলেছে। কালোতে সয়লাব প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তা এক ঘণ্টার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রতিবাদী জমায়েত যথেষ্ট মিডিয়া কাভারেজ পেয়েছে। এমনকি একটি বিদেশি টেলিভিশনের রিপোর্টার ফটোগ্রাফারও সাগ্রহে সমাবেশের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। তারা কাঁচা ইংরেজিতে বলে, পিউ নট বিউটিফুল। একচুয়াল বিউটি নেইম ইউ নো বুবনা।
ঠিক তখনই ভক্তরা স্লোগান দিতে থাকে, বুবনা বুবনা উইনার উইনার। … মানব না, মানব না।
চূড়ান্ত বিবেচনায় স্বর্ণমুকুট পেয়ে পিউ যতটা না আলোচনায় এসেছে, না পেয়ে বুবনা এসেছে এর অন্তত দশ গুণ।
প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার কুড়ি দিনের মাথায় বেস্ট চয়েস গ্র“প এবং কিউ ফিল্মসের পার্টনারশিপে ভেঙে যায়। বেস্ট চয়েসের কর্পোরেট অফিস থেকে উপমহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) একটি প্রেস রিলিজ দিয়ে জানিয়েছেন :
‘সুন্দরী প্রতিযোগিতার সকল খরচ কিউ ফিল্মসের চাহিদা অনুযায়ী প্রদান করার পরও বেস্ট চয়েস কোম্পানির প্রোডাক্ট অনুষ্ঠান চলাকালে টিভির স্ক্রিনে খুব কমই দেখানো হয়েছে। ক্যামেরা ব্যস্ত রাখা হয়েছে কিউ ফিল্মসের বিসদৃশ মালিককে কারণে-অকারণে স্ক্রিনে আনার কাজে। জানা যায় বিচারকের বিচারকাজে হস্তক্ষেপ করার কারণে একজন বিচারক পদত্যাগ করেছেন। শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর মুকুট স্পনসর কোম্পানি প্রধানের পরানোর কথা থাকলেও তাকে কনুইয়ের ধাক্কায় দূরে ঠেলে কিউ ফিল্মসের মালিক নিজেই তা করেছেন। এ অবস্থায়, পুরস্কারটি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায়, কিউ টিভি কর্তৃপক্ষ চুক্তি পরিপন্থী কাজ করায় এবং অরুচিকরভাবে সামান্য অজুহাতে কেবল একজন ব্যক্তির প্রচারণা চালিয়ে প্রতিযোগিতার মান ক্ষুণœ করায় কিউ ফিল্মসের সঙ্গে পার্টনারশিপ থেকে বেস্ট চয়েস গ্র“প নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে। অতঃপর সুন্দরী প্রতিযোগিতা-সংক্রান্ত কোনো ধরনের দায়দায়িত্ব বেস্ট চয়েস গ্র“প গ্রহণ করবে না। তারপরও যদি কেউ এতদসংক্রান্ত বিষয়ে কিউ ফিল্মসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান, অবশ্যই নিজ দায়িত্বে করবেন।’
এ বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পরদিনই পদত্যাগকারী বিচারকের একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতিও ছাপা হয়। তিনি বলেন, বেস্ট চয়েস গ্র“প সুন্দরী প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করা প্রসঙ্গে যে বক্তব্য প্রদান করেছে তাতে বিচারক হিসেবে আমার পদত্যাগ করার প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়েছে। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমার বিচারকাজে কেউ হস্তক্ষেপ করেনি, তবে কর্তৃপক্ষের সুন্দরী-নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি আমার কাছে অরুচিকর ও নারীর সম্ভ্রমের পরিপন্থী মনে হওয়ায় আমি পদত্যাগ করেছি এবং আগাম গৃহীত সব পারিশ্রমিকও ফেরত দিয়েছি। এতদসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে আমাকে না জড়ানোর জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।’

পরপর দু’দিন খবরের কাগজে ও অন-লাইন পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি বিবৃতি বুবনার শ্রেষ্ঠত্বের দাবি আরও প্রতিষ্ঠিত করে।
আরও দু’দিন পর কিউ ফিল্মসের আইনজীবী বেস্ট চয়েস গ্র“পকে উকিল নোটিশ পাঠায়। তাতে উল্লেখ করা হয় উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিউ ফিল্মসের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার দায়ে কেন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না দু’সপ্তাহের মধ্যে তার কারণ দর্শাতে হবে নতুবা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার ক্ষতিপূরণ বাবদ পঁচিশ কোটি টাকা আদায়ের মামলা করা হবে। আরও উল্লেখ করা হয় বেস্ট চয়েসের স্পনসরশিপের শেষ ইনস্টলমেন্টের টাকা এখনও পরিশোধ না করায় চুক্তি ভঙ্গের মামলাও দায়ের করা হবে।
বেস্ট চয়েস গ্রুপ নোটিশ পাওয়ার পর সত্যিই চুক্তি ভঙ্গ করে স্বর্ণমুকুট বিজয়ী পিউকে পাশ কাটিয়ে বুবনাকে নিয়ে বিশাল প্রেস কনফারেন্স করে তাকেই বেস্ট চয়েস পণ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর নিয়োগ করা হল। উকিল নোটিশের জবাব তিনি এভাবেই দিতে চান। পিউ নয় বুবনাই হবে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।
চেয়ারম্যান বললেন, কুদরত মল্লিক মূলত একজন ছোটলোক।
এমডি বললেন, চিন্তা করো না বাবা,…।
বাবাকে ছেলের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়। তিনি বললেন, আমি আর ক’দিন আছি। তোরা যা ভালো মনে করিস তাই কর। তবে সাবধানে পা ফেলিস। কুদরত মল্লিক টাকা-পয়সা হওয়ার পর নিজের বাপকেও বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। শেষদিকে লোকটার মাথা কিছুটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল শুনেছি। বেঁচে আছে কি না জানি না।
সোনার মুকুটধারী পিউ সেলিব্রেটি হয়ে উঠতে পারল না, রূপার মুকুট নিয়ে গণমাধ্যম মাতিয়ে দিল বুবনা। সঙ্গে এলো নগদ পাঁচ লাখ টাকা। বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস তার ওয়ারড্রব ভরে দিয়েছে। ক’জন জুয়েলার্সও এগিয়ে এসেছে। এখন তার জুতো আর স্যান্ডেলের ছড়াছড়ি।
অর্থ, বিত্ত আর প্রতিপত্তির ব্যাপারটা এমনই। যখন আসে প্লাবনের মতো আসে, ঘড়বাড়ি সব ভাসিয়ে দেয়।
রাস্তার পাশে বিজ্ঞাপনে বুবনার ওই অতিকায় ছবি থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে মন চায় না। বেস্ট চয়েস গ্রুপের একটি অন্যতম প্রধান পণ্য বেস্ট চয়েস স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপনে জিন্স আর কমলা রং টি-শার্ট পরা বুবনা মিষ্টি হেসে বলছে: …।
বুবনা পায় আরও দশ লাখ।
জমকালো একটি অনুষ্ঠানে বুবনার সঙ্গে বেস্ট চয়েস গ্র“প চুক্তি সম্পাদন করে। বেস্ট চয়েসের পক্ষে এমডি চুক্তি সই করেন। ক্যামেরার হঠাৎ আলোর অসংখ্য ঝলকানি আর বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে সই করা চুক্তিনামা বিনিময় হয়।
কোম্পানির পুরনো কর্মচারীদের কেউ কেউ বলল, এভাবে পয়সা নষ্ট করার মানে আছে? ক’দিন আগেই তো প্রেস কনফারেনসে করে এ মেয়েটিকে কিসের যেন অ্যাম্বাসেডর ঘোষণা করেছে।
কোম্পানির তরুণ কর্মচারীরা বলল, গ্রেট! এর নাম ব্র্যান্ডিং। স্যার ব্যবসা বোঝেন। প্রেস কনফারেন্সটাই ছিল একটা ব্রেকিং নিউজ। আর এটা তো গ্র্যান্ড সিরিমনি।

