কেরানিও দৌড়ে ছিল


১০
অধিক জাল দিলে দুধ ঘন হয়। অধিক কথায় পাতলা হয় কথা। আমরা কথাকারেরা এ সকল যদি না বুঝি তবে কহনে নামাটাই বিড়ম্বনা। অতএব অধিক কথায় কাজ নাই। আমাদের ও খোদ কেরানির পক্ষেই অতঃপর যে অবিশ্বাস্য ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা তার বাহানা সৃজন না করে বলেই ফেলা যাক রুহিতনের সঙ্গে কেরানির বিয়ে হয়ে যায়। আপনারা সংসারবিজ্ঞ বলে মান্য করি বটে, কিন্তু সংসারের রহন-চলন দেখে আপনারই যে থমকে যান, এটাও তো দেখি। অনুনয়, আপনারা সঙ্গেই থাকুন।
তবু একটু ঘটনার চকমক একটু দেখে নিই এখানেই। রুহিতনের সঙ্গে কেরানির বিয়েটা পুরনো ঢাকার গলি তস্য গলির ভেতরে বেশ ধুমধাম করেই হয়ে যায়। এক রাতের জন্যে রঙিন বিজলি মরিচ বাতিতে ঝলমল করে ওঠে গলি। কনের বাবা বুলবুল মিয়া খরচের কোনো কসুর করে নাই। আর করবেই বা কেন? একমাত্র মেয়ে। জান দিয়ে ভালোবেসেছে তাকে বাবা।
পাড়াবেড়ানির জন্যে নিত্য খোঁটা দিতো যে আম্মাজান, সেও অঝোরে চোখের পানি ফেলে। বিয়ের পরে কেরানি যে ঘরজামাই হিসেবে এ বাড়িতে থাকবে, এটা বলা না হলেও সব পক্ষই জানে। বাবা মা তো জানেই, কেরানিও জানে। তবু মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই যে পর হয়ে যাওয়া, সর্বকালের এই বোধটি রুহিতনের মাকে চোখের পানিতে ভিজিয়ে রাখে। চোখের পানি, তারপরও জননীর মুখে হাসির ছটা। মেয়ের শুভবিবাহ! পাড়া-পড়শী বৌ-ঝিয়েরা তাকে সাহায্য করতে ব্যস্ত। পুরান ঢাকার সব জৌলুস জেল্লা গেলেও এতটা এখনো আছে_ ঢাকাই জবানে_ হামদরদি! ভালো বাংলায়_ সহমর্মিতা। হয়তো বা এই যে পুরান ঢাকার সব গেছে বলেই পড়শীদের মধ্যে মহব্বতি আরো চোখে পড়বার মতো হয়ে পড়েছে। বিয়ের কথা ঠিক হবার পরদিন থেকেই পড়শী বৌ-ঝিদের কলকলানি শুরু হয়ে যায়। গায়ে হলুদের দিন কিভাবে কী হবে, বিশেষ যখন বর আর কনে একই বাড়ির! সেটা কি ঠিক হবে? তারচেয়ে কয়েকদিনের জন্যে বর কেরানিকে পাশের কোনো বাড়িতে তোলা হোক না কেন? তারপরে আরো আছে। কনের সাজ কেমন হবে? বাসর ঘর কে সাজাবে? খানা কী কী পদের হবে? গীত কারা গাইবে? গলির ময়লা-জঞ্জাল সরিয়ে কোথায় ফেলে হবে? কত রকমের সমস্যা। একেক বৌ-ঝির একেক পরামর্শ। মনান্তর। মতান্তর। ঝগড়া। আবার মুহূর্তেই সব ঠিক। আবার হাসি হুল্লোড়ে ভেঙে পড়া!
মরদ মহলেও কত রকমের কথাবার্তা। -ওই মিয়া, খানা কী হইবো, কুন বাবুর্চিরে খবর দিবা, আগে হেইটা ঠিক করো। -আরে মিয়া, গেট বানতে হইবো না! গেট দিতে হইবো গলি্লর মুখ থিকা, মাথার উপ্রে মরিচ বাত্তির চাদর হইবো, টানা চইলা আসবো বুলবুল মিয়ার বাড়ি তক্। -আহুক! মানা করছে ক্যাঠা? বাত্তি না হইলে বিয়া কিসের!
