এক কষ্টের ভেতর অনেক কষ্ট

যেদিন ঢাকার রাস্তায় ট্যাঙ্ক নামে, সাধারণ নির্বাচন স্থগিত হয়, কারফিউর ঘোষণা থেকে থেকে জানানো হয় এবং বলা হয় রাস্তায় বের হলে সরাসরি গুলি করা হবে, সেদিন রহমত আলী তার খামারবাড়িতে নিবিষ্ট মনে আম্রপালী গাছগুলোর গোড়ায় সার দিচ্ছিল। গত বছর আম ধরেনি। এ বছরও কি খালি যাবে? রহমত আলী মানতে পারছিল না ফলহীন আম গাছগুলোর চেহারা। তার জেদ এবার আম্রপালী গাছগুলোতে ফল ধরাবেই। সার দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে তার টু-ব্যান্ড রেডিওতে ভেসে আসে কারফিউর ঘোষণা, নির্বাচন স্থগিতের কথা, ঢাকার রাস্তায় ট্যাঙ্ক নামার কথা আর রাস্তায় কাউকে দেখা গেলে সরাসরি গুলির কথা।
কোথাও থেকে ঠা-া বাতাস উঠে আসে। শিরশির করে আম্রপালীর পাতা কাঁপে, শিরশির করে কামরাঙা আর পেয়ারার পাতা কাঁপে, রহমত আলীর শীত শীত করে। একটা পাতলা সোয়েটার গায়ে থাকলে ভালো হতো। পাঞ্জাবিটা টেনেটুনে গা ঢাকে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে রহমত আলীর দীর্ঘশ্বাস বের হয়। কোনো কারণ ছাড়াই দীর্ঘশ্বাস, যেমন বাতাসের শিরশির, পাতাগুলোর কেঁপে ওঠা, তেমনি একটা কাঁপন শরীরের ভেতর থেকে উঠে আসা। হাড় বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, খুব একটা উত্তাপ শরীরে সংগ্রহ করতে পারছে না। একটা বুড়ো গাছ আর একটা বুড়ো মানুষের মধ্যে পার্থক্য কী? কিছুই না, কিছুই না।
তিন কামরার একটা টিনের বাড়ি, চারদিকে ঘেরা সিমেন্টের বারান্দা। আলী নকী দেউড়ির পুরান পৈতৃক বাড়িটা বিক্রি করে এখানে টিনের বাড়ি তুলেছে রহমত আলী, সঙ্গে তিন বিঘা ধানী জমি। বছরের অধিকাংশ সময় এখানে কাটায় সে, ক্বচিৎ কখনো ঢাকায় যাওয়া পড়ে তার। নিরিবিলি থাকতে থাকতে ঢাকার ভিড়ভার তার ভালো লাগে না। গাছপালার ওপর মায়া জন্মেছে, পাখি পাখালি তার চেনা এখন, লোকজন তাকে চেনে।
বারান্দায় দুটো বেতের চেয়ার আর একটা বেতের ছোট টেবিল। রহমত আলীর বসার সাড়া পেয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে রহমত আলীর স্ত্রী জরিনা। তার দুই হাতে দুই পেয়ালা চা। রহমত আলী জুত করে বসেছে একটা চেয়ারে, স্ত্রীর হাত থেকে চা নিয়ে চুমুক দেয় আর চোখ মেলে দেয় দিগন্তে। সেখানে ধান ক্ষেতের বিস্তার, কিছু এলোমেলো মেহগনি গাছ, কয়েকটা গরু ঘাস চিবুচ্ছে। কয়েকটা প্রায় নেংটা ছেলে চিৎকার করছে। কয়েকটা কাক উড়ে যাচ্ছে দল বেঁধে। রহমত আলী জরিনার দিকে চেয়ে থাকে। জরিনার বয়স কত হলো? পঞ্চাশ খুব সম্ভব। চোখে মোহ তুলে রহমত আলী ভাবে : এই তার স্ত্রী।
জরিনা স্তব্ধতা ভেঙে জিজ্ঞেস করে, কী ভাবছ?
ভাবছি তোমার তো পঞ্চাশ হলো।
তা তো হলোই।
জানো?
