বাচ্চা হাতির কান্না

আবার পাওয়া গেল দলছুট একটি বাচ্চা হাতি। একেবারেই কচি। বড়জোর দেড় কী দুই মাস বয়স। সীতা পাহাড়ের বনবিট অফিসের একেবারে কাছে। এক মাইলের মধ্যেই। বিট অফিসের কাছেই একটি বনবস্তিও আছে। বুনো হাতির পাল ছানাটিকে মোষ মারার বনে ফেলে যায়।
সকালে বনবস্তির লোকেরা রোজকার মতো কাজে গেল। কাজে নেমেই ছানাটিকে পলকের জন্য দেখতে পায়। শুঁড় তুলে দু-তিনবার আঁ আঁ ডাকে। অমনি জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। বনবস্তির লোকেরা আশপাশে বুনো হাতির পাল আছে সন্দেহ করল। নিশ্চয়ই কাছেপিঠে দলটি রয়েছে। নয়তো এমন কচি বাচ্চা কোথা থেকে আসবে।
অমনি তারা ছুটল বিট অফিসে। বুনো হাতির হামলা হলে বনকর্মীরা ছাড়া কে লড়বে! বনকর্মীরা এসে শুরু করল, খোঁজ খোঁজ। কিন্তু কোথায় হাতির পাল! আশপাশে তিন-চার মাইলের মধ্যে পাওয়া গেল না। তবে হাতির পায়ের ছাপ পেল। গাছপালার ডাল ভাঙা চিহ্ন পেল। বনকর্মীরা বুঝতে পারে। রাতে হাতির পাল বন ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু উদ্বেগ একটা থেকেই গেল। বাচ্চাটাকে খুঁজতে দলের হাতিরা আবার আসে কি না! না এলেও মুশকিল।
বাচ্চাটা ততক্ষণে বনবস্তির লোকজনের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলায় মেতে উঠেছে। মা-বাবার জন্য একটুও যেন মায়া নেই। একা হয়ে যাওয়ার জন্যও চিন্তা নেই! সে এই দেখা দেয়, আবার ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। দুপুরের পর বনকর্মীরাও এসে যোগ দিল। ওরা বন ঝেঁটিয়ে দড়ি দিয়ে ওকে বেঁধে ফেলল। নিয়ে এল বিট অফিসে। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার চন্দ্রমণি চাকমা পরীক্ষায় লেগে গেলেন। আগে জানা দরকার বাচ্চাটা সুস্থ কি না। একেবারে দুধের বাচ্চা। তার খাবার জোগানোই কঠিন। মায়ের দুধ ছাড়া বাঁচাবে কী করে। বিট অফিসের বড় কর্তা সঙ্গে সঙ্গে গরুর দুধ জোগাড় করতে লোক লাগিয়ে দিলেন।
ডাক্তার পরীক্ষা করে কিছু পেলেন না। এক বালতি পানি এনে দিল। অমনি শুঁড় দিয়ে চোঁ চোঁ করে টেনে গালে পুরে দেয়। এক বালতি শেষ। শুধু তো পানি নয়, ওটা ওরস্যালাইন। গত রাতের পর পেটে বিশেষ কিছু পড়েনি। কচি ঘাস বা পাতা দু-চার কামড় খেয়ে থাকবে হয়তো। আগে স্যালাইন-পানি খাক। পেট ও শরীর ঠিক থাকুক।
মা-হারা শাবক সাধারণত এ অবস্থায় লোকজনের সামনে ঘাবড়ে যায়। কিন্তু তেমন ভয় পায়নি। পেছনের ডান পায়ে মোটা করে কাপড় বেঁধে দিয়েছে ব্যান্ডেজের মতো। এর ওপর পাটের মোটা দড়ি দিয়ে খুঁটোয় বেঁধে রাখল। শুরু হলো আলোচনা।
ডাক্তার চন্দ্রমণি বললেন, বাচ্চা দিব্যি সুস্থ।
বিট অফিসের বনকর্তা সালাম খান বললেন, সুস্থ বাচ্চাকে মা এভাবে ছেড়ে যাওয়ার কথা তো নয়! তাহলে বুঝতে হবে, দল থেকে পিছিয়ে পড়েছে। হারিয়ে গেছে।
লাইথুইয়া বিট অফিস এ রকম দুটি বুনো বাচ্চা উদ্ধার করেছিল। সেগুলো ছিল অসুস্থ। তাই মা ফেলে গেছে। এ জন্য বাঁচানো যায়নি। এ কথা বলে চন্দ্রমণি ডাক্তার যেন চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
খবর পেয়ে কাপ্তাই থেকে অতিরিক্ত বনকর্তা চলে এসেছেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটির সামনে চলে গেলেন। বাচ্চাটি তখন সামনের পা-দুটি ভেঙে নিচু হয়ে বালতি থেকে গরুর দুধ খাচ্ছে।
চন্দ্রমণি ডাক্তার বললেন, দেখেও মনে হচ্ছে বেশ সুস্থ। তারপর তিনি পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। রোঁয়া রোঁয়া লোম পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন। গরমের দিন বলে ডলে ডলে গা ধুয়ে দিতে বললেন বনকর্মীদের।
অতিরিক্ত বনকর্তা ওয়াজিদ আলী বললেন, সম্পূর্ণ সুস্থ হলে দলছুটের কারণ কী!
