বিকেলের বেহাগ


চৌদ্দ
শীতকালে বিকাল খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়, ৫টাতেই ছায়া ঘনিয়ে আসে। ৪টায় ঘুম থেকে ওঠে এনায়েতুল্লা খাবার ঘরে এসে চা-নাস্তা খান। দাউদ তখনো অফিস থেকে এসে পৌঁছেনি; তুলি বাসায় থাকলে সঙ্গ দেয়, টেবিলে পরিবেশন করে জয়নাব।
আজ সাড়ে ৪টা বেজে গেলেও এনায়েতুল্লা তার ঘর থেকে বেরিয়ে চা খাওয়ার জন্য এলেন না। টেবিলে জয়নাব নাস্তা সামনে নিয়ে বসে আছে, তার উল্টো দিকে তুলি তার ক্লাসের বই খুলে পড়ছে মাথা নিচু করে। বাইরে বরকত দারোয়ান কারো সঙ্গে কথা বলছে, সে কথা শোনা যাচ্ছে। রাস্তা থেকে গাড়ি আর রিকশার শব্দ ভেসে আসছে জানালা গলিয়ে।
জয়নাব তুলির দিকে তাকিয়ে বলল, যা তো। দেখে আয় দাদু কী করছেন। বলবি নাস্তা তৈরি, আমরা অপেক্ষা করছি।
তুলি বই থেকে মুখ তুলে বলল, তাড়াতাড়ি কিসের?আসুক না দাদু যখন তার ইচ্ছা।
জয়নাব বলল, তার একটা অভ্যাস আছে; এই সময় চা-নাশতা খাওয়া। সেটা যেন ঠিক থাকে আমাদের দেখা উচিত। হয়তো ঘড়ি দেখছেন না, তাই বিকাল যে প্রায় শেষ এটা চোখে পড়ছে না তার।
তুলি চেয়ার থেকে উঠে তার স্যান্ডেল ঘসটাতে ঘসটাতে তার দাদুর ঘরের দিকে গেল, স্যান্ডেলের একটা স্ট্র্যাপ ছেঁড়া। শব্দটা শুনে জয়নাব তার পায়ের দিকে বিরক্তির সঙ্গে তাকালো। তার বিরক্তির আরো একটা কারণ তুলি যে জিন্স পরেছে, তার একটা পায়ের পেছন দিক অনেকটা ছেঁড়া, নিচে থেকে হাঁটু পর্যন্ত দেখা যায়। হোক না বাড়িতে, এমন বেখেয়াল হয়ে থাকা তার মোটেও পছন্দ না। ভদ্রতা সব জায়গাতেই রাখতে হয়, ঘরে বাইরে সমান, এটা বিশ্বাস করে জয়নাব। সে তীক্ষè চোখে তুলির হাইট
দেখে, যেন এই প্রম চোখে পড়লো। তার বয়স এখন ষোলর কিছু বেশি; সেই হিসাবে আরো একটু লম্বা হওয়া উচিত ছিল, ভাবল জয়নাব। চুলও বেশ লম্বা হয়ে গিয়েছে, কেটে ছোট করা দরকার। বলবে সে তুলিকে, শুনবে কিনা কে জানে।
