এই চিঠিটিও পোস্ট করা হয়নি

স্যার,
স্যরি স্যার। আমি সেদিন আপনাকে তুমি বলে ফেলেছিলাম। একটু কড়া স্বরেই বলেছিলাম, তোমার না গেলেও চলবে। তুমি কত বড় বাহাদুর আমার জানা আছে। আপনি হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। আপনি বোধ হয় ভাবতে পারেননি আমি এতটা বেয়াদবি করতে পারব। দুনিয়ার সবাইকে তুমি বলা যায়, কিন্তু স্যারকে বলার প্রশ্নই আসে না। তার ওপর আপনার মতো এমন একজন গম্ভীর মানুষকে। অবশ্য আমি জানি বাবা-মা ছেলের জন্য হাসিখুশি টাইপের টিচার রাখলেও মেয়ের জন্য তাঁদের চাওয়া গুরুগম্ভীর টিচার। তাঁদের ধারণা, গম্ভীর টাইপের পুরুষ মানুষ প্রেম-ট্রেম বোঝে না।
আমি যে আপনাকে তুমি বলেছি সে জন্য খুব স্যরি। আমার মুখে তুমি শুনে আপনার মুখটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেল। চা খাচ্ছিলেন। আধকাপও খাওয়া হয়নি। কাপটা নামিয়ে রেখে আপনি আমার দিকে একটুখানি তাকালেন।
আমি ভেবেছিলাম রেগেমেগে আপনি তখনই বেরিয়ে যাবেন এবং বলবেন, বেয়াদবির মাত্রা থাকা চাই। তোমার বাবাকে জানিয়ে দেবে কাল থেকে আর আসছি না।
আপনি বলেননি। আপনি জানেন না মেজাজ খারাপ হলে আমি যাচ্ছেতাই কথা বলতে পারি। আমার মুখে কথা তৈরিই ছিল। আমিও বলে দিতাম, আপনার মতো বাজে টিচার না এলে আমার বয়েই গেল। এখনই চলে যান, রাইট নাও। আপনার চেয়ে ভালো টিচার প্রাইভেট পড়ানোর জন্য ঘুরঘুর করেন। তাঁদের কেউ কেউ দেখতে আপনার চেয়ে ভালো, ব্যবহারও মিষ্টি, ভুতুম পেঁচার মতো কেউ গম্ভীর হয়ে থাকেন না।
আপনাকে এসব কথা আমার বলতে হয়নি।
স্যার, আপনি কি দুপুরে কিছু খাননি? আপনাকে হাফপ্লেটে একটা রসগোল্লা, পোড়াবাড়ির চমচম, একটা কালোজাম আর নিমকি দেওয়া হয়েছিল। সবই খেলেন, ভদ্রতা করেও তো একটা রাখতে পারতেন।
প্রাইভেট টিউটরকে চা-বিস্কুট ছাড়া আর কী-ই বা দেওয়া হয়। কদাচিৎ একটা কি দুটো মিষ্টি। আমার কথার পর আপনি চায়ে চুমুকও দেননি। গম্ভীর হয়ে চুপচাপ বসেছিলেন। আমি স্পস্ট দেখেছি, চায়ের ওপর দুধের হালকা সর পড়েছে। রংটা বাদামি।
শুরুতে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিসের মিষ্টি?
যেন অকারণে মিষ্টি খাওয়া যায় না, জানতে হয় কিসের মিষ্টি। আমি বললাম, এটা পাত্রী দেখার মিষ্টি। আমাকে দেখতে এসেছিল। পাত্রপক্ষ টাঙ্গাইল ধনবাড়ীর জমিদারদের বংশধর। অনেক মিষ্টি এনেছে।
ভ্রুকুঁচকে আপনি বললেন, চমচম এনেছে? বাহ্ বেশ তো!
পাত্রের ফুপা আমাকে তিনটি প্রশ্ন করেছিলেন: আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান-এর আরবি কী? ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল-এর ইংরেজি কী? পাক সার জমিন সাদ বাদ কে লিখেছেন?
স্যার, একটা প্রশ্নও আমার কমন পড়েনি। আপনি যে কী পড়ান, কিছুই কাজে লাগে না। পাত্রের ফুপা আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমি আমার স্বামীকে খাওয়াইব-এর ইংরেজি কী?
আমিও ঝটপট বলে ফেললাম, আই শ্যাল ইট মাই হাজব্যান্ড। শুনে হাবাগোবা টাইপের পাত্রটাও ফিক করে হেসে ফেলল। আমার বড় মামা রেগে গিয়ে বলল, ভাইসাহেব, চাকরির ইন্টারভিউ নিচ্ছেন নাকি?
