কার্তিক বিহুতে প্রেম

kartikমাস দুই হলো হরিণঘাটার বনের ধারে ছনের ছাউনির কুটিরে ডেরা গেড়েছে মাহবুব বিন আলসাফা তৈয়বুদ্দিন। আমেরিকা থেকে পড়ালেখা শেষ করে দেশে এসে বনের ধারের এই চাকরিটি জুটিয়েছে। বেসরকারি সংস্থার অফিস। বেশ দিন কাটছে। রাতারাতি ঢাকা শহরের চেনাজানা পরিবেশ থেকে অচেনা পরিবেশে ধাম করে চলে আসা জীবন নিয়ে বাজি ধরা মনে হয় না। বরং এই স্নিগ্ধতার ঘেরাটোপে বাস করার ইচ্ছা বহুদিনের জিইয়ে রাখা ধারণার ভেতরে ছিল। এই সময় মাহবুবের সুখের সময়। ও গুনগুনিয়ে গান গায়। আজ শুক্রবার। অফিস করতে হয়নি। সারা দিন নানা জায়গায় ঘুরেছে। বেশির ভাগ সময় খালি পায়ে। কখনো জোয়ারের জলে পা ডুবিয়ে, কখনো নদীর পাড়ে গজিয়ে ওঠা ঘাসের সবুজ শ্যামলিমার স্পর্শ নিয়ে। মাথার ওপর উড়ছে গাঙচিল। সাগরের মোহনা ছেড়ে উড়ে এসে বসে ওর ঘরের চালে কিংবা নুয়ে পড়া গাছের ডালে। সন্ধ্যা হলে ভিজিয়ে রাখা চিঁড়া-গুড় মাখিয়ে খেয়েছে। সঙ্গে বড় আকারের চম্পা কলা। পেট ভরে গেছে। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে ফেলা ওর অভ্যাস। তারপর ও হারিকেন জ্বালিয়ে বই পড়ে। বেশির ভাগই কবিতার বই। পছন্দের কবিকে আবিষ্কার করতে ওর আনন্দ বেশি। এই আনন্দ নিয়ে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের শেষ সীমানা ওর কাছে বিশাল একটি প্রান্তর হয়। সেখানে মানুষ নেই, শত শত গাছের ডালপালার বিস্তার আছে, সেটিই একজন কবির আসল জায়গা। শুধু কবিই যেতে পারে হাজার মাইলের রাস্তা পার হয়ে দিগন্তরেখায়, যেখানে নুয়ে আসে আকাশ। মাহবুব ঘরের চারদিকে তাকায়। বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে শত শত ঝিঁঝি পোকার শব্দ। রাত বাড়ছে। কিন্তু ওর ঘুম আসছে না। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দেওয়ার অভ্যাস ওর আছে। আজ বুঝি তেমন রাত ওর সামনে। ও হারিকেনের সলতে উসকে দেয়। বাইরে জোয়ারের শব্দ পাচ্ছে। জোয়ারের পানি ওর ঘরের কাছাকাছি আসে। দিনের বেলায় জোয়ার দেখে আনন্দ পায় ও। ভাটির টানে পানি সরে গেলে ঘাসের ফাঁকে আটকে থাকে চিংড়ি পোনা। লোকটি কেন এমন একটি জঙ্গুলে এলাকায় চাকরি করতে এসেছে তা তারা বুঝতে পারে না। নানা প্রশ্ন করে। ও এসব প্রশ্নে মজা পায়। সরাসরি উত্তর না দিয়ে ফান করে। সেসব উত্তর শুনে অনেকে হাসে। অনেকে গম্ভীর হয়ে থাকে। তাতে কিছু যায় আসে না মাহবুবের। ও নিজেকেই বলে, সবাইকে খুশি করার দায় আমার নেই। আমি তো কবিতার ছেলে। আমার দুঃখ নেই। সবই তো আনন্দ। এসব ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে আপন মনে হা হা করে হাসে। হাসি থামালে ওর মনে হয় নদীটা বাঁশি বাজাচ্ছে। নদীও কখনো মানুষ হয়। মানুষ হওয়া খুব সহজ। নিজের এই দার্শনিক চিন্তায় নিজেকে বেশ বিজ্ঞ মনে হয় মাহবুবের। মা সামনে থাকলে বলতেন, ছেলেটার পাগলামি চিন্তার শেষ নেই। ভাগ্যিস মা সামনে নেই। তিনি হরিণঘাটার এই প্রান্তিক এলাকায় এমন একটি কুঁড়েঘরে ছেলেকে থাকতে দেখলে কেঁদে বুক ভাসিয়ে বলতেন, আমার ছেলেটা পুরোই পাগল হয়ে গেছে। মাহবুব এমন একটি পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে হাঁফ ছাড়ে। জানে, মা কখনো এখানে আসবেন না। বাবাও না। ছোট ভাইটা আসলে আসতেও পারে। ও বেড়াতে ভালোবাসে। ভালোবাসে গান। গিটার বাজিয়ে গান গায়। গানের দল আছে ওর। সেই গানের সুর নিজের ভেতর নেওয়ার আগেই নদীর বাজানো বাঁশি ওকে মোহিত করে। দরজার কাছের খুটখুট শব্দে বুঝতে পারে কোনো ছোট প্রাণী এসে ঠাঁই নিয়েছে ওখানে। ঢুকতে চাচ্ছে ঘরে। দরজা বন্ধ দেখে খুটখুট ভাষায় বলছে, দরজা খোল বন্ধু। আমি তো জানি, তুমি এখনো ঘুমোওনি। মাহবুব আবার নিজের দার্শনিক চিন্তাকে সম্বল করে দরজা খোলে। হারিকেনের আলোয় দেখতে চায় কে এসেছে। কিন্তু কোথাও কোনো প্রাণী নেই। অন্ধকারে দৃষ্টি ফেলে