তুলি তার দাদুর ঘরের ভেজানো দরজা নক করলো। ঘরের ভেতর থেকে কোনো সাড়া এলো না। সে একটু ঠেলে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। একটা যন্ত্রসঙ্গীত শোনা যাচ্ছে, লো ভল্যুমে। বেশ একটা ধ্যানমগ্ন ভাব সুরে, সেই সঙ্গে করুণও শোনাচ্ছে।যেন কোনো ভক্তের প্রাণের আকুতি যন্ত্র সঙ্গীতের সুরে বাঁধা। সে জানালার দিকে তাকালো। গ্রিলের ওপাশে লতানো গাছগুলোর পাতার ভেতর দিয়ে বিকেলের আলো উজ্জ্বল সবুজ হয়ে উঠেছে কিন্তু সকালের মতো ঘরের ভেতর ঢুকছে না। সবুজ আলো বাইরে থেকেই উঁকি দিচ্ছে ঘরের ভেতর লাজুক ভঙ্গিতে, ইতস্তত করে। একটু পর পর বাতাসে লতানো গাছের পাতাগুলো কাঁপছে, সেই সময় সবুজ রঙ নেচে উঠছে যেন। একটা সবুজ
হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে বাইরে।
ঘরের ভেতর একপাশে তাকালো তুলি; দেয়াল ঘেঁষে বিছানায় শুয়ে আছে দাদু। ঘুমোচ্ছে, চিৎ হয়ে,সটানে। একটা নকশি কাঁথা বুক পর্যন্ত টেনে দেয়া;দেখেই চিনলো তুলি। আমেনা যখন এখানে ছিল সেই সময় অবসরে সেলাই করেছিল; তার জামাইয়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আগে কাঁথাটা সে দাদুকে উপহার দিয়ে যায়। দাদু খুব খুশি
হয়েছিলেন, হাতে নিয়ে বলেছিলেন, বাহ! তোর তো অনেক গুণ। খুব সুন্দর হয়েছে। আমি এই শীতেই ব্যবহার করবো; দুপুরে ঘুমোনোর সময়। তুলি দেখলো বিছানার পাশে দাদুর মাথার কাছাকাছি মেঝেতে একটা বই পড়ে আছে। সে বুঝলো দাদু ঘুমোনোর আগে পড়ছিলেন, ঘুম এসে গেলে হাত থেকে পড়ে গিয়েছে। সে এগিয়ে গিয়ে নিঃশব্দে
বইটা তুলে নিলো; তাকিয়ে দেখলো বইটা কোয়েলহোর ‘দি অ্যালকেমিস্ট’। বইটা সে পান্থপথে এক হকারের কাছ থেকে কিনে দাদুকে পড়তে দিয়েছিল, বলেছিল এই লেখকের আরো বই তার কাছে আছে। ভালো লাগলে সে তাঁকে অন্য বইগুলোও দেবে। বইটা টেবিলে রাখতে গিয়ে সে দেখলো ভেতরে কয়েকটা পাতায় হলুদ মার্কার দিয়ে দাগ দেয়া। সে এই দাগ দেয়নি, নিশ্চয়ই দাদু দিয়েছে। সে কৌতূহলী হয়ে জায়গাগুলো দেখলো যেখানে মার্কারে হলুদ দাগ :
‘It’s the possibility of having a dream come true that makes life interesting.’ ‘When you really want something, the
universe always conspires in your favour.’
‘It’s not what enters men’s mouths that’s evill’, said the alchemist. ‘It’s what comes out of their mouths that is.’
