রেশমি

reshmiবসুন মারুফ সাহেব, বসুন।

আমি আর রেশমি ডক্টর কামালের মুখোমুখি বসলাম।

কী খবর বলুন। কেমন আছেন?

ভালো।

ভালো? তাহলে সায়কায়াট্রিস্টের কাছে এসছেন কেন? হা হা হা।

কামাল সাহেবের প্রাণখোলা হাসি দেখে আমিও হাসলাম। তবে নিঃশব্দে। রেশমি গম্ভীর।

বলুন ম্যাডাম, আপনিও কি ভালো আছেন?

রেশমি আমতা গলায় বলল, না মানে…

বলুন, আমাকে সব খুলে বলুন। আচ্ছা, রাতে আপনাদের চা খাওয়ার অভ্যাস আছে? মানে ঘুমের সমস্যার জন্য রাতে অনেকে চা খায় না। আপনারা খান?

আমি কথা বলবার আগেই রেশমি বলল, খাই।

খান?

জি।

তার মানে আপনার ঘুমের সমস্যা নেই?

না, তেমন সমস্যা নেই।

তাহলে কেমন সমস্যা আছে? হা হা হা।

এবার কথা বললাম আমি। আমরা দুজনেই মোটামুটি ভালো ঘুমাই। এগারোটা সাড়ে এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি।

উইক এন্ডে?

একটা দেড়টা।

অতরাত পর্যন্ত কী করেন?

সিনেমা দেখি। আমরা দুজনেই সিনেমার পোকা। রেশমি হিন্দি ছবি খুব পছন্দ করে।

আর আপনি?

হিন্দিও পছন্দ করি। বেশি পছন্দ হলিউডের ছবি।

কী ধরনের ছবি বেশি দেখেন? ভূতের? হরর মুভি?

না। ওসব না। যুদ্ধের ছবি, প্রেমের ছবি। সায়েন্স ফিকশানও ভালো লাগে।

রেশমি, আপনি?

ও তো বললই, হিন্দি ছবি।

কী ধরনের হিন্দি ছবি?

লাভ স্টোরি, সালমান খানের একশান…

সকালে ওঠেন ক’টার দিকে?

উইক ডে’তে সাতটা সাড়ে সাতটা?

আর উইক এন্ডে?

ন’টা সাড়ে ন’টা বেজে যায়। কোনও কোনওদিন দশটাও বাজে।

আপনারা দুজনেই জব করেন?

জি।

কে কোথায়?

আমি ব্যাংকে আর মারুফ বড় একটা গ্রুপের এক্সকিউটিভ।

পড়াশোনা?

দুজনেই এমবিএ করেছি।

অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ?

জবাব দিলাম আমি। না।

বুঝেছি। একসঙ্গে পড়তেন?

জি। বিবিএ এমবিএ একসঙ্গে করেছি।

কোন ইউনিভার্সিটি?

নর্থসাউথ।

কতদিন হলো বিয়ে হয়েছে?

সাত বছর।

বাচ্চাকাচ্চা?

নেই।

সাত বছরের বিবাহিত জীবন, বাচ্চাকাচ্চা নেই কেন?

বিয়ের দু’বছর পর বাচ্চা আমাদের হয়েছিল। মৃতবাচ্চা।

অপলক চোখে আমার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে রইলেন ডাক্তার। মাথা দোলালেন। তারপর আর বাচ্চা নিচ্ছেন না কেন?

হচ্ছে না।

থাকেন কোথায়?

উত্তরায়।

অফিস?

রেশমির ব্যাংক উত্তরাতেই। আমার অফিস গুলশানে।

নিজের ফ্ল্যাট?

না, ভাড়ার। ফ্ল্যাট একটা বুকিং দিয়েছি। আগামী বছর পাব।

কোথায়?

উত্তরাতেই। এখন যে ফ্ল্যাটে থাকি তার কাছাকাছি।

সংসারে আছে কে কে?