রাখে! যেন কাউকে খুঁজছে। অন্ধকারে দেখা যায় না এমন বোধ ওর ভেতরে কাজ করে না। ও বিশ্বাস করে, অন্ধকারও ভিন্ন আলো। এই আলো সবাই দেখতে পায় না। এই আলো দেখার জন্য ভিন্ন দৃষ্টি লাগে। ও হারিকেনটি দরজার কাছে রেখে দেয়। নিজেকে বলে, আশপাশে কোথাও ফুলমেহের আছে। ঘাসের মধ্যে ওর বাঁকা পা নিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। ওর হাঁটতে কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে বসে পড়ে। যেদিন ও এসেছিল সেদিনই কুঁড়েঘরে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কেন এখানে এসেছ? তুমি কি হারিয়ে গেছ? কেউ তোমাকে চুরি করে এনে এই বনের মধ্যে ফেলে গেছে বুঝি? হা হা হাসিতে কুঁড়েঘর মাতিয়ে তুলেছিল মাহবুব। হাসতে হাসতে বলেছিল, শোন মেয়ে, আমি কেন এসেছি, আমি এসেছি পোকা খুঁজতে। পাখি দেখতে। হরিণের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে। তোমার হাত ধরে নদীর ধারে হেঁটে বেড়াতে। আমিও তোমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াব। আমাকে তোমার হাত ধরতে দেবে? বলেছি না, তোমার হাত ধরে নদীর ধারে ঘুরে বেড়াব। তখন আমি তোমাকে আমার গল্প বলব। গল্প? তোমার বয়স কত সোনাবান? নয় বৎসর। আমি যে ঠিকমতো হাঁটতে পারি না, সে জন্য স্কুলে যাই না। এক দিনও স্কুলে যাইনি। তোমার গল্পটা কী? আমার মা নেই। কোথায় যেন চলে গেছে। আমি জানি না। মাকে আমি এই নদীর ধারে খুঁজতে আসি। ঠিক আছে। এখন থেকে আমিও তোমার মাকে খুঁজব। ঠিক তো? মিথ্যে বলছ না তো? আমি তো মিথ্যে বলি না খুকুমণি। আমার নাম ফুলমেহের। বাহ্, সুন্দর নাম। কে রেখেছে তোমার নাম? আমার মা। মা ছাড়া আমার কেউ নেই। তোমার বাবা? বাবা আমাকে ভালোবাসে না। ভালোবাসে না? হ্যাঁ, একটুও ভালোবাসে না। বাসে, বাসে। তুমি বুঝতে পারো না। আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি। তোমার মতো ছোট না। আমি তো অনেক বড়। দেখ আমাকে। শুধু লম্বা হলে কি বড় হয়? বড় হতে অনেক কিছু শিখতে হয়। ঠিক আছে, আমি তোমার ছোট্ট ভাইয়া। ও হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার নাম কি ছোট ভাইয়া? মাহবুব বিন আলসাফা তৈয়বুদ্দিন। এত্ত বড় নাম? মা গো…। ফুলমেহের দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে রাখে। তোমাকে সবাই কী নামে ডাকে ভাইয়া? যার যা খুশি সেই নামে ডাকে। আমি কি একটা নাম বানাব? বানাও। যে নামে ডাকবে সে নামে আমি সাড়া দেব। ফুলমেহের হাসতে হাসতে বলে, তোমাকে আমি চিংড়িপোনা ডাকব। চিংড়িপোনা? হা হা করে হেসেছিল মাহবুব। হাসির চোটে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গিয়েছিল দাঁড়কাক কিংবা গাঙছিল। এখন কি ফুলমেহের বলছে, চিংড়িপোনা, তুমি কোথায়? আমার হাত ধরো ছোট ভাইয়া। হাঁটতে আমার কষ্ট হচ্ছে। না, কোথাও থেকে ফুলমেহেরের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে না। আসবেও না। অন্ধকার থেকে যে আলো আসে সেখানে ফুলমেহেররা থাকবে না। মাহবুব দৃষ্টি ফেরায় একবার দক্ষিণে একবার উত্তরে। হারিকেনটা নিয়ে ঘরে ঢোকার সময় কানের পাশ দিয়ে উড়ে যায় কোনো পোকা। যার চিত্রিত পাখায় হরিণঘাটার বুনো এলাকাই ফুটে থাকে, সেখানে আলাদা কোনো রং থাকে না কিংবা নকশা। নাকি ওর কানের পাশ দিয়ে উড়ে গেল প্রেমের স্মৃতি, পাখি হয়ে, পোকা হয়ে? নাকি নদীর বাঁশি হয়ে বাজছে? নাকি বাতাসের ছুটে যাওয়া হয়ে ওকে টেনে নিয়ে গেল সেই গুহায়, যেখানে কিন্নরীকুহুর সঙ্গে ওর প্রেমের স্মৃতি পাথুরে শক্ত দেয়ালে আটকে আছে। যন্ত্রণা ছাড়া সেই স্মৃতির আর কোনো অনুভব নেই। ঢাকায় থাকতে ওর মনে হতো, ও এক মৃত্যুকুঠুরিতে আছে। হরিণঘাটার জনপদের নদী, বন, সাগরের মোহনা ওকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন ফিরিয়ে দিয়েছে। এখানে এসে ও নতুন জীবনযাপনের সন্ধান