বিপন্ন লেখক

biponn lekhokokউপন্যাস ছাপানোর জন্য তুমি আমারে গয়না বেচতে বলতেছো সেইটা হবে না।’

প্রায় খেঁকিয়ে উঠলো সুলতানা।

তার বিপরীতে আরো বিনীত হয়ে গেল জাবেদ ইমাম।

‘দেখো, আমি তো বলছি, তোমার গয়নার দাম আমি পাই পাই শোধ কইরা দেবো। সুযোগ যখন একটা পাইছি এইটা হাতছাড়া করা ঠিক হইবে না বউ। তুমি আমার লক্ষ্মী বউ, সোনামানিক, আমার ময়না পাখি…।’

আরো কী কী বলতে যাচ্ছিল জাবেদ ইমাম, তাকে থামিয়ে দিলো সুলতানা।

‘হইছে রাখো, ওইসব ময়নাপাখি কইয়া আমারে ভুলাইতে পারবা না। বিয়ার পর কইছিলা আমারে একটা জড়োয়া নেকলেস বানায়া দিবা, তারপর কতো বছর চইলা গেলো, দিছো বানায়া ?’

‘এইবার দিবো, সত্যি সত্যি সত্যি, তিন সত্যি দিয়া কইলাম এইবার রোজার ঈদে তোমারে জড়োয়া নেকলেস বানায়া দিবো। তুমি শুধু আমারে উপন্যাসটা ছাপায়া বাইর করতে দাও। হুমায়ূন আহমেদ গুরুজি একটা উপন্যাস লেইখা ত্রিশ-চল্লিশ লক্ষ টাকা কামাইছেন, আমি তো পাঁচ লাখ টাকা পাবোই। সেইটা দিয়া তোমারে নেকলেস, আংটি, কানের দুল সব কিন্না দিবো।’

জাবেদ ইমাম এ পর্যন্ত তিনটি উপন্যাস রচনা করেছে, কিন্তু কোনোটিই বই আকারে প্রকাশিত হয়নি। প্রথম উপন্যাসের নাম দিয়েছিল ‘যাদের চাহিয়া তোমারে ভুলেছি’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান থেকে নেয়া নাম। আজকাল প্রায় অনেকেই রবি বাবুর গান এবং কবিতা থেকে বাক্য নিয়ে গল্প-উপন্যাসের নাম রাখছে, সেসব বই চলছেও ভালো। তাছাড়া, রবীন্দ্রনাথ তো এমন একজন মহাপুরুষ যাঁর প্রতিটা লেখা থেকেই গ্রন্থের নামকরণ সম্ভব। হুমায়ূন আহমেদ গুরুজি তার অনেক উপন্যাসের নামকরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের লেখার চরণ দিয়ে।

জাবেদ ইমাম হুমায়ূন আহমেদকে গুরুজি বলে সম্বোধন করে।

প্রথম উপন্যাসটা নিয়ে বাংলাবাজারের বেশ ক’জন প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করেছিল সে। কিন্তু এটা লেখকের প্রথম উপন্যাস বলে কেউ প্রকাশ করতে আগ্রহী হয়নি। এক প্রকাশক বলেছিল,

‘ভাই, আপনি নতুন লেখক, টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করা আমাদের জন্য রিস্ক হয়া যায়। আপনি পত্র-পত্রিকায় লেখেন, সবাই আপনারে চিনুক, তখন আমাদের রিস্কটা কমে যাবে।’

জাবেদ ইমাম তাকে বলেছিল,

‘কিন্তু উপন্যাস তো কোনো দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্কাদক ছাপাতে চায় না। কোথায় ছাপি বলেন? আমরা নতুন লেখকরা বড়োই অসুবিধায় আছি।’

এর মধ্যে নতুন কাহিনি মাথায় এসে যাওয়ায় জাবেদ ইমাম দ্বিতীয় উপন্যাসটা রচনা করে ফেলে। এর নাম দেয়—‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম’। এটাও রবীন্দ্রনাথের গানের চরণ। প্রেমের উপন্যাস। দুই কিশোর-কিশোরীর প্রেম। স্কুলে পড়ে। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে দেখা হতে হতে ছেলেটার বুকে মেয়েটার জন্য ঝড় ওঠে। সেই ঝড় সামাল দেয় কে ? মেয়ের বাবার কানে যায় যে ছেলেটা তার মেয়ের দিকে চিঠি ছুড়ে মারে। রীতিমতো ইভটিজিং। তারপর থানা-পুলিশ নিয়ে জমজমাট এক কাহিনি।

এই উপন্যাসটা নিয়ে বাংলাবাজারে কয়েক মাস ঘোরে জাবেদ ইমাম। কিন্তু প্রকাশ করতে কেউ এগিয়ে আসে না। নতুন লেখক বলে সব প্রকাশকেরই অনীহা। এই ঘোরাঘুরির সূত্রে বেশ ক’জন নবীন লেখকের সঙ্গে পরিচয় হয় জাবেদ ইমামের। তারা প্রকাশকের ধার ধারে না। তারা পকেট থেকে টাকা খরচ করে বই বের করে, তারপর নিজেরাই বুকস্টলগুলোতে বই সরবরাহ করে। কেউ কেউ প্রকাশককে পরিবেশক বানায়, ওটাও নাম কা ওয়াস্তে। পরিবেশকরা আসলে কোথাও পয়সা খরচ করে বই পাঠায় না। ওটাও করতে হয় লেখককে।

