কথায় বলে, বিপদ নাকি পদে পদেই ঘটতে পারে। তাই কথায় আছে, ‘পদে পদে বিপদ।’ এই পদ বলতে শুধু ‘পা’ বোঝায় না, পদস্থ বলতে উচ্চপদ, অপদস্থ বলতে অপমান, পদোন্নতি বলতে প্রমোশন, পদস্খলন বলতে নৈতিক স্খলন, পদচ্যুত বলতে বরখাস্ত আবার পদক মানে পুরস্কার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরস্কার কবিতায়, কবি ধনরত্ন, মনি-মানিক্য না নিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেছিলেন বোদ্ধা রাজার কণ্ঠের ফুলের মালাকে গ্রহণ করে মাথায় তুলে নিতে। রাজকণ্ঠের যোগ্য মালা রাজা নিজে যাকে পরিয়ে দেন তার যোগ্যতা কত সম্মানের এটাই ছিল কবির ভাষ্য। রবীন্দ্রযুগের কথা থাক, এই দেশেও একসময় পুরস্কার ছিল সম্মানের, প্রেরণার। এখন সম্মান তো দূরের কথা, পুরস্কারের মান নিয়েই উঠেছে নানান প্রশ্ন।
নাম, সুনাম, দুর্নাম বা বদনাম— সবকিছুর সঙ্গে নামযুক্ত থাকলেও যখন কর্মগুণে দাম না হয়ে কেবল নামগুণে দাম হয় তখন অনেক বেনাম বস্তুও নামাঙ্কিত হয়ে নামকে কলঙ্কিত করতে পারে। তবে আমাদের এই সমাজে শুধু নাম নয়, কর্মগুণেও দামি অনেক মানুষ আছেন। যাদের খুঁজে নিতে হয় কষ্ট করে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা প্রচারবিমুখ এই সব মানুষ, যারা নীরবে-নিভৃতে নিজের দায়বোধ থেকে কাজ করেন, আমরা তাদের খুঁজে এনে ‘ইত্যাদি’তে তুলে ধরতে চেষ্টা করি। যারা স্বীকৃতি-মূল্যায়ন বা পুরস্কারের লোভে কাজ করেন না। কাজ করেন বিবেকের শুভ প্রেরণা থেকে। তেমনই একজন মানুষ হলেন গহের আলী। যিনি ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ২০০৯ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রচারিত ‘ইত্যাদি’তে আমরা তাঁকে দেখিয়েছিলাম। যিনি ভিক্ষে করে তালের আঁঁটি সংগ্রহ করে নঁওগার ভীমপুরে বড় রাস্তার দু পাশে ১৮ হাজার তালগাছ লাগিয়েছিলেন, শুধু মানুষকে ছায়া দেয়ার জন্য। এই গাছ এখন রাস্তার দু পাশে মানুষকে ছায়া দিচ্ছে। গহের আলীর কাছে এটাই হচ্ছে পুরস্কার। আসলে যাঁরা ভালো কাজ করেন তাঁরা সেটা করার আগে জাহির করেন না। ছোটবেলায় একটি কবিতা পড়েছিলাম, যার দুটি লাইন ছিল, ‘নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল, তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল’। নদী নিজের জল নিজে পান করে না, গাছ নিজের ফল নিজে খায় না। তবে গাছ যারা লাগায় তারা গাছের ফল অবশ্যই ভোগ করে। কিন্তু এই সমাজে নিভৃতে-নীরবে এমন মানুষও আছেন, যিনি গাছ লাগান কিন্তু তার ফল ভোগ করেন না। তেমনি একজন মানুষ ছিলেন গহের আলী। তিনি যেমন স্বীকৃতির প্রত্যাশা করেননি তেমনি তার কৃতিত্বের প্রচারও করে বেড়াননি। আমরা জানি ফুল ফুটলে তার সুবাস ছড়িয়ে পড়বেই। অথচ আজকাল অনেককেই দেখা যায়, প্রচার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, নানাভাবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সচেষ্ট হন। তবে এ কথা ঠিক, ভালো কাজের জয় আর মন্দ কাজের ক্ষয় দেরিতে হলেও হয়। যেমন হয়েছিল গহের আলীর বেলায়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ৮০ বছর বয়সে তিনি পেয়েছিলেন জাতীয় পরিবেশ পদক-২০০৯। আর এই পদক তিনি নিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে।
পুরস্কার পেলে সবার ভালো লাগে, আমারও ভালো লাগে। তবে আমি সবার মতো এ কথা বলব না, এই পুরস্কার আমার দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে কিংবা পুরস্কারের কারণেই আমি দায়িত্ববান হয়েছি। আজকাল বিভিন্ন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের একটি প্রচলিত প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এটি, ‘এই পুরস্কার আমার দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।’ কথাটি কি ঠিক? পুরস্কার না পেলে কি দায়িত্ব কমে যাবে কিংবা আপনি দায়িত্ববান হবেন না? পুরস্কার পেয়ে কিন্তু গহের আলীর দায়িত্ব বাড়েনি। তিনি যা করেছেন তা পুরস্কার পাবার আগেই করেছেন। সুতরাং পুরস্কার পেলেই যে সবার দায়িত্ব বাড়ে এ কথাটি ঠিক নয়।
