সুরভি

ঘটনা শুরু হল ছোট্ট একটা খবর থেকে।

কয়েকদিন আগে দেশের প্রায় সবগুলো নামীদামি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল খবরটি। কোনো কোনো টিভিতেও এসেছে। ঢাকার খুবই নামকরা একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা বছরের শুরুর দিকে তাদের স্টাফদের নিয়ে কক্সবাজারে যায় পিকনিকে। একটি লাক্সারি বাস তিনদিনের জন্য ভাড়া নেয়। বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করে যাত্রা। সারারাত বাস জার্নি, সকালবেলা কক্সবাজার। শুক্রবার পুরোদিন, পুরোরাত, শনিবার বিকেল পর্যন্ত হইচই আনন্দ করে ফের যাত্রা। রোববার সকালবেলা ঢাকা। ওই একটা দিন অফিস ছুটি। রেস্টফেস্ট নিয়ে পরদিন থেকে আবার অফিস।

এবারো একই আয়োজন। হিমছড়িতে মোটেল নেয়া হয়েছে। সামনে সমুদ্র সৈকত। হোটেল মালিক সৈকতের বিশাল একটা অংশ লিজ নিয়েছেন। শুধু তার হোটেলের গেস্টরা ব্যবহার করতে পারবেন।

এবারের পিকনিকে সব মিলিয়ে ছত্রিশজন। এগারোজন মেয়ে। ঘটনার দিন বিকেলবেলা মেয়েদের আলাদা একটা দল হয়েছে। সাদিয়া তার ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে হালকা ধরনের একটা ফুটবল নিয়ে গিয়েছিল। বিকেলবেলা ওই বল নিয়ে সৈকতে খেলতে নেমেছে। মেয়েরা একত্র হলে হইচই চিৎকার চেঁচামেচি ছেলেদের চেয়ে বেশি করে। সেদিনও তাই হচ্ছে। কোনো গোলপোস্ট নেই কিচ্ছু নেই যে যেদিকে পারে আন্দাগুন্দি বলে কিক করছে, যে যেদিকে পারে বল নিয়ে ছুটছে। মীম আর প্রিয়াঙ্কার পায়ে বেশ জোর। পাকা ফুটবলারের ভঙ্গিতে চান্স পেলেই বড় বড় শট নিচ্ছে। মীমের ওরকম এক শটে বল চলে গেল সমুদ্রে। তখন জোয়ার শুরু হয়ে গেছে। প্রিয়াঙ্কা ছুটে গিয়ে সেই বল আনার আগেই সুরভি গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সমুদ্রে। দুহাতে বলটা বুকের কাছে মাত্র ধরতে যাবে বিশাল এক ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাকে। নিয়ে গেল তো নিয়েই গেল। মুহূর্তে উধাও। বল ভেসে আসে পানিতে, ঢেউয়ের তালে নাচছে কিন্তু সুরভি উধাও। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল সবাই। হইচই চিৎকার চেঁচামেচি, কান্না বিলাপ। উদ্ধারকর্মীরা এল। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত তন্ন তন্ন করা হল সমুদ্র। সুরভির হদিস পাওয়া গেল না। নেই তো নেই। সমুদ্রের কোনো অতলে বিলীন হয়ে গেছে।

এই ধরনের খবর আমার মধ্যে একটা ঘোর তৈরি করে। গভীর আনন্দে মেতে থাকা একটি মেয়ে মুহূর্তে চলে গেল মৃত্যুর জগতে। নিজে মেয়ে বলে কিনা কে জানে, সুরভির জায়গায় আমি তখন নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। কলিগ বন্ধুদের সঙ্গে সমুদ্র সৈকতে সুরভির ফুটবল খেলার আনন্দটা পুরোপুরিই অনুভব করছিলাম। সামনেই বিশাল সমুদ্র মৃত্যুদূত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে টেরও পাচ্ছিলাম না। বল আনতে ছুটে গেছি সমুদ্রে। পরনের জিন্স টি-শার্ট ভিজে একাকার হচ্ছে সেদিকে খেয়ালই নেই। ঝাঁপিয়ে পড়ে দুহাতে ধরতে গেছি বল, সমুদ্র আমাকে গিলে খেল। স্রোতের টানে কোন অতলে তলিয়ে গেলাম! নাক মুখ দিয়ে গলগল করে ঢুকল নোনাজল। দম বন্ধ হয়ে গেল। অসহায়ভাবে হাত-পা ছুড়ে বাঁচতে চাইলাম। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে চাইলাম, মুখ দিয়ে শব্দ বেরোল না। কী করে বেরোবে, গলায় তো তখন ঢুকছে নোনাজল। গ্যালন গ্যালন নোনাজল। দম নিতে না পারার ফলে বুক ফেটে যাচ্ছে, পেট ফুলে ঢোল হচ্ছে। শরীরের ওজন ডাবলেরও বেশি হয়ে গেছে। সেই শরীর সমুদ্রের তলদেশের স্রোতে কোন অচেনা জগতে যে চলে যায়!

সুরভির কথা ভাবতে ভাবতে অদ্ভুত একটা ঘটনা সেদিন ঘটল।

ঘুম ভাঙার পর দুটো জিনিস আমার লাগবেই। এক মগ লিকার চা আর খবরের কাগজ। এই দুটো না হলে সকালটা আমার শুরুই হয় না। রেখা আন্টির ফ্ল্যাটে পেয়িংগেস্ট হয়ে আসার পর প্রথম দুতিনদিন খবরের কাগজ পেতে দেরি হয়েছে। আন্টির হকারের নাম মান্নান। সে কাগজ দেয় একটু দেরি করে। আটটার দিকে। আমি ঘুম থেকে উঠি সকাল সাতটায়। যত রাতেই ঘুমাই সাতটায় আমি উঠবই। উঠে নিজেই নিজের চা তৈরি করি। লিকার তৈরি করা ইজি। একমগ গরম পানিতে একটা টিব্যাগ, ব্যাস হয়ে গেল চা। সেই চা নিয়ে বসে থাকি, খবরের কাগজের দেখা নেই। শুরু হয় অপেক্ষা। অপেক্ষা খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপার। সেই অস্বস্তি নিয়ে কাটিয়েছি প্রথম কয়েকদিন। তারপর ধরলাম মান্নানকে। আমার কাগজ সাতটার মধ্যে দিতেই হবে। মান্নান হাসিমুখে বলল, আইচ্ছা আফা, দিমুনে।

প্রমিজ!

আফা। আমার মুখের জবান পাক্কা।

মান্নান তার পাক্কা জবান রেখেছে। ঘুম ভেঙেই আমি এখন খবরের কাগজ পাই। খবরের কাগজ হাতে নিয়ে সকাল শুরু করি। আটটার দিকে আন্টি একবার আমার রুমে আসেন। আমার রুম্পা নামটার সঙ্গে তিনি ‘রানি’ যোগ করেছেন। ফলে নাম হয়েছে রুম্পারানি। আন্টি হাসিমুখে দরজায় দাঁড়িয়ে বলবেন, শুভ সকাল, রুম্পারানি।

আমি মুখের সামনে খবরের কাগজ ধরে বসে আছি। আনমনা ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিয়েছি। আন্টির কথায় তার দিকে তাকিয়ে হাসি। শুভ সকাল, আন্টি। দিনের কাজ ঠিকমতো শুরু হল?

হ্যাঁ। ঠিক সাড়ে পাঁচটায় উঠে রমনা পার্কে চলে যাই। পুরো একঘণ্টা হাঁটি। পার্কে মহিলাদের সংগঠন আছে। সেটার মেম্বার হয়েছি। ফিফটি টু মেম্বার আমাদের। একসঙ্গে হাঁটি সবাই। হাঁটা শেষ করে গল্পগুজব করি, বাড়ি ফিরি সাতটার দিকে। ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মের মধ্যে থাকতে হয়। সকালবেলা দুটো সুগার ফ্রি বিস্কুট আর একগ্লাস পানি খেয়ে বেরোই। সাতটার দিকে ফিরে শাওয়ার নিয়ে নাশতা করি। লাবণী মেয়েটা অনেকদিন হল সঙ্গে আছে। আমার দেখাশোনা খুবই ভালো করে। ও তো আর সেই অর্থে কাজের মেয়ে না। দূর সম্পর্কের গরিব আত্মীয়। বিয়েও হয়েছিল। স্বামীটা বদ। ফেলে রেখে উধাও হয়ে গেছে। গরিব মা-বাবা এই মেয়ের লালন পালন কিভাবে করবে। আরেকটা বিয়ে দেবে সেই সামর্থ্যও নেই। লাবণী দেখতে তেমন ভালো না বলে বিয়ে দেয়াও মুশকিল। আমার কাছে নিয়ে এলাম। খুব লক্ষ্মী মেয়ে। আমিও বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। লাবণী রাজি হয় না। বলে, জীবনটা সে আমার সঙ্গেই কাটাতে চায়। এত বলি, আমি মারা গেলে কে দেখবে তোকে? তখন কোথায় যাবি তুই? থাকবি কোথায়? লাবণীর এক কথা, কপালে যা আছে তাই হবে। ওসব কথা এখন ভেবে কী লাভ? সাবা অবশ্য বলেছে, লাবণীকে সে নিয়ে যাবে।

সাবা হচ্ছে রেখা আন্টির মেয়ে। ওই একটাই মেয়ে আন্টির। স্বামী চিটাগাংয়ের বড় ব্যবসায়ী। চিটাগাংয়েই থাকে সে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মোবাইলে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে, মায়ের খোঁজ নিচ্ছে। মাসে দুমাসে ঢাকায় দুচারদিনের জন্য আসছে। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে মায়ের কাছে থেকে যাচ্ছে। তখন আন্টির ফ্ল্যাটে নির্জনতা বলে আর কিছু থাকে না। সাবার দুই মেয়ে আর এক ছেলে। তাদের নানা ধরনের খুনসুটি, চিৎকার চেঁচামেচি আর দুষ্টুমিতে মুখর হয়ে থাকে ফ্ল্যাট।

আন্টির অবস্থা বেশ ভালো। আংকেল বেঁচে থাকতেই আজিমপুরের এই ছ’তলা বাড়িটা করে দিয়ে গেছেন। নিচতলায় পার্কিং, বাকি পাঁচতলায় দশটা ফ্ল্যাট। দশ কাঠার ওপর বাড়ি। একেকটা ফ্ল্যাট তেইশ শো স্কয়ার ফিটের। তিনতলার একটায় আন্টি থাকেন, বাকি ন’টা ভাড়া দেয়া। ভাড়ার টাকা পান দু-আড়াই লাখ। লোনটোন কিছু নেই। দারুণ একটা জীবন। কোনো অভাব নেই, দুশ্চিন্তা নেই। কষ্ট পরিশ্রম কিচ্ছু নেই।

কষ্টের জীবন হচ্ছে আমাদের মতো মেয়ের। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি। বাবা রিটায়ার স্কুল মাস্টার। পিরোজপুর শহরের একতলা একটা বাড়ি আর বাড়ির সামনে পাঁচটা ছোট সাইজের দোকান। ওই আমাদের সম্পদ। দোকানগুলো ভাড়া দেয়া। মফস্বল শহরের ওরকম দোকানের ভাড়া আর কত? বাড়িটা বারো কাঠা জমির ওপর। কয়েকটা টিনের ঘর করে ভাড়া দেয়া হয়েছে। রিটায়ার করার পর বাবা ছাত্র পড়িয়ে কিছু রোজগার করেন। তারপরও টানাটানি আমাদের কমে না। এক সময় মোটামুটি ভালো চলছিলাম আমরা। সব শেষ করে দিল ভাইটি। আমরা একভাই এক বোন। ভাই বড়। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিল। ফালতু ছেলেদের সঙ্গে মিশে বখে গেল। বছর তিনেক হল ড্রাগ ধরেছে। এখন একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। বেশ কয়েকবার মাদক নিরাময় কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে ভালো হয়ে বেরোয়। কয়েক দিন পর যেই কে সেই। টাকার জন্য মা বাবাকে জ্বালাচ্ছে, নানা রকমের অত্যাচার করছে। বাড়ির এটা ওটা নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। আমাদের তিনজন মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে দিল। বাবা-মা সারাক্ষণ ছেলের জন্য চোখের জলে ভাসেন। যে ছেলেকে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর ছিলেন, ছেলে বড় হয়ে শিক্ষিত হবে, চাকরি-বাকরি করে সংসারের চেহারা বদলাবে সেই স্বপ্ন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল।

ছেলের কারণে আমার দিকে সেভাবে মন দিতে পারেননি মা-বাবা। আমি আমার মতো বড় হয়েছি, আমার মতো লেখাপড়া করেছি। মাথাটা পরিষ্কার। মেধাও কিছুটা আছে। স্কুল-কলেজে রেজাল্ট ভালো। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন টেস্ট দিলাম। ইকনোমিকস ডিপার্টমেন্টে চান্স পেয়ে গেলাম।

ঢাকায় থেকে ইউনিভার্সিটিতে পড়া ভালো একটা খরচের ব্যাপার। হাজার পাঁচেক টাকা লাগবে মাসে। এই টাকা কোত্থেকে আসবে? তারপরও বাবা বললেন, রুম্পা পড়বে। আমার স্বপ্ন ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার। সেটা পারিনি। পরে ভেবেছি ছেলে পড়বে, সেটাও হল না। মেয়ে পড়–ক। দরকার হলে বাড়ির অর্ধেক বিক্রি করে দেব।