করছে। মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে নিজেকে নতুন করে খুঁজে দেখছে। এখানে এসে তো ওর নতুন সময়ই পাওয়া হয়েছে—সে সময়ে মাঘ বিহু আছে—বিহু তো উৎসবেরই সেই দিন, যেখানে অনাবিল আনন্দের স্রোত মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। হরিণঘাটায় এসে ওর মনে হয়, বিহুর উৎসব দিয়ে জীবনের নানা সময়ের পর্বগুলো ভাগ করতে পারে। কিন্তু প্রেমের স্মৃতির সময়কে কোনো বিহুতে ফেলা যায় না। ওটা একটা নিদারুণ কাঁটা। সেই কৈশোরে মা-বাবার সঙ্গে আসামের গুয়াহাটিতে গিয়েছিল। কার্তিক বিহু দেখেছিল। কার্তিকের মঙ্গার সময়ও মানুষ উৎসবের আয়োজন করে। অভাবকে জয় করার উৎসব। তাহলে কি প্রেমের স্মৃতি ওর জীবনে কার্তিক বিহু? কষ্টকে জয় করার উৎসব? ঠিক। ও ঘন ঘন মাথা নাড়ে। শুনতে পায় জোয়ারের শব্দ। একটু পরে জোয়ার এসে ভরে যাবে এই খাল। সেই পানিতে ও পা ভেজাতে পারবে। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর আর পা ভেজানোর ইচ্ছা হয় না। হারিকেন নিয়ে ঘরে ঢোকে। দরজা বন্ধ করে। মনে হয়, কিন্নরীকুহু ওকে নিয়ে হাসছে। বলছে, তুমি নরমাল মানুষ না। তোমার নানা ধরনের পাগলামি আছে। তবে সেই পাগলামিতে মায়াবী সারল্য আছে। আমি তোমাকে ঠিক বুঝতে পারি না। তুমি এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলবে না। খবরদার। চেঁচিয়ে উঠেছিল মাহবুব। ঘুষি উঠিয়েছিল কিন্নরীর দিকে। কিন্নরী ভয় পেয়েছিল। ওর চেহারা বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। খানিক পরে ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। চিৎকার করে বলেছিল, পাগলের প্রেমে পড়ে নিজের আখের পুড়িয়েছি। মাহবুব বোকার মতো কিন্নরীকুহুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। কী যে হয় ওর। ধাম করে গুটিয়ে ফেলেছিল নিজেকে। রমনা পার্কের বড় গাছগুলোর পাতার ফাঁকে আকাশ দেখছিল। মনে হয়েছিল অনেক দিন আগে দেখা ঘন নীল চুটকি পাখিটি উড়ে যাচ্ছে। চমৎকার সুন্দর পাখিটি ওর খুব প্রিয়। ও নেট ঘেঁটে পাখিটি সম্পর্কে জেনেছিল। ওদের মধ্যে পুরুষ পাখিটি বেশি সুন্দর। যতক্ষণ সামনে থাকে ততক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হয়। নজর ফেরানো যায় না। ওর মগ্নতা দেখে খেপে উঠেছিল কিন্নরীকুহু। রমনা পার্কের খোলা জায়গায় চেঁচিয়ে বলেছিল, কী দেখছ? মাহবুব নির্বিকার উত্তর দিয়েছিল, পাখি। পাখি? কোথায় পাখি? মাহবুব একই ভঙ্গিতে বলেছিল, ওপরে তাকাও। কিন্নরীকুহু হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করে বলেছিল, ওপরেও কোনো পাখি নেই। বোগাস। প্রাণখোলা হাসিতে নিজেকে মাতিয়ে তুলেছিল মাহবুব। বলেছিল, তাহলে পাখিটি আমার মনের আকাশে উড়ছে। মনের আকাশে? কবিতা লিখবে নাকি? হা হা করে হেসেছিল কিন্নরীকুহু। ভয়ে আঁতকে উঠেছিল মাহবুব। প্রেমের সম্পর্ক হওয়ার পর থেকে কিন্নরীর এমন হাসি ও কখনো শোনেনি। আজ ওকে একদম অচেনা একজন লাগছে। ও অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল। কিন্নরীকুহু ভুরু উঁচিয়ে চোখ বাঁকিয়ে ঝাঁজালো কণ্ঠে বলেছিল, কী হলো, তোমার মুখ শুকিয়ে গেল কেন? আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। আমার মনে হচ্ছে, আমি কোনো মৃত্যুকুঠুরির দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। বোগাস। তোমার ডাক্তার দেখানো দরকার। কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট। না, না। আমি ডাক্তার দেখাব কেন? আমার তো কিছু হয়নি। তোমার কী হয়েছে তা তুমি বুঝবে না। বুঝব আমরা। তোমাকে আমার বোঝা হয়েছে হয়তো। আর কিছুদিন দেখব। তুমি দারুণ হ্যান্ডসাম। তোমার রূপে প্রেমে পড়েছিলাম। মাহবুব আবার নিজের ভেতর গুটিয়ে গিয়েছিল। বুঝেছিল, ওর বুকের ভেতরে পাখি ছাড়া কিছু নেই। আকাশ নেই, সূর্য নেই, মেঘ-বৃষ্টি