পুরস্কারের প্রসঙ্গ আসায় পুরস্কার নিয়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। গত ৩০ ও ৩১ মার্চ আলমগীর কবির ফিল্ম সোসাইটি এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর যৌথ উদ্যোগে শিল্পকলা একাডেমী প্রাঙ্গণে একটি চলচ্চিত্র উত্সবের আয়োজন করা হয়। উত্সবে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর এম.পি, আমাদের নূর ভাই। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির সে সময় চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে দেশে নানান জাতের, নানান পদের অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হলেও দীর্ঘ ২৫ বছর আলমগীর কবির প্রবর্তিত এই অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানটি বন্ধ ছিল। দেশের প্রচুর চলচ্চিত্র বিষয়ক অনুষ্ঠান— ‘চলচ্চিত্র মেলা’, ‘চলচ্চিত্র পুরস্কার’, ‘চলচ্চিত্র টক শো’, ‘চলচ্চিত্রের ভালো-মন্দ’ নিয়ে গোলটেবিল-সেমিনার-ওয়ার্কশপ’ হলেও আলমগীর কবিরের মতো চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব প্রবর্তিত এই পুরস্কারটি চালু করার উদ্যোগ কেউ নেয়নি। তবে নিজেদের প্রতিষ্ঠান কিংবা নিজের পরিবারের সদস্যদের নামে সৃষ্ট নতুন নতুন পুরস্কার পেতে ও দিতে দেখা গেছে অনেককেই। তবুও আনন্দের বিষয়, আলমগীর কবির ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগে এ বছর এই সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ডটি প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জুরিবোর্ডের মাধ্যমে টেলিভিশনে বিশেষ অবদানের জন্য আমাকে ‘শ্রেষ্ঠ উপস্থাপক এবং সমাজসেবক’ হিসেবে মনোনীত করা হয় এবং উত্সবের প্রথম দিন অর্থাত্ ৩০ মার্চ বিকেল ৩টায় পুরস্কার গ্রহণের জন্য একটি চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ জানানো হয়। চিঠিটির নিচে দস্তখত খ্যাতিমান নাট্যকার-গুণীজন বেগম মমতাজ হোসেনের। অর্থাত্ আলমগীর কবির প্রবর্তিত এই পুরস্কারটি পুনরায় প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছেন তার বোন।
চিঠি পাঠানোতেই শেষ নয়, চিঠি পাঠানোর আগে এবং পরে তিনি বেশ কবার টেলিফোন করে আমাকে এই পুরস্কারটি গ্রহণ করতে যাবার জন্য অনুরোধও করেছেন। পুরস্কারের প্রতি তেমন কোনো মোহ না থাকলেও তিনি ফোন করায় কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লাম। অনেকের মতো আমিও তাঁর ভক্ত। অনেক আগে থেকেই, যখন তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেশের প্রথম মৌলিক ধারাবাহিক নাটক ‘সকাল-সন্ধ্যা’ করতেন। তখন অনেকের মতো আমিও নিয়মিত দর্শক ছিলাম এই নাটকের। আমার মনে আছে যখন ‘সকাল-সন্ধ্যা’ প্রচার হতো তখন দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেত। পত্রিকায় পড়েছি, ‘সকাল-সন্ধ্যা’র রওশন জামিলের অভিনয় দেখে সত্যজিত্ রায় চিঠি লিখেছিলেন, তিনি যেন নিজের মাকে তার মধ্যে দেখছেন। ‘সকাল-সন্ধ্যা’ নামে অনেক দোকানপাট-পরিবহনের নামকরণ করা হয়েছিল। আজকাল তো অনেক চ্যানেল, অসংখ্য নাটক। দর্শক তো দূরের কথা, নাটকের পাত্র-পাত্রীরাই নিজেদের নাটক দেখেন না। যাহোক, তাই মমতাজ হোসেনের অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। নির্দিষ্ট সময়ে গেলাম কিন্তু অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। নূর ভাইসহ ৪-৫ জন অতিথি মঞ্চে বসে আছেন। সামনে ৫০/৬০ জন দর্শক। শুধু তাই নয়, যাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে তাদের মধ্যেও অনেকেই আসেননি। মনটা খারাপ হয়ে গেল আলমগীর কবিরের মতো ব্যক্তিত্বের স্মৃতির উদ্দেশে প্রবর্তিত এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষ এবং পুরস্কারপ্রাপ্তদের অনুপস্থিতি দেখে। এই পুরস্কারটি অন্য পুরস্কারের মতো নয়। যেই লোকটির নামকে ঘিরে এই অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন করা হয়েছে তিনি আলমগীর কবির, চলচ্চিত্রাচার্য। যাকে বলা হয় সত্যিকারের শিক্ষিত নির্মাতা। ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘সূর্য কন্যা’, ‘রূপালী সৈকতে’, ‘সীমানা পেরিয়ে’সহ আরো অনেক ছবির সফল নির্মাতা। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সে সময় এসব ছবি দলবেঁধে উপভোগ করতে যেত মানুষ। সে সময় ছবি বানিয়ে কোথায় কোথায় পাঠালে কিংবা কাকে ধরলে পুরস্কার পাওয়া যাবে, নির্মাতাদের মাথায় এসব চিন্তা ছিল না। সে সময় একটি পুরস্কারের অনেক মূল্য ছিল। যিনি পুরস্কার পেতেন, সবাই তার এই পুরস্কারপ্রাপ্তিতে অভিনন্দন জানাতেন। আর এখন পুরস্কার পেলে কেউ সেভাবে অভিনন্দন জানাতে আসে না, অলক্ষে হাসে। এখন কেউ পুরস্কার পেলে অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়, কে পেল? কেন পেল? কিভাবে পেল? ইত্যাদি। বরং এখন কেউ অভিনন্দন জানালে সেটাকে তোষামোদ হিসেবে ধরে নেয়া হয়। উল্লেখ্য, এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের কোনো মিডিয়া কাভারেজও ছিল না। চলচ্চিত্র নিয়ে যারা টকশোগুলোতে বেশ সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন, তাঁদেরও দেখলাম না। নীরবে-নিভৃতে হয়ে গেল অনুষ্ঠানটি। কিন্তু এই অনুষ্ঠানটিরই আয়োজক যদি কোনো চ্যানেল বা পত্রিকা হতো কিংবা অনুষ্ঠানটি যদি সরাসরি সমপ্রচার করা হতো তখন শুধু দর্শকই নয়, শিল্পীদেরও বসার জায়গা দেয়া যেত না। কার আগে কে সামনের আসনে বসবে এই নিয়ে চলত প্রতিযোগিতা।
আজকাল পুরস্কারের যে ধরন-ধারণ দেখি, বিশেষ করে যারা দেয় এবং যেভাবে দেয়, যাকে দেয় এবং যে কারণে দেয়, এসব দেখে পুরস্কার নেয়া তো দূরের কথা, কোথাও কোনো পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানেই যাই না। আজকাল বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিও কিছু পুরস্কারপ্রেমী শিল্পীকে নিয়ে পুরস্কারের বিনিময়ে পারফরমেন্স করিয়ে বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান করে থাকে। এসব অনুষ্ঠান আবার বিভিন্ন চ্যানেলে লাইভও দেখায়। এছাড়া পত্রপত্রিকায় নানাজনের দেশ-বিদেশের নানান পুরস্কারপ্রাপ্তির কথা পড়ি। দুঃখের বিষয় হলো, আজকাল অনেকেই ছবি বানান, দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কারও পান, কিন্তু দেশের সিনেমা হলে সেসব ছবি সেভাবে চলে না। রাজধানীর দুই-একটি হলে মুক্তি দেয়া হয়। তারপর পত্রপত্রিকা আর চ্যানেলে শুরু হয় পাবলিসিটি। আগে আমাদের গ্রাম-গঞ্জের মানুষের কাছে সিনেমা ছিল বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। সপরিবার বেশ ঘটা করে সিনেমা দেখতে যেতেন সবাই। শুধু তাই নয়, নতুন বিয়ে হলে শালা-শালি এবং শ্বশুরবাড়ির কুটুমদের নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া অনেকটা ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর এখন? এখনকার অনেক ছবির নামই দর্শকরা জানে না। দেখা তো দূরের কথা। সাধারণ মানুষ না দেখলেও এসব ছবি আবার ডজন ডজন পুরস্কার পাচ্ছে। এদের পুরস্কার পাওয়া দেখে দর্শকরা অবাক হন। এসব ছবি কবে মুক্তি পেল আর কবে হল থেকে নেমে পড়ল, কেউ জানে না। অথচ আগে সিনেমা দেখে বাড়িতে এসে দর্শকরা সিনেমার গল্প করত। কিন্তু এখানকার সিনেমায় তেমন কোনো গল্প খুঁজে পাওয়া না গেলেও প্রচার-প্রচারণায় জুড়ি নেই। ছবি মুক্তি পেলে হল থেকেই লাইভ শুরু হয়। কেউ বলছেন, ছবিটি ফাটাফাটি, কেউ বলছেন জোশ। কেউবা বলছেন, এমন ছবি অনেক দিন দেখিনি ইত্যাদি। অর্থাত্ হল থেকেই টিভি কাভারেজ। যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাজানো। আবার মিডিয়ায় নিজেদের চেনাজানা কিছু পরিচিত মুখও মন্তব্য করেন, ‘অপূর্ব ছবি।’ আমি অবশ্য দর্শকদের শেষ মন্তব্যটির সঙ্গে একমত, এমন ছবি অনেক দিন দেখিনি কিংবা আরো ভালো হতো যদি বলত, ‘এমন ছবি কোনো দিন দেখিনি।’
