আমার কিছু দেনা ছিল

পৌঁছে মনে হয় তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। এখন ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে রাশাদের বাড়ির এক
অংশ দেখতে পাচ্ছি। যেন দুধ-সাদা রাজহাঁসের এক অংশ, উড়াল দিয়ে যেটুকু উঠেছে সেটুকুই
আমার চোখের আওতায়। এ এলাকাটা অদ্ভুত। না আবাসিক, না বাণিজ্যিক। অবশ্য ঢাকা শহরের
কোথাও এখন আর নির্দিষ্ট এলাকা নেই। আবাসিক বলে চিহ্নিত এলাকার পেটের ভেতর ঢুকে
যাচ্ছে লেদ মেশিনের কারখানা কিংবা ক্লিনিক। আবার বাণিজ্যিক এলাকার ঠিক মাঝখানে হঠাৎ
করেই বসতবাড়ি। আসলে সবকিছু সবকিছুর দিকে নিজ নিজ হাত বাড়িয়ে দিয়ে এখন এক
জট-পাকানো অবস্থায়। আলাদা করা মুশকিল।
ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে থাকি বেশ কিছুক্ষণ। আগে পৌঁছে এখন মনে হচ্ছে মিরা এসেছে
তো! অবশ্য মিরার যে স্বভাব, আমি জানি, ও নিশ্চয় সকালেই এসে হাজির হয়েছে। নিদেনপক্ষে
দুপুরের পরপরই। তাছাড়া এখনো এসে না পৌঁছলেও বা কি অসুবিধে! আমার ফুটপাথে দাঁড়িয়ে
থাকার প্রয়োজন নেই। রাশা আমাকে খুব ভালো করে চেনে। এ সময়টুকু ওদের বাড়ির ড্রইংরুমে
কাটানো যায়। যানবাহনের ধোঁয়া, ধুলোবালি আর ভ্যাপসা গরম গায়ে মাখার চেয়ে সে-ই অনেক
ভালো। আর বড় কথা, এই ফাঁকে রাশার কাছ থেকে হয়তো জানা যাবে, মিরার কেন এই জরুরি
তলব।
গত পরশু চিঠি পেয়েছি মিরার। গতকাল ওদের পাড়ার এক ছেলে বাসায় এসে জানিয়ে গেছে।
আমাকে পায়নি, বলে গেছে ছোট বোনকে। আমার কাছে এসব বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। মিরা
লিখেছে জরুরি দরকার, কিন্তু ওর জরুরি দরকারগুলো আমি জানি। আগেও বারকয়েক এমন
হয়েছে। আমি তড়িঘড়ি করে দেখা করার পর টের পেয়েছিÑআসলে কিছুই নয়, মিরা খামোখাই
ডেকে পাঠিয়েছে। এবার চিঠি পাওয়ার পরও সে রকমই কিছু হবে ভেবেছি। কিন্তু পরদিনই যখন
ওদের পাড়ার ছেলে খোঁজ করতে আসে, তখন একটু অবাক হতে হয়। তবে কি ব্যাপারটা সিরিয়াস
কিছু? কিন্তু হঠাৎ করে সিরিয়াস কী এমন ঘটবে, তাও ভেবে পাই না।
প্রথম প্রথম আমার মিরার সঙ্গে দেখা করতে একটুও ইচ্ছে না। আমার মন ভালো নেই। মন
ভালো থাকার কোনো কারণ নেই। হাতের চারপাশে সবকিছুই ক্রমশ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
কিছুই আয়ত্তে থাকছে না আমার। পার্টির অবস্থা ছত্রখান, পেছনে সম্ভবত কেউ লেগেছে, মনে হয়
চোখে চোখে রাখছে। আর এদিকে বাবা প্রায় আলটিমেটাম দিয়ে বসে আছেÑ হয় সম্পূর্ণ তার
কথামতো চলতে হবে কিংবা বাড়ি ছাড়তে হবে। আমার পক্ষে দুটোর একটাও সম্ভব না।
আমি জানি, মিরার সঙ্গে দেখা করতে এলে এসব সঙ্গে নিয়েই আসতে হবে। কিন্তু মিরাকে
খামোখা এসবের সঙ্গে জড়াতে ইচ্ছে করে না। তার চেয়ে, মাস তিনেক ওর সঙ্গে দেখা নেই,
এভাবে যদি সবকিছু চুকে-বুকে যায়, সেই ভালো। কিন্তু এসব ভেবেও, শেষ পর্যন্ত না যেয়েও পারি
না। দেখা করার কথা রাশাদের বাড়িতে। মিরার বন্ধু রাশা। কিছু কিছু অদ্ভুত ব্যাপার সব সময়ই
থাকে। এই যেমন মিরা আর রাশার বন্ধুত্ব। ওদের কোনো মিল নেই। আমি গত কয়েক বছরে
ওদের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পাইনি। কিন্তু ওদের বন্ধুত্ব টিকে আছে দিব্যি। অবশ্য রাশা মেয়েটি
ভালো। বড়লোকের মেয়েরা অনেক সময়ই স্নব হয়। রাশা খুব বড়লোকের মেয়ে হয়েও স্নব
হয়নি। আর আমাকে-মিরাকে যখন-তখন প্রয়োজনে সাহায্য করেছে খুব। এই প্রসঙ্গ হঠাৎ কখনো
উঠলে মুখ টিপে হেসে বলেছে, ‘ওয়েল, আমার না হয় আপনাদের কাছে পাওনা হচ্ছে, পরে শোধ
করে দেবেন। তাছাড়া আয়াম অলওয়েজ অ্যা হেলপিং হ্যান্ড, বিশেষ করে এসব ব্যাপারে।’ রাশার
অবশ্য বাড়তি সুবিধা। সেই প্রথম থেকেই দেখছি, ওর কাছে কে, কারা আসছে-যাচ্ছে, সে
নিয়ে ওদের বাসার কারো উৎসাহ নেই।
রাশার কাছ থেকে মিরার জরুরি তলবের কারণটা জানা যাবেÑ এই ভেবে এগোই। কিছু ধারণা
থাকলে মিরার সঙ্গে কথা বলতে সুবিধা হবে। জানি, দেখা করি না বলে মিরা এমনিতেই আমার
ওপর নির্ঘাৎ ক্ষেপে আছে।
কিন্তু আমার এ পরিকল্পনাটা কাজে লাগে না। রাশার সঙ্গে আগে দেখা করে প্রস্তুতি নেয়ার
সুযোগ পাওয়া যায় না। ওদের বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছতেই দেখি রাশার দোতলার ঘরের
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মিরা। আমাকে দেখে পরমুহূর্তে নিচে নেমে আসে। আমি ততক্ষণে
একতলার বারান্দায় এসে উঠেছি।
মিরা আমার দিকে বোকার মতো তাকায়, অস্থির গলায় বলে, ‘তুই এত দেরি করে এলি যে!’
শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। হাতঘড়ির দিকে একবার তাকাই। মিনিট দুয়েক আগেই একবার
তাকিয়েছিলাম। মিরার দিকে ফিরে অবাক গলায় বলি, ‘দেরি কোথায়! তুই তো আরো আধঘণ্টা
পর আসতে বলেছিলি!’
মিরা সে কথা শোনে শোনে না, ছোট একটা শ্বাস ফ্যালে, বলে, ‘তোর অবশ্য সময় সম্পর্কে
কোনোদিনই কোনো ধারণা ছিল না।’
আমি মিরার দিকে আবার তাকাই। ওর কথাবার্তা সব সময়ই এ রকম। কিন্তু এখন গলার স্বর
খুব ক্লান্ত। প্রথমে লক্ষ করিনি। এখন ওকে দেখে বোঝা যায়, ও খুব চিন্তায় আছে। নজরে পড়ে
ওর পোশাক খুব-একটা গুছিয়ে পরা না। মনে হয় ঘরের পোশাকেই চলে এসেছে। ওর চুল
এলোমেলো, চোখের নিচে কালো দাগ, চোখ লালচেও (কেঁদেছে নাকি!)। আমি বোকা বোকা
গলায় জিজ্ঞেস করি, ‘কী হয়েছে মিরা?’ মিরা ম্লান হাসে, ‘শুনবি, সে জন্যেই ডেকেছি।’
ভেতরে ঢোকার দরোজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল রাশা। বললো, ‘ভেতরে আসতে আজ্ঞা হয়।’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম, ‘কেমন আছেন, ভালো?’ রাশা মাথা নাড়লো, ‘আমি
ভালো। আপনি?’ আমিও মাথা নাড়লামÑ‘ভালোই, খারাপ থেকে কোনো লাভ নেই।’ রাশা
হাসলো, ‘তা ঠিক, নেই।’
আমরা প্রথমে ড্রইংরুমে বসি। বসে খুব গোপনে একটা শ্বাস ফেলি। খুব ক্লান্তি সে শ্বাসটির
সঙ্গে জড়িয়ে। আজ সকালেই বাসায় বাবার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা কাটাকাটি। সেই পুরনো
কথা। ও বাসায় থাকতে হলে তার কথামতোই থাকতে হবে। লোকটার সামনে আমি কখনো মাথা
উঁচু করে দাঁড়িয়ে জোর গলায় কথা বলতে পারি না। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাবা বলে
গেছে, আমি শুনে গেছি। তবে মেজাজ যতই বিগড়ে যাক, এ-ও আমি বুঝি, ও লোকটা আপত্তিকর
বা মিথ্যা কিছু বলছে না।
সকালে বাবার সঙ্গে মেজাজ খারাপ করে নাশতা না করেই বেরিয়েছি। নাশতা করার পয়সা
অবশ্য পকেটেই ছিল। কিন্তু নাশতা করার পর যে পয়সা পকেটে আছে তাতে দুপুরের খাওয়া হয়
না। দুপুরে তাই খাওয়া হয়নি। কয়েক গাস পানি খেয়েছি আর তিন-চারটে সিগারেট। এখন
সামান্য কিছু খুচরো পয়সা পকেটের এক কোণে চুপচাপ পড়ে আছে। দুপুরে খাইনি, কিছু করারও
ছিল না, খামোখাই এদিক-ওদিক হেঁটে হেঁটে সময় পার করেছি। শরীরে এখন খুব ক্লান্তি। নরম
সোফায় বসে সে ক্লান্তি আরো বেড়ে যায়। রাশার কাছে এক গাস পানি চাই। এসব টুকটাক কাজে
রাশা কখনো বাড়ির কাজের ছেলেকে হুকুম করে না। ও নিজেই পানি নিয়ে আসে। ঠা-া পানি
খেয়ে লুকিয়ে একটা তেতো ঢেকুর তুলি। মিরার দিকে আড়চোখে তাকাই। আমার দিকে, না,
আমার দিকে তাকিয়ে নেই ও। ওকে চিন্তিত ও বিমর্ষ দেখাচ্ছে। রাশা পানির গাস রেখে ফিরে এসে

বলে, ‘আপনি একটু শুকিয়েছেন মনে হচ্ছে।’ আমি একটু হাসি, ‘চিত্তে সুখ না থাকলে মানুষ
তো শুকাবেই।’ ‘না-কি!’ রাশাও হাসে, ‘বেশ, এবার আমার ঘরে চলুন।’
রাশাদের বিরাট দোতলা বাড়ির কোথাও কোনো শব্দ নেই। এ বাড়িতে আগে এসেও কখনো
কোনো শব্দ পাইনি। আমি তরতর করে প্রায় এক দমে দোতলায় উঠে আসি। এ বাড়ির কোথায়
কি, তা আমার জানা, এক সময় তো আমি আর মিরা প্রায়ই আসতাম এখানে। আজ অবশ্য প্রায়
সাত-আট মাস পর এসেছি। একটু বদলেছে রাশার ঘর। খাটটা অন্য কোণে নিয়ে গেছে। জানালার
পাশটুকু এখন ফাঁকা। আমরা বসি। রাশা অল্পক্ষণ বসে। ‘মিরা, তোরা কথা বল, আমি আসছি’
বলে বেরিয়ে যায়। বাইরে থেকে দরজা টেনে বন্ধ করে দেয়। জানি, এখন আমরা না বেরুলে রাশা
এ ঘরে ঢুকবে না। অন্য কেউ তো নয়ই।
আগে, এ ঘরটি ছিল আমার আর মিরার নিরাপদ আশ্রয়। এ ঘর ছাড়া আমাদের নিশ্চিন্তে বসে
গল্প করার আর কোনো জায়গা ছিল না। প্রথম যেদিন এসেছিলাম, সেদিনের কথা খুব মনে আছে।
আমি তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। মিরা কলেজে, ইন্টারমিডিয়েট দেবে। সেদিন রাশা অবশ্য
অনেকক্ষণ কথা বলেছিল। তারপর ‘আপনারা বসুন’ বলে দরজা টেনে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমি
সহজ হতে পারিনি। বার বার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাম। মিরা আমার অবস্থা লক্ষ করে অবাক
হয়ে তাকিয়ে ছিল, ‘কী ব্যাপার, তুই মনে হয় নার্ভাস হয়ে গেছিস!’ ‘তা একটু হয়েছি বটে’, আমি
বলেছিলাম, ‘এভাবে দরোজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল! ওর বাবা-মা জানলে কী বলবে?’ ‘কিচ্ছু
না’, মিরা হেসেছিল, ‘রাশা আমাকে বলেছে, ওরা জানবেই না, জানলেও মনে করবেন ওর বন্ধু,
… আমরা ওর বন্ধুই তো।’ ‘হ্যাঁ বন্ধু!’-আমার নার্ভাসনেস কাটেনি, ‘কী বন্ধু! এসেই দরোজা বন্ধ!’
‘ওসব তোর কিছু ভাবতে হবে না’, -মিরা জোর গলায় বলেছিল। রাশাও পরে কথায় কথায়
বলেছিল, ওসব নিয়ে আমার মাথা না ঘামালেও চলবে। ও অবশ্য একটু অবাকই হয়েছিল। আমি
কেন ফ্রী হতে পারছি না, তাও বুঝতেই পারছিল না। এসব অবশ্য প্রথম দিককার কথা। এক সময়
সবকিছুই সহজ হয়ে এসেছে। ওসব দিনের কথ মনে হলে এখন হাসি পায়।
মিরা অবাক হয়ে তাকায়, ‘কী ভাবছো? মুখে হাসি যে!’
‘প্রথম প্রথম যখন এ বাসায় আসতাম, তখনকার কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল।’
‘ও’, মিরা ছোট করে বলে চুপ করে যায়।
কিন্তু মিরা ডেকেছে কেন? আমি যখন এলাম, তখন খুব উদ্বিগ্ন আর ব্যস্ত দেখাচ্ছিল ওকে।
এখন তাকিয়ে দেখি, গম্ভীর মুখে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মেঝেতে আঁকিবুকি কাটছে। আমি উঠে
জানালার পাশে দাঁড়াই কতক্ষণ। কতক্ষণ এদিক-ওদিক করি।
তারপর ধীরে-সুস্থে আবার চেয়ারের ওপর ফিরে জিজ্ঞেস করি, ‘বাসার খবর কি? খালা-খালু
ভালো আছেন?’
জানালা গলে বিকেলের রোদ এসেছে। সে রোদ বিছানার ওপর এসে পড়েছে ত্রিকোণ আকার
নিয়ে। নিচে পুরো বাড়ি চুপচাপ, কোথাও কোনো শব্দ নেই। কখনো হঠাৎ বেসুরো যে শব্দ কানে
এসে পৌঁছে তা বাইরের রাস্তার।
মিরা যেন আমার কথা শুনতেই পায়নি। ও বিছানায় এসে পড়া রোদের দিকে তাকিয়ে থাকে
কতক্ষণ, আমার দিকে ফিরে বলে, ‘তুই মাঝখানে অনেক দিন আসিস নি।’
তা ঠিক, মিরা ভুল কিছু বলছে না, সে তো প্রায় মাস তিনেকের কথা। আমি মিরার দিকে
তাকিয়ে একটু মাথা দোলাই, ‘তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস, … আসলে সময় করে উঠতে পারি না।
কিছু না কিছু কাজে আটকে যাই রোজ। … আজ অবশ্য এমন করে আসতে বলেছিস …’
মিরা একটু হাসে, ‘তাই এসেছিস?’
আমিও একটু হাসলাম, ‘দেখতেই পাচ্ছিস।’
মিরা কতক্ষণ অপলক আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, দাঁতে নখ খোঁটে, শাড়ির আঁচল জড়ায়
আঙুলে, তারপর ফিসফিস করে বলে, ‘এসেছিস, … এখন, এখন তুই কিছু না করলে আমি মরে
যাব।’
মিরা কখনো এভাবে কথা বলে না। ও আর দশটা মেয়ের তুলনায় নরম, কিছু বোকা; কিন্তু
কথা বলার সময় ওর গলা কোনোদিন এমন খাদে নামেনি। আমি চমকে উঠে ওর দিকে তাকাই,
একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করে সহজ গলায় বলি, ‘মরবি, মরবি কেন, দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছিস।’
‘না’, মিরা জোর গলায় বলে সজোরে মাথা নাড়ে, ‘আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, তুই জানিস
না?’
না, আমি জানি না। মাস তিনেক ওর সঙ্গে দেখাই নেই। চিঠিতেও এ বিষয়ে কিছুই লেখেনি।
তাই এ মুহূর্তে খবরটা বড় আচমকা এসে আমাকে অপ্রস্তুত করে দেয়। কী করবো, কী বলবো,
গুছিয়ে ঠিক করতে পারি না, মুখ দিয়ে বোকার মতো বেরিয়ে যায়, ‘বিয়ে মিরা, তোর বিয়ে?’
‘তবে কি তোর?’ মিরা জেদি মেয়ের মতো ফুঁসে ওঠে, ‘ছেলেপক্ষ দেখে গেছে। তুই এখন কী
করবি?’
আমি এখন কি করবো? আমার এখন কি করার আছে? কিছু কিছু পরিস্থিতি এমন তৈরি হয়ে
যায় তখন কি কিছু করার থাকে? এই মুহূর্তে মন বলে, থাকে না। শরীরও সে কথায় সায় দেয়।
আজ সকালে বাবার সঙ্গে যখন কথা কাটাকাটি হচ্ছিল, দুপুরে যখন দু’গাস পানি ঢকঢক করে
খেয়ে খিদে মেটাচ্ছিলাম, তখন কি জানতামÑএরপর কী করবো? না, জানতাম না। এই এখনো
তেমন জানি না। অনেক কিছুই নাগালের বাইরে থাকে, সব সময়, সেসব কখনো জানা যায় না।
জানতে ইচ্ছেও করে না। সাহস হয় না। কিন্তু মিরার বিয়ে!
খবরটা আমাকে ভেতরে ভেতরে সত্যিই কাঁপিয়ে দিয়েছে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না, তাই
কাঁপুনিটুকু সামলে নিয়ে খুব হেলাফেলায় বলার চেষ্টা করি, ‘ধ্যাৎ, তুই ইয়ারকি মারছিস।’
কিন্তু জিভ আটকে যায, একটু তোতলাই, একটু বোধ হয় কাঁপেও গলা। মিরা অবশ্য এসব
লক্ষ করে না। ও সামনে এগিয়ে এসে আমার দু’হাত ধরে সবেগে মাথা নাড়ে, ‘না, ইয়ারকি না,
আমি রোজ কাঁদি, কথা পাকাপাকি হয়ে গেছে, কিন্তু তোর কোনো খবর নেই, আমি এই বিকেল
বেলা তোর সঙ্গে ইয়ারকি মারছি না, তুই কিছু একটা কর।’
‘কিছু একটা করো, কিছু একটা করো’ বাবা প্রথম প্রথম খুব বলতেন এ কথা। এখন বাবার
মেজাজ খারাপ হলেই মা খুব বিষণœ গলায় বলেন, ‘খোকা, তুই কিছু একটা কর।’ কী করবো,
কোথায় করবো, কিভাবে করবোÑ মাকে খুলেমেলে কখনো কিছুই বলা হয় না। আর এখন মিরা
তাকিয়ে আছে অপলক। একটা কিছু করা, এই ‘একটা কিছু করা’ কী চমৎকার বাক্য! কিন্তু কী-ইবা
করা যায, একটু ম্লান হাসি, একটু মাথা দোলাই, বলি ‘আমি কী করবো মিরা?’
‘তুই কি করবি মানে, তুই কেন এ কথা বলছিস, তুই করবি না তো কে করবে, আমি? … হ্যাঁ
হ্যাঁ, আমিই করবো, তুই যা বলবি, আমি তাই করবো’, মিয়া প্রথমে হঠাৎ করেই রেগে ওঠে,
পরমুহূর্তে নিভে গিয়ে করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
চেয়ারের ওপর পুরো শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে বিকেলের রোদের মতো নিস্তেজ নিথর বসে
থাকা ছাড়া আর কিইবা করার আছে! আমি জানালা গলিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। টের পাই, মিরা
আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝি, ও প্রতি মুহূর্তে অপেক্ষা করছে, আমার মুখ থেকে পছন্দসই
এবং প্রয়োজনীয় কিছু শুনবে। কিন্তু আমাকে চোখ ফেরাতে না দেখে শেষে ম্লান, বিমর্ষ গলায় বলে,
‘তুই কিছু করবি না?’
একটু হাতের নখ দেখি, একপলক দেখি ওকে, আমাদের এতদিনের সম্পর্ক, তারপর মুখ নিচু
করে বলি, ‘তুই মিরা, … বিয়েটা তুই করেই ফেল মিরা।’
মিরা করুণ চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে, ‘তুই এ কথা বললি! … না, এ কথা শোনার জন্যে আমি
তোকে এখানে ডেকে আনিনি, সে তো আমি পারি-ই। … কিন্তু তুই সব অস্বীকার করবি?’
অস্বীকার! মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যদি পারতাম! যদি খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠতে পারতাম,
‘আমি অস্বীকার করি’। কিন্তু পারি না, এরকম মনে হলেই গলা বুজে আসে। কত কি-ই তো স্বীকার
করে নিতে হয়, বলি, ‘আমি কী করবো মিরা?’
‘তুই বললে আমি এখনই তোর সঙ্গে বেরিয়ে যাব।’
আমি একটু হেসেই ফেলি, এ অবস্থায়ও। কতক্ষণ চুপ করে থাকি, মাথা নেড়ে বলি, ‘তা হয়
না মিরা। বেরিয়ে কোথায় যাব, কোথায় উঠবো, কী খাব, কী করবো?’
‘কেন, কেন হয় না’, মিরা আমার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছটফট করে ওঠে, ‘কেন হয়
না! তুই একটা চাকরি নিবি, আমার কাছে টাকা আছে। তোর চাকরি না হওয়া পর্যন্ত আমার টাকায়
দু’জনের দিব্যি চলে যাবে।’
কিছু কিছু ছেলেমানুষি আছে, যা মেয়েদের মানায়। মিরার কথা শুনে আমার ভীষণ হাসি পায়।
পরমুহূর্তেই মন আমার খারাপ হয়ে যায়। ওর ছেলেমানুষি নিতান্তই ছেলেমানুষি, তার সঙ্গে আর
কোনো চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বুদ্ধি জড়িয়ে নেই। যদি এমন হতো, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যদি
অতসব চিন্তা-ভাবনার আর মেপেজোখে দেখার প্রয়োজন না পড়তো! কিন্তু আমি জানি, সব
অনিশ্চয়তাকে জীবনে গ্রহণ করা যায় না, আমি ঠেকে শিখেছি আমাদের দেশে কোনো অনিশ্চয়তাই
কোনো অবস্থাতেই নিশ্চয়তার পূর্বাভাস নয়। আমি মিরার দিকে তাকাই না, বলি, ‘ব্যাটারটা
নিতান্তই ছেলেমানুষি হবে মিরা।’
‘কিসের ছেলেমানুষি, কেন ছেলেমানুষি হবে’, মিরা আমার হাত ধরে তীব্র ঝাঁকুনি দেয়, ‘বল
তুই, কিসের ছেলেমানুষি হবে?’
