বকুল ফুলের ভোরবেলাটি

এক মেয়ের কথা শুনবি, বকুল?

তোর মতো আমার এক বাঙালি বোনের কথা শুনবি? কী অমানবিক নৃশংস ভয়াবহ রকম নির্যাতন তার ওপর করা হয়েছিল, কল্পনাও করতে পারবি না। দিনের পর দিন পাশবিক নির্যাতনের পর কীভাবে তাকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি …গুলো, শুনবি? সহ্য করতে পারবি সেই মেয়ের কাহিনি?

পারবি। তুই তো এখন সহ্য-অসহ্যের বাইরে!

সেই মেয়ের নাম ভাগীরথী। নদীর নামে নাম। ভারতের গঙ্গাই আসলে ভাগীরথী। নীহাররঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস পড়েছিলাম ‘অস্তি ভাগীরথী তীরে’। গঙ্গার প্রাচীন নাম ভাগীরথী। হিন্দুপুরাণে ভাগীরথীর আরেক নাম জাহ্নবী। শঙ্কু মহারাজ ভ্রমণকাহিনি লেখেন। তাঁর একটি বইয়ের নাম ‘বিগলিত করুণ, জাহ্নবী যমুনা’।

জাহ্নবীর কথা শুনবি?

গঙ্গার কথা!

শুনবি শহীদ ভাগীরথীর কথা!

দুরকমভাবে ভাগীরথীর কথা আমরা শুনেছি। দুভাবেই তোকে বলি।

আমাদের এই স্বর্ণগ্রামের মতো বাংলার এক গ্রামের মেয়ে ভাগীরথী। গ্রামের নাম বাঘমারা। বরিশালের ওদিককার পিরোজপুর অঞ্চলে বাঘমারা গ্রাম। ওই অঞ্চলের বহু কিশোরী তরুণী যুবতী নারীর সঙ্গে ভাগীরথীকেও ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি…রা।

মে মাসের এক বিকালবেলায় ভাগীরথীদের গ্রাম বাঘমারায় চড়াও হলো ওরা। যাকে যেভাবে পারল হত্যা করল, আগুন দিল মানুষের ঘরবাড়িতে। হত্যাযজ্ঞ চলল সন্ধ্যা পর্যন্ত। কিন্তু ভাগীরথীকে মারল না। ভাগীরথীর রূপ লাবণ্যের জন্য তাকে বাঁচিয়ে রাখল। ট্রাকে তুলে নিয়ে গেল কদমতলা আর্মিক্যাম্পে।

ওই যে বললাম দুরকমভাবে শুনেছি ঘটনা। দুরকমভাবেই বলছি, শোন তারপর কী হলো। কদমতলার একটি স্কুলঘরে আটকে রাখা হলো বাঘমারার উচ্ছল আনন্দময়ী জীবন নিয়ে নানারকম মধুর স্বপ্ন দেখা ভাগীরথীকে। ওই বয়সী যুবতী মেয়েরা যে রকম স্বপ্ন দেখে, ভাগীরথীর চোখ জুড়েও ছিল সেরকম স্বপ্ন।

বাংলার বহু কিশোরী তরুণী আর যুবতী নারীর মতো, এই তোর মতো, আমার বোন বকুলের মতো ভাগীরথীর সব স্বপ্ন ধ্বংস করে দিল ওরা। ক্যাম্পে আটকে রাখা ভাগীরথীর ওপর প্রতিদিন চলত অকথ্য নির্যাতন। পাশবিক নির্যাতন।

তুই আমার একমাত্র ছোটবোন, শব্দটা তোকে আমি বলতে পারব না।

প্রতিদিন ভাগীরথীর ওপর চলত ওই নির্যাতন। পৈশাচিকতা।

তারপরও ধুকে ধুকে বেঁচে ছিল ভাগীরথী।

ভাগীরথীর কথায় মনে পড়ছে ভূপেন হাজারিকার গানের কথা। ভাগীরথীর অন্য নাম গঙ্গা। এজন্যই বোধহয় মনে পড়ছে।

বিস্তীর্ণ দু-পারে অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনে

ও গঙ্গা তুমি বইছো কেন?

আমাদের ভাগীরথী, আমাদের গঙ্গা নামের বোনটি তার ধ্বংস হয়ে যাওয়া জীবন এবং শরীর নিয়েও বয়ে যাচ্ছিল নদীর মতোই।

কেন বয়ে যাচ্ছিল?

সে কথা পরে বলি। আগে শোন তারপর কী হলো?

পাকিস্তানি…রা একটা সময়ে ক্যাম্পের কাজের মেয়ে হিসাবে ব্যবহার করতে লাগল ভাগীরথীকে। ওদের রান্নাবান্না ফুট ফরমাস খাটতে লাগল ভাগীরথী। ওরা যে যা বলে, যে কাজ করতে বলে, খুবই আন্তরিকতা এবং দক্ষতা নিয়ে তা সে করে দেয়। খুবই নিষ্ঠা নিয়ে করে, বিশ্বাস নিয়ে করে।

ওরা ভাগীরথীকে লক্ষ করে। কিছুদিনের মধ্যেই ভাগীরথী ওদের বিশ্বাস অর্জন করে ফেলে। ওরা মনে করে এই মেয়ে প্রকৃত অর্থেই ওদের সহচরী। ওরা তাকে নিজেদের মানুষ মনে করতে থাকে।

নিজেদের মানুষকে কি কেউ আটকে রাখে!

একটা সময়ে ভাগীরথীকে ওরা ছেড়ে দিল।

কিন্তু ভাগীরথী বাংলার মেয়ে। জাহ্নবী, গঙ্গা। বুকের ভেতর ধিকিধিকি জ্বলছে আগুন। প্রতিশোধের আগুন। প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত সেই আগুন নিভবে কেন!

ভাগীরথীকে ওরা ছেড়ে দিল ঠিকই কিন্তু ক্যাম্পে যাওয়াটা ভাগীরথী রাখল।

কীভাবে রাখল?

রাখল ভিখিরির সাজে।

বাস্তবেও ভাগীরথীর অবস্থা তখন ভিখিরিনীর মতো। শরীর-স্বাস্থ্য কিচ্ছু নেই। শীর্ণ হাত-পা মরা ডালপালার মতো। পরনে জীর্ণ ময়লা শাড়ি। হাতে ভিক্ষার থালা।

ততদিনে এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে ভাগীরথীর। আর্মিক্যাম্পে ভিক্ষার ছলে সে যাতায়াত শুরু করেছে এজন্যই। তাকে কাছে পেলেই ফুটফরমাস খাটায় ওরা, এটা ওটা কাজ করিয়ে নেয়। ভিক্ষা চাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে, ফুট ফরমাস খাটার ফাঁকে ফাঁকে, ওদের রান্নাবান্নার ফাঁকে ফাঁকে ভাগীরথীর চোখ ঘুরে বেড়ায় ক্যাম্পের কোথায় কী আছে সেই দিকে। কী কথা ওরা বলাবলি করে, কোন পরিকল্পনা করে বাঙালি হত্যার, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করার, সব সে শোনে।

এতদিন ওদের সঙ্গে থাকার ফলে ওদের কথাবার্তাও কিছু কিছু বুঝতে পারে ভাগীরথী। যে কাজেই থাকে, কান থাকে ওদের আলাপ আলোচনার দিকে। আড়চোখে দেখে ওদের অবস্থান আর সব এসে জানায় মুক্তিযোদ্ধাদের। অর্থাত্ ইনফরমারের কাজ শুরু করে ভাগীরথী।

মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে ভাগীরথীর কথায়।

জীবনের মায়া তখন আর ভাগীরথীর নেই। সে জানে ধরা পড়লে অবধারিত মৃত্যু, ভয়ংকর মৃত্যু। মৃত্যুর কথা সে মনে রাখে না।

একেই বলে জীবনবাজি রাখা, বুঝলি বকুল।

জীবনবাজি রেখে ইনফরমারের কাজ চালিয়ে যেতে লাগল বাংলার এক বীরকন্যা।

ভাগীরথীর কাছ থেকে খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকবার আক্রমণ করল বাঘমারা আর্মিক্যাম্প। বেশ কিছু পাকিস্তানি সৈন্য মেরে ফেলল।

পাকিস্তানি…গুলো চিন্তিত হলো। ক্যাম্পে ঢুকে এইভাবে আক্রমণ! একদম জায়গা বুঝে আক্রমণ! এটা কী করে সম্ভব? মুক্তিযোদ্ধারা জানে কী করে ক্যাম্পের কোথায় কজন সৈন্য আছে?

ভাগীরথীকে সন্দেহ করল ওরা। এক সময় ধরেও ফেলল তাকে।

তারপর?

তারপর যে অত্যাচার ভাগীরথীর ওপর করা হলো, যেভাবে তাকে হত্যা করা হলো, সেই বর্ণনা শুনলে পৃথিবীর যেকোনো পাষণ্ডরও বুক কেঁপে উঠবে, দম বন্ধ হয়ে আসবে। কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, হার্টফেল করতে পারে কারও কারও।

বলব, বলব সেই কথা?

ভাগীরথীর নির্মম মৃত্যুর কথা বলব, বকুল?

সহ্য করতে পারবি?

যেরকম নরম কোমল মনের মেয়ে তুই, পারবি ভাগীরথীর পরিণতির কথা সহ্য করতে!

হ্যাঁ পারবি।

এখন পারবি।

এখন তোকে বলা যায়।

তুই তো এখন আর তুই নেই। তোর আত্মা হূদয় মন, যা-ই বলি না কেন, অনুভব অনুভূতি যা-ই বলি না কেন, তার কিছুই এখন আর নেই। মায়ের কবর খুঁড়তে খুঁড়তে, তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এমন এক ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম, কোন ফাঁকে যে তোর কবরও খুঁড়ে ফেলেছি, টের পাইনি। মাকে কবরে শুইয়ে দেওয়ার পর এসেছি তোর ঘরে। তোকে নিয়ে শুইয়ে দেব কবরে, মা-বাবার পাশে।

তোর ঘরে আসার পর মনে পড়ল ভাগীরথীর কথা। বোধহয় ভালোরকম ক্লান্ত হয়েছি। তোর পাশে বসে খুব ইচ্ছা করছে অনেক কথা বলি তোর সঙ্গে। আমাদের ফেলে আসা জীবনের কথা, যুদ্ধের কথা। বুয়া পারুলের কাঁথায় যাকে জড়িয়ে ছিলাম সে তো আমার বকুল ফুলের নিথর দেহ। আর কিছু না, কিচ্ছু না।

সুতরাং তোকে বলা যায়।

শেষ পর্যন্ত…

ভাগীরথীর মৃত্যুর কথা, পরিণতির কথা পরে বলি। আগে বলি, এতক্ষণ বললাম প্রথমে ভাগীরথীর কথা যেভাবে শুনেছিলাম সেটুকু। পরে যেভাবে শুনেছিলাম এখন বলি সেটুকু।

পরিণতির কথা দুবারই এক রকম। তবে দ্বিতীয়বার যা শুনেছি সেটাই আসল সত্য। ভাগীরথী ওই কাজটাই করেছিল।

ভাগীরথীর বিয়ে হয়েছিল। সে ছিল দরিদ্র এক গ্রাম্যবধূ। হেমন্তের সেই গানটির কথা তোর মনে আছে। গান শুনতে বসে গানের ইতিহাস বলতেন বাবা। ওই যে ওই গান

কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো

রূপকথা নয় তো নয়

জীবনের মধুমাসে কুসুম ছেঁড়া গাঁথা মালা

শিশির ভেজা কাহিনি শোনাই শোনো

সলিল চৌধুরীর সুরে গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের গান। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় লেখা হয়েছিল।

এসব তোর মনে আছে?

ইস কেন যে এভাবে আমি তোকে প্রশ্ন করছি? যে দেহে প্রাণ নেই তাকে কেন এইভাবে প্রশ্ন করা!

তারপরও তোকে সব বলতে ইচ্ছা করছে বকুল। সব বলতে ইচ্ছা করছে।

বিয়ের বছরখানেক পর মা হলো ভাগীরথী। কোল আলো করে ছেলে হলো তার। তারও এক-দুবছর পর স্বামী মারা গেল। বিধবা হয়ে গেল সে। ভালো বাংলায় ‘অকাল বৈধব্য’।

আমার ধারণা ভাগিরথী বিধবা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ শুরুর বেশিদিন আগে না। কিন্তু কোলের ছেলেটির কী হলো, জানা যায়নি। পরিবারের অন্য সবার মতো ওইটুকু ছেলেটিকেও হয়তো হত্যা করা হয়েছিল সেই বিকালে।

ভাগীরথীর কথা ভাবলে একবার আমার মনে হয়, সেই বিকালে সেও যদি মারা যেত তাও তার জন্য ভালো ছিল। আবার মনে হয়, না, যত অত্যাচারই করা হয়েছিল তার ওপর তারপরও বেঁচে থেকে বড় রকমের একটা প্রতিশোধ সে নিতে পেরেছিল। সত্যিকার বীরের কাজ করেছিল। ভাগীরথী এক বীরমুক্তিযোদ্ধা।

আচ্ছা পাকিস্তানি…গুলো ট্রাকে তুলে কোন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল তাকে? পিরোজপুর ক্যাম্প, নাকি কদমতলী ক্যাম্প?

জায়গাটির নাম কি কদমতলী না কদমতলা?

না অনেক কিছুই ঠিকঠাক বলতে পারছি না। অনেক কিছু মনেও করতে পারছি না।

না না পারছি। পারছি।

শোন, তারপর কী হলো! মানে দ্বিতীয়বার শোনা ঘটনা শোন। এটাই আসল ঘটনা। এটাই হচ্ছে ভাগীরথীর আসল বীরত্ব। ওই যে প্রথমবার শুনেছিলাম তার মুখে খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকবার কদমতলী আর্মিক্যাম্প আক্রমণ করেছিল, কিছু পাকিস্তানি সৈন্য হত্যা করেছিল ওটা বোধহয় ঠিক না। দ্বিতীয়বার শোনা ঘটনাই ঠিক।

ভেতরে ভেতরে ভাগীরথী প্ল্যান করেছিল কীভাবে ক্যাম্পের বেশিরভাগ …গুলোকে এক জায়গায় জড়ো করা যায়। জড়ো করার পর…

জুন মাসে সুযোগটা সে পেল।

পাকিস্তানি …গুলোর বিশ্বাস ততদিনে এতটাই সে অর্জন করেছে, আর তার হাতের রান্না খেয়ে …গুলো এতই মুগ্ধ, ভাগীরথী একদিন তাদের বাঘমারা নিজগ্রামে দাওয়াত দিল। আমাদের গ্রামে চলেন। ভালো রান্না করব, ভালো খাওয়াব আপনাদের। এতদিন যা খেয়েছেন তারচে হাজার গুণ ভালো খাওয়া।

ভাগীরথীর কথা বিশ্বাস করল ওরা। রাজি হলো। ৪৫ জন সৈন্য এলো ভাগীরথীর সঙ্গে তাদের বাগমারা, নাকি বাঘমারা, বাঘমারা কদমতলায়!

গ্রামের নাম বোধহয় বাঘমারা কদমতলাই হবে। নিশ্চয় অতীতে কোনোদিন কেউ সুন্দরবনের কোনো বাঘ মেরেছিল এখানে। হয়তো কোনো এক প্রাচীন কদমগাছের তলায় মারা হয়েছিল হিংস্র বাঘ। রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এজন্যই ওরকম নাম গ্রামের। বাঘমারা কদমতলা।

এভাবেও অনেক গ্রামের নাম হয়েছে বাংলাদেশে।

পাকিস্তানি …গুলোকে নিজগ্রামে প্ল্যান মতো নিয়ে আসবে ভাগীরথী, মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে রেখেছে। মুক্তিযোদ্ধারা তৈরি।

ট্রাকে করে ওরা ৪৫ জন এল। রাস্তায় ট্রাক রেখে নামল সবাই। ভাগীরথীদের বাড়ির দিকে রওনা দিল।

সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ। চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে লাগল মুক্তিযোদ্ধারা। ৪০ টি …কে হত্যা করল। বাকি ৫ জন আহত অবস্থায় কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল।

ভাগীরথী সেদিন থেকে উধাও।

এতবড় ঘটনা ঘটে গেছে এলাকায়, ভাগীরথী ঘটিয়েছে এই ঘটনা, পাকিস্তানিরা ঘোষণা দিল, ভাগীরথীকে ধরে দিতে পারলে একহাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।

রাজাকাররা নড়েচড়ে উঠল।

একহাজার টাকা পুরস্কার!

বুনো কুকুরের মতো হন্যে হয়ে ভাগীরথীকে খুঁজতে লাগল তারা।

একসময় ধরা পড়ে গেল ভাগীরথী। ভাগীরথীকে হাতে পেয়ে ওগুলোর আনন্দের সীমা পরিসীমা নেই। প্রভুদের কাছে নিয়ে এল তাকে। পিরোজপুর মিলিটারি ক্যাম্পের প্রভুরা যেন হাতে চাঁদ পেল।

এখন কী করা যায় ভাগীরথীর?

কীভাবে শাস্তি দেওয়া যায় তাকে?

কোন উদাহরণ সৃষ্টি করলে ভাগীরথীর মতো কাজ করবে না আর কেউ!

সেদিন হাটবার। ভাগীরথীকে এনে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড় করানো হলো। শত শত মানুষের সামনে তার শরীর থেকে খুলে নেয়া হলো জীর্ণ শাড়ি। দুটো জিপ দাঁড়ানো পাশাপাশি। দুই জিপের মাঝখানে ভাগীরথী। তার দুই হাত বাঁধা হলো দুই জিপের সামনের দিকে, দুই পা বাঁধা হলো পিছনের দিকে।

তারপর?

