মেয়েটি এবং ছেলেটি

মেয়েটি বলল, আমাদের বারান্দা কিন্তু ডালিয়া আর ক্যাকটাসে ভরা থাকবে।
ছেলেটি বলল, আর কিছু থাকবে না ? বেলি, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা ?যাও, হাসনাহেনা আবার টবের মধ্যে হয় নাকি ?হয় না ?উঁহু। ..হাসনাহেনার গন্ধে কিন্তু সাপ আসে, জানো ?
শুনেছি, মানুষ বলে।আচ্ছা, আমি একটা সাপ পালবো। মেয়েটি বাচ্চাদের মতো আদুরে ভঙ্গিতে বলে।অ্যা ? সা-প! ছেলেটির হতভম্ব-মুখটি হয় দেখার মতো।হ্যাঁ। একটা বাচ্চা সাপ। আমার খুব শখ। জানো, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময়লিমন আমার জন্মদিনে একটা সাপ গিফ্ট করতে চাইছিল। কিন্তু বাসায় তো আর সাপ পুষতে পারব না, তাই নিতে পারি নাই। আমার অনেক মন খারাপ হইছিল তখন।তুমি সাপ পালতে চাও ! তোমার মাথার ঠিক আছে তো ?মেয়েটি ঠোঁটে একটু দুষ্টহাসি ঝুলিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করে, শোনো, সাপরে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। ওরা খুব শান্ত।সাপ শান্ত ? ছেলেটি ঢোক গিলতে গিয়ে সামলে নেয়। তারপর কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, কী সাপ ?এই ধর, অজগর হতে পারে আবার ছোটোখাটো অন্য প্রজাতির সাপও হতে পারে যেগুলো তেমন বিষাক্ত না। খুব উৎসাহ নিয়ে বলতে থাকে মেয়েটি।ছেলেটির এবার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা, তারপর সাপটা রাখবে কোথায় ?কেন ? ঘরে, কাচের জারের মধ্যে। ঘরের মধ্যে ? ছেলেটি ভীতস্বরে চেচিয়ে ওঠে, ভুরু দুটি তার প্রায় সাপের মতোই বেঁকে যায়, আমরা বিষাক্ত সাপ পাশে রেখে ঘুমাব ?আহা, বিষাক্ত হবে কেন ? নির্দিষ্ট সময় পরপর বিষদাঁত তুলে ফেলব না ?ছেলেটি কয়েক মুহূর্ত মেয়েটির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, যেন ব্যাপারটা হজম করতে চেষ্টা করছে। তারপর এক নিশ্বাসে বলতে শুরু করে, তুমি
কি আমারে বাড়িছাড়া করতে চাও ? দুধকলা দিয়ে তুমি কালসাপ পুষবা আর সেই সাপ ঘরের মধ্যে রেখে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাইতে পারব ? ঘুমের মধ্যে খালি স্বপড়ব দেখব আমার চারপাশে সাপ কিলবিল করতাছে। আমার গলা পেচাঁইয়া ধরতাছে। উহ, কী ভয়ংকর !ছেলেটির কথা শুনে মেয়েটি আগে একচোট হেসে নেয়। তারপর হাসি থামলে বলে, আচ্ছা, ঠিক আছে, তাহলে বারান্দায় রাখব।তোমার যেইখানে খুশি ওইখানে রাখো, আমার সাফ কথা তুমি যদি বাসায় সাপ পালো, ঐ বাসায়ই আমি ঢুকব না।
এটা একটা কথা হল ? আমার এতদিনের শখ..। আচ্ছা, তাহলে আমাদের যখন নিজেদের বাড়ি হবে তখন পালবো, কেমন ?ছেলেটি চুপ করে থাকে। মুখের ভাবে যেন বলছে, তখনকারটা তখন দেখা
যাবে।
মেয়েটি এবার হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে, জানো, আমার না খুব পাখিও পালার শখ একটা ময়না পাখি আমি ওকে কথা শিখাব। পাখি ? একটা সুন্দর পাখিকে তুমি খাঁচার মধ্যে পুরে পালতে চাও ? যেখানে
একটা পাখি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে পারে সেখানে তুমি একে ছোট্ট একটা খাঁচায়
বন্দি করতে চাও ? খাঁচার ভিতর তো এ উড়তেই ভুলে যাবে।
ও.. তাইলে, বারান্দায় ছেড়ে দিয়ে পালব। ধরো, বারান্দার পুরোটা নেট দিয়ে
খাঁচার মতো করে ফেলব, তাইলে অনেক বড়ো খাঁচা হবে।
তোমার যা বুদ্ধি ! বারান্দায় খাঁচা বানাইলে জামা-কাপড় শুকাইবা কোথায় ?
আর পাখি হেগে-মুতে বারান্দা নষ্ট করে দেবে না ? ওই গন্ধে ঘরে থাকা যাবে ?