এ প্রসঙ্গে বেশ কিছুদিন আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে বিলকিস আক্তার শম্পা নামে একজন কর্মজীবী মহিলা ‘ইত্যাদি’তে একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাঁর চিঠির বিষয়বস্তু হলো দেশে এখন ভারতীয় ছবি নকলের প্রতিযোগিতা চলছে। একটি টিভি চ্যানেলে ভারতীয় ও বাংলাদেশের একটি ছবির পাশাপাশি দৃশ্য দেখিয়ে নকলের বিষয়টি নাকি তুলে ধরা হয়েছে। তিনি আরও লিখেছেন, ইদানীং আবার কিছু কিছু ছবি নির্মিত হচ্ছে যেগুলো ফিল্ম নামক টেলিফিল্ম। দেশের দর্শকদের আকৃষ্ট করতে না পারলেও এরা দেশ-বিদেশের নানান পুরস্কার অর্জন করছেন বলে বিভিন্ন প্রচারণায় দেখা যায়। সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে তিনি ‘ইত্যাদি’র মন্তব্য জানতে চেয়েছেন। আমরা অনুষ্ঠানে এর একটি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েছিলাম, মেধাহীন চলচ্চিত্র লেখক ও নির্মাতাদের দৌরাত্ম্যে নকল ছবি নির্মাণ যেমন ঘৃণ্য তেমনি ক্ষতিকর হচ্ছে টিভি নাটককে টেনে বাড়িয়ে বড় পর্দায় চলচ্চিত্র হিসেবে প্রদর্শন করা। এই দু ধরনের মানুষের জন্যেই দেশীয় চলচ্চিত্র ধ্বংসের মুখোমুখি। কিন্তু যাঁরা এই অপকর্ম বন্ধের দায়িত্বে আছেন তাঁরাই যখন এসব কর্মকাণ্ডক পুরস্কৃত করেন তখন আর তিরস্কার করব কাকে?
একজন বিনোদন সাংবাদিক একদিন কথায় কথায় চলচ্চিত্রের জন্য একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এমনি ডজন ডজন পুরস্কারপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমাদের এখানে যখন চলচ্চিত্র পুরস্কার দেয়া হয়, তখন অধিকাংশ পুরস্কার একই চলচ্চিত্রকে দেয়া হয়। গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ, অভিনয় ছাড়াও চিত্রগ্রহণ, শব্দ গ্রহণ, সেট, সম্পাদনাসহ নানান পুরস্কার থাকে। এসব ক্ষেত্রে অন্যান্য ছবিকেও দেয়া যায়। তাতে অন্যকেও উত্সাহিত করা হয়।’
আমি কৌতূহলবশত জানতে চাইলাম, ‘অন্য ছবি বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?’
তিনি সরাসরিই সামপ্রতিককালে জনপ্রিয় একজন চিত্রনায়কের কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘ঐ চিত্রনায়ক দেশ-বিদেশের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে, প্রচুর অর্থ ব্যয় করে সুন্দর সুন্দর লোকেশনে গিয়ে ছবির শুটিং করেন। যা অসাধারণ। ধরে নিলাম তার গল্প বা কাহিনি পুরস্কার পাবার মতো নয়।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘পুরস্কার পাবার মতো নয় কেন?’
তিনি হেসে বললেন, ‘আজকাল আমাদের এখানে অধিকাংশ ছবিই পুরস্কার পাবার জন্য বানায়। দর্শক না দেখলেও এগুলো পুরস্কার পায়। এসব ছবি অনেকটা টিভিনাটকের আদলে করা হয়, ছবির সেই ডেপথ বা গভীরতা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই ধরেই নেয়া হয়, এই সব ছবিই পুরস্কার পাবে। হিট ছবির ক্ষেত্রে এত পুরস্কার পেতে দেখা যায় না। কিন্তু এই নায়ক ভদ্রলোকের ছবি চিত্রায়ণ, কারিগরি মান, শব্দ গ্রহণসহ অনেক বিষয়েই পুরস্কার পেতে পারে। কারণ তাঁর ছবিতে থাকে আধুনিক নির্মাণশৈলী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যা আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু ঐ যে “যারে দেখতে নারি-তার চলন বাঁকা” দোষ একটি খুঁজে বের করা হয়, তার অভিনয় ভালো নয়। ভাবখানা এমন, তিনি কেন অভিনয় করেন? অন্যকে দিয়ে করালেই তো পারেন?’