তারপর জিপ চালিয়ে দেওয়া হলো।

প্রথমে আস্তে ধীরে এমনভাবে চালানো হলো, নির্দিষ্ট একটা মাপ রেখে। ফলে ভাগীরথীর দেহ ছেঁছড়াতে লাগল রাস্তায়। …গুলো জিপে বসে মজা দেখছে, বীভত্স দাঁত কেলিয়ে হাসাহাসি করছে।

ততক্ষণে ফাঁকা হয়ে গেছে হাট।

এই দৃশ্য সহ্য করতে পারে কোনো মানুষ?

কোনো বাঙালির পক্ষে সম্ভব তাদের এক বোনের এই অবস্থা দেখা!

কিছু রাজাকার ছিল। ওই সেগুলো, একহাজার টাকা পুরস্কার পাওয়ার আশায় ভাগীরথীকে যারা খুঁজে বের করেছিল। ধরে এনেছিল ক্যাম্পে।

রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে ওরা মজা দেখছিল। জিপে বসা প্রভুদের হাসাহাসি করতে দেখে, তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য নিজেরাও কেলিয়ে হাসছিল। হাততালি দিয়ে সাবাসি দিচ্ছিল।

এইভাবে কিছুদূর এগোলো জিপ দুটো।

তারপর?

তারপর যা ঘটল, বকুলরে, আমি, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। যোদ্ধাদের মন শক্ত রাখতে হয়, যোদ্ধাদের আবেগ থাকতে নেই…

না না অবশ্যই যোদ্ধাদের আবেগ থাকতে হয়। প্রেম ভালোবাসা মায়া মমতা সবই থাকতে হয়। সেটা থাকতে হয় দেশের জন্য, দেশের মাটির জন্য।

ও আমার দেশের মাটি

তোমার পরে ঠেকাই মাথা

দেশ মানে মানুষ।

দেশের মানুষ।

দেশের মানুষের জন্য প্রেম ভালোবাসা আবেগ মায়া মমতা না থাকলে যোদ্ধা আবার যোদ্ধা হয় কেমন করে?

শোন তারপর কী হলো! ভাগীরথীর ভাগ্যে কী ঘটল?

একটু এগিয়ে, দুই জিপের সঙ্গে হাত-পা ওভাবে বাঁধা ভাগীরথীর, জিপ দুটো ওরা দুদিকে চালিয়ে দিল।

এতক্ষণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল ভাগীরথী। তারপর আর কাতরাতেও পারল না। যে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল মুহূর্তে থেমে গেল কাতরানো। মুহূর্তে ভয়ংকর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে গেল বাংলামায়ের বীরকন্যা।

ভাগীরথীর দেহ মাঝখানে থেকে ছিঁড়ে দু টুকরো হয়ে গেল। যেন অতি পুরোনো সুতি শাড়ি মাঝখান থেকে টেনে প্যার প্যার করে ছিঁড়ে ফেলা হলো।

ভাবতে পারিস?

দৃশ্যটা তুই ভাবতে পারিস বকুল?

যুদ্ধের মাঠে দুবার দুভাবে শুনেছি ভাগীরথীর কথা। প্রথমবার শোনলাম, তার খবরের ওপর নির্ভর করে আর্মিক্যাম্পে কয়েকবার আক্রমণ চালিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। ওই ঘটনা বোধহয় ঠিক না। আসল ঘটনা দ্বিতীয়বার শোনা। ৪৫টি …কে নিজ গ্রামে দাওয়াত দিয়ে এনে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়েছিল ভাগীরথী। ৪০টিকে খতম করিয়েছিল।

এক হাজার টাকা পুরস্কার পাওয়ার লোভে রাজাকাররা তাকে খুঁজে বের করেছিল। জিপে বেঁধে ওইভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছিল—এই ঘটনা দুবারই শুনেছি। শুনে আমার মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধাই চোখের জলে ভেসেছে।

বাংলার মাটি কি ভাগীরথীর কথা কখনো ভুলবে?

ভুলবে না। গভীর মমতায় স্মরণ রাখবে তার এই বীরকন্যার কথা। শহীদ ভাগীরথীর কথা!

তোর কথা মনে রাখবে না, বকুল?

তুইও তো এক ভাগীরথী!

আমার বাবার কথা মনে রাখবে না বাংলার মাটি! মায়ের কথা মনে রাখবে না! মায়া, মায়ার গর্ভে আমার সন্তান, তাদের কথা মনে রাখবে না!

বকুলরে, বাড়িতে ঢুকে যে দৃশ্য আমি দেখেছি, এরকম দৃশ্য দেখে কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না তার মাথা ঠিক রাখা।

বাবার লাশ পড়ে আছে উঠানে।

মায়ের লাশ বসার ঘরে।

বোনের ছিন্নভিন্ন লাশ তার ঘরে।

স্ত্রীর লাশ ভিতর দিককার উঠানে। বেয়োনেট চার্জ করে লন্ডভন্ড করা হয়েছে তার গর্ভের সন্তান।

এই দৃশ্য কেমন করে সহ্য করে মানুষ!

কেমন করে তাকিয়ে দেখে!

আমি দেখেছি। আমি সেই মানুষ, আমি দেখেছি। দেখার পরের অনুভূতি বলতে পারব না।

এই অনুভূতির ব্যাখ্যা নেই।

এই অনুভূতি প্রকাশের ভাষা নেই।

এরকম দৃশ্য যে দেখে, শুধু সে-ই জানে তার অনুভূতি কেমন। মনের অবস্থা কেমন! এরকম দৃশ্য দেখে কেমন করে বেঁচে থাকে সে! কেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে না! কেন হার্টফেল করে না!

না, আমি অজ্ঞান হইনি।

হার্টফেল করেনি আমার।

আমি বেঁচে আছি।

আমি তোদের জন্য বেঁচে আছি। আমি বেঁচে আছি দেশের সাত কোটি মা বাবা ভাই বোন স্ত্রী আর সন্তানের জন্য! দেশের বেঁচে থাকা মানুষগুলোর জন্য আমি বেঁচে আছি।

যোদ্ধার বেঁচে থাকতে হয়!

দেশের স্বাধীনতার জন্য বেঁচে থাকতে হয়।

মুক্তির জন্য বেঁচে থাকতে হয়।

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আমি বেঁচে আছি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার জন্য। সাত কোটি মানুষকে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেই বাংলাদেশ আমার বাবা দেখে যেতে পারলেন না, আমার মা পারলেন না। আমার আদরের বকুল ফুলটি পারল না, আমার মায়া পারল না। আর স্বাধীন দেশের আলো-হাওয়ায় জন্মাতে পারল না আমার সন্তান।

আমার বুকজুড়ে এখন এই হাহাকার।

তবে ধাক্কাটা আমি অনেকখানি কাটিয়ে ফেলেছি, বুঝলি!

প্রথমে অবস্থা হলো কী জানিস, উঠানে বাবার লাশ দেখার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, কে যেন লোহার খুব ভারী একটা ডান্ডা দিয়ে আমার মাথায় বাড়ি মারল।

এমন বাড়ি!

মাথা ফাটলো না। থ্যাঁতলালো না। চূর্ণবিচূর্ণ হলো না। অর্থাত্ বাইরে কিছুই হলো না। যা হওয়ার হলো ভেতরে। ভেতরটা এলোমেলো হয়ে গেল। চিন্তাচেতনা এলোমেলো হয়ে গেল।

আমার বাবাকে এইভাবে মেরে ফেলে রেখেছে উঠানে!

তারপর দেখি মাকে।

তারপর দেখি তোকে।

তারপর দেখি মায়া আর আমার সন্তান!

শুধু চারজন মানুষের রহস্য আমি উদঘাটন করতে পারছি না! কদম বুয়া পারুল আর বারেক।

বারেক কি এই বাড়িতে ছিল?

নাকি সে আছে নারায়ণপুরে, মোসলেম মিয়ার বাড়িতে!

কদম কি বিলের ওদিক থেকে উধাও হয়ে গেল?

বুয়া?

পারুল?

এই দুজন মানুষের কী হলো? গোলাগুলির শব্দে এত বড় বাড়ির কোনো দিকে পালাতে গিয়ে গুলি খেল! ঝোপ-জঙ্গলের আড়ালে পড়ে আছে তাদের লাশ! নাকি বর্ষার পানিতে গিয়ে পড়েছে! এতক্ষণে ফুলেফেঁপে ঢাউস হয়ে গেছে।

বল্টু কুকুরটাকে নিয়ে যেমন ভেবেছি, বুয়া আর পারুলের ক্ষেত্রেও কি ও রকমই ঘটেছে!

পারুল ছিল দশাসই তাগড়া ধরনের মেয়ে!

নাকি তার অবস্থাও হয়েছে তোর মতো!

নাকি বুনো কুকুরের দল তাকে খাবলেখুবলে খেয়েছে। হয়তো বা তখনো বেঁচে আছে বলে তাকে ধরে নিয়ে গেছে। দিনের পর দিন আটকে রাখবে হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্পে আর চালাবে নির্যাতন!

এলোমেলো মাথায়ও আমি তারপর কয়েকটা কাজ করেছিলাম, জানিস! অবচেতন মন থেকেই করেছিলাম! নিজের অজান্তেই করেছিলাম।

ওই যে বললাম, বাড়ির কিছুই নেই আমাদের। আসবাবপত্র সব লুটপাট হয়ে গেছে। ঘরের দরজা-জানালার কপাট, লোহার শিকগুলোও খুলে নিয়ে গেছে। কোনো ঘরে কিচ্ছু নেই। মায়ার ঘরে ছিল পুরোনো ছেঁড়া খবরের কাগজগুলো। বুয়া পারুলের ঘরে ছিল একটা একেবারেই ছেঁড়া মাদুর আর দু-তিনটা ছেঁড়া কাঁথা।

ওগুলো কে নেবে?

ওই দিয়ে কী হবে!

তোর ঘরের পালঙ্কটা নিয়ে গেছে। দরজা কপাট আলমারি আর পুরোনো আমলের ড্রেসিংটেবিল, কিচ্ছু নেই তোর ঘরে।

তোর ঘরে আছিস শুধু তুই।

মেঝেতে পড়ে আছিস।

তোর দিকে আমি তাকাতে পারিনি। আমার বকুল ফুল, আমি তোর দিকে তাকাতে পারিনি।

এই ঘরে ছুটছি।

ওই ঘরে ছুটছি।

তোর জন্য, শুধু তোর জন্য। তখন মাথায় আর কিছু নেই। তোকে রক্ষা করতে হবে। শুধু তোকেই যেন রক্ষা করতে হবে।

কী রকম রক্ষা?

কিন্তু বাড়ির কোথাও কিছু পাই না।

কী দিয়ে রক্ষা করব তোকে?

কী দিয়ে ঢাকব তোকে?

বুয়া পারুলের ঘর থেকে নিয়ে এলাম ছেঁড়া মাদুর আর কাঁথাগুলো। কী রকম বোঁটকা একটা গন্ধ আসছিল কাঁথা থেকে!

আশ্চর্য ব্যাপার, জানিস।

আশ্চর্য ব্যাপার!

ওই অবস্থায়ও বহুদিন ধরে ব্যবহার করা, না-ধোয়া কাঁথা থেকে আসা বোঁটকা গন্ধটা আমি ঠিকই পেলাম।

এটা কী করে সম্ভব, বল তো?

এমন হয়?

এই অবস্থায় এমন হতে পারে?

আমার ক্ষেত্রে হলো। বুয়া পারুলের কাঁথার বোঁটকা গন্ধে বমি আসতে চাইল।

তবে মুহূর্তের জন্য। তার পরই সব ঠিক। আর কোনো অনুভূতি নেই।

মাদুর কাঁথা নিয়ে তোর ঘরে এলাম। কাঁথা দিয়ে পা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিলাম তোকে। শুধু মুখটা খোলা।

কিন্তু মাদুরটা আনলাম কেন?

মাদুর দিয়ে কী করব?

মাদুরটা ফেলে রাখলাম তোর মাথার কাছে।

এখন সেই মাদুরে এসে বসেছি। তোর মাথার কাছে। এই তো বুয়া পারুলের কাঁথায় ঢাকা তুই পড়ে আছিস আর ভাইটি বসে আছে তোর মাথার কাছে।

কিন্তু তোর মুখের দিকে আমি তাকাতে পারি না, বকুল।

তোর মুখ আর মুখ নেই।

তোর গোলাপের মতো গাল আর গাল নেই।

তোর চিবুক আর চিবুক নেই।

ঠোঁট আর ঠোঁট নেই।

শুধু চোখ দুটো ঠিক আছে। ভয়ংকর আতঙ্কে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল চোখ। বুয়া পারুলের কাঁথায় ঢাকার সময় চোখ দুটো বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলাম।

চোখ বন্ধ হচ্ছিল না।

কেন বল তো!

যতবার বন্ধ করতে যাই, খুলে যায়!

এমনই কি হয়!

মৃত্যুর দীর্ঘক্ষণ পর খোলা চোখ কি বন্ধ হতে চায় না!

বন্ধ হয় না!

বাবার চোখ তো বন্ধ হয়েছিল!

নাকি বাবার চোখও বন্ধ হয়নি! আমি ভুল দেখেছি। ভুল ভেবেছি!

আমার অবস্থা এখন কেমন, জানিস! এই পাগলি, জানিস তোর ভাইয়ের অবস্থা এখন কেমন!

আমি তোর কপালে আর মাথায় হাত বুলাচ্ছি। তোর গালে মুখে হাত বুলাচ্ছি। নাকের ডগাটা একটু ছুঁয়ে দিলাম। ছোটবেলার সেই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার মতো।

আমাদের পুরেনো আমলের এই বিল্ডিং এমন, প্রতি ঘরে কোনো না কোনো দিক দিয়ে ঢোকে প্রচুর আলো হাওয়া। তোর ঘরে চাঁদের আলো গলগলিয়ে ঢুকছে। রাতের হাওয়া ঢুকছে তিরতির করে। তোর মুখও আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। যেমন পাচ্ছিলাম মা-বাবার মুখ।

আহা রে, তোর মুখটা কী সুন্দর ছিল!

আমার বোনের মুখের মতো সুন্দর মুখ কি এই পৃথিবীর আর কারও আছে?

আছে।

এই দেশেই আছে।

দেশের প্রতিটি বোনের মুখ তোর মুখের মতো সুন্দর। প্রতিটি বোন তার ভাইয়ের জন্য সমান কাতর। সমান ভালোবাসা প্রত্যেক বোনের তার ভাইয়ের জন্য। শচীন কর্তার সেই গানের কথা তোর মনে আছে?

কে যাস রে ভাটিগাঙ বাইয়া

আমার ভাই ধনরে কইয়ো

নাইয়র নিতো আইয়া

নদীর ভাটিতে নৌকা বেয়ে যাচ্ছে মাঝি। নদীতীরের শ্বশুরবাড়িতে আছে এক বোন। ভাইয়ের জন্য মন আকুল। মাঝির উদ্দেশে সে এই গান করে! ভাই যেন তাকে এসে নিয়ে যায়।

এই তো আমার বাংলার বোন!

এই তো আমার দেশের প্রতিটি বকুল।

ও, আমার অবস্থার কথা তোকে বলতে চাইলাম! আমার অবস্থা এখন কেমন সে কথা বলতে চাইলাম!

কেমন একটা গন্ধ আসছে, বুঝলি।

মার সামনে যখন বসেছিলাম তখনো এই গন্ধটাই পাচ্ছিলাম!

মনে হচ্ছে ফুলের গন্ধ! কী ফুল বুঝতে পারছি না। বুনোফুল হবে। অচেনা বুনোফুল। এই বাড়ির কোনো ঝোপ-জঙ্গলে ফুটেছে বর্ষার বুনোফুল। রাতেরবেলাই বুঝি গন্ধ ছড়াচ্ছে সেই ফুল।

নাকি গন্ধটা অন্য কিছুর!

আমার মা বাবা বোন স্ত্রী আর সন্তানের রক্তের গন্ধ!

পচন ধরা মাংসের গন্ধ!

এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি, মাথা কাজ করছে না। হাত-পা লেপ্টালেপ্টি হয়ে আছে মা-বাবার রক্তে, শার্ট-লুঙ্গিতে লেপ্টালেপ্টি হয়ে আছে।

এ তো একরকম ভালোই হয়েছে। আমার শরীরজুড়ে আমার পরিবার। আমার অন্তরজুড়ে আমার পরিবার।

ওই যে আমার অবস্থার কথা বলতে চাইলাম, সেটা শোন।

পঁচিশে মার্চের পর লাখখানেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল বুড়িগঙ্গার ওপারে।

এপ্রিলের ২ তারিখে ওই এলাকায় আক্রমণ চালাল পাকিস্তানি …রা। ফজরের আজানের সময় থেকেই শুরু করল হত্যাকাণ্ড । গান পাউডার দিয়ে জ্বালাল জিঞ্জিরা বাজার। মেশিনগানের গুলি ছোটাল বৃষ্টির মতো। মর্টারের শেল উড়ে আসতে লাগল শিকারি বাজপাখির মতো। ঘুমভাঙা দিশাহারা মানুষ জান বাঁচাতে যে যেদিকে পারে ছুটতে লাগল আর গুলি খেয়ে পড়তে লাগল মাঠঘাট রাস্তা আর ফসলের ক্ষেতে। হাজারখানেক মানুষ এক সকালে মেরে ফেলল ওরা।

আমি আর বাচ্চু মুনিরদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুটছি। রাস্তার ধারে পচা পানি কাদার ডোবা। দৌড়াতে দৌড়াতে আচমকা বাচ্চু আমার হাত থাবা দিয়ে ধরল। হ্যাঁচকা টানে আমাকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ল ডোবায়।

না না আমাদের কারও গায়ে গুলি লাগেনি। গুলি থেকে বাঁচার জন্যই বাচ্চু এটা করেছে। সেই পচা পানি কাদার মধ্যে মাথা জাগিয়ে বসে রইলাম আমরা। এখানে গুলি লাগার ভয় নেই।

এদিক ওদিক পাগলের মতো ছুটছে অসহায় দিশাহারা মানুষ। ডোবায় বসে আমরা দুজন দেখছি।

এ সময় অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য একটা দৃশ্য চোখে পড়ল।

একজন মানুষ প্রাণভয়ে ছুটছে। মর্টারের শেল এসে লাগল তার ঘাড়ে। মাথাটা ছিটকে পড়ে গেল রাস্তার ধারে। মানুষটার ছোটার গতি তখনো থামেনি। সে ছুটছে।

ভাবা যায়, মাথা উড়ে গেছে মর্টার শেলের আঘাতে, তবু মানুষটা ছুটছে।

কয়েক পা মাত্র, মাথাহীন দেহ তার লুটিয়ে পড়ল রাস্তার পাশের ডোবায়।

এই জিনিসের নাম গতি।

আমি কি এখন তেমন এক গতির মধ্যে আছি!