নেই। চারদিক ধু-ধু প্রান্তর। কোথাও গাছপালা নেই। কিন্নরীকুহু জিজ্ঞেস করেছিল, কী হলো, কথা বলছ না কেন? আমি আমার পৃথিবীতে আছি। এখন আমি ঘুমাচ্ছি। পাখি ছাড়া আমার পৃথিবীতে আর কিছু নেই। কেউ না। আমি? আমি নেই? কিন্নরীকুহুর জিজ্ঞাসায় মাহবুবের অন্যমনস্ক জিজ্ঞাসা ছিল, তুমি কে? তোমাকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। পাচ্ছ না? কিন্নরী ওর মাথাটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে চেপে ধরে রেখে বলেছিল, এবার দেখতে পাচ্ছ? না, পাচ্ছি না। তুমি আমার কেউ না, কেউ না। তুমি আমার স্মৃতির খাঁচায় একটা মরা ইঁদুর। তুমি আমাকে ইঁদুর বললে? তেমনই তো লাগছে তোমাকে। সরে যাও, সরে যাও বলছি। নইলে আমি বাঘের মতো— দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে এক ধরনের হুংকার দিয়েছিল। দ্রুত পায়ে সরে গিয়েছিল কিন্নরী, পেছন ফিরে তাকায়নি। সেদিন রমনার গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ঘন নীল চুটকি পাখি অনেক খুঁজেছিল। দেখতে পায়নি। দেখেছিল নীলাভ আকাশ—পাখিশূন্য ও বিবর্ণ। এই মধ্যরাতে ও ঘরের চারদিকে তাকায়। ভাবে, ঘরের মধ্যে কোথাও পাখিটি আছে। চিৎপাত শুয়ে আছে। ডানা ঝাপটায় না। ডানা ঝাপটালে বুঝতে পারত কোথায় আছে। হারিকেন উঁচু করে চারদিকে খোঁজে। নেই কোথাও। ওর রাগ হয়। হারিকেনটা ছুড়ে মারে দরজার দিকে। ওটা ধপ করে জ্বলে উঠে নিভে যায়। কেরোসিন ছড়িয়ে পড়লে আগুন ধরে যেতে পারত, এমন ভাবনা ওর মাথায় কাজ করে না। ও চৌকির ওপর শুয়ে বুকে বালিশ আঁকড়ে ধরে। প্রবল শূন্যতায় ওর দম আটকে আসতে চায়। ও বিড়বিড় করে বলে, শব্দহীন কান্নায়, বাস্তবের ধাক্কায় আমার মৃত্যুর বুকে ঘুমাতে ইচ্ছা হলো। আমি একা, দারুণভাবে একা। ওর আর কিছু মনে থাকে না। ও ঘুমিয়ে যায়। স্বপ্নের ঘোরে মনে হয় ছোটবেলায় মা ওকে কচ্ছপ ডাকত। রাত হলে বলত, কচ্ছপের মতো গুটিসুটি মারা ছেলেটাকে নিয়ে আর পারি না। ও বলত, কচ্ছপ কী মা? মা হাঁ করে তাকিয়ে থেকে আঁচল দিয়ে চোখ মুছত। কচ্ছপ কি আমার লাট্টুর মতো? বনবন ঘোরে? মা মৃদু হেসে বলেছিল, না, কচ্ছপ বনবন ঘুরতে পারে না। বুঝেছি। আমার লাট্টু আমি ঘোরাই। লাট্টু আমার মতো ঘোরে। তুমি আমাকে লাট্টু ডেকো মা। আমি তোমার লাট্টু হব। মা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, লাট্টু? লাট্টু তো নিজে নিজে কিছু করতে পারে না। অন্যরা লাট্টু ঘোরায়। কচ্ছপ কি নিজে কিছু করতে পারে? পারে তো। গুটিগুটি পায়ে হাঁটে। আমিও কি গুটিগুটি পায়ে হাঁটি? হা হা করে হাসতে হাসতে ও চারদিক ভরিয়ে তুলেছিল। তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, কচ্ছপ আমার বন্ধু হবে। আমি কচ্ছপকে আমার মায়ের গল্প শোনাব। বলব, মা আমাকে বলেছে আমি তোমার মতো গুটিগুটি মারা ছেলে। বোকা। তোর কথা তো কচ্ছপ বুঝবে না। ওটা তোর নিজেকেই বলা হবে। আমি তো আমার সব কথা নিজেকেই বলি মা। আমি তোমাকেও বলি না। মায়ের চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। মায়ের দিকে কখনো সরাসরি তাকায় না মাহবুব। আজও ওর দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরানো। দেখতে পায় না মায়ের বিষণ্ন চেহারা। মা ভাবে, এই ছেলেটি মেয়ে দুটোর মতো না। ওদের চেয়ে একদম আলাদা। কেন ও এমন, সেটা মায়ের বুঝতে খুব কষ্ট হয়। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মাহবুব স্বপ্নের জাদুতে তলাতে থাকে। ওর মনে হয়, স্বপ্ন এক অলৌকিক জগৎ। ওই পথে হাঁটলে পথ ফুরোয় না। তখন আস্তে আস্তে হাঁটতে হয়। পা টিপে টিপে একটু একটু করে। এমন করে হাঁটলে মানুষ তো কচ্ছপই হবে। আমি কচ্ছপ, কচ্ছপ। ঘুমের মধ্যে চেঁচামেচি করে জেগে গেলে মনে হয়, বাইরে এখন নদীর ভাটির টান। যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। ও চোখ খোলে না, মাথা তোলে না। আচ্ছন্নের মতো পড়ে থাকে। মনে হয়, হরিণঘাটার এই বসবাসে ও আর একটি জীবন পেয়েছে। এখানে ওর নতুন জন্ম হয়েছে। ও এখন অন্য পৃথিবীর একজন, যার সামনে রঙের ছড়াছড়ি আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত। এখানে কিন্নরীকুহু নেই। আছে তার সঙ্গে প্রেমের স্মৃতি। সকালে যখন ঘুম ভাঙে দেখতে পায় চারদিকে ছড়িয়ে থাকা আলোর রশ্মি ওর বাঁশের বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকেছে। বেশ লাগছে দেখতে। কোথাও আলো গোলাকার হয়ে আছে, কোথাও লম্বা সুতোর মতো। কোথাও বাতাসের দোলায় চক্রাকারে ঘুরছে। ওর ভেতরে ইচ্ছার স্ফুরণ ঘটে। মনে হয় হাজার রকম ইচ্ছা ওর দিকে ছুটে আসছে। ও বুকের ভেতরের আনন্দ উপভোগ করে। বিছানায় উঠে বসে। নিজেকেই বলে, মৃত্যু আর বেঁচে থাকা একই রকম সুন্দর। বিছানায় বসে দুই হাত ওপরে ওঠায়। ফিজিওথেরাপি করে। অনেক দিনের প্র্যাকটিস। ডাক্তার শিখিয়ে দিয়েছিল কৈশোরে। মা ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। নানা কথার পরে ফিরে আসার সময় মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ছেলেটা কি আমার কচ্ছপই থাকবে, নাকি বানর হবে? ডাক্তার মৃদু হেসে বলেছিল, দেখা যাক। ও বানরের মতো লাফালাফি করুক, মাটিতে গাছে ঘরের ছাদে—এটাই আমার ইচ্ছা। ডাক্তার মৃদু স্বরে বলেছিল, মানুষের সব ইচ্ছা কি পূরণ হয়! ওর মা মুখ কালো করে ঘরে ফিরেছিল। ওর মনে হয়েছিল, ও বানর হতে চায় না। ওর কচ্ছপ থাকাই ভালো। ও বুঝতে পারেনি যে মা যত দিন বেঁচে ছিল, মায়ের খুব কষ্ট ছিল। এখন মা নেই। আছে তার স্মৃতি। এই স্মৃতি নিয়ে ওর কোনো কষ্ট নেই। ও হাসতে হাসতে ভাবে, মায়ের স্মৃতি ওর কাছে রঙ্গিলা বিহু। শুধু রং। আনন্দের রং। উৎসবের রং। হা হা করে হাসতে হাসতে বিছানা ছাড়ে ও। জানে, দরজা খুললে দেখতে পাবে দবিরকে। ঘরের সামনে বসে থাকার জন্য ও একটি কাঠের গুঁড়ি জোগাড় করেছে। ওখানেই বসে থাকে ও। দবির ওর অফিসের পিয়ন। আকারে অনেক ছোট বলে লোকে ওকে বামন ডাকে। বামন শব্দ শুনলে ও মন খারাপ করে। বলে, স্যার, ক্যান মোর এমন একটা জনম হইল? আমি তো কোনো গুনাহ করি নাই। তুমি আমার সামনে দরিয়া। আমি তোমাকে দরিয়া ডাকব। হাছা স্যার? হাছা ডাইকবেন? আল্লাহ রে, মোর কত ভাগ্য! স্যার, আল্লাহ আপনের হায়াতদারাজ করুক। তুমি কলাগাছ কেটে একটি ভেলা বানাও, দরিয়া। আমরা ভেলায় চড়ে সাগরে যাব। সত্যি স্যার? সত্যি যাইবেন? হ্যাঁ, যাব তো। যদি ভেলা ডুইবা যায়? গেলে যাবে। আমরা সাগরে ভেসে যাব। ভাসতে ভাসতে আমরা অন্য কোনো দেশে গিয়ে উঠব। নইলে সাগরের নিচে যে দুনিয়া আছে সেখানে বেড়িয়ে আসব। দবির কোনো ভাব প্রকাশ করতে পারেনি। মাহবুবের হাসির তোড়ে ভেসে গিয়েছিল ওর ভাবনা। হাঁ করে তাকিয়ে থেকে ভেবেছিল, মানুষটা কি জাদু জানে? দবিরের সঙ্গে ভাবনার জায়গাটি মনে রেখে ঘরের দরজা খোলার জন্য সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজায় সিটকিনি নেই। আছে কাঠের হুড়কো। এখানে আসার আগে এমন হুড়কো লাগানো কাঠের দরজা ও দেখেনি। হাত দিয়ে টানার সময় হেসে বলে, বেঁচে থাকো কাঠের হুড়কো। তুমি আমার নতুন জীবনের সঙ্গী। তুমি আমার কাছে জাদুর খেলনা। জাদু? শব্দটা ওকে অন্য জগতে নিয়ে যায়। শব্দটার সঙ্গে সঙ্গে ওর সামনে দবিরের মুখ ভেসে ওঠে। ভাবে, ও যদি জাদু জানত তাহলে দবিরের জীবনটা বদলে দিতে পারত। ওকে একটা হ্যান্ডসাম যুবক বানিয়ে দিত। তাহলে ও বলতে পারত না, স্যার, কনু মাইয়া মোর দিগে ভালা কইরা চায় না। পেরেমের কথাও কয় না। স্যার, মোর অপরাদ কী? অপরাধ! মাহবুবের ভাবনায় শব্দটি তোলপাড় তোলে। তাই তো, অপরাধ না করলে মানুষ শাস্তি পাবে কেন? মানুষের দুঃখের জায়গা এতভাবে তৈরি হবে কেন? মাহবুব দরজা খুললে দেখতে পায় দবির ঠিকই ওর গাছের গুঁড়ির ওপর বসে আছে। দড়ি দিয়ে বাঁধা একটি শূকরছানা। ওর