ও..। মেয়েটির মুখটা হঠাৎ দুঃখী দুঃখী দেখায়।
তারপর জ্যোৎসড়বা রাতে বারান্দায় মাদুর পেতে শুয়ে তোমার যে চাঁদ দেখার
প−্যান, সেটা হবে কীভাবে ? আর বারান্দায় বসে চা খাওয়ার কথা না হয় বাদই
দিলাম।
মেয়েটি ছেলেটির কথা শুনে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। সে সরল চোখের
দৃষ্টি দেখে ছেলেটির মায়া হয়, বলে, শোনো, তুমি যা ভাবছ, এর জন্য আমাদের বহু
বছর অপেক্ষা করতে হবে। ঢাকার আশেপাশে একটা বড়ো জায়গা কিনে বাড়ি
করলে তখন তোমার মিনি চিড়িয়াখানাটা বানানো যায়।
মেয়েটির মুখ এবার খুশিতে ঝলমল করে, সত্যিই আমাকে মিনি চিড়িয়াখানা
বানিয়ে দেবে ? উহ, দারুণ হবে, আমি অনেক জিনিস পালবোÑ খরগোস, হরিণ,
বড়ো খাঁচা করে অনেক পাখিÑ
আরে, এখন এসব ভেবে লাভ আছে ? ভবিষ্যতে কবে টাকা হবে, কবে বিশাল
জমি কিনতে পারব তার নাই ঠিকÑ ছেলে না হইতেই হাজমের সাথে দোস্তি। হেঃ
তুমি নাÑ একদম রস-কষ নাই, ভবিষ্যতে হোক-না-হোক মনে মনে ভাবতে
দোষ কী ? ভাবতে কী ভালো লাগছিলÑ।
ও, ঠিক আছে, ভাবতে থাক, ভেবে মনে মনে সুখ পেতে থাক।
ছেলেটি মাথা ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক তাকায়। তার পায়ের কাছের ঘাসে
বিকেলের এক টুকরো রোদ শুয়ে আছে। ছেলেটি মাথা নিচু করে সেখান থেকে ঘাস
ছিঁড়তে শুরু করে।
সামনের মাসে ছেলেটি এবং মেয়েটির বিয়ে। দুজনের বাড়িতে কথাবার্তা
পাকাপাকি। যদিও দু পক্ষের পরিবার এত সহজে রাজি হয়নি। মেয়ের পছন্দের
কথা শুনে মেয়েটির বাপ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, হাজবেন্ড-ওয়াইফ সেম এইজ হইলে
কিছু সমস্যা হয়। যদিও এখন যুগ পাল্টাইছে, এইটা অনেকেই করে। কিন্তু আমি
ভাবতাছি আয়-রোজগারের কথা, ছেলে তো কেবল তোর সাথেই অনার্স করল, না ?
চাকরি কইরা আর কয় টাকা পাইব। কত ? বারো হাজার পায় ? বারো হাজার
টাকায় ঢাকা শহরে কী হয় ? ..যাউক, তুই ইউনিভার্সিটি পড়া শিক্ষিত মেয়ে, এখন
তো আর জোর করতে পারি না। নিজের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা নিশ্চয়ই তোর
হইছে। তুই সুখে থাকলেই আমাগো সুখ।
ছেলেটির বাপ শুনে প্রথমেই একটা ধমক দিয়ে বলেছিলেন, এত তাড়াতাড়ি
বিয়ে করার কী হইল ? তোর বিয়ের বয়স হইছে ? মাত্র চাকরি শুরু কইরাই পাখ
গজাইয়া গেছে, না ? তারপর খানিক চুপ করে থেকে গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞেস করেন,
মাস্টার্স দিবি না ?
ছেলেটি তাড়াতাড়ি জবাব দেয়, এই মাস্টার্স না, আমি ইভিনিং এমবিএ-তে
ভর্তি হব।
বাপ আর তেমন উচ্চবাচ্য করলেন না, এ বছর তিনি হজ্জে যাবেন ঠিক
করেছেন, যাওয়ার আগে ছেলের বিয়েটা দিয়ে যেতে পারলে মন্দ কী ! তাছাড়া
ধর্মেও আছে যুবক বয়সই বিয়ের উত্তম সময়। ছেলেমেয়ে দুজনেই যখন শিক্ষিত,
দুজনে মিলে রোজগার করলে খেয়েপরে ভালোই থাকবে।
বগুড়া নিবাসী ছেলেটির মা-বাবা ঢাকায় এসে মেয়েটিকে দেখে গেছেন।
মেয়ের সবই ঠিক আছে কেবল লম্বায় খাটো। কথাটা ছেলেকে তারা বলতে গিয়েও
বলেননি, আর বলে লাভ কী ? ছেলে নিজেই যখন পছন্দ করেছে।
নড়াইল থেকে মেয়ের মা-বাবাও ঢাকায় এসে ছেলেকে দেখে গেছেন। ছেলে
তাদের পছন্দ হয়েছে।
অবশেষে ছেলেটি আর মেয়েটির পাঁচ মাসের প্রেম সফল হতে যাচ্ছে। আগামী
মাসে ছেলেপক্ষের পনেরোজন গিয়ে বিয়ে পড়িয়ে একবারে বউ তুলে নিয়ে আসবে।
দু পক্ষ থেকেই কোনো অনুষ্ঠান করা হবে না।
ছেলেটি এবং মেয়েটি এখন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। তাদের চোখে শত শত
রঙিন প্রজাপতি। জীবনের সবচে রোমাঞ্চকর, আনন্দঘন এবং উত্তেজনাময় মুহূর্ত
এখন তারা পার করছে। ছেলেটি অফিস শেষে প্রতি সন্ধ্যায় দৌড়াতে দৌড়াতে
মেয়েটির হলে চলে আসে। দুজনে খুলে বসে তখন ভবিষ্যত-স্বপেড়বর ডালা।
মেয়েটি ছেলেটির হাত ধরে বলে, আচ্ছা, শোনো, আমরা যে বাসাটা দেখে এসেছি
না ? ওটা এখন ভালো লাগছে না। ছাদের ওপর কোনো বাসা খোঁজো না !