ছোট বাচ্চা। বড়দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে না পারলে দলের সবাই তার জন্য অপেক্ষা করে। তাহলে কী হাতিদের অসাবধানতায় বাচ্চাটি পিছে পড়ে গেল? সালাম খান বললেন। সবাই খুব চিন্তিত।
না, সুস্থ বাচ্চাকে মা এবং দলের সব হাতি চোখে চোখে রাখে। অসুস্থ হয়ে পড়লেও সহজে ছেড়ে যায় না। অসুস্থ এবং হাঁটতে না পারলে তবেই ছেড়ে যাবে। ওয়াজিদ আলী বললেন।
কাপ্তাই থেকে চিড়িঙ্গাকে ডানে রাখে হাতিরা। তারপর ওরা সীতা পাহাড় ঘুরে ওয়াগ্গা চা বাগানে যায়। এই পথ তাদের বহু দিনের। এটি রাঙ্গুনিয়ার কুশইল্যামুড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। এই পথ ধরে যাওয়ার সময় হাতির পাল বাচ্চাটিকে ফেলে যায়। বনও এখন শেষ হয়ে যাচ্ছে। হাতিরা বারবার জায়গা বদল করছে। এ সময় বাচ্চাটি হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়ে থাকবে। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিল বাচ্চাটা। অথবা অন্য কী কারণ কে জানে!
চারদিকে খোঁজ পড়ল, কোথায় বাচ্চাসহ পোষা মা হাতি আছে। কাপ্তাই অফিসে একটি মা হাতি আছে বাচ্চাসহ। শুধু থাকলে তো হবে না। একটি বাচ্চা থাকতে আলগা একটিকে সে গ্রহণ করবে কি? বাচ্চাটাকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে। পর পর দুদিন প্রবল বৃষ্টির জন্য বাচ্চাটাকে নেওয়া গেল না। পোষা হাতি হলে না-হয় কথা ছিল। সেই দুদিন বাচ্চাটি বেশ ভিজল। ভিজে ঠাণ্ডা লাগল। ছোট বাচ্চা, তার ওপর আলগা দুধ খায়। বিট অফিসের বারান্দার টিনের চালের নিচে রাখা হলো। মা থাকলে বাচ্চারা বৃষ্টিতে মায়ের শরীরের নিচে আশ্রয় নেয়। মায়ের যত্নে ভালো থাকে। পরদিন লাইথুইয়া বিট অফিস থেকে একটি কুনকি হাতি আনা হলো। ওর বাচ্চা বড় হয়ে গেছে, বুকে দুধ নেই। তবুও হাতি এবং মা। তার আদর ও যত্নে যদি ভালো হয়ে যায়।
কুনকি হাতি যেদিন এল সেদিন বাচ্চাটির কী আনন্দ! ডাক্তার চন্দ্রমণি দেখে খুব খুশি। গরুর দুধের সঙ্গে চালবাটা মিশিয়ে খাওয়ানো চলল, শরীরে বল আসার জন্য। কিন্তু বাচ্চাটি দিন দিন কাহিল হয়ে যেতে লাগল। রোগা-পটকা হয়ে গেছে। মাহুত একদিন কুনকি ও বাচ্চাটিকে ছেড়ে দিল এবং কাছ থেকে নজর রাখল ওদের ওপর। তখন কুনকি দুর ছাই করে বাচ্চাটিকে নিয়ে বনে চলে গেল। পেছন পেছন মাহুতও চলল। বনের গাছপালা থেকে বেছে বেছে কিছু লতাপাতা খেতে দিল বাচ্চাটিকে। বাচ্চাটি পালক মায়ের আদেশমতো চিবিয়ে খেল। চন্দ্রমণি ডাক্তার বুঝতে পারলেন, বাচ্চাটি আসলেই অসুস্থ। তাকে মা ওষুধ খাওয়াচ্ছে।
ব্যস, পরদিন বাচ্চাটি অনেক সুস্থ। চন্দ্রমণি ডাক্তার ছাগলের দুধ জোগাড় করতে বললেন। কারণ ওতে শক্তি বেশি। কিন্তু ছাগলের অত দুধ পাবে কোথায়? বনকর্মীরা আশপাশের গ্রাম খুঁজে এক লিটার জোগাড় করল। দ্বিতীয় দিন দেড় লিটার। তাতে কি হয় অত বড় বাচ্চার। মা হাতি আরেকদিন নিয়ে গেল বাচ্চাকে। টলমল পায়ে হাঁটে। পিছিয়ে পড়ে। মা কাছে গিয়ে ডেকে নেয়। সেই একই লতাপাতা খাওয়াল খুঁজে খুঁজে। মাহুত সেগুলো চিনে রাখল। প্রতিদিন মাহুত সেগুলো এনে খাওয়াতে লাগল। ছাগলের দুধে বাদাম ও চালের গুঁড়ো মিশিয়ে দিতে লাগল। ওষুধ খেয়ে বাচ্চাটি সারা দিন খেলল।
