সাহিত্যের রাষ্ট্রবিরোধিতা

কবিতা না লিখলেও প্লেটো যে একজন কবি ছিলেন তা তাঁর গদ্য রচনার পরতে পরতে প্রমাণিত। উপমায়, রূপকে, শব্দচয়নে ওই দার্শনিক তাঁর অন্তর্গত কবির কল্পনা ও সৌন্দর্যবৃদ্ধি উভয়কেই ব্যবহার করে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে কবিতার গুণ ও আবেদন তিনি যে জানতেন তাতে সন্দেহ করার অবকাশ নেই। কিন্তু তিনি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের জন্য কোনো জায়গা রাখেননি। জায়গা রাখবেন কি, নির্দেশ দিয়েছেন তাঁদেরও বের করে দেওয়ার জন্য। কবিদের সম্মান দেওয়া হবে, মালা ও সুগন্ধি দিয়ে তাঁদের সজ্জিত করা যাবে, কিন্তু তাঁদের সবিনয়ে বলতে হবে : মহাশয়বৃন্দ, আপনাদের জন্য আমাদের রাষ্ট্রে কোনো স্থান নেই।

কেন নেই? অভিযোগটা আপাতত এটা যে, তাঁরা মিথ্যা কথা বলেন। কিন্তু তার গভীরে আরো একটা ব্যাপার রয়েছে। সেটা এই যে কবিরা রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলাকে বিপন্ন করেন। প্লেটোর ‘সাম্যবাদ’ ফ্যাসিস্ট ধরনের অর্থাৎ শ্রেণিবিভাজনকে মেনে নিয়ে, তবেই সমান, বিভাজনের ভেতরে সমান, ভেঙে দিয়ে নয়। সে রাষ্ট্রে দার্শনিকরা শাসন করবে, সৈনিকরা করবে যুদ্ধ, শ্রমিকরা করবে উৎপাদন। এই বিভাজন কিছুতেই ভাঙা যাবে না। কাব্য তথা সাহিত্য যে গ্রহণযোগ্য নয় তার মূল কারণটা নিহিত রয়েছে না-ভাঙার এই রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারেই।

সাহিত্য কী করে? সাহিত্য মানুষের আবেগ জাগিয়ে দেয়। মানুষকে সংবেদনশীল করে, যার ফলে মানুষ বিভাজন ডিঙিয়ে যেতে চায়। দার্শনিক হয়তো শ্রমিকের দুঃখ দেখে কাতর হবে, শ্রমিক হয়তো চাইবে সে শাসক হবে, সৈনিক হয়তো ওপরে যেতে চাইবে কিংবা নিচে; তখন রাষ্ট্র ভেঙে পড়বে, তখন ‘ন্যায়’ বলে কিছু থাকবে না, অন্যায় ছেয়ে যাবে সব কিছুতে। প্লেটোর সে রাষ্ট্রের প্রধান কথা হলো নিরাপত্তা অক্ষুণ্ন রাখা, সেখানে তাই সাহিত্যের স্থান নেই। প্লেটোর রাষ্ট্রের জন্য সাহিত্য বিপজ্জনক, যেমন তা বিপজ্জনক ছিল হিটলারের রাষ্ট্রের জন্য।

রাষ্ট্রের অনেক কিছুই থাকে। সিপাহি, সান্ত্রি, আইন আদালত—সব কিছুই আছে তার। বিবেক নেই? হ্যাঁ, বিবেকও আছে বৈকি। সেই বিবেক হচ্ছে শাসকশ্রেণির স্বার্থ। ‘ন্যায়’ও তাই, শাসকশ্রেণির স্বার্থ। ওদিকে সাহিত্যের কাজটাই হলো মানুষের ভেতর যে বিবেকবান অর্থাৎ সংবেদনশীল মানুষটি থাকে, তাকে জাগিয়ে রাখা, তাকে সতেজ করা। সাহিত্য তাই শ্রেণিবিরোধী এবং সে কারণে রাষ্ট্রবিরোধী।