কী বলবো! বলার কিছুই নেই, নিজে না বুঝলে এসব কাউকে বলে বোঝানো যায় না। আমি
কতক্ষণ চুপ করে থাকি। ‘বুঝছিস না তুই’, এক সময় বলি, ‘শোন মিরা, সব জেনে, বুঝে-শুনে
এতটা ইম্যাচুরিটি বোধহয় আমাদের মানায় না। … তুই আমার সব কিছু জানিস।’
‘কী, কী জানি আমি?’
আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি। মিরা তো জানে, ওকে নতুন করে বলার নেই কিছুই।
একপলক মিরার দিকে তাকাই। এমন ব্যগ্র চোখে তাকিয়ে আছে, যেন ও নিশ্চিত আমার মুখ থেকে
অজানা কিছু শুনবে। আমি মাটির দিকে তাকিয়ে বলি, ‘মিরা তুই জানিস আমাদের বাড়ির অবস্থা।
… বাবা ক’দিন পর রিটায়ার করবেন, আমি পাস করে বছর দেড়েক হলো বেকার, চাকরি নেই।
আর চাকরি চাইলেই পাওয়া যায় না, আমার পরে পাঁচটা ভাইবোন। … আর মিরা তুই জানিস,
আমার নিজের কিছু বিশ্বাস আছে, আমি একদম পুরোপুরি জড়িত কখনো ছিলাম নাম, ওকে জড়িত
থাকা বলে না, তবু …, তাছাড়া পার্টির অবস্থা এখন ভালো না, এসবের সঙ্গে আর যাই হোক
তোকে জড়ানো যায় না, যদি এমন হয়Ñ আমার পেছনে পুলিশের লোক, হ্যাঁ মিরা তাও হতে পারে,
সাদা পোশাকের দু’জন লোক দেখি পালা করে আমাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করে।’
‘আমি এর একটাও ভয় পাই না।’ মিরা খুব তীব্র ও জেদিভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি মাথা নাড়ি, ‘না মিরা, ভয় পাওয়া না-পাওয়ার ব্যাপার না। … তুই বাইরে থেকে
অসুবিধাগুলো কখনো বুঝতে পারবি না।’

‘আমিও তো বাইরে থাকতে চাই না। আয় তুই আর আমি একসঙ্গে, তোর কথামতো ভেতর
থেকে দেখি।’
এর কী উত্তর? আমি আবার ছোট করে বলি, ‘মিরা, সত্যি করে বলছিÑ তুই বুঝবি না।’
‘বুঝবো না, না? বুঝবো না, তবে তুই আগে এসব বলিসনি কেন?’
এ কথার কোনো উত্তর নেই। একটা বয়স থাকে যখন সম্পর্কের ইচ্ছে মনের ভেতর তীব্রভাবে
জেগে ওঠে, তখন অন্যান্য সব বন্ধন ছাপিয়ে নতুন একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন পড়ে।Ñ আমার মনে
হয়, আমি কিংবা মিরা কেউই জানতাম না, আমাদের আরম্ভ ছিল এভাবে। তখন অন্য কিছু ভাবার
প্রয়োজন পড়ে না, ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না, আমিও কিছু ভাবিনি, মাথা ঘামাইনি। কিন্তু
আমি কি জানতাম, আমাদের সম্পর্ক একদিন এরকম যান্ত্রিকভাবে শেষ হয়ে যাবে? না, জানতাম
না। তখন কোনো অসুবিধে চোখের সামনে ভাসতো না। কিন্তু এখন এক-একটা অসুবিধে চোখের
সামনে ভেসে ওঠে। মনে হয়, আমার সামনে সবকিছু এক-এক করে বদলে যাক, আমি একটা
চাকরি পাই, বাবা আমাকে তার লক্ষ্মী সন্তান হিসাবে কাছে টেনে নিক, তখন আমার আর মিরার
সামনে কোনো বাধা থাকবে না।Ñ কিন্তু এসব কি এত সহজে হয়।
বাইরে বিকেলের রোদ মরে আসছে, সন্ধ্যে নামবে একটু পর, আমি মিরাকে এড়িয়ে সেদিকে
তাকিয়ে থাকি। মিরা খুব শান্ত গলায় হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ‘তুই আমাকে ভালোবাসিস?’ কী অদ্ভুত
প্রশ্ন, আর এখন আচমকা; আমি তো হলফ করে বলতে পারি, বাসি মিরা, বাসি। মিরা জিজ্ঞেস
করে অল্প একটুক্ষণ অপেক্ষা করে। তারপর আমার দু’কাঁধের ওপর হাত রেখে তীব্র ঝাঁকুনি দেয়।
যেন এভাবে আমাকে ফিরিয়ে আনবে, বলে, ‘বল, ভালোবাসিস।’
আমি সামান্য মাথা নোয়াই, ‘তুই জানিস না?’
‘তবে এমন কেন করছিস?’
‘তোর জন্যে যেটা ভালো হবে, আমি তো শুধু সেটাই বলছি।’
‘আমার ভালো আমি নিজে বুঝি না?’
নিজের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা মানুষের থাকে বৈকি। কিন্তু ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা
থাকলেও সে হিসেবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কি তার থাকে? তার আয়ত্তে থাকে? থাকে না। আমি
চুপ করে থাকি। মিরা তখন ‘তবে শোন’ বলে আমার দৃষ্টি ওর দিকে ফিরিয়ে আনে। খুব দ্রুত
শাড়ির আঁচল সরিয়ে বাউজের বোতাম খুলে দেয়, ‘দেখ, দেখ তুই এখানে মুখ রেখেছিলি। রেখে
কি বলেছিলি, শুনবি?’
আমি হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকি, তারপর ক্লান্ত গলায় বলি, ‘মিরা, তুই পাগলামি
করছিস।’
‘আর তুই আমাকে নিয়ে এতদিন যা করেছিস, সেসব?’
উত্তেজনায় মিরা হু হু করে কেঁদে ফেলে।
আমি ফিসফিস করে বলি, ‘ওসব কখনো পাগলামি ছিল না, মিরা।’
‘তবে, তবে কি ছিল, লুচ্চামি’, উত্তেজনায় মিরা কাঁপে। এই শেষ বিকেলে রাশার নির্জন ঘরে
আমার সামনে মিরা শরীরের উপরাংশ উন্মুক্ত করে হুহু করে কাঁদে, বলে, ‘বল, তুই বল, কেন তুই
আমার শরীর ছুঁয়েছিলি, কেন আমার বুকে মুখ রেখেছিলি?’
বলা যায় না, জীবনে কত কী ভেঙেচুরে বলা যায় না! আর তাছাড়া মানুষ সব সময় তো সব
প্রশ্নের জবাব জানেও না। আমি বলি, ‘ঠিক হয়ে বস মিরা, রাশা কোনো সময় চলে আসবে।’
‘আসুক’, মিরা ফোঁপায়, ‘আজ এদিকে তাকাচ্ছিস না কেন? আজ কেন রাশার আসার প্রশ্ন!’
আমি মুখ নিচু করে বসে থাকি।

মিরা বোধ হয় একটু হাসে, একদম অচেনা গলায় বলে, ‘তুই কি ভাবছিস এত সহজেই
সবকিছু চুকে-বুকে গেল?’ ঐ অচেনা গলার আওয়াজে আমি চমকে যাই। মিরার দিকে বোকার
মতো তাকাই। মনে হয়, না, তা যায় না, এভাবে চুকে-বুকে যায় না বাইরে কোনো ফাটল থাকে
না, কিংবা কোনো দাগ; কিন্তু ভেতরে দাগ, গভীরে; সে দাগ মোছে না। কিন্তু মিরা এখন এসব
কিছুই শুনবে না, বিশ্বাস করবে না। আমি আবার মাথা নিচু করেই বসে থাকি, মেঝেতে পায়ের
বুড়ো আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটি, একটু পর বলি, ‘আমি এখন যাই মিরা, আমাকে আরেক
জায়গায় যেতে হবে।’
‘তবে তাই যা’, মিরা পরমুহূর্তে আশ্চর্য রকম সহজ হয়ে যায়। খুব সহজে, সাবলীল অভ্যস্ত
হাতে বুকের কাপড় ঠিক করে নিতে নিতে বলে, ‘কিন্তু ভাবিস না সব চুকে-বুকে গেল, … শুধু তো
নিয়েই গেলি, দেবার বেলায় কিচ্ছু না, … মনে রাখিস, তুই ঋণী থেকে গেলি আমার কাছে।’
আমি চমকাই, ‘কি বললি?’
‘খুব সহজ কথা, আমার কিছু পাওনা থাকলো তোর কাছে।’
পাওনা, ঋণ? আমার কাছে, মিরার? বুঝি না, এ মুহূর্তে তলিয়ে ভাবতেও ইচ্ছে করে না, উঠতে
উঠতে বলি, ‘তা, তোর হবু স্বামী কী করে?’
আমার এই সহজ প্রশ্নের ধার দিয়েও যায় না মিরা। একপলক তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসে। উঠে
দাঁড়িয়ে একপাশে সরে চুল ঠিক করতে করতে বলে, ‘ওসব তোর জানার দরকার নেই।’
নিচে নেমে আসি। মিরার দিকে একবারও তাকাই না। নিচে না নামা পর্যন্ত কেউ আমাকে লক্ষ
করে না। ড্রইংরুমে বসে রাশা বিদেশী ম্যাগাজিনের পাতা উল্টোচ্ছিল। আমাকে দেখে একটু হাসে,
তারপর অবাক হয়ে যায়, ‘একা যে, মিরা বুঝি ওপরে?’ আমি সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে দরোজার
দিকে এগোই। আমাকে দরোজার দিকে এগোতে দেখে রাশা উঠে দাঁড়ায়, বলে, ‘শুনুন।’ ফিরে
দেখি রাশা তাকিয়ে আছে সরু চোখে, ‘যাচ্ছেন বুঝি?’ আমি জবাব দেই না। আমার ভয় করে।
ভয় করে, হঠাৎ যদি রাশা বলে বসে, ‘আমার কিছু পাওনা থেকে গেল আপনার কাছে।’ কিসের
পাওনা? আমি নিজেকেই জিজ্ঞেস করি। নিজেই জবাব দেইÑ সে তো কত রকম হতে পারে! যদি
বলে, ‘এতদিন খুব তো আমার ঘরে বসে নানা ন্যাকা কথা বললেন, আর নানা রকম
সুযোগ-সুবিধাও নিলেন। এখন দিয়ে যান।’ কী? কী দিতে বলতে পারে রাশা আমি নিজেকে আবার
জিজ্ঞেস করি। আবার নিজেই উত্তর দেইÑ যদি বলে, ‘দিয়ে যান, যা আছে পাওনা, প্রাপ্য।’ কিন্তু
সেরকম কিছুই ঘটে না। আমি আড়চোখে লক্ষ করি, রাশার ঠোঁটে এক চিলতে বাঁকা হাসি। আমি
দ্রুত পা বাড়াই। সদর দরোজা পেরিয়ে, বাইরের গেট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসি। পেছনে
একবারও ফিরে তাকাই না। বেশ কিছুটা পথ দ্রুত হেঁটে এসে থামি।
এখন কী করবো ভেবে পাই না। কোথাও যাওয়ার নেই। পকেটে খুচরো কিছু পয়সা মুখ থুবড়ে
পড়ে আছে। জোরে হাঁটলে ওসব পয়সার আওয়াজ হয়। ঐ আওয়াজ পর্যন্তই এর বেশি আর কিছু
করার ক্ষমতা নেই ঐ কয়েকটি পয়সার। পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। যখন
মিরার সঙ্গে দেখা করতে আসি, তখন ঠিক করেছিলাম, ওর কাছ থেকে কিছু টাকা নেব। মিরা ছাড়া
খুব কম মেয়ের সঙ্গে আমি মিশলেও, একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি, ওদের ব্যাগে সব সময় কিছু না
কিছু টাকা থাকেই। আগে মিরার কাছে যখনই চেয়েছি তখনই পেয়েছি; পাঁচ, দশ, পনেরো কখনো
পঞ্চাশও। কিন্তু আজ তো আর চাওয়ার পরিস্থিতি ছিল না। তাই এখন শুকনো এ ক’টা পয়সা
সম্বল। তবে খুব একটা ভাবাভাবির মধ্যে গেলাম না। আড়াল পেয়ে পেচ্ছাব করি, নিজেকে একটু
হালকা হালকা লাগে। এরপর সোজা এক ছাপরা হোটেলে ঢুকে পড়ি। পরপর দু’গাস পানি খাই,
তারপর এক কাপ চা। চা শেষ করে একটা সিগারেট যখন ধরালাম, তখন পকেটে দশ পয়সা
গড়াগড়ি খাচ্ছে। ব্যাপারটা উড়িয়ে দেই। এ তো আর আজকেই প্রথম নয়, কোনো কোনো
দিন পকেটে ফুটো পয়সাও থাকে না।
ছাপরা হোটেল থেকে বেরিয়ে খামোকাই অনির্দিষ্ট কতক্ষণ ঘোরাঘুরি করি। কখনো রাস্তার এক
কোণে দাঁড়িয়ে থাকি। শেষে পার্কে এসে এক বেঞ্চে বসি। নামেই পার্ক, দেখে বোঝার উপায়
নেই। তবু এই শেষ নিকেলে কিছু লোক এসেছে। আর আছে কিছু ভাম্যমাণ ফেরিঅলা, পতিতা
ও দালাল। জোচ্চর-বাটপারও কিছু আছে। ওদের দেখে আমার পক্ষে চেনা সম্ভব না, হয়তো কারো
পক্ষেই নয়। কিন্তু ওরা আছে, কারণ ওরা থাকে। তবে এসব কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না। আমি
কখনো দূরে কোনো গাছের দিকে তাকিয়ে থাকি, কখনো তাকিয়ে থাকি পায়ের আশেপাশে ঘাসের
দিকে। মিরার কথা কিছু ভাববো না ঠিক করেছি। কিন্তু কিছু না ভেবে কি পারা যায়! অনবরত
টুকরো স্মৃতি অতল থেকে ঘাই খেয়ে উঠে আমাকে এলোমেলো করে দেয়। খুব কষ্ট হয় নিজেকে
সামলে রাখতে। সব সময় কি সবকিছু সামলে রাখা যায়! মনে হয়, যে আমাকে দেখবে, সে-ই
বুঝবে, এক পরাজিত পুরুষ বসে আছে।
কিন্তু মিরা ওকি বললো? ওর পাওনা থাকলো আমার কাছে? আমি ঋণী থেকে গেলাম ওর
কাছে? না, সামান্য ভেবেএ চিন্তা বাদ দিতে হয়। এখন কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করে না। সবকিছু
ছাপিয়ে শরীরে টের পাই অসম্ভব ক্লান্তি। মিরার ওসব কথা ভেঙেচুরে দেখতে শরীর সায় দেয় না।
এখন শরীর চায় এক নিটোল, পরিচ্ছন্ন বিশ্রামের জায়গা। পার্কের এই কাঠের বেঞ্চে বসে শরীরে
ধস নামে।
শেষে উঠে পড়ি। দাঁড়িয়ে থাকি কতক্ষণ, তারপর হনহন করে হাঁটতে আরম্ভ করি। পরক্ষণেই
হাসি পায়। হনহন করে হেঁটে যাওয়ার মতো কোনো গন্তব্য নেই আমার। নিজের বাড়িও না। তবে
ওভাবে হাঁটছি যে? এই প্রশ্নের উত্তর নেই।
সকালে যখন বাবার সঙ্গে কথা কাটাকাটির পর বেরিয়ে আসি, তখন ঠিক করেছিলাম, ফিরবো
না, আর ফিরবো না, এ বাড়িতে। এখন পকেট শূন্য ক্লান্ত শরীর সে ইচ্ছেয় সাড়া দেয় না। তবু
জেদ ধরে রাখার চেষ্টা করি। বাড়ি ফিরলেই তো মার অসহায় মুখ, ভাইবোনগুলোর দূরত্ব বজায়
রেখে চলা, সামনা-সামনি হলে অবজ্ঞা মেশানো বাবার কঠিন চোখ!Ñ এসবের মুখোমুখি হতে ইচ্ছে
করে না।
কিন্তু আর কোথাও তো যাওয়ারও নেই। তাছাড়া বাড়ি তো ফিরতেই হয়Ñ এই রকম ভেবে
মনের দ্বিধা কিছু কাটে। তবে বাড়ির কাছাকাছি হয়েই সতর্ক হই। মিরাকে মিথ্যা বলিনি। সত্যিই
দু’জন লোক পালা করে বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করছে। লোক দুজন সরকারের নিরাপত্তা বিভাগের
কেউ হলে এটা হবে এক আশ্চর্য ঘটনা। কারণ পার্টির সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, কিংবা আমি যে
পর্যায়ের কর্মীÑ এসব বিচার করলে আমার বাড়ির সামনে সাদা পোশাকের কাউকে মানায় না।
পার্টি বেআইনী, এটা ঠিক, তবু ব্যাপারটা মানানসই নয়। সে যাই হোক, ঐ লোক দু’জনের কী
উদ্দেশ্য তা জানা সম্ভব না। তবে এ ধরনের লোক বিপজ্জনক, এটুকু জানি, তাই বেশ কিছুটা দূর
থেকেই আমি সতর্ক হই, আর যাই জোক, লোক দু’জনের কারো সামনে পড়ে আমি নার্ভাস হয়ে
যেতে চাই না। বাড়ির কিছু দূরের একটা গাছের পেছনে নিজেকে লুকিয়ে উঁকি দেই। এখান থেকে
অনেকটা পথ চোখে পড়ে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। কাউকেই চোখে পড়ে না। আমার স্বস্তির
নিঃশ্বাস পড়ে।
আমাদের বাড়িটা মাঝারি আকারের। বাড়িটা দাদার ছিল। বাবার আর কোনো ভাই না থাকায়
এখন পুরোপুরিই তার। আর কিছু না থাকুক, বাসায় আমার একটা আলাদা ঘর আছে। ইচ্ছে
করলে আমরা পুরো ঘর ভাড়াও দিতে পারি। কিন্তু বাবার কিছু অদ্ভুত ব্যাপার আছে। এই যেমন,
দুটো ঘর ভাড়া না দেয়া। সে যাই হোক, বাড়িটা থাকায় আমাদের অনেক সুবিধে, ভাড়া বাসায়
থাকতে হচ্ছে না। বাসা ভাড়া করে থাকতে হলে বাবার বেতনে আমাদের দশ দিনও চলতো না।
বাসায় ফিরে প্রথম প্রথম একটু লজ্জা লাগে। পরমুহূর্তে অবশ্য বুঝতে পারি, খামোকা ইতস্তত
করছি। কারণ, আমি যে বাড়ি ফিরবো না বলে মনস্থ করেছিলামÑ সে প্রতিজ্ঞার কথা কেউ তো
জানে না। আর তাছাড়া কতদিনই বাবার ধমক খেয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেছি বাড়ি থেকে,
এরপর আবার ফিরে তো এসেছি ঠিকই।
সুতরাং এখন সঙ্কোচ করে থাকা অর্থহীন। আমি রোজকার মতো পোশাক পাল্টে হাত-মুখ ধুয়ে
নিলাম। ডাক এলে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলাম।
খাবার সময় মা সব সময়ই পাশে থাকে। আমি ভাতের সঙ্গে তরকারি আর ডাল খুব ভালো
করে মেখে নিয়ে একগ্রাস মুখে পুরে বলি, ‘শুনেছো নাকি, মিরার বিয়ে?’
‘কার বিয়ে?’ মা চোখ তুলে তাকায়।
‘বিয়ে, মিরার বিয়ে’, আমি খুব হঠাৎ একটু খেঁকিয়ে উঠলাম।
‘মিরার বিয়ে!’ মা যেন কঁকিয়ে ওঠে। মার স্বভাবটাই এই। খুব অল্পতেই চমকে যায়, ঘাবড়ে
গিয়ে এলোমেলো কা- করে বসে। এখন, না তাকালেও বুঝি, মা আমাকেই দেখছে।
‘তুই গিয়েছিলি মিরাদের ওখানে?’
‘নাহ্’, আমি খুব হেলাফেলায় উত্তর দেই, ‘রাস্তায় এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো, ও মিরাকে
চেনে, সেই বন্ধুই বললো, … সামনের মাসে সম্ভবত।’
‘আহারে’, মা কেমন ভেঙে পড়া গলায় বলে, ‘এত ভালো মেয়েটা।’
“এর মধ্যে তুমি ‘আহারে’ পেলে কোথায়? তুমিই বলছোÑ ভালো মেয়ে, বিয়ে হচ্ছেÑ খুশির
খবর। ‘আহারে’ কেন?”
মা আমাকে লুকিয়ে বড় একটা শ্বাস ফেলে, ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করে,Ñ ‘ছেলে কি করে?’
‘আহ্, আমি অত কিছু খোঁজ নিয়েছি নাকি!’
‘খুব হঠাৎ করে বিয়ে’, মা মৃদু গলায় বলে।
‘হঠাৎ করে কোথায়, ওর বয়সও তো কম হলো না … মিরা নাকি বিয়েতে রাজি ছিল না।’
মা চুপ করে থাকে।
আমি বলি, ‘আজ তরকারি কে রেঁধেছে মা, খুব ভালো হয়েছে।’
খেয়ে উঠে বাবার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট সরাই। এ কাজটা আমি খুব ভালো পারি।
ঘরে বসে সিগারেট অর্ধেক শেষ করেছি, এমন সময় বারান্দা থেকে বাবার ডাক আসে। সিগারেট
নিভিয়ে রেখে বারান্দায় বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে বাবা বলে, ‘বস, চা খাও।’ বাবার এই অদ্ভুত
অভ্যেস, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে চা খাওয়া। না খেলে রাতে নাকি বাবার ঘুম হয় না। সেই
ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। মা বলে দাদারও এই অভ্যেস ছিল। আমার নেই। তবে এখন
খেতে হবে।
বারান্দায় দুটো চেয়ার। সামনে ছোট টেবিল, টেবিলের ওপর দুটো চায়ের কাপ। দেখে বুঝি,
বাবা হঠাৎ করে ডাকেনি, প্রস্তুতি বেশ কিছুক্ষণের। আমি একটু ইতস্তত করি। সকালেই এক পশলা
কথা শুনেছি। তাছাড়া এই বয়সে, রাতে চায়ের অভ্যেস থাকুক আর না থাকুক, বাবার পাশে বসে
চা খেতে কেমন যেন লাগে। না বসেও অবশ্য পারি না। চায়ের কাপ টেনে নিয়ে জড়সড় হয়ে বসি।
বাবা বাইরে গেটের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, ‘তোমার আগামীকাল চাকরির একটা ইন্টারভিউ
আছে না?’
শুনে অবাক হয়ে যাই। বাবা কী করে জানে! মৃদু গলায় বলি, ‘হ্যাঁ, আছে।’
‘যাচ্ছ তো?’