সে দিন মায়ের সঙ্গে গিয়ে ছড়ায় গা ধুয়ে এল। বেশ গরমও পড়ছে। চন্দ্রমণি ডাক্তার সব লক্ষ্য রাখছেন। ওরস্যালাইন চলছে। রাঙামাটি থেকে জেলা বনকর্তা এসে দেখে গেছেন। নাম রেখে গেছেন কলি। ছানাকে নিয়ে ছড়ায় যাওয়ার সময় মায়ের সে কী উদ্বেগ! ছড়ায় নামার রাস্তা ভালো করে দেখে নিল। একটা মরা বড় ডাল পড়ে ছিল পথে। সেটা সরিয়ে দিল দূরে। মাহুতকে বলার সময় না দিয়ে কুনকি সব কাজ করে গেল ছানার জন্য। যেন নিজের সন্তান। কলি এগিয়ে গিয়ে মায়ের সঙ্গে হাত লাগাতে চায়। মা তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। ছড়ায় নেমে শুঁড় দিয়ে কলির গায়ে পানি ছিটিয়ে দেয়। কলিও তাই করে। স্বচ্ছ টলটলে জল। মায়ের হাঁটু ডুবে গেছে। ব্যস, অমনি লুটিয়ে পড়ল কলি। কাত হয়ে, মাথা ডুবিয়ে সে কী জলকেলি! মা ডাক ছেড়ে কী কী যেন বলল। অমনি কলি উঠে দাঁড়াল। পেট পুরে পানি খেল আবার। মাহুত নারকেলের ছিবড়া নিয়ে এসেছে। কলির গা ডলে দিল। কুনকির সারা গায়ে চামড়ায় খাঁজ পড়েছে। ওখানে পরজীবী পোকা হয়। হাতি এ জন্য গায়ে ধুলো-কাদা ছিটোয়। সব ধুয়ে দিল।
বনের লতাপাতা ওষুধ খেয়ে হোক বা কুনকির আদরে হোক, কলি ভালো হয়ে উঠল। চন্দ্রমণি ডাক্তার হস্তীশুঁড় ও ধুতুরার পাতা খাইয়েছে বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লাগার সময়।
এভাবে কলির তিন বছর বয়স হলো। এখনো সে বাচ্চা। তাহলেও তার রেহাই নেই। শুরু হয়ে গেল তার স্কুলে যাওয়া। কষ্টকর সেই ট্রেনিং স্কুল। ট্রেনিং শেষে তাকে নামতে হবে কাজে। পাহাড়-জঙ্গল থেকে কাটা গাছ টেনে আনতে হবে তাকে। তাই শুরু হয়ে গেল ট্রেনিং। তার গলায় দড়ি বেঁধে, পেছনের পা দুটো টেনে বেঁধে উবু করে শুইয়ে চলল ট্রেনিং নামক নির্যাতন। সামনেই তার পালক মা ও অন্য পাঁচটি শিক্ষিত হাতি। ট্রেনিংয়ের নামে এই নির্যাতনের নাম ‘হাদানি’। কলি চিৎকার করছে, কাঁপা কাঁপা গলায়।
পশু হলেও কলি তো শিশু। মায়ের আদর থেকে কাছছাড়া হতে চায় না সে। চিৎকার করে আঁ আঁ ডাক ছাড়ে। কিন্তু কোনোমতেই সে মায়ের কাছে ছুটে যেতে পারে না। তার হাত-পা যে বাঁধা। কলির মা যাতে কলির কষ্ট ও দুর্দশায় উত্তেজিত হয়ে সাংঘাতিক কিছু করে না বসে, সে জন্য শিক্ষিত পাঁচটি হাতি রাখা। আর কলিকেও বোঝানো হচ্ছে যে তার মা এই কাজে সায় দিচ্ছে। কী কষ্ট কলির! সামনের পা দুটিও টেনে খুঁটোর সঙ্গে বাঁধা। এভাবে তিন মাস কলির ট্রেনিং চলবে। জোর করে তাকে শেখানো হবে কঠিন সব কাজ। কঠিন কঠিন।
কলি যন্ত্রণায় কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকছে আঁ…আঁ…মা…মা…। মা, তুমি আমাকে বাঁচাও। মা, তুমি এত নিষ্ঠুর! মা, তুমি দেখতে পাও না! ও, তুমি আমার মা নও তাহলে! আমার মা কোথায় তাহলে! কোথায়! কোথায় মা!