২০১৬ ভালোবাসার বছর

2016
আমার পৃথিবীতে দিনের পর রাত্তির এসে চড়াও হওয়ার মতো প্রাত্যহিক এক সময়ে সে ছিল না, আমি ছিলাম। ওর জগতে সে রকম সময়ে আমি ছিলাম না, সে ছিল। পরে এক সময় জানতে পারি, ওর আকাশে তারাভরা ছায়াপথ ছিল। আমিও সে রকম ভেবেছি মনে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে, তারাভরা ছায়াপথ ছিল।
২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি, আমার গ্রামের বাড়িতে কিছু সময়ের জন্য থাকতে হয়েছিল। সেখানে মোবাইল ফোনে এক তরুণীর সঙ্গে শূন্যতাবশত পরিচয় হয়। সে আমার নাম জানত না। আমিও তার নাম জানতাম না। আমি তার ফোন নম্বর জানতাম না। সেও আমার ফোন নম্বর জানত না। নামহীন ও দেখাহীন শুধু কণ্ঠস্বররূপে সুদুর্ঘটনাবশত পরিচয়।
দুর্ঘটনাপ্রবণ আমার দেশে এটা আমি সুদুর্ঘটনা মনে করেছি। সেও অনাবেগ আভাস-ইঙ্গিতে সে রকম একটা কিছু বলেছিল বলে আমার মনে আছে। এমনকি অপার্থিব ভালো কিছু মনে করেছিল বলে জানাতে ভোলেনি। আর তা পার্থিব বলে তর্ক করার সুযোগ গ্রহণ করিনি। শুধু বলেছি, অপার্থিব ভালো একটা ঘটতে যাচ্ছে পৃথিবীতে।
শুরুতে আমি তার নাম সযত্নে জানতে চাইনি। সেও অযত্নে জানতে পারেনি। আমি তখন কী করছি জানতে চাইলে ১৯৮২ সালের বিখ্যাত ইউচিউ বোতান রচিত একটি থাই উপন্যাস ‘লেটারস্ ফ্রম থাইল্যান্ড’ পড়ছি বলেছি। এ রকম ঘটনাকে আমি খবর হিসেবে বললেও সে বলল, বইটি ১৯৬৯ সালে সিয়াটো পুরস্কারপ্রাপ্ত। এ সময় সে বইটি পড়েছে বলার প্রসঙ্গে নিজের নাম বলে দেয়। আমিও সেই সুযোগে ভদ্রতাবশত আমার নাম বলে দিই। বইটি কিভাবে সংগ্রহ করেছি সে প্রসঙ্গ এসে গেল কথায় কথায়। সেই সূত্রে আমার থাই বান্ধবীর নাম বললাম, সংসারণ নীলক্ষুমাহেং। ও তখনো বিয়ে করেনি এবং এখনো করেনি, তাও বলে দিলাম। এমনকি সম্ভাবনাও ফুরিয়ে আকাশে উবে গেছে বললাম।
তারপর সুপক্ষ আমের মতো জানতে পারলাম ও চট্টগ্রাম শহরে থাকে। আমিও শহরে এসে পড়েছি জানিয়ে দিলাম এবং থাকব আরো বেশিও নয়, কমও নয়, একতরফা নব্বুই দিন। কোনো কারণ ঘটলে বেশিও হতে পারে। তখন ওকে বোধ হয় কথায় পেয়ে থাকবে। ওর কণ্ঠও সে সময় মধু পূর্ণিমার মতো ছিল। তাই কথায় কথায় বলে দিলাম, জীবনে না-দেখা পিয়াল ও পারুলগাছ খুঁজতেই শহরে এসেছি। সেও খুব করে ভিরমি খাওয়ার আগের মুহূর্তের মতো হয়ে বলল, সেও পারুল ও পিয়াল ফুল দেখেনি। দেখার আশাও ছেড়ে দিয়েছে একটু আগেই। আর আকাশবিজ্ঞানীদের সদ্য আবিষ্কৃত নতুন ছায়াপথ দেখার আশার মতো। কারণ ভূ-বাংলাদেশে তেমন উগ্র শক্তিমান টেলিস্কোপ না থাকার কারণে। তার চেয়ে বড় কথা, বইপত্রের ছবিতে ছায়াপথ দেখার চেয়ে এক জনম না-দেখাই নাকি পরিষ্কার ভালো। তার ওপর যারা নক্ষত্র দেখে গবেষণা করে তাদের প্রেম-ভালোবাসা ভালো হয় না।