চুক্তি অনুযায়ী বুবনা পুরো এক বছর বেস্ট চয়েসের পণ্য ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানির পণ্য প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবে না। এ ক্ষতি পুষিয়ে দিতে প্রতিমাসে তাকে আড়াই লাখ টাকা করে মাসোহারা দেয়া হবে। কর্পোরেট হেডকোয়ার্টারে মার্কেট প্রমোশন বিভাগে তার একটি অফিস কক্ষও থাকবে। বেস্ট চয়েস সেনেটারি ন্যাপকিন ছাড়া কোম্পানির অন্য যে কোনো প্রোডাক্ট বাজারজাত করতে কিংবা স্বল্প চাহিদার কোনো প্রোডাক্টের নতুন কোনো ব্র্যান্ডিংয়ে বুবনা অংশগ্রহণ করলে নতুন করে চুক্তি হবে এবং চুক্তিমাফিক আলাদা পারিশ্রমিক পাবে।
রাস্তার পাশে অতিকায় এক বিলবোর্ডে হাফ প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে স্কিপিং করছে বুবনা। তার মুখের কাছে একটি বড় বুদ্বুদের ভেতর লিখা আছে : কই আমার তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
বুবনা এমনিতে অভাবী ঘরের মেয়ে নয়। প্রয়োজন মেটানোর মতো সঙ্গতি বরাবরই ছিল। এখন সচ্ছলতা আসছে।
খরচ বেড়েছে সত্যি, কিন্তু তা মিটিয়েও হাতে যা থাকছে তাও ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। বুদ্ধিটা নিজেরই। লেকঘেঁষা প্রায় সমাপ্ত একটি ভবনের পাঁচতলায় ১৪৫০ বর্গফুট ফ্লোর স্পেসের একটি অ্যাপার্টমেন্ট বুক করে ছ’মাসের মধ্যেই সব টাকা শোধ করে দেয়। ব্যাংক থেকে কিছু ঋণ নিতে হয়েছে। ঋণ পেতে ঘুষ লাগেনি, ভোগান্তিও হয়নি। বরং বুবনা যে ঋণের চেক গ্রহণ করছে, ব্যাংক এটাকেই একটা উৎসবে পরিণত করেছে। টেলিভিশন আর খবরের কাগজের ক্যামেরাম্যান ও রিপোর্টার ডেকে ভি. হাউজিং ফিন্যান্স কোম্পানি চমৎকার একটি কাভারেজ করিয়ে দিল।
ব্যাংক যে বুবনার মতো একজন সেলেব্রিটিকে গৃহনির্মাণ ঋণ দিতে পেরেছে, বোর্ড তাতেই খুশি। ব্যাংকের বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়ার আমন্ত্রণ বেস্ট চয়েসের সঙ্গে চুক্তি বহাল থাকার কারণে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ব্যাংকের ম্যানেজার পাবলিক রিলেশন্স আরও একধাপ এগিয়ে বলেছে, কোম্পানির একটি অংশ ডেভেলপার হিসেবেও কাজ করে। ম্যাডাম যদি রাজি থাকেন ভি. গ্র“পই আপনাকে চমৎকার একটা রেডি ফ্ল্যাট দিতে পারে। আমরা শুরু থেকেই আপনার ওপর চোখ রাখছিলাম। আমরা নিশ্চিত ছিলাম সোনার মুকুট আপনিই পাবেন। কিউ ফিল্মস এমন অবিচার করবে, আমরা ভাবিনি। ম্যাডাম, আপনি দেখবেন বুবনা ফ্যান পেইজে তপু নামের একজন লিখেছেন : …। এই তপু হচ্ছে আমাদের সিইও। যদি আমাদের জন্য কিছু বিজ্ঞাপন করে দেন কোম্পানি নিশ্চই একটা রেডি ফ্ল্যাট অফার করবে। ভি. গ্রুপের সুনাম সবার মুখে মুখে।
ববুনা জানিয়ে দেন, এখন সম্ভব নয়। বেস্ট চয়েসের সঙ্গে এক বছরের চুক্তির মাত্র আড়াই মাস কেটেছে। পরে দেখা যাবে।
বুবনা হিসাব করল বেস্ট চয়েসের সঙ্গে লেগে থাকলেও গৃহ ঋণের ইনস্টলমেন্ট শোধ করতে বেশি সময় লাগবে না।
রানার্স আপ হলেও এই প্রতিযোগিতা তাকে দিয়েছে একটি বিগ ব্রেক। স্পট লাইট যখন তারই ওপর- এমন সময় বুবনা হুট করে একজন আবদুলকে কবুল করে ফেলল।
যখন প্রতিযোগিতা চলছে শর্ট লিস্টিংয়ের পর একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বুবনা বলেছে, কখনও মনের মানুষ পেলে তাকে বিয়ে করব। কিন্তু এ জীবনে সে মানুষের দেখা পাব কিনা কে জানে। যদি পাই আপনাদের নিশ্চয়ই জানাব।
বুবনা যে পথ দিয়ে হেঁটে গেছে সে পথেই ছড়িয়ে গেছে সকালবেলার ঝরা বকুলের সুগন্ধ। কিংবা ব্যাপারটা এমনও হতে পারে যে পথে ভোরের বকুলের সুবাস ছড়ানো বুবনা কেবল সে পথেই পা বাড়িয়েছে।
ইচ্ছা করেই হোক কি অনিচ্ছায় বুবনা হঠাৎ কোনো যুবকের চোখের দিকে এক মুহূর্তের জন্য তাকালেও অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে যুবকের রক্ত সঞ্চালন, অনড় মূর্তি হয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে সেই পুরুষ। ফ্রিজড হয়ে গেছে তার উপচে পড়া চাপল্য।
বুবনা জেনেশুনে যাদের এবং অজ্ঞাতসারে যাদের মুগ্ধ করে রেখেছিল তাদের সংখ্যা হাজার না লক্ষ কে জানে। তার আঁচলের হাওয়া অনেক অন্তরে দোল দিয়েছে। যারা প্রকাশ্যে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে এবং যারা অন্তরে তাকে বিয়ের বাসনা লালন করেছে তাদের যে দীর্ঘ কিউ, আমি কেবল তার সামনের অংশটুকু দেখেছি। পেছন দিকটা যে কোথায় শেষ হয়েছে আমার জানা নেই।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের অধিকাংশের স্বামীই রূপবান নয়, কেউ কেউ বরং কুৎসিত- এটা নিশ্চয়ই সুন্দরীদের স্বামীরা অস্বীকার করবে না। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে এমনই একজনকে বিয়ে করে অনস্বীকার্য এই সত্যটিকে বুবনা আরও প্রতিষ্ঠিত করে ছাড়ল।
বুবনার বিয়ের খবরটা সংকটকালের বিশ্ব সংবাদের মতোই চারদিক ছড়িয়ে পড়ল। জনে জনে তখন হাজার প্রশ্ন।
কে? কাকে? ওহ মাই গড! আর কেউ ছিল না?
বুবনাকে যারা চেনে তাদের মধ্যে একজন ছাড়া আর সবাই দীর্ঘশ্বাস ছেড় বলেছে, ছি, এর চেয়ে সুইসাইড করা ভালো ছিল।
আমি দেখেছি, বুবনার কাছাকাছি অন্যরাও দেখেছে তাকে পাওয়ার জন্য দীর্ঘ কিউর সামনে ছিল হার্টথ্রোব নায়ক, সদ্য পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে আসা তরুণ বিজ্ঞানী, আইটি স্পেশালিস্ট …
বুবনা তখনই সিদ্ধান্ত নিল। এসব সুদর্শন ও চৌকশ পাত্রের সবাইকেই প্রত্যাখ্যান করে জনৈক আবদুলকে বিয়ে করে ফেলল।
বুবনাকে যারা জানে তারা ভাবতে বাধ্য হল গ্রাম থেকে মাথায় সর্ষের তেল মেখে ঢাকা শহরে আসা এক বিদঘুটে যুবক …
সহ্য করতে না পেরে এক সময় বলল, এটা বুবনার পার্সোনাল ব্যাপার। আমরা কেন মাথা ঘামাতে যাচ্ছি। যেমন কর্ম তেমন ফল। পরে টের পাবে। প্রতারণা করে বুবনার টাকা-পয়সা হাতিয়ে এক সময় কেটে পড়বে।
সেলিব্রেটি হওয়ার আগে থেকেই সৌন্দর্য, মেধা ও অমায়িক আচরণের জন্য বুবনা ইউনিভার্সিটির কলাভবনে মিস থার্ড ইয়ার নামে খ্যাত ছিল। ফার্স্ট ইয়ারের লুবনা যদি না থাকত অবলীলায় তাকে মিস ইউনিভার্সিটি খেতাব দেয়া যেত।
লুবনাও একই রকম সুন্দর, চেহারায় কৈশোর কাটেনি, লাবণ্য তাই বুবনার চেয়ে একটু বেশিই। লম্বায় দু’জনই পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি।
দু’জনের সৌন্দর্যের উৎস একই- কাশ্মীরের মুজাফফরাবাদের রমণী তারানা আনজুম। তাদের বাবা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নুরুস সাফা, তখন ক্যাপ্টেন, পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে বেদিয়ান সেক্টরে লড়াই করে লাহোর রক্ষা করেন। ইন্ডিয়ান আর্মি তখন পিছু হটছে। ক্যাপ্টেন পরিস্থিতি যাচাই করতে ট্রেঞ্চের বাইরে এলেন। পেছন দিকে সিগন্যালসের একটি জিপ, গাছের পাতা ও ডালে ক্যামোফ্লেজ করা। চারদিক পর্যবেক্ষণ করে তার ইউনিটকে পরবর্তী নির্দেশ দেবেন। ঠিক তখনই গুলিটা এসে লাগে ঠিক কোমর বরাবর, ক্যাপ্টেন সাফা রক্তাক্ত অবস্থায় ট্রেঞ্চে নেমে পড়েন। তারপর মাথার ওপর দিয়ে এক ঝাঁক গুলি। আর কেউ হতাহত হয়নি। তারিখটা এগারই সেপ্টেম্বর। মোহাম্মদ আলী জিন্নার মৃত্যুর দিন। গুলিবিদ্ধ ক্যাপ্টেনকে প্রথমে অস্থায়ী গ্যারিসন হাসপাতালে, সেখান থেকে কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতাল। কাশ্মীরি নার্স তারানা আনজুম কেবল এই গুলিবিদ্ধ সৈনিকের শরীরের শুশ্রূষাই করেননি, তার অন্তরের হাহাকারও যতটা সম্ভব নিবৃত্ত করেছেন।
ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তারানার সম্পর্কটা যখন জমাট বাঁধতে থাকে, তার সহকর্মী পাঞ্জাবি নার্স সারওয়াত বানু জিজ্ঞেস করে, বাঙালি কেন? কত চমৎকার পাঞ্জাবি ছেলেও তো রয়েছে।
তারানা জবাব দেয় তাদের প্রায় সবাই জেসিও কিংবা নন-কমিশনড। নুরুস সাফা স্যার কমিশনড, এখন ক্যাপ্টেন, একদিন মেজর জেনারেল হবেন। আমি তখন জেনারেল সাফার ওয়াইফ হয়ে থাকব।
সারওয়াত বানুর চোখ কান খোলা। বলে, ইম্পসিবল। বাঙালি লোক মেজরের ওপর উঠতে পারবে না।
তারানা বলল, তাতেও চলবে। আমি তখন মেজর সাফার ওয়াইফ।
তারানা আনজুম আরও কতগুলো বিষয় খোলামেলা বলে দেয়। বাড়িতে সৎ মা। তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কোনোদিন যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই। সৎ মা তার নামে গ্রামে অপবাদ রটিয়েছে, মেয়ের চরিত্র খারাপ। লাহোরের হিরামন্ডি বেশ্যাখানায় থাকে।
ক্যাপ্টেন নুরুস সাফা বলে, আরও খারাপ জায়গায় থাকলেও আমার সমস্যা নেই। আমি তোমাকেই বিয়ে করব।
তারানা বলে, স্যার হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। পরে আফসোস করবেন। আগে আপনার বাবার সম্মতি নিন।
নুরুস সাফা বলেন, বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইউনিভার্সিটির পড়া ফেলে হুট করে বেঙ্গল রেজিমেন্টে জয়েন করেছি। সে জন্যই তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তোমাকে আমি হারাতে চাই না। ছোটবেলা থেকে যা করেছি তার প্রায় সবই করেছি বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তোমাকে বিয়ে করলে বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বড়জোর আর একটা পয়েন্ট বাড়বে। তুমি রাজি থাকলে কারও পরওয়া করি না।
স্যার, এমনিতেই আমার চরিত্র নিয়ে বাড়িতে কথা উঠেছে। তখন আমার সহকর্মী নার্সরাও বলতে ছাড়বে না আনজুম ছেনালিপনা করে পাকিস্তান আর্মির ক্যাপ্টেন বাগিয়েছে।
তক্ষণে নুরুস সাফার কমান্ড ফিরে এসেছে। চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, সিস্টার আনজুম, নো ফারদার টক। হোয়াট ইয়োর ক্যাপ্টেন ডিসাইডস ইজ ফাইনাল। গেট রেডি ফর নেক্সট কোর্স অব অ্যাকশন।
বাঙালি ক্যাপ্টেন তার চেয়ে দেড়-দু’ইঞ্চি খাটোই হবেন। সিস্টার তারানা আনজুম তার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সিস্টার আনজুম চোখ তুলে আবার নামিয়ে আনে। নমিত স্বরে বলে, স্যার, দয়া করে হেভি কোনো এক্সারসাইজে যাবেন না। কোমরে নতুন কোনো ইনজুরি দেখা দিতে পারে।
তিনি আবাও চেঁচিয়ে ওঠেন, ডোন্ট টক ননসেন্স।
সিস্টার আনজুম স্যালুট করে নার্সিং হোস্টেলের দিকে পা বাড়ায়।

ক্যাপ্টেন নুরুস সাফা ছুটিতে ছেষট্টির ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। সঙ্গে আসেন তারানা আনজুম, কালো বোরকায় ঢাকা। বাবার অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করাতে অনেক সমস্যাই হতে পারত, কিন্তু যখন আনজুম বোরকার পর্দা উঠালেন কারও মুখ থেকে টু শব্দটি বের হয়নি। সবাই, এমনকি বদমেজাজি অ্যাডভোকেট নুরুন নবীও হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ে মানুষ এত সুন্দর হয়। মেয়ে মানুষ নাকি অন্য কিছু?
কলাবাগান বশিরউদ্দিন রোড, লেক সার্কাস এলাকায় রটে গেল অ্যাডভোকেট নুরুল নবীর বড় ছেলে ক্যাপ্টেন নুরুস সাফা কাশ্মীর থেকে একটি পরীকে বিয়ে করে এনেছে। লেক সার্কাস গার্লস স্কুলের গা ঘেঁষা টিনশেড একতলা বাড়িতে প্রতিবেশীদের ভিড় জমেছে। মহিলাদের কেউ কেউ এ বউটি সত্যিই মানুষ কিনা পরীক্ষা করতে ছুঁয়েও দেখেছে।
সেই পরীর গর্ভে দুই কন্যা- দু’বছরের ব্যবধানে বুবনা ও লুবনা। বুবনার জন্ম ছেষট্টির ৩০ অক্টোবর, লুবনার আটষট্টির ২২ নভেম্বর। দু’জনের জন্মই ঢাকায়। তখন নুরুস সাফার পোস্টিং ঢাকা সেনানিবাসে। একমাত্র ছেলে আইয়াজ সাফার জন্ম কোয়েটায় একাত্তরের ৯ জুলাই। পূর্ব পাকিস্তান তখন বাংলাদেশ হওয়ার জন্য সশস্ত্র লড়াই করে যাচ্ছে। ততদিনে পদোন্নতিপ্রাপ্ত মেজর নুরুস সাফা কার্যত নজরবন্দি।
মেজর নুরুস সাফা স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে চুয়াত্তরে আবার ঢাকা ফিরে এলেন। অনেক বাধা ডিঙ্গিয়ে আবার সেনাবাহিনীতে ঢুকলেন। কিন্তু তার ধূর্ত-সহকর্মীদের মতো তিনি তেমন এগোতে পারলেন না। লেফন্ট্যান্ট কর্নেল থেকেই তাকে অবসর নিতে হল। একধাপ উপরে হলেও লেফন্ট্যান্ট অংশটুকু খসে পড়ল। তিনি পরিচিত হলেন রিটায়ার্ড কর্নেল সাহেব হিসেবে। তার একমাত্র ভাই বিএ ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র নুরুস সালাম একাত্তরে কশবার যুদ্ধে গুরুতর জখম হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে পরদিনই মারা যায়। মেজর নুরুস সাফার একবছরের জুনিয়র ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন সেখানে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। নুরুস সাফা চান বা না-ই চান পুরো বাড়িটার মালিকানা শেষ পর্যন্ত তার ওপরই বর্তাবে।
দূরের জেলা শহর থেকে রাজধানী ঢাকা শহরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আসা ছেলেরা মেট্রোপলিটন পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে আপ্রাণ চেষ্টা করে, কড়া ইস্ত্রির শার্টপেন্ট পরে, শার্টের উপরের দুটি বোতাম খোলা রেখে বুকের কিয়দংশে রোদ-বৃষ্টির ছোঁয়া লাগাতে চেষ্টা করে। তড়িঘড়ি করে স্মার্ট হতে চাওয়া ছেলেদের … খেতাব দিয়ে খেতাবি নাম ধরে ডাকা হয়। এমনকি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে ছেলেটি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেয়ে যায়, পিএইচডি করতে লন্ডন অক্সফোর্ড কেমব্রিজ মানচেস্টার যায় নামটি তাকে আর ছাড়ে না। শহরে ছেলেরা তো করেই, মেয়েরাও বলাবলি করে, আমাদের … ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছে, তোদের … নাকি পিএইচডি করতে অক্সফোর্ড যাচ্ছে।
আমার পোশাক, কথা বলার ঢং, বাংলা উচ্চারণ এবং ইংরেজি বলার চেষ্টা আমাকে আবদুলে পরিণত করে। রেজাই করিম নাম ধরে ডাকলেও আমার মনে হয়, নিশ্চয়ই আমাকে নয়, অন্য কাউকে ডাকছে। কিন্তু আবদুল ডাক শুনলে নিশ্চিত হই, এবার আমাকেই ডাকছে, পরবর্তীকালে এমন ছেলের নাম খালেক কিংবা মফিজও হয়েছে।
এমন ছেলেদের আবেদন বেশি, যখন-তখন তাদের বোকা বানানো যায়, হাসি-ঠাট্টা করা যায়। অন্যকে বোকা বানানোর মজাই আলাদা।
আমি ভেবেছিলাম বুবনার এতটা নিষ্ঠুর হওয়ার কথা নয়। আফটার অল আমরা ক্লাসমেট তো।
বুবনা ভিন্ন কিছু করল। একেবারে ভিন্ন কিছু।
আমি বিশ্বাস করতে চাইনি। জোর দিয়ে বুবনাকে বলেছি, ঠাট্টা করবেন না।
বুবনা বলল, একশ বার করব।
দেহমন দিয়ে বুবনা আমাকে বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছে যে তার ঠাট্টার ধরনটি ভিন্ন।
বুবনা একদিন গায়ে পড়েই বলল, ওরা তোমাকে আবদুল বলে ডাকে আর তুমি দাঁত বের করে হাসো। কী আশ্চর্য, ওদের ধমক লাগাতে পার না?