‘When we strive to become better than we are, everything around us becomes better, too’
জায়গাগুলোর লেখা পড়ে খুশি হলো তুলি; সে বুঝলো যে বইটা দাদু বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়েছে। তাঁর ভালো লেগেছে লেখকের দার্শনিক-আধ্যাত্মিক কথাগুলো। টেবিলে বইটা রেখে সে ফুলদানির রজনীগন্ধাগুলো দেখলো; অর্ধেক শুকিয়ে হলুদ দেখাচ্ছে। কোনো গন্ধ নেই, আজকাল রজনীগন্ধায় গন্ধ প্রায় থাকেই না। শুধুই দেখার জন্য। বেশ সুন্দর দেখায় যখন তাজা থাকে, মনে হয় সাদা পায়রা বসে আছে। আগে টেবিলে কোনো ফুলদানি ছিল না, ফেং সুইয়ের ডিজাইন করার সময় সে এটা এখানে এনে রেখেছে। দু’দিন পর পর নতুন ফুল রাখা হয়;কখনো গোলাপ, কখনো রজনীগন্ধা, আবার কখনো অর্কিড। অর্কিড ফুল অনেকদিন তাজা থাকে, রঙটাও চমৎকার, হালকা বেগুনি। দাদুর খুব পছন্দ। সে ফুলদানি থেকে বাসি রজনীগন্ধাগুলো নিঃশব্দে তুলে নিলো। সালাম ড্রাইভারকে ফোন করে বলবে আব্বাকে অফিস থেকে নিয়ে আসার সময় রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ফুলের দোকান থেকে অর্কিড কিনে নিয়ে আসবে। ফুলদানি খালি থাকবে না বেশিক্ষণ,হয়তো দাদু জেগে উঠবার আগেই অর্কিড এসে যাবে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে আজ দেরিতেই ঘুমিয়েছেন; উঠতে দেরি হবে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যাও হয়ে যেতে পারে।
টেবিলের পাশে দাদুর গান শোনার থ্রি-ইন-ওয়ান একটা শোকেসে রাখা। এখন চালু তাই সবুজ বাতি দেখা যাচ্ছে। সে কাছে গিয়ে যে ক্যাসেটের গান হচ্ছে সেটা হাতে নিয়ে দেখলো; ওস্তাদ বেলায়েত হোসেন খানের সরোদ। রাগ আহির ভৈরব। সে পড়ে দেখলো এই রাগ সাধারণত সকালেই বাজানো আর শোনা হয়; রাগ ভৈরবের একটা শাখা। দাদুর নিশ্চয়ই খুব পছন্দ, তাই সকাল-বিকেল মানেন না শোনার সময়। ক্যাসেটের ওপরের লেখা অনুযায়ী রাগের আলাপ অনেক আগেই শেষ হয়েছে এখন হয় তিনতালে ‘গাট’ হচ্ছে অথবা শেষ পর্বে গিয়ে ‘ঝালে’পৌঁছেছে। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের এইসব রাগতাল সে বোঝে না, কিন্তু মনোযোগ দিয়ে শোনার পর
সরোদ কিংবা সেতারে মূর্ছনা তাকে আচ্ছন্ন করে।
এখন, এই মুহূর্তে আহির ভৈরবের রাগ শুনে তাঁর ভেতর একই সঙ্গে প্রশান্তি আর বিষন্নতার ভাব জেগে উঠলো। সে একটু সময়ের জন্য আনমনা হয়ে গেল,
কেন এসেছে এই ঘরে সে কথা মনে থাকলো না।
সে তাকিয়ে দেখলো আরো কয়েকটা ক্যাসেট ছড়ানো। রাজেশ্বরী দত্ত, পঙ্কজ মল্লিক, সনজিদা খাতুন, অদিতি মহসিন, লোপামুদ্রা এবং আরো কয়েকজন। দাদু রবীন্দ্র সঙ্গীতের খুব ভক্ত। আজকাল একটা গান প্রায়ই শোনেন :
‘প্রাণে খুশির তুফান
উঠেছে/ ভয়-ভাবনার বাধা টুটেছে।’
