আলো দাও, অগ্নিপুষ্প

চিঠিটা বারবার পড়েও আমার বোধগম্য হয় না যে লোকটা কে, আর কী চায়? অফিসের ডেস্কের ওপরে চিঠির গুচ্ছ থেকে ওটা আবিষ্কার করেছি। চিঠিটা বলছেÑ আমি আপনার বন্ধু না হলেও দেশের জন্য আমারও রয়েছে কিছু অবদান। আমিও যুদ্ধ করেছি। দেশের জন্য। আপনার বন্ধু ইকবাল আমাকে চেনে। কেবল একটা সময়ের ব্যবধানে আমাদের পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু বেঁচে থাকার সৌভাগ্য আমারও হয়েছে। এবার আমার আসল বক্তব্য জানানো দরকার। স্বাধীনতার পর থেকে যে ভদ্রমহিলা আপনার স্ত্রী হিসেবে জীবন কাটাচ্ছেন তিনি আসলে আমার বাগদত্তা ছিলেন। তার আসল নাম পরী। বাবা আহমদ আলী ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মী। একাত্তরের এপ্রিল মাসে গ্রামের বাড়ি পালানোর সময়ে শত্রুদের হাতে খুন হয়ে যায় গোটা পরিবার। শত্রুদের ক্র্যাকডাউনের আগে আমার সঙ্গে মেয়েটির আংটি বদল হয়েছিল। ওর কাছে নিশ্চয়ই আছে। আমি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম। সম্প্রতি ফিরে এসেছি। এসে খোঁজ পেলাম যে, সে বেঁচে আছে। আমি চাই ওর সঙ্গে দেখা হোক। অসম্পূর্ণ বিয়েটা সম্পূর্ণ হোক। তাহলে তাকে বিদেশে নিয়ে যেতে চাই। আশা করি আপনি দায়িত্বশীল একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে আমাকে সাহায্য করবেন। ইতি শাহাদাত আলী। খামের ওপর কোনো ঠিকানা লেখা নেই প্রেরকের। কতো বড় দুঃসাহসী হলে এমন ধৃষ্টতায় ভরা চিঠি লেখে লোকটা। না, মাথা হারানো চলবে না। আগে রুহীকে জিজ্ঞেস করা দরকার। এটা একটা ফাঁদ হতে পারে। মানুষ এখন অনেক দক্ষ। প্রায় সব রকম অপরাধে পাকা হয়ে উঠেছে, জটিল চিন্তার ব্যাপারে। প্রথম কাজ হলোÑ একজন পরিচিত লোককে কিসের ভিত্তিতে এরকম চিঠি লিখে পাঠায় সেটা খোঁজ করা। কথাটা ভাবতেই আমার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠলো। কিছু একটা করতে হবে। আম্মার সঙ্গে কথা বলবো? নাকি প্রথমে শিকড়-বাকড়হীন চিঠির ভিত্তিতে একটা জিডি করতে হবে। তারপর খোঁজ-খবর নেয়া দরকার। প্রতিকার খোঁজার আগে উৎস জানা প্রয়োজন।

রুহীকে খুঁজতে খুঁজতে রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়ালাম।

-তুমি কি খুব ব্যস্ত? একটু শুনে যেতে পারবে?

রুহী রান্না ঘরে বুয়ার হাতে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো।

-কী বলছো? কিছু লাগবে?

-না, একটু দরকার আছে। আম্মা কোথায়?

-আম্মা তো গোসল করতে গেছেন। আমাকে বল কী লাগবে।

-রুহী, আমি একটু তোমার সঙ্গেই কথা বলতে চাই আচ্ছা এতোগুলো বছর আমরা দুজনে এক সঙ্গে কাটিয়ে দিলাম। কখনো ঝগড়া বিবাদ হলো না, এ নিয়ে তোমার কিছু মনে হয় না? কোনো অভিযোগ, কোনো দোষ আমার তরফেও থাকতে পারে?

-আমি তোমার কাছে কিছু চেয়েছি? আমার একটা শার্ট আলনায় গুছাতে গুছাতে মৃদু গলায় বলে রুহী।

-মনে করো, এর চেয়েÑ আব্বা যেমন বলেছিলেনÑ ভালো একজনে ভদ্রলোক খোঁজ করে তোমার বিয়ে দিতেন সেটাই হয়তো ভালো হতো। ঘর ভরা ছেলেমেয়ে এমন কি নাতি-নাতনি নিয়ে তোমার জীবনটা ভরে উঠতো। পূর্ণ হতো। তাই নয় কি? তোমার এসব হেঁয়ালিভরা কথার আমি কোনো মানে খুঁজে পাই না। কী বলতে ডেকেছো, সেটা বলবে তো? নাকি এভাবেই ধাঁধায় কথা বলতে বলতে সময় নষ্ট করবে?

-এই লোকটাকে চেনো? শাহাদাত আলী! সে নাকি তোমাদের প্রতিবেশী ছিল একাত্তর পর্যন্ত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে গায়েব হয়ে যায়। দেখো তো কিছু উদ্ধার করতে পারো কিনা? চিঠিটা রুহীর হাতে তুলে দিই আমি। রুহী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিঠিটা পড়ে। তারপর ধপ করে বসে পড়ে। শক্ত হাতে ধরা চিঠিটা ওর আঙুলের মধ্যে কাঁপছে। ধীরে ধীরে বলেÑ এতোদিন ছিল কোথায় বদমাশটা? কী অত্যাচারই না করেছে তখন। আমাদের মস্ত বাড়ি ছিল পুরোনো ঢাকায়। সেটার দিকে নজর ছিল ওর বাবার। আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার পর থেকেই বাবা-মাকে নিয়ে খাতির জমিয়ে তোলে আব্বা-আম্মার সঙ্গে। ওর ইচ্ছা, আমাকে বিয়ে করবে। ওর একটা দল ছিল। ভয়ানক খুনে গু-ারা ওর বন্ধু। একাত্তরে হঠাৎ মার্চ মাসের শেষে একদিন ওর বাবা-মাকে নিয়ে আসে। জোর করে আংটি পরায়। বলে যায় চারদিক একটু শান্ত হলে ঘরে তুলে নিয়ে যাবে। সেই দিনের পরেই আব্বা-আম্মা আর আমাকে নিয়ে নৌকা ভাড়া করে রওনা দেন আমার দাদারবাড়ির দিকে। কয়েকটা অচেনা পরিবার মিলে। একটু হলেই পৌঁছে যেতাম আমরা। পথে নামলো ঝড়। সেনাবাহিনীর টহল দল লঞ্চ নিয়ে তাড়া করে নৌকাগুলোকে। তখন আব্বা-আম্মার গুলি লাগেৃ বলতে বলতে ঝরঝর করে পানি পড়ে রুহীর চোখ থেকেৃ রুহীর নিঃশব্দ কান্নায় আমার কষ্ট হয়। সত্যিই তো, রুহীকে তার আত্মীয়স্বজনের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য যুদ্ধের পরে কতো জায়গায় যে খোঁজখবর করেছি। না, আসলে ওদের বাড়ি ছিল পশ্চিম বাংলায়। এখানে কেরানীগঞ্জে ওর মায়ের আত্মীয় নানা ছিলেন, সেখানেই ওরা পালিয়ে যাচ্ছিল। শেষ অবধি জানা যায়, ওর সেই নানারা যুদ্ধের শুরুতেই দেশ ছেড়েছিলেন।