আমি কিছু বলি না। ইন্টারভিউ কম দেয়া হলো না।
আমার উত্তর না পেয়েও বাবা বলে, ‘সারাদিন টো টো করে না ঘুরে একটু বইপত্র উল্টালেও
পারতে।’
আমি চুপ করে থাকি।
‘কয়েক দিন হলো একটা লোককে দেখছি আমাদের বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করে। লোকটাকে
তুমি চেন?’
আমি মৃদু গলায় বলি, ‘না।’
‘আজ বিকেলের দিকে লোকটাকে দেখেছি। তা, কী জন্যে তার এই ঘোরাঘুরি তা নিশ্চয়
জান?’
আমি মাথা দোলাই, ‘জানি।’
‘সবার ওসব ঘোড়া রোগ মানায় না, বুঝেছো? ওসবের জন্যে অন্য ধরনের লোক দরকার, তুমি
সে ধরনেরও নও। তাছাড়া তোমার জন্যে বাড়ির আর সবার বিপদ হোক তা আমি চাই না। তুমিও
নিশ্চয় চাও না। … তুমি ওসব পার্টিফার্টি ছেড়ে দাও।’
আমি চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলি, ‘আচ্ছা।’

দুই
‘দেন।’
আমার সামনে তিন পাথরের মূর্তি। আমার নাম-ধাম আর টুকিটাকি দু-একটা প্রশ্ন করার পর
একজন হাত একটু বাড়িয়ে দেয়, ‘দেন।’
এই ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখোমুখি হওয়ার এই একটু আগেও ছিলাম বাইরের একটা ঘরে।
মাঝারি আকারের ঘর। মানুষজন ছিল ঠাসাঠাসি করে বসে, এদিক-ওদিক দাঁড়িয়ে। আমি খুব
সকালে এসেছিলাম বলে কোনোমতে বসার জায়গা পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু অনেক্ষণ ধরে, এই
প্রায় ঘণ্টা তিনেক এক নাগাড়ে বসে থাকতে থাকতে পিঠ ব্যথা। একটু উঠে যে এদিক-ওদিক
করবো, সে সুযোগ নেই। বলতে গেলে শরীরের ওপরই হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে কয়েকজন।
একবার উঠলে আর বসার জায়গা ফেরত পাওয়া যাবে না।
তবু ঐ বসা অবস্থায়ই কোনো রকমে শরীরটা একটু এদিক-ওদিক করি। সামান্য সময়ের জন্যে
অবসাদ কিছু কাটে বৈকি! কিন্তু সে কোনো ব্যাপার নয়। অল্পক্ষণেই শরীর আবার ভারী হয়ে আসে,
পা দুটো টনটন করতে আরম্ভ করে। একটা সিগারেটের ইচ্ছা জেগেছে সেই কখন। সঙ্গে দুটো
সিগারেট ছিল, সে দুটো বহু আগে শেষ। এখন হা-পিত্যেশ করি, এদিক-ওদিক তাকাই, ভাবি,
একটা সিগারেট রেখে দিলেও পারতাম। রাখা হয়নি, এখন সিগারেট-তৃষ্ণা এড়িয়ে বসে থাকা
ছাড়া উপায় নেই। সিগারেট আনতে হলে বাইরে যেতে হবে। ঘরের দরোজার বাইরে ফুটপাথের
কোণ ঘেঁষে বাক্স নিয়ে এক বিক্রেতা, কিন্তু অতোটা দূরে সিগারেট কিনতে যাওয়া মানে ফিরে এসে
অনির্দিষ্ট কালের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকা। সে ইচ্ছে আমার নেই।
আড়মোড়া ভেঙে দুবার মাথা ঝাঁকিয়ে ঘরের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত একবার তাকাই।
ভালো করে তাকালে বোঝা যায় ঘরটা আসলে মাঝারি নয়, বড়ই। মানুষজনের এমন ঠাসাঠাসি
ভিড়ের কারণে ঠিক আকার বোঝা যাচ্ছে না। কত লোক যে বসে কিংবা ঠায় দাঁড়িয়ে! দাঁড়িয়ে
যারা, তারা অধিকাংশ দেয়ালে হেলান দিয়ে। এত লোক দেখে বারবার নার্ভাস হয়ে যাই, মনে হয়
খামোকাই আসা। তখন খামোকাই সঙ্গে আনা মার্কশীট, সার্টিফিকেট এসব মোটা এক খামের
ভেতর থেকে বের করে দেখি। যখন-তখন, পরিস্থিতি একটু বেকায়দামতো হলেই নার্ভাস হয়ে
যাওয়ার ব্যাপারটা আমার বহু দিনের। বহু চেষ্টা করেও এটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তবে নার্ভাস
হলেও, এখন কোনো খারাপ চিন্তা মাথায় এলেই সেটা মুহূর্তের মধ্যে ঝেড়ে ফেলছি।
আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছি। বারান্দায় চেয়ার টেনে বসে থেকেছি অনেকক্ষণ। তখন
আবোল-তাবোল কত কী মনে হয়! মনে হয় মিরার কথা। সম্পর্ক তো আমাদের অল্পদিনের নয়।
তাই হাজার স্মৃতি। সকালবেলা সেগুলো বড্ড জ্বালায়। আর মিরার কাছে আমার ঋণ? কী পায়
মিরা আমার কাছে? কবে চাইবে? আমি বারান্দা থেকে উঠে ঘরে চলে আসি।
নাশতার টেবিলে সবাই একসঙ্গে। এই নিয়মটা বাসায় এখনো চালু আছে। নাশতা শেষ করে
ইন্টারভিউ দিতে বেরোনোর প্রস্তুতি। প্রস্তুতি আর কি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তো একটা খামে তুলে
রাখাই আছে। তবে একটু ফিটফাট হওয়ার চেষ্টা করি। গোসল সারি, দাড়ি কামাই। বাবা আমাকে
তৈরি হতে দ্যাখে, দেখে কাজে বেরিয়ে যায়। মা দ্যাখে, ছোট ভাইবোনগুলোও। কেউ কিছু বলে
না। প্রথম প্রথম মার উৎসাহ ছিল প্রচুর। ছেলের চাকরি হবে, নিজেই তাই প্রয়োজনীয় সবকিছু
গুছিয়ে রাখতো। ফিরলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতো, কী কী প্রশ্ন এসেছে, আমি কেমন উত্তর
দিয়েছি, এসব। ছোট ভাইবোনগুলোও খুব উৎসাহী ছিল। প্রথম যেদিন ইন্টারভিউ দিতে
গিয়েছিলাম, সেদিন বাসায় সাজ সাজ রব দেখে একদম ছোট ভাইটা বলেছিল, ‘ভাইয়া, আমার
জন্যে একটা লাল বল নিয়ে এসো।’ এখন কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না। যেন সবাই ধরেই নিয়েছে,
চাকরি আমার হবে না। তবে ইন্টারভিউ দিয়েই যেতে হবে।
সে যাক, এখন ক্ষিধেয় পেটের ভেতর বেশ আপ-ডাউন খেলা চলছে, কখনো কোনো নাড়িতে
টান পড়ছে। খুব হঠাৎ করেই খেয়াল হয় সকালের নাশতা জুতসই হয়নি। এখানে এভাবে কতক্ষণ
বসে থাকতে হবে তার কোনো ঠিক নেই। ঘরের একপাশে প্যাসেজের শেষ মাথা কিংবা কোণ
থেকে এক চাপরাশি নাম আর সিরিয়াল নাম্বার ধরে ডাকছে। আর এ ঘর থেকে কেউ একজন
তড়িঘড়ি উঠে যাচ্ছে, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, ফেরার নামটি করছে না। এতক্ষণ ধরে একেকজন
প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে! আমাকেও দিতে হবে! মনে হলেই শরীরে কাঁপুনি ধরে। এই কাঁপুনিটুকুই বড়
অসহ্য। ইন্টারভিউ তো কম দিলাম না, তবু কথা নেই বার্তা নেই, কাঁপুনি আসে, এড়াতে পারি না।
দুপুরের আগে ভিড় পাতলা হয়ে আসে। অর্ধেকের বেশি লোক বেরিয়ে গেছে। তবে তাদের
কাকে কী জিজ্ঞেস করেছে জানার উপায় নেই। ইন্টারভিউ শেষ হলে অফিসের পেছনের দরজা দিয়ে
বের করে দিচ্ছে। তা দিক, কী জিজ্ঞেস করেছে তা কি কেউ বলতে চায়, নাকি তা জেনে কোনো
লাভ আছে? সবাইকে তো আর এক প্রশ্ন করে না। আমি ভিড় পাতলা হয়ে আসছে দেখে প্যান্ট-শার্ট
টেনেটুনে নেই, মোটা খাম খুলে দেখে নেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সব ঠিক ঠিক আছে কিনা।
কিন্তু কপালে কিছু ভোগান্তি ছিল। তাই চাপরাধি এসে জানালো, ইন্টারভিউ আপাতত বন্ধ,
ঘণ্টাখানেক পর লাঞ্চ-আওয়ার শেষ হলে আবার শুরু হবে। তা, কী আর করা! মাথা গরম করে
তো কোনো লাভ নেই। এদিকে পকেটেও যথেষ্ট পয়সা নেই যে দুপুরের খাবারটা এখানেই সেরে
নেব। একটা শিড়ারা আর এক কাপ চা খাই। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে কষে টানতে থাকি।
আমার ইন্টারভিউটা হলো খুব মজার। পেটে ক্ষিধে নিয়ে চেয়ারে বেশ গ্যাঁট হয়ে বসে ছিলাম।
লাঞ্চ-আওযার শেষ হওয়ার আধঘণ্টার মধ্যে আমার ডাক পড়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে সব স্নায়ু সজাগ
হয়ে উঠেছিল, খুব দ্রুত উঠে দাঁড়ানোর ফলে মাথা একবার চক্কর খেয়েছিল বটে, তবে সেটা গ্রাহ্যের
মধ্যে আনিনি।
ভেতরে বসেছিল পাথরের তিন মূর্তি। সালাম দিলে একজন বসতে বললো। এসব ব্যাপার
আমার তো প্রায় মুখস্থ, আমি খামের মুখ খুলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সব এগিয়ে দিলাম।
একজন হাতে নিল বৈকি; কিন্তু সামান্য চোখ বুলিয়ে ওগুলো নিয়ে যেন খেলতে আরম্ভ করলো।
একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘নাম।’ তারপর ঠিকানা। যেন এগুলো কত দরকারী ব্যাপার।
একজন একটা দেশের রাজধানীর নাম জানতে চাইলো। আরেকজন জানতে চাইলো দেশের
শাসনকার্যে কোন্ পদ্ধতি আমার পছন্দ এবং কেন।
এ সবের পালা শেষ হলে একজন গম্ভীর মুখে হাত বাড়িয়ে দিল, ‘দেন।’
আমি অবাক। কি দেব? প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র তো টেবিলের ওপরই। আমাকে অবাক
হয়ে তাকাতে দেখে সে লোকই আবার বলে, ‘দেন।’
আমি বললাম, ‘কী?’
এবারে পাথরের তিন মূর্তি অবাক হয়ে যায়, ‘কী! অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট কই?’
আমি আরো অবাক হয়ে যাই, অভিজ্ঞতার কথা তো কোথাও লেখা ছিল না। আমি সে কথা
বললে তিনজন আমাকে দেখে। একজন বলে, ‘তা লেখা না থাকতে পারে, কিন্তু যারা এসেছে আজ
তাদের সবারই কম-বেশি অভিজ্ঞতা আছে। … থাকতে হবে, আমরা অভিজ্ঞতা প্রেফার করি।’
তাদের বলার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, আমার কাছে তাদের অভিজ্ঞতা পাওনা আছে, এখন তা
চাচ্ছে।
আমি আর কথা বাড়াই না। টেবিলের ওপর রাখা কাগজপত্র উঠিয়ে নিয়ে খামে পুরে বেরিয়ে
আসি। কাজটা খুব সহজভাবে করি। কিন্তু বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে টের পাই, বাড়াবাড়ি হয়ে
গেছে। আমি আরো কিছুক্ষণ কথা চালাতে পারতাম, বলতে পারতাম, অভিজ্ঞতা নেই ঠিক, কিন্তু
প্রশ্ন করলে সহজে আটকাবো না। কিন্তু এখন পস্তিয়ে লাভ নেই। অবশ্য তাতে খুব একটা লাভ
হতো বলেও মনে হয় না। এক মূর্তি ‘দেন’ বলে যেভাবে হাত পেতেছিল, তাতে মনে হয়, কিছু না
পেলে শূন্য হাতে সে কিংবা বাকি দু’জন কিছুতেই সন্তুষ্টি হতো না। তাদের চাওয়ার মধ্যে অবশ্য
খুব প্রচ্ছন্ন একটা হেলাফেলার ভাব ছিল। যেমন, মিরা গতকাল বলেছিল, ‘আমার কিছু পাওনা
থাকলো তোর কাছে’, ঠিক তেমনি।
এদিকে মাথার ওপর শেষ দুপুরের জ্বলন্ত রোদ। পেটের মধ্যে ক্ষিধের আপ অ্যান্ড ডাউন খেলা
চমৎকার। এসব কিছুই ভাববো না ঠিক করে একটা সিগারেট ধরিয়ে কষে টান দিয়ে অনেকক্ষণ
ধরে কাশি।
এই অসময়ে বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। ঘুরেফিরে বারবার তিন মূর্তির মুখ আর ‘দেন’
বলে একজনের বাড়িয়ে দেয়া হাত ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ঐ বাড়ানো হাত লক্ষ্য করে ইচ্ছে
হয় লাথি বসাই। কিন্তু কোথায় হাত! সামনে রাস্তা। ঐ রাস্তার দিকেই পা উঠিয়ে দেয়া যায়।
কয়েক পা এগোতেই এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও
অনেকদিনের বন্ধু, আর অনেকদিন দেখাও নেই।
‘এখানে দাঁড়িয়ে ভ্যাবলার মতো কি করছিস?’ প্রশ্ন শুনে আমি চমকে পেছনে ফিরে তাকিয়ে
বন্ধুকে দেখি।
সামান্য একটু হেসে নেই, তারপর শুকনো মুখে জবাব দেই, ‘একটা ইন্টারভিউ দিয়ে
বেরোলাম, … হবে নারে, … ওরা কিছু চাচ্ছিল, দিতে পারিনি।’
‘অ্যাঁ, কি চাচ্ছিল রে?’
‘অভিজ্ঞতা। এমনভাবে চাইলো, যেন ওদের পাওনা।’
শুনে বন্ধু খ্যাকখ্যাক করে হাসে, ‘চল চল, চা খাব এখন।’
তা, চা পর্বটা বেশ ভালোই হয়।
‘দুপুরে কিছু খাইনি … খাওয়া হয়নি … ইন্টারভিউয়ের জন্যে বেরোনোর সময় পেলাম না’,
এই বলে দুটো শিড়ারা আর একটা কিমা পরোটা সাবার করে দেই।
একটা ঢেকুর ওঠে, তেতো। পিত্ত চড়া হয়েছে। এখন বোধ হয় চা খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু
শরীর ম্যাজম্যাজ করছে, আলস্য। সুতরাং চা খাই। চা শেষ করে বন্ধুর দামি সিগারেট ধরিয়ে খুব
আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়ি। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করি, ‘বেশ আছিস মনে হচ্ছে। কী করছিস?’
বন্ধু বলে, ‘টুকটাক।’
ঐ বন্ধুর সঙ্গেই থাকি অনেকক্ষণ। বন্ধুর সঙ্গে এদিক-ওদিক যাই। নানান অফিসে নানা ধরনের
লোকের সঙ্গে ওর তুই-তোকারি থেকে আপনি ভালো আছেন স্যার জাতীয় সম্পর্ক। ভালো মানুষের
মতো আমি কখনো বন্ধুর পাশে থাকি, কখনো পেছনে। পাশে আর পেছনে থাকতে থাকতে টুকটাক
ব্যাপারটা কিছু কিছু বুঝি।
সন্ধ্যের দিকে বন্ধুর সঙ্গে যাই আমাদের এক পুরনো আড্ডায়। আমি এ আড্ডা ছেড়েছি বহুদিন
আগে। আমার তো আসলে এখন আর এই আড্ডায় আসা মানায় না। নানা রকম মন্তব্য শুনতে
হয়। প্রথম প্রথম তাও আসতাম। কিন্তু সব বন্ধু এদিক-ওদিক চাকরি বা ব্যবসা জুটিয়ে নিয়েছে,
তাদের কড়া মন্তব্য মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে, আমি তাই আসা বন্ধ করে দিয়েছি।
আজ অবশ্য পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় তারা খুশিতে আর কিছুটা
আশ্চর্য হয়ে হৈহৈ করে ওঠে। তাদের সবারই খুব জমকালো ভাব, তাদের চেহারা,
পোশাক-আশাক, কথাবার্তাÑ সবকিছুতেই চেকনাই। আড্ডায় বসে কথায় কথায় আমাকে এক
সময় বলতেই হয়, আজ দুপুরেও আমি একটা ইন্টারভিউ দিয়েছি। শুনে এক বন্ধু খুব হাসে, ‘দিয়ে
যা দোস্ত, তুই পারিসও বটে, তোর কপাল একদিন খুলবেই। আমরা অল্পতেই চাকরি পেয়ে গেছি,
তুই পাচ্ছিস না; ঐ যে কথায় আছে না, যে গাছ লকলক করে বাড়ে সে পড়েও জলদি। আমাদের
অবস্থা সেরকম হবে দোস্ত, আর তুই তো ধীরে ধীরে উঠছিস …।’ বাকিটুকু বলতে হয় না, একটা
হুলোড় পড়ে যায় আড্ডায়।
আরেক বন্ধু আমার পিঠ চাপড়ে দেয়, বলে, ‘রবার্ট ব্রুশ অব টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি। কে তোকে
ঠেকায়!’ আবার হাসির হুলোড় ওঠে। আমাকেও হাসতে হয় সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে। কিন্তু
ভেতরে ভেতরে আমার ইচ্ছা করে ঐ দুই বন্ধুর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে। এজন্যেই আমি এ
আড্ডায় আসা ছেড়ে দিয়েছি। মাঝে মাঝে এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় যে মাটির সঙ্গে
মিশে যেতে ইচ্ছে করে। ইতিমধ্যে আরেক বন্ধু কিছুটা দূর থেকে উঠে এসে বসেছে আমার পাশে।
সে আমার ডান হাতটা টেনে নিয়ে হাতের তালু দেখে খুব মনোযোগের সঙ্গে। তারপর খুব গম্ভীর
গলায় বলে, ‘তুই দোস্ত ভূত তাড়ানোর কোনো পাথর পর আঙুলে। তোর কপাল খুলে যাবে।’
আবার হাসি।
এমনটা অবশ্য বেশিক্ষণ চলে না। আমাকে ছেড়ে এক সময় সবাই আড্ডায় জমে যায়।
এক-এক করে আরো অনেকে এসেছে। তাদের সবাইকে আমি চিনিও না। তাদের সব কথাও আমি
বুঝি না। কাপের পর কাপ চা চলছে, সবার হাতে দামি সিগারেট। একবার দু’জন খুব সামান্য
ব্যাপার নিয়ে দু’হাজার টাকা বাজি ধরে ফেলে। আমি লুকিয়ে একটা শ্বাস ফেলি, দীর্ঘশ্বাস। তারপর
উঠি।
বন্ধুকে বাইরে ডেকে এনে খুব নরম গলায় বলি, ‘তুই আমার একটা উপকার করবি? ঐ
টুকটাকের লাইনটা আমাকে একটু ধরিয়ে দিবি?’
বন্ধু হেসে ইয়ারকির ছলে ধাক্কা দেয়, ‘যা ভাগ, ওসব সবাই পারে না … তুই পারবি না।’
‘পারবো’, আমি খুব জোর গলায় বললাম।
‘পারবি না।’
‘পারবো।’
বন্ধু কতক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর হাসতে হাসতে হঠাৎ বললো,
‘দে।’
‘কি’, আমি খুব অবাক।
‘দশ মিনিটের মধ্যে লোক ঠকানোর তিনটা উপায় বাতলে দে।’
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম।
বন্ধু আবার বললো, ‘দে।’
‘কি?’
‘অফিসের বড় সাহেবের হাঁড়ির খবর বের করার একটা পথ বের করে দে।’
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
বন্ধু বললো, ‘দে।’
‘কি?’
‘ঘুষ দেয়ার তিনটা উপায় বাতলে দে।’
আমি মাথা নাড়লাম।
বন্ধু বললো, ‘সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না, বুঝেছিস?’
আমি হাসলাম, ‘কিন্তু তুই এমনভাবে এসব জানতে চাইলি, যেন আমি তোর কাছে ঋণী।’
‘আমার কাছে নয়’, বন্ধুও একটু হাসে, ‘যাদের সঙ্গে তুই কাজ করবি তাদের কাছে, … যা,
এখন বাড়ি যা।’
ফুরফুরে বাতাসে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরে আসি। বাবা তখনো ফেরেনি। মার মুখোমুখি হলে
মাথা নেড়ে খুব সহজ গলায় বললাম, ‘ইন্টারভিউ এক দম ভালো হয়নি মা, চাকরিটা হবে না।’
তন
চাকরিটা হলো না। এ তো জানাই ছিল, নিশ্চিতই ছিলাম। সুতরাং বিন্দুমাত্র মন খারাপ হয়
না। কিন্তু বাবা ব্যাপারটা মোটেই সহজভাবে নেয় না। বাসায় বাবার সঙ্গে এমনিতে কথা হয় না।
আমি যতক্ষণ বাসায় থাকি ততক্ষণ নিজের ঘরে থাকি। সামনা-সামনি পড়ে গেলে আমি মুখ নিচু
করে পাশ কাটাই।
তবে এক বিকেলে বাবা ডেকে পাঠায়। সেদিন আমি বাড়ি থেকে বের হইনি। বাড়ির সামনে
যে লোকটা ঘুরঘুর করতো তাকে কয়েকদিন হলো দেখছি না, তাই নিশ্চিন্ত ছিলাম। লোকটার কথা
ভেবে হাসি পেত মাঝে মাঝে। আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সবকিছু চোখে চোখে রাখার কোনই
প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু হয়তো বড় কর্তার আদেশ। অবশ্য তার নিজেরই আমাকে সন্দেহ হয়েছে,
এমনও হতে পারে। সে যাই হোক, ইদানীং লোকটাকে দেখি না বলে আমি স্বস্তি পেয়েছি। এখন
এমনিতেই মন ভালো নেই, মন খারাপ হয়ে আছে তো আছেই, এ সময় যদি একটা লোক আমার
পেছনে ঘুরঘুর করতো তবে সেটা খুব খারাপ ব্যাপার হতো।
বাবা বারান্দায় বসে ছিল। সামনে চায়ের কাপ। আধ কাপ মতো চা শেষ হয়েছে। আমাকে
দেখে বললো, ‘বস।’
আমি বসলাম। ঠিক কী বলবে তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। তবে আমার ভবিষ্যৎ,
চাকরি-বাকরি এসবই আলোচনার বিষয় হবে, আমার জানা ছিল। অবশ্য আলোচনা শব্দটা ব্যবহার
করা উচিত নয়। কারণ আলোচনা বলতে পারস্পরিক মত বিনিময় বোঝায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে
বাবা বলে যাবে, আমাকে সম্মতি জানাতে হবে। আমার বিন্দুমাত্র বিরুদ্ধাচরণ বাবা এখন সহ্য
করতে পারে না, আমি জানি।
কথাবার্তা আমার আন্দাজমতোই আরম্ভ হলো, ‘এখন কী করবে বলে ঠিক করলে?’