আমি বলি, খারাপ কিছু তো বলে না।
তাহলে এটা খুব ভালো কিছু? বেশ তাহলে আমিও তোমাকে আবদুল বলে ডাকতে শুরু করব।
শুনে আমি হেসে উঠি। বলি, বেশ তো ডাকবেন।
আমি সত্যিই কিন্তু আবদুল ডাকব।
ডাকুন না সমস্যা নেই।
এভাবে ঠাট্টা মশকরা করতে করতে হোক কিংবা ভেতরে ভেতরে ক্ষিপ্ত হয়েই হোক বুবনা আমাকে আবদুল বলেই ডাকতে শুরু করল।
বুবনা বলল, আবদুল ক্লাস নোটসগুলো ঠিকভাবে লিখবে, স্পষ্ট করে লিখবে। আমার যেন পড়তে অসুবিধে না হয়।
আপনিও তো ক্লাসে থাকবেন, তাই না? তাহলে…
আবদুল তুমি আমার মুখের ওপর কথা বলতে শুরু করেছ? আমি ক্লাসে থাকব না রাস্তায় নেমে খেমটা নাচ নাচব, সেটা আমার ব্যাপার। তোমাকে বলেছি ঠিকভাবে স্পষ্ট করে লিখবে, যাতে পড়ে দেয়ার জন্য তোমাকে ডাকতে না হয়। আবদুল আবদুল করে ডাকাডাকি করতে আমার ভালো লাগে না।
আমি বলি, আমার হাতের লেখা তেমন ভালো নয়। কখনো আমার নিজেরই পড়তে কষ্ট হয়।
বাজে কথা বল না। হাতের লেখা যদি নিজে নিজে ভালো করতে না পার তাহলে একটা কোর্সে ভর্তি হয়ে যাও। হাতের লেখা সুন্দর করার কোর্স আছে। তিন মাসের গ্যারান্টি আছে, এর মধ্যেই তোমার হাত ভালো করে লিখতে শিখে যাবে, বিফলে মূল্য ফেরত।
জ্বি কী বললেন?
বলেছি, বুবনার মাথা, আবদুলের মুণ্ডু। বলেছি, ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে উপুড় হয়ে বসে প্রথম একমাস স্লেটে লিখবে। পরের একমাস পেনসিলে। হাত যখন বিশ্বাসী হয়ে উঠবে, তখন কলম হাতে নেবে। একই জায়গায় বাংলা বানান শেখার একটা কোর্সও আছে। বিদেশীদের জন্য এটা অ্যাডভান্সড কোর্স। দু’মাসের। দেখতে দেখতে চলে যাবে। কালই ভর্তি হবে। আর শোনো, ওখানে পড়াশোনার সময় যদি কোনো বাচ্চার মায়ের দিকে তোমার এমন আহাম্মকি চাহনি দিয়ে তাকাও, তাহলেই আট ইঞ্চি গজাল গনগনে আগুনে পুড়িয়ে তোমার চোখ গেলে ফেলব। আবদুল তুমি আমাকে চেন না- আমার নাম বুবনা সাফা।
আমি মাথা নিচু করে রাখি। বলি, জি, আচ্ছা।
জি আচ্ছা মানে কী?
ক্লাস নোট ঠিকঠাক লিখে রাখব।
বুবনা বলল, দ্যাটস অ্যা গুড বয়।
অন্য একদিন টিউটোরিয়াল শেষ হতে হতে বিকাল গড়িয়ে যায়। বোশেখের দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে।
বুবনা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ঝড় আসছে। কিন্তু এই ঝড়ের মধ্যে আমি বাড়ি ফিরব কেমন করে।
আমি চুপ করে থাকি।
বুবনা চেঁচিয়ে ওঠে, এই আবদুল কথা বলছ না কেন? ঝড়ের মধ্যে একজন ভদ্রমহিলাকে একা রিকশায় তুলে দেয়া ঠিক হবে তোমার এ কাণ্ডজ্ঞানটুকু নেই? স্টুপিড কোথাকার। এত বছর ধরে পড়াশোনা করছ এটুকু সৌজন্যও শেখোনি?
আমি আধভেজা হয়ে রিকশা ডেকে আনি। বুবনা উঠে বসে। আমি নীচতলা থেকে রাস্তায় নামার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকি।
বুবনা আবারও চেঁচায়। আমাকে রিকশায় তুলে দিয়েই তোমার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল? রিকশাওয়ালা যদি আমার মুখ চেপে ধরে অন্ধকার কোথাও নিয়ে যায়? তখন কী হবে?
আমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারত, কিসের দায়িত্ব? তুমি কে? কিন্তু আমি সশব্দে কিছুই না বলে একা একা কী যেন আওড়াতে থাকি।
এবার কণ্ঠ নামিয়ে বলে, আবদুল তুমি আমার কথা বোঝনি?
আমি নিঃশব্দে রিকশায় উঠে বসি। বুবনার পাশে। শরীরে শরীরে লাগালাগি যাতে না হয়, একটুখানি দূরত্ব সৃষ্টি করে রাখি।
রিকশাওয়ালা মুখ চেপে ধরে যদি কোথাও নিয়ে যায়- কথাটা রিকশাওয়ালা ভালোভাবে নেয়নি। হয়তো ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্যই কয়েকবার প্যাডেল মেরে বলে ফেলল, আপা, সঙ্গের মানুষই আকাম-কুকাম করে, রিকশাওয়ালা অত সাহস পাবে কোথায়?
বুবনা ধমকে ওঠে, স্টপ টকিং ননসেন্স।
আমি বুবনাকে তাদের লেক সার্কাসের বাসার গেটে নামিয়ে হেঁটে হেঁটে হলে ফিরে আসি।
তার পরদিনও ক্লাস বিকালে। এসেই বলল, আজও আমাকে বাসায় নামিয়ে দিতে হবে। আমার গায়ের সঙ্গে লাগলে তোমার গা পচে যাবে নাকি? রিকশায় এমন করে বসো কেন?
একদিন কলাভবনের তিন তলার করিডোরে বুবনার স্যান্ডেলের স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল। হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে। আমি তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছি।
বুবনা খেঁকিয়ে ওঠে, তুমি হাঁ করে মজা দেখছ নাকি? আমি সিঁড়িতে বসছি। মুচি কোথায় পাবে জানি না, তাড়াতাড়ি সেলাই করে নিয়ে আস।
হাতে এক পাটি লেডিস স্যান্ডেল নিয়ে মহসিন হলে ঢোকার মুখে ব্যস্ত মুচিকে ধরে স্যান্ডেল সেলাই করে ফিরে আসি।
বুবনা চার্জ করে, এতক্ষণ লাগল কেন? রোকেয়া হলের কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়েছিলে নাকি?
আমি বলি, মহসিন হলের মুচিকে দিয়ে সেলাই করিয়েছি। ওটা ছেলেদের হল।
বুবনা বলল, দেখো আবদুল আমার মুখের ওপর কোনো কথা বলবে না। তাতে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
এক সকালে টিউটোরিয়াল ক্লাস শেষ করে বের হওয়ার সময় বুবনা বলল, আমি যা বলব তোমাকে তা-ই করতে হবে। এখন থেকে আমি তোমার না বলার শক্তি কেড়ে নিচ্ছি।

আমার মনে হল, মগজের একাংশ বার্থডে কেক কাটার মতো কেটে বিচ্ছিন্ন করে নিঃশব্দে সঙ্গে নিয়ে চলে যাচ্ছে বুবনা। মগজের এ অংশটুকুতেই ছিল আমার না বলার ক্ষমতা। বুবনা আমাকে এক ধরনের বাক-প্রতিবন্ধী করে ফেলল। আমি না বলতে পারব না, আপত্তি করতে পারব না।
আমি বহুবার না বলেছি। আমার বাবা বলেছে, ঢাকা শহরে যাওয়ার দরকার নেই, এ জামালপুর শহরে আশেক মাহমুদ কলেজে বিএ পড়লেই চলবে।
আমি বলেছি, না। আমি ঢাকাতেই যাব। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে যাব। নতুবা পড়াশোনা করব না।
তারপর মা বলেছে, তাহলে পিলখানায় তোর মামার বাসায় থেকে পড়াশোনা করিস।
আমি তখনই বলেছি, অসম্ভব, কারও বাড়িতে থাকার জন্য নয়, আমি হলে থাকার জন্য ঢাকায় যাচ্ছি। আমি মামার বাসায় যাব না।
আমি গ্রামের স্কুল, মফস্বলের কলেজ থেকে ভালো রেজাল্ট নিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি। আমার মামার মেয়ে শহুরে স্কুল ও কলেজ থেকে পাস করে সেখানে চান্স পায়নি। আন্দোলন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা কলেজে ভর্তি হয়েছে ইসলামের ইতিহাসে। আমার একটু অহংকার থাকারই তো কথা।
মামা-মামী এবং তাদের মেয়ে ফারহানাসহ যখন আমাকে হল থেকে বাসায় নিয়ে যেতে এলেন এবং মামী বারবার বললেন তুমি তো আর দূরের কেউ নও, আমাদেরই ছেলে, আমাদের বাসায় চল, আমাদের একটা এক্সট্রা রুমও আছে, অসুবিধে হবে না, আমি না যাওয়ার পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বের করলাম- আপনাদের বাড়িতে আমার সমবয়সী কেউ নেই, তাছাড়া ওখান থেকে ক্লাসে আসা-যাওয়ায় অনেকটা সময়ই নষ্ট হবে, সে জন্যই যেতে চাচ্ছি না।
মামী বললেন, সমবয়সী নেই মানে? ফারহানা তোমার চেয়ে মাত্র ছ’মাসের ছোট।
তা ঠিক। তবে আমার সমবয়সী মেয়ে যে ঝগড়াটে হবে এটা নিশ্চিত। আমি ঝগড়া বিবাদ থেকে দূরে থাকতে চাই।
ফারহানা চোখ তুলে বলল, তুমি একটা ফাজিল। রেজাল্ট একটু ভালো করছ বলে ডাট দেখাতে শুরু করেছ? একটু মন দিয়ে পড়াশোনা করলে তোমাদের ইউনিভার্সিটিতে আমিও চান্স পেতাম। যাক তোমার যেতে হবে না। আমি দেখব পড়াশোনা করে শেষ পর্যন্ত তুমি কী হও- প্রফেসর না ক্লার্ক?