সেদিনের পরিপক্ব সন্ধের সময় আসকারদিঘির উত্তর-পুব কোণের মোড়ের পলাশগাছের ছায়ার লুটোপুটিতে ওর সঙ্গে মিলন হলো। ওর হাত দুটি অসচরাচর দীর্ঘ মনে হলো। ওর আঙুল ছুঁয়ে আছে হাঁটুঅব্দি, ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো। খোঁপা খুলে দিলেও তার ব্যতিক্রম হবে না মনে হলো। কিন্তু শরীর ও মুখ উসকানির আবেগে লাবণ্যে ভরপুর। গভীর কালো চুলে নীলের দ্যুতি ছড়ায় ক্ষণে ক্ষণে। আর তখুনি আমার ভাবনা-ভীতি শনাক্ত করে খোঁপা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সঙ্গে হাত মানানসই হয়ে গেল নৃত্যকলার মতো।
সেই সন্ধেয় আমরা সার্সন রোড ধরে হেঁটেছি শোঁ শোঁ হাওয়ার সঙ্গে বারকয়েক ধাক্কাধাক্কি খেয়ে। বা যুদ্ধ করতে করতে পরাজয় না মেনে আমি ওর মনের কুঠুরিতে কী আছে খুঁজেছি। সেও আমার মনের বাক্সে শন শন কিছু হাওয়া আছে কি না খুঁজেছিল। চোখে চোখ পড়লে তাতে নিবিড় তিমির ছায়া খুঁজেছিল বলে মনে হয়েছিল। তখন আরো মনে হয়েছিল মোড়ের সড়কদ্বীপের পলাশগাছের সব পাতা যেন মুক্তিযোদ্ধা গোয়েন্দার সন্ধানী চোখ হয়ে আমাদের দেখেছিল। আমিও বারবার ওদের দিকে দেখছিলাম। ওরা অমনি প্রত্যেকবার হেসে দিয়েছিল বঙ্গোপসাগরের মতো নগ্ন বুক ফুলিয়ে উদ্দাম সৌন্দর্যে। ওর একটি মাত্র স্তন, দুটি শ্রোণিভারের বদলে কয়টি তা ভেবে দেখিনি।
ওর ডান হাত দিয়ে আমার বাঁ হাত ধরেছিল। আমি বাঁ হাত দিয়ে ওর ডান হাত ধরেছিলাম। তখন ওর বাঁ হাতের কনুই ১৮০ ডিগ্রি হয়ে হাওয়ার কারসাজির মতো দুলছিল। হাওয়া এসে সুযোগ বুঝে ওর খোলা চুল উড়ুক্কু মাছের মতো এসে আমার গায়ে আছড়ে পড়ে। ওর চুল সেক্সি নয়, আবার আমের মতো উত্তেজক কিন্তু অনুভূতিশীল সহৃদয়। উত্তাল ঢেউয়ের মতো দানবীয় শান্তিদায়ী। এ রকম অনুভূতি আমার আর কোনো সময় অনুসন্ধানী হয়ে আসেনি। আমার করতল প্রায় শক্ত, ওর প্রায় মাখনতুল্য কোমল। তখনো পলাশ পাতাদের চোখগুলো নিবিড় নির্মীলিত চোখে দেখে যাচ্ছিল। ফুল ফুটিয়ে চলছিল অন্তর্বাস খোলার মতো। ঢেউ দুলছিল ভালোবাসা করার মতো শর্তে।
ওর বাড়ি দিঘির কাছেই। আমার আশ্রয় পাথরঘাটায় গির্জার কাছে। ওখানে প্রতিদিন নিয়মিত সময়ে গম্ভীর সুরে ঘণ্টা বাজে ঢং ঢং ঘড়ির নির্দেশে। আমি সেখান থেকে বিকেলের দিকে, কখনো বা সন্ধের সময় ছুটে আসতাম। সে কখনো আমার হাতে চুমো খায়নি। আমিও খেতে পাইনি। বুভুক্ষু থেকেছি কাণ্ডজ্ঞানহীন বোকার মতো।
ও তার মেয়েবেলার কথার মালা খোলে। আমি ছেলেবেলার। আমাদের ছেলেমানুষিতে গিলে ধরেছিল। একবার আমার যৌবন উন্মেষের সময়ের একতরফা ভালোবাসার প্রসঙ্গ প্রায় বলতে বলতে শুরু করতে পারিনি। ভূমিকাটাও যদি বলতে পারতাম কাজের মতো একটা কাজ হয়ে যেত। সেও বলতে চেয়েও শুরুটা পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি। তখন ওর সঙ্গে ভালোবাসার প্রারম্ভিক টর্নেডো দানা বাঁধছিল মিছরির মতো। তখন আমার সঙ্গে ওর পিয়াল ও পারুল খুঁজতে যাওয়ার কথাই হচ্ছিল। এ ব্যাপারে প্রথমে বন বিভাগের সরকারি বড়কর্তার সঙ্গে দেখা করা দরকার বলে মনে হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সেও অদম্য সায় দিয়েছিল। সে প্রায় তৎপর হয়ে চাষির মতো কথার হালচাষ শুরু করেছিল। আমিও পার্বত্য চট্টগ্রামের বন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে হেস্তনেস্ত করব ভাবছিলাম। সে আবার গোপনে শৌখিন বৃক্ষবিদদের খোঁজ শুরু করেছিল। আমি আবার গোপনে ওর মন খোঁজাখুঁজি চালিয়ে যেতে থাকি। ভালোবাসার এ রকম অনেক সমস্যা ও খোলাখুলি রহস্য থাকে বলেও শুনেছি অভিজ্ঞ বন্ধুদের কাছে।