আমি চুপ করে থাকলাম।
‘এভাবে যে চলে না, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পার।’
আমি একটু ঘাড় নাড়লাম।
‘আমার চাকরির বয়স প্রায় শেষ, কিন্তু তোমার কিছুই হলো না, এদিকে তোমার ছোট
ভাইবোনগুলোর লেখাপড়া শেষ হতে অনেক দেরি।’
আমি আবারও মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালাম।
‘তা, তুমি এখন কী করবে?’
আমি কী বলবো! এমন নয় যে আমার কিছুই করার ইচ্ছে নেই। কিন্তু সুযোগ মিলছে কোথায়!
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বাবা এবার অসহিষ্ণু গলায় বললো, ‘তুমি পাস করে
বেরিয়েছো সে তো কম দিন হলো না।’
সে তো আমিও জানি।
‘এতোদিন তো নিজে চেষ্টা করে দেখলে, কিছু করতে পারলে না, এবার দেখি আমি তোমার
জন্যে কিছু করে দিতে পারি কিনা। তোমার আপত্তি না থাকলেই হলো। অবশ্য তোমার আপত্তি
করার তেমন যুক্তিসঙ্গত কারণও নেই।’
আমার জন্যে বাবার চেষ্টাটা কী রকম হতে পারে? চেনা-জানা কাউকে বলবে আমার জন্যে?
হতে পারে। আমি অবশ্য আপত্তি করবো না। কিছুদিন আগে হলেও অবশ্য রাজি হতাম না। বাবার
সঙ্গে এজন্যেই কথা কাটাকাটি হতো। কিন্তু এখন খুব ক্লান্ত লাগে নিজেকে। বাবা কোথায়,
কিভাবে, কাকে কী বলে আমার ব্যবস্থা করবে তা ভাবতে ইচ্ছে হয় না। শুধু মনে হয়, একটা
ব্যবস্থা হলেই হলো।
বাবা বললো, ‘তোমার সঙ্গে এখন ওসব পার্টি-ফার্টির কোনো সম্পর্ক নেই আশা করি।’ আমি
বললাম, ‘না, সম্পর্ক নেই।’
‘তুমি কাল বিকেলে আমার সঙ্গে লতিফ সাহেবের ওখানে যাবে।’
বাবা খুব শান্ত গলায় বলে, বুঝি এ কথায় নড়চড় হবে না। তবু আমি বলি, ‘কেন?’
‘তা তো তুমি জান, জান না?’
‘লতিফ সাহেব কী করবেন?’
‘এটাও তো তুমি জান। তুমি তার কথা শুনলে তোমার জন্যে একটা চাকরি জোগাড় করে দেয়া
তার জন্যে কোনো ব্যাপারই নয়।’
‘লোকটাকে আমার পছন্দ নয়।’
‘আমারও নয়, কিন্তু লতিফ সাহেব ক্ষমতাবান।’
কী বলবো ভেবে পাই না। লতিফ সাহেবকে আমার বিন্দুমাত্র পছন্দ নয়। কিন্তু লোকটা সত্যিই
প্রচুর ক্ষমতা রাখে, কিছু তরুণের মধ্যে এবং আমাদের পাড়ায় তিনি খুব জনপ্রিয়। তিনি ইচ্ছে
করলেই আমার জন্যে কিছু করতে পারেন। কিন্তু ইচ্ছে নেই তার কাছে যাওয়ার।
চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে আমি বললাম, ‘দেখি।’
‘দেখাদেখির কিছু নেই, তুমি কাল বিকেলে আমার সঙ্গে যাবে।’
আমার ঘুমের সমস্যা অনেকদিনের। মাঝে মাঝে এমন হয়, সারা রাত ঘুমহীন কেটে যায়।
আজ রাতেও ঘুম হবে না টের পেয়ে যাই। রাতের খাওয়া শেষ হলে নিজের ঘরে বসে থাকি
কতক্ষণ। খুব পুরনো কিছু ম্যাগাজিন এখনো গুছিয়ে রেখেছি, সেগুলো উল্টেপাল্টে দেখি। শেষে
যখন টের পাই বাসার সবাই শুয়ে পড়েছে তখন বারান্দায় গিয়ে বসি। সিগারেট ধরাই। বাইরে দূরে
তাকিয়ে থাকি।
কখন মা এসে পাশে বসেছে টের পাইনি। পাশ ফিরে হঠাৎ তাকে দেখে চমকে উঠি, ‘কখন
এলে?’
‘এই তো’, মা হাসলো, ‘তুই কী যেন ভাবছিলি।’
আমিও একটু হাসলাম, ‘আর ভাবনা …’
মা বোধ হয় কিছু বলবে। ভাবসাব দেখে তাই মনে হয়। বারবার আমার মুখের দিকে তাকায়,
ইতস্তত করে।
আমি বললাম, ‘কিছু বলবে মা?’
মা বাচ্চা মেয়ের মতো মাথা নাড়লো, কতক্ষণ চুপ করে থাকলো, তারপর খুব হঠাৎ করে
বললো ‘দিবি খোকা?’
আমি খুব চমকে গেলাম, ‘কি দেব মা?’
মা সামান্য হাসলো, ‘তুই তো আমার বড় ছেলে, তুই আমার গর্ব খোকা …
‘বল।’
‘… তুই যখন ছোট্ট ছিলি তখন থেকেই আমার মনে হতো তুই একদিন বড় হবি, তুই অনেক
লেখাপড়া শিখবি, বড় একটা চাকরি নিবি, সকালে যখন অফিসে যাবি তখন আমি তোকে গেট
পর্যন্ত এসে বিদায় দেব …’
‘কিন্তু তুমি কী চাইছিলে? কী দেব মা?’
‘তুই একটা চাকরি নে। সকালে উঠে যখন অফিসে যাবি তখন আমি তাকিয়ে থাকবো, আমার
খুব গর্ব হবে, … তুই আমাকে তোকে নিয়ে একটু গর্ব করার সুযোগ করে দে খোকা।’
‘চাকরি তো পাচ্ছি না মা।’
‘তুই কাল তোর বাবার সঙ্গে লতিফ সাহেবের ওখানে যা।’
আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকি। বাইরে তাকিয়ে থাকি। মা আমার দিকে তাকিয়ে আছে
বুঝতে পারি। মার দিকে ফিরে খুব মৃদু গলায় বলি, ‘আচ্ছা মা, যাব।’
পরদিন খুব মিরার কথা মনে হয়। লতিফ সাহেবের কাছে যখন যেতেই হচ্ছে তখন তো আগে
গেলেও পারতাম। এক বছর আগে, পরীক্ষা শেষ করে বেরোনোর পরপর, কিংবা ছ’মাস আগে।
লতিফ সাহেব এখন যেমন পারেন, এক বছর আগে ঠিক তেমনই পারতেন। তখন গেলে জীবন
এখন অনেক নিশ্চিন্ত হতো। আমিই হয়তো এর মাঝে একদিন খুব দৃঢ় পায়ে যেতে পারতাম মিরার
কাছে, বলতে পারতাম, ‘মিরা আর দেরি নয়, বিয়েটা বোধ হয় এখন সেরে ফেলা উচিত।’ মিরা
হেসে বলতো, ‘তাই? তা বিয়ে যে করব, আমাদের সংসার কী করে চলবে শুনি?’ আমি বলতাম,
‘আহ্ মিরা, ইয়ারকি নয়, তুই তো জানিসই আমি একটা ভালো চাকরি করি, মা’ও তোকে খুব
পছন্দ করে।’ মিরা চোখ বড় করে তাকাতো, ‘তাই বুঝি, ঠিক আছে, এবার তাহলে বল বিয়েটা
কবে হবে, আমি শুনি।’ আমি তখন গুছিয়ে বলতে আরম্ভ করতাম, বলতাম বিয়েটা কবে হবে,
বলতাম বিয়ের পর আমরা কোথায় কোথায় যাব। বলতাম, আমরা যাব বনভূমিতে, সেখানে হঠাৎ
বিশাল সব পাথরের চাঙর, এবং কোনো এক চাঙর ভেদ করে তীব্র বেরিয়ে এসেছে ছোট এক
খরস্রোতা নদী। বলতাম, মিরা তুই কি জানিস, জীবন এই নদীর মতোই তীব্র বহমান?’ এসব বলা
হলো না। উল্টো মিরার কাছে আমি ঋণী থেকে গেলাম। হিসেব করে দেখলাম, খুব বেশিদিন
হয়নি মিরার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছে। অথচ মনে হয় সেই কতদিন আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। তবে
এসব ছাপিয়ে মিরার সেই শেষ কথাই কানে বাজে অধিকাংশ সময়, ‘তুই ঋণী থেকে গেলি, আমার
কিছু পাওনা থাকলো তোর কাছে।’ ভয় হয় কখনো কখনো, মিরা খুব ঠা-া গলায় ও-কথা
বলেছিল। মিরা কি হঠাৎ কোনোদিন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আবার খুব ঠা-া গলায় বলবে, ‘দে।’
আমি বোকার মতো ওর মুখের দিকে তাকালে ও আবার বলবে, ‘ফেরত দে, আমার পাওনাটুকু।’
আমি তখন কী করবো? জানি না।
শুধু মনে হয় লতিফ সাহেবের কাছে আগে গেলে আমাকে এত সব কিছুর মুখোমুখি হতে হতো
না। খামোখা দিন কয়েক আগে ইন্টারভিউ বোর্ডে পাথরের তিন মূর্তির সামনেও যেতে হতো না
আমাকে। তারা হাত বাড়িয়ে খুব হেলাফেলায় বলতেও পারতো না, ‘দেন।’ আমার সেই বন্ধুও
আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ‘দে’ বলে আমাকে বিভ্রান্ত করে দিতে পারতো না। এখন
এতসব সহ্য করে আমাকে লতিফ সাহেবের কাছে যেতে হচ্ছে। খুব হাসি পায়। লতিফ সাহেব
আমাকে দেখে কী করবেন? আমাকে চেনেন সেই ছোটবেলা থেকে। আমাকে দেখে শুধু চোখ তুলে
তাকিয়ে ইঙ্গিতে বসতে বলবেন, নাকি খুব অবাক হয়ে যাবেন, ‘আরে আরে, সেই ছোট তুমি কত
বড় হয়ে গেছ, আর আমার কাছে যে একদম আসো না!’ আমি তখন কি বলবো, ‘কেন, এই যে
এলাম’ এটুকু? হয়তো তাই। কারণ এছাড়া আর কিইবা বলার থাকবে!
চার
‘দাও।’
হঠাৎ এমন ভাবে শব্দটা উচ্চারিত হয়, মুহূর্তের মধ্যে আমার ভেতরে যেন ভূমিকম্প ঘটে
গেল। আমি বোকার মতো লতিফ সাহেবের দিকে তাকালাম। লতিফ সাহেব হাসি মুখে কাগজটা
বাড়িয়ে রেখেছেন, আঙুল দিয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গা দেখিয়ে বলরেন, ‘দাও, … হ্যাঁ, এখানে।’
লতিফ সাহেবের কাছে এসেছি বিকেলের পরপর। বাবা সঙ্গে ছিল। লতিফ সাহেব খুব
আন্তরিকতার সঙ্গে বাবার সঙ্গে হাত মেলালেন। আমার দিকে একপলক তাকালেন। ঘরে আরো
কিছু লোক ছিল। ‘আমি এদের সঙ্গে কথা সেরে নেই, আপনারা একটু বসুন, তারপর গল্প করা
যাবেক্ষণ’, বাবার দিকে তাকিয়ে বলে লতিফ সাহেব অচেনা কিছু লোকজনকে নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে
পড়লেন।
আমি চেয়ারে বসে ভদ্রলোককে লক্ষ্য করতে আরম্ভ করলাম। আর দশটা লোকের মতোই,
আলাদা করে কিছুই নজরে পড়ার মতো নয়। তবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা
বলার সময় তার মুখের আকার বদলে বদলে যায়, এটুকুই। সম্ভবত এ ব্যাপারে তিনি জ্ঞাত নন,
নইলে চেষ্টা করে সব সময় মুখ এক রকম রাখতেন নিশ্চয়, এবং এ রকম রাখাই যুক্তিসঙ্গত ও
সুবিধেজনক।
পাশের চেয়ারে বাবা কোলের ওপর অ্যাশট্রে রেখে খুব গম্ভীর হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে
সিগারেট টানছে। ছেলেকে নিয়ে লতিফ সাহেবের কাছে আসতে হয়েছে বলে তার কি খারাপ
লাগছে? কোনো রকম গানি, অক্ষমতার? আড়চোখে বাবাকে লক্ষ করি কিছু বোঝা যায় না।
বাইরের লোকজনকে বিদায় করে লতিফ সাহেব সোজা আমার দিকে ফিরলেন, ‘তুমি খোকা,
না? … চিনতে আমার ভুল হয়নি, তোমরা না হয় আমাদের কোনো খোঁজখবর রাখো না, কিন্তু
আমরা বড়রা তোমাদের খোঁজখবর না রেখে পারি না। কি বলেন, ইসলাম সাহেব?’ বাবা হাসলো,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো বটেই।’ লতিফ সাহেব হাসেন না, ‘আজকালকার ছেলেরা মুরব্বিদের খুব
ইগনোর করে, এই যেমন খোকা, ওর তো আমার কাছে সকাল-বিকেল দু’বেলা আসা উচিত,
অথচ আসে না, আজ হঠাৎ করে চলে না এলে হয়তো আরো কয়েক বছরের মধ্যেই দেখাই হতো
না।’ লতিফ সাহেব এমনভাবে কথা বলেন যেন আমার আসার কারণ সম্বন্ধে কিছুই জানেন না,
যেন আমরা তার বাসায় বেড়াতে এসেছি।
বাবা এর পরপরই উঠতে চাইলো। কিন্তু ‘চা খেয়ে যাবেন!’ শুনে তাকে আরো কিছুক্ষণ বসতে
হলো। চা খেতে খেতে টুকটাক কথা হয়। দু’জনেই দেশের যুব-সম্প্রদায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে,
নৈতিকতা বলে কোনো কিছু থাকছে না, এ ধরনের কথা বলে প্রায় উদাস হয়ে যায়।
বাবা চলে গেলে লতিফ সাহেব একটা চুরুট ধরালেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খোকা,
তোমার পুরো নাম কি যেন?’
এমন ভাব, যেন আমার পুরো নাম এই একটু আগেও জানতেন, এখন ভুলে গেলেন।
আমি বললাম, ‘রায়হান ইসলাম।’
‘সুন্দর নাম, কিন্তু খোকা এসবের তো কোনো মানে হয় না, বোহেমিয়ান তোমাদের বয়সে
আমিও ছিলাম, বুঝেছ? তাই বলে চাকরি করিনি এমন তো নয়, … তুমি শুনলাম চাকরি করতে
চাও না, উঁহু, মোটেই ভালো ব্যাপার নয়, তোমার বাবা নাকি তোমাকে বুঝাতেই পারছেন না, তবে
তোমাকে যখন কাছে পেয়েছি তখন তোমাকে বুঝিয়ে আমি ঠিক রাজি করাবো।’
ভদ্রলোক স্রেফ মিথ্যা কথা শেষ করে খুব দিলখোলা হাসি হাসেন। চুরুটটা নিভে গিয়েছিল,
আবার ধরিয়ে বলেন, ‘চাকরি তোমাকে করতেই হবে, আমার কিছু বন্ধু বান্ধব আছে বুঝেছো,
বিভিন্ন ধরনের অফিস ওদের, সবাই আমার কাছে ইয়ং, ব্রাইট আর এনার্জেটিক ছেলে চায়, অ্যান্ড
সি মাই বয়, য়ু আর ওয়ান অব দেম।’
শুনে আমি পুলকিত হই। হাসি চেপে রেখে সুবোধ বালকের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
‘খোকা, মন ঠিক কর, বললাম না তোমার মতো উড়– উড়– ভাব এক সময় আমারও ছিল,
সুতরাং আমি তোমাদের বুঝি, তোমার জন্যে এমন চাকরির ব্যবস্থা করা হবে যে তুমি সেখানে
একটুও বিরক্ত হবে না, বুঝেছো খোকা? তুমি তোমার বাবার কথায় রাজি হয়ে যাও, চাকরি নিয়েই
নাও।’
এ ধরনের অর্থহীন কথা আর ভালো লাগে না, একটু জোরের সঙ্গেই বলি, ‘চাকরি করার
ব্যাপারে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
‘রিয়েলি’, লতিফ সাহেব আমার জোর গলায় একটু চমকে উঠেই পরমুহূর্তে সামলে নিয়ে
উলাস প্রকাশ করেন, ‘গুড, ভেরি গুড, তোমার বাবা শুনলে রিয়েলি পিজড হবেন … আর হ্যাঁ,
কালকেই তোমার মার্কশীট, সার্টিফিকেট ওসব আমাকে দিয়ে যাবে। এখন চা খাও, না না, চা না,
কফি; তুমি চাকরি করতে রাজি শুনে আমার খুব ভালো লাগছে।’
কফি খেতে খেতে লতিফ সাহেব এক নাগাড়ে প্রশ্ন করেন। সে নানা ধরনের প্রশ্ন,
বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সাবজেক্ট ছিল, সাবজেক্ট হিসেবে ইতিহাস কিংবা অর্থনীতি কেমন লাগে এসব
জিজ্ঞেস করতে করতে প্রেমট্রেম করেছি কিনা তাও জানতে চান, এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করেন
রাজনীতি সম্পর্কিত খুঁটিনাটি বিষয়।
কফি শেষ হলে তিনি নিভিয়ে রাখা চুরুটটা ধরিয়ে নিলেন, বললেন, ‘তুমি তো এখন যাবে,
তাই না খোকা, ঠিক আছে, একটু দাঁড়াও।’
লতিফ সাহেব সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ড্রয়ার খোলেন, হাফ ফুলসক্যাপ সাইজের একটা
কাগজ বের করেন, তারপর সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘দাও।’
‘অ্যাঁ, কি?’
কাগজটা আমার দিকে বাড়ানোই, লতিফ সাহেব বলেন, ‘তোমার একটা সিগনেচার, হ্যাঁ,
দাও, এখানে।’ আঙুল দিয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গা দেখিয়ে দেন তিনি।
আমি কতক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারলাম না। বোকার মতো চুপ করে বসে থাকলাম।
‘কি হলো খোকা?’
‘ঐ কাগজে কি লেখা?’
‘তেমন কিছুই নয়।’
‘সিগনেচারের কী দরকার?’
‘বারে! লতিফ সাহেব হাসলেন, ‘তুমি ঘাবড়াচ্ছো মনে হচ্ছে, অথচ দেখ ব্যাপারটা তেমন
কিছুই নয়, তোমার নতুন জীবন আরম্ভ হচ্ছে …’
আমি মাথা নাড়লাম, ‘না, আমি সিগেনচার দেব না।’
লতিফ সাহেব কতক্ষণ অপলক তাকিযে থাকলেন আমার দিকে, তারপর ঠা-া গলায় বললেন,
‘দেখ, তোমার রেকর্ড খারাপ …’
‘হোক, এ ধরনের বিনিময়ে আমি রাজি না, আমার চাকরির দরকার নেই …’
‘তুমি চাকরি কর আর না কর, সিগনেচার তোমাকে দিতেই হবে, আজ কিংবা কাল, কিংবা
আরো দু’দিন পরে। … নাও, ছেলেমানুষি করো না।’
আমি উঠে পড়লাম। লতিফ সাহেব এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রাখেন, মৃদু একটা চাপড়
দিয়ে বলেন, ‘দেখ খোকা, এই কাগজটা আসলে কিছুই নয়, তুমি তোমার পার্টির সঙ্গে সব ধরনের
সম্পর্ক ছিন্ন করেছো, এখন আমাদের সঙ্গে আছ, দেশের ভালো চাও, নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ
এটা এ ধরনের একটা স্বীকারোক্তি মাত্রা।’
‘আমি কখনো কোনো পার্টি করতাম না।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, করতে না’, লতিফ সাহেব সামান্য হাসলেন, ‘কিন্তু চাকরির জন্যে
একটা বন্ড তো লাগে, তুমি মন দিয়ে কাজ করবে, কোনো রকম গ-গোলে যাবে নাÑ এ ধরনের
একটা স্বীকারোক্তি তো লাগে, দাও।’
‘না’, আমি মাথা নাড়লাম, আর দাঁড়ালাম না, লতিফ সাহেবকে আর কিছু বলার সুযোগ না
দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলাম।
রাস্তায় এসে আর এদিক-ওদিক তাকাই না। সোজা বাসায় চলে এলাম। বাবা ছিল বারান্দায়
বসে। আমাকে হনহন করে আসতে দেখে অবাক হয়ে তাকালো, ‘কী হলো?
আমি বললাম, ‘যত্তসব।’
‘ব্যাপারটা কি?’
‘দিতে হবে, সিগনেচার।’
‘অর্থাৎ।’
আমি যেটুকু বুঝেছি বাবাকে খুলে বলি। বাবা কতক্ষণ চুপ করে থাকলেন, আমার দিকে
তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি সিগনেচার দাওনি?’
‘দিলে আর এসব কথা কেন?’
‘কেন দাওনি?’
‘দাসখত দেব কেন?’
বাবা সামান্য হাসলো, ‘দাসদের খত তো দিতেই হবে।’
‘আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
‘কিন্তু তোমার বাবার পক্ষে সম্ভব। অর্থাৎ, আসলে তোমার পক্ষেও সম্ভব। ওসব
উপন্যাস
আনন্দপাঠ ২০১৫ ঈদ সংখ্যা ২১৭
বিদ্রোহ-ফিদ্রোহ বাদ দাও, কাল সকালে উঠেই যেও।’
‘যাব না।’
বাবা যেন আমার কথা শুনতেই পেল না, ‘লতিফ সাহেবকে কি রাগিয়ে এসেছ? অবশ্য
ভদ্রলোক এসব সাধারণ ব্যাপার নিয়ে রাগবেন না।’
‘আমি কাল যাব না।’
‘অবশ্য ভদ্রলোক রাগ করলেও সামলাতে পারবো।’
‘আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।’
‘সম্ভব। কাল ভদ্রঘরের ছেলের মতো যাবে। যা করতে বলবেন তুমি তাই করবে।’
‘আমি যাব না।’
‘যাবে। শোন, কাল সকালে উঠে তোমার প্রথম কাজ হবে লতিফ সাহেবের কাছে যাওয়া।
তিনি এমন কিছু করতে বলেননি যে পার্লামেন্ট মেম্বারের মতো তোমার ওয়াকআউট করতে হবে।
আমি যা বললাম, মনে রেখ।’
বাবা আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে ঘরের ভেতর চলে গেলেন।
পাঁচ
চাকরি তবু একটা হয়েই যায়।
লতিফ সাহেবই ব্যবস্থা করে দেন। আমি খুব অবাক হই। এমন নয় যে, বাবার ধমক খেয়ে
পরদিনই আমি লতিফ সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম। সেদিন বরং সারাদিন আমি বাসায়ই ছিলাম,
শুয়ে-বসে। যেন কিছুই হয়নি, এমন ছিল ভাব। কিন্তু চিন্তা যে হচ্ছিল না, এমনও নয়।
বাবা অফিস থেকে ফেরেন সন্ধ্যের পর। তার আধঘণ্টা পর আমাকে ডেকে পাঠান। একটা
খাম আমার দিকে বাড়িয়ে দিলে বলেন, ‘ধর, কাল থেকে জয়েন করবে।’
ব্যাপারটা বুঝতে পারি না আমি। হাত বাড়িয়ে খামটা নেই বৈকি, তবে অবাক হয়ে বাবার
মুখের দিকে তাকিয়েও থাকি। বাবা গম্ভীর গলায় বলে, ‘ওটা তোমার চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট
লেটার।’
‘কোন্ চাকরি?’