প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে আন্টিগনির যে গল্পটি আছে, সেটি একটি বিদ্রোহের কাহিনী। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তির বিদ্রোহ। শাসনের বিরুদ্ধে বিবেকের অভ্যুত্থান। অ্যান্টিগনি বলেছে, তার মৃত ভ্রাতাকে সে কবর দেবে। দেবেই দেবে। কেননা এটি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্র বলেছে দেওয়া যাবে না, কেননা লোকটি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহী। এই বিশেষ কারণে রাষ্ট্রের মুখপাত্রটি অন্য কেউ নয়, তিনি হচ্ছেন অ্যান্টিগনিরই আপন মামা, ক্রিয়ন। কিন্তু এখানে আত্মীয়তা কাজে দেয় না। রাজা বন্দি রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলে। অ্যান্টিগনি এগিয়ে গেল ভাইকে কবর দিতে, ক্রিয়ন বিদ্রোহী অ্যান্টিগনিকে আটক করে কবর দিয়ে দিল, জ্যান্ত। ক্রিয়নের ছেলে তার প্রেমিকা অ্যান্টিগনির কবরে গিয়ে মারা গেল কাঁদতে কাঁদতে। কিন্তু ক্রিয়নের কিছু করার ছিল না। রাজা হয়ে তিনি বন্দি। ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, রাজা তখন রাষ্ট্রের পক্ষে এবং ব্যক্তির বিরুদ্ধে, অতি অবশ্যই; নইলে তিনি রাজা কেন।

অ্যান্টিগনির মতো যারা বিবেকবান মানুষ, রাষ্ট্র তাদের ভয় করে। আর সাহিত্যের কাজই হচ্ছে সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে মানুষকে বিবেকবানে পরিণত করা। সাহিত্য আনন্দ দেয় এ আমরা জানি; সাহিত্য শিক্ষা দেয় এও আমরা মানি; তবু সাহিত্য বিনোদনের অনুষ্ঠান নয়। যেমন নয় সে পণ্ডিতের পাঠশালা; সাহিত্যে ওই দুয়েরই ভূমিকা থাকে, কেননা এরা উভয়েই সাহিত্যের মূল কর্তব্যের অংশ, যেটি হলো মানুষের হৃদয়কে সংবেদনশীল করা। সাহিত্যের শিক্ষা মস্তিষ্কের নয়, হৃদয়ের। হৃদয়বান মানুষেরাই বিবেকবান, যে জন্য হৃদয়কে রাষ্ট্রের বড় ভয়।

রাজনৈতিকভাবে শেকসপিয়ার ছিলেন রক্ষণশীল। তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু বড় শিল্পী ছিলেন বলেই শেকসপিয়ার বারবার তাঁর নাটকে দেখিয়েছিলেন রাষ্ট্র কী করে ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করে। রাজপুত্র হ্যামলেট একা লড়েছেন রাজার বিরুদ্ধে। কিন্তু রাজা একা নন, রাষ্ট্র আছে তাঁর আজ্ঞাবহ রূপে দাঁড়িয়ে। হ্যামলেট দেখেছেন একজন দুর্বৃত্ত যেহেতু বসে আছে সিংহাসনে, তাই সব কিছুই রওনা হয়েছে নষ্টের অভিমুখে। রাষ্ট্র বড়ই কঠিন প্রাণী।

দুই

তলস্তয় শেকসপিয়ারকে পছন্দ করতেন না। শেকসপিয়ার রাজা-বাদশাহদেরই গ্রহণ করেছেন পাত্র-পাত্রী হিসেবে, জনগণকে বিশেষ মর্যাদা দেননি। হ্যাঁ, শেকসপিয়ারের দেশপ্রেমও ছিল সংকীর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন তো চরিত্রের অবস্থান নয়, প্রশ্ন হচ্ছে চরিত্রের মানবিক পরিচয়। পোশাক কিংবা সামাজিক পরিচয় যা-ই হোক, শেকসপিয়ার দেখেছেন অন্তর্গত মানুষটিকে। সেই মানুষটি রাজা নন, রাজপুত্র নন, শুধুই একজন মানুষ। বিবেকবান রাজপুত্র হ্যামলেটের রাষ্ট্রও মিত্র নয়, শত্রু বটে। রাষ্ট্র তাকে হত্যা করার চেষ্টার কোনো অবধি রাখে না।