ছেলেটি একটু অবাক হয়। গতকাল দুজনেই আজিমপুরের বাসাটা পছন্দ করে
এল। আগামীকাল এডভান্স দিতে যাওয়ার কথা। আর এখন এমন কথা ! ছেলেটি
ভুরু কুঁচকায়, কেন ? ওটা সমস্যা কী ?
উহু, ওটা না। ছাদের ওপর রুম, এমন বাসা খোঁজো।
কেন ?
মেয়েটি খুব মিষ্টি করে হেসে লাজুকস্বরে বলে, যাতে বৃষ্টি এলে আমরা ভিজতে
পারি। ধরো, রাত্রে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে, আমরা ঘুমিয়ে আছি কিন্তু ঘুম আসছে না।
তখন ছাদে গিয়ে দুজনে মজা করে ভিজব। বৃষ্টিতে হাত ধরে দুজনে ওয়েস্টার্ন নাচ
নাচব।
ছেলেটির চোখ আর ঠোঁটের কোণে হাসির ঢেউ ওঠে, বাহ, দৃশ্যটা ভাবতেই
ভালো লাগছে। কিন্তু আমার হবু বউ ! ঢাকা শহরে চিলেকোঠার ঘর পাওয়া তো
সহজ কথা না। ছাদের ওপর যা-ও ঘর পাওয়া যায়, দেখা যায় ছাদে ঢোকার মুখে
দরজা লাগিয়ে বাড়িওয়ালা ছাদ তালা দিয়ে রাখে।
খুঁজলে নিশ্চয়ই খোলা ছাদের বাসা পাওয়া যাবে। আমার খালার বাসাই তো
এরকম।
এত মহা ফাঁপড়ে পড়লাম। দ্যাখো, ভাবতে অনেক কিছুই ভালো লাগে কিন্তু
সবকিছু কি করা যায় ? এই যেমন তুমি প্রায়ই বলতে ঝুম বৃষ্টিতে আমরা রিকশার
হুড ফেলে দিয়ে ঘুরব, একেবারে কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরব। কই ঘুরছো
একদিনও ?
মেয়েটি ঠোঁট টিপে হাসে, আহা, আমি তো চাই, কিন্তু রিকশায় এরকম
কাকভেজা হয়ে ঢং করে বেড়ালে রাস্তার মানুষগুলা তো বেহায়ার মতো তাকিয়ে
থাকবে, মানুষ অসভ্যের মতো আমার ভেজা শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকুক সেটা
দেখতে তোমার খুব ভালো লাগবে না ?
ইম্পসিবল, যে তাকাবে একেবারে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেব না। আমার
জানকে দেখার অধিকার কেবল আমার। আমিই রসিয়ে রসিয়ে দেখব, একেবারে
খুলে খুলে দেখব-
এই এই, খবরদার খারাপ কথা বলবে না। ফাজিল ছেলে ! মেয়েটি শাসানোর
ভঙ্গি করে।
ছেলেটি মজা পায়, মেয়েটির কথা শুনে হেসে ফেলে। মেয়েটিও হাসিতে যোগ
দেয়। তারপর দুজন দুজনের দিকে খানিক চুপ করে চেয়ে থাকে, যেন পরস্পরের
চোখে তারা তাদের ভাবনার জীবন্ত ছবি দেখছে।
মেয়েটি একটু বাদে হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়েছে ভঙ্গিতে বলে, আচ্ছা, আমি
তো ভালো রানড়বা করতে পারি না, তুমি খেতে পারবে তো ? পরে আবার রানড়বা খারাপ
হলে বকবে না তো ?
ছেলেটি চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, তোমাকে বকবো আমি ? এমন কথা তুমি
বলতে পারলে !
উহু, যদি বকো ?
কক্ষনো না। বকবো কেন ? আমরা তো কেবল ভালোবাসাবাসি করব। আর
রানড়বা তুমি একা করবে কেন, আমিও করব। ধরো, সকালে ও দুপুরে তুমি রানড়বা
করবে আর সন্ধ্যায় আমি অফিস থেকে এসে দুজনে মিলে রানড়বা করব।
আচ্ছা, ছুটির দিনে আমরা কী করব ? কোথাও ঘুরতে বের হবো না ?
আবার জিংগায় ! অবশ্যই।
কোথায় যাব ?
এই কাছাকাছি কোথাও যেখানে গেলে খরচ অল্প। যেমন ন্যাশনাল পার্ক,
সোনারগাঁ, চিড়িয়াখানা, লালবাগ কেল−া, তারপর নভোথিয়েটার, জাদুঘরে যাওয়া
যায়, বেইলি রোডে নাটক দেখতে যাওয়া যায়। এরকম জায়গাগুলাতে আর-কি।
অথবা কোনো কোনো সপ্তায় আমরা বাসায় থেকে মুভি দেখব, সারাদিন গল্প করে
কাটাব।
বাহ, দারুণ মজা তো। ভাবতেই কী এক্সসাইটিং লাগছে ! জীবনটা কত সুন্দর
তাই না ?
