আট কুঠুরি নয় দরজা –১৫

আকাশলাল হাসিমুখে মাথা নাড়ল।
আপনার নাক, চোখের ওপরের সামান্য পরিবর্তনেই সেটা সম্ভব। আর তার জন্যে মুখে কোনও দাগ হবে না। ব্যাপারটা কখন করতে হবে?-স্বজন জিজ্ঞাসা করল।
আরও দুটো দিন আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে ডাক্তার।
তার মানে আরও দুটো দিন আমাদের ওই ভাবে বন্দি হয়ে থাকতে হবে? স্বজনের গলায় আগের অসন্তোষ ফিরে এল।
হায়দার বলল, আপনার ওপর কোনও রকম অত্যাচার করা হচ্ছে না। হ্যাঁ, আপনার চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কিন্তু বুঝে দেখুন, এ ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনও পথ খোলা নেই। এই মুহুর্তে ভার্গিস সাহেবের চোখে আপনি পলাতক। সমস্ত শহর চষে বেড়াচ্ছে পুলিশ আপনাকে খুঁজে বের করতে। আপনি ধরা পড়রে আমাদের পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যেত। তা ছাড়া, আপনি এখন অনেক কিছু জেনে গিয়েছেন। আশা করি আমাদের সমস্যাটা আপনি বুঝতে পারছেন। হায়দার ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল।
হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। একটি মানুষকে তার বর্তমান পরিচয় পাল্টাতে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু মনে রাকবেন, হাতের ছাপ এক থেকে যাবে। প্রতিপক্ষ বুদ্ধিমান হলে ধরা পড়তে বেশি দেরি হবে না। যাক গে! কিন্তু ব্যাপার টা কি রকম গোপন থাকছে?
আকাশলাল বলল, এই ঘরের বাইরে আর একজন ঘটনাটা জানবে। সে হায়দারের দিকে তাকাল, ডেভিডের ফিরে আসা উচিত ছিল।
হায়দার ঘড়ি দেখে মাথা নাড়ল।
স্বজন উঠে দাঁড়াল, আমি এবার যেতে পারি?
অবশ্যই। ডাক্তার, আপনার মন পরিষ্কার হয়েছে তো?
না। এখানে আসার পথে আমরা একটা নির্জন বাংলোয় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেখানে মাটির নীচের ঘরে কফিনের মধ্যে একটি মৃতদেহ দেখতে পাই।
বাবু বসন্তলালের মৃতদেহ। হায়দার বলল।
তাকে কি আপনারাই খুন করেছেন?
এই প্রশ্নের উত্তর জেনে আপনার কি লাভ? আকাশলাল গম্ভীর হল।
কাউকে খুন করে ওইভাবে রেখে দেওয়া আমাকে বিস্মিত করেছে।
ও। না, আমরা খুন করিনি। বিপ্লব শুরু হলে হয়তো বাবু বসন্তলাল আক্রান্ত হতেন। এই লোকটা নিজের স্বার্থের জন্যে মন্ত্রী এবং বোর্ডের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আমরা ওর বিচার করতাম।
আমরা ভেবে পাচ্ছি না কে ওকে খুন করল! জানি দায়টা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিলে ভার্গিসদের সুবিধে হয়। আর কিছু?
স্বজন আর দাঁড়াল না।

বৃদ্ধ ডাক্তার চলে গিয়েছিলেন। আকাশলালের সামনে হায়দার, ডেভিড এবং ত্ৰিভুবন বসে আছে। ত্ৰিভুবন জিজ্ঞাসা করল, সোমকে নিয়ে কি করব?