আপনি কিন্তু তখনো মিষ্টি খেতে শুরু করেননি। বড় মামা মুখ খোলার পর পাত্রপক্ষের হেড এক্সামিনার মুখ বন্ধ করলেন। আপনার ধারণা আছে কি না জানি না, পাত্রী দেখতে গেলে মিষ্টি নেওয়া বাধ্যতামূলক, পছন্দ হোক বা না হোক পাত্রীর হাতে কিছু নগদ টাকাও দিতে হয়।
স্যার, আমাকে দিয়েছে পাঁচ শ টাকা।
আপনি বললেন, হু।
হু মানে কী? পাঁচ শ টাকা দেওয়ায় আপনি খুশি হয়েছেন না দুঃখ পেয়েছেন, আপনার বিদঘুটে কণ্ঠে হু শুনে আমার পক্ষে তার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা সম্ভব নয়।
শোনেন স্যার, মাস্টারি আর পণ্ডিতি দিয়ে দুনিয়া চলে না। সংসারের বুদ্ধির ধরনটা ভিন্ন। এটা প্রাইভেট টিউটর কখনো শেখাতে পারেন না। ১০০ টাকার ১০ নোট থেকে হেড এক্সামিনার দুইটা ময়লা নোট এক হাতে দলা করে আমার হাতে উঠিয়ে দিলেন। আমি তখনই বুঝে গেছি পাত্রপক্ষ কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাওয়ার সময় বলে যাবেন, মেয়ে তো ভালোই, আমরা বাড়ি ফিরে দু-এক দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেব। চিন্তা করবেন না।
স্যার, আপনি বলবেন, তুমি কি টাকা গোনার সময় হাঁ করে টাকার দিকে তাকিয়েছিলে? তা ছিলাম না। কিন্তু আমি জানি, পুরো ১০টা নোটই আমার জন্য এনেছিলেন। পছন্দ হলে হাজার দেবেন, না হলে দুই শ। বাসা থেকে বেরিয়ে পাত্রপক্ষ আমার বড় মামাকে বলেছেন, মেয়ের সবই ঠিকই আছে, তবে খাটো। পোলাপানগুলো তো হবে লিলিপুট।
ভাগনির মান বাঁচাতে বড় মামাই মুখের ওপর বলে দিলেন, বলে ভালো করেছেন। আপনাদের ছেলে তো দেখতে সিনেমার রবিউলের মতো। খুকু বেচারার জীবনটা দুর্বিষহ করে ফেলত।
পাত্রের বড় বোন বললেন, বলেন কী! এই অবস্থা। মেয়েমানুষ এমন হলে ঘর-সংসার করবে কেমন করে?
বড় মামা বললেন, আমিও তো তা-ই বলি। খুকুর যে মেজাজ কেমন করে ঘর করবে? আপনাদের রবিউল বড় বাঁচা বেঁচে গেল।
বড় বোন ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, আমার ভাইয়ের নাম রবিউল নয়, শরাফত। চৌধুরী মুহাম্মদ শরাফত।
আপনি তখনো মিষ্টি মুখে তোলেননি। গাম্ভীর্য ধরে রেগে আপনি বললেন, ফলাফল কী?
আমি বললাম, খুকুকে রিজেক্ট করেছে। মনে হলো আপনি খুব খুশি হয়েছেন। গম্ভীর মানুষের ঠোঁটে একটু হাসি ফুটলে কী যে বিতিকিস্তিরি দেখায়। ওমা, আমাকে যে প্রত্যাখ্যান করেছে ভাব দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুবই আনন্দ পাচ্ছেন। অমনি মিষ্টি খেতে শুরু করলেন। রসগোল্লা, চমচম, কালোজাম আর একটা নিমকি। আপনাকে হাভাতের মতো দেখাচ্ছিল। মনের আনন্দে সবই খেলেন। কিসের আনন্দ? খুকুকে যে রিজেক্ট করেছে সে আনন্দ!
