মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী

0a689a66af91b7a4c3d4dae85d1413e8-15মন্ত্রী হতে চাওয়া কি কোনো দোষের ব্যাপার?
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে সরকারের সচিব হতে চাওয়া দোষের নয়, ছাত্রনেতাদের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হতে চাওয়া দোষের নয়, রিকশার মালিকানা ছাড়াই মালিক সমিতির সভাপতি হওয়া দোষের নয়, আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার সম্পাদক হতে চাওয়া দোষের নয়, টাকার জোরে কদাকার চেহারা নিয়ে সিনেমার নায়ক হতে চাওয়া দোষের নয়। তাহলে জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়ার পরও মন্ত্রী হতে চাওয়া দোষের কেন হবে?
কিন্তু যখনই মুখ খুলে বললাম, মন্ত্রী হতে চাই; তিনি আঁতকে উঠলেন।
আমি মোটেই ভয়ংকর কিছু বলিনি। আমাদের পার্টির এক নম্বর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছানাউল্লাহ তরফদার ফিসফিস করে বললেন, আরে মিয়া আস্তে কথা বলো। দেয়ালেরও কান আছে। অন্য কেউ শুনলে একান-ওকান ঘুরে কথাটা লিডারের কানে চলে যাবে।
আমি বললাম, সে জন্যই তো বললাম। তিনি শুনলেই না আমাকে মন্ত্রী করার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে শুরু করবেন।
তোমার কথা ঠিকই। কিন্তু অভিজ্ঞতারও তো কিছু দাম আছে, তাই না? তা হলে শোনো, পঁচিশ বছর আগে আমিও মন্ত্রী হতে চেয়েছিলাম। লিডার তাড়াহুড়া করে আমাকেই প্রেসিডিয়াম মেম্বার বানালেন। এখন তো পা একটা কবরে। তবু আশায় আছি দেশের প্রেসিডেন্টের পদটা যদি কোনো দিন খালি হয়, বয়সের কারণে লিডার যদি আমাকে যথেষ্ট বৃদ্ধ এবং এত দিন পার্টির সঙ্গে লেগে থাকার পুরস্কারস্বরূপ অনুগত মনে করেন, হয়তো এক নম্বর পদে বসিয়েও দিতে পারেন, কিন্তু মুখ খুলে কাউকে বলি না। এই যে মুখ না খুলে থাকা, অপেক্ষা করা—এটাই আনুগত্য।
আবার এটাই যে একমাত্র ফর্মুলা, তা-ও নয়। আমাদের সবচেয়ে ত্যাগী বুড়ো ভাই মাহমুদ উল্লাহ একানব্বই বছর আশায় আশায় থেকে বিরানব্বইতম জন্মদিনে নিজের হাতে কেক কাটলেন, নিজের হাতে আমার মুখেও এক টুকরা তুলে দিলেন। মাঝরাতে সেই যে ঘুমোতে গেলেন, আর উঠলেন না। তাতে আমার সুবিধে হলো, দুই নম্বর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে এক নম্বরে প্রমোশন পেলাম। আমার একাশি চলছে, বুড়ো ভাইয়ের মতো আয়ু তো আর পাব না। বুঝলে আবদুজ জাহের, অপেক্ষা করো। সবুর করো। গৌতম বুদ্ধও অপেক্ষা করতে বলে গেছেন। তিনি বলেছেন, ওয়েট, থিঙ্ক, ফাস্ট। অপেক্ষা করো, চিন্তা করো, উপবাস করো।
পার্টির মহাসচিবকে বললাম, বদি ভাই, গরিবের কথাটা একটু মনে রাখবেন। প্রথমবার বাপ-দাদার জমিজমা বেঁচে এমপি হলাম, কিছুই তো দিলেন না।
আমি দেওয়ার কে? দেয় তো জনগণ। তোমাকেও দিয়েছে—এমপি খেতাব। তোমাকে দিয়েছে জনগণের খেদমত করার সুবর্ণ সুযোগ। এই খেতাবটার জোরে যদি কিছু করতে না পারো, আমার কী করার আছে।
বদি ভাই, টানা পাঁচ বছর বসে বসে বুড়ো আঙুল চুষলাম। এলাকার জনগণকে তো আর মুখ দেখাতে পারি না। এবার যে আর মন মানছে না। শুনছি, শিগগিরই নাকি মিনিস্ট্রি রিশাফলিং হচ্ছে।
মহাসচিব বদিউল আলম খান মিন্টো রোডের লাল বাড়ির দেয়ালে ঝিম মেরে আঁকড়ে থাকা পেটে ডিমওয়ালা টিকটিকির দিকে চোখ রেখে আমাকে বললেন, আবদুজ জাহের, এটা তো তোমার সেকেন্ড টার্ম, নাকি ভুল বললাম?