আমি আর রেশমি। একজন কাজের বুয়া আছে। বিধবা নিঃসন্তান মহিলা। আমাদের গ্রামেরই। বিয়ের পর পরই মা জোগাড় করে দিয়েছিলেন। সহজ সরল ভালো মানুষ। আমাদের দুজনকেই খুব পছন্দ করে। দুজনকেই আগলে রাখে। রান্না খুব চমত্কার।

চা কেমন বানায়?

রেশমি আনমনা হয়েছিল। চায়ের কথায় ডাক্তারের দিকে তাকাল। বুয়া নিজে দুধচা খায়। বেশ ভালো বানায় দুধচা। আমরা খাই গ্রিনটি। ওটা তো বানাবার কিছু নেই। গরম পানিতে টিব্যাগ দিয়ে দিলেই হয়।

এক্ষেত্রে আপনাদের সঙ্গে আমার খুব মিল। হা হা। আমিও গ্রিনটি খাই। রাতে চা খাওয়ার প্রশ্নটা এজন্যই করেছিলাম। আমি এখন গ্রিনটি খাব। আপনারা খাবেন?

খেতে পারি।

গুড, ভেরিগুড। চা খেতে খেতে কথা বলাটা ভালো জমে।

ডাক্তার কলিংবেল বাজালেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঢুকল পিয়ন। স্যার…

তিন মগ গ্রিনটি।

জি স্যার।

ডাক্তার আবার রেশমির দিকে তাকালেন। রাতের চা সাধারণত ক’টার দিকে খান?

দশটা সাড়ে দশটা।

ডিনারের পর?

জি।

ডিনার করেন ক’টায়?

সাড়ে ন’টা দশটা বেজে যায়। কোনও কোনও রাতে তারও বেশি।

তার মানে ডিনারের পর পরই গ্রিনটি?

জি।

আমার দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন, আমি বেশি রোগী দেখি না। হাসপাতাল শেষ করে চেম্বারে আসি ছ’টার দিকে। ছ-সাত জনের বেশি রোগী দেখি না। আজ পাঁচ জন ছিল। একটা কেস একটু বেশি জটিল। ন’টার পর রোগী দেখি না। কিন্তু আপনি যার পরিচয়ে এসছেন, ডক্টর রিয়াজ মোবারক, সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সব শুনে বললাম, ন’টার দিকে আসতে বলো। কাল ছুটির দিন, আজ একটু রাত করে রোগী দেখা শেষ করলেও অসুবিধা নেই।

থ্যাংকস ডক্টর।

ইউ ওয়েলকাম। মারুফ সাহেব, আপনার হোম ডিস্ট্রিক্ট কোথায়?

মুন্সিগঞ্জ। লৌহজং থানা।

রেশমি, আপনার?

আমার দিনাজপুর।

দিনাজপুর কোথায়?

শহরেই।

দুজন দু’প্রান্তের।

জি।

আপনার মা বাবা ভাইবোন সবাই আছেন?

ভাই নেই। আমরা দু’বোন। বড়বোন আমেরিকায় থাকে। আপা দুলাভাই দুজনেই স্কুল টিচার।

আমেরিকার স্কুল টিচার মানে ভালো জব।

জি।

বাবা কী করেন?

বাবাও স্কুল টিচার ছিলেন। এখন আর কিছু করেন না।

মাও কি তা-ই?

রেশমি হাসল। না, মা কিছু করেন না। হাউস ওয়াইফ।

মারুফ সাহেব আপনার…

পিয়ন গ্রিনটি নিয়ে ঢুকল। বড়মগের ওপর সুন্দর ঢাকনা দেওয়া। ডাক্তার বললেন, তিন মিনিট ভিজালে গ্রিনটি ভালো জমে।

রেশমি বলল, আমরা এভাবেই খাই।

রেশমির কথাটা ডাক্তার মনে হয় শুনতেই পেলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার ফ্যামিলির অবস্থা বলুন।

আমরা দু’ভাই এক বোন। ভাই বড়। তারপর বোন, তারপর আমি। বাবা-মা ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন।

কোথায়?