জাবেদ ইমাম একদিন এক দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্কাদককে ফোন করে ফেলে, তার আশা যদি উপন্যাসটা ছাপার একটা ব্যবস্থা হয়।

‘স্যার, আমি একটা উপন্যাস লিখেছি, যদি আপনার সাহিত্য পাতায় ছাপার ব্যবস্থা করেন। আপনি বললে আমি পাণ্ডুলিপি নিয়ে যাবো আপনার কাছে।’

‘উপন্যাস লেইখা ফেলছেন? কী নাম দিছেন?’

‘স্যার, এ উপন্যাসটার নাম দিয়েছি—চোখের আলোয় দেখেছিলেম ।’

‘আরো লেখছেন নাকি?’

‘জি স্যার, আমার প্রথম উপন্যাসের নাম—যাদের চাহিয়া তোমারে ভুলেছি।’

‘বই বাইর হইছে?’

‘না স্যার।’

‘ভাইরে, কী সব ভাবেন আপনারা? আমার সাহিত্যপাতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ছাপতে পারি নাই ধারাবাহিকভাবে, আপনারটা ছাপি ক্যামনে? দৈনিক পত্রিকা কি উপন্যাস ছাপার জায়গা?’

‘সরি স্যার, দুঃখিত স্যার।’ জিহবায় কামড় দিয়ে ফোনটা রেখে দিয়েছিল সে। দৈনিক পত্রিকা নিয়ে তার আক্কেল হয়েছে।

একটা প্রাইভেট অফিসে জব করে জাবেদ ইমাম। বাইরে ঘোরাঘুরির কাজ। অফিসের কাজের কথা বলে বাইরে গিয়ে নিজের কাজও করে আসা যায়। অফিসের সবাই জানে সে লেখালেখি করে।

তৃতীয় উপন্যাসটা লিখতে লিখতে জাবেদ ইমাম পরিকল্পনা করে এই উপন্যাসটা সে কোনো প্রকাশকের সাথে যৌথভাবে প্রকাশ করবে। এরকম প্রস্তাব সে দু-এক জায়গায় আগে পেয়েছিল। সাহস করেনি। বেতন যা পায় তা দিয়ে টেনেটুনে মাসটা চলে যায়, বই ছাপাবার টাকা জুটবে কোথায়? তখনই সে ভেবেছিল সুলতানার হাতের চুড়ি দুটো বিক্রি করলে পনেরো হাজার টাকা পাওয়া যেতে পারে। ফিফটি-ফিফটি খরচ হিসাব করলে পনেরো হাজারে তার হয়ে যাবে।

কিন্তু সুলতানার মন গলে না।

উপন্যাস তার লেখা শেষ। তৃতীয় উপন্যাসের নাম সে দিয়েছে ‘সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে’।

বিয়োগাত্মক উপন্যাস, শেষ পরিচ্ছেদে নায়িকা মারা যায়।

ফিফটি-ফিফটি শর্তে প্রকাশক রাজি হলো।

‘ভাই প্রচ্ছদ ডিজাইন এবং প্রিন্ট করে দেবেন আপনি, আমি আমার মতো ছাপাবো এবং বাঁধাই করবো।’

‘আমার কতো খরচ হতে পারে ?’ জাবেদ ইমাম জানতে চেয়েছিল প্রকাশকের কাছে।

‘দশ-বারো হাজারে হয়ে যাবে।’

পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে প্রচ্ছদের জন্য শিল্পীর বাসায় দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল তার। সুলতানার মন একটু গলেছে, চুড়িজোড়া বাগিয়ে নেয়া অসম্ভব হবে না।

প্রচ্ছদশিল্পী চেয়ে বসলেন তিন হাজার টাকা। অগ্রিম দিয়ে তবে কথা বলতে হবে। প্রচ্ছদ ডেলিভারির বিষয়টা তখনই ঠিক হবে।

‘বুঝলা সুলতানা, প্রকাশক উপন্যাসটা পছন্দ করছে। বললেন, বই বাইর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক হাজার কপি নাকি বিক্রি হয়া যাবে। পাবলিক লাইব্রেরি আর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে ধরাইতে পারলে বুঝবা হয়া গেছে, পাঁচ লাখ টাকা চলে আসা কুনু ব্যাপারই না।’

আলমারি থেকে চুড়িজোড়া বের করে দিলো সুলতানা। নারীজাতি বড়ই অবলা, স্বামীর সঙ্গে খুটখাট করতে পারে, কিন্তু সংসার ভাঙার কাজ করতে পারে না।

‘এই নাও, দিলাম। আমারে তুমি কী দিবা না দিবা আমি ভাবি না। এই চুড়িজোড়া বিয়ার সময় তুমিই দিছিলা, তুমি ফিরায়া নিলা।’