কিন্তু সেতো গেলো রুহীর জীবন কথা। এই শাহাদাত আলীর ব্যাপারটা কী করা যায়? রুহীর কাছ থেকে আমি যেটুকু শুনতে পেলাম তাতে তাকে অবিশ্বাস করার কোনো যুক্তি নেই। আমার ভেতরের মানুষটা বিস্ময় আর ক্রোধে গরজায়। আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে ইঁদুরদৌড়ে সমানতালে পাল্লা দিচ্ছি আমরা। একদিকে সুনাম, খ্যাতি, সততার গৌরব। অন্যদিকে উচ্চাশা, উচাকাক্সক্ষায় ক্রমাগত স্ক্যান্ডাল তৈরি হচ্ছে আমাদের কর্মকা- নিয়ে। গার্মেন্টস সেক্টরে কেবলই দুর্ঘটনা। কেবলই মৃতের তালিকা দীর্ঘতর হয়ে চলে। কবে আসবে কাক্সিক্ষত শান্তি? কবে ক্রমাগত পরস্পরকে আঘাত করার অপরাধবোধ থেকে খোলা হাওয়ায় আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারবো? বলতে পারবো, হ্যাঁ হরিদাসীর কপাল শতশতবার ভাঙছে না। নিষ্ঠুর আক্রমণে মরছে না ঘুমন্ত শিশুরা, উড়ন্ত মৃত্যুর বাহন হয়ে ছুটে আসছে না আগ্নেয়াস্ত্রের আঘাত। কিন্তু দেখা দিয়েছে নতুন নতুন ব্যাধি যা মানুষকে বদলে দিচ্ছে ভীষণভাবে।

আমি কাজ করছি একটি আধুনিক প্রকাশনা সংস্থায়। সারা দেশের নিয়ম-অনিয়ম নিয়ে লেখা এবং সংবাদগুলো আমার হাত থেকে ছাড়পত্র পেলেই সেটি প্রকাশিত হবে। কোনোরকম অবাস্তব অথবা মনগড়া খবর মানুষের কাছে পৌঁছানোর আগে আমার কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। আমার কাজটা ঠিক যেন ছুরির ওপর দিয়ে হাঁটার মতন। পুলিশম্যান তো ঠিক আছে, কিন্তু প্রতি মুহূর্ত উল্টা-পাল্টা চ্যালেঞ্জের সামনাসামনি যাচাই-বাছাই করতে হয় এবং সেটা আমাকেই করতে হয়। প্রতিটি কাজের সঙ্গে এমনই সম্পর্ক গড়ে ওঠে যে মনে পড়ে যায় যেন কোনোভাবেই কারো প্রতি অসম্মান না হয়। যারা লেখে তাদের প্রতিটি লেখা আরো সিক্ত, কখনোবা অবাস্তব মনে হতে পারে। যাদের চলে যাওয়ায় আমরা গৌরব বয়ে এনেছি তাদের চলে যাওয়া স্মৃতিতে যেন সতীর্থদের হাসি মুখটা সবার কাছে সত্য হয়ে ফিরে আসে।

শব্দটা নিষ্ঠুর। নিঃশব্দ রাতের বুকের ওপরে ধাতব একটা শব্দ। গুলির আওয়াজ নিশ্চয়ই। আজকাল এ শব্দ আমাদের পরিচিত সারাদেশেই এখন এর তা-ব চলছে। যা শুনতে শুনতে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। অস্বস্তি নিয়ে ওঠে বসি বিছানায়। পাশেই রুহীর ঘুমন্ত মুখ দেখে ভারি মমতা হয়। সারাদিন ছুটোছুটি হাজার কাজের ভিড়ে দুরন্ত প্রাণবন্ত রুহী, অনায়াসে কাজ করে চলে। কিন্তু রাত হলেই ক্লান্ত শিশুর মতো ঘুমে এলিয়ে পড়ে। জীবনের একটা কঠিন সময় আমাদের দুজনেই জীবনকে পেয়েছি আগুনে জ্বলতে জ্বলতে, পুড়তে পুড়তে। বসন্ত দিন ছিল জীবনে কিন্তু জীবনের নয়। আদর্শ ছিল শিক্ষায়। কিন্তু চর্চা করার সুযোগ ছিল না। এমনি একটা সময়ে রুহী এসেছিল আমাদের পরিবারে। আমার মায়ের ছেলেবেলার সইয়ের মেয়ে রুহী। আরো হাজার হাজার শিকড় ছেঁড়া মানুষের মতো ওরাও এসেছিল উত্তরবঙ্গের এক দূর গ্রামে। আশ্রয় পাবার জন্য। পথে নৌকাডুবিতে কাছাকাছির আপনজনদের হারিয়ে একলা হয়ে পড়ে। ঐ নৌকার সঙ্গী ছিল অন্য আরেকটা নৌকা। তার মধ্যে ছিলেন এক ডাক্তার। গ্রামের কাছে এক পলক দেখে বুকের মধ্যে কি মায়া হলো। নিজের নৌকায় তুলে নিলেন। না, মরেনি মেয়েটা। তবে জ্ঞান ফিরতে স্বাভাবিক হতে প্রায় দুদিন লেগে যায়। চোখের সামনে মা, ভাইবোনকে গুলিতে মরতে দেখেছে। দম নিয়ে নিয়ে, স্রোতে ভেসে কোনোমতে ধুক ধুক করতে ফাঁকা নিঃশ্বাস নিয়ে হয়তো বাঁচতো না। কপাল ভালো। সেই বৃদ্ধ ডাক্তার তাকে জীবনে ফিরিয়ে আনলেন। কিন্তু ঘুমের মধ্যে চমকে চমকে কেঁদে কেঁদে উঠতো, পালাবার জন্য ছটফট করতো। ঘোর জ্বরের মধ্যে ডুকরে উঠতো গুলি, গুলিৃ ঐ যে মাৃ গুলিতে পড়ে গেলা মা, ডুবে গেলোৃ। আব্বাৃ ঐ যে! গোমরানো কান্নায়ও থরথর করে কাঁপতো সারা শরীর। ক্রমাগত যতœ আর সেবা দিয়ে তাকে সারিয়ে তুললো সবাই মিলে। দুঃসময়ের আত্মীয় যেন একই পরিবার হয়ে উঠেছিল।

যুদ্ধের সময়ে আমরা বর্ডার পার হয়ে চলে যেতাম নিজেদের ইউনিটে। দেশকে স্বাধীন করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়। প্রতিটি মুহূর্ত ছিল মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেদের যাচাই করার চ্যালেঞ্জ। আব্বা বলেছিলেন, ‘ব্যাটারা হুকুম দিয়েছে চাকরিজীবীদের রোজ নির্ভুল অফিসে যেতে হবে। কী আর করা। তোমরাই চলে যাও গাঁয়ের বাড়িতে। না, কান্নাকাটি একদম চলবে না। দুঃসময়ের শেষে যদি ভাগ্যে থাকে। আবার সবাই একসঙ্গে হবো। তো সেই নির্দেশ মেনেই আমি আমার মাকে মামাদের সঙ্গে যমুনা নদীর তীরের গ্রাম মোহনগঞ্জে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাই নিজেদের দলে যোগ দিতে।

