সম্পর্ক

শান্তা বলল, লুকিয়ে কদিন রাখবে? আমার আর বুঝতে বাকি নেই যে তোমার মায়েরই চরিত্র খারাপ।

গোলাম রসুল বলল, সাবধান।

সংক্ষিপ্ত একটি অনুনাসিক ধ্বনি শুনিয়ে শান্তা আবার বলল, খারাপ বলা যাবে না। বলতে হবে ফুলের মতো পবিত্র।

গোলাম রসুল এবার আরো ঝাঁজাল কণ্ঠে বলল, সাবধান।

শান্তা বলল, মাকে গিয়ে সাবধান করো। তার কাছে পুরুষ মানুষ আসে, বেগানা পুরুষ।

গোলাম রসুল বলল, আর একটা কথা বললে…।

শান্তা স্বর নামিয়ে বলল, তোমাকে তো বলিনি, তোমার মাকে বলেছি। মন্দ কী বলেছি। বেশ্যাদের পেটেও তো অনেক সময় সুসন্তান হয়। নাকি হয় না? গোলাম রসুল আরো চটে গিয়ে বলল, মা সম্পর্কে আর একটা কথা বললে…।

শান্তা তার বাক্যটিই টেনে নিয়ে মুখ বিকৃত করে জবাব দেয়-আর একটা কথা বললে কী কচুটা করবে? তোমার মুরোদ আমার জানা আছে।

গোলাম রসুল আর একটি কথাও না বলে দুহাত স্ত্রীর গলার দিকে এগিয়ে নিল। শান্তাকে মেরেই ফেলবে এমন কোনো প্রতিজ্ঞা থেকে কাজটা করেনি। ছোট একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছে।

আরো অনেক পুরুষের মতো গোলাম রসুলও ধরে নিয়েছে, স্ত্রীকে শিক্ষা দেওয়ার একক অধিকার ও দায়িত্ব স্বামী হিসেবে তারই।

শান্তা শুরুতেই স্বামীকে একটা ধাক্কা দিতে পারত। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে ফেলেছে। একই কথা শান্তা আগেও বলেছে; কিন্তু গোলাম রসুল এমন ভয়ংকর হয়ে ওঠেনি।

শান্তা শেষ পর্যন্ত মরেনি। কারণ বউমার চেঁচানো ঝগড়া ও হঠাৎ থেমে যাওয়া তার শাশুড়িকেই ধন্ধে ফেলে দেয়। আলেয়া খাতুন ঘরে ঢুকে প্রচণ্ড শক্তিতে গোলাম রসুলকে ধাক্কা মারেন। অসমান পায়ের ক্রোধান্ধ মানুষটি স্ত্রীর গলা ছেড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ধারালো কিছুতে লেগে ডান গালে কাটা দাগ পড়ে এবং সেখান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়।

আলেয়া খাতুন নিজেও ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যান। খাটের পায়ায় মাথা পড়ে ফুলে যায়। অনেকক্ষণ ঝিম মেরে পড়ে থাকেন। শান্তার মনে হয় তার গলা দিয়ে রক্ত উঠছে। বেসিনে থুথু ফেলল, কুলি করল। সে রকম কিছু হয়নি। হতে পারত। শান্তা পেছন ফিরে চায়, গোলাম রসুল উঠে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু আলেয়া খাতুন তখনো উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

গোলাম রসুলের ডান পা-টা বাম পায়ের চেয়ে দেড় সেন্টিমিটার ছোট। এই সমস্যা আড়াল করা খুব কঠিন কাজ নয়। ডান পায়ের জুতোর সোল বাম পায়েরটার চেয়ে দেড় সেন্টিমিটার উঁচু হলেই হুট করে কেউ এই খুঁতটা ধরতে পারবে না। কিন্তু তা তো শার্ট-প্যান্ট পরে থাকা অবস্থায়। বাড়িতে লুঙ্গি পরতে হয়, তোয়ালেতে নিজেকে পেঁচিয়ে কখনো বাথরুম থেকে বের হতে হয়, স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরতে হয়। ঘরের ভেতর খালি গায়ে, খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করতে হয়। জুতো আর প্যান্ট পরে তো বাসর শয্যায় আসেনি। শান্তা শুরুতেই খেয়াল করেছে-জুতো ছেড়ে যখন স্পঞ্জের স্যান্ডেলে পা রাখে, গোলাম রসুলের শরীরটা হঠাৎ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, কিন্তু সে সামলে নেয়। এ রকম যাদের শারীরিক ত্রুটি, তাদের সবারই সামলে নেওয়ার ক্ষমতা অসাধারণ।