পুরান ঢাকা। গেণ্ডারিয়া।

নিজেদের বাড়ি?

ভাইয়ের।

বাবার না?

না।

ভাই কী করেন?

বিজনেস। কাপড়ের বিজনেস। টেক্সটাইল মিল আছে।

বোন?

বোন খুবই বড়লোকের বউ। শ্বশুরপক্ষের শিপিং বিজনেস। সে থাকে চিটাগংয়ে।

ভাইবোনদের বাচ্চাকাচ্চা?

ভেতরে ভেতরে আমি একটু বিরক্ত হচ্ছি। এলাম যে সমস্যা নিয়ে তার ধার কাছ দিয়েও যাচ্ছেন না ডাক্তার। কী খেজুরে আলাপ শুরু করলেন?

রেশমিও মনে হয় এরকমই ভাবছে।

কিছু ভাবছেন, মারুফ সাহেব?

না।

অবশ্যই ভাবছেন। কী ভাবছেন বলে দিতে পারি। ভাবছেন, আপনাদের সমস্যার কথা না শুনে ফালতু প্যাঁচাল কেন পাড়ছি আমি। তা-ই না?

আমি কথা বলি না, মাথা নিচু করে রাখি।

এটা ভাবাই স্বাভাবিক। নিন চা নিন। এতক্ষণে পারফেক্ট গ্রিনটি হয়েছে।

ডাক্তার চায়ে চুমুক দিলেন। রেশমি, চা খান, চা খান। শুনুন, মানসিক ডাক্তাররা কিন্তু একটু পাগল টাইপ হয়। আমি আধা পাগল। হা হা হা…। বলুন মারুফ সাহেব, ভাইবোনদের বাচ্চাকাচ্চার কথা বলুন। কার ক’বাচ্চা, কে কী করে?

ভাইয়ের এক মেয়ে এক ছেলে। মেয়ে বড়। সে থাকে মেলবোর্নে। হাজব্যান্ড ওয়াইফ দুজনেই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। একটাই বাচ্চা ওদের। মেয়ে। মেয়ের বয়স চার বছর।

আর ভাইয়ের ছেলেটা?

মাস্টার্স করেছে। বাবার বিজনেস দেখে।

বিয়ে করেছে?

হ্যাঁ। তিন বছর হলো বিয়ে করেছে। এখনও বাচ্চা নেয়নি।

বোনের কী অবস্থা?

বোনের দুই ছেলে। একজন জাপানে থাকে। জাপানি মেয়ে বিয়ে করেছে। ওদের এক ছেলে।

বোনের ছোট ছেলে?

সে এখনও বিয়ে করেনি। বিসিএস করেছে। এখন চাকরিতে ঢুকবে।

রেশমির দিকে তাকিয়ে ডাক্তার আচমকা বললেন, আপনার বোনের কখনও কি মৃত বাচ্চা হয়েছিল?

রেশমি একটু চমকাল। জি। প্রথম বাচ্চাটাই মৃত হয়েছিল।

ডাক্তার মাথা নাড়লেন। বোনের দ্বিতীয় বাচ্চা হলো কতদিন পর? একটু বেশি গ্যাপে?

জি।

কত বছর বলুন তো?

এগারো বছর।

ডাক্তার আবার মাথা নাড়লেন। আপনার বাচ্চাটি বেঁচে থাকলে কত বয়স হতো?