বাড়ি অবশ্য বিক্রি করতে হয়নি। প্রথম মাস ছয়েক কোনো রকমে চলেছি। হলে জায়গা পাইনি দেখে কাঁটাবনের ওদিককার একটা মেয়েদের হোস্টেলে থেকেছি। ততদিনে আমার মতো অনেক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। লেখাপড়ার ফাঁকে তারা অনেকেই টিউশনি করে, পার্টটাইম জব করে। জব আমি পাইনি, টিউশনি পেয়েছিলাম। চলবার মতো টাকা টিউশনি থেকে আসত না, কিছু টাকা বাড়ি থেকে আনতে হত। বছর খানেক পর তার আর দরকার হয়নি। চলবার মতো টাকা টিউশনি থেকে আসত। দিনে দিনে এমন হল, প্রাইভেট টিউটর হিসেবে ভালো নাম হল আমার। একটা কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত হলাম। সব মিলিয়ে হাজার দশ বারো টাকা রোজগার হতে লাগল। নিজে ভালোভাবে চলে বাড়িতেও টাকা পাঠাই। অনার্স শেষ করেছি, এ বছর মাস্টার্স হয়ে যাবে। কোচিং সেন্টারের ব্যবসাটা বুঝে গেছি। মাস্টার্স করার পর চেষ্টা করব বন্ধুদের সঙ্গে কোচিং সেন্টার খুলতে। ভাই যে অসুখী জীবন মা-বাবাকে দিয়েছে সেই জীবনটা আমি চেষ্টা করব বদলে দিতে।

বছরখানেক আগে হোস্টেল জীবন শেষ করেছি। আমার বন্ধু দোলার অবস্থাও আমার মতোই। টিউশনি করে চলে। কিন্তু হোস্টেলে সে থাকে না। সেগুনবাগিচার ওদিকে পেয়িংগেস্ট থাকে। তাতে একা একটা রুম নিয়ে নিজের মতো করে আরামে থাকা যায়। হোস্টেলে একরুমে তিনচারজন। একেকজনের লাইফ স্টাইল একেকরকম। বনিবনার সমস্যা। ওসব নিয়ে আমিও বেশ সাফার করেছি। রুমমেট চারটি মেয়ের একজন ডলি, বদরাগি টাইপের। ওর সঙ্গে বনতই না। পরে দোলাই আমাকে পেয়িংগেস্ট থাকার বুদ্ধি দিল।

প্রথমদিকে পেয়িংগেস্ট ছিলাম ইউনিভার্সিটি এলাকাতেই। তারপর পেয়ে গেলাম রেখা আন্টিকে। মানুষটা এত ভালো, আমি যেমন তাকে পছন্দ করলাম, তিনিও আমাকে তেমন পছন্দ করলেন। মাস চারেক পর দেখি আমার কাছ থেকে ভাড়া আর নেনই না। রুমের ভাড়া ঠিক হয়েছিল তিন হাজার টাকা। চার মাস পর ভাড়ার টাকা দিতে গেছি, আন্টি হেসে বললেন, দিতে হবে না।

আমি অবাক। মানে?

মানে আবার কী? ভাড়া দিতে হবে না।

কেন?

প্রচুর বাড়ি ভাড়া পাই আমি। এটুকু না নিলে কিছু হবে না। পেয়িংগেস্ট রাখতেই চাইনি। তোমাকে দেখে, তোমার সাথে কথা বলে ভালো লেগেছিল বলে ভাবলাম, এত বড় ফ্ল্যাট পড়ে আছে, এতগুলো রুম, থাকুক একটা মেয়ে, যদি তার কিছুটা উপকার হয়। আর মাসে কিছু টাকাও এল। যার যত টাকা তার টাকার প্রতি তত আগ্রহ। সেই আগ্রহ থেকেই তোমাকে নিয়েছিলাম। পরে দেখি তুমি এত ভালো একটা মেয়ে, নিজ পরিবারের জন্য এত কষ্ট করছ, তোমার পাশে দাঁড়ানো মানুষ হিসেবে আমার কর্তব্য। আমি সেই কর্তব্য পালন করছি। যতদিন তোমার পড়াশোনা শেষ না হয়, যতদিন পর্যন্ত নিজের পায়ে না দাঁড়াও, ততদিন তুমি আমার এখানে থাকবে। নিজের জন্য বাজার করতে তুমি, রান্না করে খেতে, ওটাও আর করবে না। খাবে আমার সঙ্গে।

আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। কেমন করে কোথাকার এক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল আর সেই মানুষ এমনভাবে দাঁড়ালেন আমার পাশে!

খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাসটা পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। আমাদের মফস্বল শহরে খবরের কাগজ আসে দুপুরের দিকে। একবার পড়া সেই পুরনো খবরের কাগজই পরদিন সকালবেলা উঠে অনেকক্ষণ ধরে পড়তেন বাবা। ওই দেখে দেখে অভ্যাসটা আমার হয়েছে। হোস্টেলে থাকার সময় অভ্যাসে ভাটা পড়েছিল। পেয়িংগেস্টের জীবনে এসে সেটা আবার চালু করেছি।

সুরভির নিউজটা পড়ার পর অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। এখন শরৎকাল না, শিউলি ফোটার দিন না তবু কোত্থেকে এল শিউলি ফুলের অপূর্ব গন্ধ। গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে গেল রুম। আমি দিশেহারা হলাম। শিউলি আমার খুবই প্রিয় ফুল। শিউলির গন্ধ আমাকে পাগল করে ফেলে। ছোটবেলা থেকেই। আমাদের বাড়িতে শিউলি গাছ ছিল। শরৎকালে ফুটত ফুল। গন্ধে ভরে থাকত সন্ধ্যাবেলাটা, সকালবেলাটা। শিউলি কুড়িয়ে পড়ার টেবিলে রেখে দিতাম আমি। নরম ধরনের ফুল। দ্রুত ম্লান হয়ে যেত, তবু ফেলতাম না।

কিন্তু এখন, এই সময় শিউলির গন্ধ আসছে কোত্থেকে!

আমি ছুটে রুম থেকে বেরোলাম। লাবণী যাচ্ছিল কিচেনের দিকে, তাকে বললাম, তুমি কি একটা গন্ধ পাচ্ছ?

লাবণী অবাক, কিসের গন্ধ?

শিউলি ফুলের।

না তো!

আমি পাচ্ছি। রুমে বসেই পাচ্ছিলাম, এখন বাইরে এসেও পাচ্ছি।

লাবণী অবাক। কই আমি তো কোনো গন্ধ পাচ্ছি না।

আন্টি কি তার রুমে এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করেছেন?

জানি না।

আমি তারপর আন্টির রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আসব আন্টি?

এসো।

আমি রুমে ঢুকলাম। হ্যাঁ এখানেও সেই একই গন্ধ। কথাটা বললাম আন্টিকে। আন্টি, মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে না?

আন্টি অবাক। গন্ধ? কিসের গন্ধ?

শিউলি ফুলের।

আন্টি নাক টানলেন। কই, আমি পাচ্ছি না তো! আর এ সময় শিউলি ফুলের গন্ধ আসবে কোত্থেকে? এটা তো শিউলি ফোটার সময় না।

আমি পাচ্ছি আন্টি। আমি শিউলির ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। আপনার পুরো ফ্ল্যাটে শিউলির গন্ধ।

আন্টি তীক্ষè চোখে আমার দিকে তাকালেন। চিহ্নিত গলায় বললেন, তোমার কী হয়েছে? এমন দিশেহারা ভাব কেন? কোথায় শিউলির গন্ধ?

আমি নিজেকে সামলালাম। হাসিমুখে বললাম, না হঠাৎ করেই কেমন যেন একটা শিউলি ফুলের গন্ধ পেলাম। আমাদের বাড়িতে শিউলি ফুলের গাছ আছে। বাড়ির কথা ভাবছিলাম বলেই এমন হল কিনা কে জানে?

আন্টির কাছে আমি সামান্য মিথ্যা বললাম। সুরভির কথা ভাবতে ভাবতে গন্ধটা আমি পাচ্ছিলাম, সে কথা ঘুরিয়ে বাড়ির কথা বললাম।

কিন্তু সুরভির সঙ্গে শিউলির কী সম্পর্ক। তার কথা ভাবতে ভাবতে শিউলির গন্ধ আমার নাকে আসবে কেন? কোত্থেকে আসবে? আর এটাই বা কী করে সম্ভব, ফ্ল্যাটের বাকি দুজন মানুষের কেউ গন্ধ পাচ্ছে না, পাচ্ছি শুধু আমি? নিজের রুমে তো পেলামই, ডাইনিং স্পেসে পেলাম, আন্টির রুমে পেলাম। শিউলির গন্ধ তীব্র হয় না। হালকা ধরনের মন ভালো করা গন্ধ। সেই গন্ধ পেলাম শুধু আমি! আশ্চর্য ব্যাপার।

খবরের সঙ্গে সুরভির পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি ছাপা হয়েছে। রুমে ফিরে সেই ছবি বের করলাম। খুবই সাধারণ মেয়ে সুরভি। তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই চেহারায়। আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের মতো। বেশিক্ষণ তাকিয়ে দেখার কিছু নেই। তবু সেই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হল সুরভির সঙ্গে আমার চেহারার বেশ মিল। হ্যাঁ, এই তো সুরভির চোখ দুটো আমার চোখের মতোই মাঝারি সাইজের, পটলচেরা চোখ না, গোল। মাথার চুলও আমার মতোই, ছবিতেও দেখা যাচ্ছে বেশ ঘন। কপালের তেমন ওপর থেকে শুরু হয়নি। ফলে কপাল ছোট। নাক আমার মতোই বোঁচা ধরনের। আশ্চর্য ব্যাপার, আমার মতোই নাকে একটা নোজপিনও আছে। কী আশ্চর্য ঠোঁটও দেখি অনেকটাই আমার মতো। একটু ফোলা ফোলা, অভিমানী টাইপ। গোলগাল মুখ খেয়াল করে দেখলে কেউ কেউ সুরভিকে আমার বোনও বলতে পারে।

এইভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সুরভিকে যখন দেখছি তখন শিউলি ফুলের গন্ধটা আবার পেলাম। বেশিক্ষণের জন্য না, কয়েক সেকেন্ডের জন্য। কী রকম হঠাৎ করে এল গন্ধটা আবার হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেল। কী কারণে এমন হচ্ছে বুঝতেই পারলাম না।

না সুরভিকে নিয়ে বেশি ভাবাভাবি ঠিক হচ্ছে না। আমাকে কী রকম পেয়ে বসেছে সমুদ্রে ডুবে মরা মেয়েটি। খবরের কাগজ রেখে উঠলাম আমি। ইউনিভার্সিটিতে যাই, কোচিং সেন্টারে যাই, নিজের কাজগুলো করি।

তারপরও সুরভি আমাকে ছাড়ল না। যখন ক্লাসে থাকি তখন কিছু হয় না। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডায় থাকলে, ছাত্রী পড়াতে থাকলে, কোচিং সেন্টারে ব্যস্ত থাকার সময় কিছু হয় না, ঘটনা ঘটে একা থাকলেই। সুরভির মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, শিউলি ফুলের গন্ধটা আসে। চেষ্টা করেও চোখ থেকে সুরভিকে সরাতে পারি না। টিভি দেখি, বই পড়ি, গান শুনি, না সুরভি চোখ থেকে যায়ই না। বছর দেড়েক টাকা জমিয়ে আমি একটা ল্যাপটপ কিনেছি। সেই ল্যাপটপ নিয়ে বসলেও আনমনা হয়ে যাই। সুরভির মুখটা যেন ভেসে ওঠে ল্যাপটপের স্ক্রিনে। মোবাইলে দিনে এক দুবার বাড়িতে কথা বলি আমি। বাবার সঙ্গে, মার সঙ্গে। কখনো কখনো এডিকটেড ভাইটির সঙ্গে। ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আনমনা হই। সুরভির কথা মনে পড়ে। অর্থাৎ আমার চিন্তাভাবনা ঘুম জাগরণ কাজকর্মের প্রতিটি স্তরেই যেন ঢুকে যাচ্ছে সুরভি। মৃত মেয়েটি যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলছে আমাকে। আমি আর সুরভি যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছি।

এ সময় প্রতিরাতেই সুরভিকে স্বপ্নে দেখতে লাগলাম।

আমি স্বপ্ন দেখি কম। যাদের ঘুম খুব গভীর তারা স্বপ্ন দেখে কম। আমার ঘুম বেশ গভীর। শুয়ে পড়ার পর কয়েক মিনিট লাগে ঘুমিয়ে পড়তে। বিছানায় যাই বারোটা সাড়ে বারোটার দিকে। একটানা সকাল সাতটা পর্যন্ত ঘুম। এই ঘুম তছনছ হয়ে গেল সুরভির জন্য। চিন্তা-চেতনার মতো আমার ঘুমও আচ্ছন্ন করে ফেলল সুরভি। স্বপ্নে হানা দিতে লাগল প্রতি রাতে।

