একজন আতঙ্কিত নাগরিকের নববর্ষ ভাবনা

d0494d7768ff86222681c91e1fe50897-5উফ্। ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪-এর পত্রিকাগুলো সামনে নিয়ে বসে আছি। সকালবেলা। শীতটা আরামপ্রদ, বাইরে রোদ্দুর, বারান্দায় চড়ুইপাখি কিচিরমিচির করছে। পত্রিকার ডান দিকের শিরোনাম—শুভ বড়দিন আজ। শান্তির বার্তা ও আশ্বাস নিয়ে আসা একটা দিন।
কিন্তু পত্রিকাজুড়ে সব নেতিবাচক খবর। একজন সাংসদের রক্তাক্ত ছবি। ছাত্রলীগের একজন সুদর্শন ক্যাডার হাতে তুলে নিয়েছেন, না, কলম নয়, বই নয়, একটা ছোট্ট আগ্নেয়াস্ত্র, হয়তো পিস্তল বা রিভলবার, গুলি ছুড়ছেন তিনি। তঁার লক্ষ্য বিএনপির নেতা-কর্মীরা, উপলক্ষ দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা। বিএনপির এক কর্মীকে রাস্তার বিভাজকের ওপরে ফেলে বেশ কজন সরকার–সমর্থক একযোগে পেটাচ্ছেন লাঠি দিয়ে, একজনকে পেটানো হচ্ছে মাটিতে ফেলে। প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার আরও চারটা খবর: বিমানে ৮৬৫ কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি, সাবেক মন্ত্রীর জামাতার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র। হিন্দু হোন, নয় ভারত ছাড়ুন। ৫ জানুয়ারি ঘিরে আগাম উত্তেজনা। সাংসদ এনামুলকেও দুদকের দায়মুক্তি।
শেষের পৃষ্ঠার চার খবর: মধুপুরে ট্রাক-টেম্পো মুখোমুখি, নিহত ১০। দুই ঘণ্টা অচল চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ বিপর্যয়। মিজৌরিতে পুলিশের গুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক নিহত, ঘুষ গ্রহণের কথা স্বীকার করলেন এফবিআই এজেন্ট। শেষের পৃষ্ঠায় আরও দুটো আইটেম আছে, শহীদ বুদ্ধিজীবী মীর আবদুল কাইয়ুমের পরিচিতি আর শুকতারায় ভাসমান শহরের কাল্পনিক ছবি।
ডিসেম্বরের শেষে এসে আমরা নতুন বছরের জন্য প্রস্তুতি নিই। বিগত দিনগুলোর হিসাব-নিকাশ করি। সামনের বছরটা শুভ হোক, কল্যাণময় হোক—এই আশায় নতুন করে বুক বাঁধি। জ্যোতিষীরা আগামী বছরটা কেমন যাবে ধরনের নিবন্ধ লেখেন, পত্রপত্রিকায় সেসব প্রকাশিতও হয়।
আজকের দিনে বাংলাদেশের মানুষের মনে শঙ্কা, আগামী বছরটা কি তাহলে খুব খারাপ যাবে?
২০১৩ সালের চেয়ে ২০১৪ সাল ভালো গেছে। ২০১৩ সাল গেছে ভয়াবহ। এত রক্ত, এত আগুন—বাসে আগুন, ট্রেনে আগুন, অফিসে-আদালতে আগুন—এমনকি ঘাটে ভেড়ানো লঞ্চে আগুন দেওয়া হয়েছিল। স্কুল-কলেজে আগুন, ঘরে-বাড়িতে আগুন। তখন হাসপাতালের বার্ন ইউনিট ছিল সবচেয়ে ব্যস্ত এলাকা, মাংসপোড়া গন্ধে বাতাস ছিল ভারী। তখন পরীক্ষা দিতে যাওয়া শিশুও শিকার হয়েছিল পেট্রলবোমা কিংবা আগুনের।
ওই আন্দোলনে ভয় ছিল, ভীতি ছিল, সহিংসতা-হিংস্রতা ছিল, শুধু কমে যেতে শুরু করেছিল মানুষের উপস্থিতি, একটা সময় সেটা পরিণত হলো মানুষের সংস্রববিহীন মূর্তিমান আতঙ্কে। সে এমনই ভয়ংকর যে আজও মানুষ আঁতকে ওঠে। আজ যখন খবরের কাগজে শিরোনাম হচ্ছে যে বিএনপির এবারের আন্দোলন বাঁচা-মরার আন্দোলন, তখনো যেকোনো মানুষ, তিনি যে দলেরই ভোটার হোন না কেন, প্রথমেই আঁতকে ওঠেন, এটা কি তাঁকেও বাঁচা-মরার দোলাচলে ফেলে দেবে, তাঁর এবং তাঁর নিকটজনের, পরিবারের সদস্যদের প্রতিদিন ফেলে দেবে এই পরীক্ষার মধ্যে—‘আরও একটা দিন বেঁচে গেলাম, কালকের দিনটা বাঁচব তো!’