সাহিত্য দেশ মানে না। কাল মানে না। রাষ্ট্র মানে না। শুধু মানে না বললে যথেষ্ট বলা হবে না, সাহিত্য ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বটাকে তুলে ধরে। সাহিত্য স্থান ও কালবিরোধী যতটা নয়, রাষ্ট্রবিরোধী সে তুলনায় অনেক বেশি। তলস্তয়ের নিজের লেখায়ও রাষ্ট্রবিরোধিতা অত্যন্ত স্পষ্ট। স্বভাবতই। সেই অতিবৃহৎ উপন্যাস ‘যুদ্ধ ও শান্তি’তে তলস্তয় দেখাচ্ছেন যুদ্ধ ব্যাপারটা রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রেরই সংঘর্ষ আসলে, কিন্তু দুর্ভোগটা সাধারণ মানুষেরই। আর রাষ্ট্রনায়করাও সাধারণ মানুষই শেষ পর্যন্ত, যদিও তাঁরা ভান করতে ভালোবাসেন অসাধারণত্বের।

‘আন্না কারেনিনা’র নায়ক-নায়িকারা অধিকাংশই রাষ্ট্রের সেবক। আন্নার স্বামী মস্ত বড় আমলা, তার প্রেমিকা সেনাবাহিনীর অফিসার। আন্নার ভাইও বড় সরকারি কর্মচারী। ওই সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ভেতরেই আন্নার চলাফেরা, ওঠাবসা ও জীবনযাপন। অনেক দিক দিয়েই অসাধারণ এই মেয়ে; সৌন্দর্যে, ব্যক্তিত্বে, মেধায় ও আচরণে নিজের বৃত্তের সব মানুষকে ছাড়িয়ে ওঠে; বিশেষভাবে ব্যতিক্রমী হলো তার আন্তরিকতা। এই মানুষটিকে চরিতার্থতা দেওয়ার ক্ষমতা তার স্বামীর নেই, তার প্রেমিকেরও নেই। বেচারা আন্না বেশি বয়সী স্বামীকে ছেড়ে প্রায় সমবয়সী প্রেমিকের কাছে যায়, কিন্তু চরিতার্থতা না দিল তাকে তার আমলা স্বামী, না তার সৈনিক প্রেমিক। উভয়েই সামান্য তারা, রাষ্ট্রলালিত বুর্জোয়া স্বার্থপরতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণেই বিশেষভাবে। এ উপন্যাসে রাষ্ট্রবিরোধী রাজনৈতিক লোকেরাও রয়েছে, তারা ছায়া ছায়া, খুব প্রত্যক্ষ নয়। তারা নতুন ব্যবস্থার কথা ভাবে, কমিউনিজমের কথাও। মোট বিষয়টা দাঁড়ায় এই যে, প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যর্থ হয়ে গেছে, এটা ভেঙে পড়েছে। আন্নার মতো মানুষদের পক্ষে এখানে তাই আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকছে না। তলস্তয়ের এ উপন্যাসে আসন্ন বিপ্লবের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। রেলগাড়ির নিচে মানুষের স্বপ্নগুলো ওভাবেই কেটে টুকরো টুকরো করবে, যদি বিপরীত কিছু না ঘটে।

এক অর্থে তলস্তয় রক্ষণশীল। তিনি রক্তপাত পছন্দ করতেন না, রাষ্ট্র বিপ্লবও নয়। কিন্তু তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে রুশ বিপ্লবকে এগিয়ে আনছিলেন তিনি বিদ্যমান রাষ্ট্রের অন্তঃসারশূন্যতা নিষ্ঠুরতাকে উন্মোচন করে দিয়ে। এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। হৃদয় দিয়ে বুঝেছেন এবং অন্যের হৃদয়ে সেই বুঝটাকে সংক্রমিত করে দিয়েছেন।