এরই মধ্যে আমি ওকে আমার বড় আয়নায় দেখতে থাকি। সেও ফোনে বলল, একই কথা। সেটা ২০১৬ সালের ২ মার্চ ছিল নির্ভুলভাবে এবং নিরহংকারীর বেশে।
বললাম, এমনকি আয়নার দিকে পেছনে ফিরে থাকলেও ওকে দেখতে পাই। সেও বলল, একই সঙ্গে অজান্তে লুকোচুরি অবস্থা ওর, আমার সঙ্গে।
বললাম, বললাম তো উল্কার লেজের মতো তোমার দীর্ঘ চুল রাতে আমার ঘরে অন্ধকারে উড়ে বেড়ায়।
সে বলল, তোমার অতল চোখ আর আগ্রাসী কুমারতুল্য ঠোঁট পরস্পর বিপরীতধর্মী।
বললাম, তোমার আজানু লম্বা হাত।
সে বলল, আমার বড় আয়নায় এখন আমার সম্পূর্ণ হাত দেখতে পাই না। তার চেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ দেখতে পাই। তবে পূর্ণিমার রাতে।
আয়না থেকে ছুটি নিতে বললাম, কর্ণফুলীর উজানে বড় হরিণা ও ছোট হরিণায় পিয়ালের খোঁজ পাওয়া গেছে।
আমিও যাব, সে বলল। আর বলার সঙ্গে সঙ্গে ওর চুলও লাফিয়ে আছাড় খেয়ে বসল। ওর এবং আমার গায়ে।
সে অনেক দূর, দুদিন লাগবে। আমি বললাম, ও যাতে যাওয়া থেকে বিরত না হয় সে রকম গলায়।
পিয়াল ও পারুলের কথা পড়েছি রবীন্দ্রনাথের গানে, প্রাচীন বইপত্রে। সে উৎসাহ নিয়ে বলতে লাগল, নাচিয়ে দিল চোখের পাতা ও ভ্রু। ওর উৎসাহ দেখে আমার বাঁ কাঁধ ও বাহু ঠাণ্ডা উত্তেজনা বোধ করল, নাকি পিত্তথলি নেচে উঠল বুঝতে চেষ্টা করলাম। ততক্ষণে ওর মধ্যে বোধ হয় মায়াবিভ্রমের জন্ম হয়েছিল। আর তাও আমার অনিচ্ছায় হয়েছিল। ওর প্রতি আমার ভালোবাসা তখনো আঁতুড়ঘরে ছিল, জন্ম হয়নি। তাই উদভ্রান্তও হয়ে ওঠেনি। অথবা ভালোবাসার বাল্যশিক্ষাও পড়ে শেষ করিনি বলে বুঝতে ভুল করেছি। ফোনেও তেমন বার্তা আভাসেও লিখে পাঠাইনি। তবে ওর চুলের পাকস্থলীতে উড়নচণ্ডী হাওয়া ভরে দেওয়ার অদম্য স্বপ্ন একদিন ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল। তাকে অনেক তোষামোদ করে নজরবন্দি করে রাখতে পেরেছিলাম। তাও ওই সার্সন সড়কের পলাশ ফুলের মাত্রাতিরিক্ত উসকানি সহ্য করে এবং আতঙ্কজনকভাবে সাঁতার শেখার সময় জলে ডুবে মরার মতো অবস্থায়। তাতে সার্সন সড়কের পাহাড়ের ঢালের মাদার ফুলের ইন্ধন থাকা সত্ত্বেও। আশপাশে শিমুল ফুল ছিল না বলে ওর মতামত জানা যায়নি। তবে তখন আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম ভালোবাসার ভবিষ্যৎ-অতীত না বুঝে।
এসব ঘটিতব্য বিষয় নিয়ে আমার কোনো উদ্বেগ-আশা ও আতঙ্ক নেই। আমি তখন কী করে যেন জেনে গিয়েছিলাম, ভালোবাসা বা প্রেম হলো এক রকম মানসিক স্বভাব, যার কোনো দাওয়াই আমার জানা নেই।
কিন্তু ব্যাপারটা এত সরল নয়। ২০১৬ সালে যা ঘটেছিল (পাঠিকা-পাঠকদের ভাষায় ঘটবে) তা কেন এভাবে ঘটবে! দৃষ্টিবিভ্রমকারী মায়া কী তাহলে আগেই ফুটে যেতে বসল?