পায়ের কাছে মাটিতে গড়াগড়ি করছে। মাহবুব অবাক হয়, খুশিও হয়। শূকরের এত ছোট বাচ্চা ও কখনো দেখেনি। দূর থেকেই বলে, এটা কোথায় পেলি রে দবির? জঙ্গল থন আনছি। ওর মা লগে আছিল না। আপনেরে তো কইছি স্যার যে এই বনে মেলা শুয়োর আছে। শুয়োরের বাইচ্চাডারে আপনের লাইগা ধরছি। ভালো কাজ করিসনি। ওকে মায়ের কাছ থেকে ধরে আনা ঠিক হয়নি। ওর মা কাঁদবে না? কানবে তো। হুগল মাই তো পোলাপানের লাইগা কান্দে। অহন কন, শুয়োরের বাইচ্চাডারে আপনে পাইলবেন? বলেছি না, শুয়োর বলবি না, বলবি শূকর। আর এটা হলো বাচ্চা শূকর। কিংবা শূকরছানা। কমু, কমু। অহন কন, বাইচ্চাডা আপনের পছন্দ হইছে? হ্যাঁ, হয়েছে। খুব সুন্দর বাচ্চা। কিন্তু আমি ওকে ভয় পাচ্ছি; যদি আমাকে কামড়ে দেয়। তাইলে ছাইড়া দিমু? দুপুরের আগে যখন গোসল করতে নামব তখন তুই আর আমি মিলে বনের ধারে ছেড়ে দেব। ওকে তো পাহারাও দিতে হবে, না রে? ও যদি ওর মাকে না পায়, তখন কী হবে? হেইডাই তো কতা। আপনেরে নাশতা বানাইয়া দেই। আপনের লাগি মুই কলা আনছি। আণ্ডা হেনদোও আনছি। তাই নাকি? তাহলে তো আজ আমার রাজভোগ হবে। যাই মুখ-হাত ধুয়ে আসি। মাহবুব দুই পা এগিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। বাচ্চাটা বাঁধা আছে তো দবির? হ, আছে। বাইনধা না রাইখলে ওইডা তো মোরে থুইয়া পলাইব। মাহবুব হেসে মাথা ঘুরিয়ে নেয়। দবিরকে ও খুব পছন্দ করে। দবির ওকে হরিণঘাটার অনেক গাছপালা, পশুপাখি চিনিয়েছে। বেশ লেগেছে ওর এমন করে জানতে। এখন লোকটি শুধু ওর অফিসের পিয়ন নয়। প্রতিদিনের সঙ্গী। আজ অফিস ছুটি। ছুটির দিন সকালবেলাই চলে আসে। নিজের বাড়ি থেকে এটা-ওটা নিয়ে আসে। নাশতার সময় দেয়, নয়তো অন্য সময়। মাঝে মাহবুব বলে, তুই আমার জন্য এত কিছু করিস কিন্তু আমি তো তোর জন্য কিচ্ছু করতে পারি না রে দবির। আপনেও মোর লাগি হক্কল কিছু করেন। মোর লগে দরদ দি কথা কন। এইডাই মোর কাছে মেলা কিছু। মানষে তো মোর লগে এমুন কইরা কথা কয় না স্যার। কথা বলতে বলতে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে দবির। বুকের ভেতর কেমন জানি অনুভূতি হয় মাহবুবের। মনে হয়, লোকটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু ও এতই ছোট যে জড়িয়ে ধরা আর হয় না ওর। তখন মন খারাপ লাগে। আজও তেমন অনুভূতি ওকে আচ্ছন্ন করে। ও রোজ যেখানে হাত-মুখ ধোয় আজও সেখানে এসে নদীর ধারে বসে। এখানে ম্যানগ্রোভ ছইলা গাছের সারি আছে। দুই হাতে পানি তুলে নিজের মুখে ঝাপটা দিলে শীতল প্রবাহ বয়ে যায় সবখানে। সমুদ্র মোহনা থেকে কলকল শব্দ ভেসে আসছে। সূর্য আলো ছড়িয়ে রেখেছে সমুদ্রের ওপর। চারদিকে সুবাতাসে। বুক ভরে শ্বাস টেনে নিজেকে ভরিয়ে দেয় ও। সামনে তাকালে আচমকা দেখতে পায় নদীর ওপারে বনের ধারে দাঁড়িয়ে আছে একটি বুনো শূকর। মনোযোগ দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বুক কেঁপে ওঠে। বাচ্চাটি কি এই শূকরের? হতে পারে। এখনই বাচ্চাটাকে ছেড়ে দেওয়ার সময়। ও হাতের পানি ঝারতে ঝারতে উঠে দাঁড়ানোর আগেই একটি পাকা ছইলা ফল টুপ করে ঝরে পড়ে। দবির ওকে এই ফল চিনিয়েছে। বলেছে, এই গাছের ফুল থেকে চমৎকার মধু হয়। এই ফুলের মধুর টেস্ট অন্য যেকোনো গাছের ফুলের মধুর চেয়ে অনেক বেশি ভালো। মাহবুব ফলটা তুলে নদীর পানিতে ধুয়ে নেয়। গ্রীষ্মকালে ছইলা ফুলে ছেয়ে যায় বন। ফলগুলো আতার মতো। ও ফলটা নাড়াচাড়া করতে করতে নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার সময় পেছনে তাকিয়ে দেখে যে শূকরটি ওর সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসছে। ও বুঝে যায়, এটাই বাচ্চাটির মা। ভাবে, ভালোই হয়েছে, মায়ের কাছেই ফিরতে পারবে বাচ্চাটি। ও খুশি হয়ে শিস বাজায়। শিসের শব্দ শুনে দবির বুঝে যায় যে ওর স্যার ঘরে ফিরছে। মানুষটি এখানে আসার পর থেকে ওর দিনগুলো অন্য