প্রথম রাতে দেখলাম নির্জন সমুদ্র সৈকতে সুরভি আর আমি। বিকেল শেষ হয়ে আসছে। সূর্য ডুবতে বসেছে সমুদ্রের জলে। হু হু করে আসছে মধ্য সমুদ্রের হাওয়া। আমাদের দুজনার চুল উড়ছে। দুজনেই জিন্স আর টি-শার্ট পরা। টি-শার্টের রঙ সমুদ্রের মতো নীল। স্বপ্নে রঙ দেখা যায় না, কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমাদের দুজনার টি-শার্টের রঙ। জিন্সের রঙও দেখতে পেলাম, হালকা আকাশি। ডানদিককার হাঁটুর কাছে একটুখানি ফেঁসে গেছে। এই ধরনের জিন্স এখনকার ছেলেমেয়েরা রেগুলার পরে। স্বপ্নে সুরভি আমার আগে আগে হেঁটে যাচ্ছে। আমাদের দুজনারই খালি পা। সমুদ্রের কাছাকাছি যেতেই ঢেউ এসে আমাদের পা ভিজিয়ে দেয়। পায়ে সমুদ্রজলের স্পর্শ পেয়ে শিশুর মতো আনন্দে হাসছি আমরা।

তারপর দেখি সুরভি সমুদ্রের দিকে নেমে যায়। আমি তীরে দাঁড়িয়ে বলছি, যেও না সুরভি, সমুদ্রে যেও না। এখন জোয়ারের বেলা। এখন সমুদ্রে নেমো না।

সুরভি আমার কথা শোনে না। হাসতে হাসতে নেমে যায় সমুদ্রে। আমি মানা করতেই থাকি। সে আমার কথা শোনে না। ঢেউ ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যায়। পেছনে দাঁড়িয়ে আমি চিৎকার করি, যেও না সুরভি, যেও না। সে আমার কথা তো শোনেই না, ফিরেও তাকায় না।

সমুদ্রজল সুরভির কোমর ছোঁয়া, বুক গলা ছোঁয়া। তারপর সুরভি নেই, কোথাও নেই। সমুদ্রজলে বিলীন হয়ে যায়।

এই পর্যন্ত দেখে আমার ঘুম ভাঙে। বাকি রাত ঘুম আর আসেই না। ঘুম না আসার যন্ত্রণায় এপাশ ওপাশ করি, ছটফট করি। না, ঘুম আসে না।

এই একই স্বপ্ন দেখলাম তিনরাত। হুবুহু এক স্বপ্ন। তিনরাত না ঘুমাবার ফলে চোখের নিচে কালি পড়েছে। নাশতা করতে বসে এক সকালে আন্টি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী হয়েছে, রুম্পারানি?

ম্লান হেসে বললাম, কিছু না আন্টি।

কিছু না মানে, নিশ্চয় কিছু। চোখের কোলে কালি পড়েছে কেন?

ঘুমটা ভালো হচ্ছে না।

বলো কী? তুমি হচ্ছো ঘুমের মাস্টার। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে যে মেয়ে, একটানা ছ’সাত ঘণ্টা ঘুমায়, তার হঠাৎ ঘুম ভালো হবে না কেন? এতদিন আমার সঙ্গে আছ কোনোদিন তো দেখিনি ঘুমের প্রবলেম হচ্ছে তোমার?

এবার হচ্ছে আন্টি।

কোনো কিছু নিয়ে টেনশনে আছ নাকি?

না, একদম না।

তাহলে?

সুরভির কথা, স্বপ্নের কথা ঘুণাক্ষরেও আন্টিকে বললাম না। কিন্তু সুরভির প্রসঙ্গটা অন্যভাবে এসে গেল। আন্টি বললেন, সেদিনের পর তোমার সঙ্গে তো বিষয়টা নিয়ে আর কথা বলা হল না। খুবই দিশেহারা দেখলাম তোমাকে, আচমকা বললে শিউলির গন্ধ পাচ্ছ, ব্যাপারটা কী বলো তো? এরপরও কি অমন হয়েছে তোমার?

মিথ্যা বলতে আমার খুব খারাপ লাগে। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে বলি সেটা ঠিক আছে, একদিন ভালো লাগল না, ছাত্রী পড়াতে গেলাম না, তখন তাদের সঙ্গে বলি সেটাও ঠিক আছে কিন্তু যে মানুষটি আমার জন্য এত করছেন তাকেও মিথ্যা বলব, মন সায় দেয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে বলতেই হবে। সুরভির মৃত্যু আর তাকে নিয়ে আমার ভাবনা, তার সঙ্গে নিজেকে একাকার করে ফেলা, এসব শুনলেই আন্টি আমাকে নানারকম সাজেশন দেবেন। বলবেন এ এক ধরনের মানসিক সমস্যা। তুমি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাও।

ডাক্তার এভয়েড করার স্বভাব আমার ছোটবেলা থেকে। ডাক্তারের কাছে আমি যেতেই চাই না। একদম বাধ্য না হলে কে যায় ডাক্তারের কাছে! বড় রকমের অসুখ-বিসুখও কখনো হয়নি। জ্বরজারি সর্দিকাশি এসব হয়। নিজেই নিজের ট্রিটম্যান্ট করে ফেলি। দিন তিনেক সকাল আর রাতে একটা করে ‘নাপা’। ব্যস কিচ্ছা খতম।

নিজেকে দিয়ে আমি দেখেছি খাওয়া ঘুম আর পরিশ্রম ঠিকঠাক মতো করলে অসুখ-বিসুখ ধারে কাছে তেমন আসে না। দুশ্চিন্তা থেকে যতদূরে থাকা যায় তত ভালো। ঢাকায় আসার পর প্রথম প্রথম নিজেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কিছুটা ছিল। কিভাবে পড়ার খরচ চালাবেন বাবা, কোথায় কিভাবে থাকব, এসব ভাবনা। কপাল ভালো ওসব সমস্যা মাস ছয়েকের মধ্যেই কেটে গিয়েছিল। এখন নিজেকে নিয়ে আমার কোনো দুশ্চিন্তা নেই। মাসে হাজার পাঁচেক টাকা পাঠাই বাড়িতে। বাবা-মাও ভালো আছেন। শুধু ভাইটাকে বাগে আনা গেল না। ওই এক দুশ্চিন্তা কখনো কখনো হয়। তারপর ভাবি, ওকে নিয়ে চিন্তা করে আর লাভ নেই। যত রকম চেষ্টা করার আমরা করেছি। এখন আর কিছুই করার নেই। ও বেঁচে থাকুক ওর মতো। যতদিন পারে বেঁচে থাকুক।

নাশতা খেতে খেতে সেদিন তার পর মিথ্যাই বলতে হল আন্টিকে। আরে না আন্টি। বললাম না আপনাকে, বাড়ির কথা ভাবছিলাম তো, বাড়ির শিউলি গাছটা, শিউলি ফুলের গন্ধ এসব খুব মনে পড়ছিল। আমার এই স্বভাবটা আছে। কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে থাকলে এত গভীরে চলে যাই সেই বিষয়ের, পরিবেশ পরিস্থিতি সব উল্টোপাল্টা হয়ে যায়। ভাবনা আর বাস্তব একাকার হয়ে যায়। সেদিন ওরকমই হয়েছিল।

আমার কথা শুনে আন্টি হাসলেন। খুবই সুন্দর করে বললে কথাটা। নিজের স্বভাবের বিশ্লেষণ করলে চমৎকারভাবে। তুমি সত্যি খুব ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে।

মনে মনে বললাম, ব্রিলিয়ান্ট মেয়ের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে সুরভি।

তারপর থেকে সুরভি আমার রুমে আসতে লাগল। স্বপ্নে। সারাদিন ক্লাস টিউশনি কোচিং সেন্টার এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তারপরও ফাঁকে ফাঁকে সুরভির চিন্তা আসে। সুরভির মুখটা ভেসে থাকে চোখের সামনে। তখন আনমনা হয়ে যাই। বন্ধুরা ব্যাপারটা খেয়াল করে, কোচিং সেন্টারের মালিক ওয়াকিল ভাই খেয়াল করেন, অন্য টিচাররা খেয়াল করেন আর ছাত্রছাত্রীরা তো করেই। ওয়াকিল ভাই কথাটা একদিন বলেই ফেললেন। রুম্পা, কিছুদিন ধরে তুমি বেশ এবসেন মাইন্ডেট। আমার মনে হয় তোমার রেস্ট হয় না। দিন দশেকের ছুটি নিয়ে বাড়ি যাও। রেস্ট নিয়ে এসো।

না না ওয়াকিল ভাই। সব ঠিক আছে। কালরাতে ভালো ঘুম হয়নি। এজন্য হয়তোৃ

তার মানে মিথ্যা বলতে হল।

ওয়াকিল ভাই হেসে বললেন, বাড়ি চলে যাও। বিকেল থেকেই ঘুমাতে থাকো।

তিনি আমাকে ছুটিই দিয়ে দিলেন।

আমি এখন তিনটা টিউশনি করি। একটা ধানম-ি চার নাম্বার রোডে, মাঠের পশ্চিম দিককার একটি ফ্ল্যাটে আর দুটো আজিমপুরেই। একটা আমার বাসার কাছে আরেকটা ছাপড়া মসজিদের ওদিকে। ধানম-ির ছাত্রী বেশ বড়লোকের টিনএজ মেয়ে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ধানম-ি ব্রাঞ্চে ক্লাস নাইনে পড়ে। ভালো ছাত্রী। সায়েন্স কমার্স নেয়নি, নিয়েছে আর্টস। নাম সারা। খুবই ফুটফুটে চোখে লেগে থাকার মতো মিষ্টি মেয়ে। ওর ইচ্ছে ইংরেজি সাহিত্যে পড়বে। চেহারার মতো বুদ্ধিও সার্ফ। সন্ধ্যাবেলা ওকে পড়াই সপ্তাহে তিনদিন। পড়াতে পড়াতে এক সন্ধ্যায় সুরভিকে নিয়ে আনমনা হয়েছি, হঠাৎ সারা ডাকল। ম্যাম।

চমকে সারার দিকে তাকালাম। ইয়েস।

কী হয়েছে আপনার?

কই কিছু না।

সারা মিষ্টি করে হাসল। নিশ্চয় কিছু হয়েছে।

আমিও হাসলাম। কী করে বুঝলে?

আপনি অনেকক্ষণ ধরে কী যেন ভাবছেন। এমন করে ভাবছেন, যেন আপনি আমাকে পড়াচ্ছেন না, আমার রুমে আপনি নেই। কোথায় যেন চলে গেছেন।

তাই?

হ্যাঁ। আরো দুতিনদিন আমি খেয়াল করেছি। আপনি আগের মতো নেই। খুবই এবসেন মাইন্ডেট। সারাক্ষণ কী যেন ভাবেন।

সারাকে আমি বেশ ঘুরিয়ে সুরভির কথা বললাম। কেন যেন ওকে বলতে ইচ্ছে করল। সারা, আমার এক বন্ধু সমুদ্রে ডুবে মারা গেছে।

সারা চমকাল। বলেন কী? কবে? কিভাবে?

বললাম সারাকে। সব শুনে সে মন খারাপ করল। আই অ্যাম সো সরি ম্যাম। খুব কাছের বন্ধু এভাবে মারা গেলে মন তো খারাপ থাকবেই। আমার বেস্টফ্রেন্ড সংযুক্তা। ওর যদি কখনো কিছু হয়, ওহ্ মাই গড, আমি মনে হয় তক্ষুনি মরে যাব।

সারার গালে হাত দিয়ে ওকে একটু আদর করলাম। না না, এভাবে ভেব না। কতভাবে কত প্রিয়জন আমাদেরকে ছেড়ে যায়! তবে পূর্ণ বয়সে কেউ মারা গেলে তাকে নিয়ে তেমন দুঃখ হয় না। আমার বয়সী একটা মেয়ে, কলিগ বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করতে গেছে সমুদ্র সৈকতে আর মৃত্যু তাকে টেনে নিল। সুরভিকে আমি ভুলতেই পারছি না।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

ওয়াকিল ভাইর মতো সারাও আমাকে বলল, কয়েকদিনের ছুটি নিতে, রেস্ট নিতে। ডিসাইড করলাম, ঠিক আছে, সবাই যখন একই কথা বলছে, কয়েকদিন ছুটি নেই। এ ক’দিন ইউনিভার্সিটিতে যাব না। তেমন জরুরি ক্লাসও নেই। প্ল্যান শুনে আন্টি বললেন, তাহলে বাড়ি যাও। মা বাবা ভাইর সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে এলে ভালো লাগবে।

ভাইর জন্য বাড়িতে আমার যেতে ইচ্ছে করে না। ওর কঙ্কালের মতো চেহারা, নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকা, ভিকিরির মতো অবস্থা, তাকিয়ে দেখা যায় না। বাড়ি গেলেই ও যখন তখন আমার কাছে আসবে, নেশার টাকার জন্য হাত পাতবে। না, আমি সহ্য করতে পারি না। বাড়ি গেলে চোখের সামনে ভাইকে দেখে আমার শুধু কান্না পায়। এজন্য দূরে থাকা ভালো।

ভাইয়ের ঘটনা আন্টি জানেন। তারপরও তাকে বুঝিয়ে বললাম, কেন বাড়ি যেতে চাই না। শুনে আন্টি বললেন, না না ঠিক আছে! তাহলে এখানেই রেস্ট নাও।

রেস্ট নিতে গিয়ে আরো ঝামেলা হয়ে গেল। ওই যে বললাম সুরভি আমার রুমে আসতে শুরু করল। রাতের স্বপ্ন এখন বদলেছে। সমুদ্র সৈকতে সুরভির সঙ্গে আমি, এই স্বপ্নটা আর দেখি না। দেখি ওই একই ড্রেসে, জিন্স আর নীল টি-শার্ট পরা সুরভি যখন তখন রুমের দরজায় এসে দাঁড়াচ্ছে। মুখে হাসি নেই। ম্লান শুকনো মুখে বলছে, আসব?