উচ্চতায় পাঁচ ফুট দেড় কী দুই ইঞ্চি, ওজন বাষট্টি কেজি, এর তেমন হেরফের কখনো হয়নি। আর শান্তা এমনিতে পাঁচ ফুট পাঁচ। বিয়ের সময় ওজন চৌষট্টি কেজি, স্বামীর চেয়ে সাড়ে তিন কী চার কেজি বেশি; আর এখন তো আটাত্তর কেজির নিচে নামছেই না। আশিও ছুঁয়েছিল। এ রকম শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়ে শান্তা একটুও রুখে দাঁড়াতে পারল না? শান্তা কখনো রুখে দাঁড়ালে বেকায়দায় পড়ে যেতে পারে এ আশঙ্কা হয়তো তার ছিল।

আশঙ্কাটা আতঙ্কজনক হওয়ার কারণেই আগে আরো দুবার ইচ্ছে হওয়ার পরও শান্তার ওপর হাত তোলেনি। দুই হাতের করতল মুষ্টিবদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত গুটিয়ে নিয়েছে। খাটো পায়ের কারণে সম্ভাব্য ভারসাম্যহীনতা তার মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে-সামান্য ধাক্কাতেই হয়তো উল্টে পড়ে যেতে পারে। সুতরাং শান্তার উসকানির পরও নিজেকে যথেষ্ট সংযত রাখতে পেরেছে বলে তার ধারণা।

শান্তা আর তার শাশুড়ি আলেয়া খাতুনের মধ্যে সম্পর্কটি যে ভালো নেই, এটা কোনো অবাক করা বিষয় নয়। শতকরা নিরানব্বইজন বউমা শাশুড়িকে সহ্য করতে পারে না। শাশুড়িদের বেলায়ও হয়তো তাই। সুতরাং মা ও স্ত্রীর মধ্য থেকে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষায় কিছু মিথ্যাচার গোলাম রসুলকে করতেই হয়েছে। শুরুতে যখন আলাদা বাড়িতে ছিল, মাকে গিয়ে বলত, শান্তা তো আমার শাশুড়িকে বলেছে গোলাম রসুলের মার মতো মানুষ হয় না। স্ত্রীকে বলত, মা বলেছে, বউমাদের মধ্যে তুমিই ভালো-দেখতেও, ব্যবহারেও।

শান্তা বলত, আমার বাবা তো আর তোমার ছোট ভাইয়ের শ্বশুরের মতো ঘুষ খেয়ে ছয়তলা বাড়ি বানাতে পারেনি। আমাকে তো ভালো ব্যবহার করতেই হবে। আর দেখতে কেমন… তোমাদের নেহরিন আমার বাবার বাড়ি যে কটা কাজের বুয়া দেখেছি, সবচেয়ে কুৎসিতটাও দেখতে ওর চেয়ে সুন্দর।

তার পরও অভিযোগ ছিল নেহরিন বাবার ঘুষের টাকায় তোমার মাকে এটা-ওটা কিনে দিয়ে শেষ পর্যন্ত মানুষটাকেই কিনে ফেলেছে। বুড়ো মানুষ, এক পা কবরে, এই বয়সেও মানুষ এত লোভী হয় ভাবতেই পারি না। ঈদের দিন বিকেলবেলা দেখলাম তোমার মা নেহরিনের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছেন। আমি পৌঁছতেই কথার মোড় ঘুরিয়ে বললেন, দিনদুপুরে খুন করছে, চালডালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, মন্ত্রীরাও টাকা পাচার করছে, সরকার হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে। বুঝলে, তোমার মা কত বড় পলিটিশিয়ান! নেহরিনের সামনে আমাকে হাইকোর্ট দেখিয়ে দিলেন।

গোলাম রসুল ঠিক মায়ের পক্ষ নিয়ে নয়, আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দিতে বলল, একজন মন্ত্রী নাকি তাকে ফিজিও করাতে আসা মেয়ের বয়সী একজন থেরাপিস্টকে বিয়ে করে ফেলেছে?