আমি বললাম দেখলেনই তো, ভুল বলিনি।
আমি এখন হলে ডাবলিং করছি। নেক্সট ইয়ারে একটা বেড পেয়ে যাব। ফারহানা চেঁচিয়ে তার মাবাবাকে বলল, সময় নষ্ট করছো কেনো? ও নিশ্চয়ই এখন পড়তে বসবে। ওকে পড়াশোনা করতে দাও। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবে।
মামা বললেন, ছুটির দিন চলে আসিস। সারাদিন কাটিয়ে রাতের খাওয়া সেরে হলে ফিরবি।
আমি বললাম, তা হলে আমার হলের খাবারের কী হবে?
এ পর্যন্তই। ফারহানা মেজাজ দেখিয়ে রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করল। বিড়বিড় করে বলল, পাগল, একটা আস্ত পাগল।
আমি বেশ অনুভব করলাম বুবনার সামনে আমার না বলার শক্তি অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে। আমাকে হতচকিত করে বুবনা জিজ্ঞেস করল, আবদুল, তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
আমি বুবনার দিকে তাকিয়ে থাকি।
করবে?
আমার জিহ্বা শুকিয়ে আসে। আমি জানি আমার না বলার শক্তি নেই, কিন্তু হ্যাঁ-ও বলতে পারছি না।
বুবনা আবার বলে, কথা বলছ না কেন?
আমি বলি, আপনি আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছেন? ডিপার্টমেন্টের ছেলেরাও আমাকে নিয়ে খুব ঠাট্টা করে।
বুবনা বলল, বেশ, আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে না, আমার ক্ষমতা থাকলে আমিই তোমাকে বিয়ে করব।
আমি সম্ভবত তার কথার মানে বুঝতে পারছি না। কিংবা ঠাট্টাটা খুব নির্মম মনে হচ্ছে।
বুবনা বলল, এখন তুমি হ্যাঁ বলো।
আমি চললাম, আচ্ছা।
বুবনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, গুডবয়, ভেরি গুডবয়।
মেয়ে যখন সেলিব্রেটি হয়ে উঠে, মেয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আর মা-বাবার হাতে থাকে না। মেয়ের সিদ্ধান্ত মা-বাবা কখনো মেনে নেয় কখনো প্রত্যাখ্যান করে।
বুবনা আমাকে তার বাবার সামনে হাজির করে বলল, আব্বু, আবদুল আমার ডিয়ারেস্ট ফ্রেন্ড। আমি আবদুলকে বিয়ে করব। ফাইনালি হি অ্যাগ্রিড টু বি মাই হাজব্যান্ড। তবে আবদুলকে রাজি করাতে অনেক এফোর্ট দিতে হয়েছে। তোমার ব্লেসিংস চাই।
কর্নেল নুরুস সাফা ইংরেজিতে মেয়েকে যা বললেন তার সারমর্ম হচ্ছে : তোমার যখন জন্ম হয় তখন বাড়িতে যে দু’জন চাকর ছিল তাদের একজনের নাম আবদুল, অন্যজনের নাম বাকের। আবদুল নামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। আমি জেনুইন আবদুলকে ডাকতাম আবদুল ওয়ান এবং বাকেরকে ডাকতাম অবদুল টু। আর তুমি আমার সামনে নিয়ে এসেছ আবদুল থ্রি। নাকি ভুল বললাম?
কর্নেল নুরস সাফা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, মাই বস, কর্নেল ওসমানি মানুষ না পুষে কুকুর পুষতেন। তার সিদ্ধান্তই ঠিক। অ্যাবসলিউটলি রাইট।
এবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বজ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, গেট আউট, গেট আউট অব দিস হাউস।
বাবা এমন রূঢ় হবে বুবনা ভাবেনি।
কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে বুবনা ঝাপসা চোখের অশ্রু সামলে নিয়ে বলল, হু কেয়ার্স? লুক বাবা, তোমার ব্লেসিংস ছাড়াও আমার চলবে। দিস ইজ মাই লাইফ অ্যান্ড আই উইল ডিসাইড। আবদুল, লেটস গো।
বুবনা আমার হাত ধরে টানলো।
সম্ভবত মেয়ের মুখোমুখি হতে চাচ্ছেন না বলেই উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে কর্নেল সাফা আবার চেঁচালেন, নো মোর আবদুল ইন দিস হাউস। এ বাড়িতে আর আবদুল নয়।
বুবনা আমাকে সামনের দিকে টানছে। তিনি আবার মুখ ফেরালেন। আমার চোখাচোখি হলেন। তার চাহনিতে দেখি পরাজিত সৈনিকের আতঙ্ক। কিন্তু তার কম্পমান ঠোঁট বলে যাচ্ছে, আমাদের দু’টি আবদুলই যথেষ্ট। তিন নম্বর আবদুলের কোনো প্রয়োজন নেই।
বুবনা বলল, আমার সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ বেস্ট চয়েস সেনেটারি ন্যাপকিনে মডেলিং কখনো কখনো বাধ্য হয়ে একটু দেরিতে বাড়ি ফেরা- বাবা এর কিছুই পছন্দ করছেন না। বাবা চান লুবনার মতো একটি লক্ষ্মী মেয়ে- বাবা যা বলবে, তা-ই শুনবে, বাবা ভুল করলেও বলবে খুব ভালো হয়েছে, বাবা ঠিকই করেছে। কিন্তু আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। এসব থাক- আমাকে কোথায় তুলবে?
মানে?
বউ তুলবে না? তোমাদের হলে তুলবে নাকি?
আমি বলি, আমি তো এখনো সিঙ্গেল রুম পাইনি। পেলেও কি হলে বউ তোলা যায় নাকি?
আমি বললাম, তোমার আব্বুর রাগ পড়ে গেলে আবার চেষ্টা করা যাবে।
বুবনা বলল, আমি কর্নেল সাফাকে চিনি। হি ড্রোভ মাই মাদার টু ডেথ। আমার মাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবদুল, আসলে আমার মা মারা যায়নি। আমার বাবা কাশ্মীরের মুজাফফরাবাদের একটি মফস্বল এলাকা থেকে ঢাকা শহরে আসা তারানা আনজুমকে শেকড় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চেয়েছে। মা হাসপাতালে নার্সিং শুরু করতে চেয়েছে। বাবা রাজি হয়নি, তাতে স্ট্যাটাস নেমে যাবে। মা যখন মানসিক ভারসাম্য হারাতে বসেছে বাবা নিজেই বহু বছর পর মুজাফফরাবাদে যোগাযোগ করে। তারা তাদের অবাধ্য মেয়েটির জন্য আগ্রহ দেখায়নি। তবে তার বড় চাচার ছেলে শাহাবুদ্দিন খান একদিন ঢাকায় এসে হাজির। বোনকে চিকিৎসা করাতে লাহোরে নিয়ে যেতে চান। তাকে দেখে মা বদলে যেতে থাকে, আচরণ স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং চিকিৎসার জন্য লাহোর যেতে রাজি হয়। আর্জেন্ট ফি জমা দিয়ে তার জন্য পাসপোর্ট করিয়ে আনা হয়। বাবাই রিটার্ন-টিকেট করে দেয়। কিছু ডলারও দেয়। শিগগির ফিরে আসার আশ্বাস দিয়ে দু’বছর বয়সী আইয়াজ আর আমাদের রেখে মা চলে যায়। চাচাতো ভাইয়ের সাথে। আব্বুকে আমরা হাজারবার জিজ্ঞেস করেছি- আম্মু কবে আসবে? আব্বু বলেছে, মাথা ঠিক হলে চলে আসবে। পাগলের চিকিৎসায় দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এক সময় শুনলাম আম্মু আর ফিরে আসতে রাজি নয়। আবার এটাও শুনলাম এই শাহাবুদ্দিন খানই নার্সিং কোর্স করার সময় তারানা আনজুমকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। এখন শাহাবুদ্দিনই তাকে আটকে রেখেছে, ফিরে আসতে দিচ্ছে না। উনিশ শ’ একাশিতে আমি যখন ক্লাস টেনে, যে ঘটনাটি তখন জানতে পারি তা আমার কাছে সত্যি মনে হয়। আম্মু মেন্টাল হসপিটালের ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, দারোয়ান- সবার চোখে ধুলো দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। সে রাতে কেউ আর তাকে খোঁজ করেনি। পরদিন যখন বোঝা গেল প্যাশেন্ট নেই, হাসপাতালের লোকজন পুলিশ নিয়ে খুব খোঁজাখুঁজি করল। খবর মিলল না। আমার কেবল বছরের পর বছর মনে হয়েছে আম্মু হেঁটে হেঁটে আমাদের কাছে আসছে। আমি ম্যাপ খুলে বসেছি, ভেবেছি লাহোর সীমান্ত দিয়েই আম্মু ইন্ডিয়ায় ঢুকেছে, তারপর হাঁটছে আর হাঁটছে।

বুবনা আমাকে আরো জোরে টেনে সামনে এগোতে থাকে। ধমকের স্বরে বলে, ডোন্ট লুক ব্যাক, ডোন্ট লুক অ্যাট ড্যাড, হি ইজ অ্যা …। পেছনে তাকালে তোমার দুই চোখ …। তুমি আমাকে চেন না আবদুল। আই ক্যান বি অ্যাজ ক্রুয়েল অ্যাজ কর্নেল নুরুস সাফা। আফটার অল আমি তারই মেয়ে।
আমি বুবনাকে অনুসরণ করতে থাকি। আমি হলে গিয়ে নিজের বিছানায় রাত কাটাতে পারব, কিন্তু বুবনা থাকবে কোথায়?