আমি বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছি। সুরভিকে দেখে বলি, এসো।

সুরভি ঢোক। আমি ল্যাপটপ অফ করি। বসো।

সুরভি বসে না, দাঁড়িয়েই থাকে। সমুদ্র সৈকতের স্বপ্নে যা হত না, আমার রুমের স্বপ্নে সেটা হতে লাগল। সুরভি এলেই তার সঙ্গে আসে শিউলির গন্ধ। স্বপ্নেও গন্ধটা আমি পরিষ্কার পাই।

তেমন কথা সুরভির সঙ্গে আমার হয় না। রুমে ঢুকে করুণ বিষণœ মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে বুঝতে পারি না, আমার ঘুম ভেঙে যায়।

তিনদিন আগে স্বপ্নটা বদলাল। সুরভি বিষণœ মুখে আর দাঁড়িয়ে থাকে না, কথা বলে। একই কথা তিনদিন ধরে বলল, ইনকমপ্লিট একটা সেনটেন্স। আমার গীতবিতানটাৃ

বেশ আকুলতা নিয়ে ওই দুটো শব্দই শুধু বলে।

না এ তো দেখি ভালো যন্ত্রণা! কী করা যায়? যাব একজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে! খুলে বলব তাকে সবকিছু। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি না পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে আমার। লেখাপড়া কাজকাম সব চাঙ্গে উঠেছে।

তারপর অন্য একটা কথা ভাবলাম। আচ্ছা সুরভির ব্যাপারে একটু খোঁজখবর নিলে কেমন হয়! ওর অফিসে গেলাম, কলিগ বন্ধুদের সঙ্গে কথা বললাম। দরকার হলে অফিস থেকে ঠিকানা নিয়ে ওদের বাড়িতে গেলাম। মা বাবা ভাই বোনদের সঙ্গে কথা বললাম। এই করে দেখি না ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়। নতুন ধরনের একটা এক্সপেরিয়েন্সও হবে।

সুরভি যে এডভারটাইজিং এজেন্সিতে কাজ করত সেটা খুবই বিখ্যাত। ধানম-িতে অফিস। পরদিন সেখানে গিয়ে হাজির হলাম।

২.

অফিসের লিফটে চড়ে টের পেলাম অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে আমার। যেন খুব পরিচিত একটা জায়গায় এসেছি। এই লিফটে যেন বহুবার চড়েছি আমি। লিফটে মৃদু একটা এয়ারফ্রেশনারের গন্ধ। গন্ধটাও যেন আমার পরিচিত।

রিসেপশনে এসেও একই অনুভূতি। জায়গাটা যেন খুব চেনা। কিন্তু এই অফিসে আমি কোনোদিন আসিনি। আজই প্রথম। তাহলে এরকম অনুভূতি হচ্ছে কেন?

রিসেপশনে বসা মেয়েটি আমাকে দেখে ভালো রকম চমকাল। চিন্তিত চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কথা বলতে যেন ভুলে গেছে।

এই মেয়েটিকেও আমার চেনাচেনা লাগছে। যেন অনেক দেখেছি তাকে। অনুভূতিটা চেপে রেখে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললাম, এক্সকিউজ মি।

মেয়েটি বাস্তবে ফিরল। ইয়েস।

আমি আপনাদের অফিসের দুয়েকজনের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

কী ব্যাপারে?

কিছুদিন আগে হিমছড়ি সমুদ্র সৈকতেৃ

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই মেয়েটি বলল, সুরভির ব্যাপারে কথা বলবেন?

জি?

আমরা জানি সুরভির কোনো ভাইবোন নেই। সে ছিল তার মা বাবার একমাত্র সন্তান। বাবা মারা গেছেন, আছেন শুধু মা। কিন্তু আপনার চেহারা দেখেৃ

এ সময় একটা ফোন এল। মেয়েটি ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ফোন ধরল। তাদের একজন এক্সিকিউটিভকে চাইল কেউ। তাকে ফোনে লাগিয়ে দিয়ে আবার আমার দিকে তাকাল। আপনার সঙ্গে সুরভির খুব মিল। সুরভিকে যারা চেনে তারা আপনাকে দেখলেই বলবে, আপনি নিশ্চয় সুরভির বোন।

আমি হাসিমুখে বললাম, না, সুরভির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

তাহলে তার ব্যাপারে কথা বলতে এলেন যে!

এসব ক্ষেত্রে চালাকি তো করতেই হবে, মিথ্যা তো বলতেই হবে। আমিও তাই করলাম। দেখুন, আমি একটা সাবজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। আমাদের সমুদ্রে প্রতি বছরই বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনা ঘটলে, সমুদ্রে ডুবে কেউ মারা গেলে বেশ কয়েকদিন ওই নিয়ে মিডিয়া খুব সোচ্চার হয়। প্রিন্ট মিডিয়াতে প্রচুর লেখালেখি হয়, ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে হয় নানা রকমের টকশো তারপর সব থেমে যায়। কাজের কাজ কিছুই হয় না। আই মিন, দুর্ঘটনা এড়াবার ব্যবস্থা সেভাবে নেয়া হয় না। সচেতন করবার কাজটা সেভাবে হয় না। আমার কাজটা এই নিয়ে। অনেকদিন ধরেই কাজটা করছি আমি। রিসেন্টলি সুরভির ঘটনা কাগজে পড়ে আপনাদের কাছে এলাম। আপনি আমাকে একটু হেলপ করুন।

কী ধরনের হেলপ?

সুরভি কিভাবে ডুবে গেল তা আমি কাগজে পড়েছি। ওর সম্পর্কে ডিটেইল জানা দরকার। মেয়েটির পার্সোনাল লাইফ, ফ্যামিলি স্ট্যাটাস ইত্যাদি। আপনাদের এখানে কতদিন ধরে জব করছিল সেৃ

আবার ফোন এল। মেয়েটি এবার আর ‘এক্সকিউজ মি’ বলল না, ফোন ধরল। আমি সেই ফাঁকে তাকে খেয়াল করে দেখতে থাকি। একটু মোটার দিকে শরীর। আমার চেয়ে বয়সে কয়েক বছরের বড় হবে। গায়ের রঙ কালো কিন্তু চেহারা বেশ মিষ্টি। দেখতে ভালো লাগে। সবচাইতে আকর্ষণীয় হচ্ছে তার ভয়েস। ভারি মিষ্টি কণ্ঠস্বর। শুনলে শুনতেই ইচ্ছে করে।

মানুষ পটাবার দুয়েকটা অতি সরল কায়দা আমার জানা। মেয়েটির ওপর সেটা এপ্লাই করলাম। আপনাকে একটা কথা বলব?

প্লিজ।

আপনি দেখতে যেমন সুন্দর, ভয়েসও তেমন সুন্দর। বলিউডের সোনাক্ষী সিনহার মতো ভয়েস আপনার।

মেয়েটি হাসল। কী যে বলেন? কোথায় সোনাক্ষী আর কোথায় আমি! আমি মোটা কালো একটা মেয়েৃ

কালো না, আপনি হচ্ছেন শ্যামলা। অনেকদিন শ্যামলা গায়ের রঙের এত মিষ্টি মেয়ে আমি দেখিনি।

এখন আর মেয়ে নই, মহিলা হয়ে গেছি। ছেলের বয়স সাত বছর।

ওমা, কী বলেন! একদমই বোঝা যায় না। আপনার নামটা খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

আমি মিথিলা।

সঙ্গে সঙ্গে মিথিলাকে আমি আপু বানিয়ে ফেললাম। আমি রুম্পা। মিথিলা আপু, আপনি আমাকে হেলপ করেন না, প্লিজ।

সিওর। সুরভি আমাদের সবারই খুব প্রিয় ছিল। ওর ব্যাপারে অফিস আপনাকে নিশ্চয় হেলপ করবে। তার পরও আমি একটু বসের পারমিশন নিয়ে নিই।

মিথিলা তার বসকে ইন্টারকম করল। প্রথমেই বলল, একটা মেয়ে এসছে স্যার একদমই সুরভির মতো দেখতেৃ

পরের কথাগুলো আমার কানে গেল না। মিথিলা হাসিমুখে পারমিশন নিল তারপর আবার ইন্টারকম করল। লতা, তুমি একটু রিসেপশনে আস।

মিনিট খানেকের মধ্যে লতা নামের মেয়েটি এল। সেও আমাকে দেখে মিথিলার মতোই অবাক হল, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মিথিলা বলল, অবাক হচ্ছো লতা?

হ্যাঁ, আপুটা তো সুরভি আপুর মতো দেখতে।

রাইট। কিন্তু সুরভির সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই।

যে কেউ ভাববে আপুটা সুরভি আপুর আপন বোন।

বুঝলাম মেয়েদেরকে কথায় কথায় আপু বলা লতার মুদ্রাদোষ।

মিথিলা বলল, তুমি রিসেপশনে বসো। আমি রুম্পাকে নিয়ে ভেতরে যাচ্ছি।

ওকে আপু।

আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল মিথিলা।

অফিসটা যে কী সুন্দর! এত সুন্দর অফিসে আমি জীবনে ঢুকিনি। বিদেশী সিনেমায় এরকম অফিস দেখেছি। আমাদের বাংলাদেশেও এত সুন্দর অফিস আছে! এতগুলো মানুষ কাজ করছে কিন্তু কোনো শব্দ নেই। নিঃশব্দে যে যার কাজ করছে, কেউ কেউ তার ডেস্কে বসে চা-কফি খেতে খেতে ডেক্সটপ চালাচ্ছে, ল্যাপটপ চালাচ্ছে। পাশের ডেস্কের লোকও শুনতে পাবে না এমন নিচু গলায় মোবাইলে কথা বলছে কেউ। এয়ারফ্রেশনারের মনোরম গন্ধের সঙ্গে স্পিøটের শীতলতা, আহ্ অসাধারণ পরিবেশ।

এখানেও সেই আগের অনুভূতি আমার। প্রথম ধাক্কা কাটাবার পরই মনে হল, অফিসটা দেখে এত অবাক হচ্ছি কেন? এ তো আমার চেনা অফিস! এখানে তো আমি একদিন না, বহুদিন এসেছি। এই পরিবেশ আমার চেনা, লোকগুলো আমার চেনা। এমন কি এয়ারফ্রেশনারের গন্ধটা পর্যন্ত!

অনুভূতিটা আমি চেপে রাখি।

তানভীর সাহেবের রুমে যাওয়ার পথে যাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছিল, আমাকে দেখে মিথিলা আপুর মতোই অবাক হচ্ছিল তারা। আনমনা চোখে তাকিয়েই কেমন চমকে উঠছে। সুরভির ছবি দেখে নিজের সঙ্গে তার কিছুটা মিল আমি খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু এই অফিসে এসে তো দেখি আমি যতটা মিল আবিষ্কার করেছি তারচেয়ে অনেক বেশি মিল এরা খুঁজে পাচ্ছে।

মিথিলা আপু নিচু গলায় একই কথা বলছিল, সুরভির সঙ্গে অনেক মিল। কিন্তু সুরভির কিছুই হয় না রুম্পা।

কোম্পানির দুজন মালিকের একজনের নাম তানভীর হাসান। তিনি অফিসে ছিলেন। আমাকে নিয়ে মিথিলা তার রুমে ঢুকল। স্যার, এই মেয়েটিৃ

আমি যা অনুমান করেছি তাই হল। তানভীর সাহেবও অফিসের অন্য সবার মতো অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। ষাটের কাছাকাছি হবে বয়স। বেশ লম্বা, সিøম। টকটকে গায়ের রঙ। মাথায় চুল বলতে কিছু নেই, পুরো মাথাই টাক। মাথার টাক তিনি দাড়ি দিয়ে ম্যানেজ করেছেন। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। তাতে এত সুন্দর এবং ব্যক্তিত্বময় লাগছে তাকে, ভাবা যায় না। খুবই আন্তরিক ভদ্রলোক। গলায় অদ্ভুত একটা স্নেহের সুর আছে। বিস্মিত গলায় বললেন, আমি যদি না জানতাম যে সুরভির কোনো বোন নেই তাহলে বিশ্বাসই করতাম না যে তুমি সুরভির বোন নও। খুব মিল সুরভির সঙ্গে তোমার। বসো, বসো। কী খাবে, চা না কফি? চা খাও, গ্রিন টি দিতে বলি। তুমি খেলে আমিও তোমার সঙ্গে আরেক মগ খেতে পারি।

আমি বিনীত গলায় বললাম, জি আচ্ছা।

বলার দরকার নেই, তবু বলি। মিথিলা আপুর মতে, অফিসের অন্য সবার মতো তানভীর সাহেবও আমার চেনা লাগছে। যেন অনেক দেখেছি তাকে। অনেক এসেছি এই রুমে। তার গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি সব আমার চেনা।

অদ্ভুত ব্যাপার! এমন হচ্ছে কেন!