আনন্দ আপনার গাম্ভীর্যের খোলসটাকে ছিঁড়ে ফেলল। বললেন, এভাবে পাত্রী দেখা অসম্মানজনক একটি কাজ।
একটু বেফাঁস হলেও আপনি বলে ফেললেন, বিয়ে করার জন্য বাড়ি থেকে আপনাকেও চাপ দেওয়া হচ্ছে। মেজো ফুপুর মেয়ে রেশমাকে বিয়ে করার হুকুম হয়েছে। হুকুম দিয়েছেন আপনার বাবা। বলেছেন, মঞ্জুর জন্য বাইরের কোনো মেয়ে বউ হয়ে এলে হাজারটা বিষয় তার কাছ থেকে আড়াল করে রাখতে হবে। রেশমা হলে সমস্যা নেই, সব বিষয়ই তার জানা এমনকি আপনার বাবা যে বুড়ো বয়সে মেয়ের বয়সী একটি বিধবা মেয়েকে বিয়ে করার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিলেন, সে কথাও।
কথা শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বাইরের মেয়ে সম্পর্কে এত বাজে ধারণা কেন? বাড়ির মেয়েটি বউ হলেও এতটুকু ছাড় দেবে না, চামড়া ছিলে লবণ লাগিয়ে দেবে। কিন্তু এসব না বলে বললাম, প্লিজ স্যার, রেশমার ছবি দেখান না। আপনার মানিব্যাগে নিশ্চয়ই আছে। রেশমাকে কবে বিয়ে করবেন? রেশমা নিশ্চয়ই খাটো নয়। আপনাদের বাচ্চাগুলো হবে গালিভারের মতো একেকটা তালগাছ। বউ নিয়ে বাসায় আসবেন, আমার মা খুব খুশি হবেন।
মা খুশি হবেন কারণ আমার আপনার প্রেমে পড়ার আশঙ্কা কমে যাবে। আমি বলি, রেশমা হারামজাদি যদি এ বাড়িতে আসে, আমি তার খাবারের সঙ্গে ইঁদুর মারার ওষুধ মিশিয়ে রাখব। শত্রু জীবিত রাখতে নেই।
পাত্রপক্ষ আমাকে রিজেক্ট করেছে তো বেশ। তাতে আপনার কী? আপনার আনন্দ দেখে মনে হচ্ছে আমার উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে। আপনার কি ধারণা, আমার স্বামীকে খাওয়াইব-এর ইংরেজি আমি জানি না। এটা যে ইট-এর জায়গায় ফিড হবে, আমি ক্লাস সিক্সেই শিখেছি। পাত্রটাকে আমার পছন্দ হচ্ছিল না। অন্য কেউ হলেও পছন্দ হতো না। নাদিম কিংবা ওয়াহিদ মুরাদের মতো কেউ হলেও আমি একই জবাব দিতাম। প্রশ্নের কী ছিরি! স্বামীকে খাওয়াবার জন্যই যেন আমার জন্ম হয়েছে।
অর্ধেক চা শেষে করে বললেন, আপনি যাচ্ছেন। কবে আবার পড়াতে আসবেন জানেন না।
আমি স্বর চড়িয়ে বললাম, তোমার না গেলেও চলবে। তুমি কত বড় বাহাদুর আমার জানা আছে।
আমার কাছে এ ব্যবহার আপনি আশা করেননি, আমি জানি। কিন্তু আমি কী করব?
বাইরের আকাশটা মেঘলাই ছিল; মেঘটা এখন ঘন। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি।
স্যার, আপনি এমনই এক আঁধার রাতে আমার দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় গোটানো ছাতাটা হাতে নিয়ে যখন দরজার চৌকাঠ পার হলেন, আমার ভেতরের দুর্বিনীত খুকু চেঁচিয়ে উঠল, তোমাকে আর কোনো দিনও আসতে হবে না।

২.
আপনার মতো এমন একটা ভীতু মানুষ—সবাই যাচ্ছে তাই আপনিও যাচ্ছেন, গিয়ে আপনি কী কচুটা করবেন? ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবেন না তো?