শান্তা বলল, তুমিও আমার সঙ্গে পলিটিঙ্ শুরু করে দিলে? মায়ের রক্তই তো, হবে না? সিনিয়র মন্ত্রী রিয়াজউদিন সাহেব ফিজিওথেরাপিস্টকে বিয়ে করেছেন অন্তত নয় মাস আগে। নতুন বউ তার মেয়ের বয়সী হবে কেমন করে। তার তো পাঁচ ছেলে, কোনো মেয়ে নেই। অসুবিধে নেই, মন্ত্রী হতে পারলে তুমিও একজন ফিজিওথেরাপিস্টকে বিয়ে করে নিয়ো। অনাপত্তি দিয়ে রাখলাম।

আমি তো সে কথা বলিনি।

তোমার আর তোমার মার কথা বুঝতে বাকি নেই। তুমি বলতে চাইছ মন্ত্রী মেয়ের বয়সী একজনকে বিয়ে করেছে, এটা একটা স্ক্যান্ডাল, এতে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। দিনদুপুরে কে কাকে খুন করেছে তোমার মা তার জন্য সরকারকে দোষী করছেন আবার দাঁত খিঁচিয়ে বলছেন, সরকার হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তোমাদের উদ্দেশ্য আমার বুঝতে বাকি নেই। আমার মার ফুপাতো ভাই এই সরকারের মন্ত্রী, এটা তোমাদের সহ্য হচ্ছে না। সরকারের পতন হলে মিন্টু মামা আর মন্ত্রী থাকতে পারবে না-এটাই তোমাদের লাভ। নেহরিনের এ নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। তার মার ফুপাতো ভাই প্রিন্স হেয়ার ড্রেসিংয়ের মালিক। মানে চুল কাটে। সোজা কথা নাপিত। তোমার মা নাপিতের ভাগ্নিরই শাশুড়ি হওয়ার উপযুক্ত। কত আহলাদ ছোট বউমার জন্য।

গোলাম রসুল বলল, কত মন্ত্রী দেখলাম! আমার মার এক ডিস্ট্যান্ট কাজিনও মন্ত্রী ছিলেন। তাতে কী এসে-যায়।

শান্তা বলল, তার কথা থাক। এখন তো জেলে, নাকি জেল থেকে বের হয়ে আবার মন্ত্রী হওয়ার ফন্দিফিকির করছে?

শান্তা, এবার বেশ নমিত স্বরে বলে, নাপিতের ভাগ্নির সঙ্গে তাল মেরে তোমার মা বললেন, সরকার হুমড়ি খেয়ে পড়বে? সরকারের দুই পা-ই সমান। কোনো খাটো পা নেই সরকারের যে ভারসাম্য হারাবে।

গোলাম রসুল কষ্ট পায়। শান্তা তার খাটো পা নিয়ে ঠাট্টা করবে কেন? বিয়ের সময় তো লুকোয়নি। তা ছাড়া প্রস্তাবটি তো শান্তাদের দিক থেকেই এসেছে। পাত্র দেখতে যেদিন শান্তাদের পরিবারের লোকজন এলো, গোলাম রসুল সেধে বলল, দেখুন আমার পায়ে সমস্যা আছে। এই যে দেখুন ডান পাটা বাম পায়ের চেয়ে…।

গোলাম রসুল কথা শেষ করতে পারেনি। শান্তাদের পক্ষে দলনেতা শান্তার ছোট মামা সোনালী ব্যাংকের এজিএম গাউসুর রহমান বলে ফেললেন, আরে রাখো তোমার পায়ের সমস্যা। মাথার সমস্যা আছে-এমন মানুষ পর্যন্ত বিয়ে করে। শুধু বিয়ে? প্রমোশন পেয়ে ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার পর্যন্ত হয়। আমার ব্যাংকের জিএম মুরতায়েশ আলী পুরো পাগল। আমার ডিজিএম হওয়াটা আড়াই বছর ধরে আটকে রেখেছেন। আমাদের সচিব আর মন্ত্রীকেও অনেকেই পাগল বলে। পাত্রীপক্ষকে পারলে প্যান্ট-জুতো খুলে পায়ের অবস্থা দেখাতে চেয়েছে, তাদের সেদিকে আগ্রহ নেই। পাত্র বিদেশি সংস্থায় চাকরি করে। পচানব্বই হাজার টাকা বেতন পায়-তারপর পায়ে সমস্যা, না মাথায় সমস্যা এটা দেখার কোনো বিষয় নয়।