বলো।
আমাদের ছেলেপুলে না হওয়াতে ভালোই হলো।
কেন!
রেডিও তো শুনেছ।
শুনেছি।
এই বয়সের ছেলেরা কারফিউ মানে না।
তা ঠিক।
হই হই করে রাস্তায় বের হয়। সস্নোগান দেয়।
তারপর?
গুলি খায়। মরে যায়।
আমরা বুড়াবুড়ি ছেলের লাশ নিয়ে বসে থাকতাম।
সেই কষ্ট থেকে রেহাই পেয়েছি।
সত্যি পেয়েছ?
জানি না।
তবু মনে হয় ছেলেপুলে থাকলে ভালো হতো।
গুলি খেয়ে মারা গেলেও?
হ্যাঁ, তাই।
রহমত আলী ও তার স্ত্রী চুপচাপ বারান্দায় বসে থাকে। অন্ধকার যেখানে ওতপেতে ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে আসে। ঘিরে ধরে বাড়িটা, তারপর বারান্দা, তারপর বাড়ির সামনে ফলমূলের বাগিচা।
রহমত আলী বলে, আর এক কাপ চা দিবা।
খাবা?
গলাটা কেমন উসখুস করছে।
রাতে তোমার ঘুম হবে না।
না হোক।
খেতে চাও খাও।
জরিনা উঠে ভেতরে যায়। একটু বাদে এক পেয়ালা চা নিয়ে আসে। আর এক হাতে নিয়ে আসে একটা লণ্ঠন। ইলেকট্রিসিটি আছে। প্রায়ই থাকে না। তাই এ ব্যবস্থা। ইলেকট্রিসিটি এলে লণ্ঠন নিভিয়ে দেয়া হয়। ক্ষণস্থায়ী ইলেকট্রিসিটির রাজত্বে লণ্ঠনের স্থায়ী ব্যবস্থা। যেদিন জরিনা লণ্ঠন কিনে নিয়ে আসে সেদিন রহমত আলী অনেকক্ষণ হেসেছিল। এখন আর হাসে না। সব ব্যবস্থা হাতে থাকা ভালো।
জরিনা।
বল।
রেডিওর খবর শুনে আমার একটা কথা মনে পড়ল।
কী কথা?
ট্যাঙ্ক নামাবার কথা।
খুলে বল।
আমরা তখন রাজারবাগ থাকতাম। মনে আছে?
পুলিশ লাইনের পেছন দিকে।
পাকিস্তানিরা ট্যাঙ্ক নিয়ে অ্যাটাক করল আর আমাদের ছেলেরা গজারির লাঠি নিয়ে ট্যাঙ্ক প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল।
ওসব কথা মনে হলে মন খুব খারাপ হয়।
ছেলেগুলো মরে গেল।
আমাদের ছেলে থাকলে ছেলেটা মরে যেত।
ওই বয়সের ছেলেরা ট্যাঙ্ক বোমা বারুদ মানে না।
তা ঠিক।
মানবেই বা কেন।
মানা উচিত না।
ওই বয়সের ছেলেরা ট্যাঙ্ক মানে না, বোমা মানে না। তারা কিছু মানে না। আমাদের ছেলে থাকলে তা-ই করত।
কিছু মানত না।
ওই বয়সের ছেলেরা কোনো কিছু মানে না।
তবু কষ্ট হয় ছেলে মারা গেলে।
কষ্ট হয় গুলি খেলে।
এই কষ্টের শেষ নাই।
আল্লাহ আমাদের এই কষ্টের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তবু কষ্ট হয়। রহমত আলী ও জরিনা চুপচাপ হয়ে যায়। আকাশটা চুপাচাপ। যত দূর চোখ যায়, যতটুকু চোখে দেখা যায় সব চুপচাপ।
বারান্দায় বসে আছে বুড়াবুড়ি। যেমন এক নদীর ভেতর অনেক নদী, তেমনি এক কষ্টের ভেতর অনেক কষ্ট।
রহমত আলী ও জরিনা, এক বুড়া এবং আর এক বুড়ি, চুপচাপ, অন্ধকারের ভেতর বসে থাকে। অন্ধকারের ভেতর আলো আছে। সে আলোর কথা তারা ভাবে।