পাঁচ বছর।

ডাক্তার বড় করে চায়ে চুমুক দিলেন। চলুন এবার আসল ঘটনায় ঢুকি। মারুফ সাহেব, আপনি বলুন। তার আগে বলে নিই, আমি আপনাদের সঙ্গে এতক্ষণ প্রচুর কথা বলেছি। আপনাদের মনে হতে পারে, সব কথাই এলোমেলো। অপ্রয়োজনীয় কথা। একটিও অপ্রয়োজনীয় কথা আমি বলিনি বা জানতেও চাইনি। আপনাদের দুজনার ফ্যামিলির খুটিনাটি জানা আমার ট্রিটমেন্টের অংশ। আর এত কথা বলার ফাঁকে আরেকটা কাজও হয়েছে, আপনারা অনেকটা সহজ হতে পেরেছেন। আড়ষ্টতা থাকলে তা কেটে গেছে। বলুন মারুফ সাহেব, বলুন।

চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, আমাদের ফ্ল্যাটে রেশমি একটা বাচ্চাকে ঘুরে বেড়াতে দেখে।

ভাবলাম শুনে খুবই চমকাবেন ডাক্তার। কিন্তু তিনি একেবারেই নির্বিকার। কত বড় বাচ্চা?

বছর পাঁচেকের।

তার মানে আপনাদের বাচ্চাটি বেঁচে থাকলে যে বয়সের হতো?

জি।

কখন দেখেন?

আমার মনে হয় রেশমির সঙ্গে কথা বলা ভালো।

কেন?

সে গুছিয়ে বলতে পারবে।

সে আপনাকে বলেনি?

জি বলেছে। সব শুনেই তো ওকে আমি আপনার কাছে নিয়ে এলাম।

আপনি আপনার স্ত্রীর মুখে যা শুনেছেন তা-ই বলুন।

এক গভীর রাতে দেখি রেশমি বিছানায় নেই। ভাবলাম ওয়াশরুমে গেছে। অপেক্ষা করছি, দেখি সে ফিরেই না। প্রায় চল্লিশ মিনিট। চিন্তিত হলাম। কোথাও কোনও সমস্যা হলো কিনা। উঠে বাথরুমের দরজা ধাক্কা দিয়েছি, দেখি দরজা খোলা। ভেতরে কেউ নেই। রেশমি তাহলে কোথায় গেল? ড্রয়িং ডাইনিংয়ে গেলাম। না নেই। বুয়া ঘুমায় কিচেনের পাশের ছোট্ট রুমে। সামান্য নাক ডাকার অভ্যাস আছে তার। বুয়ার নাক ডাকার শব্দ পাচ্ছি। কিন্তু রেশমি কোথায়?

আপনাদের কয় রুমের ফ্ল্যাট?

তিন রুমের। মাস্টার বেডের পাশে বাচ্চার রুম। সবশেষ রুমটা গেস্টরুম। আমাদের বুকসেলফ, ডেস্কটপ ইত্যাদি রাখা আছে।

ম্যাডামকে নিশ্চয় বাচ্চার রুমে পেলেন?

জি। ওই রুমে অন্ধকারে বসে আছে।

বিড়বিড় করে কথা বলছিল?

জি।

কী বলছিল কিছু বুঝতে পারছিলেন?

প্রথম দিন পারিনি। মাস দেড়েক পর পারলাম।

তার মানে তারপর থেকে প্রায় রাতেই তিনি ওই রুমে চলে যান?

জি।

আপনি টের পেতেন?

প্রতিবারই যে পেতাম তা না। তৃতীয় রাতে যখন বুঝলাম সে ওই রুমে গিয়ে ঢুকেছে, কী বলে বাইরে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করলাম।

ফিসফিস করে কথা বললে বাইরে থেকে কী করে বোঝা যাবে?

সেদিন একটু শব্দ করেই বলছিল।

কী বলছিলেন বলুন তো?

কাকে যেন বলছে, এতদিন পর মায়ের কথা মনে পড়েছে তোমার? পাঁচ বছর হয়ে গেছে, এতদিনে একবারও এলে না? তুমি তো বড় হয়ে গেছ! তোমাকে তো আমি চিনতেই পারছিলাম না। তুমি যখন মা বলে ডাকলে তখন বুঝতে পারলাম, আরে, এ তো আমার সোনামানিক!

রুম কি অন্ধকার ছিল?