সবাই জানত, আমিও জানতাম আপনি আনন্দ মোহন কলেজের ভালো ছাত্র। দুই নম্বরের জন্য বিএসসিতে ফার্স্টক্লাস মিস করেছেন। ঢাকায় গিয়ে এমএসসিতে ভর্তি হয়ে এসেছেন। ইকবাল হলে দু-তিন রাত থেকেছেনও। ফিরে এসে বাবাকে আপনি বলেছেন, পড়াশোনার পরিবেশ নেই। ছেলেরা বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করে দিয়েছে। যারা মন বসিয়ে পড়াশোনা করতে চায়, তাদের নাকি ব্ল্যাকলিস্ট করা হচ্ছে।
বাবা আপনাকে বলেছেন, পরিস্থিতি ভালো হোক, যেয়ো। তত দিন খুকুকে পড়াও।
স্যার, আমার মনে হচ্ছে পুরোটাই ভাওতা। আপনি রেশমাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন। আপনার এত বিয়ে করার খায়েশ কেন? বিবাহিত মানুষের, বিশেষ করে ভীতু টাইপের পুরুষ মানুষের বিয়ের পরের জীবন কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে সে সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা আছে? নাকি আপনি সে রকম একটা জীবনই চান? ধরে নিলাম আপনার রেশমা খুবই ভালো। এই খুবই ভালো মেয়েটিও পান থেকে চুন খসলে আপনাকে জনমের শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। বিয়ে করার সাধ মিটিয়ে দেবে।
আমার মেজাজটা বিগড়ে ছিল। সে জন্য দরজা খুলে আপনার চলে যাওয়া দেখিনি। আগে দেখতাম। আপনি কখনো ফিরে তাকাননি। আপনার ধারণা, ছাত্রীর দিকে ফিরে তাকানো কোনো সম্মানজনক কাজ নয়। শিক্ষকদের দাম কমে যায়। বায়োলজির শওকত স্যার ক্লাস টেনের রুবিনা খানমের দিকে কেবল ফিরে তাকাতেন না, তাকে ভালোও বাসতেন। রুবিনাকে লেখা শওকত স্যারের একটি প্রেমপত্র আমাদের হাতে হাতে ঘুরেছে। পড়তে গেলে কান লাল হয়ে যায়। কী কথা—রুবিনা, তোমার জন্য আমার শত-কোটি চুমু! বলুন স্যার, এক জীবনে এক শ কোটি চুমু খাওয়া সম্ভব?
স্যার, আপনি চলে যাওয়ার পর, অনেক দিন আমার জন্য কোনো প্রস্তাব আসেনি। সুতরাং নতুন করে প্রত্যাখ্যাতও হইনি অনেক দিন।
আপনি চলে যাওয়ার বর্ষপূর্তি ২২ জুন। যারা যুদ্ধে গেছে, তাদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে, প্রায় সবাই ডিসেম্বরের মধ্যেই ফিরে এসেছে। তাহলে আপনি ফিরছেন না কেন? আপনি ঠিকঠাকভাবে না পড়ালে আমি যে বছরের পর বছর ধরে ফেল করে যাব। আমার বিয়ে পাস করা হবে না, বিয়ে করা হবে না; বিচ্ছু টাইপের কয়েকটা বাচ্চাকাচ্চার মা হওয়া হবে না। আর এই যে হবে না, হবে না, হবে না—সবগুলোর জন্য দায়ী থাকবেন আপনিই।
কিন্তু স্যার, আনন্দের খবরটা শুনুন। ’৭২-এর এই নতুন বছরের গোটা মার্চ মাসটাই ছিল উৎসবের। পাত্র খুব ব্যস্ত। সে জন্য ২৬ মার্চ ছুটির দিনটাই বেছে নিল—পাত্রী দেখতে আসবে।
পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে সাতজন। পাত্র নিজেই জিজ্ঞেস করল, গান গাইতে জানেন?
আমি হ্যাঁ বা না কিছু বলার আগেই বলল, একটা গান গেয়ে শোনান তো। গঙ্গারাম নামের এক পাত্রকে নিয়ে একটা সুন্দর ছড়াগান আছে। ভাবলাম ওটাই গাইব। কিন্তু অতিথিরা চটে যেতে পারেন মনে করে অন্য একটা গান গাইতে শুরু করলাম গুন গুন করে।
পাত্রপক্ষের কেউ একজন বললেন, গলা তো মিষ্টি। একটা নাথ-ই-রাসুল গেয়ে শোনাও তো।
আমাকে শোনাতে হয়নি। একজন বললেন, চেহারাটা ভালোই, কিন্তু বড্ড খাটো।
পাত্র বলল, আমার মা তো আরও খাটো ছিলেন।
সবাই নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করেন। তাঁদের দলনেতা বললেন, খাটোতে যখন আব্বাসের সমস্যা নেই, তাহলে আমরা আংটি পরিয়েই দিই।
আমি মনে মনে বলছিলাম পছন্দ হয়ে থাকলে নগদ অন্তত এক হাজার টাকা দিন, আমাকে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার কিনতে হবে। পছন্দের গান শুনব, বারবার শুনব।
আমার হাতে আংটি।
ঠিক তিন দিন পর সন্ধ্যাবেলা পাত্রের বড় চাচা এসে আমার দাদাকে বললেন, আমাদের প্রতিবেশীর স্ত্রী তাঁদের নিশ্চিত করেছেন যে আমার চরিত্র খারাপ। বাড়ির প্রাইভেট মাস্টারটার সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক আছে। তিনি নিজে দেখেছেন, মাস্টার যখন পড়িয়ে বাড়ি ফিরত, খুকু বেহায়ার মতো তার চলে যাওয়া দেখত। পাত্রপক্ষ মাস্টারের নামও উদ্ধার করেছে—মঞ্জুর হোসেন, আদি বাড়ি হালুয়াঘাট।
তিনি বললেন, জেনেশুনে একটা বাজে মেয়েকে আব্বাসের বউ করে ঘরে তুলতে পারি না। স্যার, আপনার জন্য আমার বিয়েটা ভেঙে গেল। এখন খুশি তো?