এ তো আর মান্ধাতার আমল নয় যে বিয়ের আগে পাত্রপাত্রীর দেখাদেখি নিষিদ্ধ। গোলাম রসুল মূলত পায়ের সমস্যার কথা জানাতেই বিয়ের আগে পাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইল। দেখা হলো। শেরে বাংলানগর লেকের পাশে হাঁটতে হাঁটতে গোলাম রসুল তার সম্ভাব্য স্ত্রীকে বলল, আমার ডান পায়ে একটু সমস্যা…।

শান্তাও কথা শেষ করতে দিল না। বলল, ছোট মামা বলেছে একটা পা আরেকটা পায়ের চেয়ে ছোট। কই ভালোই তো হাঁটছেন দেখছি। এটা কোনো সমস্যাই নয়। আমার বড় দুলাভাইয়ের তো মাথায় সমস্যা-বছরে তিন মাস অক্টোবর নভেম্বর ডিসেম্বর বেডরুম বন্ধ করে বসে থাকে, শুয়ে থাকে। এখন তো নভেম্বর, সে জন্য আপনাকে দেখতে যেতে পারেনি। এই তিন মাস আপা ড্রইং রুমের কার্পেটে ঘুমায়। দুলাভাই এ সময় দাড়িও কাটে না। ডিসেম্বরের শেষ দিন আয়নায় নিজেকে দেখে আঁতকে ওঠে। তারপর দাড়ি কাটে, বাড়ির পাশের সেলুনে গিয়ে চুল ছাঁটে। ইস্ত্রি করা শার্ট-প্যান্ট আর কালো পালিশ করা চকচকে জুতো পরে নিজের অফিসে যায়। এই তিন মাস আপার বড় ছেলে তানভির একাই অফিস চালায়। মাথায় কোনো সমস্যা থাকলে বলেন, আমি কার্পেটের ওপর ঘুমাতে পারব না। পায়ের সমস্যায় আমার অসুবিধে হবে না।

গোলাম রসুল বলল, তবু আমি আপনাকে সবটা জানিয়ে রাখতে চাই, যেন বিয়ের পর আমার পায়ের অবস্থা দেখে আমাকে প্রতারক ভাবতে শুরু না করেন।

শান্তা এবার কড়া স্বরে বলল, শুনুন, আমাকে যদি আপনার পছন্দ না হয়ে থাকে সরাসরি বলে দিন। পা ছোট, না হাত ছোট এসব অজুহাত কেন দিচ্ছেন। আমারও একটা সমস্যা আছে। একটা জিনিস ছোট। কিন্তু আমি এখন বলব না। বিয়ে হলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন।

শান্তার কথা তার মাথায় ঢুকল না। ততক্ষণে শান্তা বলে ফেলল, যদি বিয়ে হয়, তাকে গান গাইতে বাধা দেওয়া যাবে না।

গোলাম রসুল বলল, বাধা দেব কেন, আমিও আপনার কাছে গান শিখব।

শান্তা বলল, এত আহলাদি লাগবে না। গান গাওয়া বেশরিয়তি কাজ না বললেই হবে।

আপনি কি হারমোনিয়ামে গান, না তানপুরায়?

তানপুরায় গাওয়া যায়, এটাও জানেন দেখছি।

এই সাক্ষাতের ঠিক একুশ দিন পর এমপি হোস্টেলের হলরুমে তাদের বিয়েটা হয়ে গেল। গোলাম রসুলের খাটো ডান পা বিয়েতে কোনো বাধার সৃষ্টি করল না। শান্তাও কী একটা সমস্যার কথা বলেছিল, সে কথা বিয়ের দিন পর্যন্ত মনেও পড়ল না। গোলাম রসুল যে শান্তার তুলনায় বেশ খাটো এ নিয়ে কেউ কোনো কথা তোলেনি।