‘আন্না কারেনিনা’র পরের উপন্যাস ‘পুনরুজ্জীবন’। এতে রাষ্ট্রের মুখচ্ছবি আরো প্রত্যক্ষ। কাটিউসা মাসলোভা একজন নিরপরাধ কিশোরী। সামন্ত পরিবারের যুবক নেখলিউদভ তাকে নষ্ট করল। মাসলোভার সন্তান হবে, কিন্তু সন্তানের বাবা নেখলিউদভ তখন অনেক দূরে। সে তখন সেনাবাহিনীর নবীন অফিসার। মাসলোভা কাজ করে, দেহ বিক্রি করে, জেলও খাটে। সবই বাঁচার চেষ্টায়। আসামি হয়ে আদালতে এসেছে মাসলোভা। অদৃষ্টের কী কৌতুকবোধ, সেই বিচারে জুরিদের একজন হয়ে বসে আছে নেখলিউদভ। নেখলিউদভ চিনেছে ওই মেয়েকে। তার ভেতরে পাপের বোধ জেগেছে। সে চাইল মাসলোভাকে রক্ষা করবে। কিন্তু পারল না। বিচারে নির্বাসন হয়েছিল মাসলোভার। জেলটা মওকুফ করাল নেখলিউদভ, আমলাদের কাছে দেনদরবার করে। কিন্তু নির্বাসন বলবৎ রইল।

মাসলোভা চলেছে সাইবেরিয়ায়। নেখলিউদভ চলেছে পিছু পিছু। তার পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। সে প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। মাফ চাইবে। মাসলোভা রাজি হলে তাকে বিয়ে করবে। শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটা নেখলিউদভ করতে পারল মাসলোভার কাছে, সাইবেরিয়ায় গিয়ে। আশা করছিল মাসলোভা কালবিলম্ব করবে না সম্মত হতে। কিন্তু মাসলোভা ওই প্রস্তাবে সম্মত নয়। তার প্রত্যাখ্যানটা খুবই দৃঢ়। সে বলল, ‘বুঝেছি, সেবার আমার দেহটা ব্যবহার করেছ, এবার ব্যবহার করতে চাইছ আমার আত্মাটাকে। না, তা হবে না।’

আসলে মাসলোভারও পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। সেও আর আগের সেই পথহারা মেয়েটি নেই। পথের সন্ধান পেয়ে গেছে সে। সাইবেরিয়ায় তার সহবন্দিদের মধ্যে কয়েকজন ছিল রাজবন্দি। এরা অন্য ধরনের মানুষ। এরা সংযমী, মেধাবী, এরা বই পড়ে, একজনের থলের ভেতর দেখা যায় মার্কেসের ‘পুঁজি’ বইটি উঁকি দিচ্ছে। এদেরই একজন হচ্ছে সাইমনসন। তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে মাসলোভার। তারা ভালোবেসে ফেলেছে পরস্পরকে। তাদের বিয়ে হবে।

নেখলিউদভরা যতই যা করুক, তারা বন্দি বটে, রাষ্ট্রের বৃত্তের ভেতর আবদ্ধ। ওই বৃত্তে কারোরই মুক্তি নেই, না নেখলিউদভের, না মাসলোভার, না সাইমনসনের। বিশেষভাবে পীড়িত হবে মাসলোভারা। নেখলিউদভরা তাদের ব্যবহার করবে নিজেদের বিশেষ প্রয়োজনে। মানুষের মুক্তির জন্য নতুন ব্যবস্থা প্রয়োজন হবে, যে ব্যবস্থার পক্ষে সাইমনসনরা লড়বে। বলা বাহুল্য, ওদের মধ্যেই লেনিন ছিলেন, যাঁর সন্ধান তলস্তয় তখনো পাননি, ‘পুনরুজ্জীবন’ উপন্যাসটি যখন তিনি লিখে শেষ করেন, ১৮৯৯-এ।