জীবন তো সুন্দরই। সুন্দর করে সাজাতে হয়, উপভোগ করতে জানতে হয়।
হুম্, উপভোগ। মেয়েটি বিড়বিড় করে বলে। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখে।
হল সংলগড়ব রাস্তায় তাদের মতো আরো অনেক জুটি বসে আছে। ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে
গল্প করছে, হাসছে। ঝালমুড়ি, ফুসকা, আইসμিম খাচ্ছে। ওরাও কি বিয়ের পর
জীবনটা এইভাবে উপভোগ করবে ?
এই, কী ভাবছ ? ছেলেটি মেয়েটিকে মৃদু নাড়া দেয়।
নাহ, কী ভাবব ? মেয়েটি ছেলেটির চোখে চোখ রাখে।
আচ্ছা, আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠব কয়টা বাজে ? ছেলেটি জিজ্ঞেস করে।
এই, সাতটা।
কে আগে উঠবে, আমি না তুমি ?
যেই আগে উঠুক সে উঠে প্রথমে চা বানাবে, তারপর আরেকজনকে ডাকবে।
মানে বেড-টি ?
হু। ধরো, আমি যদি আগে উঠি, উঠে আগে চা বানানো শেষ করে তারপর
তোমাকে জাগাব, কানের মধ্যে কু দেব।
কী দেবে ? ছেলেটি ভ্রু কুঁচকায়।
কু। মেয়েটি হেসে ফেলে। ছেলেটির কানের কাছে মুখ এনে দেখায়, এই যে
এইভাবে। কু-ও।
ও-হহো।
দুজনেই শব্দ করে হেসে ওঠে।
হাসি থামলে দুজনে খানিক চুপচাপ। মেয়েটি ছেলেটির উরুতে আঙুল দিয়ে
আঁকিবুঁকি কাটতে থাকে। এক সময় ছেলেটির হাতের ওপর আলতো করে হাত
রাখে, আঙুলের ফাঁকে আঙুল গলিয়ে দিয়ে মৃদু ডাকে, এইÑ।
কী ?
মেয়েটি কিছু বলে না। মাথা নিচু করে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল মাটিতে ঘষতে
থাকে।
কী, বল ?
না, বলব না। লজ্জা লাগছে।
লজ্জা ? ছেলেটি কৌতূহলী চোখে মেয়েটির মুখ পড়তে শুরু করে। তার হবু
বউ তাকে কী কথা বলতে চায় যার জন্য লজ্জা পাচ্ছে ?
বল।
উহু, না। তুমি কী মনে করÑ।
আহা, মনে করার কী আছে ? বলো তো। ছেলেটি অভয় দেয়।
মেয়েটি ছেলেটির দিকে লাজুক চোখে তাকিয়ে কী দেখে, তারপর পলকে চোখ
নামিয়ে ফেলে, না, আমি বলতে পারব না, লজ্জা করে।
আহা, লজ্জার কী আছে ? কদিন পরই তো আমরা স্বামী-স্ত্রী হয়ে যাব, লজ্জা
পেলে চলবে ? বল। মেয়েটি ছেলেটির চোখে তাকিয়ে সময় নিয়ে প্রায় ফিসফিসিয়ে
বলে, বিয়ের পর আমরা বাবু কবে নেব ?
কথাটি শুনে ছেলেটি তাজ্জব হয়ে গেলেও ভিতরে একটা মৃদু শিহরন বয়ে যায়।
মনে মনে হেসে ওঠে। ঠোঁটের কোণেও অজান্তেই একটা দুষ্ট-হাসি ঝুলতে শুরু
করে। এ কারণেই বলা হয় নারীর পূর্ণতা মাতৃত্বে। বিয়ে হওয়ার আগ থেকেই
কাচ্চা-বাচ্চার চিন্তা শুরু হয়ে গেছে।
কী ? কথা বলে না কেন ? মেয়েটি ছেলেটিকে হালকা নাড়া দেয়।
ছেলেটি কিছু বলে না, কেবল মিষ্টি হাসে।
এই, হাসবে না খবরদার।
হাসবো না তো কী করব ? বিয়ে না-হতেই আণ্ডা-বাচ্চার চিন্তা শুরু হয়ে গেল !