আমার পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের।

আমার মাথা হচ্ছেন বাবা।

কলিজা মা।

চোখ দুটো তুই।

হূদয় হচ্ছে মায়া।

আমার হাত-পা!

আমার হাত-পা আর চালিকা শক্তি হিসাবে পৃথিবীতে আসতে চাইছিল একজন মানুষ। আমার সন্তান। সব, সব চলে গেছে। তবু আমি বেঁচে আছি।

এই অবস্থায় কেমন করে বেঁচে থাকে মানুষ?

বকুল, বছরে যে একবার জ্বর হতো তোর, সে কথা মনে আছে!

চৈত্র-বৈশাখ মাসের দিকে?

তখন স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি হয়ে যেত! আমাদের বাড়ির বৈশাখী আমগাছগুলোতে পাকতে শুরু করত আম।

বৈশাখী আম মানে বৈশাখ মাসে যে আম পাকে।

দাঁড়কাক, পাতিকাক দুই রকমের কাকই পাকা আমে ঠোকর দিত। দু-এক ঠোকর খেতও। আম পাকতে শুরু করলে বোঁটা নরম হয়। কাকপাখির ঠোকরে বোঁটা আলগা হয়ে পাকা আম পড়ে যেত তলায়। আমরা কুড়াতে যেতাম।

তুই, আমি। তুই তখন বেশ ছোট। তাও আমার সঙ্গে যেতি। বারেক পালিয়ে যাওয়ার আগে সেও যেত।

বৈশাখী আম পাকতে শুরু করেছে, এটা জানিয়ে দিত বাড়ির কাকগুলো। আমতলায় হলুদ রংয়ের আম পড়ে থাকতে দেখলেই তুই আর আমি লাফালাফি শুরু করতাম। সন্ধ্যাবেলা বারেক বলত, কাইল বিয়ানে ম্যালা আম পাওয়া যাইবো। বৈশাখী আমগাছের বেবাক আম পাইকা গেছে!

বাড়িতে উত্সব শুরু হতো। বৈশাখের পর একে একে পাকতো সব গাছের আম। আর তখনই তুই জ্বরে পড়লি।

তোর জ্বরের কথা বলার আগে একটা মজার ঘটনা বলি। ছুটির ঘটনা।

যেদিন গ্রীষ্মের ছুটি হবে, সেদিন ক্লাস হতো না স্কুলে। ছাত্ররা সবাই দু-চারআনা পয়সা জোগাড় করে স্যারদের জন্য মালা বানাত। ছুটি ঘোষণার পর স্যারদের গলায় মালা পরিয়ে দিত।

মালাগুলো ফুলের না।

কিসের মালা?

মালা হচ্ছে বিস্কুটের।

পুরা বাজারে এক ধরনের গোল গোল খুব মিষ্টি বিস্কুট পাওয়া যেত। রমেশ মুদির দোকানে টিনভরতি থাকত সেই বিস্কুট।

বিক্রমপুরের ভাষায় মুড়ি কিংবা বিস্কুটের ওই ধরনের টিনকে বলে ‘জের’।

নাম যেন কী ছিল বিস্কুটটার?

না, মনে পড়ছে না।

‘কুকিচ’ নামের একটা বিস্কুটের কথা মনে পড়ছে। ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো দেখতে। বেশ বড় সাইজের বিস্কুট। গ্রামের অনেকেই গোবিন্দর চায়ের দোকানে বসে এক কাপ দুধ চিনি দেওয়া ঘন চায়ে কুকিচ বিস্কুট ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেত।

বাড়িতে আমরাও খেয়েছি। বাবা কিনে আনতেন। অনেক সময় কদম গিয়েও কিনে আনত।

কী যে মজার বিস্কুট! চায়ে ভিজিয়ে একটা খেলেই পেট ভরে যেত। সকালের নাশতা হয়ে যেত।

কিন্তু ওই বিস্কুটটার নাম মনে পড়ছে না। গোল মাঝারি সাইজের বিস্কুট। ছোট ছোট অনেক ছিদ্র বিস্কুটে। ওই ছিদ্র দিয়ে সুতা ঢুকিয়ে বিস্কুটের মালা বানাতাম আমরা। স্যারদের গলায় পরাতাম।

প্রতিটি ক্লাসের ছেলেমেয়েরাই করত।

একআনা দুআনা যে যা পারে বাড়ি থেকে নিয়ে আসত। সব পয়সা একসঙ্গে করে হয়তো একটা টাকা হলো। এক টাকার বিস্কুটে তিন-চারটা মালা হয়ে যেত।

যাদের অবস্থা একটু ভালো, সচ্ছল ঘরের ছেলেমেয়ে, তারা কেউ কেউ সিকি (চার আনা, এক টাকার চার ভাগের এক ভাগ), কেউ আধলি (আট আনা, এক টাকার অর্ধেক) নিয়ে আসত। কোনো কোনো বছর দু-তিন টাকাও হয়ে যেত আমাদের। মালা বেশি বানানো যেত।

আমাদের ক্লাসে মোশারফ নামের একটা ছেলে ছিল। খুবই দুষ্টু প্রকৃতির। বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো না। বাবা কৃষিকাজ করেন। ক্ষেতের ধান, পুকুরের মাছ আর গোয়ালে দুটো গাই গরু, ওই দিয়ে সংসার চলে।

গ্রীষ্মের ছুটির দিনে দু পয়সা এক আনার বেশি মোশারফ কখনো দিতে পারে না।

একবার সে এক টাকার পাঁচটা নোট নিয়ে হাজির। ক্লাসে ঢুকে বীরদর্পে বলল, এবার রমেশ মুদির দোকানের পুরা জের কিনা ফালামু। কুড়ি-পঁচিশটা বিস্কুটের মালা বানামু। একেক স্যাররে দুই-তিনটা কইরা মালা পরামু।

এটা ছুটির আগের দিনের ঘটনা।

পয়সা আমরা আগের দিনই তুলতাম। মালা বানিয়ে রাখতাম আগের দিন। পরদিন স্যারদের গলায় পরাব।

মোশারফের কথা শুনে আমরা অবাক।

বাচ্চু বলল, এত পয়সা কোথায় পাব?

বেবাক আমি দিমু।

আমি বিস্মিত। তুই!

হ। ক্যান, বিশ্বাস হয় না?

বাদল নামের একটা ছেলে বলল, না। তুই তো দুই পয়সা এক আনার বেশি দিতে পারছ না।

এইবার দিমু পাঁচ টেকা!

আমরা সমস্বরে বললাম, পাঁচ টাকা দিবি!

হ, দিমু। এই যে টেকা।

এক টাকার পাঁচটা নোট পকেট থেকে বের করল সে।

আমরা হতভম্ব হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। মোশারফের মতো ছেলে পাঁচ টাকা পেল কোথায়?

পাঁচ টাকা ওই বয়সে আমরা চিন্তাই করতে পারি না।

আমাদের মধ্যে বুলু একটু ট্যাটন টাইপের। বলল, ঘটনা কী রে মোশারফ? এত টেকা পাইলি কই?

কই পাইছি ওইটা জাননের কাম কী?

কাম আছে।

কিয়ের কাম?

তুই দুই পয়সা এক আনাও অনেক সময় দিতে পারছ না। এইবার পাঁচ টেকা পাইলি কই?

আমার দুলাভাইয়ে দিছে।

কিছুদিন আগে মোশারফের বড়বোনের বিয়ে হয়েছে। গরিব গৃহস্থবাড়ির মেয়ের যেভাবে বিয়ে হয়, সে রকম বিয়ে। জামাই দর্জি। বিক্রমপুর এলাকায় দর্জিকে বলে ‘খলিফা’। মোশারফের বোনজামাই খলিফার কাজ করে ঢাকার সদরঘাটে। দু-তিনদিন আগে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসেছে।

বজলু বলল, দুলাভাই তোরে পাঁচ টেকা দিল?

হ, দিল। আমি একমাত্র শালা। কইলাম ইসকুলে মালা দিমু স্যারগো। কোনোদিন দুই পয়সা এক আনার বেশি দিতে পারি না। কোনো কোনো বছর ওই পয়সাটাও দেয় না বাবায়। দুলাভাই, আপনে আমারে এইবার একটা টেকা দেন। ইসকুলের বেবাকতেরে আমি একটু দেখাইয়া দেই আমার কলিজা কত বড়।

বুলু বলল, তোর কথা আমার বিশ্বাস হয় না।

আমি মিছা কথা কই না।

মনে হয় মিছা কথাই কইতাছস।

তয় আমি পাঁচ টেকা পাইলাম কই?

তুই তো দুলাভাইর কাছে চাইলি এক টেকা!

হ, এক টেকাই চাইছি। শুইনা সে কইলো, তুমি আমার একমাত্র শালা। তোমার মান-ইজ্জতের ব্যাপার। এক টেকা না, আমি তোমারে পাঁচ টেকা দিলাম। বেবাক মালা তুমি একলা দেও গিয়া। যাও।

বাদল বলল, খলিফা কামে এত টেকা রুজি হয়?

হয় বেডা, হয়। নাইলে দিল কই থিকা? আর প্যাঁচাল পারিচ না। ল, বাজারে ল। বিস্কুট কিনা আনি। মালা বানাইয়া ফালাই। বিয়ানবেলা সময় পাওয়া যাইবো না।

বাজারের দিকে রওনা দেওয়ার আগে বুলু বলল, তোর কথা অহনও আমার বিশ্বাস হয় না, মোশারফ। মনে হয়, টেকা তুই চুরি করছস!

শুনে বেদম খেপা খেপল মোশারফ। রেগে গেলে সে একটু তোতলায়। তোতলাতে তোতলাতে বলল, দে দে দেখ বুইল্লা, আ আ আমারে যুদি চো চো চোর কছ, তয় ক ক কইলাম ঘুষা দি দিয়া তো তোর দাঁ দাঁ দাঁত আমি ভা ভাইঙ্গা ফা ফা ফালামু।

দুজনের মারামারি প্রায় লেগে যায়।

এইসব মারামারি সামলানোর ওস্তাদ বাচ্চু। সে দুজনকে থামাল। আমরা দলবেঁধে পুরা বাজারে চলে গেলাম।

রমেশ মুদি জানে গ্রীষ্মের ছুটি শুরুর দিন তার ওই বিস্কুট কিনতে যাই আমরা। এজন্য আগেভাগেই দীঘিরপাড় বাজার থেকে দু-তিন জের বিস্কুট পাইকারি দরে কিনে আনে।

সেবারও তা-ই করেছে।

মোশারফ তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে বলল, পুরা এক জের বিস্কুটের দাম কত, রমেশ কাকা?

রমেশ তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, সেইটা জাইনা কাম কী? কয় ছটাক নিবা সেইটা কও।

পুরা জেরের দাম জানতে চাই।

ক্যান, পুরা জের কিনবা?

হ, কিনুম। দাম কন।

সাড়ে চাইর টেকা।

কম হইব না?

কত কম?

তিন টেকা।

না।

সাড়ে তিন টেকা।

না, চাইর টেকা হইলে দিমু।

দেন।

রমেশ মুদি হতভম্ব। সত্যই দিমু?

তয় কি মিছা নি?

রমেশের তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না মোশারফের কথা। সে ফ্যাল ফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকাল।

বুলু বলল, হ, দিয়া দেন। ওর কাছে টেকা আছে।

চার টাকা দিয়ে এক জের বিস্কুট মোশারফ কিনে ফেলল।

ও, জের সমন্ধে আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি। মাথা ঠিক নেই তো, আগের কথা পরে, পরের কথা আগে এসে পড়ছে। জেরের তিন দিকে পাতলা টিন, পরিষ্কার সাদা টিন। অনেক সময় টিন রং করা থাকে। মুখের দিকটাও রং করা। নীল নয়তো সবুজ রং। সামনের দিকে কাচ লাগানো। চকচকে পরিষ্কার কাচ। যেন বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় জেরে কী আছে।

পুরো জেরের বিস্কুট পাঁচটা ঠোঙায় বেঁধে দিল রমেশ। আমাদের একেকজনের হাতে একেক ঠোঙা।

বুলু বলল, আরও একটা টেকা তো রইয়া গেল রে মোশারফ?

হ, এক টেকা রইয়া গেছে।

এই টেকা কী করবি?

ল, জিলাফি খাই। সাধনের দোকানে বৈকালবেলা জিলাফি ভাজে। এক টেকায় বেবাকতে খাইতে পারুম।

বজলু বলল, তয় খাওয়া জিলাফি।

আমি কি না করছি? ল, যাই সাধনের দোকানে।

মোশারফের কাজ কারবারে আমরা থ হয়ে আছি। বাচ্চু আর আমি প্রায়ই মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি।

এটা কী করে সম্ভব!

মোশারফের মতো ছেলেকে তার দুলাভাই দিয়েছে পাঁচ টাকা!

দর্জিগিরির কাজে পাঁচ টাকা তখনকার দিনে এক-দুদিনেও রোজগার করা যায় না। আর শ্যালককে পাঁচ টাকা দিয়ে দিয়েছে দুলাভাই! মোশারফও দুহাতে উড়াচ্ছে সেই টাকা! যেরকম গরিব ঘরের ছেলে সে, ব্যাপারটা একদমই মানায় না।

আমাদের নিয়ে মোশারফ তারপর সাধনের মিষ্টির দোকানে এল। তখন এক টাকায় কতবেল সাইজের কুড়িটা রসগোল্লা পাওয়া যায়। জিলাপি পাওয়া যায় সেরখানেক।

সাধনের দোকানের রসগোল্লারও বিরাট কদর। দেশগ্রামে সাধনের রসগোল্লার নামডাক আছে।

মোশারফ বলল, জিলাফি খাবি, না রসোগোল্লা?

রসগোল্লাকে আমরা বলতাম ‘রসোগোল্লা’।

জিলাপির চেয়ে রসোগোল্লা বেশি স্বাদের। আমরা একত্রে বললাম, রসোগোল্লা, রসোগোল্লা।

মোশারফ বুক ফুলিয়ে সাধনকে বলল, আমরা কয় দোস্ত আছি?

সাধন হাসিমুখে বলল, পাঁচ জন।

এক কুড়ি রসোগোল্লার দাম কত?

এক টেকা।

একদাম?

হ। আমার দোকানে দামাদামি নাই।

ঠিক আছে। একেকজনরে চাইরখান কইরা রসোগোল্লা দেন।

ঠিক আছে, ঠিক আছে।

আমরা বড়দের কায়দায় সাধনের দোকানের বেঞ্চে বসলাম। চিনামাটির মাঝারি আকারের প্লেটে চারটা করে কতবেল সাইজের রসোগোল্লা সাধন অতি যত্নে তুলে দিল। ওই সাইজের চারটা রসোগোল্লা…।

আচ্ছা শোন বকুল, তুই খেয়াল করেছিস, আমিও মোশারফের সেই বয়সের মতো রসগোল্লাকে রসোগোল্লা রসোগোল্লা বলে যাচ্ছি!

না, মাথা আমার সত্যি ঠিক নেই রে।

আমি এলোমেলো, একদম এলোমেলো!

তো, চারটা ওই সাইজের রসগোল্লা কিন্তু ঠিকই খেলাম আমরা। খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে বাচ্চুদের বাড়িতে ফিরলাম। ওই বাড়িতে বসেই মালা বানাব।

মোশারফের আসল ঘটনা জানা গেল পরদিন বিকালে।

বকুল, তোর জীবনের গোপন একটা খবর আমি জানি।

কখনো বলিনি তোকে। বললে লজ্জা পাবি। এখন তো আর লাজ-লজ্জার কথাই নেই। ওসবের বাইরে চলে গেছিস তুই। এখন বলা যায়।

কথাটা আমাকে কে বলেছিল বল তো?

অনুমান কর কে বলতে পারে?

ঠিক, তোর অনুমান ঠিক। মায়া বলেছে, মায়া।

দেখ তো কী পাগলামি করছি। ভাবটা এমন, যেন আমি প্রশ্ন করছি আর তুই সত্যি সত্যি জবাব দিচ্ছিস।

আহা রে, যদি তা-ই হতো!

যদি সত্যি সত্যি তুই আমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারতি!

মায়া একদিন মজা করে বলল, বোনের খবর কিছু রাখো?

বিকালবেলা আমি সেদিন দীননাথ সেন রোডের বাড়িতে। তুইও আছিস। খালার সঙ্গে নিচতলার বারান্দায় বসে ঘন দুধের চায়ে ডালপুরি ভিজিয়ে খাচ্ছিস। আমি আর মায়া লিচুতলার ওদিকটায় পায়চারি করছি।

একবার মায়াকে বলেছি, চল ঘাটলায় গিয়ে বসি।

মায়া তার স্বভাবমতো ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ইস আল্লাদ কত? তোর সঙ্গে বিকালবেলা ঘাটলায় বসে আমি এখন প্রেম করব!

আমি তোকে প্রেম করার কথা বলেছি?

বলে দেখো না!

বলেছি কি না বল।

ওই যে বললাম, বলে দেখো না।

বললে কী করবি?

এখনই গিয়ে মাকে বলব।

কী বলবি?