তিন

আমাদের এই উপমহাদেশে সাহিত্যচর্চার সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব ছিল। ইংরেজ আমলে যেমন, পরেও তেমনি। ইংরেজের শাসনামলে মনে হয়েছিল, রাষ্ট্র বাংলা সাহিত্যকে বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। তা করছে বটে। বাংলা গদ্যের সৃষ্টি ইংরেজ আগমনের ফল, এ কথা ইতিহাসে লেখা আছে। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে অতটা এগিয়ে নিয়ে গেল তারাই বা কোথা থেকে আসত, ইংরেজ না এলে। ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তন না করলে, চাকরিবাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি করে না দিলে কে-ই বা পড়ত বাংলা সাহিত্য। সবই সত্য। কিন্তু বাঙালি যে ইংরেজির চর্চা না করে বাংলার চর্চা করল, এটা একটা রাষ্ট্রবিরোধিতা তো বটেই। সে মিশে গেল না। কেউ কেউ গেল। যারা ইংরেজ হতে চাইল। কিন্তু অত্যন্ত বড়মাপের অনেক মানুষ যে গেলেন না, তাঁরা যে মাতৃভাষার চর্চা করলেন, সেই ঘটনা তো দিচ্ছে বলে যে গ্রহণের অন্তরালে সুদৃঢ় একটা বর্জন রয়ে গেছে। মাইকেল মধুসূদন চলে গিয়েছিলেন, তিনি সাহেব হয়েছেন, মেমসাহেব বিয়ে করেছেন, ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়েছিলেন, ইংরেজিতেই লিখবেন ঠিক করেছিলেন; কিন্তু ওই যে ফিরে এলেন, হলেন বাঙালি লেখক, ওইখানেই তাঁর আসল বিদ্রোহ, ইংরেজ হওয়ার বিদ্রোহের চেয়ে যা অনেক গভীর।

রাষ্ট্রভাষা ছিল ইংরেজি। বাঙালি সে ভাষা চর্চা করেছে; কিন্তু সে ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেনি। না করে বাংলা ভাষাকেই বরং এগিয়ে নিয়ে গেছে। স্বাধীনতার দাবি সেই সাহিত্য এসেছে নানাভাবে, নানা সুরে। কিন্তু রাষ্ট্র ছিল অত্যন্ত প্রবল। তার ক্ষমতা ছিল অপরিমেয়। তার ক্ষতিকর দাপটকে যে অস্বীকার করা যাবে তা সম্ভব ছিল না। না, সাহিত্যও পারেনি। সাহিত্যের ক্ষতি হয়েছে দুটি। একটি সাম্প্রদায়িকতা, অপরটি শ্রেণিবিভাজন। বঙ্কিমচন্দ্রের দৃষ্টান্ত সহজেই আসে। তিনি অসামান্য ছিলেন যেমন ইহজাগতিকতায়, তেমনি স্বাধীনতাপ্রিয়তায়। স্বাধীনতার পক্ষে লিখতে গিয়ে তাঁর লেখার কথা ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে, কিন্তু তা লেখা সম্ভব ছিল না বলে ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরানী’তে শত্রু হিসেবে দাঁড় করালেন অনুপস্থিত মুসলমানকে। সাহিত্যে ওই যে সাম্প্রদায়িকতা প্রবেশ করল, ওই যে নদী ঘুরে গেল তার স্বাভাবিক ধারা থেকে ভিন্ন দিকে, তার প্রভাব পরবর্তীকালে অনেক ক্ষতির কারণ হয়েছে। বাঙালির জন্য। ১৯৪৭-এ এসে বঙ্গদেশ যে দুই টুকরো হলো তার প্রধান কারণ সাম্প্রদায়িকতা এবং সেই কারণকে সাহিত্য প্রতিহত করেনি, বরং পুষ্টই করেছে।