র্ধু। আমি তো ভবিষ্যতের কথা বলেছি।
সেই ভবিষ্যতের চিন্তাটা আরো পাঁচ বছর পর করা যাবে।
নয় মাস পর।
‘সংসার জীবনের প্রথম ডায়েরি লিখছি। এতদিন যে প্রয়োজন পড়েনি তা নয়,
মনে লিখা ভাবনাগুলো কেন যে কাগজে স্থান পেল না ! দীর্ঘদিন পর আজ যখন
আবার শুরু করলাম, কীভাবে আরম্ভ করব বুঝতে পারছি নাÑ আজ তোমাকে খুব
দূরের কেউ মনে হচ্ছে…
না, আমি তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করব না, এ ডায়েরি কোনো
অভিযোগলিপি নয়। আমার একান্ত অনুভূতিগুলোই এ ডায়েরিকে বলছি। জীবনটাকে
কখন যেন প্রাঞ্জল ভাবতে শুরু করেছিলাম কিন্তু ভাবনার গালে এত জোরে চড়
পড়বে বুঝতে পারিনি। একত্রিত জীবন শুরুর আগে তুমি আমাকে যে স্বপড়বগুলো
দিয়েছিলে সেগুলো কোথায় ? কোনোকিছু পাওয়া হয়ে গেলে তার আবেদন আর
আগের মতো থাকে না, সেই যে কবিতার লাইনটা মনে পড়ে ? Ñমানুষ এমন তয়,
একবার পাইবার পর নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর। আগে আমাকে
সময় দিতে তোমার কোনো সমস্যা হত না। এখনÑ হয় তুমি অফিস, এমবিএ বা
অন্যান্য কাজে বাইরে ব্যস্ত থাক, নয়ত যখন বাসায় আস পড়াশুনা বা পত্রিকা
পড়াতে ব্যস্ত থাক ; আমাকে দেয়ার মতো বিন্দুমাত্র সময়ও তোমার হয় না।
এমনকি ভালো করে কথা বলারও অবকাশ তোমার নেই। বর্তমান সময়গুলোতে শুধু
জৈবিক প্রয়োজন হলেই আমার কথা তোমার স্মরণ হয়। একবারও কি ভাবো না,
একবারের জন্যও কি তোমার মনে প্রশড়ব জাগেÑ আমার দিনগুলো কেমন যায় ?
রাতগুলো কেমন কাটে ! একজন মানুষ যে তোমার সাথে বাস করছে এটা তোমার
খেয়াল থাকে ? নাকি তোমার ধারণা এখানে তুমি একাই প্রাণী !
এখন আটটা বাজে। হয়ত আর কিছুক্ষণের মধ্যে তুমি বাসায় চলে আসবে।
কাপড় ছেড়ে চা খেয়েই বই-খাতা নিয়ে বসবে, রাতে কখন ঘুমাবে জানি না।
সকালে উঠে সেই একই নির্ঘণ্ট..। আলবেয়ার কামুর আউসাইডার বইটা পড়েছ
তুমি ? শনিবার, রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার, বৃহস্পতিবার, শুμবার।
আবার শনিবার, রবিবার… উহ, কী একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন গতানুগতিক জীবন !
ভেবো না আমি চাই সবসময় তুমি আঠার মতো আমার সাথে লেগে থাক, তবে
যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু তো দেয়া উচিত। যাহোক, অনেক চেষ্টা করছি এ জীবনে
অভ্যস্ত হতে কিন্তু পারছি না। প্রচণ্ড কষ্ট হয়। বন্ধু-বান্ধবও এখন কেমন পর পর
আচরণ করে। সবার থেকে বিচ্ছিনড়ব হয়ে আমি কেমন অবস্থানে আছি, এটা তুমি
জানো ? একে নিঃসঙ্গতা বলে না, তার চেয়েও আরো ভয়ংকর কিছু !…’
টিং-ডং।
দরজার কলবেল বেজে উঠল। ছেলেটি এসে পড়েছে নিশ্চয়ই। মেয়েটি ডায়েরি
বন্ধ করে দরজা খোলার জন্য উঠল।
ছেলেটি ঘরে ঢুকেই ফ্যানের স্পিড ফুল করে দিল। তারপর কাপড় ছাড়তে
ছাড়তে বিরক্ত-মুখে বলল, কী ব্যাপার, ঘর এত বালি বালি কেন ? ঝাড়– দেও নাই
আজকে ?
মেয়েটির মুখ হঠাৎ গোমড়া হয়ে যায়। ছেলেটি সারাদিন পর বাড়িতে ফিরে
কোথায় তাকে হাসিমুখে জড়িয়ে ধরবে, ভালোমন্দ দু-একটা কথা বলবে, তা-না
এসেই ঘর ঝাড়–র কথা ! যেন বউ বিয়ে করে আনা হয়েছে কেবল ঘরের কাজকাম
করার জন্য। মেয়েটির মেজাজ খারাপ হল, বলল, আজকে না, কাল-পরশুও ঝাড়–
দেই নাই।
কেন ?
প্রত্যেকদিন আমি ঝাড়– দিতে পারব না ; ঘর মোছা, ঝাড়– দেয়া খুব কষ্টের
কাজ।
কষ্টের কাজ তো সবই। দুনিয়াতে আবার আরামের কাজ কোনটা ?
সগতোক্তির মতো বলতে বলতে ছেলেটি হ্যাঙ্গারে শার্টটা ঝুলাতে গিয়ে থেমে যায়,
মাথা ঘুরিয়ে বিস্ময় মাখানো গলায় বলে, একি ! জামা দুইটা ইস্ত্রি কর নাই ?
সকালে না বলে গেলাম।
মেয়েটি আহত কণ্ঠে বলে, তোমার আর কোনো কথা নাই, সারাদিন পর
অফিস থেকে বাসায় আসছ কী আমারে বকা দেওয়ার জন্য ?