তুলি যখন শোনে হাসে, কিছু না বলে দাদুর দিকে তাকায় হাসি মুখে। সে ক্যাসেটগুলো নেড়েচেড়ে দেখে; তার দেয়া দুটো সিডিও রয়েছে; শিরোনামহীন ব্যান্ডের রবীন্দ্র
সঙ্গীতের অ্যালবাম; অরূপ রাহীর ব্যান্ড মিউজিকে লালন সঙ্গীত।
হঠাৎ মেঝের দিকে তাকিয়ে একটু চমকে উঠলো তুলি। কখন জানালা গলিয়ে এক ফালি রোদ ঘরের মেঝেতে এসে পড়েছে তারপর হামাগুড়ি দিয়ে দেয়ালে ওঠার চেষ্টা করছে তা তার চোখে পড়েনি।
দেয়ালে দাদীর ছবি; বিকেলের হলুদ আলোটা যেন সেই ছবিটাকে স্পর্শ করতে চাইছে। দাদীর ছবিটা অয়েল পেইন্টিংয়ে করা। লার্জার দ্যান লাইফ। মনে হয় যেন তিনি হাসছেন তাঁর দিকে তাকিয়ে। ছবির সব মানুষ তাই করে, যে তাকায় তার দিকে তাকিয়ে হাসে। ছবিটা তুলি এমন ভাবে টাঙিয়েছে যে দাদু বিছানায় শুলেই চোখে পড়বে, ঘুমোনোর আগে।
দাদু লম্বা হয়ে তাঁর বিছানায় শুয়ে আছেন, বুক পর্যন্ত আমেনার সেলাই করা কাঁথা বিছানো। বিকেলে শীত ভাবটা বেশ টের পাওয়া যায়। এখন দাদু নিশ্চয়ই রোজই কাঁথাটা শোয়ার সময় ব্যবহার করেন। তুলি তাকিয়ে দেখে দাদুর মাথার সাদা চুলের একগোছা কপালে এসে পড়েছে। তাঁর কপাল মসৃণ আর প্রশস্ত;কোনো ভাঁজ পড়েনি। চোখের ভ্র-গুলো সাদা-পাকা;লম্বা নাকটা বন্ধ ঠোঁটের কাছে এসে সুন্দরভাবে দুই দিকে একটু ফুলে ছড়িয়ে আছে। তাঁর ঠোঁটে স্মিত হাসি, যেন তাকে দেখতে পেয়েছেন।
তুলি একবার ভাবলো দাদুকে ডেকে তোলে।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সে ঘর থেকে চুপচাপ বেরিয়ে এলো। ঘরের ভেতর তখনো আহির ভৈরবের রাগ তিনতালে এগিয়ে চলেছে বিনম্র আর করুণ সুরে।
তাকে একা আসতে দেখে জয়নাব সপ্রশ্নে তাকালো।
সে কিছু বলার আগেই তুলি বলল, দাদু ঘুমোচ্ছে।মনে হয় আজ দেরিতে শুয়েছে।
শুনে জয়নাব টেবিলে রাখা খাবারগুলো দেখলো।
তারপর উঠে রান্নাঘরের সামনে গিয়ে বলল,আমেনার মা, বাবার নাস্তাটা নিয়ে যাও। যখন খেতে আসবেন গরম করে দিয়ো। তুলির আব্বাও এসে যাবে কিছুপর। দু’জনকে একসঙ্গেই নাস্তা দেবে খেতে। আমেনার মাকে নির্দেশ দেয়ার পর টেবিলে এসে তুলির হাতে রজনীগন্ধার ডাটাগুলো দেখে বলল, খুব বাসি হয়নি। আরো কয়েকদিন চলতো।
তুলি ডাটাগুলো একটা ওয়েটপেপার বাস্কেটে ফেলে দিয়ে বলল, হলুদ হয়ে গিয়েছে। খারাপ দেখায়।
আমি সালাম ড্রাইভারকে অর্কিড আনতে বলে দিয়েছি।
জয়নাব শুনে ভ্র-কুঁচকে তুলির দিকে তাকালো; কিছু বলল না। আর তখনই বাইরে গাড়ি বারান্দায় গাড়ি থামার শব্দ শোনা গেল। তুলি বই থেকে মুখ তুলে বলল, আব্বা এসে গিয়েছেন। সালামের কাছ থেকে অর্কিড ফুল নিয়ে আসি। বলে সে চেয়ার থেকে উঠে বাইরে গাড়ি বারান্দার দিকে গেল।
পেছন থেকে জয়নাব বলল, আসুক না ভেতরে। এত তাড়াতাড়ি কি?
তুলি যেতে যেতে বলল, দাদু ঘুম থেকে ওঠার আগেই ফুলদানিতে অর্কিডগুলো রাখবো খুব সারপ্রাইজড হবে ঘুম থেকে উঠে।

শেষ