হায়দার বলল, লোকটাকে ভার্গিস খুঁজে পেলে শেষ কেরে দেবে।
ডেভিড বলল, তা হলে ওকে ভার্গিসের হাতে তুলে দেওয়াই ভাল।
কিন্তু এই মুহূর্তে সোম ভার্গিসের শক্ৰ। হায়দার বলল।
আকাশলাল এবার কথা বলল, না। ও ভার্গিসের শক্র হতে পারে। কিন্তু আমাদের মিত্ৰ ভাবার কোনও কারণ নেই। একটা লোক এত বছর ধরে যে অত্যাচার করে গেছে তা আমরা রাতারাতি ভুলে যেতে পারি না। ও চাইবে ভার্গিসের ওপর প্রতিশোধ নিয়ে বোর্ডের আস্থা অর্জন করতে। ত্ৰিভুবন এই মুহুর্তে ভার্গিসের চেয়ে সোম আমাদের কাছে কম বিপজ্জনক নয়। আর যাকেই হোক, মেরুদন্ডহীন প্ৰাণীকে প্রশ্রয় দিলে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনা হবে।
এখন নিশুতি রাত। তবে আজকের রাতটার সঙ্গে বছরের অন্যান্য রাতের কোনও মিল নেই। আজ এই নগরের পথে পথে মাঠেঘাটে অজস্র মানুষ জেগে আছে। সকাল হওয়ার জন্যে।
যাদের পকেটে টাকা নেই, হোটেল বাঁ ধর্মশালার চার দেওয়ালের মধ্যে যারা আশ্রয় নিতে পারেনি তারা আগুন জ্বেলে গল্পগুজব করে যাচ্ছে খোলা আকাশের নিচে বসে। একটাই তো রাত আর রাত ফুরোলেই উৎসব।
পুলিশ প্রাণপণে শৃঙ্খলা বজায় রেখেছে এখনও কিছু রাস্তায় নো এন্ট্রি করে দেওয়া হয়েছে ফুটপাত থেকে নীচে নামতে দেওয়া হচেছ না। সর্বত্র। তবে এই জনতরঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়। ভালয় ভালয় উৎসব পর্ব চুকে গেলে গোল এরা শহর ছেড়ে গেলে হাফ ছেড়ে বাঁচবে পুলিশ। ভার্গিসের নির্দেশ ছিল এই মানুষের দঙ্গলে আকাশলালদের খুঁজতে হবে। লুকিয়ে পথে নেমে পড়ার সুবৰ্ণ সুযোগ আকাশলাল হারাবে না, ভার্গিস এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত। কিন্তু এই হাজার হাজার মানুষের ভেতর সন্ধানকাজ চালানো যে অসম্ভব ব্যাপার তা কাজে নেমে বোঝা যাচ্ছে। বরং আইন ভাঙার ভয় দেখিয়ে গরিব মানুষগুলোর কাছে যা পাওয়া যায়। তাই হাতিয়ে নেওয়াই অনেক সহজ ব্যাপার বলে মনে করছে পুলিশরা।
ত্ৰিভুবন চুপচাপ। এই ভিড়ে মিশে গিয়েছিল। রাতটা যদি আজকের রাত না হত তাহলে তার পক্ষে এমন নিশ্চিন্তে হাঁটা সম্ভব ছিল না। আকাশলালের খুব কাছের লোকদের মধ্যে যে সে অন্যতম তা পুলিশ যেমন জানে নগরের সাধারণ মানুষেরও অজানা নেই। ত্ৰিভুবনের বয়স অল্প এবং সে সুদৰ্শন। সুবেশ থাকলে ফিল্মস্টার বলে ভুলে হয়। সাধারণ মানুষ তাই তাকে সহজেই মনে রাখে। আকাশলালকে ধরে দিলে পুরস্কার দেওয়া হবে, সরকারী এই ঘোষণা পর সে দিনের বেলায় রাস্তায় বেরুনো বন্ধ করেছে, কিন্তু সংগঠন ও অন্যান্য কাজ চালাতে তাঁকে রাতের পর রাত জেগে থাকতে হয়। আগামীকাল একটা চূড়ান্ত ব্যাপার হয়ে গেল। হায়দার কিংবা ডেভিডের যতই থাকুক, ত্ৰিভুবনের মনে হয় চুপচাপ ইঁদুরের মত লুকিয়ে থাকার চেয়ে এখন মরিয়া হওয়া ঢের ভাল।