বুবনা বলল, ঘাবড়াবে না। আমাদের নিজেদের ফ্ল্যাটে চল।
মানে আপনার ফ্ল্যাটে, কিন্তু এখনো তো অনেক কাজ বাকি, চাবিইতো হ্যান্ডওভার করেনি।
বুবনা বলল, হ্যান্ডওভার না করুক। ঘরের দরজা তো লাগানো হয়েছে। এখন বলে কয়ে চাবি নিয়ে ওখানেই থাকতে শুরু করব।
চাবি অনুরোধ করেই নিতে হল। দ্রুত নীলক্ষেত এসে তোষক, বালিশ, লেপ, চাদর আর মশারি নিই, টুকটাক এটাওটা কিনে বুবনার ফ্ল্যাটে ফিরে আসি। বুবনাও নিঃশব্দে তাদের লেক সার্কাসের বাড়িতে ঢুকে স্যুটকেসভর্তি কাপড়চোপড় নিয়ে আসে।
বুবনা আমাকে আদেশ দেয়, আবদুল, তোমার হলের পাট চুকিয়ে ফেল। যা আছে নিয়ে এখানে চলে এসো। আমরা এখন থেকে এই বাড়িতেই থাকব।
আমি ইতস্তত করতে থাকি।
বুবনা জিজ্ঞেস করে, তুমি আমাকে এখানে রেখে চলে যেতে চাচ্ছ নাকি?
আমি বলি, তোমার সাথে থাকলে লোকে কী বলবে?
বুবনা জবাব দেয়, মেয়েমানুষের মতো কথা বলছ কেন? কিছু বললে তো বলবে আমাকে।
আমি বিড়বিড় করি, আমি হলের সিট ছাড়ব না। বিশ্বাস নেই, বুবনা একদিন বলবে, এটা তো আমার ফ্ল্যাট। ইউ গেট আউট ব্লাডি আবদুল। শহরের মেয়েদের কোনটা হাসি-হাট্টা, আর কোনটাতে তারা সিরিয়াস আমি ধরতে পারি না।
সে রাতেই দু’একটা বই-খাতা, কিছু কাপড়চোপড় আনার জন্য হলে যাওয়ার পথে ছাত্র নামধারী এক মাস্তান কাইল্যা শামসু কোনো ধরনের প্ররোচনা ছাড়াই আমার কলার চেপে ধরে বলল, আবদুল, বুুব না মালটাকে…। এখন বল কোন পথে আগামু?
আমি তার হাতে ঝাকি দিয়ে বলি, হাত ছাড়ুন।
ততক্ষণে আরও চার-পাঁচজন আমাকে ঘিরে ধরল। এদের কয়েকজন আমার পরিচিত। লেংড়া ভুট্টো, চার আঙ্গুুইল্যা কাশেম, ভাইস্তা বাবলু। প্রতিপক্ষ কাশেমের একটি আঙ্গুল গোড়া থেকে কেটে টিস্যুপেপারে পেঁচিয়ে সাথে নিয়ে গেছে আর লেংড়া ভুট্টোর একটি পা জন্ম থেকেই খাটো।
ভাইস্তা বাবলু আমার গলা টিপে ধরে বলল, ঐ শালীকে আজ রাতে কিডন্যাপ করব, তুই সাথে থাকবি, ঘর থেকে ডেকে বাইরে নিয়ে আসবি, রাজি না হলে… বলেই গলায় আরো জোরে চাপ দিল। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, চোখও তখন ঝাপসা।
এক সময় ভাইস্তা বাবলু আমার গলা ছেড়ে দিল। কাইল্যা শামসু তার সহযোগীদের ধমকালো। বলল, খামোশ, বড় ভাইয়ের গায়ে হাত দিবি না। মুরুব্বিকে সম্মান করতে হয়।
… মালটা ফার্স্ট ক্লাস। তুই আমাগো হেল্প করবি কি না বল?
মানে?
কাজটা সহজ। আমরা বুবনাগো বাসা চিনি। তুই শুধু ডাইকা বাইরে নিয়া আসবি। আমাগো মাইক্রোবাস রেডি থাকব, শালীরে তুইলাই …। কিডন্যাপ করতে যারা সাহায্য করবে, …। এখন ব্যাটা তুই রাজি হ।
আমি চিৎকার করে উঠি, না। আমি পারব না।
তখনই শুরু হয় বেদম মারপিট। লেংড়া ভুট্টো বলে তুই পারবি তো তোর বাপ পারবে।
অপরিচিত একজন আমার … চেপে ধরে বলে, শালাকে খোজা করে দিই ওস্তাদ।
সম্ভবত কাইল্যা শামসুকে ওস্তাদ সম্বোধন করছে।
চারজন আমাকে ঠেলে মাইক্রোবাসে তুলল। ওস্তাদ গাড়িতে উঠেনি। বলল, আমি বাইক নিয়ে আসছি।
ছাত্র নামধারী বহিরাগত নেতা লেংড়া ভুট্টো বলল, বুবনা হোক কি কাজের বুয়া হোক …।
বুবনা-কিডনাপ-মিশনে সহযোগিতা করতে রাজি না হওয়ায়… ওরা আমার চোখ বেঁধে ফেলল। আমি বললাম, বুবনার বাবা কর্নেল। বাড়িতে ফায়ার আর্মস আছে।
ভাইস্তা বাবলু বলল, আমাদেরও আছে। কর্নেলের আছে দু’নলা বন্দুক আর আমাদের একে ৪৭। কর্নেল বন্দুক বের করতে করতে তার খুলি উড়ে যাবে। ভয় দেখাইস না।
আমার অসহযোগিতা না করার বিষয়টি যখন তাদের কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল আরও একদফা নির্যাতন করে দুই পা, দুই হাত ও চোখ বেঁধে আমাকে যেখানে নামিয়ে দিল, পরে বুঝতে পারি এই জায়গাটা মিরপুরে বেড়িবাঁধের পশ্চিমের অংশ। সবার কাছে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা যে, চলন্ত গাড়ি থেকে আমাকে ফেলে দেয়নি। আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে নদীতে নিক্ষেপ করেনি। আমার মুণ্ডুটা বিচ্ছিন্ন করে সুন্দর র‌্যাপিং পেপারে পেঁচিয়ে উপহার হিসেবে বুবনার কাছে পাঠায়নি।
হাত, পা ও চোখ বাঁধা মার খাওয়া একজন মানুষের দড়ির বাঁধন কেউ খুলতে সাহস পাচ্ছিল না। আমিই অনুরোধ করি, পুলিশ ডাকুন। পুলিশই খুলে দেবে।
পুলিশ আমাকে মিরপুর থানায় নিয়ে যায়। আমার অভিযোগ শোনার বদলে নিজেরা পরস্পরকে বলাবলি করে- শালা একই গ্যাঙ্গের মেম্বার। টাকা-পয়সার কোন্দল বেঁধে যাওয়ায় ফেলে গেছে। ভালো করে ডলা দিলে ফরফর করে সব বলে দেবে। শালার চেহারাটাই তো ক্রিমিনালের।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেবার জন্য আমার উপর চাপ দিতে থাকে। আমি একপর্যায়ে বলে ফেলি কর্নেল নুরুস সাফা আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ততক্ষণে ভোর হয়েছে। অমনি থানাদারদের আচরণ পাল্টাতে থাকে। আমাকে জিজ্ঞেস করে, স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন, ফোন নম্বর বলেন।
আমি জিজ্ঞেস করি, কোন স্যার?
কর্নেল নুরুস সাফা।
না, তাকে বিব্রত করতে চাই না। কাল আমার টিউটোরিয়াল পরীক্ষা, ছেড়ে দিন অথবা থানায় চালান দিন যা বলার কোর্টে বলব।
সাব-ইন্সপেক্টরদের একজন বলেন, বড্ড সেয়ানা মাল।
ওসি বললেন, আন্ডারটেকিং নিয়ে ছেড়ে দাও। ঝামেলা থানায় এনো না, যা করার স্পটেই করবে।
আমার সব পকেট হাতিয়ে সবশুদ্ধ পঁয়তাল্লিশ টাকা বের করে কী মনে করে পুরো টাকাটাই ফেরত দিয়ে সাব-ইন্সপেক্টর বললেন, যা শালা তোর কপাল, সারের মুড ভালো। তাই ছেড়ে দিলাম। মিরপুর এলাকায় যেন না দেখি।
যখন বুবনার অসমাপ্ত ফ্ল্যাটে পৌঁছি, বুবনা ঘরের তালাবন্ধ করে বের হচ্ছে। আমাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ভেগে গিয়েছিলে তাই না? আবার ফিরলে কেন?
আমি একবার চোখ তুলে তাকালাম। বুবনা আমাকে ডিঙ্গিয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে তাকালো।
জিজ্ঞেস করল, তোমার মুখে কিসের দাগ? চেহারার এ অবস্থা কেন?
একটা সমস্যা হয়েছিল।
কিসের সমস্যা? মার খেয়েছ না কি?