‘লতিফ সাহেব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’
‘ও চাকরি আমি করবো না।’
‘কেন?’
এই ‘কেন’র মুখেই আমাকে থমকে যেতে হয়। আসলেই তো, কেন আমি লতিফ সাহেবের
দেয়া চাকরি করবো না!
একটুক্ষণ থেমে থেকে বলি, ‘তিনি দাসখত চেয়েছিলেন। … লোকটা ভালো না।’
বাবা অদ্ভুতভাবে হাসে, ‘লোকটা ভালো না! তুমি বলছো এই কথা! আশ্চর্য, তোমার অমন
অভদ্রতা আর বেয়াদবি সত্ত্বেও তোমাকে চাকরি দিলেন। আর তুমি বলছো লোকটা ভালো না!’
‘হ্যাঁ, বলছি।’
‘কেন? একটু খুলে-মেলে বল, দেখি তোমার বাবা বোঝে কিনা।’
‘বললাম তো, লোকটা দাসখত চেয়েছিলেন।’
বাবা আবার হাসে, ‘শোন। তোমার বয়স কম, বুঝতে পারছো না। দাসদের দাসখত দিতেই
হয়, তোমাকে বলেছি। এটা একটা চিরস্থায়ী ব্যাপার। বহুদিন টিকে আছে এবং থাকবে। এ
নিয়ে তোমার উদ্বিগ্ন বা মনঃক্ষুণœ হওয়ার কিছু নেই।’
‘চাকরিটা হলো কিভাবে? আমি তো যাইনি লতিফ সাহেবের কাছে।’
‘তোমার বাবা গিয়েছিল।’
‘তারপর?’
‘অত শোনার তোমার দরকার নেই। লতিফ সাহেব লোক ভালোÑ হাসিমুখে তোমাকে চাকরি
দিয়েছেন। এখন কাল থেকে তুমি জয়েন করবে। এই হচ্ছে পুরো ব্যাপার, বুঝেছো?’
‘লতিফ সাহেব কি করুণা করলেন?’
বাবা অদ্ভুত চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে, ‘যারা করুণার
পাত্র, তাদের মানুষ করুণা ছাড়া আর কী দেবে?’
‘আমি এ চাকরি করবো না।’
‘তুমি করবে।’
‘করবো না।’
‘করবে।’
‘না।’
‘হ্যাঁ।’
বাবা আর আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকি বেশ কিছুক্ষণ। এক সময় আমারই চোখের পাতা
কেঁপে যায়। আমি সামান্য মাথা ঝাঁকাই, ‘ঠিক আছে, … যাব। কাল থেকে তো?’
‘হ্যাঁ, কাল থেকে।’
আমি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই বাবা আবার মুখ খোলে, ‘শোন। কাল আমি খুব সকালে এক
কাজে বেরুবো। তোমার সঙ্গে সকালে দেখা নাও হতে পারে। তাই কিছু কথা এখনই বলে রাখছি।’
আমি স্থির দাঁড়াই।
বাবা বলে, ‘তুমি তো অস্বীকার করতে পারবে না, একটা চাকরি তোমার খুব দরকার ছিল।’
‘না, পারবো না। দারকার ছিল।’
‘কিন্তু সে চাকরি তুমি নিজে জোগাড় করতে পারনি। যদিও স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী তোমারই
চাকরি জোগাড় করার কথা। আমি কি ভুল বললাম?’
‘না, ঠিকই বলেছ।’
‘চাকরি তুমি আমার কারণে পেলে। সে যেভাবেই হোক না কেন।’
‘হ্যাঁ।’
বাবা এবার হাসে, ‘তাহলে তোমার কাছে কিছু পাওনা হয়েছে আমার। আমি বলতে চাচ্ছি
বিনিময়ে আমাকেও কিছু দিতে হবে তোমার।’
‘কী?’
‘সুস্থ এবং ভদ্র জীবনÑ এটুকুই তুমি দেবে আমাকে। যাও, তোমার মাকে গিয়ে চাকরির খবরটা
দাও।’
মাকে খবর দেয়ার তাগিদ অনুভব করি না। মা খবর পাবে, মা’রা খবর পেয়েই যায়। আমি ফিরে
আসি নিজের ঘরে। চাকরির চিঠিটা হাতেই, খুলতে ইচ্ছে করে না। কেন ইচ্ছে করে না এই ভেবে
অবাক হই। বাসায় বাবাও জানে না, কিন্তু আমি নিজে তো জানি একটা চাকরির জন্যে কী পরিমাণ
হন্যে আমি। তাহলে এখন কেন খুলে দেখতে ইচ্ছে করে না চাকরির চিঠি! ব্যাপারটা অমীমাংসিত
থেকে যায়। কারণ এ নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে না। আমি চিঠিটা খুলে ফেলি।
এমনভাবে চোখ বুলোই যেন এমন চিঠি পড়ে পড়ে অভ্যস্ত আমি। তবে এক সময় একটু
শিহরণও অনুভব করি। চাকরি, হ্যাঁ, একটা চাকরি তবে হচ্ছে! হচ্ছে কেন, হয়ে গেছে।
আগামীকালই যোগ দিতে হবে। এবার সময় নিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে চোখ বুলাই। চিঠিটা
বারবার পড়ি। এবং আমার বিশ্বাস হতে চায় না।
স্টোর-কীপারের চাকরি। একটা বেসরকারী অফিস। বেতন ভালো। সকাল-বিকাল অফিস।
তবে প্রয়োজনে আরো বেশি সময় দিতে হতে পারে। তা না হয় দিলাম। এসব এখন কোনো
ব্যাপারই নয় আমার কাছে। একটা চাকরি হয়েছে, এই সুসংবাদ ক্রমশ এত বড় হয়ে যায় যে,
আমি আর কিছুই ভাবতে পারি না।
আমার ঘুম হয় না। বেশ অনেক রাতে উঠে এসে বারান্দায় বসি। চারপাশ কবরখানার মতো
চুপচাপ। একটা সিগারেট ধরানোর খুব ইচ্ছে জাগে। কিন্তু উঠে ঘরে যেতেও ইচ্ছে করে না। আমি
যেন নিজের সঙ্গেই লড়াই করি, যেন দেখি, সিগারেট না ধরিয়েও থাকা যায় কি-না। যায়। আমি
কোনোদিকে না তাকিয়ে ঠায় বসে থাকি। ভালো লাগে না। অথচ আমার তো ভালো লাগারই কথা।
দীর্ঘদিন এমন ভালো লাগার মতো কিছুই ঘটেনি। তবে ভালো লাগে না কেন? মিরার জন্য? এক
সময় বুঝি, হ্যাঁ, তাই, মিরার জন্যেই। সেই তো চাকরি হলোই, হোক লতিফ সাহেবের করুণায়,
কিন্তু এত দেরি করে কেন! এখন কি আর সময় আছে? মন বলে, নেই। হয়তো থাকতে পারে।
কিন্তু আমি কি মিরার মুখোমুখি হতে পারবো, আর কখনো? গিয়ে বলতে পারবোÑ মিরা আমার
চাকরি হয়েছে? জানি না, মনে হয় আমার কাছে মিরার কিছু দাবি, কিছু পাওনা বোধ হয় থেকেই
যাবে। আর থেকে যাবেÑ আর যা থেকে যাবে তা আমার একান্ত, তা ভাবতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু
না ভেবেই কি থাকা যায়! এই গভীর রাতে মনের কোনো গহীনে চাপ পড়ে। হুহু করে কেঁদে ফেলি
আমি। মিরার কি বিয়ে হয়ে গেছে?
সকালে বাসা থেকে বেরোবার সময় মার পা ধরে সালাম করি। করে আমি নিজেই অবাক হয়ে
যাই। পা ধরে সালাম করার ছেলে আমি নই। তবে, আজ কেন, হঠাৎ করে? মা এমনভাবে জড়িয়ে
ধরেন, এতসব ভাবার সময় পাই না। বাবা বাসায় নেই, খুব সকালেই বেরিয়েছেন। সুতরাং বাবার
মুখোমুখি হতে হয় না। মনে মনে বলি, বেঁচে গেছি। ছোট ভাইবোনগুলো অবশ্য আমাকে ঘিরেই
ঘুরঘুর করছে। ওদের মাথায় হাত বুলোই। তারপর দ্রুত বেরিয়ে আসি।
প্রথমে আমার হেড-অফিসে রিপোর্ট করার কথা। সেখানে পৌঁছে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে
হয়। কর্তাব্যক্তি ডেকে নিয়ে তেমন কিছু জিজ্ঞেস করে না, তবে আমাকে লক্ষ করে খুঁটিয়ে খুটিয়ে।
কী দেখে সেই জানে, একটু মাথা নাড়ে, হাসে। একজনকে ডেকে বলে, ‘একে গোডাউনে পৌঁছে
দাও, নতুন স্টোর-কীপার।’
সে লোকের সময় নেই। সুতরাং আরো ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা। কর্মস্থলে পৌঁছতে পৌঁছতে
লাঞ্চ-আওযার আরম্ভ হয়ে যায়। তাই আবারও অপেক্ষা। লাঞ্চ-আওয়ার ফুরোলে অবশ্য সবকিছুই
দ্রুত এগোয়। এ অফিসে লোক নেই বেশি। আমাকে নিয়ে সাত-আটজন। আমার ওপরে একজন।
সে লোকটাকে প্রথম দেখাতেই অপছন্দ হয়। আমাকে ঢুলুঢুলু চোখে দেখে, তারিয়ে তারিয়ে পান
খায, ‘কি নাম?’
আমার বায়োডাটা অবশ্য লোকটার হাতেই। মেজাজ ঠা-া রেখে নাম বলি।
‘হুম।’ লোকটা বলে। ‘খুঁটির জোর বোধ হয় আপনার যথেষ্ট। মাসের মাঝামাঝি সময়ে
চাকরিতে জয়েন করলেন।’
আমি কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি।
‘তা খুঁটির জোর আমারও অনেক।’ লোকটা বলে। ‘ভালোই। সেয়ানে সেয়ানে মিলবে মনে
হচ্ছে।’
এসব কথার উত্তর নেই। শুধু লোকটার ওপর মেজাজ গরম হতে আরম্ভ করে।
লোকটা বোধ হয় বোঝে, বলে, ‘আমার কথাবার্তা, বুঝেছেন, এ রকমই। শোনেন, আমি হচ্ছি
এখানকার সুপারভাইজার, অর্থাৎ আমিই সব। আমি যা বলবো তাই সব। আপনি স্টোর-কীপার,
আমার সাব-অর্ডিনেট। বুঝেছেন? তবে আপনারও অনেক ক্ষমতা। খুশি? … এখন টায়ার্ড লাগছে,
কাল আপনাকে বাদবাকি বিষয় বুঝিয়ে দেব। ঠিক আছে?’
ঠিক আছে। আমি সুপারভাইজারের দেখিয়ে দেয়া এক ছোট ঘরে এসে চুপচাপ বসে থাকি।
ছোট এ ঘরটা আমার জন্যেই বরাদ্দ, অর্থাৎ আমার অফিসরুম। একটা স্টিলের আলমারি, একটা
কাঠের র‌্যাক, টেবিল, কয়েকটা চেয়ার আর কিছু ফাইল। বসে থাকতে থাকতে আলসেমি ধরে
গেলে ফাইলগুলো নেড়েচেড়ে দেখি; কিছু বুঝি না। এভাবে বেশ কিছুটা সময় পার হলে
সুপারভাইজার সাহেবকে দেখা যায় ঘরের দরোজায়, ‘এখনো আছেন?’
সে তো সুপারভাইজার সাহেব দেখতেই পাচ্ছেন। আছি বৈকি, অফিস সময় হয়তো প্রায়
শেষ। কিন্তু প্রথম দিন, কাউকে কিছু না বলে হুট করে বেরিয়ে যাওয়া হয় না। সুতরাং একটু মাথা
নাড়ি, ‘হ্যাঁ, আছি।’
‘চলে যান, চলে যান। অনেক্ষণ অফিস করেছেন।’
‘বসেই তো থাকলাম সারাটা সময়।’
‘আরে ভাই, বসে থাকারই কাজ এটা।’
‘তবে, শুধু বসে থাকা নয় নিশ্চয় নয়। কাজ-টাজ কিছু নিশ্চয় আছে।’
‘ওটা কাজ না। টুকটাক। কাল কিছু বুঝিয়ে দেবক্ষণ।’
‘কিছু বুঝিয়ে দেবেন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, কিছু। বাকিটুকু আপনার বুঝে নিতে হবে। … যান, এখন বাসায় যান।’
বাসায় ফেরার পথে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। অফিস থেকে বেরিয়ে আর কোনোদিকে যাইনি।
সোজা বাসায় ফেরার জন্যে পা বাড়িয়েছি। বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, তখন হঠাৎ ব্যাপারটা
ঘটে যায়। অন্যমনস্ক ছিলাম, তাই আগের মুহূর্তেও টের পাই না। হঠাৎ শুধু একটা শব্দ কানে এসে
পৌঁছায়।
‘দেন।’
আমি চমকে উঠে তাকাই। দেখি আমাকে হেলাফেলায় ঘিরে রেখেছে ছ’সাতজন ছেলে।
অবাক হয়ে তাদের মুখের দিকে তাকাই। চেনা, পরিচিত মুখ, আমাদের এলাকারই ছেলে। তবে
বখে যাওয়া, এদের আমি সেভাবেই চিনি। কখনো কথা হয়নি তেমন, প্রয়োজন পড়েনি। বরং আমি
এদের এড়িয়েই গেছি সব সময়। অথচ এরাই এখন আমাকে প্রায় ঘিরেই রেখেছে। হাসি হাসি,
অথচ উদ্ধত মুখ সবার।
‘কিছু বলছো?’ আমি জিজ্ঞেস করি।
‘দেন।’ তারা দু’তিনজন বলে।
‘কী দেব?’ আমি অবাক হয়ে তাকাই। এরা কি ছিনতাই করবে? না, তা মনে হয় না। এত
বোকা এরা না।
ওদের নেতা গোছের একজন হাসে, ‘চাকরি পাইছেন শুনলাম।’
খবর কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আমি একটু হাসি, ‘হ্যাঁ, আজকেই জয়েন করলাম।’
‘তাইলে দেন। কিছু ছাড়েন।’
‘আহা! কী দেয়ার কথা বলছো?’
একজন অদ্ভুত শব্দ করে, ‘কিছুই দেহি বুঝেন না। আরে বড় ভাই, চাকরি পাইলেন, এ্যালা
ছোট ভাইদের জইন্যে কিছু খরচাপাতি করেন। … দেন, ছাড়েন কিছু।’
এখন, এ মুহূর্তে এদের সঙ্গে কী রকম আচরণ করা উচিত হবে, তা ঠিক বুঝতে পারি না।
একটু হাসি হাসি মুখে বলি, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, মিষ্টি খাওয়াবো বৈকি। তবে বেতনটা পেয়ে নেই।’
ওরা নিজেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কিছু বলে। তারপর ওদের
হয়ে একজন মাথা নাড়ে, ‘বেশ, আপনার কথাই সই। বেতন পাইলেই দিয়েন।’
আমি হেসে বাড়ির দিকে পা বাড়াই।
কিছুটা এগোতেই পেছন থেকে একজন গলা চড়িয়ে বলে, ‘আবার ভুইল্যা যাইয়েন না য্যান।
দিয়েন।’
আরেকটা কণ্ঠ শোনা যায়, ‘মাস পয়লা দিবেন। প্রতি মাসে বেতন পাইলে।’
অর্থাৎ প্রতি মাসে ওদের আমার টাকা দিতে হবে! আমি এবার থমকে দাঁড়াই।
তখন তৃতীয় এক কণ্ঠ শোনা যায়, ‘আপনার ছোট ভাইবোন গুলান স্কুলে যায়। নিরাপদেই
যায়, আমরা আছি, ডরানের কিছু নাই। তয় সিকুরিটি ট্যাক্স তো দেওন লাগে! ঐটা আমাগো
প্রাপ্য। দিয়েন, এদ্দিন কই নাই, বেকার ছিলেন, এখন থেইকা মাসে মাসে দিয়েন।’
আমি আর দাঁড়াই না। দ্রুত পায়ে হাঁটতে আরম্ভ করি। এদের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই, আর
প্রতিবাদ জানানো তো দূরের কথা, ছুরি-চাকু বেরিয়ে যাবে। বাড়ির কাছে এসে এদিক-ওদিক
তাকাই। কেউ নেই, অর্থাৎ গত কয়েকদিন হলো যারা নজর রাখছিল আমার ওপর, তাদের কেউ
কোথাও নেই। বুঝি, লতিফ সাহেবের বদান্যতা। কিন্তু তাতে মন একটুও ভালো হয় না। বরং
পাড়ার ছেলেদের আচরণে মনটা তেতো হয়ে থাকে।
বাসায় পৌঁছে অবশ্য জোর করে হাসি ফুটাতেই হয় মুখে। মা আর ছোট ভাইবোনগুলো তো
বটেই, বাবাও উৎসুক মুখে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি ছোট করে বলি, ‘চাকরিটা ভালোই মনে
হচ্ছে।’ এতেই বাবা সন্তুষ্ট, কিন্তু বাকি সবার, বিশেষ করে মার উৎসাহ তাতে মেটে না। মা
নাশতা, চা করে এনে আমার পাশে এসে বলে, ‘এবার বল তো খোকা, সারাদিন কী কী করলি?
খুব কি চাপ কাজের?’ আমি একটু ভাবি, তারপর মায়ের মনমতো করে বানিয়ে বানিয়ে বলতে
আরম্ভ করি।
পরদিন সকালে বাবা একশোটা টাকা দেয়, ‘তোমার হাতে বোধ হয় টাকা-পয়সা কিছু নেই।
এটা রাখ। অফিসে যাওয়া-আসায়ও তো খরচা আছে।’ আমি নেই। একশো টাকায় পুরো মাস
চলার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু যে ক’দিন চলে। তারপর নিশ্চয় আবার পাওয়া যাবে। আর মাস শেষ
হলে যখন বেশ কিছু বেতন পাওয়া যাবে, তখন টাকা-পয়সা ব্যাপারটা এখন আমাকে আর তেমন
ভাবাচ্ছে না।
অফিসে আজ খুব সহজ বোধ করি। সুপারভাইজার লোকটাকে গত কালকের মতো অত
খারাপ মনে হয় না। বরং বেশ ফ্রেন্ডলিই মনে হয়। আমাকে টুকটাক কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই
হচ্ছে ব্যাপার। আসলে বলতে গেলে তেমন কোনো কাজই নেই আপনার। শুধু হিসাব
রাখবেন – কী পরিমাণ মাল স্টোরে উঠলো, কী পরিমাণ বাইরে গেল। সবকিছু খাতায় তুলে
রাখবেন। নয়-ছয়ের ব্যবস্থা আছে, খোলাখুলিই বলছি, সেটা বুঝে নেবেন। … বুঝে নিতে হবে,
নইলে …।’
নইলে কি, তা লোকটা বলে না, চোখ টেপে। আমিও জিজ্ঞেস করি না, আমি একটু হাসি।
দুপুরের দিকে দু-তিনজন ফোর্থ ক্লাস কর্মচারী এসে ধরে, ‘দেন।’
কি দেব?
মিষ্টি খাওয়ার পয়সা। নতুন চাকরি হয়েছে। সুতরাং মিষ্টি খাওয়ার পয়সা দিতেই হবে। তারা
কখনো আবদারের ভঙ্গিতে বলে, কখনো একটু জোর গলায়। আমি যত না না করি, বলি বেতন
পেলে হবেক্ষণ, তারা শোনে না। শেষে কুড়িটা টাকা বের করেই দিতে হয়। কিন্তু কুড়ি টাকায় তারা
সন্তুষ্ট নয়। তারা শেষ পর্যন্ত আদায় করে পঞ্চাশ টাকা। ওদের মধ্যে যে প্রায় নেতা গোছের, সে
বলে, ‘দেন স্যার, খুশি হয়ে দেন, আখেরে কাজে দেবে। কাজ তো আপনাকে মিলেমিশে আমাদের
সঙ্গেই করতে হবে।’
এইভাবে দিন পেরিয়ে যায়। অফিসে কাজ আসলেও তেমন কিছু না। সারাদিন বলতে গেলে
বসেই থাকা। মাঝে মাঝে মাল আসে। সেগুলো বুঝে নিয়ে খাতায় এন্ট্রি করে স্টোরে উঠাতে হয়।
আবার মাঝে মাঝে কেউ হাজির হয় ¯স্লিপ হাতে। ¯স্লিপে যা লেখা থাকে, সে অনুযায়ী তাদের স্টোর
থেকে মাল দিয়ে দিতে হয়। মাঝে মাঝে কিছু ব্যাপার বুঝি না, খটকা লাগে, ¯িপ নিয়ে আসা কিছু
লোকের আচরণও কেমন যেন, আবার যারা মাল-পত্র স্টোরে রাখতে আসে, তাদেরও। কিন্তু আমি
ঠিক ধরতে পারি না তাদের ব্যাপার। শুধু বুঝি ফাঁক কিছু থেকে যাচ্ছে। তবে মাত্র তো প্রথম মাস,
এরকম মনে হয়, দু’তিন মাস গেলে নিশ্চয় সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এই ভেবে সকাল-বিকাল
অফিস করি। মাঝে মাঝে মূল অফিসেও যেতে হয়। এমনিতে নিজের প্রয়োজনেই একবার যেতে
হয়েছে। মার্কশীট, টেস্টিমোনিয়াল এসব জমা দিতে। এমনিতে বেশ ভালোই লাগে। শুধু অফিসে
অধিকাংশ সময় একা থাকি বলে, প্রায় মিরার কথা মনে পড়ে যায়, তখন কান্না পায়।
ছয়
‘বেতন তো পেলেন?’
পরের মাসের দ্বিতীয় দিনটিতে সুপারভাইজার লোকটা এসে আমার সামনে বসে। আমি একটু
হাসি, একটু আগেই বেতনের টাকাগুলো গুণে পকেটে রেখেছি, বলি, ‘হ্যাঁ পেয়েছি। এই তো একটু
আগে হেড-অফিস থেকে খামে করে দিয়ে গেল। সই করে দিলাম। ব্যবস্থাটা ভালো।’
‘হ্যাঁ।’ লোকটা বলে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ যায়, তারপর লোকটা হাত বাড়িয়ে দেয়, ‘দেন।’
দেন, মানে? কী দেব?
আমাকে অবাক হয়ে তাকাতে দেকে সুপারভাইজার বুড়ো আঙুলে নাকের ডগা চুলকায়, ‘দেন
ভাই, বখরা দেন, মিলেমিশে খাওয়ারই তো নিয়ম।’
‘মিলেমিশে খাওযা, বখরা-মানে?’