ইন্টারকম তুলে গ্রিন টির কথা বললেন তিনি। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে তার রুমটা দেখছিলাম। তানভীর সাহেবের, এত চেনা রুম, তবু যে কেন দেখছি! টেবিলের একপাশে সুন্দর একটা সেলফে এডভার্টাইজিং বিষয়ক কিছু বই, দুয়েকটা রেয়ার শোপিস আর রুমের চারদিকে নানা রকমের পেন্টিং। টেবিলের পাশে সুন্দর ফ্রেমে পরীর মতো সুন্দর একটি মেয়ের ছবি। আমার ছাত্রী সারার মতোই চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো মেয়ে।

তানভীর সাহেব বললেন, পেন্টিংগুলো আমার মেয়ের। বুঝতেই পারছো ছবির মেয়েটিই আমার মেয়ে। সি ইজ এ পেইন্টার। নাম অন্তরা।

অন্তরাকেও আমার চেনা লাগছে, তার ছবি, পেন্টিং সবই যেন আগে দেখেছি। নামটাও যেন জানা। তারপরও বললাম, খুব সুন্দর ছবি আঁকে। অন্তরা দেখতে যেমন সুন্দর, আঁকেও তেমন সুন্দর। মুখটা মনে হয় আপনার মুখ কেটে বসানো।

সবাই তাই বলে। বলো রুম্পা, আমরা তোমাকে কী হেলপ করতে পারি!

মিথিলা তখনো দাঁড়িয়ে আছে। তানভীর সাহেব তাকে বসতে বললেন। বসো মিথিলা। আরে তোমার চায়ের কথা তো বলিনি।

তিনি ইন্টারকম তুলতে গেলেন। মিথিলা বিনীত গলায় বলল, আমি খাব না স্যার।

সিওর?

জি স্যার।

তানভীর সাহেব আমার দিকে তাকালেন। বলো রুম্পা।

মিথিলাকে যা বলেছিলাম তানভীর সাহেবকেও তাই বললাম। অর্থাৎ ভূমিকাটুকু। তারপর বললাম, সুরভির দুর্ঘটনার দিন আপনি কি স্যার স্পটে ছিলেন?

ইয়েস ডিয়ার। ছিলাম। আমাদের চোখের সামনেই তোৃ

তিনি একটু থামলেন। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল তার। সবার মাঝখান থেকে শুধু সুরভিই হারিয়ে গেল। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। যত রকমভাবে খোঁজা যায় খুঁজেছি। না মেয়েটিকে বাঁচাতে তো পারলামই না, লাশ পর্যন্ত পেলাম না। ওর মা প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। খুব স্বাভাবিক। একমাত্র মেয়ে এভাবে চলে গেল! কোম্পানি থেকে পঁচিশ লাখ টাকা ওর মা’র নামে আমরা ফিক্সড ডিপোজিট করে দিয়েছি। মাসে মাসে পঁচিশ হাজার টাকা করে পাবেন। তাতে তার ভালোই চলে যাবে। একা মানুষ, ভালুকার ওদিককার সিড স্টোর নামের এক জায়গায় বাড়ি। সুরভি আমাদের এখান থেকে পেতো থারটি ফাইভ থাউজেন্ড। লাল মাটিয়ার একটা মেয়েদের হোস্টেলে থাকত। আড়াই বছরের মতো কাজ করল আমাদের এখানে। বিবিএ করে এসেছিল। এখানে থেকে এমবিএ করল। খুবই পরিশ্রমী চমৎকার একটি মেয়ে। কী প্রাণবন্ত, কী উচ্ছল! কথা বলত অতি পরিষ্কার ভাষায়। কোনো হাংকি পাকিং নেই, স্ট্রেট ফরোয়ার্ড।

পিয়ন সুন্দর মগে চা নিয়ে এল। আমাদের দুজনার সামনে নামিয়ে রাখল। আশ্চর্য ব্যাপার, পিয়ন ছেলেটা, তার হাঁটার ভঙ্গি এমনকি চায়ের মগটা পর্যন্ত আমার চেনা লাগছে।

তানভীর সাহেব চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে বললেন, চা নাও।

আমি চায়ে চুমুক দিলাম।

মিথিলা আপু বলল, আমি কি যাব স্যার?

না, থাকো।

তারপর আবার উদাস হলেন। আমাদের এখানে সুরভি যেদিন এল, দিনটার কথা আমার খুব মনে পড়ে। এরকম সময়ই হবে। বারোটা সোয়া বারোটা। মিথিলা ফোনে আমাকে বলল, স্যার, সুরভি নামের একটা মেয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম। বললাম, আরেকদিন আসতে বলো। এপয়েনমেন্ট করে যেন আসে। মিথিলা বলল, বলেছি স্যার। শোনে না। বলে দরকার হলে সে ওয়েট করবে। যতক্ষণ লাগে ওয়েট করবে। কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা না করে যাবে না।

তিনি মিথিলার দিকে তাকালেন। ঠিক না মিথিলা?

জি স্যার। একটু জেদই করছিল। আমি বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। রাগারাগিও করছিলাম। আপনি চাইলেই কি স্যারের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন? স্যার খুবই ব্যস্ত একজন মানুষ। আমি স্যারের সঙ্গে এপয়েনমেন্ট করে রাখছি। আপনি আরেকদিন আসুন। অফিসের ফোন নাম্বার নিয়ে যান। ফোন করে আসবেন। ও কোনো কথাই শুনছিল না। আমি স্যার না পেরে আপনাকে জানালাম।

আমিও বিরক্ত হয়েই তোমাকে বললাম, ঠিক আছে পাঠাও। সুরভি এল আমার রুমে। আমি নরম্যালি কারো সঙ্গে মিসবিহেভ বা রুড বিহেভ করি না। সুরভির সঙ্গে একটু করলাম। কী ব্যাপার বলো তো? জোর করে দেখা করতে এলে? এটা কেমন কথা। আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি। বলো তোমার ঘটনা কী? সুরভি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার গলায় বলল, আমি বিবিএ শেষ করেছি। বাবা ছিলেন স্কুল মাস্টার। খুব কষ্ট করে আমাকে পড়িয়েছেন। আমি নিজেও টিউশনি করি। কিন্তু টিউশনি সব সময় থাকে না। বাবা মারা গেছেন মাস তিনেক। আমি এমবিএতে ভর্তি হয়েছি, হোস্টেলে থাকি কিন্তু কিছুতেই থাকা খাওয়া আর পড়ার খরচ চালাতে পারছি না। মা একটা জমি বিক্রির চেষ্টা করছেন, সেটাও হচ্ছে না। চাচারা বাগড়া দিচ্ছে। আপনি আমাকে হেলপ করুন। আমাকে একটা জব দিন। যে কোনো জব। আমি আমার লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চাই। মাকে হেলপ করতে চাই।

আমি হতবাক হয়ে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আশ্চর্য ব্যাপার! এভাবে কেউ চাকরির কথা বলতে আসে! চেনা পরিচয় কিছু নেই, একটা অফিসে এসে বলছে আমার এই অবস্থা, আমাকে চাকরি দিন! আমি সুরভির মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, বসো। সে বিনীত ভঙ্গিতে বসল। আমি এতক্ষণ মেয়েটিকে খেয়াল করেই দেখিনি। বিরক্ত থাকলে যা হয় আর কী! কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। কী করুণ বিষণœ মুখ। আর আশ্চর্য রকম মায়াবী। নিজের অজান্তেই যেন বদলে গেলাম আমি। মন নরম হয়ে গেল।

তানভীর সাহেব চায়ে চুমুক দিলেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি বিশ্বাস করো রুম্পা, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বদলে তো আমি গেলামই, আমার মনের ভেতর থেকে কে যেন বলল, ওকে তুমি সাহায্য করো। তোমার ভালো হবে। বিশ্বাস করো, আমি যেন পরিষ্কার এই কথাটা নিজের ভেতর থেকে শুনলাম। অফিসে সবাই অবশ্য জানে কথাটা। আমি সবাইকে বলেছি। আমার স্ত্রী-কন্যাও জানে। সুরভিকেও পরে বলেছি। শুনে সে হাসতো। কথা বলতো না। তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত আমি সাধারণত নিই না, কিন্তু সেদিনকার ওই ব্যস্ততার মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আমার পার্টনার নঈম সাহেবকেও জানালাম না, সুরভিকে বললাম, কত হলে তোমার চলে? বলল, আট দশ হাজার হলেই চলবে। আমার খরচ হাজার ছয়েক টাকা, বাকিটা মাকে পাঠাব। আমি কিছু না ভেবে বললাম, তোমার সিভি দাও। কালই জয়েন করো, আমরা তোমাকে পনেরো হাজার টাকা দেব। বড় একটা ইভেন্টের কাজ আছে আমাদের। ওটা দিয়ে শুরু করো। আশ্চর্য ব্যাপার, এমন আচমকা এসে আচমকা চাকরি পাওয়া, সুরভি কিন্তু তেমন উচ্ছ্বসিত হল না। যেন সে জানত এমনই হবে। অথবা চাকরিটা তার প্রাপ্য। কিন্তু পরদিন সে জয়েন করল না। বলল, আজ মঙ্গলবার। আমি স্যার আগামী রোববার জয়েন করব। কাল মাকে দেখতে যাব। তাকে দেখে এসে জয়েন করব। রোববার সে কাজে এল। কাটায় কাটায় অফিসে আসে। আমাদের কাজের তো কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। বড় কাজ থাকলে ছুটির দিনেও করতে হয়। অফিস শেষ হতে রাত নটা দশটা বেজে যায় প্রায়ই। সুরভির হোস্টেলে অসুবিধা হয়। মেয়েদের হোস্টেলে সময় বাধা থাকে। সে লালমাটিয়াতেই একটা রুম সাবলেট নিল। সকালবেলার নাশতা আর রাতের রান্না নিজে করে, আমাদের অফিসে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে, দুপুরে অফিসে খায়। চাকরির ফাঁকে পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছে। আর এত চমৎকার মেয়ে সে। জয়েন করার কিছুদিনের মধ্যেই দেখি অফিসের সবাই তার ভক্ত। সবাই তাকে ব্যাপক পছন্দ করে। বিষণœতা কাটিয়ে এত প্রাণবন্ত হয়েছে সে, পুরো অফিস মাতিয়ে রাখে। আর একটা বড় ব্যাপার হল, সুরভি জয়েন করার পর একের পর এক কাজ পেতে লাগলাম আমরা। ধা ধা করে উন্নতি হল কোম্পানির। পয়মন্ত মেয়ে বলতে যা বোঝায় সুরভি ছিল তাই।

তানভীর সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, উদাস হলেন। আমরা সুরভিকে খুব মিস করি।

আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, সমুদ্রের এইসব দুর্ঘটনা রোধে আপনার সাজেশন কী?

দেখো সুরভির দুর্ঘটনার পর এসব নিয়ে আমি অনেক কথা বলেছি। কয়েকটা কমন জিনিস মেনটেইন করলেই হয়। বিপজ্জনক জায়গাগুলো মার্ক করে রাখা। কিছুতেই যেন ওসব জায়গায় না নামে কেউ। উদ্ধারকর্মীদের আরো এক্টিভ করা আর পর্যটকদের সচেতন করা। ব্যস, আর কিছুর দরকার নেই।

একটু থামলেন তিনি, তারপর বললেন, যত যাই করা হোক, যে যায় সে আর ফিরে আসে না।

কথাটা বলে অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকলেন। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ কেউ ফিরে আসে।

আমি অবাক। মানে?

তুমি যেন আরেকজন সুরভি হয়ে আমাদের কাছে ফিরে এসেছ। এক কাজ করো, তুমি আমাদের ফার্মে জয়েন করো। সুরভির জায়গায় তোমাকে আমি নিয়ে নিচ্ছি। কালই জয়েন করো। একটা সিভি নিয়ে এসো। সুরভির লাস্ট সেলারি ছিল থারটি ফাইভ থাউজেন্ড। ওটাই তোমাকে আমরা দেব।

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তানভীর সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

তিনি মিথিলা আপুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ম্যানেজার সাহেবের কাছে নিয়ে যাও। কালই জয়েন করুক।

মিথিলা আপু হেসে বলল, কিন্তু ও চাকরি করবে কিনা তাতো জানা হল না স্যার।

তানভীর সাহেব হাসলেন। রাইট। আমি তো ওর মতামত না নিয়েইৃ

আমি বিনীত গলায় বললাম, সো নাইস অফ ইউ স্যার। আমি অবশ্যই জয়েন করব। ইটস এ আনথিংকবল অপোরচুনিট। আমি কল্পনাও করিনি। আমার অবস্থা হুবহু না হলেও অনেকটাই সুরভির মতো।

সংক্ষেপে আমি আমার অবস্থা স্যারকে জানিয়ে দিলাম। শুনে তিনি খুশি। তাহলে আর কী! জয়েন করো। সুরভির মৃত্যুতে আমাদের অফিসটাও যেন মরে গেছে। সুরভির মতো আরেকজনকে পেয়ে প্রাণ ফিরে পাবে অফিস। আমি নিশ্চিত আমাদের নতুন নতুন কাজও আসবে অনেক। সুরভির মৃত্যুতে কাজ কমে গেছে আমাদের।

আমি বিনীত গলায় বললাম, আমি স্যার আগামী রোববার জয়েন করব। আজ মঙ্গলবার, এ ক’টা দিন আমি সময় নিচ্ছি, কোচিং সেন্টার টিউশনি ওসব জায়গায় নোটিশ দেয়ার জন্য।

তানভীর সাহেব কেঁপে উঠলেন। অদ্ভুত কোইনসিডেন্স। সুরভিও আমার কাছে এসেছিল মঙ্গলবার। সেও জয়েন করতে চেয়েছিল রোববার। কিন্তু ও তো ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তুমিও কি বাড়িতে যাবে?