৩.
জুনের প্রথম দিকে উষ্কখুষ্ক চুল, বিষণ্ন চেহারার একটি শ্যামলা মেয়ে ছোট ভাইকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে হাজির। মঞ্জুর ভাইজানের খোঁজে এসেছে। তারা শুনেছে, গত অক্টোবরে পাকশি ব্রিজের কাছে অপারেশন চালানোর সময় আপনার মতো এক যুবক বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পানি পানি করছিলেন; সেনাদের একজন চেঁচিয়ে বলেছে, শালালোক মুক্তিকো মা-কা বাপ। তারপর প্যান্টের বোতাম খুলে তার ওপর সেই হানাদার প্রস্রাব করে দেয়।
রেশমা পাকশি গিয়েছিল। কেউ বলেছে, এমন একটা ঘটনা ঘটেছে কিন্তু লাশ কোথায়, কারোরই জানা নেই। তার নাম মঞ্জুর হোসেন কি না, তাও কেউ জানে না।
রেশমা সর্বশেষ যা শুনেছে তা হলো, মঞ্জুর ভাইজান ছাত্রীকে বিয়ে করে কলেজ রোডে ছাত্রীদের বাড়িতে ঘরজামাইয়ের জীবনযাপন করছে।
রেশমা শুনে অবাক হলো, প্রায় এক বছর আমার সঙ্গেও আপনার যোগাযোগ নেই। ফেরার সময় রেশমা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলল, আপনি কেন যেতে দিলেন?
স্যার, আমি রেশমাকে কথা দিয়েছি, আপনি আসামাত্রই তাকে চিঠি লিখে জানাব।
আমিও তো তা-ই বলি, আমার কাছে না হয় না-ই আসুন। আমার চরিত্র নিয়ে কথা উঠেছে—এমন মেয়েকে ঘরের বউ করা যায় না। আপনি অন্তত রেশমার কাছে ফিরে যান। শুধু খবরটা পেলেই হবে, আমি নিশ্চিত হব আপনি বেঁচে আছেন।
আজ ২২ জুন। আপনার সঙ্গে শেষে দেখার এক বছর পুরো হচ্ছে। আমি আপনাকে আটকে রাখার কে?
স্যার, আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছ। চিঠির অক্ষরগুলো আর দেখতে পাচ্ছি না। না স্যার, আমি কাঁদিনি। রেশমা কেঁদেছে। আমি কিচ্ছু বলব না, আপনি রেশমার কাছেই ফিরে আসুন।
আমার ভালোবাসা বড্ড পানসে। আমি আপনাকে ধরে রাখতে পারিনি। স্যার, গত এক বছরে অন্তত এক কুড়ি চিঠি আপনাকে লিখেছি। একটিও পোস্ট করা হয়নি। ঠিকানাই তো জানি না। রেশমা চলে যাওয়ার পর আমি আপনার জন্য কাঁদতে শুরু করেছি। একা একা কাঁদি, এমনিতেই চোখ ভিজে আসে।

ইতি আপনার খুকু
২২ জুন ১৯৭২

পুনশ্চ: মাত্র দুই দিন আগে জুন মাসের ২০ তারিখ শেষরাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। ঘিয়ে রঙের প্যান্ট আর আকাশি নীল শার্ট পরে আপনি পাত্রী দেখতে এসেছেন। আপনার বড় ফুপা জিজ্ঞেস করলেন, আমি আপনাকে খাওয়াব-এর ইংরেজি কি? পাত্রী বলল, আই শ্যাল ফিড মঞ্জুর হোসেন স্যার।
বড় ফুপা বললেন, চমৎকার। আপনি গাম্ভীর্য ভুলে ফিক করে হেসে ফেললেন। এবার পাত্রীকে বললেন, তাহলে একটা গান শুনি। পাত্রী গাইতে শুরু করল: আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাইনি তোমায় দেখতে আমি পাইনি। বাহির পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয় পানে চাইনি…। এটুকু গাইতেই আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। স্যার, আপনি আবার কবে আসবেন? তখন কিন্তু পুরো গানটাই শুনতে হবে।