বদি ভাই, আপনি পার্টির মহাসচিব। সেক্রেটারি জেনারেল। পার্টির দুজন মহাসচিব দেশের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হয়েছেন। সেই মহাসচিব ভুল করতে পারেন?
এটা ঠিক বলোনি আবদুজ জাহের। ম্যান ইজ মর্টাল। মানুষ মাত্রই ভুল করে।
বদি ভাই, পার্টির মহাসচিবের পাশাপাশি আপনি আমাদের সিনিয়র মন্ত্রীও। আপনি তো তবু কিছু পেয়েছেন। স্বাধীনতার পর আপনার পার্টি থেকে আমিই আমাদের নির্বাচনী এলাকার প্রথম এমপি। প্রথমবার তো ওদের দলের শক্তিশালী প্রতিমন্ত্রী কাউসার আহমেদকে হারিয়েছি। আপনিই বলুন, আমি কি এখনো যোগ্য হয়ে উঠিনি?
অবশ্যই তুমি যোগ্য। তবে এটাও মনে রেখো, আমাদের পার্টিতে পরপর নয়বার এমপি হয়েছেন, এমন একজন; পরপর আটবার হয়েছেন, এমন চারজন; পরপর সাতবার, এমন নয়জন এমপিকে মন্ত্রী করা হয়নি। পঁয়তাল্লিশ বছর বুড়ো আঙুল চুষলে সে আঙুলের আর থাকে কী—তুমিই বলো। তোমার তো কেবল পাঁচ বছর গিয়ে ছয়ে পড়ল। আসলে কে বুড়ো আঙুল চুষবেন আর কে মন্ত্রী হবেন, এটা লিডার নিজেই ঠিক করে থাকেন। লিডার যা করেন, ঠিকই করেন। আমরা হাততালি দিয়ে সব সময়ই তাঁকে সমর্থন জানাই। এটাই গণতন্ত্র। হাততালি কম দিলেই গণতন্ত্রের দুশমন। আমাদের দলে এক লক্ষ তালি গণনাকারী রয়েছে, ভুলো না।
নয় বছর আগে পার্লামেন্টারি পার্টির একটা বিদেশ সফরে আমরা একসঙ্গে ছিলাম উড়োজাহাজের সব যাত্রী, যার যার আসনে বসে বেল্ট বেঁধে ফেলেছে। এর মধ্যে নুরুল্লাহ ভাইয়ের নাম মাইকে ঘোষণা করা হলো। কে শোনে কার ডাক। আমি বললাম, এয়ারপোর্টের সব বাথরুমের দরজায় গিয়ে নাম ধরে চেঁচালে যদি না ঘুমিয়ে থাকেন, বের হবেন। গ্রাউন্ড স্টাফ কোনোভাবে তাঁকে টেনে বের করলে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, বাথরুম থেকে মানুষ টেনে বের করা—এটা কোন ভদ্রতা। পাজামার ফিতে বাঁধতে বাঁধতে যখন তিনি উড়োজাহাজে ঢুকলেন, যাত্রীরা সবাই ঘাড় উঁচিয়ে তাঁকে দেখতে থাকল। ফিতের গিঁট ঠিক হয়নি, আচমকা পাজামাটা খুলে যায়।
বলেন বদি ভাই, লিডার কি আর এমন লোককে মন্ত্রী বানাবেন?