এবারে আমার কাজে লাগতেই হবে। স্বাধীনতার যুদ্ধ নিয়ে কাতর স্মৃতিচারণ নয়। যন্ত্রণাক্ত ক্ষোভ আর কষ্টের কথাগুলো লিখে যেতে চাই। অন্তর্দ্বন্দ্ব, স্বার্থের সংঘাত, লজ্জা আর মিথ্যাচারের যে সুড়ঙ্গগুলো মানুষকে মুনষ্যত্বের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়, সেইসব করুণ স্বীকারোক্তির দিনলিপি নিয়ে জীবন কথা লিখতে বসেছি। একজন মুক্তিযোদ্ধার লুকানো বেদনা আর অশ্রুপাত, বিক্ষোভ আর বঞ্চনা আমার সামনে খোলা। সবার কথাই ভিড় করে আসে মনের সামনে। মগবাজারে যেদিন মুকুল জুয়েল বাশারদের হাইড আউট ঘিরে ফেলে শত্রু সৈন্যরা, সেই রাতের কথা মনে পড়ে প্রথমেই। হ্যাঁ, সেদিন রাতে কাজী কামালের বুদ্ধিমত্তায় তাৎক্ষণিক মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছিল সে নিজে। বাকিরা ধরা পড়ে যায়। অবধারিত মৃত্যুই ছিল কয় বন্ধুর শেষ পরিণাম। কিন্তু আমি অন্ধকারে নিচু প্রাচীর ডিঙিয়ে রেললাইন ধরে পালাতে পারি।

একদিন কামালকে টেলিফোনে ডেকে জানতে চাই, মনে পড়ে কি সেই ভয়ঙ্কর রাতের কথা যার তারিখ ছিল ঊনত্রিশে জুন, রাত সাড়ে এগারোটা? রমনা থানায় বোমা ফাটিয়ে ফিরছিলাম আমরা কজন। অসম্ভব ক্লান্তি নিয়ে সব সময় যেমন, সেদিন ও আজাদদের বাসায় গিয়ে বেশি কথা বলার কথা বাদ দিয়ে স্টেনগানগুলো পাশে নিয়েই ঘুমে ঢলে পড়েছিলাম আমরা। আচমকা ঘরের মধ্যে বাজ পড়লো যেন। কিছুক্ষণ হতবিহ্বল নিঃশব্দে থাকার পরে ওদের প্রশ্নৃ

-ইয়ে সব কেয়া হায়? তুম লোগ সব বেইমান মুকতি হো। কাজী কামাল উত্তর দেয়ার আগেই পাশ থেকে স্টেনগান তুলে বেপরোয়া গুলি ছুড়লো এলোপাতাড়ি। ওদের ঘায়েল করার জন্য। অবরুদ্ধ আর্তনাদ শুনেই দারুণ বৃষ্টির অন্ধকারে প্রাচীর ডিঙিয়ে পালালো কামাল। যাবার আগে চিৎকার করে বলতে বলতে গেল, ‘মার শালা পাঞ্জাবিরে মার’। তার পিছু পিছু আমিও দৌড়ে পালাই। চোখেমুখে কিছু দেখার উপায় নেই। গাঢ় অন্ধকারে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। রাস্তার ধারে স্ট্রিটল্যাম্পগুলোর ভুতুড়ে আলো। হু হু করে কাঁপছে গাছপালা। সেদিন ঐ বাসা থেকে আজাদকেও ধরে নিয়ে গেছিল পাঞ্জাবি সৈন্যরা। কামালের গুলিতে ওদেরও একজন সদস্য দারুণ আহত হয়। কিন্তু তার জন্য পরোয়া করে সবাইকে এক সঙ্গে ধরে নিয়ে যায়। শূন্য বাড়িতে রুদ্ধশ্বাস নিঃসঙ্গতা আর কান্নায় ছটফট করে একা হয়ে পড়েছিলেন আজাদের মা। যে কদিন সুযোগ পেয়েছেন, ছেলেদের দেখার জন্য জানাশোনা সবার কাছে গেছেন সহায়তার জন্য। সেদিন যারা ধরা পড়েছিল কেউ ফিরে আসেনি। কিন্তু কামালকে টেলিফোন করার পর তার প্রতিক্রিয়া ছিল বিচিত্র। দুর্ধর্ষ যোদ্ধা কামাল বলেছিলেন, আমি ওসব স্মৃতি মনে করতে চাই না। আলোচনাও নয়। খুব অবাক হয়েছিলাম আমি। কিছুটা দুঃখও। কারণ এই বীরত্বের জন্য তার উচ্চপদস্থ অভিভাবকদের উচ্চ প্রশংসা পেয়েছিল এই মুক্তিযোদ্ধা। তবে স্মৃতিকাতরতা নিয়ে আলোচনায় কেন এই অনীহা? অবশ্য আমি এই বিষয়টা আমাদের মধ্যেও লক্ষ্য করেছি। কারণ মাঝেমধ্যে বিরূপ সমালোচনাও হতো। যারা মাঠে-ঘাটে জঙ্গলে, নদীতে জীবনপণ করে গেরিলা যুদ্ধ করেছে, তাদের কি প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি? নওগাঁর কাজী নুরুন্নবী ডাক্তারি পড়া ছেড়ে যুদ্ধে গিয়েছিল, যুদ্ধের মাঝখানে এসেছিল মাকে একটিবার চোখের দেখা দেখতে। সেখানেই রাজশাহী থেকে কারা যেন তাকে গুম করে ফেলে। আজ পর্যন্ত তার কোনো হদিস মেলেনি। সেই কারণেই হয়তো সতীর্থের সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠা বিচিত্রার সম্পাদকের ঘরে হা-হা করে হাসতে হাসতে আচমকা থেমে যেতো তরুণ যোদ্ধারা। একটা গভীর নীরবতা যেন নেমে আসতো চারদিকে। সিগারেটের ধোঁয়ায় কুয়াশার মতো অস্পষ্ট দেখাতো তাদের মুখগুলো। যেন তারা প্রতিজ্ঞা করেছে, বিন্দুমাত্র দুঃখ, চোখের পানি বা আহাজারি প্রকাশ করবে না। বন্ধুর লাশ কাঁধে নিজে কাঁদতে কাঁদতে ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার সে যুদ্ধ, কী দিয়ে বোঝাবে তরুণ যোদ্ধারা? বন্ধুদের সে হারানো লাশ যে ক্রমাগত তাদের কাঁধে ভারী হয়ে উঠছে সে দুঃখ কী দিয়ে বোঝাবে তারা? না। কমেনি দ্রব্যমূল্য। অপরাধও বেড়ে চলেছে। ছিনতাই, রাহাজানি প্রতিশোধের হত্যা, কী নয়? দুঃখ শুধু এই যে, তরুণরাও যেন এসব অন্যায় আচরণে শামিল হচ্ছে। বদনাম, নিন্দাবাদের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে তাদেরও নাম। তাদের বিদ্রোহ আর ক্রোধকে ভয় পাচ্ছে মানুষ সে এক জটিল সময়। তখন একদিন আম্মা আমাকে বড় দুঃখে বলেছিলেন, লেখাপড়া যদি নাই করিস, মুদি দোকান করে বাঁচার চেষ্টা কর বাদল।

আমার মা আজ অবধি কোনো নৈতিক বিষয়ে আপোস করেননি। মনে আছে, সাত-আট মাস পরে যখন যুদ্ধ শেষের দিকে, তখন একবার গ্রামে গেলাম, তখন রুহীকে নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক ওঠে। ঢাকায় ফিরে যেতে হলে আমাদের সঙ্গেই যাবে বলে স্থির হয়েছে। কিন্তু অনাকাক্সিক্ষত প্রশ্ন, কৌতূহলী মানুষের সামনে কী পরিচয়ে দাঁড়াবে সে? সেদিন ভেবে অবাক হয়েছিলাম। যে মুহূর্তে মানুষ মৃত্যুপুরী থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে সমাজের কুটিল জটিল প্রতিক্রিয়া। রুহী আমাদের কে? এখন তার পরিচয় কী হবে? আম্মা বলেছিলেনৃ

-বাদল, আমার মনে হয়, মেয়েটা মেয়েটা তোকে পছন্দ করে। দরকার হলে ওকে জিজ্ঞেস করে নোবো। অবস্থা বুঝে ঢাকায় ফিরে ওর আত্মীয়স্বজনের কাছে খুঁজে পেতে ফিরিয়ে দেবো। তুই কি বলিস?