আর রইল শ্রেণি। ইংরেজের রাষ্ট্রে বিদ্যমান শ্রেণিবিভাজনকে আরো শক্ত করেছে। সাহিত্য তাকে ভাঙতে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়নি। সাহিত্য রয়ে গেছে বিত্তবান শ্রেণির সংস্কৃতি হিসেবে।

তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে আমরা বাংলা সাহিত্যের চর্চা করেছি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় নয়, রাষ্ট্রীয় বৈরিতার ভেতরে। হ্যাঁ, পুরস্কার ছিল, পত্রিকা ছিল, গণমাধ্যমে প্রচার পাওয়া যেত; কিন্তু মূল সত্যটা ছিল এই যে ওই রাষ্ট্র বাংলা ভাষাকে রাখতে চেয়েছিল উর্দুর নিচে। ঠিক যেমন ইংরেজরা চেয়েছিল ইংরেজিই হবে প্রধান, মোগলরা চেয়েছিল ফারসির প্রাধান্য, আর্যরা সংস্কৃতের, তেমনি পাকিস্তানিরা চাইল উর্দু হবে প্রধান, বাংলা দ্বিতীয়; বাংলা সেটা মানেনি।

কিন্তু সাহিত্যে রাষ্ট্রবিরোধিতা কতটা এসেছে বা আসেনি সে প্রশ্নটা থাকে। না, বেশি আসেনি। সাতচল্লিশের পরে আমাদের সাহিত্য ছিল কবিতাপ্রধান। আমাদের প্রধান কবিরা রাষ্ট্রের মহিমাকীর্তন করে অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন। সে ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে কোনো গ্লানি দেখা যায়নি। ফরাসি কিংবা রুশ বিপ্লবের পেছনে যেমন সাহিত্যের একটা ভূমিকা ছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পশ্চাদ্ভূমিতে তেমন কোনো সাহিত্যিক ঘটনা ঘটেনি।

রাষ্ট্রের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের ব্যাপারটিকে গভীর ও প্রবল করতে না পারা সাহিত্যের জন্য অবশ্যই একটা দুর্বলতা। সে দুর্বলতা সেদিনও ছিল; আজও রয়েছে। মানুষের জীবনের অচরিতার্থতা ও দুঃখকে (কেবল বৈষয়িক অর্থে নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক ও অনুভূতিগত অর্থেও) নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারেনি। সে জন্য তার স্তরটা রয়ে গেছে বিনোদনের। আর ওই স্তরে যেহেতু টেলিভিশন ও ভিডিও কাজ করছে আরো জোরেশোরে, সাহিত্য তাই নিজেকে ততটা প্রয়োজনীয় করে তুলতে পারছে না—যতটা প্রয়োজনীয় হওয়া তার নিজের জন্য তো বটেই, আমাদের সংস্কৃতির জন্যও প্রয়োজনীয়।

দেশের হালকা উপন্যাসের পাঠক আছে, গভীর সাহিত্যের পাঠক নেই—এই অভিযোগ রয়েছে। তা গভীর সাহিত্য তেমন একটা লেখা হচ্ছে কি?

তেমন সৃষ্টি কোথায় যেখানে চিন্তা, অনুভব, উপলব্ধি, কল্পনা এক হয়ে গভীরতা লাভ করেছে? যা বড়, যেমন দার্শনিকতায়, তেমনি নান্দনিকতায়?

রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির দ্বন্দ্বের জায়গাটিতে তাৎপর্যপূর্ণরূপে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হলে সাহিত্য সাফল্য আশা করতে পারে না। এ সত্য সব বড় লেখকের লেখায়ই পাচ্ছি আমরা। আমাদের সাহিত্যের একটা বড় দুর্বলতাও সেই ব্যর্থতায়ই নিহিত রয়েছে।

অনুলিখন : শ্যামল চন্দ্র নাথ