মহাসচিব বললেন, মন্ত্রিসভার বৈচিত্র্যের জন্য এমন দু-একজন থাকা দোষের কিছু নয়।
ঠিকই বলেছেন, মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে একবার পাশাপাশি তিন মন্ত্রী ঘুমাচ্ছিলেন। লিডার নাকি বলেছেন, তাঁদের ডিস্টার্ব করার দরকার নেই। স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার কারণে তিনজনের কেউই বাসায় ঘুমোতে পারছেন না। মিটিংটাই নিরাপদ। দর্শনার্থীরও ভিড় থাকে না।
মহাসচিব বললেন, আমাদের এত সব গোপন কথা তোমাদের কাছে কে ফাঁস করে? যাকগে, তোমার কথা আমার মনে থাকবে। প্রথম দফায় যখন বাদ পড়েছ, ওয়েট করো। যাঁরা লিডারের সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা থাকেন, তাঁদেরও দু-একজনকে ধরো। কার কথায় কাজ হয় বলা যায় না।
কাছের একজনই তো মন্ত্রিসভার নাম ঘোষণার আগে আমাকে চামড়া-ছিলা করে পঁচিশ লাখ টাকা নিয়ে নিলেন। বললেন, মন্ত্রী হওয়া নিশ্চিত, কোন মন্ত্রণালয় চান, মুখ খুলে বলুন। কিন্তু পুরো টাকাটাই গচ্চা গেল।
মহাসচিব বললেন, তখনই তো তোমার বোঝা উচিত ছিল হবে না। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নমিনেশনে দলের সাপোর্ট দিতে এরা যেখানে চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখ আদায় করে, মন্ত্রীর জন্য মাত্র পঁচিশ লাখ! তোমার মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা নেই।
কী বলেন বদি ভাই, আমার না হয় ম্যানপাওয়ারের ব্যবসা আছে, ইমপোর্ট আছে—দু-এক কোটিতে আমার তেমন ক্ষতি হবে না। কিন্তু পার্টির পুরোনো ত্যাগী নেতারা কী করবেন? তাঁরা টাকা পাবেন কোথায়?
মহাসচিব বললেন, আহাম্মক কোথাকার। পার্টিতে পুরোনো ত্যাগী নেতাদের কেউ আছেন নাকি? তোমাদের কনুইয়ের ধাক্কায় সেই কবে তাঁরা ছিটকে পড়েছেন, তাঁদের আর খবর আছে নাকি?
আমি দম নিয়ে বললাম, বদি ভাই, ইয়াং জেনারেশনকে টেনে তুলবেন না? আমাদের টানা আটবারের এমপি আবুল কালাম মুহাম্মদ নুরুল্লাহ—বয়সের ভারে এখন আর দিন-রাতের দিশা পান না, কোথায় আছেন তা-ও বোঝেন না। কদিন আগে এমপি হোস্টেলে তাঁর ঘরের অ্যাটাচড বাথরুমের কমোডে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। দরজায় হাতুড়িপেটা করার পরও সেই ঘুম ভাঙেনি। মরেই গেছেন ধরে নিয়ে পাশের রুমের এমপি হিসেবে আমাকে দরজা ভাঙার হুকুম দিতে হয়। কেয়ারটেকার দরজা ভাঙে। হঠাৎ চোখ খুলে তিনি বললেন, কী হইছে মিয়া? বাথরুমে ঢুকছ ক্যান? লজ্জাশরম দুনিয়া থাইক্যা উইঠা গেছে নাকি? তোমরা শান্তিতে হাগামুতা করতেও দিবা না?
