মৃত্যুর ভাস্কর্য

রাজী বলল, পঙ্গু হওয়ার পর তাজুল স্বপ্ন দেখত সে পূর্ব জার্মানির হাসপাতালে শুয়ে আছে। সেবিকা মারিয়া রেমার্ক তার পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে, হাতের ব্যান্ডেজ ঠিক করে দিচ্ছে, ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছে আর বুকভরা ভালোবাসা দিয়ে তাকে আলিঙ্গনে বেঁধে রেখেছে প্রচণ্ড শীতের রাতে। ভালো হয়ে উঠেছে সে, এক পা সুস্থ ও সবল, শুধু বাঁ হাতখানা নেই। তাতে কী আসে-যায়, এক হাত ছাড়া পৃথিবীতে কিছু মানুষ অসাধারণ সব সৃষ্টিশীল কাজ করে যাচ্ছে। না-ই বা থাকল একখানা হাত, বুকটা তো আছে, হূিপণ্ড আছে তরতাজা সবল। চমত্কার কাজ করছে ফুসফুস, রক্ত সঞ্চালনতন্ত্র, যকৃৎ ও পরিপাকযন্ত্র। মারিয়া ভালোবাসা দিয়ে ভালো করে তুলেছে তার হতাশাগ্রস্ত হূদযন্ত্র। রাজী বলল, আসলে আমিই তার বুকে মলম মেখে দিচ্ছি। আহতদের সঙ্গে পাঁচটি বছর কাটানোর পর আর এক দিনও স্বপ্ন দেখেনি সে। কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে! তাজউদ্দীন নেই, বঙ্গবন্ধুও চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেছেন। আর স্বপ্ন কোথায়। শুধু কোথা থেকে এসে আমিই নাকি সব এলোমেলো করে দিয়েছি। তা না হয় হলো, বোন লারার ডাকে সাড়া দেয় না কেন! লারার সঙ্গে কিছুতেই দেখা করতে চায় না। বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলে ঢাকা দেওয়া পিঠেগুলো গলে যায়। খেজুরের রসে ভেজা পিঠে আরো রসসিক্ত হয়। ফিরেও তাকায় না তাজুল। অথচ কী প্রিয় ছিল ওই পিঠে! বোনের কান্না ঠিকই শুনতে পাচ্ছে, বুকের হাড় কাঁপছে তা-ও দেখতে পাচ্ছে দরজা দিয়ে, হূিপণ্ড ও ফুসফুসও নড়ছে সেই কান্নায়। তবু নীরব তাজুল। ডাকলাম—তাজু, চোখ খোলো, না খাও তো কথা বলো। লারার সঙ্গে অন্তত একবার কথা বলো। অভিমানে হত্যা দিয়ে পড়ে আছে বারান্দায়। ওকে তুমি বোন না-ই বা ভাবলে, দেশের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাপ্রেমী বোনের মতো হলেও কথা বলো। কেউ তোমার অটোগ্রাফ নেয়নি জানি, সে আজ তোমার স্বাক্ষর নিতে এসেছে মনে করো, খাতাটি দেখো, অন্তত প্রথম পাতায় সে তোমার সইটি অক্ষয় করে রাখতে চায়। দেশের কোনো ছেলে, কোনো মেয়ে কোনো আহত মুক্তিযোদ্ধার অটোগ্রাফ নেয় না বলে তোমার পৌরুষেয় অভিমান করে লাভ কী বলো! আমাদের মানসিকতা ওলটপালট হয়ে গেছে, আবার আমরা অতীতে ফিরে যাচ্ছি ভাবছ! মানুষ অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ায়, সেখান থেকে নক্ষত্রের দেশে পাড়ি দিয়ে ব্রহ্মাণ্ড জয় করে। দেশ থেকে দেশান্তরে যাওয়া মানুষের সাধনা। কিন্তু আমরা ক্রমে ক্রমে ঘরকুনো হচ্ছি; কুনো ব্যাঙের মতো, কুয়োর ব্যাঙের মতো, গুহার ছত্রাকের মতো, কার্নিশের জঞ্জালের