-তোমাদের যা ভালো মনে হয় আম্মা।

-রুহীকে ডাকি তাহলে।

রুহীকে ডেকে তাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন আম্মা,

-মনে কর তুই আমার ছেলেবেলার সইয়ের মেয়ে। রক্তের নদীতে ভেসে আমাদের কাছে পৌঁছেছিস। এখানে তোর নিজস্ব একটা দাবি আছে। তুই যা চাইবি, তাই হবে। এখন বল, আমার এই ডাকাত ছেলেকে তোর পছন্দ হয়? ডাক্তার চাচাকে বলার আগে তোর মতটা জেনে নেয়া দরকার। তুই কী বলিস?

-আগে ঢাকা পৌঁছাই, খালাম্মা? তারপর যা হয় হবে। না। রুহী দৃঢ়তা দেখে কেউ অখুশি হয়নি। মেয়েটি বুদ্ধিমতী সন্দেহ নেই। যে ডাক্তার চাচা ওকে বাঁচিয়েছিলেন, তিনিও বললেনÑ

-এই সিদ্ধান্তই ঠিক। স্বাধীন দেশে সবকিছু না জেনে হঠাৎ একটা ডিসিশন নেয়া উচিত নয়। তাই হয়েছিল। ঢাকা শহর ঘিরে নতুন বাংলাদেশকে ভালোবেসে বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিল সবাই। যেখানে গিয়েছি, সবার সম্মান আর স্নেহ ঝরে পড়েছে আমাদের ওপরে। তার মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসে কিছু মানুষের দম্ভ, ক্ষমতার অপব্যবহার। চারদিকে ঔদ্ধত্য আর মৃত্যুর পদধ্বনি। জানুয়ারির শেষ দিনে বিরাট গুলিবর্ষণ আর অবাঙালিদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁঝরা হয়ে মারা গেলো সেলিম। সেনাবাহিনীর গর্ব এক তরুণ অফিসার। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তে যুদ্ধে গিয়েছিল। দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, ভয়ডরের বালাই নেই। কমান্ডিং অফিসার তাকে ডাকতেন বাঘের বাচ্চা নামে। সেই লেফটেন্যান্ট সেলিম বড় কষ্ট পেয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মারা গেলো। নিজের দেশে। এক সুন্দর উজ্জ্বল ঢাকা শহরে বীভৎস এক প্রতারণার ফাঁদে প্রাণ হারালো সে। ঐ সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ জহির রায়হানের বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে কিছুদিন আগে অপহরণ করা হয়। হঠাৎ কেউ তার শোকার্ত ভাই জহির রায়হানকে ফোন করে জানায় যে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ প্রান্তে বিখ্যাত সাহিত্যিক চলচ্চিত্রকার শিল্পী শহীদুল্লাহ কায়সারকে শত্রুরা ধরে নিয়ে যায়, তার খোঁজ পাওয়া গেছে এবং তা মিরপুরে কোনো এক এলাকায়। খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মিরপুরে ছুটে যান এবং আচমকা আক্রান্ত হন। সেই দুর্ঘটনায় সেলিম নিহত হয়। স্বাধীনতার প্রথম লগ্নে নিষ্ঠুর মৃত্যু কেড়ে নেয় এ দেশের অনেক বীর সন্তানকে। বুকে চাপড়ে কাঁদলেও কোনো উত্তর মেলে না শত শত কেনর। মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে তোলা গ্রুপ ছবির দিকে তাকাই। খুঁজে বের করি হারিয়ে ফেলা ফয়েজ, মোস্তাফা আরিফকে। বেঁচে থাকার অপরাধবোধ আমাকে দুঃসহ যন্ত্রণা দেয়। আসলে বন্ধুদের কথা সুখের দিনেই বুঝি বেশি করে বেদনা দেয়। কিন্তু এক স্বপ্নাতুর সূর্যের মতোই আমরা ভেবেছিলাম, শপথ নিয়েছিলাম, সামনে কতো কাজ, কতো দায়িত্ব। ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া দেশটাকে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। নিজেদের নিয়ে মেতে থাকলে চলবে না। এক মুহূর্তের জন্য সে প্রতিজ্ঞা ভুলিনি।

অতএব জীবনের দিনগুলো কেটে গেছে ঝড়-ঝঞ্ঝা, ঘটনার ঘনঘটা নিয়ে। রুহী কখনো আমার কাছে হাত পেতে কিছু চায়নি, আমিও হাত বাড়িয়ে দিইনি। নিজেদের কী ক্ষয়ক্ষতি হলো তাও কখনো হিসাব করে দেখিনি।

কিন্তু এই পরগাছা ভদ্রলোক তো জ্বালালো আমাকে! ভেতরে ভেতরে খোঁজ-খবর নিতে থাকি। খুব উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। তবে জানতে পারি, লোকটা স্বাধীনতার পরে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল। মানুষ পাচার করার ব্যবসা করতো। অভিযুক্ত হয়েও লাখ লাখ টাকার ব্যবসা ছিল বলে কিভাবে যেন ফাঁক-ফোকর দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমিও সুযোগের অপেক্ষায় আছি। লোকটাকে সুযোগ পেলেই ধরবো। মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করে আমার। লোকটা এখন টেলিফোনে নিজেকে জানান দিচ্ছে।

-প্লিজ! আমি একবার আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতে চাই।

-কিন্তু আপনাকে আমরা চিনি না। কঠোরভাবে বলি আমি।

-আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না। আমি শুধু একবার আপনার স্ত্রীকে দেখতে আসতে চাই। ও যদি বলে যে আমাকে চেনে না, কখনো দেখেনি, তবে আমি চিরকালের মতো চলে যাবো।

-আমি দুঃখিত শাহাদাত সাহেব, আপনি আমার বিশ্বাস অর্জন করতে পারছেন না। সে কি আপনাকে ভালোবাসে বলে জানিয়েছিল? আপনি তাকে কোন আইনে দেখতে আসতে চান? আপনি ভুলে গেছেন দীর্ঘদিন পার হয়ে গেছে? হঠাৎ করে বললে তার সত্যতার প্রমাণ দিতে পারবেন?

-ওর হাতে আমার দেয়া আংটি আছে।

ধপ করে রিসিভার নামিয়ে রাখি আমি। গলা তুলে ত্রুদ্ধ গলায় বলিÑ রুহী, তুমি কোথায়ৃ

রুহী হাসিমুখে ঘরে ঢোকে।

-কী হয়েছে? কার সঙ্গে এতো চিৎকার করে কথা বলছিলে। কী হয়েছে?

-কী বকছো যা-তা? চিৎকার করে কথা বললে কেন? তোমার হাতে যে আংটি ছিল সেটা একটু দাওতো?