‘আপনি একাই সব খাবেন? এ অফিসের নিয়ম মানবেন না?’
‘দেখুন সুপারভাইজার সাহেব।’ আমি ঠা-া গলায় বলি, ‘আপনি কী বলছেন তা আমি বুঝতে
পারছি না।’
সুপারভাইজারও খুব ঠা-া চোখে তাকায, ‘স্টোরের দায়িত্ব তো আপনার ওপর। সারা মাস যে
মাল এদিক-ওদিক করলেন তার বখরা দেবেন না?’
প্রথমটায় আমি বুঝতে পারি না। কিন্তু পরমুহূর্তে আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। ‘কী বললেন,
কী বললেন আপনি?’ বলে আমি চেঁচিয়ে উঠি।
সুপারভাইজারকে আমার উত্তেজনা স্পর্শই করে না, ‘আমি যা বলেছি তা আপনি ঠিকই
শুনেছেন। এখন কাজের কথায় আসুন।’
‘ওসব কিছু আমি করিনি।’
‘খাতাপত্র তা বলে না।’
‘কেন বলবে না। সব এন্ট্রি করা আছে, ঠিকমতো।’
সুপারভাইজার ঢুলুঢুলু চোখে হাসে, ‘আপনি দু’নাম্বার ¯িপে যেসব মাল দিয়েছেন স্টোর থেকে,
তার কী হবে?’
‘দু’নাম্বার ¯িপ মানে?’
‘আহা, এখন যেন কিছুই বুঝছেন না।’
আমি সত্যিই কিছু বুঝি না। এবং এক সময় সুপারভাইজার লোকটার সঙ্গে আমার তুমুল তর্ক
বেঁধে যায়। অফিসের বাকি লোকরাও ভিড় জমায়। তারা সবাই সুপারভাইজারের পক্ষে।
হিসেবমতো তাদেরও নাকি কিছু পাওনা হয়েছে আমার কাছে। অর্থাৎ তাদেরকেও আমার কিছু কিছু
করে দিতে হবে।
কেন?
এটাই এখানকার নিয়ম।
লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি একটু একটু করে ব্যাপারটা বুঝি। সুপারভাইজার
লোকটাই এক সময় খুলে-মেলে জানায় সবকিছু।
স্টোরের মাল সব সময়ই এদিক-ওদিক হচ্ছে। দু’নাম্বার এন্ট্রি এবং ¯িপের ব্যবস্থা আছে।
এটা মূল অফিসের সবাই জানে, কিন্তু তাদেরও ভাগ আছে, সুতরাং হৈচৈ নেই। সুপারভাইজারের
মুখে এসব শোনার পর বুঝি মাঝখানে ¯িপ হাতে এসে কিছু কিছু লোক কেন অদ্ভুত আচরণ
করতো। কেন সুপারভাইজার বলেছিল, অফিসের কাজকর্মের ব্যাপারে কিছু সে আমাকে বলবে,
বাকিটুকু আমার নিজের বুঝে নিতে হবে।
এখন সব বুঝে আমি সবেগে মাথা নাড়ি, ‘আমি ওসব কিছু করিনি, আর আমি ওসবের মধ্যে
নেই-ও।’
শুনে সুপারভাইজার হাসে, ‘আপনি না থাকলে তো হবে নারে ভাই।’
‘কেন?’
‘আপনি এখানে চাকরি করতে চাইলে আপনাকে ওসবের মধ্যে থাকতেই হবে।’
‘তাই বুঝি? আর আমি যদি ওসবের মধ্যে না থাকি?’
সুপারভাইজার লোকটা বুড়ো আঙুলে নাকের ডগা চুলকাতে চুলকাতে বলে, ‘আগে আপনার
জায়গায় যে লোক ছিল তার চাকরি গেছে বেশি খাওয়ার জন্যে, আপনার যাবে না খাওয়ার জন্যে।’
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাই। তারপর বলি,
‘তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে-আমাকে দু’নাম্বার কাজ করতে হবে এবং
আপনাদের ভাগ দিতে হবে?’
লোকগুলো প্রায় সবাই এক সঙ্গে বলে, ‘হ্যাঁ, দিতে হবে, আমাদের দিতে হবে।’
তারা আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন হাত বাড়িয়ে।
আমি কিছু না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি। সুপারভাইজার লোকটা আঙুলে টোকা মারে
টেবিলের ওপর, তাল ঠোকে। তারপর হাত-পা নেড়ে আলস্য কাটায়, উঠতে উঠতে বলে, ‘গত
মাসের ভাগটা কবে দেবেন তা না হয় কাল-পরশু ঠিক করবো। তবে বলে রাখছি, সামনের মাস
থেকে বেতন পাওয়ার দিনে আসবো, বলবো ‘দেন’Ñআপনি দিয়ে দেবেন।’
‘দেব?’
‘দেবেন। আমাদের পাওনাটুকু আপনাকে তো দিতেই হবে।’
অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে ঠিক করি এ চাকরি আর করবো না। সম্ভব নয়। দু’নাম্বার কাজ
করা নৈতিক অপরাধÑ এমনটা মনে হয় না। অতটা ন্যায়-অন্যায় বোধ আমার নেই। কিন্তু এও
বুঝি, ও অফিসে আমি খাপ-খাওয়াতে পারবো না। তাছাড়া কে জানে, কখন কোথায় ফেঁসে যাব।
সুতরাং এমুখো আর না হওয়াই ভালো হবে।
এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও মন-মেজাজ অবশ্য খিঁচেই থাকে। তাই বাসার কাছাকাছি হওয়ার
পর কোন্ সময় যে পাড়ার ছেলেরা ঘিরে ধরে, খেয়াল করিনি।
‘দেন।’ একজন বলে।
আমি অবাক হয়ে তাকাই এবং ছেলেদেরে দেখেই বুঝতে পারি কী ব্যাপার। কথা বাড়াতে
ইচ্ছে করে না। পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে দেই। জানি এর কমে এ দঙ্গল
রাজি হবে না।
ছেলের দল মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। একজন অনিচ্ছা সত্ত্বেও নোটটা নেয়। চুমু খেয়ে পকেটে
গুঁজে রাখে। আমি পা বাড়াতে নিলেই একজন কাঁধে হাত রাখে, ‘সামনের মাস থেকে আরেকটু
বাড়িয়ে দিয়েন।
কাঁধে হাত। এদের বয়স আমার চেয়ে অনেক কম। মেজাজ আরো চড়ে যায়। কঠিন চোখে
তাকাই। ওদেরই একজন তখন ধমকে ওঠে, ‘আরে করিস কি! বড় ভাইয়ের কাধেঁ হাত রাখিস,
নামা নামা।’
সে ছেলে হাত নামানোর আগেই আমি হাতটা সরিয়ে দেই। কিছুদূর এগোলে পেছন থেকে
ছেলের দলের কেউ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘মাইন্ড করেননি তো বড় ভাই! … মাসে মাসে দিয়েন কিছু।
জমা-খরচ। জমা-খরচ তো দিতেই হয়।’
হ্যাঁ, দিতেই হয়Ñ আমি মনে মনে বলি।
বাসায় ফেরামাত্রই সবাই ছুটে আসে। ছোট ভাইবোনগুলো সামনে, পেছনে মা। সবার
চোখে-মুখে কিছুটা বিস্ময় কিছুটা হাসি মিলেমিশে আছে। তখন খেয়াল হয়, ওদের সবার জন্যে
আমার কিছু না কিছু নিয়ে আসা উচিত ছিল। পর মুহূর্তে মেজাজও আবার বিগড়ে যায়। মনে হয়,
সবাই এমন ছুটে এসেছে-যেন আমার কাছে পাওনা আছে ওদের। এখন পাওনা মেটাতে হবে
আমাকে। আমি কিছু না বলে সামান্য কিছু টাকা রেখে বাকিটা তুলে দেই মায়ের হাতে। দিয়ে
আশ্চর্য হালকা অনুভব করি নিজেকে। মনে হয় বিরাট কোনো পাওনা শোধ করলাম।
রাতে অফিসের ঘটনাটা বাবাকে খুলে বলি। কিন্তু আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে বাবা খুব
সহজভাবে নেয় পুরো ব্যাপার। এমনভাবে আমার দিকে তাকায়, যেন-এ আর এমন কী ব্যাপার!
মুখে বলেও তাই, ‘বেশ বুঝলাম। কিন্তু তাতে কী হয়েছে?’ আমার বলতে ইচ্ছে করে, ‘কী হয়নি?’
বলা হয় না। বলি, ‘আমি ওদের শেয়ার দেব কী করে?’
বাবা স্থির চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অম্লান বদনে বলে, ‘চাকরি করতে গেলে
সহকর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশেই থাকতে হয়।’
কথাটার অর্থ কি দাঁড়াচ্ছে? বাবার মুখে অমন কথা শুনে আমার ভীষণ খারাপ লাগে।
বাবা বলে, ‘সহকর্মীদের যা দেয়ার তুমি তা দেবে বৈকি!’
‘ওদের কোনো পাওনা নেই আমার কাছে।’
‘সেটা ওরাই ভালো বুঝবে। চেয়েছে যখন তখন কিছু প্রাপ্য নিশ্চয় ওদের।’
‘আমি যদি স্টোরের মাল এদিক-ওদিক করি তবেই ওদের কিছু পাওনা হয়।’
‘সে তুমি বুঝবে। … এ বাজারে চাকরি পাওয়া কী কঠিন, তা তুমি নিশ্চয় ভালো বোঝ।’

সাত
আমি পরদিন অফিসে যাই না। সকাল বেলা অবশ্য বাড়ি থেকে ঠিকই বেরোই। সারাদিন
এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করি। ফিরে আসি সন্ধ্যের দিকে। এমনভাবে ফিরি, যেন সারাদিন অফিসে
কাটিয়ে ফিরলাম। এভাবে সপ্তাহ খানেক যায়। তারপর বাবার মুখোমুখি হতে হয়। এক রাতে বাবা
ডেকে নিয়ে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি নাকি অফিসে যাচ্ছ না?’
আমি চুপ করে থাকি।
বাবা বলে, ‘লতিফ সাহেব বললেন। সত্যি যাচ্ছ না?’
‘না।’ আমি মাথা নাড়ি, ‘যাচ্ছি না।’
‘বেশ।’ বাবা হাল ছেড়ে দেয়া গলায় বলে, ‘কাল লতিফ সাহেবের সঙ্গে দেখা করবে। দেখা
করতে বলেছেন।’
‘কেন?’
‘কোনো প্রয়োজনে নিশ্চয়ই। দেখা করতে বলেছেন, দেখা করবে এই হচ্ছে ব্যাপার।’
‘আমি তার সঙ্গে দেখা করার কোনো প্রয়োজন অনুভব করছি না।’
‘আমি করছি। তুমি কাল সকালেই যাবে।’
আমি যাই বিকেলে। খুব অনিচ্ছায়, বাধ্য হয়ে। জানি, দেখা না করলে বাড়ি ছাড়তে হবে। লতিফ
সাহেব অবশ্য খুব হাসিমুখে আমাকে অভ্যর্থনা জানান, ‘আরে, এসো এসো। … চাকরিটা ছেড়ে
দিয়েছো শুনলাম?’
আমি একটু কুণ্ঠার হাসি ফুটিয়ে তুলে বলি, ‘হ্যাঁ।’ তারপর সব খুলে বলি।
শুনতে শুনতে লতিফ সাহেব ঘনঘন মাথা নাড়েন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। … বাদ দাও, ও
চাকরি তোমার আর করতে হবে না। আমি অন্য কাজে লাগাবো তোমাকে।’
কী ধরনের কাজ সেটা? কিছুটা উৎসুক হয়েই আমি লতিফ সাহেবের দিকে তাকাই।
‘সমাজ-কল্যাণমূলক কাজ, বুঝেছ?’ লতিফ সাহেব বলেন, ‘এসো, এবার কিছু দেশের কাজ
কর।’
এবার আমার হাসি পায়। লতিফ সাহেব দেশের কাজ করার জন্যে আমাকে বলছেন। ভালো,
ভালো।
লতিফ সাহেব অবশ্য খুব উৎসাহ নিয়ে বলতে আরম্ভ করেন। এবং বলা শেষ করে হাসি হাসি
মুখে আমার দিকে তাকান, ‘কেমন, পছন্দ হয়েছে?’
ইচ্ছে করে বলি, পছন্দ হওয়ার কোনো কারণ নেই। ইচ্ছে হয় বলি, এ কাজের নামে আপনি
সরকার থেকে লাখ লাখ টাকা কামাবেন, কিছু নিরীহ লোকের দুর্ভোগ বাড়াবেন, আর সেজন্যে
আমাদের দিতে হবে স্বেচ্ছাশ্রম।
আমি নিরীহ গলায় বলি, ‘আপনার আইডিয়াটা সুন্দর, কিন্তু আমার তো অত সময় নেই
এখন।’
লতিফ সাহেব ব্যথিত চোখে তাকান, ‘তোমার কি দেশের জন্য কিছু করার নেই?’
‘আছে।’
‘তোমার কি দেশের কিছু দেয়ার নেই?’
আবার সেই দেয়ার প্রশ্ন! চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে, হ্যাঁ হ্যাঁ, দেশকে আমার অনেক কিছুই
দেয়ার আছে। কিন্তু আপনাকে নয়, আপনাকে আমার কিছুই দেয়ার নেই।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে লতিফ সাহেব সেটাকে সম্মতি বলে ধরে নেন। বলেন, ‘দাও,
তবে দাও। দেশের জন্য শ্রম দাও। হ্যাঁ?’
‘না।’ আমি আবার বলি, ‘আমার সময় হবে না।’
‘হবে না?’ লতিফ সাহেব এবার খুব হঠাৎ করে ভীষণ রেগে যান, ‘তুমি কি জান তোমার সময়
না হওয়ার পরিণতি কী হতে পারে?’
‘আমি মাথা নাড়ি, জানি না।
‘তুমি পার্টি কর। বেআইনী পার্টি। অ্যান্টি-স্টেট অ্যাকটিভিটিজ তোমাদের।’
আমি সজোরে মাথা নাড়ি, ‘আমি আগেও বলেছি আপনাকে, তেমন কোনো পার্টি আমি করি
না।’
এ কথাটা এ অর্থে সত্যিই। পার্টি তো আমি আসলেও তেমনভাবে করি না। নাম কা ওয়াস্তে
একটা সম্পর্ক আছে মাত্র।
লতিফ সাহেব অবশ্য খর চোখে তাকান, ‘কর না? আচ্ছা! শোন ছেলে, আমি সব খবরই
জানি। ঠিক জানি। আমাকে জানতে হয়।’
‘আমি এখন যাব।’ আমি উঠে দাঁড়াই।
‘তাহলে দেশের জন্যে সার্ভিস তুমি দেবে না? কিছুই দেবে না সমাজকে? দেশ আর সমাজ
তোমাদের মতো ইয়ং ক্লাসটার কাছে অনেক কিছু পায়। জান?’
জানি। আমি কথা না বলে বেরোবার জন্যে পা বাড়াই।
‘শোন।’ লতিফ সাহেব কঠিন গলায় আমাকে থামান, ‘এর ফল খুব খারাপ হবে। মনে রেখ।’
বাসায় ফিরে এই নিয়ে বাবার সঙ্গে লেগে যায়। সেদিনই রাতে। বাবা বোধ হয় অফিস থেকে
ফেরার সময় লতিফ সাহেবের ওখান থেকে হয়ে এসেছেন। তাই বাসায় ফিরেই আমাকে ডেকে
পাঠান।
‘তুমি লতিফ সাহেবকে কী বলে এসেছ?’
‘সে তুমি নিশ্চয় তার মুখ থেকে শুনে এসেছ।’
‘তবু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।’
‘তবু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।’
আমি চুপ করে থাকি। ওসব কথা নতুন করে খুলে-মেলে বলার তো কিছু নেই।
‘কী হল, কথা বলছো না কেন?’
‘ভদ্রলোক এমনভাবে বললেন যেন আমার শ্রম, আমার সার্ভিস তার পাওনা, যেন জোর করে
আদায় করে নেবেন।’
‘যাদের ক্ষমতা আছে তারা জোর করেই আদায় করে নেন।’
‘তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত না দিয়ে পারা যায়, সে চেষ্টাও আমার কাছে।’
বাবা হাসেন, ‘অত বড় কথা তোমার মুখে মানায় না। লতিফ সাহেব চাইলে তুমি না দিয়ে
পারবে?’
‘বললাম তো, চেষ্টা করবো।’
‘তোমার চেষ্টায় কিছু এসে যাবে না।’
এবার আমি হাসি, ‘ভদ্রলোক একটা প্রজেক্ট পেয়েছেন কোটি টাকার। ওখানে আমাকে,
আমাদের মতো ছেলেদের ব্যবহার করবেন। তার কাজে নিজেকে সমর্পণ করে দিলে বিনিময়ে কী
পাওয়া যাবে?’
বাবা ঠান্ডা চোখে তাকান, ‘আর কারো কথা জানি না। তুমি নিজেকে সমর্পণ করলে নিরাপত্তা
পাবে।’
‘আমি নিরাপদ নই, এ কথা কে বললো?’
বাবা এবার ধমকে ওঠেন, ‘সে আমি জানি। শোন, কালই যাবে তুমি। ভদ্রলোক অসম্ভব বিরক্ত
হয়েছেন তোমার ওপর। গিয়ে মাফ চেয়ে আসবে। ভদ্রলোক যা বলবেন তাই শুনবে।’
আমি কিছু বলি না।
বাবা বলেন, ‘আশা করছি, আমার কথা কানে গেছে তোমার। মাফ চেয়ে আসবে ভদ্রলোকের
কাছে। ওটুকু ভদ্রলোকের পাওনা হয়েছে তোমার কাছে। … তুমি যাবে।’
আট
পরদিন আমার খুব ভোরবেলা ঘুম ভাঙে। সে সময় সারা বাড়িতে কেউ ওঠেনি। প্রতিদিন মার
সবচেয়ে আগে ঘুম ভাঙে, সেই ভোরবেলাই তার কাজ আরম্ভ হয়ে যায়, আধো ঘুমের মধ্যে টুংটাং
আওয়াজ পাওয়া যায়। আজ সারা বাড়ি নিশ্চুপ, আমি বারান্দায় চেয়ার টেনে বসে থাকি
অনেকক্ষণ। মা উঠলে রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ চা বানাই নিজের হাতে।
নাশতার সময় বাবার মুখোমুখি বসে প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল এই বুঝি বাবা বলে ওঠে, ‘লতিফ
সাহেবের ওখানে কখন যাচ্ছ?’ কিন্তু পুরোটা সময় বাবা কিছুই বলে না। আমাকে লক্ষও করে না
তেমন করে। মনে হয় গতরাতে যেন আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি। অবশ্য নাশতা শেষ করে
আমার আর সাহস হয় না। বাবা যে-কোনো মুহূর্তে বলতে পারে, ‘চল, লতিফ সাহেবের কাছে,
আমিও যাব তোমার সঙ্গে।’ এ ভয়ে আমি কুঁকড়ে ছিলাম। আমার ঘরের এখানে-ওখানে হাতড়ে,
পোশাক উল্টে সামান্য যে ক’টা টাকা পেলাম তাই পকেটে রেখে বেরিয়ে পড়লাম। কাগজের টাকা
পাঁচটে, আর খুচরো পয়সায় চার টাকা, মোট ন’ টাকা, আমার দিন চলে যাবে।
বাইরে বেরিয়ে এক নাগাড়ে হাঁটলাম অনেকক্ষণ। একটা অভ্যেস আছে আমার, হাঁটতে হাঁটতে
রাস্তার দু’পাশের বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ড লক্ষ্য করি, পড়ি, কখনো দেখি হোর্ডিং। আবার
ফুটপাথে দাঁড়িয়ে রাস্তার মানুষজন লক্ষ করি। এ অভ্যেস বেশকিছু দিনের। সময় মন্দ কাটে না।
আজ তা-ই আরম্ভ করেছিলাম। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর বিরক্তি এসে গেল। কত আর সাইনবোর্ড
পড়া যায় কিংবা দেখা যায় মানুষজনের কখনো ক্লান্ত কখনো ধূর্ত মুখ। সামনে একটা লাইব্রেরি
পড়েছিল। আশ্চর্য, আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম। না, তেমন কোনো কারণ নেই। কিছু ভাবিওনি ঠিক
ঠিক, হঠাৎ করেই ব্যাপারটা ঘটে গেল। লাইব্রেরির প্রতি বিরাগ বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই,
জায়গাটা পড়–য়া ভালো ছেলেদের জন্যেÑ এ রকম একটা ব্যাপার সেই তখন থেকেই আমার
ভেতরে কাজ করেছে। অথচ আজ এ লাইব্রেরিতেই সময় কেটে গেল। এক বিদেশী ঢাউস বইয়ের
অনুবাদ হাতে নিয়েছিলাম, ওটার ভেতরেই ডুবে থাকলাম। লেখকের অন্য কোনো বই আগে পড়া
তো দূরের কথা, আগে তার নামই শুনিনি কোনো দিন। কিন্তু এ বইটা আমাকে আটকে রাখে।
মাঝখানে দুপুরের খাবার সারতে আর সিগারেট টানতে বারকয়েক বের হয়েছি, তবে বইটা শেষ
না করে ছাড়লাম না।
বইটা শেষ করে বের হলাম বিকেলের পরপর। তারপর আবার দোকানের সাইনবোর্ড দেখতে
দেখতে এগুনো। বাড়ির দিকেই এগোলাম। নির্দিষ্ট আর তো কোথাও যাওয়ার নেই। মনে হচ্ছিল
বাবা সম্ভবত আবার লতিফ সাহেবের কথা তুলবে। সকালে আমি লতিফ সাহেবের কাছে
যাইনি বাবা বুঝেছে, সুতরাং রেগেছে খুব সন্দেহ নেই, আর বেশি রাগলে বাবা আমার সঙ্গে কথা
বলে না। বাঁচোয়া।
কিন্তু এমন কিছু ঘটে গেল, যা ঘটার আশঙ্কা আমি প্রায় উড়িয়েই দিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে
দেখলাম পুরো বাড়ি কবরখানার মতো নিস্তব্ধ। এ সময় বাসায় ছোট ভাই-বোনদের পড়ার
আওয়াজ ছাড়া আর কিছু থাকার কথা নয় অবশ্য, আজ পড়ার আওয়াজ নেই এবং পুরো বাড়ি
অস্বাভাবিক রকম নীরব, কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাবাই বুঝি আমার ফেরার কথা প্রথম
টের পায়। ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমার দিকে শূন্য চোখে তাকায়, বলে, ‘ও, তুমি
এসেছো, তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, দেখ, ঘরগুলো ঘুরে দেখ।’
আমি একটু এগিয়ে এক ঘরে উঁকি দিয়ে থতমত খাই। ঘর অমন ওলোট-পালট কেন। বাঁদিকে
পরের ঘরটারও এই একই অবস্থা, ও ঘরে ছোট ভাইবোন বসে ছিল, ওরা ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে
তাকায়। আমি প্রথমে কিছুই বুঝছিলাম না। তবে কারণটা ধরতে পারি খুব হঠাৎ করেই। আমি
পরের ঘরটা দেখার প্রয়োজন অনুভব করি না, জানি ওটার অবস্থাও এ দুটোর মতো। যে আশঙ্কা
থেকে মুক্ত হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম ভুল বুঝতে পেরে আমার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছে,
সে আশঙ্কায়ই হঠাৎ সর্বনাশা চেহারা নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেছে। সন্দেহ করে ওরা আমাকে
খুঁজতে এসেছিল।
বাবা বললো, ‘তোমার খোঁজে এসেছিল, তোমাকে খুঁজলো, সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে আরো কি
সব খুঁজলো, বেশ কিছু জিনিস নষ্ট হয়েছে। … তুমি লতিফ সাহেবের ওখানে যাওনি।’
বাবার গলা অস্বাভাবিক রকম শান্ত, আমি বড় কিছুর পূর্বাভাষ পাচ্ছিলাম।
‘তা, এখন কী করবে ঠিক করলে’, বাবা আমাকে নিশ্চুপ দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘দেখ খোকা,
আমার পক্ষে বেশি কথা বলা সম্ভব নয়, আমার মন ভালো নেই। … তোমার পক্ষে কি আমার
কথামতো চলা সম্ভব? … লতিফ সাহেবের পক্ষে এখনো কিছু করা সম্ভব।’
আমি চুপ করে থাকলাম।
বাবা আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘বল, তোমার পক্ষে কি আমার কথামতো চলা সম্ভব?’