বলব তোমার বোনপো আমার সঙ্গে প্রেম করতে চায়।

যা বল গিয়ে।

এখন বলব কেন? তোমার কথামতো পুকুরঘাটে গিয়ে আমি তো বসিনি।

বসলেই যে প্রেম করা হবে এটা তোকে কে বলেছে?

আমি বুঝতে পারি।

কী করে বুঝতে পারিস?

আমি কচি খুকি না। নাক টিপলে দুধ বেরোয় না।

হাসলাম। আমি তোকে কখনো প্রেম-ভালোবাসার কথা বলেছি?

মায়া তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, সাহস থাকলে তো বলবে!

মানে আমার সাহস নেই?

না।

তোর আছে?

আছে। অনেক সাহস আছে আমার।

তাহলে তুইই বল না।

কী বলব?

প্রেম-ভালোবাসার কথা।

মানে?

আমাকে তুই ভালোবাসিস, পছন্দ করিস, প্রেম করবি আমার সঙ্গে, বল না!

মায়া চোখ পাকিয়ে কপট রাগের ভঙ্গিতে বলল, ভালো হচ্ছে না কিন্তু।

আমি আগের মতো হাসলাম। বুঝেছি।

কী বুঝেছ?

এক ফোঁটাও সাহস নেই তোর।

সাহস কি পানির মতো যে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝড়বে!

তবে তোর মন আমি বুঝেছি।

কী বুঝেছ?

তুই আমাকে ভালোবাসিস।

দেখ রবিদা, ভালো হচ্ছে না কিন্তু।

আমাকে তুই পছন্দ করিস। খুবই পছন্দ করিস।

ছাই পছন্দ করি তোমাকে। তুমি একটা পছন্দ করার মতো ছেলে হলে?

আমি পছন্দ করার মতো ছেলে না হলে তোর পছন্দের ছেলে কে?

আমার কোনো পছন্দ নেই। তোমার বোনের পছন্দ আছে।

আমি চমকালাম। কী?

মায়া জিভ কাটল, যা বলে ফেললাম।

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, যা বলার পরিষ্কার করে বল মায়া। কাকে পছন্দ বকুলের?

মায়া রেগে গেল। মাস্টারদের মতো গম্ভীর গলায় কথা বলবে না।

তুই বল।

এভাবে কথা বললে বলব না। একসঙ্গে থেকে বোনের খবর রাখো না আবার আমার সঙ্গে মাতাব্বরি।

কী করেছে বকুল? কোন খবর রাখতে হবে তার?

কিছুই করেনি।

তবে যে বললি!

এমনিতেই বলেছি।

কেন মিথ্যা কথা বলছিস। যা বলতে চাইছিস বল।

তোমার ভাব দেখে বলতে ইচ্ছা করছে না।

আমি স্বাভাবিক হলাম। আচ্ছা ঠিক আছে। এই আমি সহজ হলাম। এবার বল।

চলো তাহলে ঘাটলায় গিয়ে বসি।

না।

কেন?

ওখানে গিয়ে বসলে তোর সঙ্গে যদি আমার প্রেম হয়ে যায়?

মায়া নির্বিকার গলায় বলল, খালাতো ভাইবোনে প্রেম হতেই পারে।

মায়ার চোখের দিকে তাকালাম। তার মানে কী রে?

কোনো মানে নেই। চলো ঘাটলায় যাই।

সেই বিকালে একসঙ্গে দুটো ঘটনা জানা হলো আমার। মায়া আমাকে পছন্দ করে, আর তুই পছন্দ করিস বাচ্চুকে। না, বাচ্চু বা তুই কেউ কাউকে পছন্দের কথা বলিসনি। মনে মনে পছন্দ করা। মায়াকেও পরিষ্কার করে বলিসনি। তোরা দুজন দোতলার এক রুমে থাকিস। মায়া তোর বড়। তাও দুজনে খুবই বন্ধুত্ব। মায়া বোধহয় তোর মনের ভেতরটা দেখতে পেয়েছিল। অথবা কোনো কথায় বাচ্চুর প্রতি তোর দুর্বলতা টের পেয়েছিল। কোনো আচরণেও টের পেতে পারে। কোনো ভঙ্গিতে, কিংবা বাচ্চুর দিকে তোর তাকাবার দৃষ্টিতে।

মেয়েরা এসব খুব সহজে ধরে ফেলে।

বাচ্চু আমার বন্ধু। অতিপ্রিয় বন্ধু। জীবনের সবকিছুই আমরা একসঙ্গে করেছি। শুধু বাচ্চু এখনো বিয়ে করেনি, আমি করেছি।

আমার বিয়ের পর বাচ্চুর বাবা, হাশেম মৃধা বাচ্চুকেও বিয়ের চাপ দিয়েছিলেন।

বাচ্চুদের অবস্থা মোটামুটি ভালোই। আমার মতোই মা-বাবার একমাত্র ছেলে। বড়বোন আছে তিনজন। সবাই পিঠাপিঠি। বোনদের বিয়ে হয়েছে ভালো ঘরে। তিনজনই ঢাকায় থাকে।

না না দুজন ঢাকায় থাকে। একজন মিরপুরে, আরেকজন মগবাজারে। ছোটপা থাকেন নারায়ণগঞ্জে। বাচ্চুর বড় দুলাভাইয়ের রেশন দোকান আছে মিরপুরে। নিজেদের বাড়ি। সে গোপালগঞ্জের লোক। মেজো বোনজামাই ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করে। ছোটবোন জামাই নারায়ণগঞ্জে সূতার ব্যবসায়ী।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যে যার শ্বশুরবাড়িতে চলে গেছে। বাচ্চু তাদের খবরাখবর রাখে। ভালোই আছে সবাই।

বাচ্চুদের জায়গা-সম্পত্তি আছে মন্দ না। বংশও নামকরা। আর বাচ্চু তো আমার সঙ্গেই বড় হয়েছে। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন সচ্চরিত্রের ছেলে।

বকুল, বাবা যখন তোর বিয়ের কথা বলতেন, আমি মনে মনে বলতাম, বাচ্চুর সঙ্গেই তোর বিয়ে দেব আমি।

মুখে কখনো বলিনি। মনে রয়ে গেল মনের কথা। আমি আর মায়া নিজেদের পছন্দে বিয়ে করতে পারলে তুই আর বাচ্চু পারবি না কেন?

মুক্তিযুদ্ধ শুরু না হলে এতদিনে তোর বিয়ে হয়ে যেত। বাচ্চু আমি দুজনেই পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকবো ঢুকবো করছিলাম। ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে বাচ্চুর মামা চাকরি করেন। বাচ্চুর জন্য চাকরি সেখানে পাকা করে ফেলেছেন তিনি। জুনিয়র স্টোর অফিসার।

আর আমার চাকরি তো বাবা ঠিকই করে রেখেছেন। স্কুল টিচার হব আমি। বাবার মতো আমাদের স্কুলের টিচার। আমাকে স্কুলে ঢুকিয়ে বাবা রিটায়ার করবেন।

সব স্বপ্ন চূরমার হয়ে গেল রে বকুল। সব শেষ হয়ে গেল।

মায়া অবশ্য গ্রামে থাকতে চায়নি।

ওর ইচ্ছা ঢাকায় থেকে সেও চাকরি-বাকরি করবে। ঢাকায় না থাকলে ছেলেমেয়ে ভালোভাবে মানুষ করা যাবে না। গ্রামে ভালো স্কুল-কলেজ নেই। কোথায় পড়বে আমাদের ছেলেমেয়েরা!

আমাকে একদিন এসব বলার পর বললাম, কিন্তু আমাদের স্কুল?

আমার ছেলে মাত্র মায়ার গর্ভে এসেছে। তখনকার কথা।

মায়া বলল, স্কুলে অন্য টিচার থাকবে। বংশ পরম্পরায় তোমাদেরই চালাতে হবে স্কুল—এমন কথা আছে!

বাবাকে একথা বলতে পারবি?

মায়া চোখ পাকালো। এই, তোমাকে না বলেছি বিয়ের পর আমাকে আর তুই তোকারি করা যাবে না।

হ্যাঁ বলেছ।

তাহলে?

মনে থাকে না।

কেন মনে থাকে না?

ভুলে যাই।

কী ভুলে যাও?

তুমি আমার বউ। শুধু মনে হয়, আরে এটা তো মায়া। আমার খালাতো বোন। মা-র একমাত্র বোনের মেয়ে। তাও ছোটবোন।

এই ভুল যেন আর না হয়।

আচ্ছা হবে না।

তোকে চুপি চুপি একটা কথা বলি বকুল। মায়াকে চেতাবার জন্য আমি ইচ্ছা করেই মাঝে মাঝে ওকে তুই করে বলি। রেগে গেলে মায়াকে খুবই অন্যরকম লাগে।

মায়া বলল, আমি খালা-খালু দুজনকেই বলব, আমরা ঢাকায় থাকতে চাই। দীননাথ সেন রোডের বাড়িতে যে দোতলা টিনের ঘরটা আছে ওটা একেবারে ফক্কা হয়ে গেছে। ওই ঘর ভেঙে দোতলা বিল্ডিং করে দাও। আমার মাও তার শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা-পয়সা আনবে। দু-বোনের টাকায় দোতলা বড়সড় একটা বিল্ডিং হবে। না না, দোতলা না, তিনতলা বিল্ডিং হবে।

তিনতলা কেন?

নিচতলায় বিশাল ড্রয়িংরুম থাকবে, ডাইনিংরুম, কিচেন আর কাজের লোকজনদের থাকার ব্যবস্থা। দোতলার পুরোটা তোমার আমার। তিনতলাটা বকুল আর…

আর?

মানে বকুল আর ওর বরের। আমরা সবাই এক বাড়িতে থাকব।

আমার মা-বাবা? তোর, মানে তোমার মা। আমার শাশুড়ি ওরফে খালা?

মায়া হেসে ফেলল। এতকিছু ভাবিনি। দরকার হলে চারতলা বিল্ডিং হবে। আমাদের কি টাকা-পয়সার অভাব আছে?

কত পরিকল্পনা ছিল আমাদের। কত সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে রেখেছিলাম। তোর জন্য, আমাদের জন্য। কী সুন্দর একটা জীবন পড়েছিল তোর সামনে। পড়াশোনা শেষ করে তুইও ঢুকতি কোনো স্কুল-কলেজে। স্বাধীন বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করার দায়িত্ব নিতি। মায়াও হয়তো স্কুল-কলেজেই ঢুকত। আমি তো ঢুকতামই। বাবাকে বলে স্বর্ণগ্রাম স্কুলের দায়িত্ব অন্য কাউকে দিয়ে ঢাকায় গিয়ে থাকতাম আমরা। ঢাকার কোনো কলেজের টিচার হতাম। স্কুলের হলেও অসুবিধা নেই। তুই আমি মায়া, আমরা তিনজনই বাবার স্পর্শে মানুষ। মানুষ গড়ার শিল্পী হওয়াই ছিল আমাদের জীবনের ব্রত।

তোর যদি বাচ্চুর সঙ্গে বিয়ে হতো, কেমন হতো জীবনটা ভাব তো একবার। আমি মায়া, তুই বাচ্চু চারজন একে অপরের প্রিয় মানুষ এক বাড়িতে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের আনন্দ-বেদনা সুখ-দুঃখ আমরা ভাগ করে নিতাম। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীতে কাটত আমাদের জীবন।

কখনো কখনো গ্রামে আসতাম। হয়তো দুই ঈদেই আসতাম। ঈদের আনন্দটা কাটাতাম গ্রামে, এই বাড়িতে। উঠান-আঙিনায় ছুটাছুটি করত আমাদের শিশুরা, বিকালবেলা বাবা-মা আর বেলা খালা চা খেতে খেতে নাতি-নাতনীদের দেখতেন। আমি মায়া, তুই আর বাচ্চু আমরা গিয়ে বসতাম ঘাটলায়। কদম বুয়া আর নয়তো পারুল, বারেক বাড়িতে থাকলে বারেক আমাদের চা দিয়ে আসত। চা খেতে খেতে, গল্প করতে করতে কখন ফুরিয়ে যেত বিকাল, বাগানের দিকে ডাকাডাকি করত দিনশেষের পাখিরা, ঝোপঝাড়ে ডাকত ঝিঁঝি পোকা, আমরা বসেই থাকতাম। আমাদের গল্প যেন শেষই হতো না।

আর যদি হতো এরকম জ্যোত্স্না রাত। ঘাটলায় হয়তো সবাই এসে বসতাম আমরা। দরদালানের বারান্দায় বাচ্চাদের গল্প শোনাতো বুয়া কদম, পারুল, বারেক আর ঘাটলায় বসে একসময় গান গাইতে থাকতি তুই, নয়তো মায়া।

তোরা দুজনেই ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতি।

আজ জ্যোত্স্না রাতে সবাই গেছে বনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে

হয়তো তুই গাইলি এই গান তারপরই বাবা বললেন, এবার মায়া গাইবে।

বাড়ির বউ শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে গান গাইছে, ব্যাপারটা কেমন না! কিন্তু মায়ার কোনো জড়তা নেই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শুরু করল।

পূর্ণিমা সন্ধ্যায় তোমার রজনীগন্ধায়

রূপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়

হায়রে আমার রূপসাগর, হায়রে আমার পূর্ণিমা সন্ধ্যা, এক সকালে কোথায় মিলিয়ে গেল সব!

আচ্ছা শোন, পারুল যুবতী মেয়ে, ওরও নিশ্চয় বিয়ে দিয়ে দিতেন বাবা। বিয়ে দিয়ে হয়তো এই বাড়িতেই রেখে দিতেন। ওরা স্বামী-স্ত্রী আমাদের বাড়িতেই কাজ করত। কদম ততদিনে বুড়ো হয়ে যেত, তার জায়গায় কাজ করত পারুলের জামাই।

সব শেষ হয়ে গেল। সব।

বকুল, মোশারফের কথা বলছিলাম না!

সেই যে ছেলেবেলায় গ্রীষ্মের ছুটি, বিস্কুটের মালা, রমেশের মুদিদোকান, গোবিন্দর রসগোল্লা আর মোশারফের পাঁচ টাকার কথা বলছিলাম না! দেখ, সেই কথা বলতে বলতে কোথায় চলে গিয়েছিলাম! কোন ভবিষ্যত্ স্বপ্নের জগতে!

পরদিন দুপুরের পর মোশারফের বাবা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। দীন-দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ। লুঙ্গি-ফতুয়া পরা। দুটোই জীর্ণ। তার নাম মন্নাফ হালদার।

বাবা তাঁর ঘরে বসে গ্রামোফোনে গান শুনছেন।

দরজায় দাঁড়িয়ে মন্নাফ হালদার মৃদু শব্দে গলাখাঁকারি দিলেন। বাবা মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকালেন।

মন্নাফ হালদার ম্লান গলায় সালাম দিলেন। স্লামালায়কুম মাস্টার সাব।

ওয়ালাইকুম সালাম। কী খবর হালদার?

বিপদে পইড়া আপনের কাছে আইছি।

কী বিপদ?

এখানে খাড়াইয়াই কমু?

আরে না না ভিতরে আসো।

মন্নাফ হালদার ভেতরে ঢুকলেন।

বেঞ্চ দেখিয়ে বাবা বললেন, বসো।

হালদার বসলেন।

বলো কী হয়েছে?

আমার বড় মাইয়ার বিয়া হইছে কয়েক মাস আগে।

তা জানি। কেমন আছে মেয়ে?

আছিল ভালোই। কাইল রাইত থিকা বিপদ হইছে।

মেয়ে কি তোমার বাড়িতে?

হ। মাইয়া জামাই দুইজনই বাড়িতে। তিনদিন হইল বেড়াইতে আইছে।

তারপর?

জামাইর লগে মাইয়া থাকে ঢাকায়। জামাই সদরঘাটে খলিফাগিরি করে। লঞ্চঘাটের লগে সিলাই মিশিন লইয়া বসে। লুঙ্গি পায়জামা ছিঁড়া জামাকাপড় সিলাই করে।

রোজগার কেমন?

এই কামে আর কেমন রোজগার হইতে পারে, আপনে তো বোঝেনই।

বাবা চুপ করে রইলেন।

হালদার বললেন, জামাই বাসা করছে জিন্দাবাহারের চিপ গল্লির ভিতর। মাসে ভাড়া হইল সাত টেকা।

বুঝেছি। জামাই কি কিছু চায় তোমার কাছে? মানে অবস্থা ভালো করার জন্য সদরঘাটে দর্জি দোকান করবে, এই ধরনের কোনো মতলব?

না ওই রকম কিছু না।

তাহলে?

কাইল রাইত থিকা সে ভাত পানি খাইতাছে না। বিরাট চেতা চেতছে। আমার মাইয়ারে কইছে অরে তালাক দিবো। রাইত থিকা অহনতরি (এখন পর্যন্ত) মাইয়ায়ও কিছু মুখে দেয় নাই। খালি কানতাছে। জামাইর হাতে পায়ে ধরতাছে।

কেন?

আপনের ছাত্রর লেইগা।

মোশারফের জন্য?

হ মাস্টার সাব।

কী করেছে সে?

জামাইর পকেট থিকা পাঁচ টেকা চুরি করছে।

বলো কী?

হ। সেই টেকা দিয়া স্কুলের মাস্টারগো বিস্কুটের মালা দিছে, দোস্তগো লইয়া গোবিন্দর দোকানে রসোগোল্লা খাইছে।

এটা স্বীকার করেছে?

স্বীকার করনের সুযোগ পায় নাই।

মানে?

সন্ধ্যার সময় জামাই যহন উদিস (টের) পাইছে পকেটের আস্ট টেকার মইধ্যে পাঁচ টেকা নাই, যহন এই হগল লইয়া চিল্লাচিল্লি শুরু করছে তখন থিকা মোশারফরে বিচড়াইয়া পাইতাছি না।

রাত্রে বাড়ি ফিরেনি?