নিজের নিরাপত্তার কথা, নিজের প্রিয়জনের কুশল নিয়ে সবাই ভাবেন সবার আগে। আজকে যদি একটা এমন ভোট হয়, যাতে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে, তাতে আওয়ামী লীগ ও তার জোট হেরে যেতে পারে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জরিপে বিএনপি ও তার জোট এগিয়ে ছিল স্পষ্টতই। এরপরে একটা জরিপ প্রকাশিত হয়েছে একটা ইংরেজি দৈনিকে, তাতে অবশ্য এই সরকারের অবস্থান উন্নততর হয়েছে বলেই প্রকাশ, তা সত্ত্বেও এ কথা বলা যাবে যে এই দেশে নির্বাচনে সর্বশেষ সরকারি দলের হারাটা মোটামুটি নিশ্চিতই ধরে নেওয়া যায়। এবং পাশাপাশি এ কথাও বলা যাবে যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ যে দলেরই সমর্থক বা ভোটার হোন না কেন, সবাই শান্তি চান। শািন্তর বিনিময়ে তাঁরা কোনো দলকেÿ ক্ষমতায় বসাতে কিংবা নামাতে চাইবেন, পরিস্থিতি সে রকম হয়েছে বলে মনে হয় না।
আর বিএনপি-জামায়াত ২০১৩ সালের আন্দোলনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারেনি বটে, কিন্তু একটা কাজ করতে পেরেছে, দেশের মানুষকে আন্দোলন-আতঙ্কে ভোগাতে পেরেছে। জলাতঙ্কের রোগী যেমন পানি দেখলে ভয় পায়—আমি একবার একজন জলাতঙ্কের রোগী দেখেছিলাম, তাঁকে বাথরুমের পানির শব্দ শোনানো হচ্ছিল, অমনি তিনি ভয়ে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন—দেশের বেশির ভাগ মানুষই এখন আন্দোলন শব্দটা শুনলেই ভয় পায়। তারা ভয়ার্ত হয়ে পড়ে, তারা দুঃস্বপ্নের মতো দেখতে পায় বোমা ফুটছে যত্রতত্র, আগুন জ্বলছে বাসে-ট্রেনে-টেম্পো-রিকশায়। আগুনে পুড়ে যাচ্ছে মানুষের চামড়া, মানুষের চুল, মানুষের চোখের পাতা, মানুষের নিরিবিলি শান্তিটুকুন। আগুন তো বিএনপি-আওয়ামী লীগ চেনে না, জামায়াত কিংবা জাসদকে আলাদা করতে পারে না। প্রিয়জন হারানোর বেদনা সবারই সমান, অশ্রুর রং কালো কিংবা সাদায় আলাদা হয় না।
আগামী বছরটা কেমন যাবে আমাদের? প্রথম আলোর গতকালের কাগজের প্রথম ও শেষের পৃষ্ঠার খবরগুলো থেকেই একটা আন্দাজ করা যায়। রাজপথে বিএনপি জোট ও আওয়ামী লীগ ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা করবে। আরও রক্তাক্ত মানুষের মুখ আর সশস্ত্র ক্যাডারের উঁচিয়ে ধরা বন্দুকের নলের ছবি আমাদের দেখতে হবে। আরও দুর্নীতি হবে, করবে ক্ষমতাবানের জামাতা, ভাগনে-ভাতিজা, পোষ্যপুত্ররা। দুদক আরও আরও সাংসদকে দায়মুক্তি দেবে। ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কুশীলবেরা আরও সক্রিয় ও সোচ্চার হবে, তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এসে পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে। আর এর মধ্যে থাকবে আমেরিকার ভূমিকার কথাও। ঘুষ গ্রহণের কথা স্বীকার করলেন এফবিআই এজেন্ট, ওই খবরটার মর্ম হলো, বাংলাদেশের একজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার জন্য একজন প্রবাসী বিএনপির নেতা ঘুষ দিয়েছিলেন একজন এফবিআই এজেন্টকে। সত্যি, বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে যে দুর্যোগের ঘনঘটা, তাতে বাইরের সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হলো, ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ দেশের সম্পর্ক ও তাদের ভূমিকা।
বাংলাদেশ–যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক ভারসাম্যমূলক নয়, একতরফা; বাংলাদেশ রপ্তানি করে, যুক্তরাষ্ট্র আমদানি করে। রাজনৈতিক বিবেচনা যদি না–ও থাকে, বাণিজ্যিক বিবেচনা অবশ্যই থাকতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নির্ধারণের সময়। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে থাকুক, বাইরের কোনো চাপে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নতি স্বীকার না করুক, তা যেমন কাম্য, তেমনি কূটনৈতিক সম্পর্ক কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হওয়া উচিত। আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনাকে সুন্দর করে বিদায় দেওয়াটাই হয়তো পরিপক্বতার পরিচয় হতো। কিংবা কূটনৈতিক স্পর্শকাতর বিষয়ে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরেরই বা দরকার কী! অতিথিকে ‘দুই আনা’র মন্ত্রী বলে পরিহাসের কোনো দরকার ছিল বলে মনে হয় না। তেমনি আমেরিকার একজন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে চান, এমনকি প্রেসিডেন্ট হয়েও যেতে পারেন, তাঁর সম্পর্কে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কূটনৈতিক রাখঢাক ছাড়াই মন্তব্য করা বুদ্ধিমানের কাজ কি না, সেটা অবশ্যই বিবেচনা করে দেখা উচিত।
অন্যদিকে আছে জঙ্গি প্রসঙ্গ। জঙ্গিরা কী করতে পারে, পাকিস্তানে তা দেখে আমাদের কলজে ঠান্ডা হয়ে গেছে। ভারতেও তারা তৎপর। মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে অশািন্তর আগুন। বাংলাদেশে আমরা কি প্রস্তুত? এটা শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রস্তুতির প্রশ্ন নয়; সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক—সব দিক থেকেই একটা সার্বিক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হওয়া উচিত। আমাদের তরুণ-কিশোরদের বিশাল অংশ মাদ্রাসায় পড়ছে, তারা আসে নিম্নবিত্ত শ্রেণি থেকে, তারা সংখ্যায় অনেক, তাদের সমাজের মূলধারায় জীবন ও জীবিকা গড়ার সুযোগ তো আমাদের দিতে হবে।
তাহলে বছর শেষে হিসাব কষে আমরা কী বলব? নতুন বছরটা কেমন যাবে? কাওসার আহমেদ চৌধুরী কিংবা মহাজাতক কী বলবেন?
২০১৩ সাল থেকে যখন ২০১৪ আসে, তখন কারও পক্ষে এ কথা বলা কঠিন ছিল যে ২০১৪ তুলনামূলকভাবে ভালোই যাবে। যদিও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তবু মোটের ওপর একটা শান্তিপূর্ণ বছরই আমরা পার করেছি। ২০১৪-এর শেষে এসে বলা মুশকিল যে ২০১৫ ভালো যাবে।
কিন্তু ভালোর আশাই তো আমাদের করে যেতে হবে। আমরা যারা সাধারণ নাগরিক, যারা সরকারে নেই, যারা সমালোচনা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না, তারা তো কেবল আশাতেই বুক বাঁধতে পারি। সংসার সাগরে সুখ-দুঃখ তরঙ্গের খেলা, আশা তার একমাত্র ভেলা। কিন্তু যাঁরা আমাদের ভালো-মন্দের ভাগ্যনিয়ন্তা, তাঁরা তো কেবল আশার ভেলায় উঠবেন না, তাঁদের কাজ করতে হবে ভালোকে আনার জন্য।
সরকার যদি ভালো ভালো কাজ করে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেয়, বিরোধী মতকে দলিত না করে, মানবাধিকার লুণ্ঠিত হতে না দেয়, নিজেদের দল, অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিরস্ত্র ও নিরস্ত করে, তাহলে সুসময় আসার পথটা প্রশস্ত হয়। কিন্তু ২০১৪-এর শেষের দিকটা জানাচ্ছে বিপরীত সংকেত। সরকার তার ক্যাডারদের রাস্তায় নামাবে, বিরোধী বড় নেতাদের ‘নেড়ি কুত্তা’র মতো পেটানোর প্রয়াস চলবে, রাঘববোয়ালেরা দুর্নীতি করেই যাবে, এর মধ্যে মহামানবদের শান্তির বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস! আর বিএনপি জোটকে বলব, বাঁচা-মরার আন্দোলন নয়, বাঁচার আন্দোলন করুন, আন্দোলন চাই শান্তির জন্য, মানবাধিকারের জন্য, সুশাসনের জন্য, মরা ও মারার জন্য নয়, জীবনের জন্য, সুখের জন্য, সমৃদ্ধির জন্য, স্বস্তি ও নিরাপত্তার জন্য।
আমাদের আস্থা রাখতে হবে আলোকিত ভবিষ্যতে, ‘দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে’। বারবার করে বলতে হবে নাজিম হিকমতের কবিতা, যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর তা আজও আমরা দেখিনি, আমাদের সব থেকে সুন্দর শিশু আজও বেড়ে ওঠেনি, মধুরতম যে কথা আমি বলতে চাই, তা আজও বলিনি… আমাদের সব থেকে সুন্দর দিনগুলো আজও আমরা পাইনি, কিন্তু একদিন পাব।
আমাদের ধর্মের বাণী, অতীতের চেয়ে নিশ্চয় ভালো হবে রে ভবিষ্যৎ।
২০১৪-এর চেয়ে ২০১৫ ভালো হোক, শুভ হোক। শুভ নববর্ষ।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আনিসুল হক- র আরো পোষ্ট দেখুন