কোনটা ছোট কোনটা বড় এ রকম কোনো সমস্যা নয়। শান্তার দিক থেকে অন্য একটা খুঁত এত দিন আর সবার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। শান্তার একবার গায়ে হলুদ পর্যন্ত হয়েছিল। এক দিন বাদ দিয়ে পরদিন ইস্কাটন সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে। পার্সোনা বিউটি পার্লারে নতুন বউয়ের সাজ নিয়ে শান্তা কনের জন্য তৈরি বিশেষ ডায়াসে ফুলকন্যা হয়ে বসেছিল। পাত্রপক্ষের একাংশ চলে এসেছে, পাত্রীপক্ষের প্রায় সবাই। রাত নয়টা হয়ে যাওয়ায় অতিথিরা যখন অস্থির হয়ে উঠেছেন, শান্তার বাবা খাবার লাগাতে নির্দেশ দিলেন। সবাই খেতে বসে গেলে উত্তেজনা প্রশমিত হয়। দশটা বেজে গেলেও বরসহ মূল বরযাত্রী এসে পৌঁছেনি।

দুই পক্ষের অতিথিদের একটি বড় অংশ খাওয়া শেষে পান চিবুতে চিবুতে বেরিয়ে গেছে। রাত এগারোটার দিকে পাত্রের বড় ভাই এসে শান্তার বাবাকে ফিসফিস করে বলল, একটা সর্বনাশ হয়েছে। লজ্জায় আপনাদের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না বলে বাবা আসেননি, নতুবা তিনিই এসে ক্ষমা চাইতেন।

শান্তার বাবা বলল, বড় কোনো অ্যাক্সিডেন্ট! বরের গাড়ি উল্টে গিয়ে খাদে পড়ে যাওয়ার ঘটনা তো হামেশাই ঘটে। আমাদের জামাইবাবা ভালো আছে তো?

এতক্ষণ ভালো থাকার কথা নয়। ঠিক আটটার সময় তুলে নিয়েছে। প্রায় তিন ঘণ্টা হয়ে গেল।

কে তুলে নিয়ে গেছে, কোথায়?

ওই যে মন্ত্রীর শালা বাবলু, মাথাটা পাওয়া গেছে বনশ্রীতে, আর বাকি শরীরটা মিরপুরে শহর রক্ষা বাঁধের ঢালে। তাতে আমাদের বাবুকে নাকি আসামি করা হয়েছে। শেরওয়ানি, পাগড়ি আর নাগরা পরে ফুলে ঢাকা বরের গাড়িতে কেবল উঠেছে, কোন সংস্থার জানি না, চারজন এসে গাড়ি ঘিরে ধরে। দুজন বাবুকে টেনে বের করে একটা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

শান্তার বাবা বলল, তাহলে আর কী করার আছে। আমার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হোক বা না-ই হোক, ছেলেটা যেন বেঁচে থাকে এই দোয়া করি।

শান্তাও ব্যাপারটা শোনে। নিজেই সিদ্ধান্ত দেয় আরো কিছুদিন দেখি, নিশ্চয়ই একদিন ছাড়া পাবে।

মাস দুয়েক পর সেই ভাইটি এসে আবার জানায়, ময়মনসিংহ শহরঘেঁষা ব্রহ্মপুত্রের পারে বাবুকে পাওয়া যায়। দেহ অখণ্ডই ছিল। কাটাকাটি ছিল না, বুলেটের ছিদ্রও না। গলায় কোনো দাগও না। মেয়ের জন্য আবার পাত্র দেখতে শুরু করুন, এবার ভালো পাত্রের খোঁজে আমরাও আপনাদের সঙ্গে থাকব। পরে আমরা শুনেছি, বাবু নিজেই মন্ত্রীর শালাকে গুলি করেছে। বিয়ের যখন কথা হচ্ছে, আমরা বাবুর এই দিকটি গোপন করেছি। যা করার বাবুর নির্দেশেই করেছি। তবু কাজটা ভালো করিনি।

শান্তার প্রথম গায়ে হলুদের নয় মাস সতেরো দিন পর শান্তা আর গোলাম রসুলের বিয়ে।

নেহরিনের মা বলেছে, কেমন মেয়ে। বিয়ের আগেই এক হাজব্যান্ডকে সাবাড় করে ফেলল, এই হাজব্যান্ডটার না যেন কী হয়!