চারচকের কাছে এসে দেখল ফুটপাতের মানুষজন চুপচাপ আর রাস্তা দিয়ে একটার পর একটা পুলিশের লরি যাচ্ছে। লরিভর্তি পুলিশের হাতে আগ্নেয়াস্ত্ৰ উঁচিয়ে ধরা। ওরা যতক্ষণ যাচ্ছিল ততক্ষন আগন্তক মানুষেরা কথা বলেনি, চলে যাওয়া মাত্র যে গুঞ্জন শুরু হল তাতে স্পষ্ট বোঝা গেল পুলিসদের এমন টহল দেওয়া কেউ পছন্দ করছে না।
দূরে পাহাড়ে পাহাড়ে ঢাক বাজছে। মিছিলে আসছে এক একটা গ্রাম থেকে। ত্ৰিভুবন নিশ্চিত আজ চেকপোস্টের পাহারাদাররা হাল ছেড়ে দেবে। শহরে ঢোকার সময় এতক্ষণ পর্যন্ত যে কড়াকড়ি ওরা করে যাচ্ছিল তা শিথিল হবেই। ছোটছোট, মিছিলগুলোয় ভক্ত মানুষদের আটকাতে ওরা সাহস পাবে না। তাই সে নির্দেশ পাঠিয়েছে সোমকে নিয়ে ওইরকম একটা মিছিলে মিশে শহরে ঢুকে পড়তে। চারচকের পাশে ফোয়ারার কাছে সে অপেক্ষা করবে, তা হেনার জানা আছে। ওদের দেরি হচ্ছে কেন তা সে বুঝতে পারছিল না। ত্ৰিভুবন ঘড়ি দেখল। রাত একটা। ফোয়ারাটা আজ আরও ফুর্তি নিয়ে আকাশে জল ছুড়ছে। ওর গায়ে আলো পড়ায় দৃশ্যটা চমৎকার। নিজের গায়ে হাত বোলাল সে। দাড়ি গোফের জঙ্গলে সুন্দর মুখটাকে আড়াল করে রেখেছে। অনেকদিন হল। কিন্তু গায়ে রং আর চোখ মাঝে মাঝেই বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেলে। আগামীকাল ঘটনাটা ঘটে গেলে ভার্গিস সাহেব থিতিয়ে যাবেন চূড়ান্ত জয় হয়ে গেল ভেবে। তার কিছুদিন পরে শুরু হবে আসল খেলা। শরীরের শেষবিন্দু রক্ত সক্রিয় থাকতে সেই খেলায় সে হার মেনে নেবে না। বারো বছর বয়সে নেওয়া প্ৰতিজ্ঞাটা আজও তাকে মাঝে মাঝে উম্মাদ করে তোলে। পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে শহরে পড়তে আসত। ওরা। গ্রাম থেকে বেরিয়ে পাকদন্ডি দিয়ে ওঠানামা করতে করতে শহরের স্কুল ঠিক সময়েই পৌঁছে যেত। স্কুলটা ছিল গরিব ছেলেমেয়েদের জন্যে। কথাটা সেই সময়েই ওরা শুনেছিল। ত্ৰিভুবন ভাবত বাবা মা গরিব হলে তাদের ছেলেমেয়েকে গরিব বলা হয় কেন? গরিব হওয়া যদি দোষের হয় তাহলে ছেলেমেয়েরা কেন দোষী হবে? পড়াশুনায় ভাল ছিল সে, কিন্তু দেখতে ভাল ছিল অনেক বেশি। সবাই তার দিকে প্ৰশংসার চোখে তাকাত আর সেটা উপভোগ করতে তার মন্দ লগত না।
