ইতি

ঘুম থেকে উঠেই আদ্রিতা হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করলো আলফা কে । পুরো বাড়ি, উঠান, রাস্তার মোড়ের টঙ দোকানের সামনের ফুটপাত- সব জায়গায় খুঁজেও আলফা কে পাওয়া যাচ্ছে না । আদ্রিতা কাঁদতে কাঁদতে আলফা’র নাম ধরে চিৎকার করলো কিন্তু প্রতিবারের মতো আজ আলফা ফিরে আসছে না আদ্রিতা’র ডাক শুনে । মাঝে মাঝে আলফা লুকোচুরি খেললেও অদ্রিতা’র চিৎকার শুনে সে ছুটে আসতো, কিন্তু আজ আসছে না । আলফা’র ঘরে ফেলে রাখা হাড্ডিটা, ওখানেই পড়ে আছে ।

প্রায় দু’বছর আগে আলফাকে কুড়িয়ে পায় আদ্রিতা । তখন থেকেই বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসা । ডাস্টবিনের পাশ থেকে থেকে তুলে আনা কুকুরটাকে দেখে আদ্রিতা’র মা প্রথম প্রথম কোন ভাবেই মেনে নিতে পারে নি ব্যাপার টা । শালার এক রাস্তার কুকুর, তাকে আবার আদ্রিতা নিজের বাসায় তুলে এনেছে, বাবাকে বলে উঠোনের পাশে ঘর বানিয়ে রেখেছে ! এটা কোন কথা ! অনেক তোড়জোড় করেও আলফাকে ঘর থেকে বের করতে পারলো না অদ্রিতা’র মা । আলফা’র জন্যে আদ্রিতা’র ভালোবাসা এতোটাই প্রবল ছিল যে, এক সময় আদ্রিতা’র মা ব্যাপার টা মেনে নিতে বাধ্য হয় । ভালোই যাচ্ছিলো আদ্রিতা আর আলফা’র অপরূপ বন্ধুত্ব । আদ্রিতা’র অন্যান্য মানুষ বন্ধুরা রীতিমত হিংসায় জ্বলতো ওদের সম্পর্ক দেখে । কোন কিছুই আলফা আর আদ্রিতা’র বন্ধুত্ব ভেঙ্গে দিতে পারে না । সকাল হলেই আদ্রিতা ঘুম থেকে উঠে আলফাকে ডাক দিতো, আলফা দৌড়ে এলে তাকে কোলে বসিয়ে হাড্ডি খেতে দিতো । আলফাও তার জিভ দিয়ে আদ্রিতার গাল চেটে দিতো ।

দিন চলে যায়, অথচ ওদের বন্ধুত্ব একদম আগের মতোই । আদ্রিতা ওর সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে আলফাকে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখে, মানুষের মতোই ব্যবহার করে তার সাথে । আলফাও একসময় নিজেকে মানুষ ভাবতে শুরু করে । সে নিজের পরিচয় ভুলে যেতে থাকে, আদ্রিতা’র ভালোবাসা তাকে দিন দিন মানুষ করে তুলছে । এখন আর আলফা রাস্তার মাঝে অন্যান্য কুকুরের সাথে দাড়িয়ে থাকে না, মাদী কুকুর দেখলে লেজ নাড়ে না, যেখানে সেখানে ঘুমায় না । আলফা’র সমস্ত জগত আদ্রিতাকে ঘিরে, আদ্রিতারও এক অবস্থা । সারাদিন দুইজনের একসাথে খেলা, উঠোন জুড়ে দৌড়াদৌড়ি, অদ্রিতা হাড্ডি ছুঁড়ে মারলেই- দে ছুট । আলফা অন্য কুকুর গুলো থেকে আলাদা । খুব বদমেজাজি হলেও কোন কারণ ছাড়া সে অদ্রিতা’র সাথে রাগ করতো না । আদ্রিতা হয়তো ব্যাপারটা বুঝতো । কিন্তু, একদিন সব বদলে গেলো । আদ্রিতা এখন খুব ব্যস্ত থাকে । ক্লাস আর নতুন বন্ধুদের মাঝে আলফা’র কথা তার কতটা মনে থাকে, মাঝে মাঝে আলফা বুঝতে পারে না । যদিও আদ্রিতা বাড়ি ফিরে হালকা আদর করে দেয় আলফাকে । আদ্রিতা’র এসব কাজ দেখে আলফার খুব রাগ হয় । আদ্রিতা বাড়ি ফিরলেই ঘেউ ঘেউ করতে থাকে, কিন্তু সে বুঝতে পারে এখন আদ্রিতা তার এসবে খুব একটা পাত্তা দেয় না । মাঝে মাঝে আলফা বাড়ি থেকে চলে গেলে আদ্রিতা’র কান্না শুনে আবার ফিরে আসে, তার গাল চেটে দেয় । আদ্রিতা’র আদর পেয়ে আবার সব ভুলে যায় ।