গোলাম রসুল কারো কথাতেই কিছু মনে করেনি। শান্তার ব্যাপারটা ঠিক তা নয়, কিছু কথার জবাব তো দিতেই হবে। এসব নিয়েই বিরোধ। ধাক্কাটা আলেয়া খাতুনের চরিত্রের ওপর দিয়েও যায়।

দুই

বিয়ের প্রথম রাতেই শান্তা তাকে আলিঙ্গন করা অসম পায়ের গোলাম রসুলকে বলে, আমরা আপনাদের ঠকিয়েছি।

কিভাবে?

বুঝে যাবেন।

আপনার খাটো পা নিজেই প্যান্ট তুলে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু আমারটা তো দেখানোর সুযোগ ছিল না। হয়তো বলা যেত। কিন্তু বললেই বিয়েটাও ভেঙে যেত।

তোমার কোনটা?

আর জিজ্ঞেস করবেন না। দু-এক দিনের মধ্যেই জেনে যাবেন।

দু-এক দিন লাগেনি। সে রাতেই গোলাম রসুল জেনেছে তার স্ত্রীর ডান স্তনটি বামটির তুলনায় বেশ ছোট। ব্রাসিয়ারের একটি কাপে বাড়তি প্যাড দিয়ে ঘাটতিটা পূরণ করা হয়েছে।

গোলাম রসুল বলেছে, ও কিছু নয়। দুটো কখনোই সমান সমান হয় না।

শান্তা হঠাৎ কথার মোড় ঘুরিয়ে দেয়, আপনি কজনেরটা দেখেছেন?

গোলাম রসুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বলে, চল ঘুমিয়ে পড়ি।

সে রাতে সদ্যবিবাহিত দম্পতি আর বেশি এগোয়নি। ঘুমিয়ে পড়ে।

শান্তা জানে তার শ্বশুর গোলাম নবী সংসারবিবাগী, ছেলের জন্মের পরই দেশান্তরী হন। নেহরিনের স্বামী আলেয়া খাতুনের দ্বিতীয় বিয়ের সন্তান। সেই মানুষটিও বেশি দিন টেকেনি। মুন্সীগঞ্জে কাটপট্টির কাছে লঞ্চডুবিতে তার মৃত্যু হয়। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা করে আলেয়া খাতুন দুই ছেলেকে দাঁড় করিয়েছেন। দেশান্তরী প্রথম স্বামীর ভিটায় তার তখন ঠাঁই হয়নি। তাদের ভবঘুরে ছেলেকে বউটা ধরে রাখতে যখন পারেনি, সেই ভিটায় থাকারও অধিকার তার নেই। ছেলে নিয়ে আলেয়া যখন রাস্তায়, ওয়ারির মুদি দোকানি রুহুল কুদ্দুস তার আত্মীয়স্বজনের বাধার মুখেই আলেয়াকে বিয়ে করেন, সঙ্গে চলে আসে গোলাম রসুল। রুহুল কুদ্দুসের ছেলে মাজহারুল কুদ্দুস মায়ের আগের বিয়ের সন্তান গোলাম রসুলকে উপেক্ষা করেনি। কিন্তু নেহরিন বিয়ের পর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় গোলাম রসুল এ বাড়ির কেউ না, সুতরাং তার একটি ফ্ল্যাট দখল করে কোনো ঘুটে কুড়ানির বেটি শান্তাকে নিয়ে বসবাস করার অধিকার নেই।

গোলাম রসুল মেনে নেয়। ওয়ারি ছেড়ে চলে আসে সোবহানবাগের ভাড়া বাড়িতে। এখান থেকে অফিসও কাছে। নিজের নিরুদ্দিষ্ট বাবার বাড়ি মনিপুরিপাড়াও দূরে নয়। সম্পত্তি-বঞ্চিত দুই ফুফু এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে-তোর হিস্যা আদায় কর, আমাদেরটাও আদায় করে দে। মামলার খরচ আমরাই দেব।

পরিস্থিতি গোলাম রসুলের অনুকূলে চলে আসছে, বড় চাচা পক্ষাঘাতে বিছানায়, মেজ চাচা নিজের স্ত্রীর দায়ের করা নারী নির্যাতন মামলায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এদিকে তার সহায়তায় থানার ওসির শ্যালিকা তাদের অফিসের ফ্রন্ট ডেস্কে রিসিপশনিস্টের চাকরি পেয়েছে। ওসি বলেছে, শুধু কোর্টের একটা অর্ডার এনে দেন রসুল ভাই। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব ভাঙচুর করে আপনার ও বোনদের দখল বুঝিয়ে দেব।