না স্যার। আমি যাব সুরভির মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। তার মেয়ের কারণে আমার জীবন বদলে গেল, কথাটা তাকে আমি জানিয়ে আসতে চাই। তাকে একটু দেখেও আসতে চাই।

গুড ভেরিগুড। কবে যাবে বলো। অফিস থেকে তোমাকে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দেব। সুরভিদের বাড়ি চেনে এমন একজন ড্রাইভারও দেব। মিথিলা, শাজাহান ড্রাইভার চেনে না সুরভিদের বাড়ি?

জি স্যার।

ওকে দিয়ে দিও।

ওকে স্যার।

রুম্পাকে সাদিয়ার কাছে নিয়ে যাও। সুরভি আর সাদিয়া পাশাপাশি ডেস্কে বসত। সুরভির ডেস্কটাই রুম্পাকে দাও। সুরভির মৃত্যুতে সবচাইতে বেশি ভেঙে পড়েছে সাদিয়া। শুনেছি অফিসে এসে প্রায়ই কান্নাকাটি করে। সুরভির মতো দেখতে একজনকে পেয়ে মেয়েটি শোক ভুলতে পারবে।

সাদিয়াকে দেখেও সেই অনুভূতি হল। মনে হল সে যেন আমার অনেকদিনের পরিচিত। আমার অতিপ্রিয় বন্ধু। যেন বেশ কিছুদিন ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। একবার ইচ্ছে হল অনেকদিন না দেখা হওয়াকে বন্ধুকে যেমন করে জড়িয়ে বন্ধু তেমন করে জড়িয়ে ধরি সাদিয়াকে। সেটা করলাম না। অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম সাদিয়ার দিকে।

সাদিয়ারও তখন আমার মতোই অবস্থা। সেও ঠিক আমার মতো করেই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমরা কেউ কোনো কথা বলতে পারছি না।

অফিসে ততক্ষণে খবর হয়ে গেছে সুরভির মতো দেখতে একটা মেয়ে এসেছে, তানভীর স্যার তাকে সুরভির জায়গায় চাকরি দিয়েছেন। উৎসাহী অনেকেই আমাকে দেখছে, কেউ কেউ এসে কথা বলছে। মিথিলা আপু আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। আমি একটু আনমনা কারণ আমার মনের ভেতর তখন অদ্ভুত কিছু অনুভূতি। সাদিয়াকে দেখে প্রিয়বন্ধুর অনুভূতিটা তো হলই, আরেকটা ব্যাপার হল সুরভির ডেস্কের দিকে তাকিয়ে। মিথিলা আপু বলল, দুর্ঘটনার পর থেকে সুরভির ডেস্কে কেউ বসে না, খালি পড়ে আছে। সেই ডেস্কের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, জায়গাটা যেন আমার। আমি যেন এই ডেস্কে বসে বহুদিন কাজ করেছি। ওই তো আমার ডেস্কটপ, কলমদানি, ওই তো বছরের শুরুর দিকে কোম্পানি যে ডায়েরিটা দেয় আমার সেই ডায়েরি। যেন আমার নিজস্ব জায়গা ফেলে কোথায় চলে গিয়েছিলাম আমি। বেশ কিছুদিন পর ফিরে এসেছি।

আমার গা কাঁটা দিচ্ছিল।

সাদিয়া ততক্ষণে প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়েছে। আমিও কিছুটা স্বাভাবিক। মিথিলা আপু বলল, তোমরা গল্প করো, আমি আমার কাজে যাচ্ছি।

সাদিয়াই প্রথম কথা বলল, ওকে আপু।

তারপর আমার হাত ধরল। চল, কনফারেন্স রুমে গিয়ে বসি। এখানে বসে বেশি কথা বলা যাবে না। অন্যদের ডিস্টার্ব হবে।

চল।

কখন কোন ফাঁকে মিথিলা আপু আমাকে তুমি করে বলছে, সাদিয়া আমাকে তুমি করে বলছে, আমিও সাদিয়াকে তুমি করে বলছি, কোনো কিছুই খেয়াল করছি না। আজই যে ওদের সঙ্গে পরিচয় হল, এই কিছুক্ষণ আগে, সে কথা আমার মনেই নেই। শুধু মনে হচ্ছে এ তো আমারই কাজের জায়গা। মিথিলা আপু, সাদিয়া ওরা আমার বহুদিনের কলিগ বন্ধু। দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করলে অনেকের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়। আর বন্ধুকে কি কেউ আপনি করে বলে।

কনফারেন্স রুমে এসেও একই অনুভূতি আমার। চেনা রুম। যেন এই রুমে বহুবার বসেছি আমি। বহু মিটিং এটেন্ড করেছি। সাদিয়া আর আমি দুজনে কখনো কখনো এখানে বসে আড্ডা দিয়েছি। চা বিস্কুট খেতে খেতে গল্প করেছি।

আমরা রুমে ঢোকার মিনিট দুয়েকের মধ্যে চা বিস্কুট নিয়ে এল পিয়ন। সাদিয়া অবাক হল। আমরা তো চা বিস্কুট চাইনি জামাল।

জামাল হাসিমুখে বলল, আগেও তো চাইতেন না আপু।

মানে?

আপনি আর সুরভি আপু যখন এই রুমে বসে গল্প করতেন আমি নিজ থেকেই আপনাদেরকে চা বিস্কুট দিতাম। এই আপুটা সুরভি আপুর মতো। আপনাদের দুজনকে এই রুমে ঢুকতে দেখে আমার মনে হল সুরভি আপু বেঁচে থাকার দিনগুলোর কথা। ভুলেই গেলাম আপু নেই। তার জায়গায় এসেছে তার মতো আরেকজন। খান আপু, চা খান। বিস্কুটটা ইউসুফ কনফেকশনারি থেকে এনেছি। খুব ভালো বিস্কুট।

আমরা চা বিস্কুট খেতে খেতে কথা বলতে লাগলাম।

প্রথমে অন্যদের মতো একই রকমের কথা বলল সাদিয়া। আমি সুরভির মতো ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর ইমোশনাল হয়ে গেল। সুরভির মৃত্যুর পর থেকে আমি খুব অপরাধবোধে ভুগি। রাতে ঘুম হয় না। খেতে ভালো লাগে না, কাজ করতে ভালো লাগে না। হিন্দি সিনেমা আমার খুব প্রিয়। প্রায় প্রতি রাতে আমি একটা করে ছবি দেখতাম। হিন্দি ছবিও আমি এখন আর দেখি না। আমার ভালো লাগে না, কিচ্ছু ভালো লাগে না।

অপরাধবোধ কী জন্য?

শুধু মনে হয় আমি কেন ওই বলটা নিয়ে গিয়েছিলাম। সব নষ্টের মূল তো ওই বল। বলটা না নিয়ে গেলে আমরা খেলতে যেতাম না, দুর্ঘটনাও ঘটত না। সুরভি বেঁচে থাকত।

সাদিয়া কেঁদে ফেলল। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখ মুছতে লাগল।

আমি সাদিয়ার কাঁধে হাত দিলাম। ভুলে গেলাম সাদিয়াকে আমি তুমি করে বলছিলাম। কে যেন আমাকে দিয়ে বলালো, কাঁদিস না সাদিয়া। এভাবে কাঁদতে হয় না। আমার দিকে তাকা।

সাদিয়া চমকে আমার দিকে তাকাল। আশ্চর্য ব্যাপার! আমি কখনো মন খারাপ করলে, কখনো কাঁদলে সুরভি ঠিক এভাবে আমাকে সান্ত¡না দিত। আমরা দুজন তুই তোকারি করতাম। কিন্তু তুমি, মানে তুই, রুম্পাৃ

নিজের অজান্তেই যে কথাটা আমি বলেছি সাদিয়াকে তা বললাম না। ব্যাপারটা চেপে রেখে হাসলাম। এক বয়সী দুটো মেয়ে চট করেই ‘তুই’ হয়ে যায়। অবাক হওয়ার কিছু নেই। বল সুরভির কথা বল সাদিয়া। না না সি বিচের কথা না, তোদের বন্ধুত্বের কথা।

সুরভিকে যে আমি কী মিস করি, বলে বোঝাতে পারব না। সকালবেলা অফিসে আসার আগে মনে হয় অফিসে গেলেই যেন সুরভির সঙ্গে দেখা হবে। বেশ একটা উৎসাহ নিয়ে অফিসে আসি। এসেই মনটা খারাপ হয়ে যায়, কান্না পায়। সুরভির ডেস্কের দিকে তাকালেই বুকটা হু হু করে ওঠে। কাজে মন বসাতে পারি না। কোনো কোনো সময় মন একটু বসলে, বেশ কিছুক্ষণ নিজের মতো করে কাজ করতে থাকলে হঠাৎ সুরভির গলা ভেসে আসে। যেন আমার একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে বলছে, নে চা নে।

তার মানে তুই কাজে ডুবে থাকলে ওভাবে সুরভি কখনো কখনো তোর জন্য চা নিয়ে আসত?

হ্যাঁ। আমিও ওর জন্য আনতাম। অর্থাৎ আমরা একা কখনো চা খেতাম না। একজন চা আনতে গেলে অন্যজনের জন্যও নিয়ে আসতাম। সুরভির মৃত্যুর পর থেকে অফিসে চা খেতে আমার ভালোই লাগে না। আজ অনেকদিন পর তোর সঙ্গে বসে চা খাচ্ছি। মনে হচ্ছে সুরভির সঙ্গেই খাচ্ছি।

সাদিয়া কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে থাকল। দুতিনবার চায়ে চুমুক দিল। তারপর বলল, বৃহস্পতিবার রাতটা আমার খুবই খারাপ কাটে।

কেন?

কোনো কোনো উইকএন্ডে ওদের বাড়ি যেত না সুরভি। আমাদের বাড়িতে যেত, আমার সঙ্গে থাকত। আমার মা বাবা ভাইবোন সবাই ওকে খুব ভালোবাসত। আমাদের বাড়িতে উইকএন্ড কাটাতে সুরভিরও খুব ভালো লাগত। কারণ ও যেখানে সাবলেট থাকত সেখানে তো ওকে রান্না করে খেতে হত। আমাদের বাড়িতে সেই ঝামেলা নেই। ওর রেস্ট হত। মোহাম্মদপুরে পুরনো ছোট্ট দোতলা বাড়ি আমাদের। খোলা একটা ছাদ আছে। সেই ছাদে অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকতাম আমরা। কত গল্প করতাম। আমাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেল সুরভি।

আমি আবার সাদিয়ার কাঁধে হাত দিলাম। কোথাও চলে যায়নি। এই তো সুরভি তোর কাছে ফিরে এসেছে।

সাদিয়া আমার হাত ধরল। হ্যাঁ এখন তাই মনে হচ্ছে। তোকে দেখার পর, তুই আমার কাঁধে হাত দেয়ার পর ভেতরে ভেতরে আমি একদম বদলে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে সুরভি সত্যি ফিরে এসেছে। এখন থেকে অফিস ভালো লাগবে আমার, বাড়িতেও ভালো লাগবে।

আমি হেসে বললাম, হিন্দি সিনেমা দেখতেও ভালো লাগবে।

এই প্রথম সাদিয়া হাসল। হ্যাঁ। সালমান খানের ‘দাবাং’টা আজই আবার দেখব।

তারপর যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন গলায় সাদিয়া বলল, তুই সুরভিদের বাড়ি যাবি কবে?

শুক্রবার।

আমার কাছে ওর একটা জিনিস আছে, আজই নিয়ে যা। ওর মাকে পৌঁছে দিস।

ঠিক আছে।

তখনো পর্যন্ত জানি না কতবড় বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

আমাকে নিয়ে সাদিয়া তার ডেস্কের সামনে এল। ড্রয়ার টেনে খবরের কাগজের মলাট দেয়া মোটা পুরনো একটা বই বের করল। সুরভির ‘গীতবিতান’টা আমার কাছে রয়ে গেছে। এটা ওর মাকে দিয়ে দিস।

আমার হাত পা তখন ঠা-া হয়ে আসছে। আরে সুরভি তো স্বপ্নেও আমাকে বলছিল, আমার গীতবিতানটাৃ

৩.

গাড়ি চলছে। আমি মগ্ন হয়ে আছি আমার ভাবনায়। পাশেই আমার হ্যান্ডব্যাগ। ব্যাগের ভেতর সুরভির ‘গীতবিতান’। সুরভিদের বাড়ি যাচ্ছি আমি। এখন সকাল আটটা। শুক্রবার বলে রাস্তাঘাট ফাঁকা। শাজাহান ড্রাইভার স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে। আমার মনে পড়ছে একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনা। কোথাকার কোন সুরভির সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার খবর পড়লাম কাগজে, ধীরে ধীরে সেই মেয়ে ভর করল আমার ওপর। তার কথা ভাবতে ভাবতে শিউলির গন্ধ পেলাম, তাকে স্বপ্নে দেখতে শুরু করলাম। আবিষ্কার করলাম তার সঙ্গে আমার চেহারার মিল। সবচাইতে বড় ধাক্কা খেলাম তার অফিসে গিয়ে। সবাই আমাকে দেখে চমকাল। আমার মনে হল অফিসটা আমার চেনা। এই অফিসে অনেকদিন ধরে আছি আমি। মাঝখানে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলাম আবার ফিরে এসেছি। পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা বেতনের চাকরি হল, যা আমার কল্পনায়ও ছিল না। সাদিয়ার সঙ্গে কনফারেন্স রুমে বসে চা বিস্কুট খাওয়ার পর যা ঘটল, গীতবিতানটা এল আমার হাতে, সুরভি তো স্বপ্নে আমাকে পরিষ্কারভাবে বলেছিল, আমার গীতবিতানটাৃ। এটা কেমন করে সম্ভব! এ কেমন ঘটনা! এইসব ব্যাপারকেই কি অতিপ্রাকৃত ঘটনা বলা হয়! সুপারন্যাচারাল! না কি!