আমি এ কথার প্রতিবাদ করলাম। বললাম, ‘অভিনয়ের জন্য তো তাঁকে পুরস্কার দেয়া হচ্ছে না। অন্য বিষয়গুলোতে পুরস্কার দিতে সমস্যা কোথায়?’ সাংবাদিক বন্ধু বললেন, ‘সমস্যা বোধ করি একটি জায়গায়, পুরস্কারদাতা মহলে হয়তো তাঁর সে রকম লবিং বা যোগাযোগ নেই। আর তাছাড়া তাঁর নিজের ছবিতে অভিনয় করা তো দোষের কিছু নয়। একজন ব্যক্তি নিজে এত অর্থসম্পদ খরচ করে ছবি বানাচ্ছেন, তাঁর একটু অভিনয়ের শখ তো জাগতেই পারে। আজকাল টিভি চ্যানেলের মালিক হয়ে অনেকেই সপরিবার অনুষ্ঠান নির্মাণে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। তাঁদের সবার অনুষ্ঠান কি মানসম্মত? নিশ্চয়ই নয়। নিজের টেলিভিশনে তারা যা ইচ্ছা তাই করছেন। কেউ কি থামাতে পারছে? আবার চ্যানেলের ক্ষমতায় তাঁরা ক্ষমতাবান। সব অঙ্গনেই এদের লোক আছে। অনেকেই এদের তোষামোদ করতে ব্যস্ত। দেশের কোনো সমস্যা নিয়ে লেখার সময় না পেলেও এই সব আঁতেলরা “টিভি বলে বলীয়ান” চ্যানেলের এই সব ব্যক্তিদের নিয়ে কলামও লেখেন। সত্যি সেলুকাস…। তাই এঁরা পুরস্কৃত হন। এই ব্যক্তিরা যদি নিজের চ্যানেলে যা খুশি তাই করতে পারেন তবে চলচ্চিত্রের এই তারকা নিজের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে নির্মিত ছবিতে অভিনয় করতে দোষ কোথায়? বলাবাহুল্য, ইদানীং তিনি তো বেশ জনপ্রিয়ও। তাঁর ছবিতে যেসব দৃশ্য দেখি অনেকেই সেই সব দৃশ্যের আয়োজনই করতে পারবে না এবং কেউ কেউ বলেন, আমাদের দেশের চলচ্চিত্রে অনেক অসম্ভবকে তিনি সম্ভব করে দেখিয়েছেনও। আমাদের দেশে চলচ্চিত্রে অনেক নায়ক, অনেক খলনায়ক, অনেক অভিনেতা রয়েছেন। একসময় যাঁদের অভিনয় দেখলে দর্শকরা কৌতুক অনুভব করতেন এবং সমালোচনা করতেন কিন্তু তাঁদের সেই অভিনয়ই এখন অনেকে অনুকরণ করেন এবং তারা বেশ জনপ্রিয় এবং দামি শিল্পী। পুরস্কারপ্রাপ্ত অনেককেই সাধারণ মানুষ না চিনলেও এদের চেনে।’
যাহোক, এখন পুরস্কার দেয়া এবং নেয়াটা বেশ সহজ হয়ে গেছে। বিভিন্নভাবে পুরস্কার দেয়া হয় এবং যে কেউ ইচ্ছে করলে এই পুরস্কার পেতে পারেন। এদের বাজারে প্রতিটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় প্রতিযোগিতায় নেমে আকর্ষণীয় পুরস্কারের বিচিত্র সব ঘোষণা দেন। অর্থাত্ পুরস্কার আছে সবখানেই। বিক্রেতা চান যে করেই হোক ক্রেতাকে ধরতে এবং বিক্রি করতে। তবে এই জাতীয় পুরস্কারের চরিত্রটা ভিন্ন—এর পেছনে রয়েছে অর্থ খিদে। ‘ইত্যাদি’তে আমরা বিভিন্ন সময় আজকালকার পুরস্কারের নানান ধরন নিয়ে অনেক নাট্যাংশ দেখিয়েছি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে, কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে, কোনো ব্যক্তির বাবা-মায়ের নামে পুরস্কার দেয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যাংক, বীমা, পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল, কসমেটিকস কোম্পানি থেকে শুরু করে চানাচুর-আচার কোম্পানি পর্যন্ত কেউ বাদ যায়নি। আর যাদের পয়সা আছে তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তি হন কিংবা না-ই হন, তাতে কিছু যায়-আসে না। তারাও নিজেদের নামে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য অনেক লোক আছে। আছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। এরাও ঝোপ বুঝে কোপ মারে। অনুষ্ঠান একটি পেয়ে গেলে এরা নেমে পড়ে মিডিয়া পার্টনার আর চ্যানেলের খোঁজে। তারপর মিনিট ব্যবসায় নেমে পড়ে কিংবা স্পন্সর জোগাড় করে ফেলে। এই স্পন্সর যে-ই হোক না কেন, ঝালমুড়ি কোম্পানির মালিক হলেও অসুবিধা নেই, তাকে প্রধান অতিথি করা হয় এবং তার হাত থেকেই আমাদের তথাকথিত বড়-ছোট মাঝারি তারকারা পুরস্কার নিতে পেরে ধন্য হন। ব্যক্তি নামের পুরস্কারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিল্প-সংস্কৃতি কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিশেষ প্রতিভা থাকলেই পুরস্কার দেয়া হয় না। টাকাও একটি প্রতিভা। সেই প্রতিভা ব্যয় করেও অনেকে এসব পুরস্কার পাচ্ছেন। আবার এসব পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে শিল্পী পেতে কোনো অসুবিধা হয় না। অনেকটা গিভ অ্যান্ড টেক পদ্ধতি। উদ্যোক্তার প্রশ্ন, তুমি আমার অনুষ্ঠানে নাচবে?