আমি নিশ্চুপ।
বাবা সামান্য হাসলো, ‘ঠিক আছে, আমার পক্ষেও তোমাকে আর বাড়িতে রাখা সম্ভব নয়, শুধু
তোমার জন্যে আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে এমন আমি কখনো হতে দিতে পারি না। …
তাছাড়া ছেলে বড় হলে তার কিছু কর্তব্য জন্মে, বাবা-মা, ঘর-সংসারের প্রতি, তখন বাবা-মার ঋণ
শোধ করার সময় হয় তার … কিন্তু তোমাকে এসব বলে কি, … তুমি এসো, এই এখনই। … আর
শোন, যদি কখনো মনে কর বাবা-মার প্রতি তোমার যে ঋণ তা তুমি শোধ করতে পারবে তবেই
ফিরে এসো, লতিফ সাহেবকে বলে তোমাকে নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করা যাবে, একটা চাকরিও
ভদ্রলোক খুব সহজেই জোগাড় করে দিতে পারবেন, … এখন যাও।’
কথা শেষ করে বাবা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। আমি চোখ তুলে একবার তাকালাম।
দরোজার ওপাশে ছোট ভাইবোনরা ভিড় করে আছে টের পাই। পরমুহূর্তে আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে পা
ফেললাম। বাইরের দরোজার কাছাকাছি চলে এসেছি, পেছনে দ্রুত পায়ের শব্দ মুহূর্তের মধ্যে
কাছাকাছি চলে এল। মা, সঙ্গে একদম ছোট ভাইটা।
ছোট ভাইটা বোকার মতো মুখের দিকে তাকায়, বলে, ‘ভাইয়া, লোকগুলো না ঘর খুঁজতে
খুঁজতে বলছিল ওরা নাকি কি পাবে তোমার কাছে, কি পাবে ভাইয়া?’
আমি জবাব দেই না।
মা কিছু বলে না, চোখ তুলে তাকাতেও পারে না, শুধু কোনোমতে ফোঁপানো গলায় ‘সাবধানে
থাকিস খোকা’ বলে আমার হাতে কী যেন গুঁজে দেয়।
নয়
আমি বাইরে বেরিয়ে দেখলাম তিনটে দশ টাকার নোট। এতো বিপদ আর কষ্টের মধ্যেও কেমন
যে লাগলো! জানি, মা নোট তিনটে খুব কষ্টে সঞ্চিত গোপন তহবিল থেকে বের করেছে। এই তো
এই ছিল মার সম্বল। আমি পেছন ফিরে বাসার দিকে একবার তাকাই, তারপর নোট দুটো রেখে
দেই পকেটে।
ভয় ছিল, ভেবেছিলাম বাড়ি থেকে বেরোলেই দু’পাশ থেকে দু’জন চেপে ধরবে। কিন্তু বাড়ি
থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুটা পথ হেঁটে আসি, সে রকম কিছুই ঘটে না। তবে আমি আমাকে খোঁজার
কিংবা আমাদের বাড়ি সার্চ করার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বড় অদ্ভুত
লাগছিল আমার; আমাকে কেন, আমি তো নিতান্তই চুনোপুঁটি। এ রকম ভাবতে ভাবতে হঠাৎ,
এখন কোথায় যাব, এখন আমি নিরাপদ নইÑ এ রকম মনে হতেই সারা শরীর হিম হয়ে আসে।
কোথায় যাব, ভাবতে ভাবতে আমার চলার গতি শথ হয়ে আসে। হঠাৎ টের পাই, এই বিশাল
শহরে আমি একদম একা।
এক-এক করে অনেক জায়গার কথা মনে হয়। কিন্তু পরমুহূর্তে সেগুলো বাতিল হয়ে যায়।
এখন আমার নিরাপদ জায়গা প্রয়োজন, এমন কাউকে প্রয়োজন যার সঙ্গে বিপদ ভাগাভাগি করে
নিতে পারবো। কিন্তু সে রকম জায়গা একটাও নেই।
একবার, কোনো কারণ নেই, মিরার কথা মনে হয়। ওর বিয়ে কি হয়ে গেছে? আমার
যে-কোনো বিপদ-আপদে অসুবিধায় …। না, মিরার কথা ভাববো না, খুব দ্রুত আমি অন্য কিছু
ভাবার চেষ্টা করলাম।
আরেকবার রেহানের কথা মনে হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা এক সঙ্গে পড়তাম। হ্যাঁ, যাওয়া
যায় ওখানে। ওদের বাড়ি এসব ক্ষেত্রে পুরো নিরাপদ। কিন্তু পরমুহূর্তে দমে গেলাম। দু’দিন পর
ফেরত দেব বলে রেহানের কাছ থেকে একশো টাকা নিয়েছিলাম, তিন মাস হয়ে গেছে, সে টাকা
ফেরত দেয়া হয়নি। এখন এই অসময়ে গেলে যদি ভাবে আমি ওর পাওনা টাকা ফেরত দিতে
গেছি, কিংবা কথাপ্রসঙ্গে যদি ঐ টাকার কথা আমাকে মনে করিয়ে দেয়Ñ তখন? তখন খুব খারাপ
লাগবে আমার। তাছাড়া যেভাবে সবাই আমার চারপাশে হাত পেতে আছে, এমনও তো হতে
পারে, আমাকে দেখে রেহান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘দে।’ আমাকে তো তখন চমকে গিয়ে
কারণ জিজ্ঞেস করতে হবে, ‘কি?’ রেহানও অবাক হয়ে তাকাবে, ‘কেন, ঐ যে একশো টাকা
নিয়েছিলি, সেই টাকাটা, দে।’ থাক, তার চেয়ে রেহানের ওখানে না যাওয়াই ভালো।
শেষে ঠিক করলাম পার্টির চেনা-জানা কারো কাছে আমার যাওয়া উচিত। পার্টির জন্যেই এখন
এ অবস্থা; এ সময়ে ওরাই আমাকে আশ্রয় আর বুদ্ধি দিতে পারবে। বহু চেষ্টা করেও আমি এর
বাইরে আর কোনো পথ খুঁজে পেলাম না। কিন্তু পার্টির কার কাছে যাব? তেমন কাউকেই তো আমি
চিনি না। শুধু এটুকু জানি, পার্টির অবস্থা এখন ভালো না। উঁচু পদের, যাদের একটু পরিচিতি আছে
তারা সবাই এখন আত্মগোপন করে, তাদের কারো ঠিকানা আমি তো জানিই না, তাদের কাউকে
আমি দেখিওনি। তবে তারেকের মেসের ঠিকানা জানি, একমাত্র ওর সঙ্গেই আমার একটু
চেনা-জানা, তবে ওর সঙ্গে অনেকদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই, এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না ও,
এখনো ঐ পুরনো মেসে আছে কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু তবু ওর খোঁজে
যাওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।
তারেকের মেসে পৌঁছান দারুণ এক ঝক্কির ব্যাপার। তবু দ্রুত পা চালালাম, তারপর বাস,
তারপর আবার পায়ে হেঁটে কিছুটা পথ। বাস অবশ্য মেসের কাছাকাছি রাস্তা দিয়েই যায়, কিন্তু
আমি ইচ্ছে করেই দু’স্টপেজ আগে নেমেছি। হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে থেমে সিগারেট ধরানোর
ফাঁকে পেছন ফিরে ধীরে-সুস্থে লক্ষ্য করেছি কেউ আমাকে লক্ষ করছে কিনা। সে রকম কাউকেই
নজরে পড়েনি।
তারেকের মেসে পৌঁছতে পৌঁছতে কিছু রাত হয়ে যায়। মেসের সামনে তখনো অবশ্য
কয়েকজন জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে কেউ তেমন লক্ষই করলো না। তারেকের ঘরের
আলো নেভানো। শুয়ে পড়েছে বোঝা যায়। দরোজায় নক করি। করে অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ
খুব ভীত হয়ে পড়ি। যদি এমন হয় তারেক এই মেস ছেড়ে গেছে, তবে আমি কোথায় যাব। পার্ক
কিংবা রেল স্টেশন ছাড়া আর তো কিছু থাকবে না রাত কাটানোর। এই ভয়ে একটু জোরেই
আঘাত করি দরোজায়। ভেতরে আলো জ্বলে, কেউ একজন মৃদু পায়ে দরোজার পাশে এসে দাঁড়ায়
বাইরে থেকেও টের পাই। আমি কথা বলি, ‘এটা কি তারেক সাহেবের রুম?’ দরোজার ওপাশ
থেকে শোনা যায়, ‘আপনি কে?’ গলার আওয়াজে বুঝলাম তারেক, স্বস্তির একটা শ্বাস ফেলে
দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ, তারপর বলি, ‘আমি খোকা, দরোজা খুলুন।’
দরোজা খোলে। তারেকের চোখে-মুখে বিস্ময়, ‘এতো রাতে!’ আমি ঘরে ঢুকে বলি, ‘বাসায়
ঝামেলা, আপাতত আপনার এখানে থাকা ছাড়া উপায় নেই।’ তারেক বাইরে একবার দেখে নিয়ে
দরজা বন্ধ করে দেয়, জিজ্ঞেস করে, ‘কেউ আপনাকে এখানে আসতে দেখেনি, দেখেছে?’ আমি
মাথা নেড়ে বলি, ‘না।’ তারপর জগ থেকে এক গাস পানি ঢেলে নিয়ে চেয়ারে বসি। ভালো লাগছে
না। বমি বমি ভাব, শরীরে ক্লান্তি। আমি অনেকক্ষণ ধরে আধ গাস পানি খাই। বাকি পানি চোখে
মুখে ছিটাই। তারেক টেবিল ল্যাম্প নিভিয়ে দিল। আমার সামনে বসে জিজ্ঞেস করলো, ‘এবার কী
হয়েছে পুরোটা খুলে বলুন!’
ঘটনা বড় নয়। খুলে বলতে আমার সময় লাগে না। সব শুনে তারেক প্রথমে চুপ করে থাকে,
তারপর মাথা নাড়ে, ‘আপনার বাসায়! নাহ্, হিসেব মিলছে না।’
আমি সামান্য হাসলাম, ‘আমার একই কথা, হিসেবে মিলছে ন্’া
তারেক আবার মাথা নাড়ে, ‘নাহ্, বিশ্বাসযোগ্য নয়।’
আমি বলি, ‘তা নয়, কিন্তু ব্যাপারটা ঘটেছে।’
তারেক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, শেষে আমার কাছ থেকে পুরনো বিবরণই নিল আবার,
বললো, ‘আমাদের সবাইকে ধরার জোর চেষ্টা চলছে বটে, কিন্তু তবু আপনার বাড়ি সার্চ করাটা
হাস্যকর, অযৌক্তিক, … যাকগে, হায়দার সাহেব দেখা করেছিলেন?’
‘না।’
‘পার্টির অবস্থা ভালো নয়। সিনিয়র লেভেলে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। আমি
দিন কয়েক আগে কমরেড আজহারের কাছ থেকে খবর পেয়েছি। এখানকার তল্পিতল্পা গুটিয়ে তার
কাছে গিয়ে কিছুদিন থাকবো।’
‘হুঁ।’
‘আপনার মন ভালো নেই মনে হচ্ছে।’
‘ভালো নেই। কী করে থাকে বলুন?’
‘তাও ঠিক,’ তারেক সামান্য হাসে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো ও, বললো, ‘ঠিক আছে, ঘুমিয়ে পড়–ন। কাল কথা বলা যাবে।’
ছোট চৌকি। পাশাপাশি দু’জন শুলাম। আমার অবশ্য অসুবিধে হয় না। তারেকেরও না।
একটু পরেই ও ঘুমিয়ে পড়ে। আমার ঘুম আসে না। নানা ব্যাপার তালগোল পাকিয়ে সামনে এসে
জড়ো হয়। আমি ভোররাত পর্যন্ত জেগে থাকি।
পরদিন সকালে উঠে তারেক প্রথমে খবর নেয় আমার কাছে কী পরিমাণ টাকা-পয়সা আছে।
দু’জন একসঙ্গে রুমে বসে নাশতা সারি। বাথরুম আর গোসল সারতে সকালে যখন বেরিয়েছিলাম
তখন কেউ আলাদা করে আমাকে লক্ষ করেনি। বুঝি এখানে হরদম এর-ওর গেস্ট আসছে।
নাস্তা সেরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তারেক বলে, ‘যদিও বিপদের কোনো আশঙ্কা আছে বলে
আমার মনে হয় না, তবু আপনি ঘর থেকে একদম বেরোবেন না, বুঝেছেন। কেউ আসবে না, তবু
আমার খোঁজে কেউ এসে যদি আপনার সঙ্গে কথাটথা বলে তবে তো আমার বন্ধু হিসেবে পরিচয়
দিয়ে এটা-ওটা বলে চালিয়ে দিতে পারবেন। পারবেন না?’
‘পারবো।’ আমি বললাম।
তারপর আমার আর কিছু করার থাকে না। তারেকের ঘরে এমন কিছু নেই যা দিয়ে সময়
কাটানো চলে। আমি বিছানার ওপর কখনো শুয়ে থাকি, কখনো বসে, কখনো ঘরময় পায়চারি
করি। বহুদিন আগের একটা খবরের কাগজ ছিল। সেটাই উল্টে-পাল্টে দশবার দেখি। প্রতিটা খবর
মুখস্থ হয়ে যায় প্রায়। এভাবে দুপুর হয়ে আসে। কাছের এক হোটেলে খেয়ে এলাম। তারপর
আবার সেই একঘেয়ে সময় কাটানো। ঘুমানোর চেষ্টা করেছিলাম, ঘুম এলো না। আমি বিছানায়
বসে বসে মিরার কথা ভাবতে আরম্ভ করলাম। মিরা কি পাওনা আদায়ের জন্যে সুতোয় ধরে টান
দেবে? কোন্ সুতোয়? আমি আর মিরা যে সুতোয় বাঁধা, সে তো সব সময়ই সব ধরনের ধরাছোঁয়ার
বাইরে। মিরার পর হঠাৎ করে মনে পড়ে ইন্টারভিউ বোর্ডের পাথরের মূর্তিগুলোর কথা, একজন
খুব হঠাৎ ‘দেন’ বলে হাত বাড়িয়ে আমাকে চমকে দিয়েছিল। আমি দিতে পারিনি। একা একা যখন
সময় কাটে না তখন এক-এক করে সবার কথা মনে হয়। বন্ধু ‘দে’ বলে মিটমিট করে হেসেছিল।
মা চেয়েছিল গর্ব করার সুযোগ, লতিফ সাহেবের দরকার একটা সিগনেচার আর বাবা চায় আমি
তাদের ঋণ শোধ করি। অথচ কিছুই করা হলো না। এই নীরব-নিথর ঘরে মার মুখ ভাসে,
কান্নাভেজা। আমার ভালো লাগে না।
বিকেলের পরপর অসহ্য লাগতে আরম্ভ করলো সবকিছু। দরোজা বন্ধ করে গুটিসুটি মেরে
পড়ে থাকতে আর ভালো লাগে না।
তারেক ফেরে বেশ রাতে। ফিরে মাথা নাড়ে, ‘নাহ, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না কী হবে, কোথাও
কোনো খবর নেই, … আমি বোধ হয় পরশুই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাব, কী করা যায়, বলুন দেখি?’
তারেক যা বলতে চায় তা স্পষ্ট। ওর দোষ নেই, সিনিয়র লেভেলেই যখন অনিশ্চয়তা, তখন
ও কেন আমার ঝামেলা খামোকা ঘাড়ে নেবে। তাছাড়া আমি পার্টির বলতে গেলে কেউই নই।
আমি চুপ করে থাকলাম।
‘কী করবো এখন, বলুন তো?’ তারেক আবার জিজ্ঞেস করে। ও জানে ও কী করবে, তবে
একটু বোধ হয় সঙ্কোচ বোধ করছে।
আমি ইচ্ছে করেই ওকে একটা সুযোগ দিলাম। প্রথম থেকে সবকিছু খুলে বললাম ওকে। সব
শুনে ও বলে, ‘আপনি বরং তাইই করুন, কোনো ঝামেলা থাকছে না, … চাকরি নিয়ে নিন …।’
‘নেব?’
‘হ্যাঁ, সানন্দে’, তারেক মাথা নাড়লো, ‘আসলে আপনি কিসের বিনিময়ে কার চাকরি নিচ্ছেন
সেটা মূল ব্যাপার নয়, মূল ব্যাপার হচ্ছে আপনি মনে মনে কী বিশ্বাস পোষণ করেন। মনে মনে
যদি আপনি নিজেকে আমাদের লোক মনে করেন তবে তাতেই হবে, সময়মতো আমরা
আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবো।’
তারেক যত দ্রুত সম্ভব আমাকে কাটাতে চাচ্ছে, আমি বুঝি, তবে ওর কথার পিঠে কিছু না বলে
পারি না।
আমি বলি, ‘তখন যোগাযোগ করে কি কোনো লাভ হবে?’
‘কেন নয়?’
‘আমি তখন নানা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বো, ঐ অবস্থায় যোগাযোগ থাকলেই কি, না থাকলেই
কি। … আপনি নিশ্চয় জানেন, নিশ্চয় দেখেছেন একবার অন্য কাজে জড়িয়ে গেলে এ ক্ষেত্রে আর
ফিরে আসা যায় না, আসার মানসিকতাও থাকে না।’
তারেক একটু গম্ভীর হয়ে বললো, ‘কিন্তু এর চেয়ে ভালো সাজেশন আর কী হতে পারে বলুন?
… আর তাছাড়া, ইচ্ছে থাকলে ঐ অবস্থায়ও মিনিমাম সাহায্য আপনি নিশ্চয় করতে পারবেন, …
আসলে মিনিমাম কেন, ইচ্ছে থাকলে অনেক কিছু আপনি করতে পারবেন, কমরেড’- তারেক বেশ
গম্ভীর হয়ে বলতে নিল, ‘যদি আপনার মনে থাকে যে আপনার কাছে কারো কিছু পাওনা আছে …’
পাওনা! আমার কাছে? মুহূর্তের মধ্যে বোকা বনে যাই, ‘পাওনা? কি বলছেন আপনি, কে পায়
আমার কাছে?’
‘সমাজ’-তারেক মৃদু হাসলো- ‘দেবেন না?’
‘কী দেব?’
‘সমাজ যা পায়।’
আমি কথা বলি না অনেকক্ষণ। এসব কি ভালো লাগে, এই হঠাৎ করে এসব পাওনার কথা!
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তারেক বললো, ‘হ্যাঁ, ওটাই মূল কথা। এ সমাজের প্রতি
আমাদের দায়িত্ব আছে, কর্তব্য আছে, আমরা ঋণী। … আমি বলতে চাচ্ছি, ইচ্ছে থাকলে বিভিন্ন
সামাজিক অবস্থানে থেকেও সমাজের পাওনা শোধ করার জন্যে আমরা কিছু না কিছু করতে পারি।’
এতসব এ মুহূর্তে ভেবে দেখতে ইচ্ছে করে না। তারেকও সম্ভবত খুব-একটা গুছিয়ে কিছু
ভাবছে না। কিন্তু পার্টির সিনিয়র কর্মী হিসেবে আমাকে তো ওর কিছু একটা বলতেই হবে,
তাই এসব বলা। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী ঠিক করলেন, ফিরে
যাবেন?’ আমি বললাম, ‘আরেকটু ভেবে দেখি।’ তারেক হাসে, ‘দেখুন, তবে আমার স্থির ধারণা,
এ মুহূর্তে অন্য কোনো উপায় নেই।’
পরদিনও সেই একই অবস্থা। তারেক সকালে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সময় আবার
নিথর হয়ে যায়। আবার সেই একঘেয়ে পায়চারি ঘরময়, একটা কাঠ পেন্সিল দিয়ে পুরনো
কাগজের ওপর হিজিবিজি কাটা। কিন্তু এভাবে হয় না, আমার মাথায় রাজ্যের উদ্ভট চিন্তা এসে
জড়ো হয়, এভাবে আবদ্ধ ঘরে একাকী মানুষ বেশিক্ষণ সুস্থ থাকতে পারে না। এক সময় মনে হয়,
এই অনিশ্চিত জীবন আর সম্ভব নয় কাটানো, শরীরে আর শক্তি নেই, মনও সায় দেয় না। আর
এভাবে থাকতে থাকতে এখন ক্রমশই মনে হচ্ছে, চারপাশের দেয়াল আমাকে ঘিরে সঙ্কুচিত হয়ে
আসছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
রাতে তারেক ফিরলে বললাম, ‘হ্যাঁ, ফিরেই যাব ঠিক করেছি, আপাতত দিন কয়েক তো
ভালো থাকতে পারবো!’
তারেক মাথা দোলায়, ‘আমিও তাই বলি।’
পরদিন সকালে তারেক কিছু টাকা গুঁজে দিতে চায় হাতে, ‘নিন ধরুন, লজ্জার কিছু নেই, কখন
কী দরকার পড়ে।’
আমি মাথা নাড়ি, ‘উঁহু, বাড়িই যখন ফিরছি তখন আর টাকা দিয়ে কী হবে।’
তারেক একটুক্ষণ চুপ করে থাকে, মাথা নেড়ে সায় দেয়, ‘হ্যাঁ, তাও বটে, তা আর কী বলবো,
ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন, সুস্থ থাকা প্রয়োজন, … আর ঐ কথাটা মনে রাখবেন, সমাজের
কাছে আমাদের একটা …।’ আমি হেসে মাথা নাড়ি, ‘হ্যাঁ, সমাজের কাছে আমাদের একটা ঋণ
থেকেই যাচ্ছে। শোধ করতে হবে, মনে থাকবে।’
তারেক বেরিয়ে গেলে আমি দুপুর পর্যন্ত গত দু’দিনের মতো ওর ঘরে বসে-শুয়ে কাটাই।
বিকেলের আগে আগে ঘরে তালা দিয়ে চাবি মেসের কেয়ার-টেকারের কাছে রেখে বেরিয়ে পড়ি।
ভাবি, বাড়ি ফেরার আগে একটু ঠা-া মাথায় ঘোরাফেরা করি। কিছুটা পথ এগিয়ে বাস থেকে
নেমে যাই। এটুকু পথ পায়ে হেঁটে মেরে দেয়ার ইচ্ছে। সামনে একটা ছোটখাটো রেস্তোরাঁ দেখে
ঢুকে পড়লাম। এক কাপ চা দরকার। এ সময়ের মধ্যে বাসায় কী বলবো, কী রকম আচরণ
করবো; তাও গুছিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু চা খেতে বসে মেজাজ বিগড়ে যায়। বিশাল স্বাস্থ্যের এক
লোক, যার শরীর লাল কাপড় ও বিভিন্ন পাথর ও হরিতকির মালা, রেস্তোরাঁয় ঢুকে কথা নেই, বার্তা
নেই, ঠিক আমার সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মেঘ-গম্ভীর গলায় বলে, ‘দে।’
কী দেব! এ ধরনের আধ-পাগল, ক্ষ্যাপাটে লোক আমার কখনো ভালো লাগে না। চা’য়ের
কাপে চুমুক দেয়া হয়েছে মাত্র, আমি চোখ তুলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি, গলার স্বর গম্ভীর করার
চেষ্টা করে বলি, ‘কী চাই?’