একদিন আলেয়া খাতুনও চলে আসেন। গোলাম রসুলের সঙ্গেই থাকবেন। তিন মাসের ভাড়া অ্যাডভান্স নিয়ে ছেলের ফেলে আসা ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছেন, ভাড়াটিয়া ভাড়ার টাকা সরাসরি তাকেই দেবে।

নেহরিন মাজহারুল কুদ্দুসকে বলেছে, দেখলে তোমার মা কত বড় সেয়ানা। বাড়ির ভাড়া নেওয়া আর বাড়িতে থাকার মধ্যে পার্থক্য কী? তোমার লেংড়া ভাই গাছের আগাও খেল, গোড়াও খেল। এখন তোমার মা ভাড়ার টাকা নিয়ে চলে গেল তার বাড়িতে।

ভালোই হয়েছে। আজেবাজে লোক আসা বন্ধ হবে।

কিসের আজেবাজে লোক?

জুতোর তলায় বালুভর্তি একজন আমার নতুন কার্পেটটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। দেড় ঘণ্টা তোমার মায়ের সঙ্গে ফিসফিস করেছে। এমন কারো সঙ্গে আমি পনেরো মিনিট কথা বললেই তো ঘণ্টা পিটিয়ে বলে বেড়াতে নেহরিনের চরিত্র খারাপ। আর তোমার মায়েরটা? সেই লোক আরো একদিন এসেছে। আমরা বাসায় থাকি না। আরো কতবার এসেছে কে জানে। কাজের বুয়াকে একটা পানের খিলি দিলেই তো মুখ বন্ধ করে রাখে। মায়ের চরিত্রই তো পেয়েছে। কী করে বেড়াত কে জানে। শান্তা বলল, কেন তোমার মা নাপিতের ভাগ্নির সঙ্গে পেরে উঠল না? স্বার্থপর নেহরিন ফোন করে আমাকে বলেছে, ছেলে দুটোই মেনি বিড়াল। বুড়িটার সামনে মুখ খোলে না। বাড়িভাড়ার টাকা নিয়েছে নিক, কিন্তু টাকাটা কী কাজে খরচ করে খেয়াল রেখো। তার কাছে পুরুষ মানুষ আসে। একজন এসে তাদের নতুন কার্পেট নষ্ট করে দিয়েছে। নেহরিন নিজে দেখেছে তোমার মা লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে টাকা দিচ্ছে। তুমিও তো সেই মায়ের চরিত্র পেয়েছ। এখন থেকে তোমার বেতনের টাকা, ভাতার টাকা, ট্যুরের টাকা যা আছে সবগুলোর পাই পাই করে হিসাব দেবে। কখন আবার কোন মেয়েকে দিতে শুরু করো। নাকি শুরু করে দিয়েছ?

গোলাম রসুল বলল, চুপ করো।

মায়ের ছেলে কিনা, তাই বললাম।

বলেছি তো চুপ করো।

চুপ না করলে কী করবে?

গোলাম রসুল ক্রোধ সংবরণ করে।

শান্তা থামে না। বলে, যে মহিলা এসব নষ্টামি করে বেড়ায়, তার হাজব্যান্ডের তো দেশান্তরীই হওয়ারই কথা। দুই নম্বরটাকে নদীতে ডুবিয়ে মেরেছে। একে ডাইনি বলবে না তো কাকে বলবে?

তিন

গোলাম রসুল যেভাবে গলা টিপে ধরেছিল, আর তিরিশ সেকেন্ড হলেই শান্তার নিষ্প্রাণ শরীর মেঝেতে পড়ে থাকত। সজাগ ইন্দ্রিয়ের আলেয়া খাতুন তাকে বাঁচিয়েছেন। এতে বউমার কাছে তার কদর বাড়েনি। শান্তা বলেছে, ছেলেকে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচাতে বুড়ি আমাকে রক্ষা করেছে। এই বুড়ি আমার জন্য যা-ই করুক, শেষ পর্যন্ত ধরা পড়বে আমারই হাতে।