বুবনা বিশ্বাস করুক বা না করুক যা ঘটেছে তার কিছুটা বললাম। বুবনা চাবি ঘুরিয়ে আবার ঘরের দরজা খুলল।
আমি ফ্লোরে পাতা তোষকের উপর থেকে চাদর কিছুটা সরিয়ে বসে পড়ি।
বুবনা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকে, আবদুল আর কোথায় মেরেছে, কোথায়, আমাকে দেখাও। শার্ট খোল।
আমি ঘুমে বিছানায় ঢুলে পড়ি। এরপর কী ঘটেছে, বুবনাই জানে। কাইল্যা শামসুর গ্যাঙ্গ আমাকে হল থেকে তুলে নিয়ে গেছে এটা জানাজানি হতে সময় লাগেনি। টিউটোরিয়াল স্যারও জেনেছেন। বুবনা যখন বলল, সে জানে আবদুলের শরীর ভালো নেই, স্যার জিজ্ঞেস করলেন ইজ হি স্টিল এলাইভ?
বুবনা বলল, জ্বি স্যার। ইমপ্রুভিং।
স্যার বললেন, বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। ওদের হাত থেকে কেউ ফেরে না।
বুবনা নিজেও পরীক্ষায় বসেনি। স্যারকে বলে দু’জনের জন্য নতুন তারিখ নিয়ে এল। আমার মারের দাগ শুকাবার আগেই বুবনা বলল, কী বলেছিলাম মনে আছে?
কী বলেছিলেন?
এখনো আপনি করে বলছো? তাহলে কিন্তু সারাজীবন আপনি আপনি করেই কাটাতে হবে। শোন, সন্ধ্যায় আমরা যাচ্ছি। আজই সেরে নেব। আমি নির্বাক তাকিয়ে থাকি।
আবদুল, আমি তোমাকে আজই বিয়ে করব। সব ঠিকঠাক করে এসেছি। সাক্ষীর ব্যবস্থা কাজি সাহেবই করবেন। তুমি শুধু কবুল বলবে।
আমি মিনমিন করে বললাম, আচ্ছা বলব।
কাবিননামাতে লিখার জন্য একটি পৃথক কাগজে আমরা নিজেদের সম্পর্কে তথ্য- নাম, পিতার নাম, জন্ম তারিখ ইত্যাদি লিখে দিলাম। বুবনার কাগজটি হাতে নিয়ে কাজি সাহেব আতঙ্কিত চোখে আমাদের দু’জনের দিকে এক এক করে তাকালেন এবং বললেন, যা লস হবার হয়েছে। আর বিপদে পড়তে চাই না। আমি ইউনিফর্ম পরা লোকদের ছেলেমেয়ের বিয়ে পড়াই না। এক রিটায়ার্ড ক্যাপ্টেনের মেয়ের বিয়ে রেজিস্ট্রি করে তিন মাস কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করেছি। আর এতো কর্নেলের মেয়ে। আমার গর্দান কাটা যাবে।
বুবনা অনেক চেষ্টা করে, বলে আমি অ্যাডাল্ট, আমার সিদ্ধান্ত আমিই নেব। আব্বুর কিছু করার নেই।
কাজি নুরুল্লাহ বললেন, আপনারা বাপবেটি মিলে যাবেন। মাঝখান থেকে এই মেন্দামারা জামাই বাবা আর আমি জেল খেটে মরব। সরি আমি পারব না।
বুবনা বলল, পারতেই হবে। আরও এক হাজার টাকা দেব।
আমার শিক্ষা হয়েছে। ক্ষমা চাই। অন্য কোনো কাজি অফিসে যান।
বুবনা বলল, কোথায়? কাছাকাছি কোথায় আছে?
কাজি নুরুল্লাহ বললেন, মহাখালী। হেদায়েত কাজি। দু’নম্বরি কাজে পাকা। একবার জেল খেটেছে। বয়স কম। পুলিশের মার সহ্য করতে পারবে, আমার গা মার সইতে পারবে না।

হেদায়েত কাজি বুবনার কর্নেল পিতাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিল। বলল, সেদিনই তো এক মেজর জেনারেলের মেয়েকে বেকার এক ছোকরার হাতে তুলে দিলাম। আমার শুধু দেখার বিষয় বয়স আঠারোর কম কি না। কম না হলেই হল। ফিল্ড মার্শালের মেয়ে যা নায়েব সুবাদারের মেয়েও তা-ই।
বুবনা নিজেই ব্রেকিং নিউজটা দেয়। মনের মানুষ পেয়ে গেছে। তাকে বিয়েও করেছে। একটি ফ্লাটে ঘরসংসার শুরু করে দিয়েছে। খবরের কাগজ লিখেছে : বুবনার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বেকার পাত্রের কাছে বুবনা নিজেকে সমর্পণ করেছে। বুবনার মডেলিং ক্যারিয়ার শেষ! বুবনার জন্য কিউতে থাকা পাত্রদের দীর্ঘশ্বাস!
বুবনা গাঁটের টাকা ভেঙে অসমাপ্ত ফ্ল্যাট সমাপ্ত করে। ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজটা নিজেই করে। মডেলিং থেকে আরও টাকা আসতে থাকে। বুবনা বলে, আবদুল আমাদের হানিমুনটা কবে হবে? আমার হাতে যে এখন অনেক কাজ। সামনে তোমার আমার দু’জনেরই পরীক্ষা।
যখন সুযোগ হবে যাব নিশ্চয়ই।
তিন বাচ্চা নিয়ে তাই না? একটা তোমার কাঁধে, একটা আমার কোলে আর একটা পেটে। হানিমুন তখনই ভালো জমবে।
বেস্ট চয়েসের স্যানেটারি ন্যাপকিনের মডেলিং-এ বুবনা সুপারহিট। বাজার কোম্পানির প্রোডাক্ট নিয়ে নিয়েছে। ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোর বিলবোর্ডে বুবনাকে মিস করার উপায় নেই। একটি ডায়লগ বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের মুখে মুখে : …।
একটি বিলবোর্ডে বুবনা স্কিপিং করছে, একটিতে লনটেনিস খেলছে, একটিতে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে প্যাথলজিক্যাল ক্লিনিকে কাজ করছে, একটিতে দাপটের সঙ্গে সাইকেল চালাচ্ছে। সবগুলোতে একটি ডায়লগ : …।
বেস্ট চয়েস নারিকেল তেল কিংবা বেস্ট চয়েস ডুপ্লেক্স হাউজিং-এর ফ্ল্যাট বিক্রয়ের বিজ্ঞাপনের মডেল হলে তার ক্লাসমেট ও বন্ধুরা এতটা বাড়াবাড়ি করত না। স্যানিটারি ন্যাপকিন হওয়াতে আলোচনাটা বেশি হচ্ছে, কখনও তা শালীনতাকে তোয়াক্কাও করছে না।
মডেলিং-এ বুবনার রোল মডেল বলেছেন, কাউকে পাত্তা দেবে না, কারও কথা কানে তুলবে না, টাকা-পয়সা নিয়ে বেশি দরকষাকষি করবে না। রি-অ্যাক্ট করবে না, পত্রিকায় বাজে কথা লিখা হলেও প্রতিবাদ জানাতে যাবে না। মিডিয়ার সঙ্গে মেপে মেপে কথা বলবে, ইন্ডাস্ট্রির কারও সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করবে না। সময় থাকতে বাড়িঘর করে নিয়ো। শেষ জীবনটা যেন অর্থকষ্টে না কাটে- আগে থেকে প্রিপারেশন নিয়ো।
আপুর টিপস লিস্ট অনেক লম্বা। তবে বুবনার সবচেয়ে পছন্দের টিপস : রিমেম্বার, দিস ইজ ইয়োর লাইফ।
জীবনটা যখন তোমার, তোমাকেই গড়তে হবে।
বুবনার মডেলিং-এ জড়ানো যত বাড়তে থাকে পড়াশোনা থেকেও তত দূরে সরতে থাকে। বেস্ট চয়েস প্রোডাক্টস-এর বিজ্ঞাপন মানেই বুবনা। তাছাড়া এমন সুন্দর মুখই বা পাবে কোথায়।
বেস্ট চয়েসের কয়েকটি সিআরএস বিজ্ঞাপনেও বুবনা। একটি গাছের ডালে দু’দিকে দু’পা ছড়িয়ে বসে আছে বুবনা, মুখে মিষ্টি হাসি। নিচে লিখা আছে : আপনার মেয়ের মুুখে দুষ্টুহাসি দেখতে হলে গাছ লাগান, গাছ বাঁচান। সৌজন্যে বেস্ট চয়েস।
বুবনা সিনেমা থেকে ডাক পায়। একজন পরিচালক বুবনাকে রাজি করাতে আমাকে ঘুষ দিতে চান। টেলিভিশনেও হাজির হতে হয়। এতসব করতে করতে আমাদের মিস থার্ড ইয়ারের আর অনার্স ফাইনাল দেয়া হয়নি।
আমার অনার্স ও মাস্টার্স হয়ে যায়। খেটে পড়াশোনা করেছি, পত্রপত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি। গণিতে মাথা ভালো ছিল, বিজ্ঞান ও সাধারণ জ্ঞান আমার জন্য এমন কঠিন কোনো বিষয় নয়। সব মিলিয়ে চাকরির পরীক্ষায় পাস করতে অসুবিধে হয়নি। তাছাড়া বিসিএস গাইড থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক বিজ্ঞান আর মাসিক ডাইজেস্ট-পরীক্ষায় কাজে লাগাতে পারে এমন সব বই বুবনা কিনে দিয়েছে। পরিচিতি যখন রাস্তাঘাটে ঝামেলার মতো মনে হল বুবনা কালো বোরকাও পরে বের হয়েছে।