ত্ৰিভুবনের বাবা ছিলেন সাধারণ একজন চাষি। ভুট্টা এবং কফি চাষ করে কোনও মতেই সংসার চলত না বলে একটা দোকান খুলেছিলেন গ্রামে। মা বসতেন। সেই দোকানে। ধার দিয়ে দিয়ে দোকানটাকে ফাঁকা করে ফেলেছিলেন বাবা। আর যাই হোক ব্যবসা করার বুদ্ধি তার ছিল না। বরং ও ব্যাপারে মা ছিলেন অনেক আটসটিও। দোকান খোলার পরই মা বাবার মধ্যে ঝগড়া হতে দেখেছে সে। একবার শহরে মাল কিনতে গিয়ে বাবা আর ফিরে এলেন না। অনেক চেষ্টা করেও তার খোঁজ পাওয়া গেল না। হাল ছেড়ে দেননি মা। নিজেই দোকান চালাতেন, লোক দিয়ে চাষ করাতেন। তার মা সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু একা হয়ে যাওয়ার পরেও কোনও পুরুষকে কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। একবার পুলিশ বাহিনী গ্রামে এল। ওরা গ্রামে এলেই যে যার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিত। শুধু গ্রাম-প্রধানকে হাতজোড় করে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত। বাহিনীর ক্যাপ্টেন গ্রাম-প্রধানের কাছে খাবার দাবার চাইল। তার ব্যবস্থা হল। তখন তার নজর পড়ল মায়ের মুদির দোকানের ওপর। সরাসরি এসে লোকটা মায়ের কাছে মদ কিনতে চাইল।
মা খুবই বিনীত ভঙ্গিতে জানিয়ে দিল যে তিনি মদ বিক্রি করেন না।
লোকটা হা হা করে হাসল, পাহাড়ে মুদির দোকান। অথচ লুকিয়ে লুকিয়ে মদ বিক্রি করে না বন্দুক দিয়ে ছবি আঁকার মতো ব্যাপার। ওসব গল্পো ছেড়ে বোতল বের করো।
গ্রামপ্ৰধান মায়ের হয়ে বলতে এসে প্রচন্ড ধমক খেল। শেষ পর্যন্ত অসহায় হয়ে মা প্ৰাণের দায়ে গ্রামে যেসব ঘরে চোলাই হয় তাদের দ্বারস্ত হলেন। কিছুটা মদ জোগাড় করে ক্যাস্টেরকে দিয়ে বললেন, এর বেশি কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ক্যাপ্টেন লোকটা আর বেশি এগোয়নি। কিন্তু দলটিা চলে যাওয়ামাত্র গ্রামের লোকজন গোলমাল পাকানো শুরু করল না। একজন মেয়ে হয়ে পুলিশের মদ খাইয়েছে, এটা যে কত বড় সামাজিক অপরাধ তা সবাই মাথা নেড়ে নেড়ে বলতে লাগল। বাধ্য হয়ে গ্রাম প্রধান বিচারের আসর বসাল। তাতে রায় দেওয়া হল গ্রামের সবাইকে এক বেলা ভারপেট খাইয়ে দিতে হবে। ব্যাপারটা মায়ের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার ছিল।ওটা করতে গেলে দোকানে আর একটা কণাও থাকবে না। ত্ৰিভুবন তখন ছোট। তার প্রতিবাদ করার শক্তিও হয়নি। ব্যাপারটা নিয়ে যখন কদিন ধরে গ্রামে বেশ হইচই হচ্ছে তখন দ্বিতীয় পুলিশ বাহিনী এল। মানুষজন যে যার ঘরের দরজা বন্ধ করলেও মা তার দোকানে চুপচাপ বসে ছিলেন। এই দলের ক্যাপ্টেন লোকটা নিষ্ঠুর চেহারার। গ্রামপ্রধানকে ডেকে বলল, এই সুন্দরী মেয়েটা একা দোকান চালায় নাকি?
গ্রামপ্রধান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। ওর স্বামী হারিয়ে গেছে।
বাঃ। এখন কার সঙ্গে আছে?