রকম হয়েছে। এখন ওর বুকে কষ্টের ব্যথা কম। খুশির হাওয়া বেশি। ও একজন মানুষের মতো মানুষ পেয়েছে। হায় আল্লাহ, মানুষটা আমার জন্য বেঁচে থাকে যেন। একদিন ওর স্যার বলেছিল, দবির, আমাকে একটি কচ্ছপ ধরে দিবি? এখানে এসে আমার মনে হয়েছে আমি একটি কচ্ছপ পুষব। কচ্ছপ! ও গালে হাত দিয়ে ভেবেছিল। তারপর মাথা নেড়ে বলেছিল, মুই একডা কচ্ছপ খুঁইজা দেহুম। শুধু খোঁজা নয়। তোকে পেতে হবে রে দবির। আইচ্ছা দেহি। ওর কণ্ঠস্বর ম্লান শোনাচ্ছিল। মাহবুবের কানে ওর ম্লান কণ্ঠস্বর পৌঁছায়নি। মাহবুব ভেবেছিল, একটি কচ্ছপ ঘরে-বাইরে থাকলে ও বেশি করে মায়ের সান্নিধ্য পাবে। মাকে কাছে পাওয়ার মতো আনন্দ তো আর হয় না। ঘরে বসে দবির ওর স্যারের পায়ের শব্দ পায়। স্যার কেন কচ্ছপের কথা ভাবছে তা ওর মাথায় আসে না। ভাবে, মানুষটা পাগলা। পাগলা বলেই এমন আবোল-তাবোল শখ হয়। দবির আবার ভাবে, মানুষটা কখনো অন্য রকম হয়ে যায়। চোখের দিকে তাকানো যায় না। কোনদিকে তাকিয়ে থাকে বোঝা যায় না। কারো চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। সেই সময় দবিরের মনে হয় লোকটি অন্ধ। ও সামনের কিছুই দেখতে পায় না। তখন মাহবুব ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেতরে মুখ বাড়িয়ে বলে, শূকরছানাটার মা তোকে খুঁজছে রে দবির। খুঁজবে কেমুন কইরা? ওইডা কি মানুষ? আয় দেখবি। দেখলে বুঝবি। দবির পিঠা আর কলা টেবিলের ওপর রেখে এক লাফে দরজার কাছে আসে। ওই দেখ, খালের ওপারে তোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ও মা গো, মুই ক্যান বাইচ্চাডারে ধইরা মারে কষ্ট দেলাম। হায় আল্লাহ, হায় মাবুদ— দবির ওর ছোট পায়ে ছুট দিয়ে শূকরছানার গলার দড়ি ধরে ছুটতে শুরু করে। মাহবুবও দাঁড়িয়ে থাকে না। ওর পিছু পিছু যায়। দুজনে কাঠের ব্রিজের ওপর ওঠে। এই ব্রিজ খালের এপার-ওপারের সেতুবন্ধ। ওপারে বসতি নেই, শুধুই বন। তারপর আছে তিন নদীর মোহনা—বলেশ্বর, বিষখালি ও বুড়িশ্বর। দুজনেই দেখতে পায় মা-শূকর ব্রিজের গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি। গোঁ গোঁ শব্দ করছে। দবির ভয় পায়। মাহবুবকে জিজ্ঞেস করে, দড়িডা ছাইড়া দিমু? ছেড়ে দেওয়ার আগে দড়িটা গলা থেকে খুলতে হবে। নইলে এই দড়ি নিয়ে বনে ঢুকলে ছানাটার কষ্ট হবে। তাড়াতাড়ি কর। ওর মা ভীষণ রেগে আছে। কুইক। দবির গলা থেকে দড়ি খুলে ফেলে। ছানাটা লাফ দিয়ে নেমে যায়, নিচে মায়ের কাছে গিয়ে লাফালাফি করে। মা বনের ভেতরে ঢুকতে থাকলে ছানাটা পিছু নেয়। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়েই থাকে দুজন মানুষ। বনের দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় আড়াল হয়ে যায় দুই প্রাণী। বনের ওপর থেকে স্নিগ্ধ বাতাস এসে ছুঁয়ে যায় দুজনকে। পানির দিকে তাকালে দেখতে পায় জোয়ার আসছে। মাহবুব ডান হাত দবিরের মাথার ওপর রাখে। ও ঘাড় উঁচু করে ওর দিকে তাকায়। কিছু কইবেন স্যার? আমার মায়ের কথা খুব মনে হচ্ছে। আমার খুব কান্না পাচ্ছে দবির। ব্রিজের রেলিংয়ের ওপর মাথা রেখে মাহবুব ফুঁপিয়ে কাঁদে। দবির কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর মৃদুস্বরে ডাকে, স্যার। সাড়া দেয় না মাহবুব। দুই হাতে চোখের পানি মোছে। বাতাসের স্নিগ্ধতা আবার ওকে ছুঁয়ে গেলে ও ধীর পায়ে ব্রিজ থেকে নেমে আসে। বুকের ভেতর বড় করে শ্বাস টানে। মনে হয়, মায়ের স্মৃতির সবটুকু বুকের ভেতর স্নিগ্ধ বাতাস কিংবা কেওড়া ফুলের রং, জোয়ার-ভাটার টান, সমুদ্রের গভীরতা। এভাবেই তো বেঁচে থাকা। ওর পাশ দিয়ে ছুটে গিয়ে ছবির ঘরে ঢুকেছে। ডিম সিদ্ধ আর কলা কাঁসার থালায় করে বাইরে এনে ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছে। ও কাছে গেলে বলবে, স্যার, আমনে ওইহানে বয়েন। মাহবুব নিজেই দবিরের রাখা গাছের কাণ্ডের ওপর বসে। আবার