আলফা দিন দিন মানুষ হয়ে উঠছে । আদ্রিতা’র কাছাকাছি থাকার জন্য যা যা করা দরকার, সব করছে সে । কিন্তু আজকাল অদ্রিতা তার সাথে মানুষের ব্যবহার করে না । বাকি আট দশ টা কুকুরকে তাদের মানুষ বন্ধুরা যেভাবে গণ্য করে, ঠিক সেভাবেই আদ্রিতা আলফাকে গণ্য করে । আদ্রিতা’র জন্য আলফা এখন স্রেফ একটা কুকুর । হয়তো এর থেকে বেশি কিছু নয় । আলফা রাগ করে, ঘেউ ঘেউ করে, বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চায়, আদ্রিতা’র কান্না শুনে ফের ছুটে আসে । আদ্রিতা তাকে এখনো একটু হলেও ভালোবাসে । এই ভেবে প্রতিবার থেকে যায় আলফা । কিন্তু আদ্রিতা’র ব্যবহার দিন দিন আরও খারাপ হতে থাকে আলফা’র প্রতি । আলফা ঘেউ ঘেউ করে, ভালোবাসা চায় । আদ্রিতা’র কান্না তার সহ্য হয় না ।

এক বছর এভাবে চলার পর আদ্রিতা আর আলফা দু’জনেই বদলে যেতে থাকে । ক্যামন যেন এক দূরত্ব চলে আসে তাদের মাঝে । আলফা বুঝে উঠতে পারে না, হয়তো আদ্রিতাও বোঝে । সেও হয়তো কোন কিছু বুঝে উঠতে পারে না । আলফা’র এখন দিন কাটে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে, অন্যান্য কুকুর আর মানুষের বন্ধুত্ব দেখে । হয়তো আদ্রিতাও অন্যান্য কুকুর আর মানুষের বন্ধুত্ব দেখে, তার কি খারাপ লাগে আলফার মতো ? নাকি শুধু চলে যেতে চাইলেই আদ্রিতার ভালোবাসা উতলে উঠে ? আলফা বুঝে উঠতে পারে না, আজকাল হাড্ডিও খেতে যায় না সে । মাঝে মাঝে আদ্রিতাও হাড্ডি ছুঁড়ে দেয় না এখন । প্রতিরাতে অদ্ভুত এক সুরে আলফা কেঁদে ওঠে, আদ্রিতা’র কান পর্যন্ত সে আওয়াজ যায় না । আলফা বুঝতে পারে, তার কর্কশ ভাবে ঘেউ ঘেউ করা আদ্রিতা’র ভালো লাগে না । কিন্তু সে তো আদ্রিতা’র কাছাকাছি থাকার জন্যেই এমন করে ! দিন দিন সে আদ্রিতা’র কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । লেজ দিয়ে আলফা নিজের মুখ ঢেকে ফেলতে চায়, নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চায় ।

আজ সকাল থেকেই আদ্রিতা কাঁদছে কিন্তু আলফা ফিরে আসছে না । আলফা’র ঘরে ফেলে রাখা হাড্ডিটা, ওখানেই পড়ে আছে । কাঁদতে কাঁদতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে আদ্রিতা । স্বপ্নে আলফাকে খুঁজে পায় সে । অনেক উঁচু এক পাহাড়ের চুড়ায় দাড়িয়ে আছে আলফা । আদ্রিতা তার কাছে যায় । কিছুটা অবাক হয় সে, আলফা দেখতে পুরো মানুষের মতো হয়ে গেছে । দৌড়ে আলফাকে জড়িয়ে ধরে আদ্রিতা, চোখে পানি । মুখ তুলে আলফা’র চোখের দিকে তাকায় । প্রচণ্ড কষ্টভরা চোখে আলফা আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “হয়তো আমার কুকুর হয়ে বেঁচে থাকাটাই ভালো ছিল । তোমার অবহেলা সহ্য করতে হতো না, তোমাকেও আমার কারণে কষ্ট পেতে হতো না । মানুষের স্বরে ঘেউ ঘেউ শুনতে হতো না ।”

আলফা পাহাড় থেকে লাফ দেয় । ভেঙ্গে যায় আদ্রিতার ঘুম ।

 

 

 
——— জিহান আল-হামাদী————–
———২৩শে ফেব্রুয়ারি’২০১৫————-

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars ( votes, average: ৫.০০ out of ৫)
Loading...
জিহান আল হামাদী- র আরো পোষ্ট দেখুন