শিল্পীর প্রশ্ন, আমার লাভ?
উত্তর, পুরস্কার পাবে।
বিষয়টা অনেকটা কাজের বিনিময়ে ‘খাদ্যে’র আদলে— নাচের বিনিময়ে ‘পুরস্কার’। শুধু দেশে নয়, এই পদ্ধতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও পা রেখেছে। আর এর জন্য দায়ী হচ্ছে কিছু শিল্পী যাদের কোনো ইমেজ সচেতনতা নেই, মানসম্মান নিয়েও যারা চিন্তিত নয়। এরা জানে হুট করে শিল্পী হয়েছি, ঝরে পড়ার আগেই কামিয়ে নেই, দুনিয়াটা দেখে নেই, সুতরাং এদের দিয়েও আয়োজকরা অনেক কিছু করিয়ে নেন। বিনিময়ে কিছু অর্থ এবং স্যুভেনির শপ থেকে কিনে আনা কিছু ক্রেস্ট পুরস্কার হিসেবে দেন। এসব অনুষ্ঠান আবার কখনও কখনও লাইভও প্রচার করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব পুরস্কার কে দেয়? কিভাবে দেয়? পুরস্কারদাতাদের যোগ্যতা কী এ সম্পর্কে কারোই কোনো মাথাব্যথা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, এই সব অনুষ্ঠান আয়োজনে তেমন বাড়তি খরচ নেই। যাদের ভিসা আছে, এমন শিল্পীদের মনোনয়ন দেয়া হয়। আর আয়োজকরাও এতে নানাভাবে লাভবান হন। স্পন্সর থেকে অর্থ, টিকেট বিক্রি করে অর্থ, মিডিয়া পার্টনার থেকে অর্থ— এরপর এই সব দলের সঙ্গে অনেকেই ৪-৫ জন লোক নিয়ে যান, সেখানেও অর্থ। এছাড়া শপিংমলে কোনো শিল্পীর সঙ্গে কেউ সঙ্গ চাইলে সে জন্যেও অর্থ আছে। আবার আয়োজকদের প্রতারণাও রয়েছে। দেখা গেল, পোস্টারে ছবি দেয়া হয়েছে ২০ জনের। অথচ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন ১০ জন। বাকি দশজনই নেই। অথচ ২০ জনকে দেখিয়ে টিকেট বিক্রি করা হয়েছে। ফলে দর্শকরা হন প্রতারিত। কিছু দিন আগে তো জাপানে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে চরম প্রতারণার খবর পাওয়া গেছে। একটি টেলিভিশন চ্যানেল এ সম্পর্কে ধারাবাহিক রিপোর্টও প্রচার করেছে। তারপরও শিল্পীদের তেমন কোনো বাছ-বিচার নেই। বিদেশের অনুষ্ঠান হলেই হলো। যদিও এই সব পুরস্কার নিয়ে সবাই তিরস্কার করেন। এদের কারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তাছাড়া পত্রপত্রিকায় এসব অনুষ্ঠান নিয়ে অনেক স্ক্যান্ডাল শোনা যায়।
পুরস্কারের এই করুণ পরিণতির কারণে প্রায় ১ যুগ হয়ে গেল, আমি আর বিদেশে কোনো পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যাইনি। বিদেশে যাই, প্রবাসীদের সঙ্গে গল্প করি, কোনো সংবর্ধনা কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠান কিংবা কোনো সেমিনার, ওয়ার্কশপ কিংবা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রয়োজনে বিদেশে যাই, কিন্তু পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যাই না। কারণ এখন দেশেই বলেন আর বিদেশেই বলেন, অধিকাংশ অনুষ্ঠানই নানা কারণে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ। অনুষ্ঠানের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, এবার কারা পুরস্কার পাবে এবং কেন পাবে। কিছু কিছু জায়গায় মুখ্য হচ্ছে অর্থ এবং ব্যবসা।