ওর ছেলে সঙ্গে থাকে।
খুব ভাল কথা। ওকে বলো আজ রাতে আমরা এই গ্রামে থাকছি। আর আমি ওর অতিথি হব। যেন ভাল করে যত্ন করে। নইলে তোমাদের গ্রাম থেকে জনাদশেক ধরে নিয়ে যেতে হবে।
তখন জোর করে জোয়ান ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিনিপয়সায় সরকারি কাজ করানো হত। কাজ শেষ করে যারা ফিরে আসত তারা বাকি জীবনটা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না। দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ঘরে ঘরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামপ্রধান বিরস মুখে মায়ের কাছে এলে মা চিৎকার করে বললেন, আমি কি রাস্তার মেয়ে যে যাকে তাকে ঘরে তুলব।
গ্রামপ্রধান মিনমিন করে বলল, তুমি শুধু একটু যত্ন করো, তোমাকে যে শান্তি দেওয়া হয়েছে তা মাপ করে দেওয়া হবে। কাউকে খাওয়াতে হবে না।
ক্যাপ্টেন কথাটা শুনতে পেয়েছিল, বাঃ, এর পর শাস্তিটাস্তিও চাপানো হয়েছে দেখছি। এত সুন্দর মেয়েকে কোন শালা শাস্তি দেয়, অ্যা। কাউকে খাওয়াতে হবে না, শুধু আমাকে খাওয়ালেই চলবে। লোকটা কথা বলতে বলতে দোকানে উঠে মায়ের কাধে হাত রাখতে যেতেই মা ওকে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মারলেন। লোকটা টাল সামলাতে না পেরে চিত হয়ে পড়ে গিয়ে আচমকা স্থির হয়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য পুলিশরা ছুটে গেল দোকানে। ক্যাপ্টেনকে ধরাধরি করে তুলতেই দেখা গেল তাঁর পিঠ থেকে গলগল করে রক্ত পরছে আর সেখানে একটা বঁটির ফলা অনেকটা বিধে রয়েছে। ক্যাপ্টেনের সহকারী ঝটপট মাকে চুলধরে টেনে নীচে নামাতেই ত্ৰিভুবন আড়াল থেকে বেরিয়ে ঝাঁপীয়ে পড়ল, মারছ কেন? আমার মাকে মারছ কেন তোমরা? মা তো কিছু করেভি। ওই লোকটাই মাকে মারতে গিয়েছিল। ছেড়ে দাও–।
ওরা ত্ৰিভুবনকে তুলে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল। আছাড় খাওয়া মাত্র ত্ৰিভুবনের মনে হল পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেছে। যখন জ্ঞান ফিরল। তখন পুলিশেরা গ্রামে নেই। উঠে বসে সে শুনতে পেল ক্যাপ্টেনের মৃতদেহের সঙ্গে ওরা তাঁর মাকেও ধরে নিয়ে গেছে। সে শুন্য দোকানটার দিকে অবশ চোখে তাকাল। আর তখনই কানে এল গ্রামের মানুষ বলাবলি করছে যে ওরা আজই মাকে মেরে ফেলবে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীরে সার ফিরে এল। টলতে টলতে সে দৌড়াতে লাগল পাকদিণ্ডির পথ ধরে। পুলিশগুলো যদি শহরে ফিরে যায় তাহলে এ পথেই তাদের পাওয়া যাবে। কিন্তু শহরের মুখটায় পৌঁছেও সে পুলিশ বাহিনীর দেখা পেল না। তখন খেয়াল হল ওদের সঙ্গে যদি গাড়ি থাকে তাহলে ঘুরপথে এতক্ষনে নিশ্চয়ই শহরে ঢুকে গিয়েছে।
আগুপিছু চিন্তা না করে সে হাঁটতে হাঁটতে যখন দুর্গের মতো হেডকোয়ার্টার্সের সামনে পৌঁছাল, তখন দিন মরে এসেছে। হেডকোয়ার্টার্সের মূল গেটেই সেপাইরা তাকে বাধা দিল। অনেক কাকুতি মিনতি করা সত্ত্বেও ওরা তাঁকে ভেতরে ঢুকতে দিতে নারাজ। ঠিক সেই সময় একটা জিপ ভেতর থেকে বেরোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল। জিপের সামনে বসা অফিসার সেপাইদের জিজ্ঞাসা করল গোলমাল কিসের?