আশ্চর্য ! বকার কী দেখলা ? কথার পিঠে কথা বললাম।
মেয়েটির মন খারাপ হয়। চুপ করে যায়।
মেয়েটির নীরবতা দেখে ছেলেটির রাগ লাগে। একটু জোরে কথা বললেই নাকি
সেটা বকা। কী আজব মানুষরে বাবা। কথা বলাই বন্ধ করে দিতে হবে।
মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে বিছানার এক কোণে বসে আছে। ছেলেটি যথাসম্ভব শান্ত
গলায় বলল, তুমি তো সারাদিন বাসায়ই থাক। সামান্য রানড়বা-বানড়বা ছাড়া তো তেমন
কোনো কাজ নাই। ..একটু না-খাটলে শরীর আরো ফুলে যাবে না ? এমনিতেই
বিয়ের পরÑ।
ছেলেটি কথাটা শেষ করে না, মেয়েটি ঝাঁ করে কঠিন চোখে সরাসরি
তাকাতেই ছেলেটি থেমে যায়। প্রচণ্ড রাগ লাগে মেয়েটির, রানড়বা-বানড়বা খুব সামান্য
কাজ ? তাছাড়া সাইনাসের সমস্যার কারণে ধুলাবালি, পানি একটু বেশি লাগলেই
ঠাণ্ডা লেগে মাথা ব্যথা শুরু হয়। ছেলেটি এটা জেনেও এমন কথা বলে কীভাবে ?
মেয়েটি তীক্ষè কণ্ঠে বলে ওঠে, আমারে বিয়ে করছো কেন ? এরচে একটা কাজের
বুয়া বিয়া করতা। সব কাজ ঠিকঠাক মতো করে রাখতো।
কী ? ছেলেটির মুখ হা হয়ে যায়। মুখে কথা ফোটে না। হতভম্ব-চোখে বিয়ের
আট মাস পরে স্ত্রীকে নতুন করে চেনার চেষ্টা করে।
ছেলেটির চোখের সামনে মেয়েটি গট গট করে হেঁটে রানড়বাঘরে ঢুকে যায়।
ধাতব পাত্রের টুং টাং আওয়াজ আসতে থাকে। সেই শব্দে ছেলেটির হুশ্ ফিরে।
একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে সে বাথরুমে যায় হাতমুখ ধুতে।
কিছুক্ষণ পর মেয়েটি টেবিলে ঠক করে চা-বিস্কুটের ট্রে রেখে বলে, চা দিয়েছি।
ছেলেটি তখন অফিস-ব্যাগ খুলে কাগজপত্র বের করছিল। শব্দটা কানে যেতেই
একবার চোখ তুলে তাকায়। টেবিলে ট্রে রাখার শব্দটা আজকে অন্য রকম, ঝামটা
মেরে রাগ প্রকাশের মতো।
মেয়েটি গুটি-পায়ে বিছানার ধারে চলে যায়। একটা ইংরেজি নভেল খুলে
বিছানায় উঠে আধশোয়া হয়ে পড়তে শুরু করে।
ছেলেটি একবার চোখ ঘুরিয়ে মেয়েটিকে দেখে আরেকবার চায়ের ট্রে-টা দেখে,
তারপর নিজের কাজে মন দেয়।
খানিক বাদে মেয়েটি বইয়ে চোখ রেখেই বলে, চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
খাব না। জবাবে কৃত্রিম রাগ ছেলেটির।
বললেই হল ? একটু থেমে মেয়েটি ছেলেটির দিকে তাকায়। ভিতরে ভিতরে
একটা দুষ্ট-হাসি নিয়ে মেয়েটি বলে, আমার সাথে মেজাজ খারাপ কর ভালো কথা।
চায়ের সাথে মেজাজ দেখানোর কী হল ? খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি, ক্ষুধা লাগছে না ?
আমার ক্ষুধা লাগলে কার কী ? আমি তো কারো কেউ না। দু চক্ষের বিষ।
মেয়েটির ভিতরের দুষ্ট-হাসিটা এবার মুখে চলে আসে। বইটা বন্ধ করে ওঠে
সে। ছেলেটির সামনে দাঁড়ায়। হাত টেনে বলে, আসো।
ছেলেটি হাত সরিয়ে দেয়, লাগবে না। তোমার চা তুমিই খাও। আমি কে ?
আমারে তো হ্যায় দেখতেই পারে না।
মেয়েটি চট করে চোখ বন্ধ করে অন্ধের মতো শূন্যে হাতড়ে বলে, কই, হ্যায়
কই ? কোথায় ? আমি হ্যারে দেখতে পারতাছি না।
এবার ছেলেটি নিঃশব্দে হেসে ওঠে।
মেয়েটি চোখ খুলে ছেলেটির চোখে চোখ রাখে। দুজনের ঠোঁটের কোণেই
তখন হাসির ঢেউ।
মেয়েটি ছেলেটিকে বিস্কুট খাইয়ে দিতে দিতে হঠাৎ মনে পড়েছে সুরে বলল, ও, এই
শুμবারে না বাড়িওয়ালার নাতির জন্মদিনের অনুষ্ঠান হবে। দুপুরে দাওয়াত দিয়ে
গেছে।
তাই নাকি ? ..মাসের শেষে এমনিতেই টানাটানি তার উপর দাওয়াত। অনুষ্ঠান
হবে কোথায় ?