জি।

আপনি তারপর কী করলেন?

নিঃশব্দে রুমে ঢুকে সুইচ টিপলাম। হঠাত্ আলোর ঝলকানিতে আপাদমস্তক কেঁপে উঠল রেশমি। তারপর খুব রাগল। তুমি এসছো কেন? আমার ছেলেটা যে ভয় পেয়ে চলে গেল! আমি হতভম্ব। কী বলছ, রেশমি? তোমার ছেলে মানে…

তারপর?

রেশমি আর কথা বলে না। হঠাত্ যেমন জ্বলে উঠেছিল, তেমন হঠাত্ করেই যেন নিভে গেল। না কিছু না, চলো, বেডরুমে চলো।

দ্রুত হেঁটে বেডরুমে চলে এল?

জি।

প্রথম রাতের পর তাকে আপনি জিজ্ঞেস করেননি ওই ঘরে গিয়ে কেন সে বসে থাকে? বিড়বিড় করে কথা বলে কার সঙ্গে?

জিজ্ঞেস করেছি, অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি।

কী বলে?

কিছুই বলে না।

একদম চুপ করে থাকে?

হ্যাঁ।

আর আপনি জানার চেষ্টা করেই যাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

বারবার একই কথা শুনে রেগে যেতেন না?

হ্যাঁ। কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলত, বুঝতেই পারছ বিষয়টা নিয়ে কথা আমি বলব না। আর একবারও জানতে চাইবে না। ব্যাস এখানেই শেষ।

আপনার নিশ্চয় ততদিনে মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকেছে?

সেটাই স্বাভাবিক না?

হ্যাঁ, সেটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা বাচ্চার রুমে কী কী আছে?

একটা বেবিকট। বিভিন্ন সাইজের কয়েকটা পুতুল। দেয়াল ভর্তি সুন্দর সুন্দর শিশুর পোস্টার। বাবু হওয়ার মাসখানেক আগেই কটটা কেনা হয়েছিল।

ম্যাডাম কোথায় বসে কথা বলতেন?

মেঝেতে। কটের পাশে।

কবে তিনি আপনাকে বললেন, পাঁচ বছরের বাচ্চাটি তার কাছে আসে। তাকে মা মা বলে ডাকে। বাচ্চার সঙ্গে সে কথা বলে।

দিন দশেক আগে?

কীভাবে বললেন?

ক’দিন ধরে অফিসে যাচ্ছিল না। রাতে ঘুমায়ও না। চোখের কোলে কালি পড়ে গেছে। খায় না ঠিকমতো। আমি তো চিন্তিত হয়েছিই। বুয়াও খুব চিন্তিত। পরিষ্কার মানসিক রোগের লক্ষণ। আমিও ছুটি নিলাম অফিস থেকে। সারাক্ষণ পাশেপাশে থাকি ওর, নানা রকমভাবে চেষ্টা করি ঘটনা জানার। কথা সে বলতেই চায় না। বিরক্ত হয়, রেগে যায়। এক বিকেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কিছু বুঝতে পারো না? আমার ছেলে যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, বুঝতে পারো না? রাতেরবেলা পাশের ঘর থেকে ওর ডাক আমি শুনতে পাই। মা মা করে আমাকে সে ডাকে। আমি ঘুম ভেঙে ওর কাছে চলে যাই…

শুনে নিশ্চয় আপনি খুব ভয় পেলেন?