আয়োজন তোড়জোড় দেখে কেরানি বিহ্বল হয়ে যায়। মাত্রই সাতদিন আগে যে সে দেশের বাড়ি হস্তিবাড়ি গিয়ে মদিনাকে বিয়ে করে এসেছে, সেটা তার কাছে বিয়ে বলেই মনে হয় না। এই তো বিয়ে! এটাই তো বিয়ে! এই না হলে বিয়ে! সে মত্ত হয়ে থাকে, বিভোর হয়ে থাকে চারদিকের কলরব আর ব্যস্ততা দেখে। মন তার একেবারে উন্মুখ হয়ে থাকে বিয়ের জন্যে। ভুলেই যায় সে মদিনার কথা। তবে, এই বিয়েটার জন্যে তার বশ হয়ে থাকাটার পেছনে আরো একটা কারণ আছে। গোপন কারণ। কেরানি টের পায় তার শরীরে রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠেছে রুহিতনের জন্যে। মদিনাকে শরীরে পায় নাই। মদিনা? কে মদিনা? রুহিতনই তো তার চাওয়ার ভেতরে ছিলো! যে রাতে আফলাতুন মিয়া রুহিতনের সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাব তোলে, সেই রাতেই সে এই উষ্ণতা প্রথম ঠাহর করে ওঠে।
পরদিন বুলবুল মিয়া নিজে কেরানিকে সঙ্গে করে সদরঘাটে যায়। নিজে সে লঞ্চ কোম্পানির ম্যানেজারের কাছে কথা উত্থাপন করে। জজ মিয়ার বিয়া ঠিক হইছে, তারে ছুটি দেওন লাগবো। বুদ্ধিটা কেরানিই দিয়েছিলো। এই একদিন আগে এক সপ্তার ছুটি নিছি আব্বার অসুখ বলে। আবার কি তারা ছুটি দেবে?
এই যে বুলবুল মিয়ার সঙ্গে তার সদরঘাটে আসা, আসার মুখেই একটা দৃশ্য কেরানির চোখে পড়েছিলো। আপাতত সে দৃশ্যের সঙ্গে ঘটনার নগদ গতির কোনো সংস্রব আমরা বা খোদ কেরানি আবিষ্কার করতে না পারলেও, পরে, মাস ছয়েক পরেই দেখতে পাবো। সে কথা এখন নয়_ যথাকালে বলা হবে। তবু দৃশ্যটা এক ঝলক দেখে নেয়া যাক এখনি।
সদরঘাটে এসে লঞ্চে ওঠার জন্যে পাটাতনে পা রাখতেই কেরানির চোখে পড়ে সেই পাগলিকে। পা ছড়িয়ে বসে আছে পাগলি। গায়ে নীল ছিটের জামা। পাজামাও বেশ নতুনই মনে হচ্ছে। আর মাথার চুল দু’বেণী করা, বেণীর ডগায় লাল ফিতে! দেখে অবাক হয়ে যায় কেরানি। চুলের সেই জট গেলো কোথায়? বেশ তেল চকচকেই তো এখন দেখাচ্ছে। আর নতুন জামা পাজামাই বা পাগলির জুটলো কোথা থেকে! এক পলক তার দিকে তাকিয়েই সে বুলবুল মিয়ার পেছন পেছন লঞ্চে উঠে যায়। ছবিটা তার মনে লয় পায়। নগদ তার ছুটি পাওয়ার ব্যাপারটাই তাকে বিবশ করে রাখে।
ছুটি সে পায়। তবে বিনা বেতনে ছুটি, তাও মাত্র তিনদিনের বিষ্যুদ, শুক্কুর আর শনিবার। মালিকপক্ষ দয়াপরবশ হয়ে এটাও মঞ্জুর করে যে, গায়ে হলুদের কারণে বিয়ের দু’দিন আগে তার আর লঞ্চে বরিশাল যাত্রা করার দরকার নাই, ঢাকাতেই অফিসে হাজিরা দেবে। মালিক আহমদউল্লাহ্র কাছে বুলবুল মিয়া নিজেই আবদার আর্জি করেছিলো। আহমদ উল্লাহ্ দার্শনিক ভঙ্গিতে বলেছিলো, গরীবের হাউশ করলে চলে না। বিয়া হলুদ দিলেও হইবো, না দিলেও! গরীবের অ্যাতো হাউশ কলাম আখেরে হয় পোন্দে বাঁশ!