ছাদের ওপরে।
এ তো আরেক ঝামেলা। বাসায় থেকে না গেলে খুব খারাপ দেখাবে।
হু।
ছেলেটি চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, এক কাজ করলে কেমন হয়, সকালের দিকে
বাইরে বেরিয়ে একেবারে বিকাল কাটিয়ে বাসায় ফিরব। ব্যস অনুষ্ঠান খতম।
হে হে হে, কোথায় যাবে ?
যাব কোথাও, যেখানে গেলে তেমন খরচ নাইÑ চিড়িয়াখানায় যাওয়া যায়।
তারপর, দুপুরে খাবে কী ?
বাসা থেকে নুডুলস্ রানড়বা করে আর ডিম সিদ্ধ নিয়ে যাবে। দুপুরের রাজকীয়
খানা হয়ে গেল।
তা না হয় হল কিন্তু তার পরের শুμবারে যে খালার বাসায় দাওয়াত আছে,
সেটা মনে আছে তো ? ওইটা কিন্তু বাদ দেয়া যাবে না।
উফ্। ছেলেটি হতাশার নিশ্বাস ছাড়ে, সব মুসিবত দেখি এই মাসে। এই মাসে
টাকার সমস্যা আর এই মাসেই খালি দাওয়াত আসে।
খালা দাওয়াত দিয়েছে গত মাসে। আর দাওয়াতটা তুমিই রাখছিলা।
ছেলেটি চুপ করে যায়। ভেতরে ভেতরে মেজাজ খিচড়ে উঠছে তার। কেন যে
বিয়ের পর সব আত্মীয়স্বজন নতুন জামাই-বউকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর
প্রতিযোগিতায় নামে ! কাউকে না-ও করা যায় না। একটা দাওয়াতে যাওয়া মানেই
চার-পাঁচশো টাকার মামলা।
এই, আসো না, আর কতক্ষণ ? মেয়েটি মশারির ভিতর থেকে ছেলেটিকে ডাকে।
ছেলেটি টেবিলে বই খুলে ক্যালকুলেটার টিপে খাতায় ম্যাথ করছে। মেয়েটির
ডাক শুনে একটু বাদে সাড়া দেয়, এই তো আর দশ মিনিট।
তোমার দশ মিনিট করতে করতে তো এর মধ্যে আমি থালা-বাসন ধুয়ে
ফেললাম, দাঁত ব্রাশ করলাম, মশারি টানালামÑ আর তোমার দশ মিনিটই শেষ হয়
না।
আমি তো আর তোমার মতো সারাদিন বাসায় থাকি না, রাতেই যা একটু
পড়ার সময় পাই। এখন না পড়লে পড়বো কখন ?
সকালে উইঠা পইড়ো, এখন আসো। বারোটা বাজে।
সকালে উঠতে দেরি হয়ে যায়, তখন সময় থাকে না। ..আর তুমি ঘুমাও না,
তোমার অসুবিধা কী ?
মেয়েটি মুখে বিরক্তি সূচক শব্দ তোলে, লাইট জ্বালানো থাকলে আমার ঘুম
আসে না, জানো না ?
উহ্। আচ্ছা ঠিক আছে, দাঁড়াও, এবার সত্যি সত্যি দশ মিনিট।
মেয়েটি ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে। কে জানি বলেছিল বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর
সম্পর্ক অনেকটা ভাইবোনের মতো হয়ে যায়। কথাটা একেবারে ভুল না। বিয়ের
আগে দুজনে যখন একসাথে ঘোরাঘুরি করত, কী অদ্ভুত এক ভালো লাগা, বুকের
ভিতরে চাপা উত্তেজনা কাজ করতÑ হাতে হাত রাখলে, পাশাপাশি শরীরের স্পর্শে,
চোখে চোখ রাখায় কী অদম্য আকর্ষণ ! আর এখন ! পাশাপাশি জড়াজড়ি করে শুয়ে
থাকলেও ভিতরে বয়ে যায় শীতল নদী। হাতে হাত রাখায়, ঠোঁটে ঠোঁট রাখায় নেই
সেই রোমাঞ্চ। যেন জানার নেই আর কিছু, সবই বহু-আবিষ্কৃত।
আচমকা সবকিছু অন্ধকার।
ছেলেটি বাতি নিভিয়ে মশারির ভিতরে ঢুকল। মশারি গুঁজে সটান শুয়ে একটা
লম্বা শ্বাস ফেলে ছেলেটি।
মেয়েটি কোলবালিশের মতো ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে। ছেলেটি একটি হাত
মেয়েটির পিঠে রাখে।
একটা গল্প বল। মেয়েটি বাচ্চাদের গলায় বলে।
গল্প ? ছেলেটি হাসার চেষ্টা করে, তুমি কি বাচ্চা নাকি, তোমারে গল্প বলব ?
হু, আমি বাচ্চা, বল গল্প, বল।
ধুর, আমি গল্প পারি না।
তাইলে এমেড়ব কিছু বল।
কী বলবো ? ছেলেটি ক্লান্ত-শ্বাস ফেলে।
কী বলবা মানে ? আমার সাথে তোমার বলার কিছু নাই ? সব কথা শেষ ?