এসব কথা আমি কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারি না। কেউ বিশ্বাস করবে না। এ একান্তই আমার মনোজগতের ব্যাপার। বললে মানুষ আমাকে এবনরম্যাল ভাববে। বলবে, আমার মনে গ-গোল হয়েছে। নানা ধরনের সাজেশন দেবে। সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে পাঠাবে।

না থাক, এসব কথা কাউকে আমি বলব না। ঘটনা আমার মনের ভেতরেই থাক।

চাকরির সংবাদটা আমি মা-বাবাকে জানিয়েছি, আন্টিকে আর আমার বন্ধু-বান্ধবকে জানিয়েছি। আমার ছাত্রীদেরকে জানিয়েছি, কোচিং সেন্টারের ওয়াকিল ভাইকে জানিয়েছি। সবাই কনগ্রেচুলেট করল, ভীষণ খুশি হল।

সবচাইতে বেশি খুশি হয়েছেন মা-বাবা। অফিস থেকে বেরিয়েই বাবাকে ফোন করলাম। শুনে কী যে উচ্ছ্বসিত আমার বাবা। বললেন, জানতাম মেয়েই একদিন আমার পরিবারের চেহারা বদলে দেবে। নিজের জীবন তো বদলাবেই, আমাদের জীবনও বদলে দেবে। কিন্তু মা তোমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে না তো? চাকরি করে ক্লাস করবে কখন?

বললাম, অসুবিধা হবে না বাবা। মাস্টার্সের ক্লাস নিয়মিত না করলেও হয়। বন্ধুদের সাহায্য নেব আর মাঝে মাঝে খুব ইমপরটেন্ট দুয়েকটা ক্লাস করব। জব করে অনেকেই এভাবে পড়াশুনা করছে বাবা। তুমি চিন্তা করো না, আমি ঠিক পারব।

আমি জানি আমার মেয়ে পারবে।

মা তো সব শুনে কথাই বলতে পারলেন না। আনন্দে কাঁদলেন। ভাইয়া বাড়িতে ছিল তাকেও বললাম। সে নেশায় আচ্ছন্ন। জড়ানো গলায় বলল, প্রতি মাসের বেতন পেয়েই আমাকে আলাদা করে টাকা দিবি, কেমন?

তার কথা শুনে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। গভীর আনন্দের মধ্যেও ভাইটার জন্য বিষণœ হলাম। তারপর ডিসাইড করলাম, এখন টাকার তেমন অসুবিধা হবে না। ভালো একটা মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভাইয়াকে দিয়ে দেব। মাদক থেকে তাকে আমি ফেরাবই। সুস্থ তাকে আমি করবই।

তারপর ফোন করেছিলাম আন্টিকে। আন্টিও মা-বাবার মতোই উচ্ছ্বসিত হলেন। রাতের বেলা দেখি লাবণী স্পেশাল খাবারের ব্যবস্থা করেছে। পোলাও গরুর মাংস ভুনা মুরগির রোস্ট। রিচ ফুড আন্টি এভয়েড করেন। কিন্তু সেই রাতে খেলেন আমার সঙ্গে। খেতে খেতে বললেন, চাকরি করো আর যাই করো, থাকতে হবে আমার এখানেই। অন্য কোথাও যেতে পারবে না।

আমি হাসিমুখে বললাম, তাহলে যে ভাড়া আর খাওয়ার টাকা নিতে হবে।

কেন?

আমি তো এখন অনেক টাকা রোজগার করব।

তাতে কি। মেয়ে যদি লাখ লাখ টাকাও রোজগার করে মা কি তার কাছ থেকে থাকা খাওয়ার পয়সা নেবে?

আন্টির কথা শুনে চোখে পানি এসেছিল। এত ভালোবাসেন তিনি আমাকে!

সুরভিদের বাড়ি পৌঁছাবার পর ঘটনা কী রকম দাঁড়াবে তারপর ভাবলাম এ কথা! ওর মা কেমন করবেন আমাকে দেখে! আশপাশের বাড়ির লোকজনরা কি ছুটে আসবে! আমার চেহারা নিয়ে কথা বলতে শুরু করবে! এই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল। সুরভিদের বাড়িতে মাত্র ঢুকেছি আমি, ছোট্ট একটা মেয়ে আসছিল গেটের দিকে, আমার মুখের দিকে এক পলক তাকিয়েই ছটফট করে উঠল। তারপর সুরভি আফা আসছে, সুরভি আফা আসছে বলে ভেতর বাড়ির দিকে দৌড় দিল।

শুধু এটুকুই। তারপর আর কিছু দেখতে পেলাম না।

সিডস্টোর এলাকায় আসতেই এলাকটা আমার খুবই চেনা মনে হল। মনে হল যেন এই এলাকায় বহুবার এসেছি আমি। ওই তো সিডস্টোর বাজার থেকে পশ্চিম দিকে ঢুকে গেছে সুন্দর একটা রাস্তা। দুদিকে দোকানপাট বাড়িঘর গাছপালা। কিছুদূর যাওয়ার পর দক্ষিণে বিস্তীর্ণ ধানের মাঠ, উত্তরে ধানি জমির ফাঁকে ফাঁকে ঘরবাড়ি। সরু একটা খাল চলে গেছে উত্তর দক্ষিণে। খালের ওপর রেলিং দেয়া পুরনো একটা কালভার্ট। সেই কালভার্ট পেরিয়ে বেশ কিছুদূর আসার পর হাতের ডানদিকে রাস্তার ধারে সুরভিদের বাড়ি।

আশ্চর্য ব্যাপার, আমার ভাবনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে সব। আমি যেন জানতাম এমনই হবে।

গাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামল।

আমি গাড়িতে বসেই বাড়িটার দিকে তাকালাম। এই তো দুটো মাটির ঘরের মাঝখানে টিনের গেট। ঘর দুটোই দেয়ালের কাজ করছে। এবড়ো-খেবড়ো, মাটি খসে পড়া দরিদ্র ধরনের ঘর। তিনটা নাড়কেল গাছ আছে পশ্চিমদিকে, পুবদিকে একটা বকুল গাছ, চারটা কাঁঠাল গাছ পাশাপাশি। দুপুরবেলার রোদে কী রকম নির্জন হয়ে আছে চারদিক।

ব্যাগ হাতে গাড়ি থেকে নামলাম আমি। গেটটা খোলাই ছিল, ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই গাড়িতে বসে যেমন ভেবেছিলাম ঠিক সেই ঘটনা ঘটল। সাত আট বছরের একটি মেয়ে আনমনা ভঙ্গিতে গেটের দিকে আসছিল, পরনে প্রিন্টের বেশ পুরনো লাল রংয়ের ফ্রক, কালোকোলো রোদেপোড়া মুখ, আমাকে দেখে যেন পায়ে হঠাৎ কাঁটা ফুটেছে এমন করে চমকাল, তারপর ভেতর বাড়ির দিকে দৌড় দিল। সুরভি আফা আসছে, সুরভি আফা আসছে।

মুহূর্তে সারা পড়ে গেল বাড়িতে। মাটির ঘর থেকে এক মহিলা বেরোলেন। খালি গায়ের লুঙ্গি কাছা মারা একজন লোক ছুটে এল বাড়ির পেছন দিক থেকে। ওদিকটায় একতলা ছোট একটা দালান। সামনে চওড়া বারান্দা। লোকটা এল সেই দালানের পেছন থেকে। মেয়েটাকে একটা ধমক দিল। কী কস? সুরভি আম্মায় আসব কই থিকা।

মেয়েটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ওই যে দেখ।

মহিলা আর পুরুষ মানুষটিও বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

আমার অবস্থা তখন সুরভির অফিসে ঢোকার মতো। সব চেনা পরিচিত। সাত আট কাঠার বাড়ির পশ্চিম পাশে ওই তো রান্নাচালা, রান্নাচালার পেছনে বাঁশঝাড়, একটা কামরাঙ্গা গাছ, দুটো আমড়া গাছ। কদম গাছটা আছে দালানের পেছনে। ছাদের ওপর ঝুঁকে আছে একটা আমগাছ। সাতটা কাঁঠাল গাছ আছে পেছন দিককার বাগানে, ও তো আমি জানিই। খড়ের গাদাটাও ওইদিকে। আর উঠোন বাগান সর্বত্রই শিউলি গাছ। মোট এগারোটা শিউলি গাছ আছে বাড়িতে। উত্তর দিককার পুরনো শিউলি গাছটার গোড়ার গর্ত থেকে একবার বিশাল একটা গোখড়ো সাপ বেরিয়েছিল।

আমার মধ্যে তখন আশ্চর্য এক ঘোর। আমি যেন আমি নেই, আমি যেন সুরভি হয়ে গেছি। অনেকদিন পর যেন বাড়ি ফিরেছি। কিন্তু মা কই, মা!

বাড়ির অন্য লোকদের দেখতে পাচ্ছি, মাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?

ততক্ষণে মহিলা আর লোকটা প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়েছে। লুঙ্গির কাছা খুলে লোকটা বলল, আপনে কে? কই থিকা আইলেন? দেখতে একদম সুরভি আম্মার মতন!

মহিলাও বলল, একই কথা। হ একদম সুরভি আম্মা।

মেয়েটি বলল, আমি তো সুরভি আফাই মনে করছি।

ঘোরটা কাটল আমার। হ্যাঁ আমার চেহারা অনেকটাই সুরভির মতো। সবাই বলে। আমি আসছি ঢাকা থেকে। সুরভি যে অফিসে কাজ করত ওখানেই কাজ করি। সুরভির একটা জিনিস আছে আমার কাছে ওটা ওর মাকে ফেরত দিতে আসছি। তিনি বাড়িতে আছেন?

মহিলা বলল, জি আছে। ওই তোৃ

সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি দালানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন সুরভির মা। পরনে সাদা থান, চোখে চশমা। বেশ রোগা ধরনের শরীর। চেহারায় বনেদিআনা আছে। সেই চেহারা খুবই বিষণœ। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে সেই যে প্রথমদিন যে রকম শিউলির গন্ধ পেয়েছিলাম ঠিক সেই গন্ধটা পেলাম। সুরভির মায়ের গা থেকে যেন আসছে গন্ধ। আমার মধ্যে আবার ফিরে এল ঘোর। অপলক চোখে তিনি যেমন করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে, আমিও ঠিক তেমন করেই তাকিয়ে রইলাম। ইচ্ছে হল দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরি। তা না করে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম।

এই প্রথম কথা বললেন তিনি। গলার স্বর বিষণœ। আমার সুরভির মতো দেখতে, তুমি কে মা?

আমার নাম রুম্পা। সুরভির অফিসে কাজ করি।

ওর অফিসের সবাইকে চিনি। ওরা এসেছিল এই বাড়িতে। কই তোমাকে তো দেখিনি।

আমি তখন ছিলাম না। তিনদিন আগে সুরভির জায়গায় জয়েন করেছি।

এসো, ঘরে এসো।

আমি তার পিছু পিছু ঘরে ঢুকলাম।

আমার যেন জানাই ছিল, চেনাই ছিল ঘরটা। একটা পুরনো দিনের বড় খাট ঘরের অনেকখানি জুড়ে। একপাশে একটা পুরনো আলমারি। ওই তো আলমারির একটা কাচ ভাঙা। ভেতরে কিছু ধর্মীয় বইপত্র, কিছু সিরামিকের কাপ পেট, কয়েকটা সুন্দর গ্লাস। একপাশে কিছু শাড়ি, পাঞ্জাবি ভাঁজ করে রাখা। সিলিংয়ের সঙ্গে যে ফ্যানটা ঝুলছে আমি তা বহুবার দেখেছি। ফ্যানের একটা ব্লেড বাঁকা হয়ে গেছে। একটা হাতলঅলা চেয়ার আছে পশ্চিম দিককার দেয়ালের সঙ্গে। ফ্যান চলছে না, তবু বেশ শীতল স্নিগ্ধ রুম। ঢোকার পর কেমন একটা শান্তি লাগে।

সুরভির মাকে আমি কী ডাকব? আন্টি? বন্ধু-বান্ধব পরিচিতজনের মাকে তো আন্টিই ডাকে সবাই। বাবাকে ডাকে আংকেল। কিন্তু সুরভি তো আমার বন্ধু না। তার সঙ্গে আমার আসলে পরিচয়ই নেই। অদ্ভুত একটা পরিস্থিতিতে আমি তার সঙ্গে জড়িয়ে গেছি, তার মতো হয়ে উঠেছি।

একবার ইচ্ছে করল ভদ্রমহিলাকে আমি মা ডাকি। তারপর মনে হল ওটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। বেশি আদিখ্যেতা হয়ে যাবে।