মহাসচিব বললেন, নুরুল্লাহ ভাই আমারও মুরুব্বি। তিনিও ভুল বলেননি। ঘুম ভাঙলে নিজেই কমোড থেকে উঠে আসতেন। তোমাদের এত তাড়াহুড়া করার দরকার ছিল না। বাথরুম থেকে বেরোনোর একটাই তো দরজা। দিশা হারানোর সুযোগ কোথায়?
কিসের দিশা, বদি ভাই?
নুরুল্লাহ ভাই যতই ঘুমান, তাঁর দিশা ঠিকই আছে। মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করা গুণবান পুত্র থাকার পরও রাজনীতির জোয়ালটা নিজের কাঁধ থেকে নামাচ্ছেন না। লিডার তাঁকে বলেছেনও, ছেলেকে পলিটিকসে নিয়ে আসেন, আমাদের ব্লেসিংস থাকবে। কিন্তু তিনি জানেন, ছেলে মন্ত্রী হওয়া আর নিজে মন্ত্রী হওয়ার মধ্যে কী দুস্তর ফারাক।
বদি ভাই, আমার যে অত ধৈর্য নেই।
সে জন্যই তো ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে যাচ্ছ।
আপনি যদি আশ্বাস দেন, রিশাফলিংয়ের সময় আমার কথা মনে রাখবেন, তাহলে ধৈর্যচ্যুতি ঘটাব না।
তিনি বললেন, আশ্বাস দিতে পারব না, সে ক্ষমতাও তো নেই। জনগণকে পাশে রাখবে। আর বেফাঁস কিছু বলবে না।
বদি ভাই, আর কিছু?
মহাসম্মেলনে পারফরম্যান্স দেখাও।
আমি তো আর ডায়াসে জায়গা পাব না। বক্তৃতা দেওয়ার জন্যও আমাকে ডাকবেন না। পারফরম্যান্স দেখাব কোথায়?
আমি বেরিয়ে আসি।
আমাদের দলের একটা বিশেষ বাড়ি আছে, সেখানে লিডারের দু-একজন আপনজন বসেন। মন্ত্রী কে হবেন না হবেন, এ নিয়ে তাঁরাও ভূমিকা রাখেন। তাঁদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ক্ষীণ।
ক্ষীণ হওয়ার কারণও আছে। কেবল এমপি আর মন্ত্রীর মধ্যে ফারাকটা দুস্তর। এমপি নেন আর মন্ত্রী দেন। ঘূর্ণিদুর্গতদের জন্য টিন চাই, বানভাসা মানুষের জন্য চাল চাই, গম চাই, মসজিদ, মন্দির, গোরস্থান, রাস্তা, কালভার্ট, স্কুল—এসবের জন্য বরাদ্দ চাই। দলের ছেলেদের এটা-ওটা খাওয়ানোর জন্য চাই, খুনের মামলার আসামিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার বলে তার মুক্তি চাই, ওসি কথা শোনে না বদলি চাই, নদী ভাঙছে তাই বালুর বস্তা আর সিমেন্টের ব্লক চাই, নামগোত্রহীন স্কুলে এমপিও চাই…শুধুই চাই—এ নিয়ে মন্ত্রীদের সঙ্গে দেনদরবার।
আমি আর নিতে চাই না, দিতে চাই।
আমাদের অভিভাবক হচ্ছেন চিফ হুইপ। বছর দুয়েক আগে আমাদের একজন মাঝবয়সী সদস্যের কক্ষে একজন যৌনকর্মী আবিষ্কৃত হয়েছে বলে বিরোধীদলীয় একটি পত্রিকা দাবি করলে তিনি সেই পত্রিকার সাংবাদিককে বললেন: তোমাদেরটা কোনো নিউজই হয়নি। কম বয়সীদের জন্য তো গার্লফ্রেন্ডরাই আছে, বুড়োদের আছে কম বয়সের অ্যাডভেঞ্চারের স্মৃতি। স্ত্রীর অত্যাচারে মাঝবয়সীদের যে দুঃসহ জীবন, তাদের ঘরেই তো যৌনকর্মী না কী যেন বলো, ওদেরই ঢোকার কথা। নিউজ করার আগে আমাদের প্রয়োজনের দিকটাও মাথায় রেখো। তরুণ কারও রুমে পাওয়া গেলে লিখতে পারতে—ব্যাটা এমনই অপদার্থ একটা গার্লফ্রেন্ডই বাগাতে পারল না, কনস্টিটিউয়েন্সি ম্যানেজ করবে কেমন করে। বুড়ো কারও রুমে পাওয়া গেলে লিখতে পারবে, নিশ্চয়ই তার প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড বড় হয়ে গেছে। তা ছাড়া তোমাদের কি ধারণা, যৌনকর্মীর ভোটের দাম অন্য কারও ভোটের চেয়ে কম?