লোকটা এতসব দেখলোই না, হাত নাড়িয়ে আবার বললো, ‘দে।’
আপদ। তাকিয়ে দেখি আশেপাশের টেবিল থেকে লোকজন উৎসুক চোখে এদিকে তাকিয়ে
আছে, রেস্তোরাঁর বেয়ারাগুলোও সে-রকম, তারাও মজা দেখার জন্যে অপেক্ষায়। আমি
ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। চায়ের কাপে আবার ঠোঁট নামাই, কিন্তু চুমুক দেয়ার
আগেই লাল কাপড়ের ক্ষ্যাপাটে লোকটা হাত বাড়িয়ে কাপ সরিয়ে দিলে চা ছলকে এসে টেবিলে
পড়ে। আমার হাতে পড়ে, লোকটা বলে, ‘দে।’
আমার তখন আর কিছু করার থাকে না। আমি রেস্তোরাঁ থেকে উঠে আসি। মেজাজটা তেতো
হয়ে গেছে। যে ব্যাপারটা সেরে ফেলবো ভেবেছিলাম, তার কিছুই হয়নি, এখন হাঁটতে হাঁটতে ঠা-া
মাথায় আমাকে ঠিক করতে হবে বাড়ি ফিরে আমার আচরণ কী রকম হবে।
কিন্তু আমার বাড়ি ফেরা হয় না। আরো কিছুটা এগিয়ে রাস্তা পার হতে যাব, ভিড়ের মধ্যে
কেউ-একজন পেছন থেকে আমার কাঁধ স্পর্শ করে বলে, ‘তুই খোকা না?’ কারা, যারা আমাকে
খুঁজছে, তারা? মুহূর্তের মধ্যে আমার পুরো শরীর শক্ত হয়ে যায়। দৌড়াব কি? তার আগেই
পেছনের লোকটা বলে, ‘আমাকে চিনতে পারছিস?’
তখন আমার খেয়াল হলো, যে হাত আমার কাঁধ স্পর্শ করেছে তা মোটেই সবল নয়, বরং
কাঁপা কাঁপা এবং গলার স্বরও ভাঙা। পেছনে ফিরে এক নজরেই চিনি, স্কুলে আমাদের অংকের
ক্লাস নিতেন। এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, মুখের চামড়ায় প্রচুর ভাঁজ, জামা-কাপড়ে বিশ্রী
গন্ধ। এ সময় এ ধরনের দেখা হওয়া কি ভালো লাগে? না, লাগে না। আমি তাই চটজলদি কাটার
চেষ্টা করলাম। আমার আস্তিন ধরা স্যারের হাত কায়দা করে ছাড়িয়ে নিয়ে সালাম করি, ‘স্যার,
ভালো আছেন?’ স্যারের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস এই সুযোগে বেরিয়ে পড়ে, ‘আর ভালো থাকা,
কোনো মতে বেঁচে আছি বাবা, তোরা তো কেউ আমার কোনো খোঁজখবর নিস না।’
কী খোঁজখবর নেব? কিন্তু এ কথা স্যারকে বলা যায় না। স্যারের আরেকটি দীর্ঘশ্বাস বেরোয়,
‘আমার ছোট ছেলেটাকে একটা চাকরি-চাকরি জুটিয়ে দে না বাবা, এবার ম্যাট্রিক ফেল করলো,
পড়াশোনায় মন নেই, কিন্তু চাকরি একটা পেলে মন দিয়ে করবে।’ এ সময় নাটকের সংলাপ
আওড়ানো যায়, বলা যায় ‘আপনি আমার স্যার, আপনি সোজা হয়ে দাঁড়ান, আগে আমার কথা
শুনুন, আমি কি …?’ কিন্তু বলার সুযোগ পাই না, স্যারকে এ কথা বলাও যায় না, স্যার দম নিয়ে
আমার মুখের দিকে তাকান, বলেন, ‘তোরা সবাই কত বড় হয়েছিস, … এক সময় তো আমার
কাছেই লেখাপড়া শিখেছিলি, মনে আছেরেÑ আমি তোর স্পেশাল কেয়ার নিতাম, তুই অঙ্কে
লেটার পেয়েছিলি না?’ আমি বলি, ‘না স্যার, সে অন্যজন।’ স্যার সে কথা শোনেন না, আরেকটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘তোরা আমার ছাত্র, রক্ত জল করে তোদের মানুষ করেছি, তোদের কাছে
আমার অনেক পাওনা ….।’ আমার হঠাৎ চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, ‘স্যার, আপনার কাছেও,’
বলতে পারি না। অস্পষ্ট গলায় ‘দেখবো স্যার, আপনার ছেলের জন্যে দেখবো’ বলে ভিড়ের মধ্যে
মিশে যাই।
দশ
কিন্তু আমার বাড়ি ফেরাও হয় না। এই এতটা সময় ধরে, মানুষকে তো শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতেই
হয়, এই রকম ভেবে সব দ্বিধা-সঙ্কোচ, লজ্জা কাটিয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু এখন
ফেরার ইচ্ছে সত্ত্বেও বাড়ির কিছু দূরে থমকে দাঁড়াতে হয়।
বাড়ির সামনে পানের দোকানে বসে ভালো মানুষের মতো যে লোকটা সিগারেট জ্বালাচ্ছে, সে
লোকটাকে আমি চিনি। আমাদের বাড়ির সামনেই তাকে দেখেছি। যেদিন বাবা বাড়ি থেকে চলে
যেতে বললো, সেদিন ছোট ভাইটা বলেছিল ওদের নাকি কিছু পাওয়া আছে আমার কাছে, লতিফ
সাহেবের সঙ্গে আবার কথা না বলে ওর সামনে যাওয়া যায় না। আমি পেট মোটা একটা গাছের
আড়াল থেকে লোকটাকে লক্ষ করি। এতদূর থেকে সব কিছু পরিষ্কার বোঝা যায় না, তবে এটুকু
বোঝা যায় লোকটার হাতে অঢেল সময়, তার কোনো ব্যস্ততা নেই, লোকটা ও জায়গা থেকে
নড়ছেও না।
বেড়ে মজা, ফেরাও হবে না! এখন দেখছি মানুষ যে পথে যায় ফিরে আসার সময় সে পথের
অনেক কিছুই বদলে যায়। আর এ রকম ভাবতে ভাবতেই, নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, কী এক
ভীষণ অভিমান নিজের ভেতর ডালপালা মেলে দিয়ে ছড়িয়ে যায়। অভিমান কেন, কার
প্রতিÑনির্দিষ্ট কোনো উত্তর চেষ্টা করেও খুঁজে পাই না। হাতের কাছেই বাবা, সব অভিমান, ক্ষোভ
তার দিকে ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তাও হয় না, সবার ওপর, সবকিছুর ওপর অভিমান
ডালপালা গুটিয়ে দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে স্থির হয়ে থাকে, শরীর ছেড়ে যায় না। এ সময়
মনে হয়, না, যাব না বাড়ি ফিরে।
কিন্তু এভাবে এই গাছের আড়ালে কতক্ষণ? বাড়ি যখন ফেরা হচ্ছে না তখন অন্য আবাস
খুঁজতে হয় বৈকি! তবে রাত্রির আবাস থাক, আপাতত কোথাও যাওয়া উচিত, যেখানে নিরাপদ
বোধ করবো। ভার্সিটির দিকে যাব? মাস্টার্সের পর আর যাইনি, সে সময়ই একবার পার্টির হয়ে
বিপক্ষ দলের ছেলেদের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিলাম, সেই শেষ যাওয়া। এখন ব্যাপারটা
একটু রিস্কি হলেও যাওয়া বোধ হয় যায়। পুরনো বন্ধুরা, যারা এখনো ভার্সিটিতে বসে আড্ডা
চটকায়, তাদের পাওয়া গেলেই হলে থাকার একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারবো। ভার্সিটির দিকেই
যাব ঠিক করলাম। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট-ফোঁকা লোকটাকে আরেকবার দেখে
নেই। এমন বিপদের মধ্যেও কী যে হয়, হেসে হাত নাড়ি, টাটা বাই বাই। লোকটা এখন বাড়ি
ছাড়িয়ে অন্য দিকে হেঁটে যাচ্ছে; কিন্তু লোকটা যাচ্ছে না এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ, কিংবা তার
ডিউটি শেষ, ইতিমধ্যে হয়তো অন্য কেউ এসে দাঁড়িয়েছে, যাকে আমি চিনি না। এখানে থাকা আর
নিরাপদ নয়।
পকেটে মোটামুটি ভালো পয়সা আছে। ভালো এই অর্থে, এই পরিমাণ অর্থ আমার পকেটে
বহুদিন হলো থাকে না। তবে এখন থেকে পয়সা খুব সতর্ক হয়ে খরচ করতে হবে। ভার্সিটি বেশি
দূরেরও পথ নয়। এটুকু পথ পায়ে হেঁটে মেরে দেব ঠিক করলাম।
রাস্তার কোণ ধরে হাঁটলাম। মাঝে-মধ্যে এদিক-ওদিক তাকাই, পথে কোনো অঘটন ঘটে না।
ভার্সিটি এলাকায় যখন পৌঁছি তখন মাঝ বিকেল। লাইব্রেরির বারান্দা, রেফারেন্স-রুম, সামনে
ঝুপড়ি ক্যান্টিন বারকয়েক খুঁজে দেখি, কোনো চেনা মুখ নেই। তবে কি বন্ধুরা আসা ছেড়ে
দিয়েছে? অবশ্য এমনও হতে পারে, দল বেঁধে ওরা সবাই কোথাও গেছে, আবার ফিরে আসবে,
এ রকম মাঝে মাঝে হয়। কিন্তু এখন আমার সময় কাটে কী করে! লাইব্রেরির বারান্দায় আড্ডায়
বসতে বসতে এক স্টাফের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এখন খুঁজে সে লোকটাকেও
পেলাম না। আর কী করা, কতক্ষণ ঝুপড়ি ক্যান্টিনে বসে থাকি, চা শেষ করে সিগারেট ধরাই, বসে
থাকি আর প্রতিমুহূর্তে অপেক্ষা করি এই বুঝি এমন কেউ এসে ঢুকবে, যে আমাকে বহুদিন থেকে
চেনে, যার হাতে প্রভূত না হলেও অনেক ক্ষমতা। আপাতত আমার সমস্যাও তো বেশি নয়। কিন্তু
সে রকম কিছুই ঘটে না।
শেষে উঠে এসে লাইব্রেরির বারান্দায় বসি। ঘুম ঘুম পায়, মাঝে মাঝে এমন বিতিকিচ্ছিরি
ব্যাপার ঘটে, এখন কেন ঘুম পাবে! কিন্তু ঘুম তো আমার নিয়ন্ত্রণে নয়। আমি আরেকটা কড়া
সিগারেট শেষ করি। এ সময় লাইব্রেরির বারান্দায়ও তেমন লোকজন নেই। আমি একটা খামের
গায়ে হেলান দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসেছি। বছর দেড়েক আগে হলেও এভাবে বসতে লজ্জা
পেতাম, ভাবতাম কেউ, বিশেষ করে মেয়েরা দেখলে কী বলবে, কিন্তু এখন সে সময়ের কথা মনে
হলে বরং হাসি পায়। এভাবে বসে থাকলে ক্রমশ ক্লান্তি বাড়ে। মনেও হয় না কাজটা ভালো হচ্ছে
না, যে-কোনো জায়গায় ঘুম ভালো নয়। কিন্তু আমার শরীর ক্রমশই নুয়ে পড়ে।
বেশ পরেই সম্ভবত টের পাই কে একজন মৃদু নরম গলায় ডাকছে, ‘বড় ভাই, ভাই সাহেব,
আপনি অবেলায় ঘুমুচ্ছেন।’ চোখের সামনে প্রথম দেখি অনেকগুলো সাদা পোশাক, প্রায় ধড়মড়
করে উঠে বসে দুহাতে চোখ কচলে নেই; কিন্তু না, তারা পাশের মসজিদের লোক। আমাকে জেগে
উঠতে দেখে দলের সামনে যে দু’জন ছিল, তাদের মুখ অদ্ভুত সুন্দর হাসিতে ভরে যায়, একজন
বলে, ‘ভাই, আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালাম না তো, মাফ করে দেবেন, কিন্তু একটু আগে আজান
পড়েছে, এবাদতের সময় হয়েছে।’ একটা ঘোরের মধ্যেও যদি আছি, তবু এসব ব্যাপার বুঝতে কি
সময় লাগে, রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করি, ‘কী বলছেন?’
সামনের দু’জনই আবার হাসলো। ইতিমধ্যে তারা সবাই যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে আমার
হাতে হাত মিলিয়েছে, বুকেও টানতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি বসে আছি বলে সেটা সম্ভব হয়নি।
একজন বললো, ‘কেন বড় ভাই, আপনি কি এবাদতে যাবেন না, পরম করুণাময়ের কাছে …।’
আমি বসে থেকেই শরীরের আড়মোড়া ভাঙি। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি তারপর। কিন্তু তাদের
কেউ বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়, মুখের হাসিও তাদের মিলিয়ে যায় না, বলে, ‘আমরা সৃষ্টির সেরা জীব
বড় ভাই, আশরাফুল মখলুকাত, পরম করুণাময়ের কাছে আমরা চিরজীবনই ঋণী। এবাদত
ছাড়া আমাদের মুক্তি কোথায়? আপনি বড়ো পরিশ্রান্ত, আসুন, আমরা এবাদতের পর সবাই মিলে
আলাপ করবো, শান্তি পাবেন!’
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলাম। তারা এমন আচরণে অভ্যস্ত। এ সময় গেটের কাছে
বেশকিছু ছেলে জটলা পাকিয়েছে, তারা সেদিকে এগুতে এগুতে বলে, ‘পরম করুণাময়ের ঋণ তো
এভাবেই শোধ করতে হবে, আপনি এবাদতে আসছেন তো বড় ভাই?’
আমি মাথা নাড়ি। আপাতত বাঁচোয়া। তারপর দু’পা বাড়িয়ে দেই সামনে। বসে থেকে যদিও
খুব চেষ্টা করি, যেন ইচ্ছেমতো বাড়াতে বাড়াতে পা ঠিক পৌঁছে দেব প্রয়োজন মতো জায়গায়,
কিন্তু বেশি দূর এগোয় না আমার পা, এক নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে থেমে থাকে।
সন্ধ্যে হয়ে এলো প্রায়। এখন কী করবো, কোথায় যাব? যারা আমার ক্লাসমেট ছিল, তারা পাস
করে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু তারা তো এখনো নিয়মিত আসে আড্ডায়Ñ এ রকমই জানতাম, অথচ
এখন কাউকেই পাই না, কোনো চেনা মুখ নেই। বাড়িতেও ফিরে যাবার উপায় নেই। ক্লান্তিতে
ক্রমশ ভেঙে পড়ে শরীর।
ঠিক এ সময় আমার ঘাড়ের পাশে একটা ছেলে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো, ‘খোকা ভাই।’ খুব চমকে
যাই, ছেলেটা হঠাৎ করে এমন চেঁচিয়েছে, কিন্তু তাকে আমি চিনি না। আমার চেয়ে বছর কয়েকের
ছোট হবে, হাসি হাসি মুখে আমাকে দেখছে। বললো, ‘কখন থেকে এখানে?’ আমি আমতা আমতা
করে বলি, ‘অনেকক্ষণ, কিন্তু আপনি …?’ ছেলেটা হাসলো, ‘আমাকে কিন্তু তুমি করেই বলতেন,
অবশ্য মাত্র কয়েকদিনের আলাপ, মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক, তা থাক, আপনাকে ডাকছে সবাই,
ঐদিকে।’ ছেলেটা হাত তুলে দেখালো মধুর ক্যান্টিনের দিকে। কিন্তু কারা ডাকছে আমাকে।
ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলে হাসলো, ‘উঁহু, সেটা সিক্রেট, বলা যাবে না, সারপ্রাইজ দেয়ার মতো
ব্যাপার কিনা!’ আমি উঠলাম, হয়তো পুরনো বন্ধুরা চান্স পেয়ে আমাকে একটু ভাবাচ্ছে। তাছাড়া
ছেলেটাকেও এখন চেনাচেনা লাগছে, আশফাকের খালাতো ভাই সম্ভবত, আমাদের তিন ক্লাস নিচে
পড়তো।
সামান্য পথ। ছেলেটা এক নাগাড়ে, ‘কেমন আছেন, কী করছেন, এদিকে একদমই আসেন
না।’ এসব বলতে বলতে পুরো পথ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ দেয় না। মধুর ক্যান্টিনের
ঠিক আগে রাস্তার এপাশে অন্ধকার মতো জায়গা, ইটের পাঁজা, সে জায়গাটুকু পেরোনোর আগে
দশ-বারোজন আমাকে ঘিরে ফেলে। আমাকে যে নিয়ে এলো সে ছেলেটা দারুণ হাসিতে ফেটে
পড়ে। নেতা গোছের একজনকে বলে, ‘বাবুল ভাই, আজ চাইনিজ খাওয়ার পয়সা চাই, অভিনয়
কেমন করেছি সেটা না হয় এই ব্যাটাকেই জিজ্ঞেস করেন।’
একটা বিরাট থাপ্পড় এসে পড়ে ঘাড়ের ওপর, নুয়ে পড়লে সাথে সাথে থুতনির ওপর হাঁটুর
বাড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে যাই। তারাই টেনে তোলে।
বাবুল নামের ছেলেটা ঠিক আমার সামনে। ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে
আছে। আমি এক-এক করে সবার মুখের দিকে তাকাই, নাহ্, কাউকেই চিনি না। কিন্তু কোথায়
এসে পড়েছি, তা বুঝতে পারছি। এক পা পিছিয়ে যেতেই একজন লাফিয়ে আসে, অবলীলায় দুটো
চড় বসায় গালের দু’পাশে, কলার ধরে টানে।
ওরা এখন গোল করে ঘিরে রেখেছে আমাকে।
চড় দুটো জোর বসেছে, ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরছে বুঝতে পারি, মাথার ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করছে।
বাবুল নামের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বোকার মতো বলি, ‘আপনারা কী চান, আমি, আমি কী
করেছি!’ বাবুল হাসে, ‘পার্টি করিস, তুই পার্টি করিস শালা, শ্রেণিশত্র“ খতম করিস, বাহ্, বেশ।’
পাশ থেকে একজন বলে, ‘ওসব কথা থাক বাবুল ভাই, এ ব্যাটাকে এখন কি করবো বলেন,
নুনু কাটবো?’ বলেই সে মুগুড়ের মতো ডান হাতটা চালায় আমার পেটে, বোধ হয় রক্ত উঠে আসে,
চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। মনে হয় অনন্তকাল লাগবে সামলে নিতে, জিভ বের করে হাঁপাতে
হাঁপাতে বলি, ‘আমার কাছে, আমার কাছে আপনাদের কী দরকার?’ বাবুল হাসে, ‘চান্দু, সেই যে
মারামারির পর এ এলাকা ছাড়লা আর তো আইলা না, আর এদিকে আমাগো রহমান যে তোমাগো
পুরি খাইয়া বরবাদ হইয়া গেল, তার কি হইবো? তুমি চান্দু রহমানের পাওনা শোধ কইরা যাও …’
আমি পাগলের মতো চেঁচিয়ে ওঠার চেষ্টা করি যে, সে মারামারির দিন আমি শুধু ঘটনাস্থলেই
ছিলাম, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু কিছু বলার আগে অনেকগুলো হাত নেমে আসে আমার ওপর,
কয়েক সেকেন্ড মাত্র সামলাতে পারি, তারপর নিজেকে ছেড়ে দেই। ছেলের দল আমাকে নিয়ে
ইচ্ছেমতো খেলে। আমার নাক ফেটে যায়, ঠোঁট চিরে যায়, মনে হলো চোখের ভেতরেও কোনো
সূক্ষ্ম শিরা ছিঁড়ে গেছে। কারণ মুহূর্তের মধ্যে ভুল দেখতে আরম্ভ করলাম। চারপাশের একটা
মুখকেও এখন আলাদা করতে পারছি না, আর সবার ভেতর থেকে এখন, কী আশ্চর্য, দু’একটা
পরিচিত মুখ উঁকি দিতে আরম্ভ করলো। হ্যাঁ, মিরাকে দেখলাম, ‘আমার পাওনাটুকু দে’ বলে আমার
দিকে তাকিয়ে আছে। পর মুহূর্তে ইন্টারভিউ বোর্ডের পাথরের এক মূর্তিকে দেখি আমার দিকে হাত
বাড়িয়ে দিয়েছে। ভুল দেখছি? সামনে এসে ভিড় জমায় বাবা-মা, লতিফ সাহেব, তারেক,
সুপারভাইজার লোকটা, এমন কি অঙ্কের স্যারও। আমার মনে হলো না আমি ভুল দেখছি, আমি
জানি আমি যা দেখছি তা ঠিক। আশ্চর্য, আজকেই রেস্তোরাঁয় যে ক্ষ্যাপাটে লোকটাকে দেখেছিলাম,
তার বিশাল শরীরও দেখলাম একপলক, আমার মনে হলো আমাকে এবাদতে নিয়ে যেতে যে
লোকগুলো এসেছিল তারাও এখন আবার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আর পারিও না। ক্রমশ
এলোমেলো হয়ে যেতে যেতে আমি টের পাই সেই বিমূর্ত, অচেনা এক বিমূর্ত মূর্তি হাত পেতে
দাঁড়িয়ে থাকে, দাঁড়িয়েই থাকে। আমি টের পাই সে বিমূর্ত মূর্তির হাত ক্রমশই বড় হতে হতে কী
সহজে এগিয়ে আসছে, এগিয়েই আসছে …
এই অবস্থায়ও মনে হয় আমি পালাতে পারবো। যদি হঠাৎ লাফিয়ে উঠি, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেই
আশেপাশের সবাইকে। তবে ছুটে বেরিয়ে যেতে পারবো এখান থেকে। জানি, এ ছেলের দল পিছু
নেবে না আমার। কিন্তু ঐ বিমূর্ত মূর্তি, পিছু ছাড়বে?
আর পালিয়ে আমি কোথায় যাব?
সবাই শুধু আমার কাছেই পায়। আমিই শুধু ঋণী। এ এক জীবন! এ জীবনে সব এড়িয়ে
আমার তো যাওয়ার নেই কোথাও।