আমি এই মাত্র মুঠোফোনে জানতে পেলাম সে উন্মাদ হয়ে গেছে তার চুলসহ সারা শরীর দেখার মতো নতুন একটা আয়না কিনে আনার পর। ওই আয়নাটা কোথা থেকে কিনেছে আমার জানার আগ্রহ জাগল প্রথমে। কোনো সাধারণ দোকান থেকে নাকি দুর্লভ-দুষ্প্রাপ্য জিনিসের দোকান থেকে এনেছে। নাকি স্বপ্নে পাওয়া।
আমি ওর বাড়িতে যাওয়ার আগে ফোনে জানতে পারলাম, সে আয়নার সামনে আমাকে মনে করে দাঁড়ালে আমাকে দেখতে পায়।
আমাকে! কী বলতে চায় সে! আপনারাই বা কী বোঝাবেন আমাকে! আমি আমার বদলে ওকে দেখতে পাই বললে না হয় মায়া বা ঘোরগ্রস্ত মাতাল বলে আমার কপালে তকমা সেঁটে দিতে পারেন। তবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোনো-না-কোনো মানুষের বেলায় এ রকম ঘটতেও তো পারে! এমন কিছু কিছু ঘটনা আছে, যার কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা চলে না। স্বপ্ন বা অনুমানই একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়ায়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব বলে একটি সত্যও তো আছে; কিন্তু যার প্রতি আমার প্রেম বা সঙ্গত-অসঙ্গত আকর্ষণ তখনো জন্মায়নি, ভালোবাসাও বিশেষভাবে সুতপ্ত হয়নি, শুধু মুঠোফোনের মারফত কাল্পনিক দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, তার বেলায় কী করে এসব ঘটতে পারে!
আরো জানতে পারলাম, আয়নার দিকে পেছন ফিরে থাকলেও সে নিজেকে নয়, আমাকেও দেখতে পায়। শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমিও আমার আয়নার সামনে গিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়ালাম। আর ঠিক আমার সামনে আজানুলম্বিত হাত নিয়ে জাদুবিদ্যার মতো সে দাঁড়িয়ে আছে। তাও আবার সে উলঙ্গ, কিন্তু চুলে সারা শরীর ঢাকা।
যাকে আমি ২০১৫ সালেও ভালোবাসার জন্য কাছে পাইনি, যাকে আমি প্রেম নিবেদন তখন করিনি বা করব বলে ভাবিনি, যাকে আমি শিকারির মতো অনুসরণ করিনি, আধুনিক বিশ্বের ভাষায় খুব আবেদনময়ী বলে মনে করিনি, তার চেয়েও আধুনিক ভাষায় যাকে সেক্সি অভিধায় ভূষিত করার কথা ভাবিনি, অনাঘ্রাতা তরুণী পারুল ফুল ভেবে কাছে পাইনি, ভীমরতি ভেবে যাকে আপনারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন তেমন কিছু ভাবিনি…আপনারা বুঝতে পারছেন আমার অবস্থা! তাহলে তাকে কি মনোবিকার জাতীয় কিছু বলা বিধেয় নয়কি! হবেও-বা।
কী ভয়ংকর বাস্তব আমার ও ওর আয়না দুটি! আমাদের অসংঘটিত ভালোবাসা ও মিলনসমৃদ্ধ ঘটনাবলি!