আমাদের সেই চিফ হুইপ ডাক্তার সাদাত আলীর সঙ্গে দেখা করে নিজের কষ্টের কথা বললাম। আমার যোগ্যতা নিয়ে তাঁর মনে কোনো প্রশ্ন আছে কি না, জিজ্ঞেস করলাম।
উল্টো জিজ্ঞেস করলেন, আবদুজ জাহের, আমার যোগ্যতা নিয়ে তোমার মনে কোনো প্রশ্ন আছে?
আমি বললাম, আপনার মতো চিফ হুইপ বাংলাদেশ আগে কখনো পায়নি।
তিনি বললেন, ধ্যাৎ, আমি কি তা-ই জানতে চেয়েছি? আমার কি মন্ত্রী হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই? তোমরা না হয় আমাকে মানো, কিন্তু আমার নির্বাচনী এলাকার লোকজন, আমার পার্টির লোকজন, থানার ওসি, সেকেন্ড অফিসার, ইউএনও, ম্যাজিস্ট্রেট কি এসব বোঝে?
আমার মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নের কথা তাঁকে বলা হলো না; বরং তাঁর মন্ত্রী না হওয়ার দুঃখের কথাই শুনলাম।
বেরোতে বেরোতে বললাম, ডাক্তার ভাই, দোয়া করবেন। আপনার দোয়া নিতে এসেছিলাম।
তিনি বললেন, আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও এক মিনিট। দোয়া চাইছ কেন? বাতাস-টাতাস পেয়েছ নাকি?
কিসের বাতাস?
আমাদের মাহতাব সকালেই না দোয়া নিয়ে গেল। বলল, বাতাস পেয়েছে। শপথের জন্য তৈরি হতে বলেছে।
আমি বলি, সেকি! আপনি সেদিনই না এত বড় একটা স্ক্যান্ডাল থেকে মাহতাবকে রক্ষা করলেন। তার রুম থেকে নাকি মেয়েছেলে বের হয়েছে।
ঠিক করে বলো আবদুজ জাহের, বলো যৌনকর্মী। মাহতাব বলেছে, এই ঘটনাই তাকে লাইমলাইটে নিয়ে এসেছে। এখন সবার মুখে তার নাম। তোমার-আমার নাম কজন জানে? একটা কিছু করে তোমাকে লাইমলাইটে আসতে হবে। আমার বয়স ভাটির দিকে, তোমার তো সবে শুরু। সময় আছে, পারবে।
তাহলে আসি।
দাঁড়াও। দেখি, তোমার চোখ এত হলদে কেন? জন্ডিস? সোজা কোনো প্যাথোলজিক্যাল ক্লিনিকে চলে যাও। সিরাম বিলিরুবিনটা করিয়ে নিয়ে এসো। জন্ডিস ইজ আ ডেঞ্জারাস ডিজিজ। পলিটিশিয়ানদেরই বেশি জন্ডিস হয়।
আমি আবার চিফ হুইপের রুমে ঢুকে অ্যাটাচড বাথরুমের দরজা খুলি। সুইচ টিপতেই ভেতরটা এমনই আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে যে আমার চোখ বলতে গেলে ঝলসে যায়। আমি রঙের ভেদজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আয়নাটা ঝাপসা মনে হয়। পকেটের রুমাল বের করে আয়না মুছি। চোখ বড় করে আয়নার দিকে তাকাই। আমার চোখ হলদে নয়, লাল।
বিনা শুল্কে আনা লেক্সাসে চেপে শেরেবাংলা নগরের দিকে রওনা হই।