না আন্টিই ডাকি।

রুমে ঢুকে আন্টি বললেন, বসো মা, বসো। ওই চেয়ারটায় বসো। চেয়ারটা সুরভির বাবার। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই এই চেয়ারটায় বসতেন তিনি। মারা যাওয়ার পর সেভাবে আর কেউ বসে না। সুরভি বাড়িতে এলে ও বসতো। তুমি বসো মা।

না আন্টি আপনি বসুন। আমি খাটের কোণে বসি।

চেয়ারেই বসো। তুমি আমার সুরভির মতো দেখতে। তোমাকে ওই চেয়ারে বসতে দেখলে মনে হবে আমার সুরভি যেন হঠাৎ করে বাড়ি এসেছে।

তারপর আর বলার কী থাকে! আমি চেয়ারে বসলাম।

আন্টি তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে দেখছেন। চশমার ভেতর তার চোখ বড় লাগছে। আমিও তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। খেয়াল করলাম আমাকে দেখতে দেখতে তার মুখ থেকে বিষণœতা কেটে যাচ্ছে। একটু যেন আনন্দিত হচ্ছে তার মুখ। হাসি হাসি ভাব। বললেন, সুরভি চলে যাওয়ার পর একদমই শেষ হয়ে গেছি আমি। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর মেয়েটাকে নিয়ে বেঁচে ছিলাম। মেয়ে ছিল খুবই দায়িত্ববান। চাকরি করে পড়াশুনা শেষ করল। ওর বিয়ের কথাও ভাবছিলাম। বিয়ের কথা বললেই বলতো, এখন ওসব ভেবো না মা। অবস্থা আর একটু বদলাক তারপর দেখা যাবে। আমি কখনো ওর মতের বাইরে কিছু করতাম না, কিছু ভাবতাম না। ওর কথা শুনে মনে হত, এই ভালো। বিয়ে যত দেরি করে হবে ততোই ভালো। বিয়ে হলেই তো মেয়ে আমার পর হয়ে যাবে। বেশ একটা আনন্দ হতো যেদিন মেয়ে বাড়ি ফিরত। মন খারাপ থাকলে মেয়ের মুখ দেখলেই মন ভালো হয়ে যেত।

আমি খেয়াল করলাম আন্টি বেশ গুছিয়ে, সুন্দর ভাষায় কথা বলেন। এই নিয়ে প্রশংসা করতে চাইলাম। তার আগেই সেই বাচ্চা মেয়েটি মহিলা আর লোকটা এসে দাঁড়াল দরজার সামনে। মহিলার হাতে ছোট্ট একটা ট্রে। ট্রের ওপর কাচের গাসে, পিরিচ দিয়ে ঢাকা শরবত।

আন্টি বললেন, ও হচ্ছে ফুলজান, লোকটা ওর স্বামী মোবারক। বাচ্চাটা ওদের। নাম বিন্তি। বহুদিন ধরে আমাদের বাড়িতে আছে। ওরাই আমাকে দেখেশুনে রাখে।

ফুলজান গ্লাসটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। নেন আম্মা, শরবত খান। সুরভি আম্মায় বাড়িতে আসলেই তারে আমি লেবুর শরবত দিতাম।

ফুলজানের কথা শুনে মনে হল, আমার খুব পিপাসা পেয়েছে। মনে মনে আমি যেন লেবুর শরবতই চাইছিলাম।

শরবত নিলাম।

মোবারক বলল, আপনেরে দেইখা বড় আনন্দ লাগতাছে আম্মা। মনে হইতাছে বহুত দিন বাদে সুরভি আম্মায় বাড়িতে আইছে। নাম কী আপনের?

শরবতে চুমুক দিয়ে নিজের নাম বললাম।

বিন্তি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হঠাৎ বলল, বাবা, দেখো এই আফাটার ডেরেসটাও সুরভি আফার মতন।

মোবারক আর ফুলজান কথা বলবার আগেই আন্টি বললেন, হ্যাঁ। সুরভির এই হালকা আকাশি রঙটা খুব প্রিয় ছিল। কোনো কোনো বৃহস্পতিবার বাড়ি আসতো। অফিস থেকে একটু আগে বেরিয়ে বাস ধরতো। সন্ধ্যার পর পর চলে আসতো। শুক্রবার পুরোদিন থাকত, শনিবার দুপুরের ভাত খেয়ে রওনা দিত। পরদিন অফিস। কক্সবাজার যাওয়ার দুদিন আগে হঠাৎ বাড়িতে এসে হাজির। বলল, তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম। আমরা অফিস থেকে কক্সবাজারে যাচ্ছি। খুব মজা করব। একটা রাত আমার কাছে থেকে চলে গেল। যাওয়ার দিন ঠিক এই রংয়ের সালোয়ার কামিজ পরল। সেই যাওয়াই আমার মেয়ের শেষ যাওয়া।

ফুলজান বলল, এই জন্যই তো আম্মারে দেইখা আমার মাইয়ায় চিলাইয়া উঠল, সুরভি আফায় আইছে। আমি আর বিন্তির বাপেও টাসকি খাইয়া গেলাম।

বিন্তি বলল, সুরভি আফায় যে মইরা গেছে, এই আফারে দেইখা সেইটা আমি ভুইলা গেছিলাম মা।

আন্টি বললেন, তোরা এখন যা ফুলজান। রান্নাবান্না কর গিয়ে। মেয়েটা খাবে।

শরবত শেষ হয়ে গিয়েছিল, গ্লাস নিয়ে উঠোনের দিকে পা বাড়াল ফুলজান। তার পিছু পিছু মোবারক আর বিন্তি।

আন্টি ততক্ষণে অনেক প্রাণবন্ত। স্বাভাবিক গলায় বললেন, আমার মনটা ভালো লাগছে মা, খুব ভালো লাগছে। সুরভি নেই সে কথা যেন ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছি আমি। তোমাকে দেখার পর থেকেই এমন হচ্ছে।

বললাম, আপনার ভালো লাগছে শুনে আমারও ভালো লাগছে আন্টি। আমাকে দেখে সুরভির শোক কিছুটা হলেও আপনি কাটাতে পারছেন, এটা আমার জন্য অনেক কিছু। আমাদের অফিসেও একই ঘটনা ঘটছে। আমার চেহারা দেখেই সুরভির জায়গায় বস আমাকে নিয়ে নিলেন। সাদিয়াও আমাকে দেখে সুরভির শোক ভুলতে পারবে। অফিসের সবাই ভুলতে পারবে।

শিউলির প্রসঙ্গটা তুললাম আমি। বাড়িতে এগারোটা শিউলি গাছ, শিউলি ফুল কি আপনাদের খুব পছন্দের?

আন্টি চমকালেন। এগারোটা শিউলি গাছ তুমি জানলে কী করে?

থতমত খেয়ে নিজেকে সামলালাম আমি। সাদিয়া, সাদিয়া বলেছে। ও তো সুরভির বেস্ট ফ্রেন্ড। সুরভির সব কিছুই ও জানে।

মিথ্যা বলতে হল। কোনো উপায় নেই। তবে তখনই ডিসাইড করলাম যে অলৌকিক উপায়ে এ বাড়ির সবকিছু জেনেছি আমি, ঘুণাক্ষরেও তা প্রকাশ করব না।

আন্টি তখন একটু উদাস হয়েছেন। চশমা খুলে শাড়ির আঁচলে মুছকে মুছতে বললেন, সুরভির সবচাইতে প্রিয় ফুল শিউলি। শিউলি ফোটার দিনে ও যে কেমন করত! এই একটা শিউলি গাছের কাছে যাচ্ছে, এই আরেকটার কাছে যাচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই। মেয়ে শিউলি পছন্দ করে দেখেই ওর বাবা বাড়ি ভরে ফেলেছিলেন শিউলি বুনে। বাড়ির পেছন দিককার বড় শিউলি গাছটায়ৃ

যা ডিসাইড করেছিলাম কোন ফাঁকে যেন সে কথা ভুলে গেছি। আনমনা গলায় বললাম, বড় একটা গোখড়ো সাপ বেরিয়েছিল।

আন্টি আবার চমকালেন। এ কথাও সাদিয়া তোমাকে বলেছে?

মাথা নিচু করে বললাম, জি আন্টি।

আন্টি আবার উদাস হলেন। একটা সময়ে আমার কী হত জানো, সুরভির গা থেকে সারা বছরই আমি শিউলির গন্ধ পেতাম। মেয়ে কাছে এলেই আমার নাকে আসত শিউলির গন্ধ। ও তো ফুল কুড়িয়ে পড়ার টেবিলে রাখত, আমাদের রুমে রাখত। ওর বাবার কাজ করার টেবিলে রাখত। এগারোটা গাছে ফুটে আছে ফুল, ঘরে ঘরে আছে, সব মিলিয়ে বাড়িটা হয়ে যেত শিউলি বাড়ি। মেয়ের একটা স্বভাব ছিল হঠাৎ হঠাৎ দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরা। বহুদিন আগে একদিন, শরৎকালের সন্ধ্যাবেলা, শিউলি ফোটার দিনে মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে কি, মা, তোমার শরীর থেকে শিউলির গন্ধ আসছে। আমার বুকে মুখ রেখে তার পর থেকে বড় বড় করে শ্বাস টানতো। এই তো শিউলির গন্ধ পাচ্ছি মা।

শুনে কেঁপে উঠলাম আমি। আন্টির গায়ে আমিও তো আজ শিউলির গন্ধ পেয়েছি!

দুপুরে খেতে বসে আমি অবাক। আমি যা যা পছন্দ করি তাই রান্না করেছে ফুলজান। কাঁঠাল বিচি দিয়ে লইট্টা মাছের শুঁটকি, লাউশাক, লাল আলু ভর্তা, কইমাছ ভেজে বেশি করে পেঁয়াজ দিয়ে ভুনা আর ঘন মুসরির ডাল। মুগ্ধ গলায় বললাম, প্রতিটা আইটেম আমার খুব পছন্দ। আন্টি বললেন, এগুলো সুরভির খুব পছন্দের। ফুলজান বোধহয় এজন্যই রান্না করেছে।

আমি আবার একটু চমকালাম। এসবের মানে কী? একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের এত মিল হয় কী করে? পুরো ব্যাপারটাই কি কোইনসিডেন্স! কাকতালীয়! নাকি এর মধ্যে প্রকৃতির কোনো খেলা আছে! কোনো গভীর রহস্যময় খেলা!

খাওয়া দাওয়ার পর বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখালেন আন্টি। বাড়ি দেখতে দেখতেও চমকাচ্ছিলাম আমি। আরে এই বাড়ি তো আমার দেখা, হাতের তালুর মতো চেনা। একবার দুবার নয়, বহুবার দেখা বাড়ি। যেন এই বাড়িতেই জন্মেছি আমি, এই বাড়িতেই বড় হয়েছি। এ আর নতুন করে দেখার কী আছে!

সুরভির রুমটা ছিমছাম। একটা সিঙ্গেল খাট, পড়ার টেবিল, পুরনো আলনা, ড্রেসিং টেবিল আর একটা ওয়ার্ডরোব। ওয়ার্ডরোবটা বেশি পুরনো না। দেয়ালে সুরভির একটা বাঁধানো ছবি। হাসিমুখের ছবি না। একটু যেন বিষণœ ধরনের। সেই ছবির দিকে তাকিয়ে একবার যেন আমি দেখলাম, সুরভি হাসছে। তার হাসির শব্দটাও আমার কানে এল।

না এখন কোনো কিছুতেই আমি আর তেমন অবাক হচ্ছি না। যা হচ্ছে তা যেন অবধারিত, তা যেন হবেই।

ফেরার সময় আন্টিকে বললাম, সুরভির গীতবিতানটা

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি বললেন, ওটা তোমার কাছেই রাখো। আমার মেয়ে মন খারাপ হলেই গীবিতান পড়ত। কোনো সংকটে পড়লেই গীতবিতান পড়ত। গীতবিতান পড়লে ওর মন ভালো হত, সংকট কেটে যেত। তুমি তো আমার সুরভিই। তোমার জিনিস তোমার কাছেই থাকুক। আর মা, প্রতিদিন ফোনে অন্তত একবার আমার সঙ্গে কথা বলো। মাসে একবার অন্তত আমার সঙ্গে দেখা করতে এসো। তাহলে আমি জানব আমার মেয়ে চলে যায়নি, আমার মেয়ে আছে। এই তো সে আমাকে ফোন করছে, এই তো সে আমাকে দেখতে আসছে।

আন্টি চোখ মুছতে লাগলেন।

আমি তারপর থেকে রোজ একবার আন্টিকে ফোন করি। মাসে একবার গিয়ে একটা রাত তার কাছে থেকে আসি। এখন আর তাকে আমি আন্টি ডাকি না, ডাকি মা। তাকে ফোন করলে মনে হয় আমি আমার মাকেই ফোন করেছি। তার কাছে গিয়ে থাকলে মনে হয় আমি আমার মায়ের কাছেই আছি। আমার মা-বাবা কলিগ বন্ধুরা সবাই এ কথা জানে। আন্টি জানেন। এখন আর সুরভির কথা আমার মনে পড়ে না। তাকে আর স্বপ্নেও দেখি না। কেন তার কথা মনে পড়বে, কেন তাকে স্বপ্নে দেখব। আমি নিজেই তো এখন সুরভি।