না। আইজ সারাদিন ধইরা বিচড়াইছি (খুঁজছি)। কোনোখানে পাই নাই। বাড়ির বেবাকতে বুইঝা গেছে টেকা ও চুরি করছে। আমি সমবাত লইছি পুরা বাজারে গিয়া পশ্শু (পরশু) বিয়ালে (বিকালে) রমেশের দোকান থিকা চাইর টেকার বিস্কুট কিনছে, গোবিন্দর দোকানে বইয়া রসোগোল্লা খাইছে। রবি বাবায়ও লগে আছিল।

বাবা চমকালেন, রবিও ছিল?

জ্বে।

বাবা আমাকে ডাকলেন। বাবা।

আমি আমার ঘর থেকে দৌড়ে গেলাম। ডেকেছ বাবা?

হ্যাঁ।

তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মোশারফের কথা জিজ্ঞেস করলেন। আমি সব বললাম। শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন বাবা। খানিক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুই যা।

বাবার ঘর থেকে আমি বেরুলাম ঠিকই কিন্তু নিজের ঘরে গেলাম না। বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভেতরের সব কথা শুনতে লাগলাম।

হালদার কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, এইটা কেমুন কথা কন মাস্টার সাব। বইন জামাইর জেব থিকা টেকা চুরি! ও কেমুন পোলা? আর মাত্র পাঁচ টেকার লেইগা আমার মাইয়ার সংসার ভাইঙ্গা যাইতাছে। জামাই তালাক দিতে চাইতাছে মাইয়ারে। চোরের গুষ্টি মুষ্টি কইয়া বকতাছে। আমি যে জামাইর হাতে পাঁচটা টেকা দিয়া কমু, মোশারফ পোলাপান মানুষ, ভুল কইরা ফালাইছে, ও তো আপনের শালাই। অরে আপনে মাপ কইরা দেন। হেই ক্ষমতাও আমার নাই। ঘরে পাঁচ টেকা ক্যা, একটা পুরা টেকাও নাই। কই থিকা দিমু? ইচ্ছা করতাছে পোলাডারে বিচড়াইয়া আনি। আইন্না পিডাইয়া মাইরা হালাই। আমার মান-ইজ্জত সব নষ্ট করছে। বইনের জীবন নষ্ট করছে।

কাঁদতে লাগলেন।

বাবা বললেন, কান্নাকাটি করো না।

এবার চট করে উঠলেন হালদার। দুহাতে বাবার একটা হাত জড়িয়ে ধরলেন। আপনে আমার মাইয়ার সংসারটা বাঁচান মাস্টার সাব। পাঁচটা টেকা উধার (ধার) দেন আমারে। জামাইর হাতে টেকাটা দিয়া আমি তার কাছে পোলার হইয়া মাপ চাই। মাইয়ার সংসার টিকাই।

বাবা তাকে বসালেন, বসো বসো। এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আমি ব্যবস্থা করছি।

বুঝলাম বাবা এক্ষুনি তাঁর ঘর থেকে বেরুবেন।

আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। মন পড়ে রইল বাবার ঘরের দিকে।

নিজের ঘরে এসে মাকে ডাকলেন বাবা। রবির মা।

মা ছিলেন ঘুমিয়ে। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে মার একটু ঘুমানোর অভ্যাস। কিন্তু অদ্ভুত ঘুম। দেখে মনে হবে গভীর ঘুমে। ডাকামাত্র সেই ঘুম নেই। সঙ্গে সঙ্গে সাড়া।

চোখ মেলে বাবার দিকে তাকালেন। কী?

দশটা টাকা দাও তো।

মা উঠলেন। কোমরে চাবির গোছা। চাবি ঘুরিয়ে আলমারি খুললেন। পাঁচ টাকার দুটো নোট দিলেন বাবার হাতে।

কোনো প্রশ্ন নেই। আবার শুয়ে পড়লেন। বাবা চলে এলেন তাঁর বসার ঘরে। পাঁচ টাকার নোট দুটো দিলেন মন্নাফ হালদারের হাতে। নাও।

হালদার অবাক। দশ টেকা দিলেন ক্যান? আমি চাইছি পাঁচ টেকা।

নিজের চেয়ারে বসে বাবা বললেন, দশ টাকাই জামাইকে দিবে।

ক্যান? মোশারফ তো নিছে পাঁচ টেকা।

আমি যেভাবে বলে দিচ্ছি সেভাবে কাজটা করবে।

জ্বে বলেন।

প্রথমে পাঁচ টাকার একটা নোট দিবে জামাইর হাতে। দিয়ে বলবে, মোশারফ যে পাঁচ টাকা তোমার পকেট থেকে নিয়েছিল এটা হলো তোমার সেই পাঁচ টাকা। তুমি কিছু মনে করো না বাবা। রাগ করো না। মোশারফ ছেলেমানুষ। ভুল করে ফেলেছে। তাছাড়া সে তো তোমার শ্যালকও। শ্যালক দুলাভাইয়ের সম্পর্কটা মধুর। ঠাট্টা তামাশা করার সম্পর্ক। ধরে নাও সে তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করেছে। মোশারফের ঠাট্টার শাস্তি তুমি আমার মেয়েকে দিতে পার না।

জ্বে।

এসব কথা বললেই, আর পাঁচ টাকা হাতে পেলেই দেখবে জামাইর মন নরম হয়ে গেছে।

জ্বে সেইটা হইবো। জামাই মানুষ খারাপ না। তয় আমগো মতন গরিব মানুষের পোলা। সারাদিন মিশিন চালাইয়া দুই-চাইর টেকা রুজি করে। আমগো লাহান মানুষের কাছে পাঁচ টেকার অনেক দাম মাস্টার সাব।

তা ঠিক।

তয় অন্য পাঁচ টেকা দিয়া কী করুম?

এই টাকাটাও জামাইকে দিবে।

ক্যান?

বলবে এটা দিলাম, মেয়ে নিয়ে আপনি শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে আসছেন, আসা যাওয়ার খরচা আছে না, সেই খরচা বাবদ।

হালদারের মুখে হাসি ফুটল। তয় তো জামাই আমার বিরাট খুশি হইবো।

হ্যাঁ। তা হবে। জামাইকে খুশি করাই এখন সবচে বেশি দরকার।

জ্বে মাস্টার সাব, জ্বে।

তবে আমার আরও কিছু কথা আছে।

বলেন।

তুমি মোশারফকে কিছু বলতে পারবে না।

জ্বে?

মানে ওকে বকাঝকা মারধোর কিছু করতে পারবে না।

এতবড় একটা খারাপ কাম করলো আর অরে কিছু কমু না?

না। ছেলেমানুষ, না বুঝে করেছে। তুমি ওকে কিছুই বলবে না।

তয় আপনে অরে ইকটু শাসন কইরেন।

সেটা আমি বুঝব।

এখন যাওয়ার সময় মোশারফকে খুঁজে বাড়ি নিয়ে যাবে।

জ্বে আইচ্ছা।

মোশারফের মাকে, তোমার বড়মেয়েকে, ছোটমেয়েকে আর জামাইকে, ও তোমার তো ছোট একটা ছেলেও আছে, বাড়ির সবাইকে বলবে ব্যাপারটা নিয়ে কেউ যেন ওর সঙ্গে কোনো কথা না বলে।

আমার দুই ভাইয়ের সংসারের বেবাকতেও হুনছে ঘটনা।

শুনুক। তাদের বলে দেবে আমি বলেছি ব্যাপারটা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবে না। বললে আমি রাগ করব।

না না আপনের নাম হোনলে কেউই আর কোনো কথা কইবো না।

তাহলে এভাবেই সব করবে। ঠিক আছে?

ঠিক আছে মাস্টার সাব।

তাহলে যাও এখন। আর এই টাকা কখনো শোধ করতে হবে না। টাকা আমি এমনিতেই দিয়েছি। হালদার উঠল। পাঁচ টাকার নোট দুটো লুঙ্গির কোঁচড়ে রেখে হাত কচলাতে কচলাতে বিনীত গলায় বললেন, বড় উপকার করলেন মাস্টার সাব। বহুত বড় উপকার করলেন। আমার মাইয়ার সংসার বাঁচাইলেন।

চিন্তা কর বকুল, কোন পরাধীন দেশে আমরা জন্মেছি, কোন পরাধীন দেশে বাস করি। যে দেশে মাত্র পাঁচ টাকার জন্য একটি মেয়ের সংসার ভেঙে যেতে পারে। অথচ আমাদের দেশের টাকায়, হালদারদের মতো গরিব চাষিদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে বৃষ্টিতে, বর্ষা বাদলে, শীতে কুয়াশায় সকাল সন্ধ্যা পরিশ্রমে জন্মানো ফসলে, বিশেষ করে পাটে, সোনালি আঁশে পশ্চিম পাকিস্তানিরা রাজকীয় জীবনযাপন করে। শ্রম আমাদের, আয়েশ ওদের।

এই অবস্থা আর চলবে না।

দেশ স্বাধীন করে আমরা এক নতুন সমাজ গড়ে তুলব। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলব। যে বাংলায় মাত্র পাঁচ টাকার জন্য সংসার ভাঙবে না কোনো মেয়ের, যে বাংলায়…

আমি কেমন বক্তৃতা দিয়ে ফেলছি, না রে বকুল!

থাক, বক্তৃতা থাক। মোশারফের কথা বলি।

মোশারফ লুকিয়েছিল বেসনালের ওয়াজেদদের বাড়িতে। কেমন কেমন করে খবর পেয়ে হালদার তাকে খুঁজে বের করেছেন।

ও, তার আগে আরও কথা রয়ে গেছে।

দশটাকা কোঁচড়ে নিয়ে হালদার বেরিয়ে যাওয়ার পর বাবা আমাকে ডাকলেন। বাবা, বাবা।

আমি দৌড়ে গেলাম। জ্বি বাবা।

বসো।

বুঝলাম বাবার অন্যরকম কোনো কথা আছে।

হালদার যে বেঞ্চে বসেছিলেন সেই বেঞ্চে বসলাম। এখন আর গ্রামোফোন বাজছে না। রেকর্ড চাপানো আছে। বাবার এখন গান শোনার মন নেই।

বাবা।

বলো।

মোশারফের সঙ্গে তোর দেখা হবে?

স্কুল না খুললে দেখা হয় না। ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু না।

তাহলে ওর টাকায় তোরা বিস্কুট কিনলি কেন? মিষ্টি খেলি কেন?

ও খুব বাহাদুরি করে বলছিল, আর স্কুলের বন্ধু…

তোদের সন্দেহ হয়নি এতটাকা ও কোথায় পেল?

হয়েছে।

তাহলে?

ওসব নিয়ে আমরা অনেক কথাও বলেছি।

তারপর?

বলল, দুলাভাই দিয়েছে তোদের নিয়ে খরচা করার জন্য, স্যারদের মালা দেওয়ার জন্য। আমাদের সবারই সন্দেহ ছিল।

বুঝেছি। এখন তোকে একটা কাজ করতে হবে।

কী কাজ বাবা?

হালদারকে আমি বলে দিয়েছি এই ঘটনা সে কাউকে বলবে না। বাড়ির কেউ এসব নিয়ে মোশারফকে কিছু বলা তো দূরের কথা, উচ্চারণও করবে না। যেন ঘটনা বাড়িতে ঘটেইনি।

বুঝেছি।

তোকে যেটা করতে হবে সেটা শোন।

বলো।

তুই তোর বন্ধু-বান্ধব কাউকে কখনো কথাটা বলতে পারবি না।

আচ্ছা।

মোশারফ যে তার দুলাভাইয়ের পকেট থেকে পাঁচ টাকা চুরি করেছিল—একথা তুই আর আমি ছাড়া স্কুলের কেউ জানবে না।

আচ্ছা বাবা।

কেন জানবে না বুঝিয়ে বলি তোকে।

বলো।

এসব কথা রটে যায় দ্রুত। এক কান দুকান করে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী সবাই শুনবে, টিচাররা শুনবেন। মোশারফকে চোর বলে খোটা দেবে অনেকে, হাসাহাসি করবে, গাল দেবে। তাতে ছেলেটার মনে বড় রকমের একটা চাপ পড়বে। মন খারাপ হয়ে থাকবে। নিজে নিজে জ্বলবে, কষ্ট পাবে। এই বয়সি ছেলে এই কষ্ট থেকে একেবারেই খারাপ হয়ে যেতে পারে। আমি চাই না আমার স্কুলের একটি ছেলে খারাপ হোক, একটি ছেলে নষ্ট হয়ে যাক, একটি ছেলে মনের কষ্ট নিয়ে লেখাপড়া করুক। তাহলে লেখাপড়া ওর ভালো হবে না। মোশারফ ছাত্র তেমন ভালো না আমি জানি। তবে চেষ্টা করলে ভালো করবে।

কিন্তু মোশারফ ভালো করল না।

বখেই গেল।

কোনো রকমে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়ল। তারপর যে কাজ করল, ভাবাই যায় না। বেসনালের কবিরাজ আছে একজন, হরিপদ কবিরাজ। তার ক্লাস সেভেনে পড়া কিশোরী মেয়ে পুতুলকে নিয়ে ভেগে গেল। পরির মতো সুন্দর মেয়ে। আমাদের স্কুলেই পড়ত। কেমন করে মোশারফ ওকে পটালো কে জানে। ওইটুকু মেয়ে মোশারফের মতো হতদরিদ্র ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেল।

কোথায় গেল, কে জানে।

এসব নিয়ে কয়েকদিন গরম থাকল গ্রাম তারপর সবাই ভুলে গেল।

কিন্তু আমি মোশারফের কথা ভুলিনি। আমার মনে আছে ওর কথা।

বাবা বলে দিয়েছিলেন বোনজামাইয়ের টাকা চুরি করেছিল মোশারফ—একথা যেন কাউকে না বলি। আমি বলিনি। মোশারফ নিজেই একদিন আমাকে বলল।

দিনটার কথা পরিষ্কার মনে আছে।

বাচ্চুর জ্বর। স্কুলে আসতে পারেনি। টিফিন পিরিয়ডে আমি একা গিয়ে বসে আছি বটতলায়। বটের ছায়ায় ঝিরঝিরে হাওয়া। বটপাতা দুপুরের রোদ গায়ে মেখে হাওয়ার তালে দুলছে।

মোশারফ এসে আমার পাশে বসল।

খবর কী রে রবি? আইজ দেখি একলা? দোস্ত কো?

স্কুলে আসেনি।

হ শুনছি। জ্বর হইছে।

তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?

এমনেই করলাম। কোনো একটা অছিলায় কথা শুরু করতে হইব না!

কী কথা বলতে চাস?

চাই একটা।

বল।

ঘটনা আমি জানি।

কোন ঘটনা?

পাঁচ টেকার ঘটনা।

আমি যেন কিছুই জানি না এমন ভঙ্গিতে বললাম, কোন পাঁচ টাকার ঘটনা।

ওই যে তগো লইয়া পাঁচ টেকা খরচা করলাম।

হ্যাঁ মনে পড়েছে।

টেকা কইলাম দুলাভাইয়ে দেয় নাই।

আমি চমকাবার ভান করলাম। তাহলে?

মোশারফ মৃদু একটা ধাক্কা দিল। সব জাইনাও না জানার ভাব করতাছস ক্যান, রবি। বাবায় তগো বাড়িতে গেছিল। হেডস্যারে…

সেদিন যা যা ঘটেছিল সব বলল মোশারফ। শুনে আমি অবাক। তুই এসব জানলি কী করে?

বাবায় কইছে।

কিন্তু তাঁর তো এসব বলা নিষেধ ছিল।

অন্য কাউরে কয় নাই। খালি আমারে কইছে। তারবাদে সাবধান করছে আমি য্যান কেউরে না কই। আমি ক্যান কমু ক? কারবারটা নিজে করছিলাম। নিজে চুরি কইরা সেই কথা কেউরে কওন যায়।

তাহলে আমাকে এখন বলছিস কেন?

তুই সব জানছ। স্যারে সেদিন তোরে ডাকছিল।

হ্যাঁ।

আইচ্ছা তুই কেউরে কছ না ক্যান?

বাবা মানা করেছেন।

সেইটাও আমি বুজছি।

ঠিক আছে আজ যখন তুই কথা তুলেছিস…

বকুল, খেয়াল করেছিস আমি খুবই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছি। কিন্তু ওই বয়সে বাড়িতে আমরা শুদ্ধ বলতাম ঠিকই, বন্ধুদের সঙ্গে বলতাম না! বন্ধুদের সঙ্গে বিক্রমপুরের ভাষায় বলতাম।

আসলে তোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে শুদ্ধ ভাষাটা এসে যাচ্ছে। ঠিক আছে মোশারফের ভাষায়ই মোশারফের কথা বলি।

মোশারফকে বললাম, ঠিক আছে আইজ যহন তুই কথা তুলছস তয় ঘটনা পুরাটাই ক। হালদার কাকায় দশটেকা লইয়া বাড়িতে গিয়া কী করলো?

স্যারের কথা মতন দুলাভাইরে দিল।

দশটেকা পাইয়া দুলাভাই কী করলো?

বিরাট খুশি।

তর বইনে?

হেয়ও খুশি। বাড়িতে ধুমধাম শুরু হইয়া গেল।

তুই তখন বাড়িতে?

হ আমারে তো বাবায় বাড়িতে লইয়াইছে।

তুই আছিলি কই?

ওয়াজেদগো বাড়িতে।

বইন দুলাভাই গেল কবে?

দুইদিন বাদে।

বাড়িতে তোরে কেউ কিছু কইলোই না?

আরে না বেডা। বাবায় কইলো বাড়ির বাইরে।

কবে?

আফায় দুলাভাইয়ে চইলা যাওনের পর।

তারা তোর লগে কথাবার্তা কয় নাই।

হ কইছে। দুলাভাই মাথায় হাত দিয়া আদর করল। কইলো, যা হওনের হইছে। আমি ভুইলা গেছি। আফায়ও কইলো।

তোর বাবায় কী কইলো?