আগেই বলেছি, আগে পুরস্কার পেলে সবাই অভিনন্দন জানাত। যিনি পুরস্কার পেতেন তাঁর আনন্দের সীমা থাকত না। তবে এখন কেউ প্রতিক্রিয়া জানাক বা না জানাক, নিজের প্রতিষ্ঠানে কিংবা নিজের অর্থে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে এরা নিজেরাই নিজেদের ধন্যবাদ জানায়, যেভাবে ঈদ বা নববর্ষ এলে এলাকায় এলাকায় অনেক পোস্টার দেখা যায়, সবাই নেতাকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। নিচে লেখা, প্রচারে এলাকাবাসী। অথচ এলাকাবাসী কিছুই জানে না। আজকাল পুরস্কার পাওয়ার জন্য অনেকেই এ রকম নিজস্ব টিম তৈরি করেছে। যাদের কাজ হচ্ছে বিশ্বজুড়ে পুরস্কার অন্বেষণ করা। বিশ্বের কোথায় কী পুরস্কার আছে, দেশে কোথায় কী পুরস্কার আছে, খোঁজ-খবর নেয়া, এগুলোতে ইংরেজিতে ডাব করে ফুটেজ পাঠানো থেকে শুরু করে পুরস্কারের অর্থ জমা দেয়া, সব কাজই এরা করে। এই সব সংঘবদ্ধ চেষ্টার কারণে দু-একজন ব্যক্তি নাম না জানা দু-একটি বিদেশি পুরস্কার পেয়েও যান। ব্যস, তার ঐ পুরস্কারপ্রাপ্তিতে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে পত্রপত্রিকা এবং চ্যানেলে চ্যানেলে প্রচার-প্রচারণায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মনে হয় যেন ‘নোবেল’ কিংবা ‘অস্কার’প্রাপ্তি ঘটেছে। অথচ উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহের যুগে একটুখানি গুগলে গিয়ে খুঁজলেই এসব পুরস্কারের বিশদ বিবরণ জানা যায়। কারা এসব পুরস্কার দিচ্ছে, কাদের দিচ্ছে এবং কী উদ্দেশ্য দিচ্ছে।
আজকাল ফেসবুকেও শুরু হয়েছে পুরস্কার পাবার জন্য অভিনব প্রচার-প্রচারণা। মিডিয়ার কিছু পরিচিত লোকের ফেসবুকে ঢুকে কয়েক দিন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যাবে পুরস্কারের জন্য এরা কী না করতে পারে। এরা নিজেদের মনের বাসনা অনুযায়ী পুরস্কার হিসেবে বিভিন্ন পদ পেতেও প্রচারণা চালায়। এরা নিজেরা নিজেদের ব্যস্ততার কারণে নিয়মিত ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে না পারলেও এদের সংঘবদ্ধ টিম নিয়মিত তার হয়ে পোস্ট দেয় এবং সেই সব পোস্টে বিভিন্ন ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে তার নির্দেশেই নিজেদের কর্মচারীরা সুন্দর সুন্দর মন্তব্য লেখে। মন্তব্যগুলোও বেশ বিনোদনমূলক, ‘স্যার আপনি মহান’, ‘আপনি শ্রেষ্ঠ’, ‘স্যার দেশে আপনি ছাড়া কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি নাই’, ‘আপনাকে মন্ত্রী বা মেয়রের দায়িত্ব দেয়া হোক’, ‘আপনাকে নোবেল দেয়া হউক’, ‘এই দেশে আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে পারেন’ অর্থাত্ দেশের আর কোনো লোক কোনো কাজ করেনি। এই সব ব্যক্তিরাই সব করেছেন। এই সব প্রচারণাও সেই পদ্ধতিতে অর্থাত্ প্রচারে এলাকাবাসী। নিজের চাহিদাকে বা ইচ্ছেকে অন্যের উপর দিয়ে চালিয়ে দেয়া। আবার এসব পেইজে কেউ যদি তাদের বিপক্ষে বা তাদের সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করে তাহলে তাত্ক্ষণিকভাবে তা মুছে দেয়া হয়। আমার সেই বন্ধু এসব দেখে একটি চমত্কার মন্তব্য করেছে, এসব বিষয় তো আর কেউ তদন্ত করে না। তাহলে হয়তো মানুষ বুঝতে পারত এরা কারা, এদের চরিত্র কেমন। এইসব প্রচার-প্রচারণার ডামাডোলে এসব ব্যক্তিরা কোনো পুরস্কার পেয়ে গেলেও অবাক হবেন না। যেভাবে মাঝে মাঝে পেয়েও যাচ্ছে। পুরস্কারের এই মানহানি ঘটা শুরু হয়েছে বেশ ক বছর আগে থেকেই।
অনেকেই আমাদের ‘ইত্যাদি’র প্রতিটি পর্বেরই ইংরেজি সাব টাইটেল দিয়ে প্রচার করতে অনুরোধ জানান। কেউ বলেন, আপনাদের এইসব প্রতিবেদন বিদেশে বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ডের জন্য পাঠালে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেতে পারেন। অনেকের অনুরোধের পরও এ কাজটি করিনি। কারণ এ ব্যাপারটিতে আমার যেমন উত্সাহ নেই, তেমনি এসব কাজ করার মতো সময়ও নেই। আর সাব টাইটেলের বিষয়টি আমরা বিবেচনায় রেখেছি শুধু ইউটিউবের জন্য। প্রবাসে অনেকেই আছেন