আমার প্রতিটি পরীক্ষা পাসের পরই বুবনা আমাকে বলেছে, তুমি পারবে। জানো তো মডেল, নায়িকা, খেলোয়াড় আর… একই অবস্থা। যতক্ষণ যৌবন আছে ডাক পড়বে। শরীরে একটু ভাটার লক্ষণ দেখা দিলেই লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ ছাড়া করে ছাড়বে। হলুদ কার্ড দেখিয়ে সতর্কও করবে না। রেফারি যখন আমাকে লাল কার্ড দেখাবে তুমি আমাকে দেখেশুনে রেখ। তুমিও আবার লাল কার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে যেয়ো না।
আমি একটি ব্যাংকে যোগ দিই। বছর না ঘুরতে চলে আসি অন্য ব্যাংকে। বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে ঢোকার আগ্রহ লোপ পেতে থাকে। আমার ক্যারিয়ার দাঁড়াবে ব্যাংকিং-এ।
মডেলিং-এ বুবনার সাফল্য আমাকে আর্থিক দুশ্চিন্তা থেকে শুধু মুক্ত করেনি, আমাকে স্বাচ্ছন্দ্য ও কিছু স্বাধীনতা দিয়েছে।
যখন আমার চাকরি হয়নি, মাসের প্রথম দিনই মনে করিয়ে দিয়েছে, আজ কিন্তু মাকে টাকা পাঠাতে হবে। এই নাও, আজই কিন্তু। অর্থাৎ বুবনার অর্জিত টাকা। মা মানে আমার মা।
আমি বুবনাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছি। বুবনাকে দেখতে শেরপুর রায়গঞ্জ এবং বগুড়ার কাছের ও দূরের আত্মীয়-স্বজন ভেঙে পড়েছে। টেলিভিশন বুবনার খ্যাতি অনেক দূর ছড়িয়ে দিয়েছে। শেরপুরের ছেলে রেজাই করিম পরীর মতো একটি মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে। পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে বুবনা তাদের মুগ্ধ করেছে : মেয়ে শুধু সুন্দরই নয়, তমিজও শিখেছে। ভালো বংশের মেয়ে নিশ্চয়ই।
মা বলে, এরপর আমার বেয়াই-বেয়াইনকে নিয়ে এসো। তোমার ভাইবোনদেরও এনো। গরিবের বাড়িঘর দেখে যাবে।
বুবনা বলে, আচ্ছা আম্মা।
মা বলে, আমার নাতি-নাতনি হওয়ার আগে এখানে চলে এসো।
বুবনা বলে, আচ্ছা আম্মা।
কোনোটাতেই তার না নেই। আচ্ছা আম্মা, আচ্ছা আম্মা।

মায়ের বেয়াই মানে কর্নেল নুরুস সাফা। সর্বশেষ যতটুকু আমার জানা বুবনার বাবা মর্নিং ও ইভিনিং ওয়াক ছেড়ে দিয়েছেন। সকালে বিছানা ছাড়েন না। সন্ধ্যায় একা একা মদ্যপান করেন এবং কিছুক্ষণ পরপর ‘ফায়ার ফায়ার’ বলে চিৎকার করেন, কল্পিত কোনো টার্গেটের দিকে তর্জনী তাক করে নিজেই মুখ দিয়ে শব্দ করেন ঠ্যাটটঠ্যাটটঠ্যাটট।
বুবনা স্যুটকেস নিয়ে সেই যে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে, আর যায়নি। লুবনার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কিংবা আমি দেখা করেছি। লুবনা বলেছে, আব্বুর মাথাটা সম্ভবত খারাপ হয়ে গেছে।
মায়ের বেয়াইন তারানা আনজুম বেঁচে আছেন কিনা কে জানে। বুবনা অবশ্য বিশ্বাস করে তার মা ভারতের কোথাও আছে, হেঁটে হেঁটে বাংলাদেশের দিকে আসার চেষ্টা করছে। একদিন ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে তার দেখা হবেই।
লুবনা অনার্স দেয়নি। তার আগেই বিদেশী পাত্রের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। পাত্র তৌকির সুলতান নিউ জার্সিতে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালায়। লুবনাকে ভিসার জন্য ছ’মাস ন’মাস অপেক্ষা করতে হয়নি। বউ হিসেবে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ বলে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়েছে। তৌকির চাচ্ছিল দেরি হলেও পাকাপাকিভাবে নেয়ার ব্যবস্থা করবে, কিন্তু লুবনা চেয়েছে এখনই যাবে, তাহলে পরীক্ষায় না বসার একটি নির্দিষ্ট অজুহাত মিলবে। বলবে, বাইরে ছিলাম, পরীক্ষা দেয়া হয়নি।
বিয়ের পরপরই বউ সঙ্গে নিতে ইতস্তত করায় লুবনা জিজ্ঞেস করল, তোমার সমস্যা কী? ওখানে কি বিয়ে করা একটা সাদা বউ আছে নাকি?
জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে তাদের রিসিভ করতে আসে লেবানিজ যুবক আবদুল্লাহ মোত্তাকিন। স্টেরিও অ্যাফেক্টে সারা পথ আফ্রিকান মিউজিক বাজিয়ে মাঝরাতে নিউজার্সি ফ্ল্যাটে ঢুকে লুবনা বুঝতে পারে ফ্ল্যাটটি সম্ভবত তৌকিরের একার নয়। আবদুল্লাহ মোত্তাকিন হুটহাট করে একটি রুমে ঢুকে পড়ল। ঢোকার আগে চেঁচিয়ে বলল, টোকির, ইউ স্লেপ্ট মেনি নাইটস উইথ দিস ওমেন, টুনাইট ইউ মাস্ট স্লিপ উইথ মি। আমার সঙ্গে আজ ঘুমাতেই হবে।
লুবনা একটা ধাক্কা খেল। প্রথমত: তৌকিরের ফ্ল্যাটে আবদুল্লাহ কেন? দ্বিতীয়ত: তৌকিরের ঘরে বউ রেখে একজন পুরুষ মানুষের সঙ্গে ঘুমোতে হবে- এ কেমন আবদার।
তাদের জন্য কেউ রেঁধে রাখেনি। তৌকির বলেছিল, রাস্তার পাশের ফাস্টফুডের দোকান থেকে কিছু একটা কিনে নিই।
লুবনাই বলল, ধ্যাৎ একটু আগেই না প্লেনে পেটভর্তি খাবার খেলাম। খাবারটা গলা থেকে অন্তত খানিকটা নামতে তো হবে। কাল সকালে খাব।
বাসায় খাবার নেই মানে যে ফ্রিজভর্তি বিয়ারের ক্যান ছাড়া কিছুই নেই এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। জেট-ল্যাগ লুবনাকে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। ঘোরের মধ্যে অনেকদিন পর তার দু’বছরের ছোট ভাই আইয়াজকে দেখতে পায় খালি গা, শর্টস পরা, একই পোশাকের আরও দু’জনের সঙ্গে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে বালির ওপর শুয়ে আছে। বুয়েটের ওরা চারজন সাগরের ভাটার টানে ভেসে গিয়েছে। আনন্দ ভ্রমণে কক্সবাজার এসেছিল। লাবণী পয়েন্ট দিয়েই নেমেছিল। তিনজনকে টেনে উঠানো সম্ভব হয়েছে, একজনের হদিস মিলেনি। জোয়ার এলে কলাতলি পয়েন্টে খোঁজ করলে মিলতে পারে।
লুবনা আসলে এভাবে নিথর আইয়াজকে শুয়ে থাকতে দেখেনি। যারা দেখেছে তাদের কাছে শুনে শুনে কল্পনায় এ ছবিটি নির্মাণ করেছে। আইয়াজের কফিন যখন লেক সার্কাসের বাসায় খোলা হয় লুবনা কান্নার বদলে জিজ্ঞেস করে ভেতরে এত চা পাতা কেন? বাবু চা পাতা দিয়ে কী করবে?
চা পাতা দিলে লাশে পচন ধরতে দেরি হয়। কক্সবাজার থেকে এতটা পথ- বুঝতে পারছ, কেউ একজন জাবাব দেয়।
লুবনা, জিজ্ঞেস করে কীসের লাশ?
তখনই ঘোরটা কাটে, তার ঘুম ভেঙে যায়। লুবনা ধাতস্ত হয়। ওগুলো যদিও আনন্দ ভ্রমণ ছাত্রছাত্রী এমনকি শিক্ষকদের বেলায়ও বলা হয় শিক্ষা সফর। ফাইয়াজরা চারজন মোটেল লাবণীতেই উঠেছিল। রাতেই সমুদ্রে নেমে পড়তে চেয়েছিল। সমুদ্র ডাকছে আয়, আয়। কিছুক্ষণ আগেই নামছিল ফাইয়াজ। আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যেও ওকে দার্জিলিং-এ রেখে টুয়েলভ ক্লাস পর্যন্ত পড়িয়ে আনা হয়েছে। মেধাবী ছেলে মেডিক্যালে চান্স পেয়েছে, বুয়েটেও।
আব্বু বলল, না, মেডিক্যাল।
ফাইয়াজ বলল, মানুষের এই পচনশীল শরীর নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই। ইট-পাথর-বালি পচে না। মেডিক্যাল আর ফিজিক্সের মধ্যে কম্প্রোমাইজ করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং সামনে রেখে বুয়েটে ভর্তি হল। সেই ফাইয়াজের নাম এখন লাশ। লাশের চারপাশে চা পাতা।
লুবনা উঠে বসে।
বিছানায় সে একা কেন?
তৌকির সুলতান কোথায়?