আংটি? আমার হাতে? আমার হাতে আবার আংটি কোথায় পেলে? তোমার দেয়া আংটিটা এতো ভারি যে, পরে কাজ করা যায় না। তাই ওটা খুলে রেখেছি।

-না রুহী, অনেক আগে শাহাদাত আলী যে আংটি তোমাকে পরিয়ে দিয়েছিল সেটার কথা বলছি।

-ওটা আমি সেই সময় নদীতে ফেলে দিয়েছি। তুমি তো আমার কাছে কোনো দিন ভালোমন্দ জানতে চাও না, তাই তোমাকে কিছু বলিনি।

রুহী কতো সহজভাবে কথা বলছে! যতো দ্বন্দ্ব-ক্রোধ সব কি আমারই মধ্যে? আমি কি রুহীকে কষ্ট দেয়ার জন্য ইচ্ছে করেই এ প্রসঙ্গ তুলে আনছি? না সত্যি মিথ্যে যাচাই করার জন্য স্বামীর অধিকার নিয়ে ওকে আঘাত করছি? রুহীর সহজ ব্যবহার দেখে বলিÑ আমাকে বিষয়টা অনেক আগেই তোমার জানানো উচিত ছিল রুহী! রুহী অবাক হয়ে আমাকে দেখে, যেন চিনতে পারছে না। তারপর দৃঢ়ভাবে বলে আমার ও কথা মনেও হয়নি কখনো। তোমার কাছ থেকে এটা আমি আশা করিনি। ব্যাপারটা জুলুম করে ঘটানো হয়েছিল। ওই লোকটাকে আমি তখনো ঘৃণাই করেছি, এখনো করি। মিথ্যা জুলুমের হাত থেকে দেশকে বাঁচাবার জন্য তোমরা যুদ্ধ করেছো, আজ একটা কি প্রতারকের কথার তোমার ভেতরে এতো আগুন জ্বলে উঠলো কেন? নাকি, একটু একটু ভালোবাসো স্ত্রীকে, তাই?

-রুহী কি আমাকে ঠাট্টা করছে? ক্রুদ্ধ গলায় বলি,

-লোকটাকে একটা শিক্ষা দেয়া দরকার।

-মুখ ফুটে দুটো মায়ার কথা কখনো বলেছো আমাকে? তোমার পাশে পাশে যে ভারবাহী মানুষটা চলছে এতোকাল, তার প্রতি তোমার দায়িত্ব পালন ছাড়া আর কিছু যে চাওয়ার আছে, তা কখনো ভেবে দেখেছ। আচমকা আমার ঠিক বুকের সামনে দাঁড়ায় রুহী। গলাটা ধরে এলেও স্পষ্ট উচ্চারণে বলেÑ

-সারা জীবনই তো আমার কালরাত্রি। তুমি তো আমাকে ঠকাতে পেরেছ, তবে আজ কেন এ সন্দেহ? বলো?

আমি রুহীর কথা শুনে চমকে উঠি। দুহাতে ওর কাঁধ ধরে আমার দিকে ফেরাই। কতো বছরের জমানো যন্ত্রণা ঝরে পড়ছে ওর কণ্ঠস্বরে! আমি বলি,

-তুমিই তো সব দায়দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছ রুহী? কতো আনন্দ গড়ে তুলেছে তোমার সংসার নিয়ে। তবে আজ এ অভিযোগ কেন?

-তুমিইবা কী দেবে আমাকে? তুমি বাস করছে একটা স্বপ্নের জগতে। সেখানে আমার জায়গা কতোটুকু? ছাড়ো, আমার লাগছে।

রুহী আমার কাছ থেকে সরে দরজার দিকে চলে গেলো। আর তক্ষুনি বিশ্রি শব্দে বেজে উঠলো টেলিফোন।

রুহীকে বললামÑ আজ ঐ শাহাদাত আলী আমাদের এখানে আসবে। তুমি তৈরি থেকো। ও ঘর থেকে আম্মা এসে দাঁড়ালেন। আম্মা। বললেনÑ তুই কোনদিন বা সংসারের কী খবর রাখিস বল? এখন দ্যাখ। যদি তোর চৈতন্য হয়। জীবন নিয়ে অবহেলা করা অপরাধ। গুরুতর অপরাধ। অপ্রসন্ন মুখে আম্মা বেরিয়ে গেলেন। আমি কোনো জবাব দিই না। আম্মা রুহীকে বড় ভালোবাসে। সেই প্রথম দিন থেকেই। অসহায় রুহী তখন জ্ঞানে-অজ্ঞানে কেবল মাকে খুঁজতো। কথা বলতো না, চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরতো। তখন আমার মা ওকে পাখির বাচ্চার মতো বুকের কাছে আগলে রেখে সুস্থ রেখেছিল। সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠলে, মায়ের সঙ্গে মুরগির বাচ্চার মতো ঘুরতো সে। সত্যি বলতে গেলে ওর প্রতি আমার কিছুটা ঈর্ষাই বোধ হয়। যদিও জানি যে ব্যাপারটা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। আপাতত আম্মার সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক তোলা থাক না হয়। আজ আমার অন্য দায়িত্ব। একটা অন্যায়ের দুঃসাহসকে শিক্ষা দেয়া। তার জন্যই আজ অপেক্ষা। রুহীর আত্মমর্যাদাবোধ আমাকে আজ সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি জানি রুহী নিজেও তাই চায়।

অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসি। নিঃশব্দে এক অদ্ভুত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হই আমি। রুহী আজ সন্ধ্যা থেকে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। আম্মাকেও দেখছি সতর্কভাবে সবকিছু দেখাশোনা করছেন। এ এমন এক শক্র, যাকে আমরা চিনি না, জানি না। অথচ মিথ্যা ফাঁদে যে আমাদের এ শান্তির নীড়টাকে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে। আমাদের সব অর্জন মিথ্যা হয়ে যেতে পারে।

বসবার ঘরের টেবিলে অনেক যতেœ তুলে রাখা যন্ত্রটা সাবধানে একটা কাগজের নিচে রেখে চেয়ারে বসি আমি। সন্ধ্যার পরেই লোকটার আসবার কথা। রুহীও আজকের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু কোনো দুঃশ্চিন্তা নেই ওর মধ্যে। ঘর থেকে ঘরে ঘুরছে ফিরছে, আম্মাকে পানের বাটা এগিয়ে দিচ্ছে। রাত্রির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে উদ্বেগ, উত্তেজনা। লোকটা আবার কোন জটিলতা নিয়ে আসে কে জানে।

এক সময় ক্লান্তিতে তন্দ্রা নামে আমার চোখে। রাত্রির প্রহর এসে দাঁড়ায় মধ্যখানে। দূরে বড় রাস্তার দিক থেকে কুকুরের ডাক শোনা যায়। নিঃশব্দে ভোরের আলো এসে দাঁড়ায় জানালার ওপারে।

না, কেউ এসে দরজায় দাঁড়ায় না। সামনে নতুন দিন।

সকালে চায়ের টেবিলে বসে সংবাদপত্র খুলে দেখি, আর চমকে উঠি। পুরোনো শহরে একটা বাণিজ্যিক এলাকায় প্রবাসী ব্যবসায়ী বন্দুক যুদ্ধে নিহত। ভদ্রলোক বিদেশে লোক পাঠানোর ব্যবসা করতেন। মনে করা হয় যে টাকা-পয়সা ও ব্যবসার লেনদেন নিয়ে দলের অন্য সদস্যদের সঙ্গে মনোমালিন্যের জের ধরে এ হত্যা ঘটেছে। পুলিশ এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। তদন্ত চলতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীর নাম শাহাদাত আলী। কিছুদিন আগে ভদ্রলোক দেশে ফিরে এসেছিলেন।

খবরটা পড়ে আমি আম্মাকে দেখাই। আম্মা রুহীকে ডাকে। রুহী বলে, হ্যাঁ, এই সেই লোক। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে রুহী। যেন খোলা বাতাসের কাছে নতুন করে বাঁচার আশা খোঁজে। ভারি নিশ্চিন্ত দেখায় তাকে। ঠিক যেমনটি তাকে সব সময় দেখি। যেন কোথাও কিছু ঘটেনি।

সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফিরে আসার আগে অফিসের টেলিফোনে ডাক আসে। আমি রিসিভার তুলে অবাক হই। ওপ্রান্তে রুহীকে বলেÑ

-এই শুনছো? আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরবো।

-কেন? কোনো দরকারি কাজ আছে?