অস্থির হয়ে জাবেদ ইমাম বলে,

‘সুলতানা, ময়নাপাখি, সত্যি কইরা বলতেছি, এইটা বিক্রি কইরা যে টাকা পাওয়া যাবে, সেইটা তোমারে আমি পাই পাই বুঝায়া দিবো।’

বউকে খুশি করতে চায় সে—

‘একটু হাসো, একটু হাসো প্লিজ।’

চাঁদনীচকে চুড়িজোড়া পাঁচ দোকান ঘুরে বারো হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারল জাবেদ ইমাম। চাঁদনীচক থেকে ছুটলো ধানমণ্ডি, প্রচ্ছদশিল্পীকে টাকা দিয়ে নিশ্চিত করল প্রচ্ছদ।

‘সাত দিন পর আসেন।’

দেশের বিখ্যাত শিল্পী সাত দিন পর আসতে বলেছেন, সাত দিনই সই। আরামবাগে এক প্রেসে কথা বলল, কাগজের দোকান ঘুরল বাবুবাজারে। প্রচ্ছদে ভালো কাগজ দিতে হবে, টাকা যখন হাতে পাওয়া গেছে দরদাম কোনো ব্যাপার না।

রাতে বিছানায় শুয়ে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলল জাবেদ ইমাম।

‘বুঝলা সুলতানা, আমার তো ঘুম আসতে চায় না।’

‘কোনো সমস্যা হইছে অফিসে?’

‘আরে না, সমস্যা না।’

‘সমস্যা না থাকলে ঘুম আসে না ক্যান? আমিও তো দেখি সারা রাইত বিছানায় উথাল-পাথাল করো। ডাক্তার দেখাও। ডায়াবেটিস হয় নাই তো?’

উথাল-পাথাল কীভাবে করে বুঝল না জাবেদ ইমাম।

তবে ডায়াবেটিস বুঝল। বাইরের দোকানের চিনি আর কন্ডেন্সড্ মিল্কের চা খেলে ডায়াবেটিস না হয়ে পারে না। হতেও পারে। নারীজাতি সবকিছু আগে বোঝে।

‘আমি উথাল-পাথাল করতেছি আমার উপন্যাসটা নিয়া। বাইর হইলেই ফাটাফাটি। দেখবা পত্র-পত্রিকায় আলোচনা-সাক্ষাত্কার ভাইসা যাইতে থাকবে।’

‘কী যেন নাম দিছো উপন্যাসের?’

‘সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে। নামটা সুন্দর হইছে না?’

‘এইটা তো রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন। লাগায়া দিছো?’

‘লাগায়া দিছো’ বলতে সুলতানা কী বোঝাল সেটাও বুঝল না জাবেদ ইমাম।

‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই তো ভরসা আমাগো। বুঝলা সুলতানা, সবাই আইজকাইল রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা দিয়া উপন্যাসের নাম দ্যায়, কষ্ট কম হয়, আবার পাঠকেও কিনে মুড়ি মুড়কির মতো।’

সাত দিনের জায়গায় দশ দিনের মাথায় শিল্পী প্রচ্ছদ দিলেন। জাবেদ ইমাম প্রেস-কাগজের ব্যবস্থা করল সারাদিন। কম্কিউটারে ওঠালো, মাপজোখ হলো, পুটের মাপ, লেখক পরিচিতি, ফ্ল্যাপের লেখা, ছবি সবকিছু হয়ে প্লেট হয়ে গেল। রাতে ছাপা হবে।

প্রকাশককে ফোন করল,

‘ভাই, আজ রাতে কভার ছাপা হয়ে যাবে।’

‘কতো কপি ছাপাচ্ছেন?’

‘কেন, আপনিই তো বলেছেন পাঁচ হাজার। আমি পাঁচ হাজার একশ’ ছাপাচ্ছি। মেশিনম্যান বলল একশ’টা নষ্ট হতে পারে।’

বইয়ের জন্য নতুন করে একটা ছবি তুলেছে জাবেদ ইমাম। হুমায়ূন আহমেদের মতো, মাথায় ক্যাপ দিয়ে। তার তো নুহাশ পল্লী নেই, রমনা পার্ককে বানাতে হয়েছে ব্যাকগ্রাউন্ড। এর জন্য পাঁচশ টাকা বেশি নিয়েছে ক্যামেরাম্যান। দিতে কসুর করেনি জাবেদ ইমাম। হুমায়ূন আহমেদ তার গুরুজি, তাকে অনুসরণ করাই তার চলার পথের পাথেয়।

প্রথম ইমপ্রেশনটা দেখে বাসায় চলে এসেছিল সে। চার রঙের ছাপা, চারটা ইমপ্রেশন পড়বে। মেশিনম্যান বলেছে রাত দশটার মধ্যে ছাপা শেষ হয়ে যাবে। কাল সকালে সে ডেলিভারি নিতে পারবে। পেমেন্ট প্রেসমালিক অগ্রিম নিয়ে নিয়েছে। প্রচ্ছদে খরচ পড়লো প্রায় তের হাজার টাকা।

রাতে বাসায় ফিরে সে সুলতানাকে জানাল, তার বইটা সে প্রিয়তমা স্ত্রীকে উত্সর্গ করেছে।

এতে সুলতানার কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। তার সোনার চুড়ি দুটো চলে গেছে এটাই তার বড় কষ্ট।

‘কী লিখছি জানতে চাইলা না?’