কী বলবো ? তারচে তুমি কিছু বলো, আমি শুনি।
মেয়েটি হতাশ হয়ে শ্বাস ফেলে। মেয়েটি জানে সে কথা বলা শুরু করলে
ছেলেটি কিছুক্ষণ জবাবে ‘হু হা’ করবে, তারপর একসময় চুপ হয়ে যাবে। তখন
কেবল নিরবচ্ছিনড়ব্ নিশ্বাসের শব্দই ভেসে আসবে।
মেয়েটি ছেলেটিকে নাড়া দেয়, এই আমারে ছায়ানটে ভর্তি করাবা না ?
হু।
ওদের ফর্ম ছেড়েছে, বুঝছো ? তাইলে আমি ফর্ম নিয়ে আসবো নে।
তোমার ইচ্ছা। আমি কি বলবো ? ..তবে আমার মতামত কি শুনবা ? এই
বয়সে এই সময়ে গান শিখতে যাওয়া মানে সময়ের অপচয় করা। ..সবকিছুরই
একটা সময় থাকে, তাই না ?
মেয়েটি আহত গলায় বলে, তার মানে তুমি চাও না আমি গানে ভর্তি হই ?
বুকের গভীর থেকে একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে মেয়েটি। বিয়ের আগে দেখা
সমস্ত স্বপড়বগুলোই একে একে ভেঙে চুড়ে যাচ্ছে। নতুন সংসারের নতুন বাসার
বারান্দার ছবি সে কতদিন মনে মনে কল্পনা করেছিল। আর এ বাসায় যে বারান্দাটা
পেয়েছে সেটা না থাকার মতোই। রাস্তার সাথে বাসা হওয়ায় সেখানে প্রতিদিনই
রাজ্যের ধুলা জমে। বারান্দায় গিয়ে একটুক্ষণ দাঁড়ানোরও উপায় নেই, রাস্তার
লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বেলি আর গোলাপের দুটি টব সেখানে রাখা
হয়েছিল। গোলাপ গাছটি একসময় মারা যায় আর বেলিটি মরা ডাল হয়ে এখনো
টিকে আছে।
শুμবারে তাদের আর ঘুরতে যাওয়া হয় না। ছেলেটি বলে, সারা সপ্তাহ বাইরে
বেরিয়ে আমি ক্লান্ত, একটা দিন বাসায় রেস্ট নিতে দাও। মেয়েটি মেনে নেয়। যাক,
সারাটা দিন ছেলেটিকে তার চোখের সামনে পাবে, ঘুরতে যাওয়ার চেয়ে এই
ভালো। তাছাড়া ঘুরতে বেরিয়ে টাকা-পয়সার টানাটানির মধ্যে ফেলে লাভ কী ?
মেয়েটি খোঁজার চেষ্টা করে বিয়ের পর তার কোন আবদারটা ছেলেটি রেখেছে।
কিছুই না, সব শূন্য।
মেয়েটির দীর্ঘশ্বাসের ঢেউ ছেলেটিকে স্পর্শ করে। ছেলেটি মেয়েটির মাথায়
হাত বুলিয়ে বলে, শোনো, সময় বাস্তবতা মানুষকে অনেক কিছু করতে বাধ্য করে।
তোমার সাথে আমিও তো বিয়ের পরের সংসার নিয়ে কত স্বপড়ব দেখেছিলাম, আর
আজ, টিকে থাকার সংগ্রামে নেমে সব ধূসর হয়ে গেছে। অর্থ আর সময়ের সংকটের
কাছে নগরের মানুষ খুব অসহায়।
থাক, বাদ দাও এসব কথা, আসো ঘুমাই। মেয়েটি বলে ওঠে।
ছেলেটি টের পায় মেয়েটির বিরক্তি। কপালে চুমু খেয়ে বলে, জীবনের ওপর
হতাশ হও ক্যান ? জীবনটা মনের মতো চালাতে হলে চাই সচ্ছলতা। আমরা তো
এখন সচ্ছল নই। আমার একার সামান্য ইনকামে কোনোরকম চলে যাচ্ছে। তোমার
মাস্টার্স শেষ হলে আর আমার এমবিএ-টা শেষ হলে ভালো চাকরি-বাকরি পেয়ে
জীবনটা ইচ্ছেমতো সাজানো যাবে। তখন অনেক স্বপড়বই সহজে পূরণ হয়ে যাবে।
হু। মেয়েটির কণ্ঠে চাপা শে−ষ, আমার কি মনে হয় জানো, সচ্ছলতা-
অসচ্ছলতার ব্যাপার না, সব মানুষেরই এমন কিছু স্বপড়ব থাকে যেগুলো কখনো পূরণ
হয় না, মানুষ জানে ওসব হয়ত কখনো পূরণ হবে না, তবুও মানুষ ওসব পাওয়ার
আশা করে, ভেবে সুখ পায়।
হয়ত তাই। ছেলেটি মেয়েটির কথায় সায় দেয়, থাক এসব ভারি আলোচনা,
আসো আমরা ঘুমাই।
ছেলেটি মেয়েটিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটি ছেলেটির কাঁধে মাথা
রেখে চোখ বোজে। সব স্বপড়ব চোখে নিয়ে দুজনেই তখন ঘুমানোর চেষ্টা করে।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
রাহাদ আবির- র আরো পোষ্ট দেখুন