জি। শ্বশুর-শাশুড়িকে জানালাম, আমেরিকায় ফোন করে ওর আপাকে জানালাম। আমার বাবা মা ভাইবোন এল ওকে দেখতে। বড় ভাইয়ের বন্ধু ডাক্তার রিয়াজ মোবারকের সঙ্গে আলাপ করলেন ভাই। সবাই বুঝতে পারছি, মানসিক সমস্যা। কিন্তু এই সমস্যা এতদিন পর কেন? পাঁচ বছর হয়ে গেছে আমাদের একটা মৃত সন্তান হয়েছিল। সমস্যা হলে তো তখনই হওয়ার কথা।

ডাক্তার গম্ভীর গলায় বললেন, মানুষের মনের চেয়ে জটিল কিছু পৃথিবীতে নেই। মন কখন কী করবে আপনি বুঝতে পারবেন না।

রেশমির দিকে তাকালেন ডাক্তার। এখন কি আপনি একটু স্বাভাবিক।

রেশমি স্পষ্ট গলায় বলল, আমি সব সময়ই স্বাভাবিক।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমার কথার কি ঠিকঠাক জবাব দেবেন?

অবশ্যই দেবো।

মৃত বাচ্চা প্রসবের পর থেকে আপনার মনের অবস্থা কী ছিল?

বাচ্চার কথা ভেবে খুব কষ্ট পেতাম।

কথাটা বলতেন মারুফ সাহেবকে?

প্রথম প্রথম বলেছি।

তিনি কী বলতেন?

সান্ত্বনা দিত আমাকে।

আপনি কি খুব চাপা স্বভাবের?

বলতে পারেন। মনের কষ্ট, দুঃখ বেদনা মনে চেপে রাখতেই ভালো লাগে। সহজে বলতে চাই না কাউকে।

স্বামীকেও না।

বলতে পারেন। এর অবশ্য একটা কারণও আছে।

কী কারণ?

প্রথম প্রথম প্রায়ই বাচ্চার কথা ওকে বলতাম। একসময় দেখি ও যেন একটু বিরক্ত হয়। আমার মতো করে বাচ্চাটাকে ফিল করে না। তারপর আমি আর বলতাম না। নিজে নিজেই থেমে যাই। কিন্তু মনের ভেতর বাচ্চাটা আনাগোনা করে। কোথাও কোনও শিশুর কান্না শুনলে বুকটা মোচড় দেয়। শিশুর মা ডাক শুনলে পাগলের মতো লাগে। রাস্তাঘাটে বা কোথাও কোনও কোলের শিশু দেখলেই তাকিয়ে থাকি। কেমন যেন লাগে। অনুভূতিটা ঠিক বোঝাতে পারব না। পাঁচ বছর ধরে এই অবস্থা আমার। কিন্তু ব্যাপারটা আমি কারও সঙ্গে শেয়ার করি না। মনের মধ্যেই চেপে রাখি।

কখনও এমন মনে হয়নি, বাচ্চাটা আপনার মৃত হয়নি। জীবিতই হয়েছিল। হয়ে কোথাও চলে গেছে?

জি। গত কয়েকমাস ধরে এই অনুভূতিটা হচ্ছে।

তারপর একসময় মনে হতে লাগল, বাচ্চাটা আপনার কাছে ফিরে আসবে?

জি।

এসে মা বলে আপনাকে ডাক দেবে?

জি।

তারপর ডাক দিলো?

জি।

কবে, কীভাবে, ঘটনাটা বলবেন।

ওই যে মারুফ যে রাতে প্রথম বাচ্চার ঘরে আমাকে দেখল, সেটা আসলে তৃতীয় রাত। তার আগেও দু’রাত আমি উঠে ওই রুমে চলে গেছি। আমার স্বভাব হলো শোয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু সামান্য শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। একবার ডাকলেই শুনতে পাই। গভীর রাতে সেদিন শুনি পাশের রুম থেকে শিশুর ডাক ভেসে আসছে, মা, মা। ঘুম ভেঙে গেছে ঠিকই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই উঠলাম না। কান খাড়া করে রাখলাম। শুনি আবার সেই ডাক। মা, মা। নিঃশব্দে বিছানা ছেড়েছি, নিঃশব্দ পায়ে গেছি পাশের রুমে। দরজা জানালা বন্ধ রুমের। পাতলা পর্দা ভেদ করে ঢুকেছে রাস্তার আলো। সেই আলোয় দেখি বছর পাঁচেক বয়সের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি, আকাশি রংয়ের লুজ ধরনের প্যান্ট। মাথা ভর্তি চুল ছেলের, মুখটা কী মিষ্টি, চোখ দুটো এত ডাগর, এত মায়াভরা… …

ওরকম আলোয় কী করে দেখলেন?