হেঁ হেঁ করে হাসতে হাসতে আহমদ উল্লাহকে তোয়াজ করে বুলবুল মিয়া বেরিয়ে এলেও গায়ে হলুদের আঞ্জাম করতে সে কসুর করে নাই। আর ওই যে পাড়ার বৌ-ঝিয়েরা তাল তুলছিলো এক বাড়িতে বর কনের গায়ে হলুদ কোনো কাজের কথা নয়, পাড়ার নান্নু মিয়া বলে, ক্যাল্লা! আমরা কি মইরা গেছি নি? রুইত্তন কি আমগো মাইয়া না? বুলবুল মিয়া কি কারবালায় পড়ছে নি! বিয়ার আগের তিনদিন জজ মিয়া আমার বাড়িত থাকবো। আমার বাড়ি থিকা নওশা যাইবো। হইলো?
নান্নু মিয়া আর তার ভাই পান্নু মিয়ার যুগল ব্যবসা, ব্যান্ডপার্টি আর বিয়ের সরঞ্জাম সরবরাহ করা। নতুন ঢাকার মানুষেরা বিয়ের সরঞ্জাম এলিফ্যান্ট রোড থেকে কিনে বা ভাড়ায় জোগাড় করলেও ব্যান্ড পার্টির দরকার হলে এই পুরান ঢাকায় আসে। পান্নু মিয়াই তখন তাদের ভরসা। পান্নু মিয়ার ব্যান্ড পার্টিও বড় চমকদার, যেমন ইংলিশ সাজপোশাক তেমনই বাজনদারদের জমকালো বাজনা।
বিয়ের দিন সেই ব্যান্ড পার্টির ভ্যাঁপর-ভোঁয়ে কাকপক্ষী বসবার সুযোগ পেলো না। ওদিকে নাছির বাবুর্চি মোতায়েন হয়েছে, তার কাচ্চি বিরিয়ানির ডেগ থেকে খোশবাই উঠে পাড়া মাত করছে। শাদী মেজবানিতে সেদিন পাড়ার মানুষ তো ঠেলে এসেছিলোই, আর এসেছিলো ঘোড়ার গাড়ির বহর। এরা সবাই বুলবুল মিয়ার মতো ঢাকা শহরে বেড়ানো মানুষদের নিয়ে চক্কর দেয়। একেকটা গাড়ির সে কী সাজবাহার। যেন দুলদুল ঘোড়ার কারবার। কিন্তু তার ভেতরে চোখে পড়বার মতো সাজ বরের ঘোড়াগাড়িটির। রঙিন কাগজ আর ফিতের ঝালর। ঘোড়া দুটির চোখমুখ ঢেকে সাজ পরানো হয়েছে। আর বাড়তি লাগানো হয়েছে ঘুঙুর। ঘোড়া পা নাড়ছে কি টুনটুন করে বেজে উঠছে! বিয়ে তো বাড়ি-বাড়িতেই। বরও যে-বাড়ির, কনেও সেই একই বাড়ির। এ ঘর আর ওঘর। তাই বলে তো বরযাত্রা ভিন্ন বিয়ে হতে পারে না। অতএব বিয়ের দিন সন্ধ্যাকালে বুলবুল মিয়ার বাড়ির তিন বাড়ি পরে নান্নু মিয়ার বাড়ি থেকে কেরানিকে বরের পোশাক পরিয়ে তোলা হয় গাড়িতে। বরের গাড়িটি বুলবুল মিয়ারই সম্বন্ধী কওছার মিয়ার। সেও ঘোড়াগাড়ি চালায়। গাড়ি তো বরের জন্যে স্পেশাল করে আজ সাজিয়েছেই, নিজেও চোখে সুরমা দিয়েছে, আর মাথায় পরেছে চুমকি বসানো সবুজ টুপি। ঢাকার নবাববাড়ির কোচোয়ান ছিলো তার দাদাজান। সে কথা নতুন করে সে আবার সকলকে মনে করিয়ে দেয়।
জমানা ভি গ্যাছে! আরবী ঘোড়া ভি গ্যাছে। তয় নাছের কুচোয়ানের নাতি এলাও জিন্দা আছে এই বান্দা কওছার মিয়া। আর আমার ঘুড়া ভি হেই আরবী ঘুড়া না হইলেও পঙ্খীরাজের বাচ্চা। ঘুড়রে ছাজ পরাইতাছি কালে আমার কানে কানে কয়, মহল্লার শাদী, নওশা তো একদিনের নওয়াব ছাব, পঙ্খীরাজের লাহান উড়ায়া লিয়া যামু দুলহানের বাড়ি!