মতো! হ্যাঁ, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছোট স্কুল-ছেলেমেয়েদের কোনো ঔত্সুক্য নেই। সেটা আমরা সৃষ্টি করতে পারিনি। প্রশ্ন করলে তারা জবাব দেবে কী! শিক্ষকরাও বা কতটুকু জানে বলছ? বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা? থাক সে কথা। তাজুল শোনেনি, লারা না-জানি কী অঘটন ঘটিয়ে বসে! কানে কানে বলছি শোনো, সে যদি আজ রাতে আত্মহত্যা করে বসে! সে যদি আর ঘরে ফিরে না যায়? সে যদি আজ তোমার বোন পরিচয় দিতে না পারে, তবে তার লজ্জা বা অভিমান রাখবে কোথায়? মাকে গিয়ে কী বলবে, পাড়া-পড়শিদের কী শোনাবে? বাড়ি ফিরে গেলে পাড়ার সবাই তাকে ঘিরে ধরবে। তোমার ছোট্ট গ্রামখানির জন্য লারার এই আসাটাই মস্ত বড় ঘটনা। লারার আসার সময় সবাই ওকে এগিয়ে দিয়েছে দুচোখ দিয়ে, ফেরার সময় তেমনি আবার চোখ মেলে ডেকে নেবে। গ্রামের চেয়ারম্যানকে তুমি যেমন পছন্দ করো না, গ্রামের মানুষরাও করে না। ওকে কেউ পাত্তা দেয় না। রিলিফ দেওয়ার সময় এলে চেয়ারম্যান তত্পর হয়। ওই কাজের বিনিময়ে খাদ্য দেওয়া তো? ছিটেফোঁটা গম বিলাবে। সব তো আর গায়েব করতে পারবে না, কিছু কিছু জনগণকে বিলিয়ে দিতেই হয়। ওই দেওয়াটুকু তার মূলধন, ওইটুকু দেখিয়ে সে ভবিষ্যতের রাস্তা মাপবে। আবার চেয়ারম্যান হতে চাইবে। ওর জন্য তুমি অত ভাবছ কেন। তাজুল, শোনো, তোমার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আসমা। আসমাকে আমি প্রতি ভোরে স্মরণ করি। সে আমার চোখ খুলে দিয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পত্নী সে, তার তেজ তো দেখোনি, আমিই বা কতটুকু জানি আর। লড়াই করে সে তার স্বামীর জমিজমা অধিকারে এনেছে। একা একা সে ঢাকায় আসে। আমার স্বামীকে সে বশ করেছে বলে ভয় পেয়েছিলাম। সেসব ছেলেমানুষির দিন এখন নেই। আমার দুই ছেলেমেয়ে তোমার কাছে আসতে চায়। লারাকে আপন করে নেবে ওরা। তুমি যদি আমাকে ভালোবাসা দিতে, তাহলে আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারতাম, আমার স্বামীকে বলতে পারতাম বড় গলায়, দেশবাসীকে পত্রিকায় চিঠি লিখে জানাতে পারতাম—একজন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ভালোবাসার মতো বড় কাজ আর কিছু নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রে তোমার মতো অনেকের কথা নেই তো কী হয়েছে! আমরা নতুন করে সাক্ষাত্কার নেব, আমাদের বংশধররা সংগ্রহ করবে। তবু একটা কাজের কাজ তো হয়েছে? যারা দায়িত্ব পালন করেনি, তাদের তো আমরা চিনতে পেরেছি। এর চেয়ে বেশি আর কী আশা করতে পারি! আমরা আসলে শত্রুর চক্রান্তের শিকার হয়ে ঘুরে মরছি, যার বিরুদ্ধে তাজউদ্দীন যুদ্ধ করেছেন, বঙ্গবন্ধু করেছেন; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এই রাজী—অর্থাৎ আমি কোথায় ছিলাম এত দিন? আসমা আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছে। একাত্তরের মার্চের কথা ভেবে দেখো, আমরা তখন শত্রুদের চিনেছিলাম, শত্রু তখন পরিষ্কার চেনা যেত। এখন শত্রুরা মিত্রের বেশে কাজ করছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের অলিতে-গলিতে তারা ঢুকে পড়েছে। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ করে তবে তাদের পরাজিত করতে হবে। তুমি এখন মুখ তোলো, চোখ খোলো, লারা আমাদের প্রাণের বন্ধু। বন্ধুকে চিনে নিতে ভুল কোরো না। তোমার মা অপেক্ষা করে আছেন, দাওয়ায় বসে তসবি নিয়ে তোমার মঙ্গল কামনা করছেন, আল্লাহ-রসুলকে স্মরণ করছেন। তোমার পাড়া-পড়শি তোমার খবরের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে, তোমার বোন লারা ফিরে গেলে ওরা তোমার সব কথা খুঁটে খুঁটে জিজ্ঞেস করবে। তুমি বলবে, পাশের কামরার আহত মুক্তিযোদ্ধাদের কেন দেখছি না? ওদেরও দেখি। ওরা তোমার মতো অভিমানী হয়ে পড়ে নেই।… সাব্বির বলেছে, তাজুল—অর্থাৎ তুমি বড্ড অভিমানী ও স্পর্শকাতর। যুদ্ধের সময়ও ওরকম ছিল। কিন্তু ওর সাহস আর বুদ্ধির তুলনা হয় না। সে ছিল আমাদের প্রাণ। পরাজয় আর হতাশা—শব্দ দুটি ওর অভিধানে ছিল না। দুজন আমাদের আহত হয়েছে? তাজুল একজনকে সারা পথ একা বয়ে এনেছে। যুদ্ধের প্রচণ্ড খাটুনির পরও তাজুল একটুও দমেনি। ক্যাম্পে তো আর নার্স নেই। একজন অনিয়মিত ডাক্তার আছেন। তাজুল সারা রাত দরকারমতো জেগে থাকত। পরদিন আবার যুদ্ধে যাওয়া, আবার ফিরে আসা, আবার মরণপণ খাটুনি—তাজুলের জুড়ি নেই। সাব্বির বা অন্য কাউকে সেবার জন্য রেখে, পরদিন অপারেশনে না গিয়ে ক্যাম্পে কোনো ছুতোয় পড়ে থাকবে—সে রকম অধম যোদ্ধা সে নয়। শত্রুর সামনে অস্ত্র নিয়ে সাহস ভরে এলোপাতাড়ি ছুটে যাবে অমন বোকাও নয় সে। তার গুণের তালিকা বাড়িয়ে এখন আর লাভ নেই, তাজুল হলো তাজুল। সে এখন ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটে, হুইলচেয়ারে চলে। আহত পাখানা চলার শক্তি খুইয়ে ফেলেছে। তবু সে অদম্য, দুরন্ত। তাজুল, ওঠো। লারা বারান্দার মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। ছাত্রাবস্থায় তুমি যেমন অনশন ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিলে, যেমন তুমি কাকে যেন ভালোবেসে তোমাদের গ্রামের জমির আলের ওপর সারা রাত বসে বসে কাটিয়ে দিয়েছিলে, যেমন করে মাছরাঙা অনেকক্ষণ শিকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে—বেচারি মাছরাঙা হয়তো জানেই না যে ও-পুকুর মাছশূন্য, ও-জলাশয় মাছহীন, ও-নদী মাছবিহীন। সেই তাজুল তুমি, ওঠো, দুহাত ঝেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াও। তোমার একটা হাত নেই। একটা পা অকেজো। বাঁ হাত ও ডান পা। মন শক্ত করো, তোমাকে আমি কাজ দেব। তুমি তো ইচ্ছা