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর কাছে এসে হাতের ডানে অসাধারণ স্থাপত্যের পার্লামেন্ট ভবনটা চোখে পড়ে।
পার্লামেন্ট নিয়ে মহামতি লেনিন কী রকম জঘন্য একটা কথা বলেছেন। কথাটা না-ই বললাম।
আমি মাননীয় স্পিকারের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করি। তিনি ব্যস্ত। আমি বললাম, স্যার, আপনি নিরপেক্ষ স্পিকার হলেও আমাদের দলের অন্যতম কান্ডারি। এত ত্যাগের পরও আমাকে মন্ত্রী করা হয়নি, এ নিয়ে আমার দুঃখ নেই। কিন্তু সামনের রিশাফলিংয়েও যদি আমার নামটা না আসে, এলাকায় মুখ দেখাতে পারব না।
তিনি বললেন, কে শপথ নেবে আর কে হাততালি দেবে, তা আমি ঠিক করি?
তবু স্যার, আপনি লিডারের সবচেয়ে কাছের মানুষ, বিপদে-আপদে আপনাকেই তো সবার আগে ডাকেন। লিডারের পরই তো আপনি।
তিনি বললেন, লিডার আমাকে ডাকুন বা না-ই ডাকুন, তুমি যখন আমাকে তাঁর কাছের মানুষ মনে করো, এটাই আমার জন্য অনেক। লিডারের পর আমি—সেটা তো ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে; তুমিই বলো, বাদশা বাবরের পর কে? তাঁর পুত্র বাদশাহ হুমায়ুন। লিডারের পর লিডারের ছেলে, তারপর…তারপর…। আর এর সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই। লিডারের ইচ্ছে ব্যক্ত হওয়ার আগেই আমরা দুই হাত তুলে সমর্থন জানাই—একেবারে নিরঙ্কুশ সমর্থন।
তাহলে থাক স্যার, মন্ত্রী যখন বানাবেনই না, ফিরে যাই।
তিনি বললেন, থাকবে কেন, চেষ্টা চালিয়ে যাও। চেষ্টায় কী না হয়। তোমার বয়স কম, চেষ্টাই যদি করতে হয়, প্রতিমন্ত্রী হতে চেষ্টা করো। তাহলে তোমার মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন একদিন হয়তো সফল হবে। দু-একটা রিশাফলিংয়ের পরই তোমাকে ফুল মিনিস্টার বানিয়ে দেবেন। আর যদি মিনিস্টার হওয়ার পর স্বপ্নটা ছেঁটে না ফেলো, আরও বড় কিছু হতে চাও, যেদিন লিডার টের পাবেন, সেদিনই তোমাকে ছেঁটে ফেলবেন।
আমি আমার স্বপ্ন এক ধাপ নামিয়ে প্রতিমন্ত্রীতে নিয়ে এলাম। চেষ্টা চালিয়ে যাব। এরপর পলিটিক্যাল সেক্রেটারিকে প্রতিমন্ত্রী হওয়ার বাসনার কথা বলতে যাব। দ্রুত লুই আই কানের এই মায়াবী দালান থেকে বেরোনোর সিঁড়ি খুঁজছি। এই দালানে যাঁরা একবার ঢোকেন, তাঁরা জানেন, লিফট বন্ধ থাকলে বেরোনোর সিঁড়ি খুঁজে পাওয়া কতটা দুরূহ ব্যাপার।
মহাসচিব বললেন, আহাম্মক কোথাকার। পার্টিতে পুরোনো ত্যাগী নেতাদের কেউ আছেন নাকি? তোমাদের কনুইয়ের ধাক্কায় সেই কবে তাঁরা ছিটকে পড়েছেন, তাঁদের আর খবর আছে নাকি?