আফায় দুলাভাইয়ে চইলা যাওনের দুইদিন পর বাবায় আমারে কইলো, আমার লগে চকে (মাঠে) ল। কাম আছে। আমি গেলাম। বাবায় আমার কান্ধে হাত দিল। স্যারের কথা কইলো। কানলো। কানতে কানতে কইলো, এমুন কাম আর কইরো না বাজান। এইবার মাস্টার সাবে তোমার বইনের সংসার বাঁচাইছে, এরবাদে এই রকম ঘটনা ঘটলে কে আমগো বাঁচাইবো, কও?

তুই কী কইলি?

কইলাম, তুমি কাইন্দো না বাবা। জিন্দেগিতে এই রকম কাম আমি আর করুম না।

আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, কিন্তু এইটা তুই করছিলি ক্যান?

জিদ কইরা করছিলাম।

কেমুন জিদ?

তোগো উপরে জিদ।

আমগো উপরে?

হ। তোরা বড়লোকের পোলাপান। দু-চাইর আনা কইরা দেচ এহেকজনে বিস্কুট কিননের লেইগা। আমি দুই পয়সা এক আনার বেশি দিতে পারি না। তাও কোনো কোনো বছর পারি না। তগো কাছে বহুত শরম করতো আমার। ভিতরে ভিতরে জ্বলতাম। এর লেইগা এইবার কামডা করছি। বেবাকতেরে দেখাইয়া দিতে চাইছি আমি পাঁচ টেকাও খরচা করতে পারি। বড়লোকের পোলাপানগো রসোগোল্লা খাওয়াইতে পারি। একলা দিতে পারি কেলাসের বেবাক মালা।

সেই বয়সে বুঝিনি, আজ মোশারফের কথার আসল অর্থ আমি ব্যাখ্যা করতে পারি। প্রত্যেক মানুষের বুকের ভেতর একটা বাঘ থাকে। ঘুমন্ত বাঘ। কোনো না কোনো সময় বাঘটা জাগে। ওই বাঘ জেগে উঠলেই মানুষ বদলে যায়। কোনো না কোনোভাবে বড় কিছু একটা করার চেষ্টা করে। কখনো বুঝে করে কখনো না বুঝে করে।

কবিরাজের মেয়ে পুতুলকে নিয়ে পালিয়ে গেল মোশারফ। তখনো বোধহয় ওর ভেতরকার ঘুমন্ত বাঘটা জেগে উঠেছিল। কিন্তু দুবারই খারাপ কাজ করল মোশারফ। গ্রামে হৈ চৈ পড়ল। মন্নাফ হালদার খুবই বিপাকে পড়ল ছেলের কারণে। লজ্জায় মুখ দেখান না কাউকে। কবিরাজ মশায় এসে বসে থাকেন বাবার কাছে। মেয়ের জন্য কান্নাকাটি করেন।

এই ধরনের ঘটনার কী বিচার করবেন বাবা!

কিছুদিন খোঁজ-খবর করা হলো মোশারফ আর পুতুলের। খোঁজ-খবর পাওয়াই গেল না। কোথায় উধাও হয়ে গেছে কে জানে!

কিন্তু একটি মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেল মোশারফ, এইসব কাজে কিছু টাকা-পয়সা লাগে না! টাকা-পয়সা মোশারফ পেল কোথায়!

পরে জানা গেল পুতুল তার বাবার জমানো শখানেক টাকা, মায়ের গহনাগাটি নিয়ে গেছে। বাড়ির ছোটমেয়ে। সবকিছু তার হাতেই ছিল। মা-বাবা দুজনেই তাকে খুব বিশ্বাস করত, ভালোবাসত, কিন্তু মোশারফের কাছে কী এমন পেল সে, কোন টানে মা-বাবার ভালোবাসা, ভাই-বোনদের ভালোবাসা উপেক্ষা করল, কে জানে!

কবিরাজ মশায়ের ছয় ছেলেমেয়ে। বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। একজন থাকে বরিশালে। জামাইর ছোটখাটো থান কাপড়ের দোকান। পরের মেয়ে আর বড়ছেলে থাকে নারায়ণগঞ্জে। মেয়ের জামাই গেঞ্জির হোঁসিয়ারিতে কাজ করে, ছেলে কাজ করে কবিরাজ মশায়ের এক আত্মীয়ের সূতার আড়তে। তার পরের দুই ছেলে আমাদের স্কুলে পড়ে। ওরা যমজ। দুজনেই পড়ে ক্লাস নাইনে। ছাত্র তেমন সুবিধার না।

পুতুলও ছাত্রী ভালো না। দেখতে সুন্দর। স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখত।

এই মেয়ে পছন্দ করল মোশারফকে?

আশ্চর্য ব্যাপার।

মানুষের মন বোঝা খুব মুশকিল। একে মোশারফ মুসলমান, তার ওপর হতদরিদ্র ঘরের বখে খাওয়া ছেলে। মানুষ যে কার ভেতর কী আবিষ্কার করে! মানুষের মন যে কী চায়, বোঝা মুশকিল।

অথচ আমাদের স্কুলে বানীখাড়ার মুখার্জি বাড়ির অপু পড়ত। ওরা একসময় এলাকার প্রভাবশালী ছিল। পার্টিশানের পর বংশের সবাই প্রায় কলকাতায় চলে গেছে। অপুরা রয়ে গেছে। বাবার ধানচালের বিশাল আড়ত দীঘিরপাড় বাজারে। অপু দেখতে ভালো, নম্র-বিনয়ী, ছাত্রও ভালো। সে তখন পড়ে ক্লাস টেনে। বাবা আশা করছেন অপু ফার্স্ট ডিভিশান পাবে এসএসসিতে।

আমরা জানতাম, অপু মনে মনে পছন্দ করে পুতুলকে! কিন্তু পুতুল বেছে নিল মোশারফকে! রাতের অন্ধকারে বাবার জমানো টাকা, মায়ের গহনা আর নিজের জামাকাপড় টিনের সুটকেসে ভরে মোশারফের সঙ্গে পালিয়ে গেল!

গেল তো গেলই। কোনো হদিস নেই। মোশারফ এবং পুতুলের দিককার সব আত্মীয়-স্বজনের, যে যেখানে থাকে সর্বত্র খোঁজখবর করা হলো।

না নেই। পুতুল আর মোশারফ কোথাও নেই।

এসব নিয়ে গ্রামে কিছুদিন চাপা গুঞ্জন চলল, স্কুলে চলল, তারপর ধীরে ধীরে সব থেমে গেল।

বাবা অবশ্য কঠিনভাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, স্কুলে ওদের নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ। মোশারফ এবং পুতুলকে নিয়ে কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না।

মানুষ ধীরে ধীরে সব ভুলে যায়। আমরাও ভুলে গেলাম মোশারফ আর পুতুলের কথা। হয়তো মোশারফদের বাড়ির লোকে ভুলল না, হয়তো কবিরাজ মশায় ভুললেন না।

তবে বহু বহু বছর পর, বছর দেড়েক আগে মোশারফের সঙ্গে হঠাত্ করেই আমার দেখা হয়েছিল, বকুল। আমি প্রথমে চিনতেই পারিনি—এটা মোশারফ।

বাহাদুর শাহ পার্কের ওদিকটায়, মানে বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে সদরঘাটের দিকে যেতে, বাংলাবাজার হাইস্কুলের দিকটায়, স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার বিল্ডিংটার পশ্চিম পাশে, রাস্তার ওপারের কোণায় একটা পত্রপত্রিকার টংঘর ধরনের দোকান, তার সঙ্গে লম্বা ধরনের একটা রেস্টুরেন্ট। কী কাজে ওইদিকে গেছি। সেদিন বাচ্চু নেই সঙ্গে, আমি একা। ওই দোকানের চা অসাধারণ। ভাবলাম এক কাপ চা খাই।

ঢুকলাম।

রেস্টুরেন্টে তেমন ভিড় নেই। সামনের দিককার টেবিলে বসে চায়ের অর্ডার দিয়েছি। ভেতর দিককার টেবিল থেকে একজন মানুষ উঠে এসে দাঁড়াল আমার সামনে। রবি না?

আমি থতমত খেয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। পরনে টেটরনের সাদা প্যান্ট, গায়ে হাফহাতা নীল রংয়ের শার্ট, পরিষ্কার করে কামানো মুখ, স্বাস্থ্য ভালো, অর্থাত্ একটা সুখী সুখী চেহারার মানুষ। আমি চিনতেই পারলাম না।

কী রে, চিনস নাই?

না।

সে আমার কাঁধে হাত দিল। আরে বেডা আমি মোশারফ। মন্নাফ হালদারের পোলা। তোর লগে এক ক্লাসে পড়তাম।

আমি থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মোশারফ!

হ বেডা।

কী করে চিনব বল, এত এত বছর পর দেখা!

আমি হাত ধরে মোশারফকে বসালাম। বস বস।

মেসিয়ারের দিকে তাকিয়ে বললাম, দুকাপ চা।

চা আমি এখনই খাইছি এক কাপ। ভাত খাইয়া তারপর চা খাইলাম।

তুই থাকিস কোথায়?

কুমিল্লা টাউনে।

করিস কী?

ছোটখাটো ব্যবসা করি দোস্ত। খলিফা দোকান দিছি।

তাই নাকি?

হ। পাঁচজন কর্মচারী লইয়া দোকান চালাই। দোকানটা আগে ছোট আছিল। কিছুদিন হইল একটা বড়দোকান লইছি। দোকানের সামনের দিকটায় থান কাপড় রাখি। দোকানেই কাপড় কিনতে আসে কাস্টমার, দোকানেই শার্ট-প্যান্ট, পায়জামা-পাঞ্জাবি, সেলোয়ার-কামিজ, ফ্রক এইসব বানাইতে দেয়।

বাহ। ভালো তো!

হ দোস্ত। আল্লাহপাক ভালো রাখছে।

চা এল। আমরা চায়ে চুমুক দিলাম।

আমার মনে তখন পুতুল। কীভাবে পুতুল প্রসঙ্গ তুলি, ভাবছিলাম।

মোশারফ বলল, কী চিন্তা করছ?

করি একটা চিন্তা।

বুজতে পারতাছি। পুতুলের কথা চিন্তা করতাছস না?

হ।

পুতুল ভালো আছে।

কেমুন ভালো?

বহুত ভালো। আরে অর লেইগাই তো আইজ আমি এই অবস্থায় আইছি।

কেমনে?

ওর বাপের টেকা, ওর মার গয়নাগাটি বিক্রি কইরা এই অবস্থা আমার।

তাই নাকি?

হ। তোরে যখন পাইছি, কই বেবাক ঘটনা।

ক।

সময় আছে তোর? নাকি ব্যস্ত?

না তেমন ব্যস্ত না। বল।

আমি অবশ্য কাম-কাইজ সাইরাই আইছি।

কী কাম?

ঢাকায় আইছি মাল কিনতে। ইসলামপুরে বোম্বাইয়াগো থান কাপোড়ের দোকান থিকা মাল নেই। একজন কর্মচারী আছে লগে অরে দিয়া মাল কিনা পাঠাইয়া দিয়াই এইদিক আইছি ভাত খাইতে। তোর লগে দেখা।

আইজই কুমিল্লা চইলা যাবি?

হ।

কুনসুম?

সন্ধ্যার ট্রেনে।

আমি চায়ে চুমুক দিলাম। পুতুলের কথা ক।

কইলাম না ভালো আছে।

পোলাপান কয়জন তোর?

নাই।

মানে?

হয় নাই।

এতদিন হইল বিয়া করছস…

পুতুল কোনোদিন মা হইব না দোস্ত।

কচ কী?

হ ও হইল বাঁজা।

তা-ই নাকি?

হ। তয় এইসব লইয়া আমার কোনো দুঃখ নাই। পুতুলের আছে। সে মাঝে মাঝে দুঃখ কইরা কয়, আমি তোমারে পোলাপান দিতে পারতাছি না, তুমি আমারে রাখছো ক্যান? আরেকটা বিয়া করো। আমি উল্টা তারে বুঝাই। পোলাপান না দিছো কী হইছে, আমারে তো ভালো একটা জীবন দিছো। সারাজীবন আমার লগে থাইকো, আমার হাত ধইরা থাইকো, তাতেই আমি খুশি।

শুইনা বহুত ভালো লাগল রে! তুই বহুত বদলাইয়া গেছস মোশারফ।

আমারে বদলাইয়া দিছে পুতুল। তয় দোস্ত আমার আর লেখাপড়া হয় নাই, কিন্তু পুতুলরে আমি পড়াইছি। আইএ পাস কইরা নার্স হইছে পুতুল। কুমিল্লা সরকারি হাসপাতালের নার্স। বহুত ভালো নার্স। নার্স হিসাবে ভালো নাম করছে।

শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বাহ। এইটা একটা কামের কাম করছস দোস্ত।

মোশারফ হাসিমুখে চায়ে চুমুক দিল।

পুতুল এখন কোথায় আছে জানিস বকুল? আগরতলার বাংলাদেশ হাসপাতালে। দিনরাত কাজ করছে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায়। মোশারফ ব্যবসা-বাণিজ্য ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। সে যুদ্ধ করছে রণাঙ্গনে, বউ যুদ্ধ করছে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাবার কাজে।

সেই বখাটে মোশারফ, সেই ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় কিশোর প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া পুতুল, স্বাধীনতা যুদ্ধ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে তাদের। দেখ বকুল, মোশারফ পুতুলের মতো আমিও কেমন বদলে গেছি। বোনের লাশের সামনে বসে বোনের কথা না বলে, তার শোকে কাতর না হয়ে, পাথর না হয়ে আমি বলছি মোশারফের কথা, পুতুলের কথা।

তোর অবাক লাগছে না?

তোর খুব অবাক লাগছে না বকুল!

ভাইয়ের এই আচরণে তোর অবাক লাগছে না?

বকুল, তোর সেবারের সেই জ্বরের কথা মনে পড়ছে। জ্বর ছাড়ছেই না তোর। পাঁচদিন, সাতদিন কেটে যায়। ডাক্তার কাকা দুবেলা আসেন। মিকচার দিয়েছেন, ট্যাবলেট দিয়েছেন। মুহূর্তের জন্যও জ্বর ছাড়ছে না। বাবা-মা তো চিন্তিতই। ডাক্তার কাকা পর্যন্ত চিন্তিত হয়ে গেলেন!

জ্বর ছাড়বে না কেন?

কী জ্বর?

টাইফয়েড?

জ্বরের ধরনটাই ধরতে পারছে না ডাক্তার কাকা। এলাকার এত নামকরা ডাক্তার, জন্মের পর থেকে তোকে আমাকে দেখছেন, বাড়ির সবাইকে দেখছেন, কখনো এমন হয়নি।

বাবার সঙ্গে চিন্তিত মুখে বসে থাকেন ডাক্তার কাকা। তোর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। বাড়ির সবাই তোকে নিয়ে চিন্তিত। জ্বরে জ্বরে এমন অবস্থা হয়েছে, তোর মুখের দিকে আমি তাকাতে পারি না। আমার বুক ফেটে যায়! শুধু কান্না পায়।

বাড়ির সবাই সারারাত জেগে বসে থাকে তোর পাশে। বাবা-মা, বুয়া পারুল। কদম বসে থাকে বারান্দায়। থেকে থেকে তামাক খায়।

আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। তুই ক্লাস টু তে। সামার ভেকেশান চলছে।

বাচ্চু যখন তখন আসছে আমাদের বাড়িতে। তোর জ্বরের খোঁজ-খবর নেয়া, আমি মন খারাপ করে থাকি, আমাকে সান্ত্বনা দেয়। এত চিন্তা করিছ না রবি, বকুলের জ্বর ছাইড়া যাইবো।

কবে সারবো? আমি তো আমার বইনের মুখের দিকে তাকাইতে পারি না।

বাচ্চু আমার কাঁধে হাত দেয়। এত ভাইঙ্গা পড়লে চলে! ভাইঙ্গা পরিছ না।

বাচ্চুর কথা শুনে কান্না পায়। চোখের পানি শুকাবার জন্য আমি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি। কথা বলতে পারি না।

কদম একদিন কবিরাজ মশায়কেও ডেকে আনল। তিনিও দেখে গেলেন তোকে। গাছের শিকড়-বাকড় পাতা রস এইসব দিয়ে তৈরি ওষুধ দিলেন। সেই ওষুধও চলল।

কাজের কাজ কিছুই হয় না।

দীঘিরপাড় বাজারে নন্দ ডাক্তার আছেন। হোমিওপ্যাথিক। তিনিও এলেন একদিন। হোমিওপ্যাথিও চলল। একসঙ্গে তিন রকমের চিকিত্সা।

না কাজ হয় না।

ডাক্তার কাকা বলছিলেন, এত কিছুর দরকার নাই। ঢাকায় নিয়া যাও মাস্টার। মিটফোর্ড মেডিক্যালের বড় ডাক্তার দেখাও।

বাবা সেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

বেসনালে একজন ফকির আছে। মালেক ফকির। ঝাড়ফুক করে, পানি পড়া দেয়। বুয়া একদিন তাকেও নিয়ে এল।

বাবা অবশ্য এসব বুজরুকি একদমই সহ্য করেন না। কিন্তু সেদিন কোনো কথা বললেন না। মেয়ের এই অবস্থা, কী বলবেন! কে জানে কোনদিক দিয়ে কার কারণে সেরে ওঠে তাঁর মেয়ে!

কাজ হলো না।

জ্বর আগের মতোই। এত দুর্বল হয়েছিস তুই, পরিষ্কার করে কথাই বলতে পারিস না। চোখ খুলতেও যেন কষ্ট।

মা আড়ালে কাঁদেন।

বাবা গম্ভীর হয়ে তোর শিয়রে বসে থাকেন।

আমি দাঁড়িয়ে থাকি দরজার সামনে। তারপর বাগানের দিকে চলে যাই, ঘাটলায় গিয়ে বসে থাকি। মন পড়ে থাকে তোর কাছে। শুধু মনে হয় তুই বাঁচবি তো? তুই মরে যাবি না তো? এই জ্বরে সবাইকে ছেড়ে যাবি না তো তুই?