-দরকারি কাজ ছাড়া বাড়ি আসা যায় না?

-আসবো। ঠিক আছে?

সন্ধ্যার আলো নিভে গেলেই আমাদের ঘরটা যেন ঝলমল করে ওঠে। স্নিগ্ধ আলোয় স্বপ্নাতুর পরিবেশ, যেন স্বপ্নটা অপার্থীব, আমার অভিজ্ঞতার বাইরে। সারা ঘরে ফুলের স্তবক গুচ্ছ গুচ্ছ করে সাজানো। সুগন্ধের, সৌন্দর্যের মতোই রুহী এসে আমার হাত ধরে, বলেÑ এসো।

আমি হঠাৎ যেন নার্ভাসবোধ করতে থাকি। বুকের গভীরে বেদনা আর আনন্দের যুগলবন্দীর নির্ঝর যেন জল তরঙ্গের মতো বেজে ওঠে। আমি বলতে চাই, এই ঘরটা আমার, এই দেশটা আমার, এই বুক ভরা ভালোবাসা, সেও আমার। তুমি যদি রুপোর কৌটায় ভরে স্বাধীনতা আমার হাতে দাও, তবে সেটাও আমার। এই নিঃসঙ্গতা এই কষ্ট, এই আনন্দ সবই আমার। এর পুরো মালিকানা আমার। কিন্তু, কিন্তু যা চাই না, যা স্বীকার করি না সেই ঘৃণা? বলো রুহী, ঘৃণার যন্ত্রণাটাও কি আমাকেই বয়ে বেড়াতে হবে? বলো রুহী, বলো? রুহী কিন্তু উত্তর দেয় না। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে জানালার ধারে দাঁড়ায়। ওর বুকের ভেতর থেকে একটা প্রবল নিঃশ্বাস এসে পর্দাগুলো দুলিয়ে দেয়। কোথা থেকে একটা গোমরানো বাতাস হু হু করে ঘরের জানালা ছুঁয়ে যায়। ঠিক মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার মতো। আমি যেন অনুভব করতে পারি, অনেক অদৃশ্য মানুষ। আমাদের তাকিয়ে দেখছে। মাঝে মাঝে আমার বন্ধু ফয়েজ যেমন হাসতে হাসতে বলতোÑ যুদ্ধটা শেষ হোক রে বাদল, তখন এক দৌড়ে যাইয়া হাজির হমু আমার মায়ের কাছে। তুই কিন্তু আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই যাবি। কেমন? এ যুদ্ধের শেষতক বাঁচতে চাই। তুই চাস না? তুই থাকবি না আমার সঙ্গে? অন্যদিকে ফিরোজ আমাদের আরেক বন্ধু, সে মৃদু হেসে বলতো আগে তো দেশটা স্বাধীন হইয়া লউক। এখন তো একটাই লক্ষ্য, দ্যাশটারে জালিমের হাত থেইকা স্বাধীন, সুস্থ কইরা তুলতে হবে। রাতের বেলা তারার আলোয় ভিজে ক্যাম্পের সামনে বসে সারদিনের ক্লান্তি ভোলার সময় কথাগুলো বলাবলি করতো ছেলেরা। কখনো বা পাশের বিছানায় শুয়ে নিতো জীবনের স্বপ্ন, সাধ আর অপূর্ণতা। কিন্তু কথা রাখতে পারেনি ওরা। হারিয়ে গেছে অজানা দেশে সেসব দিন এখনো অনেক রাতের অন্ধকারে পাহারা দেয় সেই দিনের তরুণ-তরুণীদের। মাঝখানে চলে গেছে দীর্ঘ সময়ের স্রোত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আলো আঁধারে কুয়াশায় বুকের ভেতর তোলপাড় তোলে। সকাল হতে জীবনের লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে ওঠা, অফিস করা আর দায়িত্ব পালনের জন্য জীবনের চাকা ঘুরতে থাকি আমরা। আমার ভেতরের প্রাচীরে তরুণটা যেন বাড়ি না ফিরে পথে পথে ঘুরে, কখনো বাড়ি ফিরে ভাবি, স্বপ্নস্নাত সেই যৌবনের দিনগুলো শেষ করে কোনোমতেই প্রথম লাইন ধরতে পারলাম না কেন আমরা? কেউ কেউ আবার স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসাপত্তর নিয়ে ব্যস্ত। কেউ বা কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। আমাদের বন্ধুরা কেউ কেউ ব্যাংকার, কেউ বা বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। দেশে ফিরে দেখি, পর্বতপ্রমাণ অহঙ্কার। আর মিথ্যার নিচে সব ঢাকা পড়ে গেছে নিজেদের সেই অহম আর প্রতিযোগিতার নিচে আমরা একটি নাম একটি জাতি, যার নাম মুক্তিযোদ্ধা।

সেদিন বিকেল বেলায় ফাইলটা আমার সামনে এনে দেয় বেয়ারা। বিষয়টা ভেরিফাই করে দেখতে হবে তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্তের নির্দেশ দেবেন। তাজরীন ফ্যাশন আর রানা প্লাজার শুকনো মৃতদেহের খাঁচাগুলো যেন প্রাচীন মমির মতো। শুধু তাই নয়, মীরপুর নূর মসজিদের নিচে পাওয়া অস্ত্রগুলো পানির ট্যাঙ্কে মানুষের দেহাবশেষে সব দুঃসহ স্মৃতি আমার সামনে দাঁড়ায়। কারা যেন সমস্বরে বলে ওঠেÑ ‘আমরা শপথ করেতিছি যে, আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষার্থে জীবন বাজি রাখিয়া শক্রর সঙ্গে যুদ্ধ করিব। ব্যক্তি স্বার্থ নয়। জন্মভূমির প্রতি আমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় আমরা সফল হইবোৃ’

চোখটা যেন র্ক র্ক করে ওঠে। শত শত অনামী মুক্তিযোদ্ধারা যেন মানববন্ধন তৈরি করে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়ে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলায়। হ্যাঁ, এভাবেই আমরা বেঁচে আছি। আমাদের স্বার্থ, বাক স্বাধীনতা আর ঈর্ষায় আমরা ফুলে ফেঁপে উঠেছি, এখনকার মায়েরা চাঁদ মামার গল্প শোনায় না, তারা এখন ভিন গ্রহের রোবট খোঁজে। একাদিক রক্তের নিষ্ঠুর স্রোত, অন্যদিকে ভোগ বিলাসের পাহাড়। আমরা অবশ্য তাতে বিচলিত নই। চোখের পানি ফেলে সময় নষ্ট করা আমাদের মানায় না। তাই আমারা নানামুখী বৈচিত্র্য খুঁজে নিই, যাতে হৃদয়ের গভীরে যে পরাজয়, তাকে ভুলে থাকা যায়। সেদিন এখানকার উচ্চস্তরের এক ক্লাবে নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা, কোলাকুলি আর স্নেহবন্ধনে নতুন করে ফিরে পেলাম নিজেদের। মনে পড়ে যায় যুদ্ধদিনের কতো বেদনার্ত দিন, কতো অন্ধকার রাত্রি আহত মুমূর্ষ বন্ধুকে কাঁধে নিয়ে রাতের পর রাত অজানা-অচেনা লোকালয়ে একটু সাহায্যের আশায় ছুটে বেড়ানো, তারপর সেই অচেনা লোকালয়ে তাকে কোনো আশ্রয়, চিকিৎসা ছাড়া মাটির নিচে শুইয়ে দেয়ার পর একটা সবুজ গাছের ডাল মাটিতে পুঁতে দেয়া। স্যালুট করে, চোখের পানি লুকিয়ে পালিয়ে আসা নদীর ধার ঘেঁষে শক্রদের লঞ্চ থেকে নিদ্রাকাতর, ভীত-সন্ত্রস্ত গ্রামগুলোর ওপরে ছুটে আসতো জোরালো সার্চলাইট, সাঁতরে বেড়াতো মানুষ ধরার আশায়। কখনো বা এক রাউন্ড রাইফেলের গুলি ছুড়ে দিতো, তারপর ধীরে ধীরে চলে যেতো।