সেপাইরা ত্ৰিভুবনকে ধরে নিয়ে গেল অফিসারের সামনে, ত্ৰিভুবন উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলল।
অফিসার চুপচাপ শুনল। যে ক্যাপ্টেন গ্রামে গিয়েছিল তার নাম জানো?
না। আমার মায়ের কোন দোষ নেই। ওরা অন্যায় করে ধরে নিয়ে গেছে মেরে ফেলবে বলে।
তোমার মা কেমন দেখতে?
ত্ৰিভুবন ঢোক গিলল। মা কেমন দেখতে? মায়ের চেয়ে দেখতে ভাল এমন কাউকে সে এখনও দ্যাখেনি। কিন্তু বারো বছর বয়সেই সে বুঝে গিয়েছিল ওই প্রশ্নটার মানে কি। সে দাঁতে দীত চেপে জবাব দিয়েছিল, ভালো।
তুমি জিপে উঠে বসো। দেখি ওরা কোথায়?
হঠাৎই আশার আলো দেখতে পেল যেন। জিপে যেতে যেতে অফিসার জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের গ্রাম কোনদিকে?
দিকটা জানিয়ে দিল ত্ৰিভুবন। অফিসার বাঁ হাতে তাঁর গাল টিপে ধরল। তুমি খুব মিষ্টি দেখতে। অত ভয় পাচ্ছ কেন? আমার সঙ্গে থাকলে তোমার কোন ভয় নেই।
কোনও মতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ত্ৰিভুবন। ওই বয়সেই সে গ্রামের কিছু লোকের আদর করার ভঙ্গি থেকে বুঝে নিয়েছিল কোনও কোনও পুরুষ কেন এমন আদর করে। তাঁর মন বলল এই অফিসার লোকটা খারাপ, খুব খারাপ। কিন্তু দ্রুত ছুটে যাওয়া জিপ থেকে নেমে যাওয়ার কোন উপায় নেই। আর নেমে গেলে মায়ের সন্ধান পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।
সন্ধে নেমে আসছে দ্রুত। নির্জন পাহাড়ি রাস্তায় হঠাৎ পুলিশের বড় ভ্যানটাকে আসতে দেখা গেল। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিপ থামতেই ভ্যানটাও থামল। ত্ৰিভুবন দেখল ক্যাপ্টেনের সেই সহকারী এগিয়ে এসে অফিসারকে স্যালুট করল।
স্যার, একটা খারাপ খবর আছে।
অফিসার জিজ্ঞাসা করল, মেয়েটা কোথায়?
ক্যাপ্টেনের সহকারী হকচাকিয়ে গেল। খবরটা এত তাড়াতাড়ি কি করে উপর তলায় পৌঁছে গেল তাই বোধহয় বুঝতে চেষ্টা করছিল। সে কিন্তু কিন্তু করে জবাব দিয়েছিল, আমরা ধরে নিয়ে এসেছিলাম। মার্ডার চার্জ স্যার। গাড়ি অনেক নিচে ছিল। হেঁটে আসার সময় পথে বাথরুম পেয়েছে বলায় ওকে একলা ছেড়ে একটু সরে এসেছিলাম ভদ্রতা করে। সেই সুযোগে নিচে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে।
মরে গেছে?
এখনও মরেনি।
কোথায়??