‘ওইসব জাইনা কী হবে? পাম দিয়া কতো কিছু লেখছো।’

আসলেই জাবেদ ইমাম স্ত্রীকে খুব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উত্সর্গপত্র তৈরি করেছে। সুলতানা সেটা জানল কীভাবে? নারীরা কি ভবিষ্যত্দ্রষ্টা? নাকি তৃতীয় নয়নে সবকিছু দেখতে পায়? হতেও পারে। চতুর্থ উপন্যাসটার কাহিনি তার মাথায় কিলবিল করছে। পারিবারিক কাহিনি হবে সেটা। মনে করেছিল ওটার নাম আর রবীন্দ্রনাথ থেকে না নিয়ে নিজেই রাখবে—সুলতানা। কিন্তু ওটাও রাখা যাবে না, বেগম রোকেয়া ‘সুলতানা’ নামে একটা বই লিখে ফেলেছেন। স্ত্রীকে সেটা সে জানায়।

‘আমারে নিয়া তুমি আর কী লেখবা? ঝগড়াঝাটির কথা ছাড়া তো তোমার-আমার কিছুই নাই। এখন ঘরের কথা প্রচার কইরা সর্বনাশ করার দরকার নাই।’

সুলতানার কথায় একরকম কোণঠাসা হয়ে যায় জাবেদ ইমাম। জবাব দেয়ার মতো কোনো কথা তার মুখে আসে না। সে মুখে ঠুলি লাগিয়ে টিভি দেখে। চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কোথাও সাহিত্য অনুষ্ঠান হচ্ছে নাকি সে খুঁজে বেড়ায়।

এমন সময় ফোন করে মেশিনম্যান জানায় যে প্রচ্ছদ ছাপা শেষ।

কিন্তু গোল বাঁধিয়ে বসলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সঙ্গে স্বর্গে বসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আলাপ করছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশসহ আরো অনেক কবি-সাহিত্যিক। হুমায়ূন আহমেদ বসেছিলেন সবার পেছনে।

বুদ্ধদেব বসুর কাজই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে যেকোনো বিষয়ে খুঁচিয়ে দেয়া। জীবদ্দশায় করেছেন কমবেশি, স্বর্গের আড্ডায় সেটি করে আরো মজা পান। তো কথা তুললেন তিনি এভাবে—

‘কবিগুরু, বিশ বছর পর তো আপনার কোনো গান-কবিতার চরণ আর আপনার রইবে না। সবই তো নিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকরা।’

রবীন্দ্রনাথ মনে করলেন এটাও বুঝি বুদ্ধদেবের খোঁচা। তবুও বললেন,

‘কেন হে বত্স? সমস্যা কী হয়েছে?’

‘আপনার সব উজ্জ্বল পঙিক্তমালা বাংলাদেশে বইয়ের নাম হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পর সবাই ভাববে এটা বুঝি ওই লেখকেরই দেয়া নাম।’

হুমায়ূন আহমেদ পেছনে আরো গুটিসুটি মেরে বসলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক গান-কবিতার বাণী তার উপন্যাস-চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছেন। বুদ্ধদেব বসু এখন তার নামটাই উচ্চারণ করে বসেন কিনা এই আশঙ্কায় থাকলেন। ‘আগুনের পরশমণি’, ‘আমার আছে জল’—এসব তো কবিগুরুর পঙিক্ত।

কিন্তু বুদ্ধদেব বসু তা করলেন না। তিনি শুধু বললেন, ‘কী যে আপনি লিখেছেন গুরুদেব, ওই পঙিক্তগুলো এখনো সবাই ভেঙে ভেঙে খাচ্ছে। যদিও আমার জন্ম কুমিল্লায়, জীবনের বেশ একটা সময় আমার বাংলাদেশে কেটেছে, বাংলাদেশের জন্য আমার ভালোবাসাও আছে প্রচুর, কিন্তু খেয়াল করলে দেখছি কলকাতার লেখকদের কিন্তু আপনার কাব্য-পঙিক্ততে আসক্তি নেই, যা আছে সব বাংলাদেশে। ব্যবস্থা একটা নিন।’ জীবনানন্দ দাশ বুদ্ধদেব বসুকে নিবৃত্ত করলেন। এ প্রসঙ্গে আর না যাওয়াই ভালো।

সভা ভাঙলে বিষয়টা নিয়ে ভাবলেন রবীন্দ্রনাথ। ক্ষুব্ধ হলেন বিশ্বভারতীর প্রতি। বিনা ট্যাক্সে এবং বিনা অনুমতিতে তাঁর কাব্য-পঙিক্ত সীমান্ত পার হয়ে চলে যাচ্ছে, এটা হতে পারে না। ভারতের আমদানি-রপ্তানি নীতিতে নিশ্চয়ই বিষয়টাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, সে জন্যে খোদ বাণিজ্যমন্ত্রীর প্রতি উষ্মা প্রকাশ করলেন তিনি। রাগ প্রশমনের জন্যই হোক অথবা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যই হোক কাগজ টেনে খস্খস্ করে লিখে ফেললেন একটি পত্র।