কওছার মিয়ার বাক বিস্তার শুনে বুলবুল মিয়া একটু ভড়কেই গিয়েছিলো। সেও তো পুরান ঢাকারই মানুষ, সে জানে এত বাহাদুরির পরেই আসবে ভাড়ার প্রশ্ন। পাঁচশ’ হাজারই না চেয়ে বসে।
আরে, তুমি কও কী! মাথামুথা খরাব হইছে নি তুমার। তুমার মাইয়ার শাদি। পহা লমু! তোবা তোবা! দ্যাহো না, ঘুড়া আর গাড়ির এমুন ছাজ ছাজাইছি নওব ছলিমউল্লা ভি টাছকি খাইতো! তো ছাজাইছি আমার মন খুছিতে! রইত্তনের বিয়া না আমার মাইয়ারই বিয়া। তয়, দিও! দিও তুমার মন যা চায়। না দ্যাও তো গিল্লা নাই। ঘুড়ারে দানাপানি দিও, তাতেই হইবো!
বুলবুল মিয়া মনে মনে ভেবেছিলো তার গাড়িতেই বর বসবে। সে কথা শুনে এই কওছার মিয়াই কলরব করে উঠেছিলো, এইডা কুন জাতের কথা, অ্যাঁ? হছুর টানবো গাড়ি আর নওশা বইবো হেই গাড়িতে! আক্কেলখান কি! আমরা কব্বরে গেছি নি? দামাদরে লিয়া আমরা যাত্রা করুম। চকে চক্কর দিমু নওশা লিয়া। মাইনষে চায়া দেখবো! জিগাইবো, কার শাদী? আর কার? বুলবুল মিয়ার মাইয়া রইত্তনের।
কওছার মিয়া যখন সাজ পরিয়ে গাড়ি এনে গলিতে ঢোকায়, দেখে তাক লেগে যায় সবার। যেন ইন্ডিয়ার লাটবাহাদুরের গাড়িটা ঝিলিক দিচ্ছে বাহারি সাজে। কিন্তু বরকে নিয়ে চকবাজার চক্কর দেয়াটা নেহাত কথার কথা। সে দিন গত হয়ে গেছে।
সেই সেকালে বরের গাড়ি নিয়ে কনের বাড়ি বরযাত্রা করে যাবার আগে চকবাজারে চক্কর দেবার রেওয়াজ ছিলো। চকে তখন বিকাল থেকে শহরের খোশবাসী মানুষেরা শরবতের দোকানে দোকানে আড্ডা জমাতো। শরবত চলতো, আর চলতো হুঁকা ফরসি টানা। বরের গাড়ি দেখেই তারা সজাগ হয়ে জিগ্যেস করতো, কার শাদী! তখন বরের গাড়ির সমুখে আলগা ঘোড়ায় বসা বরপক্ষের মাতবর একজন হাঁকতো অমুকের বেটা অমুকের সাথে অমুকের মাইয়া অমুকের সাথে শাদীর জলুশ লইয়া যাত্রা করছি! খোশবাসীরা প্রশ্ন করতো, কয় চক্কর? উত্তরে বলা হতো_ তিন কি পাঁচ কি সাত কি সর্বোচ্চ এগারো চক্কর। বরের সামাজিক অবস্থানভেদে চক্করের সংখ্যাটা বলে দিতো পাড়ার সর্দার। সর্দারের কাছে হুকুম এনে তবে বরযাত্রা করা হতো। সেকালে রেডিও টেলিভিশন খবরের কাগজ ছিলো না। চকে চক্কর দেয়ার উদ্দেশ্যই ছিলো বিয়ের খবরটা সেদিনের ঢাকা শহরকে জানানো।