ব্যস, শুরু হয়ে গেল উড়ন্ত চুম্বন বৃষ্টি। গোলাপ বা পারুল ফুলের পাপড়ির মতো, প্রজাপতির দল যেমন উড়ে বেড়ায়। উড়ন্ত চুম্বনগুলো পরস্পরের গায়ে কেবলই আক্রমণ করছে বাঘিনীর পরাক্রমে। তাও যেমন-তেমন নয়। পানিতে ডোবা মানুষকে কূলে তোলার পর জীবনরক্ষাকারী চুম্বনরূপে। চুমো অথচ চুমো নয়। জীবন বাঁচানোর জন্য বায়ু ঢুকিয়ে দেওয়ার চুম্বন। গাড়ির চাকার টিউবে হাওয়া ঢোকানোর মতো একটানা নয়, সাইকেলের টিউবে হাতের চাপে ক্ষেপে ক্ষেপে ঢোকানোর মতো। তারপর বুকের ওপর এক হাতের তালুতে আরেক হাতের তালু বসিয়ে ক্ষেপে ক্ষেপে চাপ দেওয়া। যাতে দম ফিরে আসে। মৃত্যুর আগে জীবন ফিরে পাওয়া যায়।
এসব অঘটন ঘটনার শেষে কী হলো শুনুন তাহলে।
সে অমনি বলল, তুমি এক্ষুনি চলে এসো। আমার আয়নার কাণ্ডকারখানা বন্ধ করে দিয়ে যাও। দেখি দুজনে একসঙ্গে আয়নায় দাঁড়ালে কী ঘটনার জন্ম হয়। অথবা আমার নাকি তোমার মতিভ্রম হয়েছে তার একটা সুস্থ সমাধান হওয়া দরকার। কাল্পনিক হলেও হেস্তনেস্ত হওয়া ভয়ংকর প্রয়োজন। কোনো ভয়ংকর কিছুকে সুপাহারায়ও ফেলে রাখা উচিত নয়।
কতগুলো উড়ন্ত চুমো ভেসে বেড়াচ্ছে কি পারুল ফুলের পাপড়ির মতো? আমি মুখে হাসি না ছড়িয়েই বললাম।
নিজের চোখে দেখে পিথাগোরাসের উপপাদ্য সমাধান করে দিয়ে যাও, বলে মোবাইলে ভালোবাসার সুগন্ধ পাঠিয়ে দিল।
তাহলে ভালোবাসা হওয়ার আগে এই সুরক্ষা? ভেবেই আমি উড়ন্ত চুম্বনের মতো তক্ষুনি ওর জীবন্ত আয়নার ঘরে হাজির। ও তখন আয়নার সামনে একাকী ব্লাউজের বোতাম লাগাচ্ছিল। আর আয়নায় দেখা গেল ঠিক উল্টো অবর্ণনীয় দৃশ্য। সেটা বলার নয়, শুধু ভালোবাসা করার সময় তার দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ততক্ষণে আমাদের মধ্যে ভালোবাসার জন্ম উৎসবও শুরু হয়ে গিয়েছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ষড়যন্ত্রে।
ও তখন উড়তে থাকা একটি চুম্বন ধরে নিয়ে বলে দিল, আমরা তাহলে দাঁড়িয়ে-বসে আছি কেন! সময় তো ভবিষ্যতেও ঘটতে থাকে, অতীতেও তার মতো করে ঘটেছিল। ঘটমান বর্তমান বলে একটি সূত্রও তো আছে। নাকি ২০১৬ সাল থেকে তা বাতিল প্রমাণিত হয়ে গেছে!
আর সেই বর্তমান ঘটনা যখন শুরু হয়েছিল, তখন আয়নাও তার সব দৃশ্য একে একে দেখাতে শুরু করে দিল ভালোবাসার সত্যতা পূরণের মতো অক্ষরের পর অক্ষর বিন্যাস করে, চুমোর পর চুমো সাজিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পাতা ওড়ার মতো চুমোর ঝড় ধরে ধরে, ভালোবাসা করার প্রথম উৎসব উন্মাদের মতো বিনা মূল্যে শুরু করল, আর কোনোমতেই তারা শত চেষ্টা করেও নিজেদের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, যেন সুতোর ডগায় ঝুলছে, উড়ন্ত চুমোগুলোর ভারও সহ্য করতে পারবে না সেই সুতো।