তারপর স্বর্গের একজন পরীকে ডেকে চিঠিটা ফ্যাক্স করে দিতে বললেন বিশ্বভারতীর উপাচার্যকে। একটু যেন শীতল হলেন। ক্ষোভ পুষে রাখার চেয়ে প্রকাশ করা উত্তম। স্বর্গের বাতাস তাঁকে শান্ত করে দিলো।

পরী চিঠিটা নিয়ে যাবার সময় আড়াল থেকে খেয়াল করছিলেন মোহিতলাল মজুমদার। তিনি এবার সামনে এসে পরীর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়লেন। মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল তাঁর মুখে। তিনি পকেট থেকে কলম বের করে গুরুদেবের স্বাক্ষরের নিচে বিশেষ দ্রষ্টব্য লিখে আরো কিছু কথা লিখে দিলেন।

আহা-আহা করে উঠল স্বর্গের পরী। মোহিতলাল তাকে বোঝালেন যে এই সামান্য লেখায় কিছু ক্ষতি হবে না। বরঞ্চ গুরুদেবের উপকারই হবে।

বিশ্বভারতীর উপাচার্য তখন ব্যস্তসমস্ত হয়ে নথিপত্র দেখছিলেন। ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠলো ফ্যাক্সটা। সারাদিনই ওটা বাজে, চিঠিপত্র আসে। তেমন কিছু না। ফ্যাক্সটা তার বাঁ হাতের পাশেই রাখা। শব্দে তিনি একটু চোখ তুলে ফ্যাক্সের দিকে তাকিয়ে আবার নথিতে মগ্ন হতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু থমকে গেলেন। ফ্যাক্সে চিঠি আসছে স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের! হাতের সব কাজ ফেলে তিনি তাকিয়ে থাকলেন চিঠির দিকে। ফ্যাক্স থেমে গেলে তিনি টেনে নিলেন চিঠিটা, বারকয়েক পড়লেন, তারপরই কলিং বেল বাজিয়ে সরগরম করে তুললেন উপাচার্যের অফিস। ছুটে এলেন অধ্যাপকবৃন্দ, রেজিস্ট্রার এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। ফটোকপি করা হলো চিঠিটার।

অধ্যাপক রজনীকান্ত বললেন,

‘স্যার, বাংলাদেশে এটা হচ্ছে অথচ আমরা কোনো খবরই রাখি না। এটা আমাদের একটা বড়ো অন্যায় হয়ে গেছে।’

সিন্ডিকেটের জরুরি সভা ডাকলেন উপাচার্য।

সব সদস্যদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে চিঠির কপি।

উপাচার্য চিঠিটা পড়ে শোনালেন—

‘প্রিয় উপাচার্য,

নমস্কার রইলো।

আমি অত্যন্ত ব্যথিত মনে এই চিঠি লিখিতেছি। বুদ্ধদেব বসুর কাছে জানিতে পারিলাম বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিকরা আমার কবিতা ও গানের পঙিক্ত দিয়া কোনোরূপ অনুমতি না লইয়া তাহাদের গ্রন্থের নামকরণ করিতেছে। ইহাতে আমার আনন্দিত হইবার কোনো কারণ দেখিতেছি না। একসময় পাঠকের মনে হইবে এইগুলি আমার লেখা নহে, তাহাদেরই সৃষ্টি। বাংলাদেশের মানুষকে আমি বড়োই ভালোবাসি, আমার জীবনের অনেকটা সময় আমি শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসরে কাটাইয়াছি। তাহারা আমার গানকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দিয়াছে, এইবার আমার জন্মজয়ন্তীতে তাহারা শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন করিয়াছে। সবই ভালো, কিন্তু নবীন সাহিত্যিকরা এখন যাহা করিতেছে তাহা সমর্থনযোগ্য হইলেও নৈতিকতার কারণে তাহা আমি মানিয়া নিতে পারিতেছি না। ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করিবেন, শিক্ষামন্ত্রীকে জানাইবেন এবং আপনি আপনার পারিষদ লইয়া আর যেন কেহ এইরূপ না করিতে পারে তাহার যথাশীঘ্র ব্যবস্থা লইবেন।

ইতি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বি: দ্র: বাংলাদেশের জাবেদ ইমাম নামে একজন নবীন কথাশিল্পী ঢাকার আরামবাগের একটি ছাপাখানায় ‘সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে’ নামকরণ করিয়া একটি উপন্যাসের প্রচ্ছদ ছাপাইতেছে। ইহা যাহাতে বই হইয়া বাহির হইতে না পারে সেজন্য বাংলাদেশ সরকারকে বিশেষ অনুরোধ করিবেন।

সিন্ডিকেটের অনেক সদস্যই কবিগুরুর সাহিত্যকর্মের অননুমোদিত ব্যবহার সম্কর্কে অবহিত ছিলেন না। অথচ স্বর্গে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই তথ্য পেয়ে যান। কেউ কেউ বললেন, বুদ্ধদেব বসুর একটা আলাদা ভালোবাসা আছে পূর্ববঙ্গে জন্মেছিল বলে, ফলে সে দেশের সাহিত্যচর্চা তাঁর খোঁজখবরের মধ্যে থাকে।