যদি সেই সর্দারদের আমল থাকতো ঢাকায় তাহলে আমাদের কেরানির জন্যে তিন চক্করের হুকুম হতো। ওটাই সমাজের একেবারে নিচুতলার জন্যে ছিলো বাঁধা। এখন সেদিন নাই। চক্করও এখন নিজের হাতেই। আর সে চকবাজারও আগের হালে নাই। সেই সেদিনের চক পাকিস্তান হওয়ার পরপরই আগুনে পুড়ে যায়, তারপর দিনে দিনে জঙ্গল হয়ে ওঠে দালান আর আধুনিক দোকানপাটের। সেই শরবতের দোকানও নাই, শহরের খোশবাসীরাও আজ নাই। কেরানির বরযাত্রা যে সুরিটোলা থেকে চক পর্যন্ত যাবে, তারও জো নাই।
অতএব নান্নু মিয়ার বাড়ি থেকে আমাদের কেরানিকে বর বেশে তুলে কওছার মিয়া রওনা হয় চক্কর দিতে। চক্কর তো নয় রেওয়াজ রক্ষা। মানুষ মরে, কাল বিগত হয়, রেওয়াজটা থেকে যায়_ বিশেষ করে জন্ম মৃত্যু বিবাহ ব্যাপারে। নিত্যই আমরা তা দেখি। এবং অনেক সময় আমরা তার প্রসঙ্গটাও বুঝি না। কেরানিকে নিয়ে আশেপাশেই খানিক চক্কর দিয়ে, সুরিটোলা থেকে ছাতা মসজিদ হয়ে বংশালের মুখ থেকে ফিরে আবার সেই সুরিটোলায় আসে বরযাত্রীরা। গলির মুখেই ব্যান্ড পার্টির বাজনদারেরা তৈরিই ছিলো। তারা ভ্যাঁপর-ভোঁ করে ওঠে হিন্দি ছবির গানের সুরে। দিদি তেরে দেবর দিওয়ানা! বুলবুল মিয়া সমাদর করে কেরানিকে নামায়। বিয়ে বাড়িতে ঢোকার গেট আটকে দাঁড়িয়ে আছে পাড়ার মেয়েরা। আমরা তো জানিই আমাদের কেরানিটির মুখচ্ছবি অনিন্দ্য সুন্দর। নওশা বেশে তাকে শাহজাদার মতো রূপ ফুটেছে। মেয়েরা তার সেই অপরূপ কান্তি দেখে বিস্ময়ে ঈর্ষায় বুক ঠেলে হিসহিস করে ওঠে। আহা, রুহিতনের এমন ভাগ্য! এত সুন্দর বর!
আমাদের কেরানি কিন্তু তখন জ্ঞানহারা। পুরোপুরি জেগেই আছে সে, স্বপ্ন নয়, তবু যেন স্বপ্ন। বিভোর বিহ্বল তার মনের দশা। যেন তার বিশ্বাসই হতে চায় না, তাকে নিয়েই এসব হচ্ছে? সে স্বপ্ন দেখছে না তো!