আমার বন্ধুরা তাদের রাজ্য থেকে বেরিয়ে যখন একত্রিত হই তখন সব যেন সেই আগের মতোই গ্রামাঞ্চল। সেই সদ্য তরুণেরা নির্ভেজাল সত্য ঘটনা পত্রিকায় দেখছে তাদের মধ্যে ফিরে আসছে একাত্তরের রক্তাক্ত স্মৃতি। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান একটা গভীর মূল্যবোধ থেকে মাঝে মাঝে সভা, স্মৃতিচারণ নিয়ে আসর বসায়। গভীর নষ্টালজিয়ায় ভুগতে থাকি তখন কালো রাত্রিগুলোর কথা মুখে মুখে ফেরে। স্পেকট্রা কনভেনশন ক্লাবের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্নিগ্ধ, ফুল সাজানো টেবিল থেকে উঠে আসা মৃদু সুগন্ধ পার হয়ে ভেজা স্যাঁতসেঁতে কাদাটে মাটির গন্ধ আমাদের নাকে এসে লাগে। সহজে পিছু ছাড়ে না। একাত্তর থেকে প্রতিটি বছরই যেন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ফেরে। এভাবেই একাত্তর প্রতিদিন সহযাত্রী।

কিন্তু এরকম কথা তো ছিল না। সবাই মিলে চমৎকার একটা বাড়ি, এক টুকরো বাগান, ঘাসঢাকা আঙিনা আর সুখ-দুঃখের ওমে ঢাকা একটা জীবন তৈরি করবো বলেই তো এতো যুদ্ধ। স্বাধিকারের সে যুদ্ধের অবসানে আমাদের ছেলেমেয়েরা সহজ জীবন পাবে, বলিষ্ঠ শিরদাঁড়ার শক্তি পাবে, এটা কি খুব বেশি দাবি ছিল? কথা বলতে বলতে আচমকা স্তব্ধতা নেমে আসে সারা ঘরে। হুইল চেয়ারে করে হলে ঢুকেন আমাদের প্রিয় সুহৃদ তারেক ভাই। গভীর ভালোবাসায় আমাকে দুহাতে কাছে টেনে নেন তারেক ভাই। বলেন তোরা যেসব লেখা লিখে যাচ্ছিস, বড় ভালো লাগছে। সাঈদ বই ভালোবাসে। সে বলে অনেকের লেখা বই আমার কাছে আছে কিন্তু তোর লেখায় আমি আমার সেই সব নিষ্ঠুর দিনগুলো ফিরে পাই। সে সব জায়গায় গিয়ে দাঁড়াই। তোর মনে আছে? কাশিমপুরের আমবাগানে শফিকে কাঁধে নিয়ে তোর দৌড়?

কিন্তু ওকে তো বাঁচাতে পারিনি তারেক ভাই? সে দুঃখ আমি আজো ভুলিনি।

তার মানে আমরা সবাই যেন একেকটি একাত্তরের একেকটি দিনের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে হাঁটছিÑ ব্রাভো ব্রাদারস ব্রাভো। ব্রাভোর উইনারস ব্রাভো! মোটা ভারী গলায় কেউ পেছন থেকে গেয়ে ওঠে। সবাই তাতে সুর মেলায়। চমৎকার, ভারী এবং গম্ভীর গানের জোরালো কণ্ঠে শুধু আমাদের সুরটাই ওঠে পড়ে, ঠিক যেন কোথাও দূরের অন্ধকার ছিঁড়ে চলেছে দেশ মাতৃকায় সন্তানরা।

যুদ্ধদিনের গানে অনেকেরই চোখে নামে অশ্রুধারা, অনেকেই স্তব্ধ হয়ে থাকে। বর্তমানের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই।

সকাল বেলায় কাজের জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। রুহী এসে দাঁড়ায়। হাতে চায়ের পেয়ালা।

শুনছো? আজকে বিকালে একটা কর্নফ্লেক্স এনো। আম্মার জন্য।

তোমার কিছু লাগবে না?

না। লাগলে বলবো তো তোমাকেই! রুহী ব্যস্ত পায়ে কাজ করে বেড়ায়। আমার ভারী অবাক লাগে। আমার কাছে দাঁড়িয়েও- টের পাই- নিজের মনে অনেক কথাই বলে রুহী। ঘরের মধ্যে হাঁটে। মশারি টাঙায়, বইগুলো মাড়ে, চায়ের পেয়ালা পিরিচে শব্দ তুলে কাজ করে টুং টাং। এতোগুলো বছর আমরা এক সঙ্গে রয়েছি এর ব্যতিক্রম হয় না কখনো। পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে সমবায় সমিতি নিয়ে সে ব্যস্ত। কোনো উপলক্ষ পেলে, নববর্ষ বা ঈদ যাই হোক মেলায় তাদের স্টল থাকবে। ঝলমলে আনন্দে কেটে যাবে সময়। বাড়ি ফিরে আম্মা বলবেন, এ মেয়েটা একটুও বদলালো না। তেমনই চুপচাপ। খালি কাজের নেশা। আমাকে তো কোনো কাজই করতে দেয় না। শুধু যদি ঘরটা একটু ভরা ভর্তি থাকতো। একটা সোনার শিশু যদি থাকতো তাহলে আমার কলিজাটা ঠা-া হইতো। কী আর বলি, দুইটাই অপদার্থ।

মাঝে মাঝে আমাকেও যেন কিসে পায়। চায়ের পেয়ালা পড়ে থাকে পাশে। স্মৃতি আক্রান্ত আমি ফাইল খুলে বিভোর হয়ে দেখতে থাকি মনে মনে কথা বলি। প্রতিটি ঘটনার মধ্য দিয়ে ফিরে যাই চেনা পথে, তোদের সঙ্গে জটিল খানাখন্দের মধ্য দিয়ে। ফুর্তিতে শীষ দিয়ে উঠতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু না। নীরবতাই তখন একমাত্র পথ প্রদর্শক। চলতে চলতে ওদের হাত ধরে হোঁচট খাওয়া থেকে রক্ষা করি নিজেকে। মনে মনে বলি, তোদের সঙ্গেই আছিরে! কোথাও যেতে পারি না। যেতে চাই না। তাই তো লিখছি তোদের সবার কথা। তোদের হাসি খুশি, ক্রোধ, এমনকি বিদ্রোহ পর্যন্ত। এই দৌড়ে চলা বিশাল একবিংশ শতাব্দীতে চলতে চলতে হাঁফ ধরে যায়। কিন্তু এ ছাড়া উপায়ই বা কোথায় বল?

খুব সাবধানে আমার কাঁধে কেউ হাত রাখে। আমার ঘোর কেটে যায়। ফিরে দেখি, রুহী? সরি আমি তো খেয়াল করিনি। কখন এলে?