উপাচার্য মহাশয় ভর্ত্সনা করলেন সকলকে। সিদ্ধান্ত হলো খুব দ্রুত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিদেশ মন্ত্রণালয়কে চিঠি লেখার। বিদেশ মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠাতে হবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের নজরে বিষয়টি আনার জন্য। বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে যে বিষয়টির উল্লেখ করা হয়েছে তার হস্তাক্ষর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো নয়। তবুও এটিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিল বিশ্বভারতী সিন্ডিকেট। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠির অনুলিপি ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনারকে দেওয়ার সিদ্ধান্তও হলো।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরদিনই চিঠি পাঠিয়ে দিলো ভারতের বিদেশ মন্ত্রক।

পররাষ্ট্র সচিব চিঠি পেয়েই ছুটলেন মন্ত্রীর কাছে।

‘স্যার, বিষয়টাতো সিরিয়াস। আমরা তো এটা খেয়ালই করিনি।’

মন্ত্রী বললেন,

‘বইয়ের নাম খুঁজে বেড়ানো তো আমার মন্ত্রণালয়ের কাজ নয় সচিব সাহেব। ওটার দায়িত্ব সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। আপনি চিঠিটা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে এনডোর্স করে ব্যবস্থা নিতে বলুন। দেখি আমিও মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবো।’

যে সব সাংবাদিক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিট করে তারা খবরটা জেনে যাওয়ায় সচিব সাহেবের বক্তব্য জানতে চায় তারা। সম্মেলন কক্ষে দশ মিনিটের জন্য আসতে হয় তাকে। একজন সাংবাদিক জানতে চায়,

‘মাননীয় সচিব, আপনারা কি লেখকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করবেন?’

আরেকজন সাংবাদিক এক কাঠি সরেস, সে জিজ্ঞাসা করে,

‘আইনগত মামলা মানে কি ফৌজদারি মামলা? এটা কি জামিন অযোগ্য মামলা হবে মাননীয় সচিব?’

সচিব সাহেব সবাইকে শান্ত করেন। তিনি বলেন,

‘আমরা কোনো সুপারিশ করবো না। ব্যবস্থা যা নেয়ার তা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ই নেবে।’

রাতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে পররাষ্ট্র সচিবের ইন্টারভিউ প্রচারিত হলে মাথা ঘুরে যায় জাবেদ ইমামের। তার বইয়ের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান থেকে নেয়া, এখন তাহলে কি সে ফেঁসে যাবে?

মধ্যরাতে প্রকাশকের ফোন আসে।

‘ভাই, খবর শুনেছেন?’

আতঙ্কে ফোনের জবাব দেয় জাবেদ ইমাম।

‘জি ভাই, শুনেছি।’

‘আমি তো ভাই বই ছাপতে সাহস পাচ্ছি না। আশি পৃষ্ঠার উপন্যাস কম্পোজ শেষ করে, পেজ মেক-আপ দিয়ে প্রুফ দেখাও শেষ করে রেখেছি। এখন তো মনে হচ্ছে এই বই প্রকাশ করা যাবে না।’

‘ভাই, পরে কথা বলি। আমার মাথা ঘুরছে।’

রাতের মধ্যেই বাংলাবাজারের প্রকাশকদের গোডাউনে যেখানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে বই প্রকাশ করে রাখা হয়েছিল, সব উধাও হয়ে গেল, কিছু চলে গেল আন্ডারগ্রাউন্ডে। কোনো কোনো লেখক ফোন করে কিছু কপি সংগ্রহ করে চুপিচুপি নিয়ে গেল। এক ভীতু প্রকাশক তার প্রকাশিত ‘নির্মল করো মঙ্গল করো’ নামের কাব্যগ্রন্থের সব প্রচ্ছদ ছিঁড়ে ছিঁড়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থা নিল। ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করা প্রভু’ নামে একটি উপন্যাস ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নামী অধ্যাপকের, অনেক চাপাচাপিতে প্রকাশক রাজি হয়ে গত বইমেলায় তিনশ’ কপি ছেপেছিল, তার আড়াইশ’ কপিই গোডাউনে জমে আছে। অধ্যাপক ফোন করে বললেন,

‘ভাই, আপনি ভয় পাবেন না। আমি দু-চারজন ল’ইয়ারের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা আইনি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। প্রয়োজনে আমি মহামান্য হাইকোর্টে রীট করব।’

‘আমি তো ভেবেছিলাম পুড়িয়ে ফেলে…।’

আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল প্রকাশক, অধ্যাপক তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

‘পোড়াবেন কেন? বই কি পোড়ানোর জিনিস? আমার এই উপন্যাস ছেলেমেয়েরা পাগলের মতো পড়বে, তাদের জ্ঞান বাড়বে, আমাদের দেশে ফিকশনের যে ধারা সেই ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছি আমি। আমি একটা নতুন ধারার সৃষ্টি করতে চাই।’

‘কিন্তু স্যার, বইমেলায় তো মাত্র দশ কপি বিক্রি হলো।’