আমাদের আনন্দে ভরা বাড়িটি যেন ম্লান হয়ে গেছে। একদম বিষণ্ন হয়ে গেছে। যেন বাড়ির কবুতরগুলোও ঠিকঠাকমতো ডাকে না, মোরগ-মুরগি তাদের মতো চড়ে বেড়ায় না। কুকুর-বিড়াল বাড়িতে তখন ছিল কি না মনে নেই। গরুগুলো ছিল। নিয়ম করে তাদের মাঠে নিচ্ছে কদম, বিকালবেলা বাড়ি আনছে। গরুগুলোরও যেন তোর জন্য মন খারাপ। হাম্বা ডাক তারা আর ডাকে না। বাগানের দিকে আগের মতো যেন ডাকাডাকি করে না পাখিগুলো, গ্রীষ্মের ফোটা ফুল গন্ধ ছড়ায় না। হাওয়ার চলাচলই যেন নেই। ঘুঘুর ডাকে নির্জন দুপুর আরও নির্জন হয়।

আমি একা একা হেঁটে সামনের দিককার পুকুরঘাটে চলে গেছি। বিকাল হয়ে আসা রোদ ছড়িয়ে আছে চারদিকে। ঘাটলায় ছায়া ফেলে আছে বিশাল দুটো বকুলগাছ। বকুলের ছায়ায় বসে ভাবছি আমার বকুলের কথা। আমার বোনটির কথা। ভাবতে ভাবতে কখন কাঁদতে শুরু করেছি মনে নেই। চোখের পানিতে গাল বুক ভেসে যাচ্ছে।

এসময় পেছন থেকে কে আমার কাঁধে হাত দিল।

চমকে তাকিয়েছি। দেখি, আমাদের স্কুলের ধর্ম টিচার মাওলানা গোলাম মুস্তাফা স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে সাদার ওপর হালকা সবুজ ডোরাকাটা পরিষ্কার লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবি। মাথায় সাদা গোলটুপি।

স্যারের গায়ের রং খুব ফরসা। মুখের চাপ দাড়িতে পাক ধরেছে। চেহারা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। ভক্তি-শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। আর গলার স্বর শুনলে, কথা বলার ভঙ্গিতে যত কঠিন হূদয়ের মানুষই হোক বিনীত না হয়ে পারবে না।

স্যারকে দেখে আমি উঠে দাঁড়ালাম। দুহাতে চোখ মুছে সালাম দিলাম। স্লামালেকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম সালাম।

কখন আসছেন স্যার?

এখনই আসলাম। শোনলাম বকুলের জ্বর ভালো হইতাছে না, ওরে একটু দেইখা যাই। তেঁতুলতলার ওদিক দিয়া তোমাদের বাড়িতে ঢুকছি। হঠাত্ দেখি পুস্কুনির ঘাটে তুমি বইসা আছো। তোমার চোখের পানি দূর থিকাই দেখছি। এইভাবে কানতাছো ক্যান, বাবা?

স্যারের হাত তখনো আমার কাঁধে। একদিকে তার হাতের স্পর্শ, অন্যদিকে মায়াবী গলায় ওইসব কথা। আমার বুক হু হু করে উঠল। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। স্যার, বকুলের জ্বর ভালো হয় না। বকুল মনে হয় বাঁচবো না। বকুল মইরা গেলে আমিও মইরা যামু স্যার। আমিও বাঁচুম না। আমার বোনরে ছাড়া আমি কেমনে বাঁচুম!

কিন্তু এখন আমি বেঁচে আছি কী করে, বকুল!

তুই নেই, আমি বেঁচে আছি কী করে!

মা নেই বাবা নেই, তুই নেই মায়া নেই, আর আমার ওইটুকু ছেলে, চোখ দুটো ফোলা ফোলা, যেন গভীর কষ্টে কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে, জীবনের প্রিয়তম সবকজন মানুষ হারিয়ে কী করে বেঁচে থাকে মানুষ!

আমি বেঁচে আছি কেমন করে!

চাঁদের আলো এখন আরও প্রখর। এমন করে এসে ঢুকেছে ঘরের ভেতর, তোর ঠিক মুখের ওপর চাঁদের আলো। আমার হাত তোর মুখে-মাথায়, নিজের অজান্তেই হাত বুলাচ্ছি, চাঁদের আলোয় মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে তোর মুখ, আমার হাত। রাত দুপুরের হাওয়াটা আছে, হাওয়ায় আছে অচেনা ফুলের গন্ধ। ঝিঁঝি ডাকে, চাঁদের আলো ভেঙে নিঃশব্দে উড়ে যায় বাদুড়, দূরে কোথায় যেন কী একটা পাখি ডাকে, আমি বসে থাকি তোর শিয়রে। বসেই থাকি। মনে পড়ে সেই বিকালের কথা। ধর্ম স্যারের কথা।

আমাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে আমার মাথাটা তিনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন। গভীর মমতায় মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, কাইন্দো না বাবা, কাইন্দো না। এইভাবে কাইন্দো না। বোনের জন্য আল্লাহপাকের কাছে দোয়া চাও। হে আল্লাহ, হে পাকপরোয়ারদিগার, দ্বীন দুনিয়ার মালিক, আমার বোনরে তুমি দয়া করো। তার ওপর তোমার রহমত বর্ষণ করো। তোমার রহমতের সবগুলি দরজা তার জন্য খুইলা দাও। দেখবা আল্লাহপাক দয়া করবো, তোমার বোন আল্লাহর রহমতে ভালো হইয়া যাইবো।

বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন তিনি। যাই, বকুলরে দেইখা আসি।

স্যারের কথামতো ঘাটলায় বসে সারাটা বিকাল আমি তোর জন্য আল্লাহর কাছে দয়া চাইলাম। স্যার যেভাবে বলে দিয়েছিলেন, ঠিক সেইভাবে। বিকাল ফুরিয়ে কখন সন্ধ্যা হলো টেরই পেলাম না।

পরদিন তোকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে। সেই প্রস্তুতি চলছে। রাতেরবেলা বাবা আমাকে ডাকলেন। বাবা।

জ্বি বাবা।

এদিকে আয়।

বাবা হাতলঅলা চেয়ার নিয়ে বসে আছেন বারান্দায়। আমি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বারান্দায় তেমন আলো নেই। বিভিন্ন ঘরের হারিকেনের আলো যতটা ছিটকে এসেছে বারান্দায়, আলো ওইটুকুই। উঠানের দিকে ঘোরতর অন্ধকার।

বাবা বললেন, ঘাটলায় বসে কাঁদছিলি?

আমি কথা বলি না।

মুস্তাফা সাহেব বললেন।

আমি তবু কথা বলি না।

কান্নাকাটি করিস না। বিপদ নিশ্চয় কেটে যাবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,

বিপদে মোরে রক্ষা করো

এ নহে মোর প্রার্থনা

বিপদে আমি না যেন করি ভয়

বাবার কথা শুনে আবার কান্না পেল। চোখের পানি সামলাতে নিজের ঘরে ফিরে এলাম।

আশ্চর্য ব্যাপার, ভোররাতে তোর জ্বর ছেড়ে গেল। হঠাত্ করেই ছেড়ে গেল। তুই চোখ মেলে তাকালি ঠিক ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে।

চারদিকে আলো ফুটল। বেশ কয়েকদিন পর আমরা যেন সুন্দর একটা সকালবেলা দেখলাম। তোর জ্বর সেরে গেছে, আমাদের বাড়ি যেন আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। সকালের রোদ প্রতিদিনকার চে অন্যরকম করে ছড়িয়েছে। রোদের যেন তাপই নেই। মায়ের আদরের মতো রোদ। হাওয়া বইছে, গাছের পাতায় পাতায় আলোর নাচন। পাখি ডাকছে গলা খুলে। কাক শালিক খাবারের খোঁজে নেমেছে উঠানে। মুরগি চড়ছে, কবুতর ডাকছে। গরুগুলো খুশি মনে কদমের সঙ্গে চলে গেল মাঠে। বুয়া পারুল যেন অনেকদিন পর নাশতা বানাতে ঢুকল রান্নাঘরে।

তাহলে কি ঢাকায় যাওয়া হবে না?

বাবা-মা দুজনেই বসে আছেন তোর পাশে। আমি দাঁড়িয়ে আছি তোর মাথার কাছে।

বাবা বললেন, আজকের দিনটা দেখব?

মা বললেন, কী দেখবেন?

জ্বর আর আসে কি না! জ্বর এলে কাল রওনা দেব, না এলে…

দশটা এগারোটার দিকে ডাক্তার কাকা এলেন। তোকে দেখে বললেন, ঢাকায় যেতে হবে না। জ্বর আর আসবে না।

সত্যি সত্যি আর জ্বর এল না তোর। সেদিন বিকালবেলাই উঠে দাঁড়ালি।

এখন আমার কী মনে হচ্ছে জানিস!

মনে হচ্ছে এই সময়টা যদি বদলে যেত। এই সময় যদি চলে যেত আমার সে ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে। ক্লাস টুতে পড়া তুই গ্রীষ্মের ছুটিতে জ্বরের ঘোরে বিছানায় পড়ে আছিস। ধর্ম স্যার আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহকে ডাকো। বোনের জন্য রহমত চাও আল্লাহর কাছে। আল্লাহপাক দয়া করবেন। আমি সারারাত এইভাবে বসে তোর জন্য আল্লাহপাকের কাছে দয়া চাইতাম। আল্লাহ আমার বোনকে তুমি দয়া করো। তার ওপর তোমার রহমত বর্ষণ করো। তোমার রহমতের সবগুলো দরজা খুলে দাও তার জন্য!

বকুল, তুই যে কোন ফাঁকে বড় হয়ে গেলি টেরই পেলাম না। আমার কাছে সব সময়ই তুই সেই ছোট্ট বকুল। ফড়িং ধরছিস, প্রজাপতির পেছনে ছুটছিস। সারাক্ষণ ব্যস্ত, চঞ্চল বোনটি আমার।

সেই বোন এসএসসি পাস করল। ঢাকায় গিয়ে কলেজে ভর্তি হলো। মায়া আমাকে তার মনের খবর পর্যন্ত বলে দিল।

আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না এমন হতে পারে!

এইটুকু মেয়ে…

কথাটা সেই বিকালে মায়াকে বোধহয় বলেও ছিলাম।

মায়া বলল, বোনের দিকে তাকিয়ে দেখো না! তাকিয়ে দেখো সে বড় হয়ে গেছে। কলেজে পড়ে।

সেদিনই আমার মনে হলো, আরে তা-ই তো! তুই কলেজে পড়িস। বড় হয়ে গেছিস! সেদিন থেকে তোর প্রতি বাচ্চুর দুর্বলতা আমি খেয়াল করতাম।

বাচ্চু খুবই চাপা স্বভাবের ছেলে। আমি ওর অনেক কিছুই বুঝতাম আবার অনেক কিছুই বুঝতাম না।

তোর ব্যাপারটা একবিন্দুও সে আমাকে বুঝতে দেয়নি। তোর চে আট বছরের বড়, ভাইয়ের বন্ধু। আট বছরের ব্যবধানে বিয়ে তো হতেই পারে!

তোর কথা, মানে বাচ্চুকে তুই পছন্দ করিস—এটা যেমন মায়া আমাকে বলেছিল, আবার মায়া যে আমাকে পছন্দ করে—এটা প্রথম আমাকে বলেছিলি তুই। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। তুই একদিন বললি, তোমাকে একটা কথা বলব দাদা।

বল।

রাগ করতে পারবে না।

আচ্ছা।

তিনবার বলো।

তিনবার বলছি।

একজন মানুষ তোমাকে খুব পছন্দ করে।

জানি।

তুই আকাশ থেকে পড়লি। জানো?

হ্যাঁ জানি তো?

কে বলো তো?

বাচ্চু। আমার বন্ধু। সে সত্যি আমাকে খুব পছন্দ করে।

শুনে তুই এমন করে হাসতে লাগলি, হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাচ্ছে তোর। স্থান, দীননাথ সেন রোড। সময়, দুপুর সাড়ে তিনটা, পৌনে চারটা।

আমি দোতলা ঘরের নিচতলায় বসে সেদিনকার ‘ইত্তেফাক’ পড়ছি।

তুই কি তখন কলেজের ছাত্রী! নাকি তখনো স্কুলে পড়িস! এসএসসি দিবি! ঘটনাটা কি ওই সময়কার! খালার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিস!

সময়টা আমি গুলিয়ে ফেলছি বকুল!

না না তুই তখনো কলেজের ছাত্রী না। স্কুলেই পড়িস। আমি ইউনিভার্সিটিতে। অনার্স বোধহয় শেষ করেছি।

দুপুরের পর বাড়িটা খুব নির্জন হয়। এসময় বাবার মতো গ্রামোফোন বাজিয়ে গান শোনে মায়া। সে তার মতো গান শুনছে দোতলার ঘরে।

সেদিনকার সেই গানের কথা পরিষ্কার মনে আছে আমার।

স্বপ্ন ভরা স্বপ্ন মায়া

নিবিড় কালো, আঁধার ছায়া

সন্ধ্যা নামে ওই নীল গগনে হায়

কার গান কে জানে। ভারি সুন্দর গান। শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়। গানের ভেতর মায়া শব্দটা আছে। তুই হাসতে হাসতে বললি, বাচ্চু দাদা তোমাকে পছন্দ করে—এটা বলার জন্য তোমাকে আমি বলব, তিনবার বলো, রাগ করবে না!

আমি তোর দিকে তাকালাম। তাই তো! তাহলে কে আমাকে পছন্দ করে?

একটি মেয়ে।

কী?

হ্যাঁ।

মেয়েটি কে?

মায়াপা গান শুনছে না, ওই গানটা শোনো।

শুনছি তো!

ওই গানে সেই মেয়ের নাম আছে।

আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম। তারপরও না বোঝার ভান করতে লাগলাম। বুঝতে পারছি না। নামটা বল!

তুমি ভাবো। ভাবলেই বেরিয়ে যাবে।

নাম কি স্বপ্ন?

স্বপ্ন কোনো মেয়ের নাম হয় না।

স্বপ্না হয়।

হ্যাঁ।

তাহলে কি নিবিড়?

ধুত্।

আঁধার।

এরকম নাম হয় কোন মেয়ের? মেয়ের কেন, কোনো মানুষের নামই আঁধার হতে পারে না।

ছায়া!

এটা মেয়েদের নাম। কিন্তু তার নাম ছায়া না।

সন্ধ্যা?

না।

নীল গগন!

দাদা, ফাজলামো করো না। জানি তুমি বুঝতে পেরেছ। মুখে গানের প্রায় সবগুলো শব্দই বললে শুধু একটা শব্দ বাদ দিয়ে গেছ?

কোনটা বল তো?

তুমিই বলো। চালাকি করো না?

আমি তোর মুখের দিকে তাকালাম। যেন কিছুই বুঝতে পারিনি এমন গলায় বললাম, ও হ্যাঁ, মায়া শব্দটা বাদ দিয়ে গেছি।

এই তো আসল কথায় এলে। এই নামের মেয়েটিই তোমাকে পছন্দ করে।

তোকে বলেছে?

সরাসরি বলেনি।

তাহলে?

হাবভাবে বুঝেছি।

তাহলে এখন আমাকে কী করতে হবে?

তার আমি কী জানি। আমি যা বুঝেছি বলে দিলাম, ব্যাস! এখন তোমারটা তুমি বুঝবে, মায়াপারটা মায়াপা বুঝবে!

বকুল, এসময় কি বকুল ফোটে নাকি রে!

বকুল ফুলের গন্ধ পাচ্ছি যে!

পুকুরঘাটের বকুলগাছের ওদিক থেকে আসছে!

নাকি গন্ধ আসছে তোর শরীর থেকে। বকুল শুকিয়ে গেলেও তার গন্ধ থেকে যায়। তুই নেই, তোকে ওরা শেষ করে দিয়েছে। তারপরও তুই রয়ে গেছিস। তোর ভাইয়ের হূদয়ে রয়ে গেছিস, শরীরে রয়ে গেছিস। কতদিন তোকে আমি কোলে নিয়েছি, এখন এই আমার হাত ছুঁয়ে আছে তোকে, তোকে স্পর্শ করেছে এই হাত, এই স্পর্শ কি মুছে যেতে পারে!

আমি আসলে তোর গন্ধই পাচ্ছি। আমার শুকিয়ে যাওয়া বকুল ফুলটির গন্ধ পাচ্ছি। আমার বোনের গন্ধ পাচ্ছি!

ভোর থেকে এভাবে পড়ে আছিস তুই। শ্রাবণ দিনের বৃষ্টি বাদল নেই। ভ্যাপসা গরমে আকাশ আর পৃথিবী ভাসিয়ে উঠেছে চাঁদ। শরীরে পচন ধরে গেছে তোর। রক্তের গন্ধ, ক্ষত মাংসের গন্ধ। এই গন্ধ আমার কাছে শুকনো বকুল ফুলের গন্ধ।

আমি সেই গন্ধই পাচ্ছি।

আরেক মেয়ের কথা শুনবি বকুল। এক গ্রাম্য মেয়ের কথা শুনবি। আরেক বাঙালি কন্যার কথা।

কত বয়স তার?

পনেরো ষোলো বছর।

কিশোরী মেয়ে।

শুনবি তার কথা।

সেই মেয়ের নাম আমরা কেউ জানি না।

সালদা নদীর নাম শুনেছিস?