তার মনের মধ্যে কে যেন কথা কয়ে ওঠে_ বিয়ে যদি, তবে এটাই তো বিয়ে! রুহিতন! সেই রুহিতন! বুলবুল মিয়ার বাড়িতে জায়গীর হয়ে আসবার প্রথম দিনেই মেয়েটাকে তার চোখে পড়েছিলো। তারপর দিনে দিনে তাকে নিয়ে কেমন যেন ভালো লাগা! লঞ্চ থেকে নেমে ক্লান্ত পায়ে বাড়িতে এসে আর কারো জন্যে নয়, রুহিতনকে একটু চোখে দেখবার আশা, নেশা! তারপর সেই টেলিফোন_ আমি পলাইতেও রাজি! আব্বা আম্মা রাজি না হইলে আপনের লগেই! সেই রুহিতন! একটু পরেই সে হবে তার বৌ! উষ্ণ হয়ে ওঠে শরীর, ছলকে ওঠে রক্ত। হাঁ, নেশার ঘোরেই কেরানি এখন জ্ঞানহারা।
তার মনের মধ্যে এখন শুধু রুহিতন আর রুহিতন। আর তাকে নিয়ে এই যা হচ্ছে, এই রঙিন আলো, এই কলরব, এই ব্যান্ড পার্টির বাজনা, মেয়েদের ওই গেট আটকে দাঁড়ানো, এ সবই তার কাছে সিনেমার মতো মনে হয়। বুকের ভেতরে খুশি নাচে। এমন খুশি তার পনেরো দিন আগের বিয়েতে এতটুকু সে হয় নাই। এক শুক্রবার আগের শুক্রবারে দেশের বাড়ি হস্তিবাড়িতে সে মদিনাকে বিয়ে করে এসেছে। বিয়েটা তো করা নয়, নিজের ইচ্ছায় নয়, কেরানির পরিবারের ইচ্ছাতেই বিয়েটা। সে বিয়েতে সে শুধু নাটকের চরিত্রের মতো পার্ট করে গেছে। আর, এই যা হচ্ছে এটাই জীবন। এখানেই জীবন।
কলমা পড়বার মুহূর্তে, ধুর ছাই, কেরানি তুতলে ওঠে। কবুল বলতে গিয়ে_ ক-ক-ক-কবুল! একবার যেন সেই ছবিটা ফিরে আসে। না, হস্তিবাড়ির মসজিদে ঠাণ্ডা মেঝের ওপর বসে সেই কবুল বলা নয়, বাসরঘরে মদিনার সেই মুখগুঁজে বসে থাকার ছবিটি নয়, মদিনা নাম শুনেই তৎক্ষণাৎ পুণ্য এক স্থানের নাম মনে পড়ে চমকে ওঠা নয়- কেরানির মনে পড়ে, মনের পর্দায় ভেসে ওঠে মদিনার সেই মুখ, কেরানি যখন ঢাকায় ফিরে আসবার জন্যে ঘর থেকে পা ফেলেছিলো, সেই ভোর রাত, সেই আলো-আঁধারি, পথে পা রেখে একবার সে পেছন ফিরে তাকিয়েছিলো, ভেবেছিলো বড় বুবু তখনো লণ্ঠন হাতে দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে, না, বড় বুবুর পাশে দুয়ারের পাট ধরে তাকিয়ে ছিলো মদিনা! মুখখানা মোটে দেখা যায় নাই, কারণ তখনো আলো ফোটে নাই, বড় বুবুর লণ্ঠনের আলো তার মুখে পড়ে নাই যে ফুটে থাকবে মুখ। কেবল একটা শরীরের ছবি। দুয়ারের পাট ধরে। অন্ধকারের ভেতরে নারীর শরীর ধরে জমাট একখণ্ড অন্ধকার।
ওই অন্ধকারটি, অন্ধকার রচিত ওই যুবতী দেহটি, দুয়ারের পাট ধরা সেই নারীটি হঠাৎ ঠেলে ওঠে চারদিকের রঙিন বাতির ভেতরে।
বলেন, বাবা, বলেন। মীর্জা আসগরউল্লাহ ওরফে বুলবুল মিয়ার কন্যা ফতেমা খাতুন ওরফে রুহিতন, বিশ হাজার এক টাকা দেনমোহর শর্তে আপনি তাকে_
কথাগুলো কানে পশে না কেরানির। মৌলভী সাহেব আরো কী কী বলে যান নিয়ম মোতাবেক। মজলিশ কান পেতে থাকে কেরানির কবুল শুনবার জন্যে। একবার সে চোখ তুলে দেখতে পায় বুলবুল মিয়াকে। সে চোখে পানি। আরে, পানি কেন? কেরানিরও চোখ সজল হয়ে ওঠে।
ক-ক-ক-কবুল।
আর একবার বলেন।
এবার আর সে তোতলায় না। স্পষ্ট গলায় উচ্চারণ করে, কবুল।
তার উচ্চারণের স্পষ্টতা আমাদের কানে পশে। পনেরো দিনের ভেতরে এক পুরুষের দুই বিয়ে! মদিনা আর রুহিতন। আমরা চমকেই উঠবো। অন্তত এমনটাই তো হবার কথা। কিন্তু এও আমরা জানি, জীবনের চেয়ে বড় নাটক নাই।
[চলবে]