করলে সব শিখতে পারো। তোমার ডান হাত ভালো, তুমি উঠে বসতে পারো। তুমি হুইলচেয়ার থেকে একা একা উঠে অন্য চেয়ারে গিয়ে বসতে পারো। তুমি মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী, স্বাধীনতাসংগ্রাম, বীরত্বের গাথা রচনা করতে পারো। তোমার নিজের কথা, সহযোদ্ধাদের কাহিনী এবং দেশব্যাপী যে ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংস তুমি দেখেছ তা লিখতে পারো। তুমি তো নিজেই অসমসাহসী, মৃত্যুভয়হীন সংগ্রামী। আমাদের লাখো শহীদ, লাখো মা-বোনের দুঃখের কথা তুমি লিখবে। দলিল তৈরি করবে। স্বাধীনতাসংগ্রামের আরেক দলিল রচনা করবে তুমি। গল্প, উপন্যাস ও কবিতায় তুমি নিজেকে ব্যক্ত করতে পারো। আমাদের সমাজে এমন উৎসর্গপ্রাণ ও নিবেদিত লেখক নেই। হঠাৎ তাজুল বিছানায় অনড় পড়ে থাকার মধ্যে একটু কেঁপে উঠল। চোখ দুটি বন্ধ। চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু। ঠোঁট দুটি ঘনসংবদ্ধ। কাত হয়ে টান টান পড়ে থাকার মধ্যে কেঁপে উঠল। মুখটা গোঁজা বালিশে। কখন কাত হলো। কখন কাত হলে, এতক্ষণ তো তোমার মুখ দেখতে পাইনি। কবে তুমি পাশ ফিরলে! কী বললে তুমি? লারাকে ডাকব? তুমি তাজুল বলছ? লারা, লারা! লারা বা দিলারাকে ডাকল রাজী। গলা ফুটে শব্দ হলো না। আবার ডাকল, লারা, লারা? লারা দেখে যাও, তাজু তোমাকে ডাকছে, সে অভিমান ঝেড়ে ফেলেছে, তোমার প্রতি রাগ বা ক্ষোভ নেই। লারা…লারা…। তক্ষুনি তাজুল বুঝি মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে না করল। সত্যিই কি না করল? পাশের কক্ষ থেকে সাব্বির ছুটে এলো ক্রাচে ভর দিয়ে। তাজুলের কামরায় অন্য দুজন সঙ্গী বাইরে বা বারান্দায় বা অন্য কোনো কক্ষে ক্যারম বা তাস খেলছিল হয়তো বা। তারাও এলো, এ সময় নিয়মমাফিক প্রতিদিন আসে বলে। সাব্বির এলো হয়তো মনের কোণে গোপন সাড়া পেয়ে। সঙ্গী দুজনও এলো বোধ করি অন্তরের আগুনের টানে। তাহলে সহমর্মীদের মনে মনে অনেক কিছু স্বতঃস্ফূর্ত বলাবলি হয়ে যায়? হয়তো তা-ই, হয়তো তা-ই। রাজীর ডাক শুনে লারা আরো ভেঙে পড়ল। বারান্দায় এলিয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। না, দৌড় দেয়নি সে, ছুটে যাওয়ার কথা ভাবেনি। সে বুঝি সব শেষ হয়ে গেছে বুঝতে পারল! আর তাজুলের মা? জানি না। জানি না কবরে শুয়ে থাকা তাজুলের বাবা এই ঘটনায় পাশ ফিরে শুয়েছিলেন কি না! মা দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে চমকে উঠেছিলেন হয়তো। মা তো, মায়ের মনে সন্তানের অমঙ্গলবার্তা আপনা-আপনি চলে যায়। তাজউদ্দীনের মাটি হওয়া ঝাঁঝরা শরীর হঠাৎ কেঁপে উঠেছিল কি না কে জানে! বঙ্গবন্ধুর কথা একেবারে আলাদা। তাঁর প্রকাণ্ড সহিষ্ণু হূদয় প্রতিটি বিপত্পাতের সময় কেঁপে কেঁপে ওঠে, রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের সময় এখনো তাঁর প্রতিটি রোমকূপ কেঁপে ওঠে। তাহলে তাজুলের বোন লারা কি বুঝতে পারল সব শেষ হয়ে গেছে! লারার মা কি কাজের মাঝে হঠাৎ করে সব ফেলে পাথরের মতো ঠায় বসে পড়লেন, ঝড়ের শেষে প্রকৃতির মতো নিস্তব্ধ-নিঃসাড় হয়ে গেল, গুলিবিদ্ধ শীতের যাযাবর পাখির মতো আকাশ থেকে পাক খেয়ে খেয়ে হতভম্ব হয়ে লুটিয়ে পড়ল, যুদ্ধের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মতো স্টেনগান হাতে তেমনি শেষতম গুলিটিও প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় শত্রুর প্রতি ছুড়ে মারল? মানুষের জ্ঞানবুদ্ধির অতীত কোনো কোনো মুহূর্ত মানুষকে হতবাক করে দেয়, তাজউদ্দীন কি শেষ মুহূর্তেও খুন করতে আসা চেনা আততায়ীকে ‘ক্ষমা ক্ষমা’ উচ্চারণ করেছিলেন! কেন ক্ষমা করবেন? ক্ষমা করার দরকার ছিল কিছু? বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা কী মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করেছে? তাজউদ্দীন কি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর ঘটনার কোনো বিচার হবে না? জোহরা তাজউদ্দীনকে আগেভাগে কিছু বলে গিয়েছিলেন কি? নিজের ডায়েরিটা সযত্নে রেখে গিয়েছিলেন প্রিয়তমা সহযোদ্ধা পত্নীর জন্য, সেখানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তের সূত্র রেখে গেছেন কি? অথবা সব কথা স্পষ্ট ভাষায় স্পষ্ট করে পিথাগোরাসের উপপাদ্যের মতো লিখে গেছেন? সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শিকড় উন্মূলন করা অত সহজ নয়, তাঁরা বোধ হয় জানতেন। সাব্বির পাশে এসে দাঁড়াল। শেষ জীবনের আরো দুই সঙ্গী-বন্ধু সাদী ও নন্দী ক্রাচে খুটখুট শব্দ করে এসে ধপাস করে বসে পড়ল লোহার খাটে। খাটও সাড়া দিল ক্যাঁচক্যাঁচ কেঁদে কেঁদে, হাওয়ার ঝাপটা হঠাৎ এসে জানালায় আছড়ে পড়ে মাথা কুটল, আকাশে একখণ্ড মেঘ এসে বজ্রপাত করল, সারা শহরের মানুষ বাজ পড়ার বিশেষ শব্দ শুনে মুহূর্তের মধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল। শহরের গাড়িঘোড়াও থেমে গিয়েছিল, ট্রাফিক পুলিশ হাত নামাতে ভুলে গিয়েছিল, নাকি তার মৃত্যু হয়েছিল ভুলে গিয়েছিল আকাশের দিকে তাকাতে গিয়ে। ঘণ্টা বাজাতে ভুলে গিয়েছিল পাশের শিশু বিদ্যালয়ের দপ্তরি, রাস্তার অন্ধ ভিখিরি তাড়াতাড়ি ভিক্ষের টিনের থালাটা হাতে ধরে মওলা মওলা জপতে শুরু করেছিল কি না সে নিজেও জানতে পারল না। বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা সে জন্যই কি সেদিন এক ঘণ্টার পরও কিছু বেশি সময় কর্মবিরতি পালন করেছিল! ঠিক দশটায় গ্রিনিচ মান সময়ে ফরাসিরা উদ্জান বোমা ফাটিয়েছিল দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর, নাকি নাভাদার মরু অঞ্চলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল এ জন্যই। পাবলো নেরুদার মৃত্যু দিবস ছিল বুঝি সেদিন! মলয়সঁকে সেই মুহূর্তে একদিন ফাঁসি দিয়েছিল! লারা তবু উঠল না, বারান্দা থেকে উঠে ঘরে ঢুকল না, কাউকে কিছু না বলে যেখানে ছিল সেখানেই চিরায়ত পড়ে থাকল। সে বোবা হয়ে গেছে। বড় বড় চোখ দুটি দিয়ে কী যেন খুঁজল। গ্রামের শান্ত পুকুরপাড়ের ছোট্ট ঘরের দাওয়ায় বসা মায়ের কথা মনে পড়ল! এ-ঘর ও-ঘর সে-ঘর ছোটাছুটি করে বেড়ানোর দুর্ধর্ষ স্মৃতি, ভাই তাজুলের সঙ্গে যুদ্ধের আগে কাটানো উজ্জ্বল-নীল দিনগুলো, অথবা একটি ছোট্ট হলুদ পাখির কথা মনে পড়ল? দিলারা তাজুলকে একবার কষে কামড় দিয়েছিল, ওই দুষ্টুমি করেই, তাজুলের হাত কেটে দিয়েছিল, রক্ত ঝরেছিল ঝরঝর, গাঁদা ফুলগাছের পাতা কচলে লাগিয়ে দিয়ে রক্ত পড়া থামিয়েছিল। একবার দুজনে দৌড়ে ভিটের কোণে গিয়ে সাংঘাতিক বিপদে পড়েছিল। একটা জাতসাপের মুখে পড়ে তাজুলের কাহিল অবস্থা। তারপর একটা কচ্ছপের ডিমপাড়া দেখে দুজনের কী খুশি! একেবারে দিনদুপুরে কচ্ছপটা ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল, কী সুন্দর মায়াবী চোখ দুটি! মা এখন ঘরে কী করছে? লারা নাকি তাজুলের কথা ভাবছে? মায়ের কত কিছু করতে হয়, কত ভয় ও ভাবনা! মায়ের মন একেবারে অবুঝ। মা বারবার বলেছিল, দিলারা রে, তুই কি একা যেতে পারবি, তাজুলকে দেখে আসতে পারবি, যা না পিঠেটুকু নিয়ে, শীতের পিঠে বড় ভালোবাসে—বলতে বলতে মা কেঁদে ফেলেছিল। দিলারা বারান্দায় গড়িয়ে পড়ল। তাহলে সব শেষ? তাজুল ভাই নেই? আকাশে কি সূর্য নেই? চাঁদের কি আলো নেই! তারারা নিভে গেল! শেষবারের মতো তাজুল ঘনসংবদ্ধ ঠোঁট দুটি ফাঁক করে কিছু বলতে চেয়ে কি কাউকে ডেকেছিল? এখন চোখ দুটি বন্ধ। চোখের কোণে টলটলে জমাট অশ্রুবিন্দু। ঠোঁট দুটি এবার চেপে বসে আছে। কাত হয়ে টান টান পড়ে আছে। আগে মুখটা গোঁজা ছিল বালিশে। কখন কাত হয়ে গেল? লারা উঠল না, নাকি পারল না, ঘরে ঢুকল না, কিছু না বলে তেমনি পড়ে রইল। সে বোবা হয়েছে, বারান্দা থেকে গোল গোল বড় বড় চোখ দুটি দিয়ে তাজুলের মধ্যে কী যেন খুঁজল। প্রিয়তম ভাইকে, নিজের অসহায় অবস্থা দেখে নিজেকে! এক ভাইকে খুঁজতে খুঁজতে এক বোন একটুকরো জ্যোত্স্নার মতো বারান্দায় পড়ে রইল, অথবা নিজেই একটুকরো জ্যোত্স্না হয়ে গেল। পৃথিবীর যাবতীয় রূপ রস সুগন্ধ সুষমা ছেড়ে একটি লোহার খাটে তাজুল পড়ে রইল। সবাই এসে দেখল, তাজুলের শরীর আস্তে আস্তে বড় হতে হতে বিশাল হয়ে যাচ্ছে। ঠিক দেখা নয়, সবাই অনুভব করল—তাজুলের দুটি হাত, দুখানি পা, বিশাল বক্ষপঞ্জর, দীর্ঘ বাবরি কাটা চুল, চকচকে হরিৎ শরীর এবং আয়ত দুটি খোলা চোখ; ঠিক যেন বিশাল এক ভাস্কর্য এবং বারান্দায়ও পড়ে আছে জ্যোত্স্নার এক ভাস্কর্য—যেন এই মাত্র উন্মোচন করা হলো তাজুল ও লারার সেই ভাস্কর্য।