গোলাম রসুলের এই দম বন্ধ করা গলা টিপে ধরায় শান্তার সঙ্গে সম্পর্কের তেমন অবনতি ঘটেনি। তৃতীয় দিনই তার বাহুতে মাথা রেখে শান্তা ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে গোলাম রসুলকে জড়িয়ে ধরে। সাড়া মেলে, সংসারের তিক্ততাগুলো চাপা পড়ে যায়। ধীরে ধীরে তাদের বসন ঝরে পড়তে থাকে। অনেক দিন পর গোলাম রসুল ছোট স্তনটাই মুখে তুলে নেয়। শান্তা বলল, এখন ডিম ফোটার সময়। ভালোই হলো, বাচ্চা লেগে যেতে পারে।

গোলাম রসুল বলে, ছেলে হলে যেন পা দুটো সমান থাকে।

শান্তা বলে, মেয়ে হলে যেন স্তন দুটো।

গোলাম রসুল বলে, একটা ছোট বড় হলে কিছু এসে-যায় না।

শান্তা বলল পা-তেও একই কথা।

অনেক দিন পর সুখমন্থন করা একটি রমন দুজনকেই দ্রুত ঘুম পাড়িয়ে দেয়। ফ্লু আক্রান্ত গোলাম রসুলের অফিস কামাই করতে হলো। ইউএনডিপির রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভের সঙ্গে তার সাভার এঙ্পোর্ট প্রসেসিং জোন পরিদর্শন করার কথা ছিল। এমন গুরুতর কিছু নয়, অফিস করা যেত। কিন্তু আর কেউ সংক্রমিত হতে পারে এই আশঙ্কা, তার অফিসই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে থাকে। ফোন করতেই প্রশাসনের ডিরেক্টর বলে দিলেন, পুরোপুরি না সারা পর্যন্ত অফিসে এসো না। টেলিফোনের সুইচ অন রেখো। যখন যা দরকার তোমার সেকেন্ড ম্যান জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে।

বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শান্তা গোলাম রসুলকে টানতে টানতে বিছানা থেকে নামিয়ে আনল। ড্রইং রুমের জানালার পর্দা খানিকটা সরানো। শান্তাই কাজটা করেছে। ঠোঁটের ওপর আঙুল চেপে গোলাম রসুলকে বলল, তাকিয়ে দেখো।

গোলাম রসুল তাকাল। এ কী! এ তো মা! উস্কুখুস্কু চুল, মুখভর্তি অবহেলার দাড়ি-মানুষটি কি মায়ের ঊরুর ওপর মাথা রেখেছে, মা তার চুলে বিলি কাটছে।

আর দেখতে ইচ্ছে করল না। মাথায় রক্ত চেপে গেল। শান্তা তো মিথ্যে বলেনি। অথচ আর একটু হলেই নিরপরাধ শান্তার মৃত্যু হতে পারত।

শান্তা বলল, বলিনি?

হ্যাঁ, দেখেছি।

বিশ্বাস হলো?

হ্যাঁ।

গোলাম রসুল উন্মত্তের মতো চিৎকার করে উঠল, ভেতরে এসব কী হচ্ছে?

নোংরা পোশাকের আতঙ্কিত মানুষটি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার সিটকিনি খুলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

মা চেঁচিয়ে উঠল, সাবধান ওকে কিছু করবি না। আমাকে মেরে ফেল।

দুজনই তখন ড্রইং রুমে। আলেয়া খাতুন একবার পুত্র ও পুত্রবধূর দিকে তাকিয়ে সোফার বালিশ দিয়ে মুখ ঢাকলেন।

শান্তার চোখ পড়ল সোফার ওপর মুষ্টি থেকে বেরিয়ে আসা বেশ কটি পাঁচ শ টাকার নোট। আতঙ্কিত মানুষটি টাকাগুলো নিতে পারেনি।

গোলাম রসুলের চোখ পড়ল দরজার কাছে ধূলিমাখা একজোড়া জুতোর ওপর। একটি জুতোর সোল অন্যটির চেয়ে ইঞ্চিখানেক উঁচু। অস্বাভাবিক ধরনের জুতোটি হাতে তুলে নেয়। পকেটে মুখ মোছার যে রুমালটি ছিল তা বের করে গোলাম রসুল এই জুতোটি মুছতে থাকে। জুতোটি ডান পায়ের।

গোলাম রসুল নিজের ডান পাটার দিকে একবার তাকায়। তারপর প্রবল ঝাঁকি দিয়ে আলেয়া খাতুনকে জিজ্ঞেস করে, মা, আমার বাবা বেঁচে আছেন!