আম্মা বললেন, তুমি ধ্যানে বসেছ। তাই বাধ্য হয়ে আসতে হলো। বিরক্ত হয়েছ? রুহী স্নিগ্ধ হাসিমুখে বলে। মোড়া টেনে আমার কাছ থেকে দূরে বসে। তারপর জোরে হাততালি দিয়ে বলে এই তোমরা সব ভেতরে এসো। ভাইয়ার কাজ শেষ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এসে ঘর ভরে যায়। কল কল করে কথা বলে, হাসে। আবার নিজেরাই মুখে আঙুল দিয়ে বলে চুপ চুপ, ভাইয়া রাগ করবে। পেছনে পেছনে মায়েরা মৃদু আড়ষ্ট পায়ে ঘরে ঢোকেন। সালাম জানান। গত কয়েক বছরে রুহী যে সমবায় সমিতি গড়ে তুলেছে, তারই সাফল্য তারা পেয়েছে। সিটি করপোরেশন আরো পাঁচটি প্রতিষ্ঠানসুদ্ধ এদের সমিতিকে ‘বেস্ট কোর’ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ চারটি প্রতিষ্ঠানকে সংবর্ধনা দিয়েছে। পুরস্কৃত করেছে।

সামনে অপেক্ষা করছে আরো বাছাই করা কার্যক্রম। আমি হতচকিত। কিছুটা বিস্মিত তো বটেই। সজাগ হয়ে শিশুদের পিঠে হাত রাখি, কথা বলি।

আম্মা আপনি বাইরে কেন? ভেতরে আসেন না মা।

এতো উচ্ছ্বসিত গলায় রুহীকে কথা বলতে খুব কমই শুনেছি আমি। আরো অবাক কা-, আম্মাকে হাত ধরে ভেতরে এনে বেতের চেয়ারে বসিয়ে দেয় রুহী।

তুমি তো জেনে অবাক হবে, আম্মাও আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন। উনার কাজ কি জানো? গল্প বলার। মায়েদের গল্প, আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প। এই যে এটা উনার জন্য। সার্টিফিকেট অফ মেরিট। খুলে দেখান

আম্মা? আমি চৎকৃত। রুহীর ব্যাপারটা অবাক করে দেয় আমাকে। বিকেলটা সবকিছু বদলে দিলো। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই তাহলে আমারও তো একটা কিছু করতে হয়। আমি বলি সামনের ক্লাসে সবাইকে আমি আইসক্রিম খাওয়াবো। ওদেরই ছেলেমানুষী যেন আমাকেও মনে করিয়ে দেয় আমিও ওদের মতো শিশু ছিলাম। এক সময় বিদায় নেয়ার আগে ওদের নেত্রীদের একজন বললেন, আমাদের সমবায় সমিতি ছিল অনেকদিন ধরেই। কিন্তু সদস্য তেমন ছিল না। গত কয়েক বছর ধরে রুহী আপার অর্গানাইজিং ক্যাপাসিটিতে সদস্য বেড়েছে অনেক বেশি। নানা রকম কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। গত তিন বছরের কঠোর পরিশ্রম আর অনুশীলনের শেষে আমরা সফল হয়েছি। আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমরা আপনার সহযোগিতা চাই।

অবাক কা-! আমরা যখন জীবনের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করে জীবনের হিসাব মেলাতে মেলাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, তখন মনে হয় জীবনের সবুজ সময়ের রক্ত ঝরানো যুদ্ধদিন যেন অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। হাতে কোনো মূলধন নেই, কেবল শূন্যতা।

রুহী কিছু একটা করে নিজেকে ব্যস্ত রাখে, এটা জানতাম। কিন্তু সে যে কতো সফলভাবে কাজে ডুবে আছে, তা কখনো ভাবিনি। আর আম্মাই বা কম কীসে? আগে আগে দেখেছি পাড়ার মেয়েদের হাতের কাজ, সেলাই-টেলাই শেখাতেন। আসলে স্বল্পে তুষ্ট মানুষদের বোঝা যায় না। আব্বা মারা গেলেন পঁচানব্বই সালে। তখন একবার সেই দূরাতীতের ছায়ায় ঢাকা গ্রামটিতে আম্মা গিয়েছিলেন দিন কয়েকের জন্য। তার সঙ্গে রুহীও গিয়েছিল। আমার মা যেন বাংলাদেশেরই মা।

তারপর আর কারোই যাওয়ার সুযোগ ঘটেনি। জীবন নামের রেল গাড়িতে ধাবমান সময় আমাদের টেনে নিয়ে গিয়েছে। আমরা কখনো ফিরে তাকাইনি নিজেদের দিকে। ভালোলাগার ফাঁকে ফাঁকে কখনো জ্যোৎস্নার বৃষ্টি মেঘে তাকিয়ে দেখিনি কামনার মাদকতায়। রুহীর চোখে চোখে তাকানোর বুঝি সময়ই পাইনি কখনো। ডুবে আছি নিজের স্বপ্নচারী মনের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। আজ এতোগুলো শিশুর প্রাণচাঞ্চল্য দেখে বুকের কোথাও যেন একটা বেদনাবোধ আমাকে খোঁচাতে থাকে। মনে পড়ে আমাদের অনাড়ম্বর বিয়ের রাতের কথা। রুহীর আলতো মুখেও সেদিন ছিল অশ্রুচিহ্ন। এমনই হয়। জীবনের ক্ষয়ক্ষতি হিসাব মেলাতে মানুষ কেবলই ছুটতে শুরু করে। কোন গন্তব্যে পৌঁছাবে, তা তার মনে থাকে না। আসলে মানুষ কী চায় তা কি সে নিজেও বোঝে? অথবা ইচ্ছে করেই ভুলে থাকে? অথবা কেবলই অপেক্ষা করে থাকে। এই বিস্মরণের খেয়া বেয়ে মানুষ পথ খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত বেদনার্ত নিঃসঙ্গ এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে পৌঁছে যায়। পেছন থেকে কোনো অদৃশ্য শক্তি মৃদু হাস্যে মানুষের যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করে।

মানুষ শিশুর মতো আকাক্সক্ষার ঘুড়ি উড়িয়ে দেয়। স্বপ্ন আর বাস্তবতার আশায় আমরা নিজেদের বলি আমি আমার তারুণ্য, আমার যৌবনকে নিবেদন করেছি দেশের জন্য। স্বাধীনতার জন্য। তবু কেন স্বপ্নের পূর্ণতা আমাদের হাতে ধরা দেয় না? অদৃশ্য থেকে কোনো জীবনের খেলোয়াড় আমাদের দেখে হাসে, বলেÑ বোঝার চেষ্টা করো না। শুধু এগিয়ে যাও। কখনো হয়তো খুলবে সিসেমের দরজা, তখন আর দুঃখ থাকবে না। নীরব বিকেলের আধো অন্ধকারের মধ্যে কে যেন সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দেয়।

রুহী, তুমি যে ৃ

হ্যাঁ আমি। চলো তো। আমার হাত থেকে ফাইলটা সরিয়ে নেয় সে। বলে আমার সঙ্গে চলো, ঘরগুলোতে আলো জ্বেলে দেবে।

দরজার পর্দাটা উড়ে উড়ে ক্লান্ত বুঝি। তার আড়াল থেকে এক ঝলক সন্ধ্যার গেরুয়া লাল আলো এসে রুহীর মুখটা ছুঁয়ে যাচ্ছে। এক অপার্থিব সৌন্দর্যে ওকে লাগছে অপরূপা। এমন বিহ্বলতা দেখে রুহী হেসে ওঠে। বলে, চলো, এখনো আলো জ্বালানো বাকি আছে।