তা বলতে পারব না। তবে একদম স্পষ্ট সব দেখলাম।

তারপর কী করলেন?

কী রকম যেন দিশেহারা হলাম। কথা বলতে গেলাম স্বাভাবিক স্বরে, দেখি শব্দ তেমন হয় না। স্বর হয়ে যাচ্ছে ফিসফিসে। ওই স্বরেই বললাম, তুমি কে সোনা?

ছেলে বলল, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না, মা?

জি। ঠিক এই কথাটাই বলল।

তারপর ওরকম গভীর রাতে মাঝে মাঝেই ছেলে এসে আপনাকে ডাকে?

হ্যাঁ। আমি ওর ডাকের জন্য অপেক্ষা করি।

স্বামীকে বলতে ইচ্ছে করে না, আমাদের ছেলেটা এসেছে। ওই যে আমাকে ডাকছে। তুমিও চলো। দেখো তাকে।

না।

কেন?

জানি না। কেমন একটা ভয় হয়।

কী রকম ভয়?

বুঝিয়ে বলতে পারব না।

শেষ পর্যন্ত বললেন কেন?

মনে হয় বিরক্ত হয়ে বলে ফেলেছি।

ছেলেকে কখনও ছুঁয়ে দেখেছেন? কোলে নিয়েছেন?

না। চেষ্টা করেছি। ছুঁতে গেলেই সরে যায় সে। ধরতে গেলেই সরে যায়।

মারুফ সাহেবকে বলার পর কি ছেলেকে আর দেখেছেন?

দেখব না কেন? রোজই দেখি। আগে শুধু রাতে দেখতাম, এখন দিনেও দেখি। নির্জন দুপুরে আমি একা আমার রুমে, হঠাত্ শুনি সে সময় ডাকে। মা, মা। পাশের রুমে ছুটে গিয়ে দেখি সে ঠিক দাঁড়িয়ে আছে।

ডাক্তার খানিক চুপ করে কী ভাবলেন। তারপর রেশমিকে বললেন, আপনি বাইরে গিয়ে বসুন ম্যাডাম। আমি মারুফ সাহেবের সঙ্গে একা একটু কথা বলব। আপনাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই।

রেশমি নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।

ডাক্তার বললেন, এ একধরনের হ্যালুসিনেসান। জটিল কিছু না। কয়েকটা ওষুধ দিচ্ছি, নিয়ম করে খাওয়াবেন। একটা বাচ্চা নিতে পারলে ভালো। গাইনির ভালো ডাক্তার দেখান। যদি বাচ্চা আর না হয়, একটা ছেলে বাচ্চা এডপ্ট করুন। ফ্ল্যাটটা বদলে ফেলবেন। অন্য ফ্ল্যাটে চলে যান। ঠিক হয়ে যাবে।

মাসখানেক পর ডক্টর কামালকে আমি ফোন করলাম। ডক্টর, আমি মারুফ।

চিনেছি। বলুন, খবর কী? আপনার স্ত্রী কেমন আছেন?

অনেকটাই ভালো। কিন্তু কিছুতেই এই ফ্ল্যাট ছেড়ে যাবে না।

কী বলেন?

কান্নাকাটি করে। বলে এই ফ্ল্যাটে আমার বাচ্চাটা আছে। ওকে ফেলে আমি কেন যাব? আমি তোমাকে একটুও ডিস্টার্ব করব না। আমাকে আমার ছেলের কাছে থাকতে দাও।

ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, গাইনির ভালো ডাক্তার দেখান। দ্রুত একটা বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করুন। নাহলে খুব ছোট একটা বাচ্চা এডপ্ট করুন। সংসারে বাচ্চা এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।