‘হোপলেস হবে না। এবার তো প্রচার-প্রচারণা কম হয়েছে, আপনি বিজ্ঞাপনও করেননি।’

‘স্যার, বিজ্ঞাপন তো আজকাল লেখকরাই করে।’

‘ভাই, এটাই তো সমস্যা করেছেন আপনারা।’

আরো কিছু কথা হয়তো হতে পারত তাদের মধ্যে। কিন্তু অন্য একটা ফোন আসায় তা কেটে দিলেন অধ্যাপক।

মেশিনম্যান ফোন করল আরামবাগ থেকে জাবেদ ইমামকে। তখন তার মাথা ঘুরছে।

‘স্যার, প্রচ্ছদ কী করবো কিছু ভাবছেন? কী একটা খবর শুনলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি মামলা কইরা দিছেন আপনার বিরুদ্ধে ?’

‘আরে ভাই আমার বিরুদ্ধে না, করেছেন সবার বিরুদ্ধে।’

‘না মানে, আপনার নাম উল্লেখ কইরা কী জানি কী করেছেন শুনলাম।’

মেশিনম্যানও আতঙ্কে। বুড়ো মানুষ, সংসারে আর কেউ নেই। এই বয়সে জেলে যেতে হলে তার পরিবার না খেয়ে মারা যাবে।

‘আপনার মালিক কী বলে?’

‘মালিক তো কয় সব বাইন্ধা ড্রেনে ফালায়া দ্যাও। ফকিরাপুলের বড় ড্রেনটার কথা বললো।’

‘না না, ফেলবেন না। আমার পনেরো হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। আপাতত প্রেসের চিপাচুপায় রাখেন, কালকে দেখা যাবে।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাবার পর সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসল। মন্ত্রী মহোদয় সচিব সাহেবের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সাহেবের সাথেও কথা হলো। আমদানি নীতি আদেশে তারা এই বিষয়টাকে রাখেননি। কিন্তু সচিব সাহেব জানাতে ভুললেন না যে ভারতের বাণিজ্য সচিবের সাথে তার কথা হয়েছে, তারা নাকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নোট পাঠাচ্ছে আমদানি নীতি আদেশে বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য।

সংস্কৃতি সচিব বললেন,

‘রবীন্দ্রনাথের সকল বইয়ের কপিরাইট বিশ্বভারতী এবং বহু গান কবির একমাত্র ছেলের নামে স্বত্ব দেয়া আছে। কিন্তু কোনো একটি বাক্য বা পঙিক্তর ক্ষেত্রে কি কপিরাইট প্রযোজ্য হবে? তাছাড়া, কবির মৃত্যুর ষাট বছর পার হয়ে গেছে, এখন তো আর কপিরাইট আইন প্রযোজ্য নয়।’

বাণিজ্য সচিব বললেন,

‘অতো কথা বলে লাভ নেই ভাইরে। সরকার যা বলে সেভাবে করেন। আপনারা আইনি অ্যাকশনে চলে যান। দিস ইজ বেটার অ্যান্ড সেফ টু আস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি, অবজ্ঞা করা যাবে?’

বাণিজ্য সচিব মাঝে মাঝে দু-চার লাইন কবিতা লেখেন। কবির সৃষ্টির মমতা তিনি বোঝেন।

সংস্কৃতি সচিব বিষয়গুলো আবার জানালেন মন্ত্রীকে। মন্ত্রী ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলাপ করেছেন। কিছু নির্দেশনাও পেয়েছেন তিনি। লাঞ্চ আওয়ারে ভারতীয় হাইকমিশনার এসে তার সঙ্গে কথা বলে গেছেন। বিষয়টা এখন গুরুত্বপূর্ণ এবং স্কর্শকাতর সন্দেহ নেই। দেশের লেখকদেরও আবার ক্ষ্যাপানো যাবে না।

সন্ধ্যার পরপরই র্যাব-পুলিশের বিশাল বহর আরামবাগ এবং বাংলাবাজার ঘেরাও করে ফেলল। প্রেসে-প্রেসে শুরু করল তল্লাশি, জাবেদ ইমামের বইয়ের প্রচ্ছদ ছাপা হচ্ছে আরামবাগে, সেগুলো জব্দ করতে হবে। বাংলাবাজারে অস্থিরতা বাড়ল বেশি, বিশাল এলাকা, র্যাব-পুলিশের দল হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে তল্লাশি করতে। মধ্যরাত নাগাদ অনেক বই আটক করল তারা। কিন্তু আরামবাগে কোনো অগ্রগতি নেই। জাবেদ ইমামের বইয়ের প্রচ্ছদ খুঁজে পাচ্ছে না তারা। মালিক প্রেস বন্ধ করে বাসায় চলে গেছে র্যাবের ঘেরাওয়ের খবর পাবার পরপরই। বুড়ো মেশিনম্যান পরিবার নিয়ে চলে গেছে গাজীপুরের কালীগঞ্জ।