ভ্যানেই আছে।
অফিসার গাড়ি থেকে নেমে ভ্যানের পেছনে দিকে যেতেই ত্ৰিভুবন ছুটল সঙ্গে। মা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কেন? প্রশ্নটা তার ছোট্ট বুকটায় উত্তাল হয়ে উঠেছিল। ভ্যানের দরজা সেপাইরা খুলে দিতেই অফিসারের মৃতদেহটা দেখা গেল। স্থির হয়ে আছে। তার পাশে রক্তাক্ত মহিলাটি তার মা? অফিসারের নির্দেশে শরীরটা নামানো হল। মায়ের গালের মাংস খুবলে খুবলে তুলে নেওয়া হয়েছে যেন। কোমরের খোলা চামড়ায় দাঁতের চিহ্ন স্পষ্ট। দুটো পা রক্তাক্ত। অফিসার বলল, হুঁ। চমৎকার আঁচড়ে ছিলে তোমরা। ওকে আমার জিপে তোল।
মায়ের চেহারা এমন ভীতিকর হয়ে গেছে যে গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছিল না ত্ৰিভুবনের। অফিসারের জিপে সোজা চলে এল শহরের হাসপাতালে। মাকে ভর্তি করে দেওয়া হল সেখানে। ডাক্তাররা বলল বাঁচানোর চেষ্টা করবে। অফিসার বলল, যাক, কাজ শেষ। আজ রাত্রে চলো, আমার কাছে থাকবে। বলে একটা চোখ কোঁচকাল।
সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে ছিল ত্ৰিভুবন। অফিসার কিছু বোঝার আগেই একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। তারপর শহরের এ গলি ও গলিতে সময় কাটিয়ে আবার ফিরে গিয়েছিল হাসপাতালে মধ্যরাতে। ঠিক তখনই ক্যাপ্টেনের সহকারীকে সে দেখতে পেল। হাসপাতালে ঢুকতে। সন্তপর্ণে একজন অ্যাটেনডেন্টকে ডেকে কিছু বলে টাকা দিল লোকটা। অ্যাটেনডেন্ট মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেল। মিনিট পনের বাদে ফিরে এসে সে সহকারীকে জানাল, কাজ হয়ে গেছে।
লোকটা খুশি মুখে বেরিয়ে গেল। ভোর হবার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করল গতরাত্রে মা হার্টফেল করে মারা গেছেন।
ষোল বছর আগের এই ঘটনার কথা মনে এলেই এখনও শরীর শক্ত হয়ে যায়। মনে হয় যেন আজই ঘটে গেছে। এগুলো। সেই সহকারী ক্যাপ্টেনকে সে নিজের হাতে খুন করেছে। বছর তিনেক হল, তবু জ্বালা মেটেনি। সেই অফিসারটি এখন তাদের লক্ষ্য। অনেক নীচে থেকে ভাল মানুষের মুখোশ পরে পরে আজ পুলিশ কমিশনার হয়ে গেছে লোকটা। নিশ্চয়ই ওর মনে নেই ষোল বছর আগে জিপে বসে যার গাল টিপেছিল। সে আজ শক্ৰদের অন্যতম।
ওকে নিয়ে এসেছি।
গলাটা কানে যাওয়ামাত্র চমকে ফিরে তাকাল ত্ৰিভুবন। তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে হেনা। দূরে গাছের তলায় আর দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে। ত্ৰিভুবন জিজ্ঞাসা করল, কোনও ঝামেলা হয়নি তো? হেনা কাছে এগিয়ে আসতে মাথা নেড়ে না।
ও কি তোমার পরিচয় জেনেছে? না। তবে শহরে ঢোকার পর আর আমাদের সঙ্গে থাকতে চাইছে না। চেকপোস্টে ওকে আড়াল করে আমরা নিয়ে এসেছি। তুমি কথা বলবে?
না। আমরা চাই না ও কালকের সকালটা দেখুক।
ও। এটা জানালে সুবিধে হত।
সিদ্ধান্ত একটু আগে নেওয়া হয়েছে। কথাটা বলে ত্ৰিভুবন হাঁটতে লাগল। রাত আর বেশি নেই। এখন যেটুক সময় পাওয়া যাবে একটু শুয়ে নেওয়া দরকার।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
সমরেশ মজুমদার- র আরো পোষ্ট দেখুন