ত্রিপুরার পাহাড়ি এলাকার নদী। সেখান থেকে প্রবাহিত হয়ে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার দক্ষিণ-পুব দিক দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। তেমন চওড়া নদী না। বর্ষায় প্রবল স্রোত থাকে সালদায়। খরালিকালে (গ্রীষ্মে) নরম সরম শান্ত নদীটি। হেমন্তের গানের মতো, ‘শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি’। কোমর বা হাঁটু সমান পানি তখন নদীতে।

এই নদীর পশ্চিম পাড়ে পাকিস্তানি …গুলো প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করেছে। প্রায় স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। পুবপাড়ে করেছি আমরা, মুক্তিযোদ্ধারা।

আমাদের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ট্রেনিংয়ের পর মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করাবার আগে সালদা নদী বা বিলোনিয়া প্রতিরক্ষা অবস্থানে সপ্তাহখানেক রাখেন। কারণ হচ্ছে গোলাগুলির শব্দ কী অবস্থা তৈরি করে সেটা বোঝা। পাশাপাশি বসা যোদ্ধাদের কথাও শোনা যায় না, কতটা ভীতিকর অবস্থা, শত্রুর আর্টিলারি বা মর্টার সেল যখন পড়তে থাকে কীভাবে কাঁপে মাটি, ধুলায় কতটা আচ্ছন্ন হয় চারদিক, এসব বোঝার জন্যই মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি পাঠাতেন।

মে মাসের শেষ দিক।

তখনো সালদা নদীর রণাঙ্গন সেভাবে তেতে ওঠেনি। নদীর পুবপাড়ে ট্রেঞ্চে মুক্তিযোদ্ধারা, পশ্চিমপাড়ে পাকিস্তানিরা।

এক মুক্তিযোদ্ধার পিপাসা পেয়েছে। মে মাসের গরমে ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তাঁর।

এসময় মুক্তিযোদ্ধা দেখতে পেলেন পনেরো-ষোলো বছর বয়সি এক মেয়ে কাঁখে কলসি নিয়ে পানি আনতে যাচ্ছে হয়তো গ্রামের ভেতর দিককার কোনো পুকুর থেকে খাবার পানি আনবে সে অথবা কোনো বাড়িতে চাপকল আছে, সেই সচ্ছল বাড়িতে হয়তো যাবে।

ট্রেঞ্চে বসে দূর দিয়ে যাওয়া মেয়েটিকে ডাকলেন মুক্তিযোদ্ধা। শোনো।

মেয়েটি দাঁড়াল।

নদী থেকে একটু খাওয়ার পানি এনে দিতে পারবে? খুব পিপাসা পেয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা ভেবেছিলেন পশ্চিম পারের পাকিস্তানি …রা মেয়েটিকে নদী থেকে পানি নিতে দেখলেও কিছু বলবে না। মানে গুলি করবে না। এই বয়সি নিরস্ত্র একটি মেয়েকে কেন গুলি করবে? সে তো কোনো অন্যায় করেনি। খাওয়ার পানি নিচ্ছে।

মেয়েটি জানে ওপারে পাকিস্তানিরা ট্রেঞ্চে বসে অস্ত্র তাক করে আছে এপারের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেঞ্চের দিকে। সে ওসব নিয়ে ভাবলই না। কোনো ভয়-ভীতি তাকে স্পর্শই করল না। নদীর পাড় ভেঙে নিচে নেমে গেল। সালদার পানিতে কচুরিপানা আর ভেসে আসা খড়কুটো জমে থাকে। কলসির তলা দিয়ে ঠেলে ঠেলে ওসব পরিষ্কার করল সে, নদীর গভীর থেকে ঠান্ডা পানি ভরল কলসিতে। ডান কাঁখে কলসি নিয়ে উপরে উঠতে লাগল।

তার পিঠ এখন শত্রুর দিকে।

নদীর ওপার থেকে পাকিস্তানি …গুলো মেয়েটিকে দেখল। পর পর চারটা গুলি করল।

মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করতে পারছে না। কারণ তাঁরা গুলি শুরু করলে ওরা গুলির ঝড় বইয়ে দিবে। মেয়েটি খোলা জায়গায়। গুলি ঝড়ে তার আর কিছুই করার থাকবে না।

কিন্তু মেয়েটির শরীরে চারটা গুলি। আশ্চর্য ব্যাপার, কলসিতে গুলি লাগেনি। তারচে-ও আশ্চর্য ব্যাপার, চার-চারটা গুলি শরীরে নিয়েও সেই মেয়ে কাঁখের কলসি ছাড়ল না। একেকটা গুলি তার শরীরে ঢুকছিল আর সে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ও রকম কাঁপতে কাঁপতেই সে নদীর তীর ভেঙে উঠে এল। যে মুক্তিযোদ্ধা পানি চেয়েছিলেন তার ট্রেঞ্চের সামনে কলসি নামিয়ে রাখল। মুক্তিযোদ্ধাদের তখন এমন অবস্থা, মেয়েটিকে সাহায্য করার জন্য তাঁরা যে বেরুবেন, উপায় নেই।

কলসি রেখে সেই মেয়ে টলতে টলতে পড়ল ট্রেঞ্চের সামনে। আর উঠল না, আর নড়ল না। দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে তার যে ভাইয়েরা তাদের সেবায় নিজের জীবন উত্সর্গ করল।

এরকম কত বোন, মা আর স্ত্রীরা দেশের জন্য জীবন উত্সর্গ করছে, সবার খবর আমাদের কাছে আসেও না। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এরকমই বকুল। দেশ স্বাধীন হয়, হারিয়ে যায় লক্ষ লক্ষ মানুষ। জীবন দিয়ে, সম্ভ্রম দিয়ে দেশের স্বাধীনতা আনে মানুষ।

আমরাও তা-ই করছি।

তুই তোর জীবন দিলি দেশের জন্য।

বাবা দিলেন, মা দিলেন, মায়া আর আমার সন্তান সবাই তোরা দেশের মাটি ভিজালি রক্তে। আমি বেঁচে রইলাম তোদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য, শত্রু শেষ করার জন্য।

আমার কথা তুই একবার ভাব তো বকুল!

দেশ স্বাধীন হলো, আমি ফিরে এলাম এই বাড়িতে। তোরা কেউ নেই, উঠানে সার সার তোদের কবর। একটি পরিবারের একজন মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। দেশ স্বাধীন করে বাড়ি ফিরেছে মানুষটি, কী করবে সে তখন!

বাবার কবরের পাশে বসে থাকবে?

মায়ের কবরে হাত বুলাবে!

বোনের কবরটা একটুখানি ছুঁয়ে দেবে! এমনভাবে ছোঁবে, যেন ছোট্ট বোনের গালে বুলিয়ে দিচ্ছে আদরের হাত!

স্ত্রীর কবরের দিকে তাকিয়ে থাকবে! তার গর্ভের সন্তানের ফোলা ফোলা চোখ দুটো ভেসে উঠবে তার চোখে!

তোরা নেই, আমি এই বাড়িতে ফিরব কেমন করে?

ফিরে কাকে ডাকব?

নিজের অজান্তে কি ডেকে ফেলব, মা ওমা, এই যে দেখো আমি ফিরে এসেছি। বাবা, ও বাবা কোথায় তুমি? বকুল, বকুল রে! তোর ভাবিকে বল আমি এসেছি। দেশ স্বাধীন করে ফিরে এসেছি। দেশের প্রতিটি শত্রুকে শেষ করে ফিরে এসেছি!

এখন আমি কাঁদতে পারছি না।

আমার চোখে পানি নেই।

পানি আসছে না।

দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসার পর, বাড়ির উঠানে তোদের কবরের পাশে বসে আমি সেদিন পারব চোখের পানি ধরে রাখতে!

বকুল রে, আমি পারব না।

আমি কাঁদব।

আমি অঝোর ধারায় কাঁদব।

আমার মায়ের জন্য কাঁদব।

বাবার জন্য কাঁদব।

তোর জন্য কাঁদব।

মায়া আর আমার সন্তানের জন্য কাঁদব।

সেই কান্না আমি কাঁদতে চাই না বকুল। আমি চাই শহীদ হতে। স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর সৈনিক হিসাবে, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হিসাবে পাকিস্তানি …গুলো আর ওদের এদেশীয় দোসরগুলোর যতগুলোকে সম্ভব শেষ করে আমি শহীদ হতে চাই। আমিও চলে যেতে চাই তোদের সঙ্গে।

একাকী স্বাধীন দেশে কেমন করে বেঁচে থাকব আমি! যে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিল আমার পুরো পরিবার, সেই স্বাধীনতার স্বাদ কী করে আমি একা ভোগ করব!

দীননাথ সেন রোডের বাড়িতেই বা আমি কেমন করে ফিরব! সেই বাড়িতে গেলেও তো আমার মনে পড়বে তোর কথা, মায়ার কথা। আমাদের মধুময় দিনগুলোর কথা! লিচুগাছের পাতা সকালবেলার রোদে ঝলমল ঝলমল করবে। হাওয়ায় নাচবে। নির্জন দুপুরে দোতলায় বসে গ্রামোফোন বাজাবে মায়া। তুই হয়তো মায়ার পাশে। হয়তো বা এরকম শ্রাবণ মাস। নিঝুম হয়ে বৃষ্টি নেমেছে। গ্রামোফোন বাজছে,

টাপুর টুপুর সারা দুপুর

নূপুর বাজায় কে

যেন এক কাজলা মেয়ে

খালা হয়তো ঘুমিয়ে আছেন। কাজের মানুষজন যে যার মতো আছে। আমি আমার রুমে ডুবে আছি কোনো বইয়ের পাতায়।

খালার সঙ্গে কি আমার আর দেখা হবে বকুল!

খালা কি বেঁচে থাকতে পারবেন স্বাধীনতা পর্যন্ত! ওরা কি বাঁচতে দেবে আমাদের কোনো নিরস্ত্র মানুষকে!

মেলাঘরের একটা ঘটনার কথা বলি। বাংলা মায়ের কয়েকজন বীরকন্যার কথা বলি।

জুলাই মাস।

মেলাঘর ক্যাম্পে উপস্থিত হয়েছে কয়েকজন মেয়ে। সবাই শিক্ষিত, কেউ কেউ উচ্চশিক্ষিত। বিয়ে হয়নি কারোই।

কী উদ্দেশ্যে মেলাঘরে এসেছে তারা?

খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করবে। কথা বলবে তাঁর সঙ্গে।

খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি জানতে চাইলেন, কী বলবে বলো।

মেয়েরা বলল, আমরা ছেলেদের সঙ্গে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে চাই। শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের ভাইয়েরা যেভাবে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করছে, আমরাও তা-ই করতে চাই।

আমাদের মেলাঘর ক্যাম্পই তখন পর্যন্ত পুরোপুরি স্থায়ী হয়নি। মূলি বাঁশের তৈরি একটা ঘরে থাকেন আমাদের বিগ্রেড কমান্ডার লেফটেনেন্ট কর্নেল খালেদ মোশাররফ।

মেয়েদের বসতে দেওয়া হলো একটি ঘরে। অন্য আর একটি ঘরে আলোচনায় বসলেন কে ফোর্স বিগ্রেডের বিগ্রেড মেজর মোহাম্মদ আবদুল মতিন, বিগ্রেড কমান্ডার লেফটেনেন্ট খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার।

কী করা যায় মেয়েদের নিয়ে?

তাদের থাকার ব্যবস্থা, নিরাপত্তা সবদিকই ভাবতে হবে। এসব নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। মেয়েরা যে ঘরে বসে আছে সেই ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে আলোচনা।

একটি মেয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। যে ঘরে আলোচনা চলছে সোজা সেই ঘরে ঢুকল। খালেদ মোশাররফের সামনে এসে দাঁড়াল।

স্যার, আমি একটু কথা বলব।

সবাই তাকালেন মেয়েটির দিকে।

খালেদ মোশাররফ বললেন, বলো।

মেয়েটি খালেদ মোশাররফের চোখের দিকে তাকাল। কোনো জড়তা নেই। পরিষ্কার উচ্চারণে বলল, স্যার, দেশের স্বাধীনতার জন্য মাঠে যুুদ্ধ করা থেকে শুরু করে যা যা করা দরকার সব করতে আমরা তৈরি। আপনি আমাদেরকে আদেশ দিন।

তারপর মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকাল। তার দুচোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে মাটিতে।

এভাবে কয়েক মুহূর্ত কাঁদল সে, তারপর নিজেকে সামলালো। ধীর শান্ত গলায় বলল, স্বাধীনতার যুদ্ধে, দেশ শত্রুমুক্ত করার জন্য যদি আমাদের সম্ভ্রমও যায়, যাক।

সেই মেয়ের কথায় পানি এসেছিল সবার চোখে।

বকুল, তুই ছিলি ঘুমে। তোর ঘুম বেশ গাঢ়! গুলির শব্দে কি জেগে উঠেছিলি? ধড়ফড় করে উঠে বসেছিলি বিছানায়! দৌড়ে নামতে গিয়েছিলি! তার আগেই কি ওরা ঢুকে গিয়েছিল তোর ঘরে!

এই প্রশ্নের উত্তর আমি জীবনে পাব না বকুল।

তোর কথা ভাবলেই আমার মনে পড়বে কোনো এক ভোরবেলার কথা।

নাকি দুটো ভোরের কথা মনে পড়বে!

একদিন ভোরবেলা তোকে আর আমি খুঁজে পাই না। বকুল ফোটার দিন। ঘাটলার বকুল গাছ দুটো ফুলে ফুলে ভরে গেছে। কত বয়স তখন তোর! সাত-আট বছর হবে।

ভোরবেলা আমার ঘুম ভাঙে বাবা-মার সঙ্গে সঙ্গে। তাঁরা নামাজ পড়েন, আর আমি বসি বই নিয়ে। তুই ঘুমাস।

বাবা বললেন, বকুলকেও তোর সঙ্গে জাগাবি। তোর সঙ্গে পড়তে বসাবি।

কদিন ধরে সেভাবেই তোকে ডেকে তুলি আমি।

সেদিন ডাকতে গিয়ে দেখি তুই নেই। নামাজ শেষ করে মা আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন। তুই গেলি কোথায়!

ভোরবেলার দোয়েল পাখি নেমেছে বাড়ির আঙিনায়। কাক শালিক নেমেছে, খোয়াড়ের হাঁস মুরগি কবুতর ছেড়ে দিয়েছে বুয়া।

তুই গেলি কোথায়!

হাওয়ায় বকুল ফুলের গন্ধ আসছে।

কী মনে করে ঘাটলার দিকে হাঁটতে লাগলাম আমি। তোকে খুঁজব। না পেলে পুকুরের পানিতে হাতমুখ ধুয়ে আসব।

কাছাকাছি গিয়ে দেখি তুই উপুড় হয়ে বকুল ফুল কুড়াচ্ছিস। সাদা ধপধপে ফ্রক পরা। এক হাতে ফুল কুড়াচ্ছিস, অন্য হাতে ধরে রেখেছিস ফ্রকের তলার দিকটা। ফুল কুড়িয়ে সেখানে রাখছিস।

দৃশ্যটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হলো।

মনে হলো, ওই যে ভোরবেলার পবিত্র আলোয় যে মেয়েটি ফুল কুড়াচ্ছে সে আমার বকুল না, সে এক পরি। সাদা পরি। পরিস্থান থেকে ফুল কুড়াতে এসেছে আমাদের বকুলতলায়।

বেঁচে থাকলে এই দৃশ্য সারাজীবন থেকে যাবে আমার চোখের ভেতর।

আমার সেই বকুল কুড়ানো বকুল, আমার সেই ছোট্ট বোনটির জীবন থেকে সব ভোর কেড়ে নিল …রা। সম্পূর্ণ ফুটে উঠতে দিল না আমার বকুলকে।

দেশ স্বাধীন হবে। আমাদের বাড়ির বকুল গাছ ফুলে ফুলে ভরে যাবে। আগের চেয়েও সুন্দর হয়ে ফুটবে ভোরের আলো। খাবারের খোঁজে দোয়েল পাখি নামবে আঙিনায়। বাঁশঝাড়ে শন শন করবে হাওয়া। পাখির গানে মুখর হবে বাড়ি। গাছের পাতারা সবুজ থেকে সবুজতর হবে। ঝোপঝাড় আর ঘাসের বনে ডাকবে কীট-পতঙ্গ। নীল ফড়িং উড়ে যাবে পুকুরের দিকে। সেখানে ফুটবে রক্ত শাপলা। কত রংয়ের প্রজাপতি উড়বে বাগানে। রোদে শুকাবে বাড়ি, নিবিড় বৃষ্টিতে ভিজবে। অন্ধকার রাতে তারার মিটমিটে আলো ম্লান হবে জোনাকির আলোয়। জ্যোত্স্না রাত হবে আমার বোনের মুখখানির মতো পবিত্র। মাথার ওপরকার আকাশ প্রতিদিনকার মতো নতুন হবে। রজতরেখা বয়ে যাবে তার নিজস্ব নিয়মে। মাঠবিল সবুজ সোনালি হবে ধানে ধানে। দিঘিরপাড়ে ডাকবে ডাহুক পাখি। বাংলার এই চিরকালীন সৌন্দর্যের মধ্যে থাকবে না শুধু আমার মানুষগুলো। আমার মা থাকবে না, বাবা থাকবে না। আমার বোনটি থাকবে না। থাকবে না আমার মায়া আর একদিন বাড়ির উঠান আঙিনায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলার কথা যার, আমার সন্তান, পৃথিবীর আলো দেখার আগেই, হাওয়ার পরশ পাওয়ার আগেই বিদায় করা হলো তাকে।

এই বেদনা নিয়ে কেমন করে বেঁচে থাকব আমি, বকুল!

যে সব বই ও পত্র-পত্রিকার সাহায্য নেওয়া হয়েছে :

১. ‘শহীদ ভাগীরথী এবং’-নাসিমুন আরা হক, দৈনিক সমকাল, ২ এপ্রিল ২০১৩

২. ‘নরহত্যা ও নারী নির্যাতনের কড়চা ১৯৭১’—মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি

৩. ‘একাত্তরের গণহত্যা ও নারী নির্যাতন’—আসাদুজ্জামান আসাদ

৪. ‘একাত্তরের কন্যা জায়া জননীরা’—মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)