সকালে অফিসে হাজিরা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল জাবেদ ইমাম। ইচ্ছে ছিল আরামবাগে প্রেসে যাবে। কিন্তু যখন জানতে পারল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বইটির তথ্য জেনে গেছেন এবং ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন তখন আর প্রেসে যাবার সাহস পেলো না। র্যাবের ইনফরমাররা এসব জায়গায় চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি করে, সরকারবিরোধী কোনো কিছু ছাপা হচ্ছে কি না তা তারা সংগ্রহ করে র্যাবকে জানায়। পুলিশের ইনফরমারদের থেকে র্যাবের ইনফরমাররা অনেক বেশি চালাক এবং দ্রুত। তাকে দেখলে আটক করে ফেলতেও পারে। বাংলাবাজারে যেতে চেয়েছিল, সেদিকেও গেল না।

প্রকাশক পরামর্শ দিল,

‘ভাই, কয়েকদিন একটু পালায়া থাকেন। পত্রিকায় যা পড়লাম তাতে আপনি অন্যতম টার্গেট।’

‘অফিস থেকে কি ছুটি নিয়ে নেবো?’

‘সেটা আপনার ব্যাপার। আপনার এমডি’র সাথে কথা বলেন, ছুটি লাগলে ছুটি নেন, না নিতে চাইলে অ্যাব্সকন্ডিং হয়া যান, যা খুশি করেন।’

প্রকাশকের পরামর্শটা ভালো লাগল তার। কিন্তু অফিস থেকে ছুটি নিলে অফিস বিপদগ্রস্ত হতে পারে। ছুটি দিলেন কেন, এই বলেও পুলিশ ধমকাতে পারে এমডি’কে। তার চেয়ে লাপাত্তা হয়ে যাওয়া ভালো। অফিসের কোনো দায়দায়িত্ব থাকে না।

রাতে সুলতানাকে নিয়ে নাইটকোচে উঠল জাবেদ ইমাম। বাসা তালাবদ্ধ করে এসেছে। মোবাইল ফোনটাও অফ করে দিয়েছে বাসে ওঠার পর। তার আগেই সে সংবাদ পেয়েছে আরামবাগ আর বাংলাবাজারে র্যাব-পুলিশের তল্লাশি শুরু হয়েছে। এখন সে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছে। কিছুদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা দরকার।

সুলতানা ফিসফিস করে বলে,

‘তুমি কি মনে করো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এইসব করতেছেন?’

‘এতো কিছু হয়া যাচ্ছে তুমি দেখতেছো না?’

‘আমি রবীন্দ্রনাথরে যতোটুকু পড়ছি, তার গান শুনছি, তিনি তোমার বই নিয়া এতো কঠোর হইবার কথা না।’

একটু যেন উদাস হয়ে গেল জাবেদ ইমাম।

‘তোমার চুড়ি বিক্রি করলাম, প্রচ্ছদ আঁকাইলাম, কাগজ কিনলাম, প্রেস মালিকরে টাকা দিলাম, তেরো হাজার টাকা খরচ হয়া গেল। আর কি খরচ করা সম্ভব আমার দ্বারা! নাম পাল্টায়া যে নতুন কভার ছাপাব সেই ক্ষমতাও তো আমার নাই। তাছাড়া, মামলা-মোকদ্দমা কী হয় কে জানে, তারপর উকিল-কোর্ট-কাচারি, কতো খরচ পইড়া যায়, চাকরিটাও থাকে কি না সন্ধ আছে। বুঝলা সুলতানা, বড়ো একটা বিপদে পইড়া গেলাম।’

ফুঁপিয়ে ওঠে সে।

জাবেদ ইমামের পিঠে হাত রাখে সুলতানা।

‘তুমি চিন্তা করবানা। আমার মন বলতেছে তোমার কিচ্ছু হবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন বিশাল সাগরের মতো, তিনি জানতে পারলে তোমার কোনো ক্ষতি হইতে দেবেন না তিনি।’

স্ত্রীর কথায় জাবেদ ইমাম একটু শান্ত হলো বোধ হয়। চোখের পানি মুছল। তারপর হাতের তালুতে কী সব লিখল। কাটাকাটি করল, তারপর আবার লিখল। তারপর সে তালুটাকে একটু ভাঁজ করে বাসের জানালার কাছে নিলো এবং ফুঁ দিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিল।

সুলতানা জিজ্ঞেস করল,

‘কী করলা?’

জাবেদ ইমাম ফিসফিস করে বলল,

‘রবীন্দ্রনাথের কাছে একখান চিঠি পাঠায়া দিলাম।’

এর পরের ঘটনাটা অন্যরকম।

স্বর্গে আরাম কেদারায় বসে নিজের গানগুলো শুনছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চোখজোড়া তাঁর বন্ধ। দেবব্রত, কণিকা, সাগর, সাদী, বন্যা অনেকের গান বাজছে একটার পর একটা।

স্বর্গের পরী এসে দাঁড়াল তাঁর পাশে। এমন মুগ্ধ সময়ে কি কবিকে বিরক্ত করা যায়? কিন্তু মোস্ট আরজেন্ট চিঠি, দিতেই হবে।

পরী অনুচ্চ স্বরে ডাকল,

‘কবি?’

চোখ খুলে তাকালেন রবীন্দ্রনাথ।

‘আপনার একটা চিঠি, মোস্ট আরজেন্ট।’

হাত বাড়িয়ে কবিগুরু চিঠিটা নিলেন। n