যারা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করেছেন, বাংলা অনেক শব্দের অর্থই তারা জানেন না। তাদের জন্যই আমরা ইউটিউবে আমাদের কিছু প্রতিবেদন ইংরেজি সাব টাইটেল করে প্রচার করছি। যাতে এই সব সত্, ভালো মনের মানুষদের জীবনাচার অন্যদের অনুপ্রাণিত করে। আর এতে কেউ যদি অনুপ্রাণিত হন, সেটাই হবে আমাদের জন্য বড় পুরস্কার। দেশের এই সব পুরস্কার জটিলতার কারণে দর্শকদের অনুরোধে ‘ইত্যাদি’তে আমরা বিভিন্ন সময় পুরস্কার নিয়ে বিভিন্ন পর্ব করেছি। একবার আমরা প্রতিটি অফিসে একটু ভিন্নধর্মী পুরস্কার চালু করার জন্য একটি প্রতীকী পর্ব করেছিলাম। অর্থাত্ প্রতিটি কর্মচারীর কাজের মূল্যায়ন এবং যাদের বিরুদ্ধে সুর্নিদিষ্ট অভিযোগ আছে সেটা তদন্ত করে বছর শেষে পুরস্কৃত কিংবা শাস্তি প্রদান করা। অর্থাত্ যে বর্ষসেরা ঘুষখোর হবে তার শাস্তি হবে বরখাস্ত করা। সেরা কমিশন খাদক— অফিসের যেকোনো কিছু বিক্রয় বা কেনার সময় তিনি কমিশন খান। তার কর্মফল হিসেবেও তাকে বরখাস্ত করা হয়। আবার একজনকে বানানো হলো সেরা ‘চামচা’। যিনি তার সুবিধামতো অনেক কিছুই বসকে জানান বা গোপন করেন। আবার অনেক কিছু বাড়িয়েও বলেন। তাই তার কাজের মূল্যায়ন করে তাকে ‘সেরা চামচা’ নির্বাচন করে সতর্ক করে দেয়া। সবশেষে সেরা ভালো মানুষের পুরস্কার দেয়া হয়, যিনি তার সততা, যোগ্যতা এবং ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। তার জন্য পুরস্কার দ্বিগুণ ইনক্রিমেন্ট এবং পদোন্নতি। তিনি তার বক্তব্যে বললেন, একটি অফিসে সবাই খারাপ হয় না, আমরা সবাই মিলে খারাপ মানুষটিকে চিহ্নিত করে নিজেরাই একটি শুদ্ধ অফিস গড়ে তুলতে পারি। তাহলে সবাই আমার মতো সেরা ভালো মানুষের পুরস্কারটি পেতে পারেন। আবার ‘ইত্যাদি’র নিয়মিত চরিত্র ‘মামা-ভাগ্নে’ পর্বেও ছিল পুরস্কার প্রসঙ্গ। মৌসুমি ব্যবসায়ী ভাগ্নে সব সময় বিভিন্ন ব্যবসা করতে চায় কিন্তু মামা অসততার কারণে একসময় থামিয়ে দেন এবং নতুন ব্যবসার উপদেশ দেন। একবার ভাগ্নে শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে পুরস্কার দেয়াটাকে ব্যবসা হিসেবে নিতে চাইলে মামা বাধা দেয় এবং ভাগ্নেকে মহল্লার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা ভালো কাজ করে তাদের পুরস্কৃত করতে উপদেশ দেন। অর্থাত্ মহল্লার বাজারের শ্রেষ্ঠ মাছ ব্যবসায়ী, যে মাছে রং দেয় না। যে বাসি মাছকে তাজা বলে বিক্রি করে না। শ্রেষ্ঠ নাইট গার্ড, যে রাত্রে না ঘুমিয়ে দায়িত্ব পালন করে। শ্রেষ্ঠ বাড়িওয়ালা যে ভাড়াটিয়ার সঙ্গে নিজের আত্মীয়ের মতো ব্যবহার করে। শ্রেষ্ঠ ড্রাইভার— মহল্লার যে ড্রাইভার সুন্দরভাবে গাড়ি চালায়, Stop দেখলে থামে। অহেতুক হর্ন বাজায় না, ট্রাফিক আইন ঠিকভাবে মেনে চলে। শ্রেষ্ঠ গৃহকর্ত্রী— যে নিজের বাড়ির কাজের লোকের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করে। শ্রেষ্ঠ হোটেল মালিক— মহল্লায় যে হোটেলমালিক কোনো বাসি-পচা খাবার খাওয়ায় না। শ্রেষ্ঠ ভালো ছেলে— যে ছেলেকে দেখলে সবাই প্রশংসা করে, যার আচরণ ভদ্র। লেখাপড়ায় ভালো। যে মুরব্বিদের সম্মান করে। এমনি দেখে দেখে বেছে বেছে পুরস্কার দেয়ার জন্য বললেন।
ভাগ্নে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তাতে লাভ?’
উত্তরে মামা বললেন, ‘এইভাবে প্রতিটি মহল্লার ভালো লোকগুলোরে যদি উত্সাহিত করা যায় তাইলে সব মহল্লার মানুষই ভালো কাজ করার উত্সাহ পাবে।’
হাজারো অপরিষ্কার পুরস্কারের ভিড়ে এর চাইতে পরিষ্কার পুরস্কার আর কী হতে পারে?