বাতাসের স্নিগ্ধতা ওকে স্পর্শ করলে ও দুই হাত ওপরে তুলে ভাবে, মা তো ওর কাছেই আছে। বলে, বুঝেছি, তুমি আমার কপালে হাত রেখেছ মা গো। এখন তুমি আমাকে খিচুড়ি আর গরুর মাংস খেতে দেবে। বলবে, একটা চালও যেন থালায় না থাকে। চেঁছেপুঁছে শেষ করবি। সব খেলে কাটিভার আইসক্রিম দেব। ঠিক আছে? ও বাতাসের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ঠিক আছে মা। ঠিক আছে। মা গো, হরিণঘাটায় এসে আমি খুব ভালো আছি। স্যার। দবিরের দিকে মুখ ঘোরায় না মাহবুব। বুকের কাছে দুই হাত জড়ো করে রাখে। হাতের মুঠিতে বাতাস ধরা আছে—এমন একটা ভঙ্গি দেখতে পায় দবির। তার পরও ডাকে, স্যার। ডিম-কলা খেতে হবে তো, দে! এখানে এসে কাঁসার থালার খাবার খেতে আমার খুব মজা লাগছে। হাত বাড়িয়ে থালা নেয় মাহবুব। এই মুহূর্তে ওর সামনে আছে খাদ্য ও সংগীত! যাই, আমনের লাগি পানি আনি। মাহবুব জানে, কাঁসার গ্লাসে পানি আনবে দবির। এখানে আসার পরে ও নিজেই স্থানীয় বাজার থেকে কাঁসার থালা-বাটি-গ্লাস-চামচ কিনেছে। বাসনকোসনের নতুন কিছু হরিণঘাটায় ওর নতুন জীবনের আর একটি দিক। মায়ের সংসারে এসব ছিল না। দবির ঘর থেকে আসার আগেই ও দুটো ডিম আর দুটো কলা খেয়ে ফেলে শূন্য থালায় টুনটুন শব্দ করে। একটুক্ষণ বাজায়। বুঝতে পারে না যে দবির কাঁসার গ্লাসে জল ভরে ঘরে দাঁড়িয়ে টুনটুন শব্দ শুনছে। ভাবছে, লোকটার হাতে দোতারার সুর তো ভালোই বাজে। টুনটুন শব্দ থামাতেই পারে না মাহবুব। ভাবে, আজ অফিস ছুটি। ও সারা দিন নদীর ধারে হাঁটবে, বনের মাঝে ঘুরবে আর কাঁসার থালা বাজিয়ে টুনটুন শব্দ করে ভরে দেবে পুরো এলাকা। পাখিগুলো বলবে, তুই কে রে? তুই কি পাখি হতে চাস যে এমন ডাক ডাকছিস? তোর মাথা কি আজ কাঁসার থালা হয়েছে? নদীর মাছগুলো ভাববে, তুই কে রে? তুই কি মাছ হতে চাস যে এমন গান করছিস? নদীর স্রোতে তরঙ্গ তুলছিস? তোর কলজে কি আজ খুশির মজায় কাঁসার থালা হয়েছে? তাহলে চলে আয়, আমরা তোকে স্রোতে ভাসিয়ে সাগরে নিয়ে যাব। সাগরে ভেসে আকাশ দেখবি তুই। বনের পোকাগুলো ভাববে, তুই কে রে? তুই কি পোকা হতে চাস যে তোর বুকটা আজ কাঁসার থালা হয়েছে? তুই পোকার মতো শব্দ তুলে বন মাতিয়ে দিয়েছিস। তুই বনের ভেতরে আয়, আমরা তোকে নিয়ে ঝরাপাতার বাগান বানাব। ফুল ফুটবে। মৌমাছি আসবে। মধু বানাবে। তোকে আমরা মধুর হাঁড়ি উপহার দেব। ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে মাহবুব। স্যার। দবির ডাকে। ও মাহবুবের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। স্যার, আমনের পানি আনছি। মাহবুবের ঘোলাটে দৃষ্টি ওর মুখের ওপর গড়ায়। সরাসরি চোখে চোখ পড়ে না। আমনে পানি খান স্যার। পানি! মাহবুব সামনে তাকায়। চারদিকে কত পানি। এটা তো মাটি, পানি আর বনের জায়গা। এখানে বাস করলে মানুষ বেঁচে থাকার নানা অর্থ খুঁজে পায়। মাহবুব ওর দিকে না তাকিয়ে গ্লাসের জন্য হাত বাড়ায়। দবির কাঁসার গ্লাসটা ওর হাতে দিয়ে থালাটা নেয়। মাহবুব এক চুমুকে গ্লাসের পানি শেষ করে। দূরের টিউবওয়েল থেকে এই পানি নিয়ে আসে দবির। কলসিতে রাখা পানি চমৎকার ঠাণ্ডা হয়ে থাকে। এখানে আসার আগে মাহবুব কোনো দিন মাটির কলসির পানি খায়নি। চারদিকে এত কিছু আছে, আমি তার কিছুই জানতাম না। তোমার তো জানা শুরু হলো মাহবুব। আরো কত কিছু জানতে হবে। জানতে তোমার ভালো লাগছে না? লাগছে। আনন্দ পাচ্ছি। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। চারদিকে তাকিয়ে হা হা করে হাসে ও। কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দবির অবাক হয়। কিন্তু প্রশ্ন করে না। ও জানে, প্রশ্ন করে লাভ নেই। হাসি থামলে আস্তে করে বলে, স্যার, মুই তো বাজারে যামু। কী মাছ খাইবেন? মাছ? ভুরু কোঁচকায় মাহবুব। আঁশের ওপর লাল দাগ টানা পুঁটি মাছ পাওয়া যাবে? কইতে পারুম না। চল, তোর সঙ্গে আমিও বাজারে যাব। ঠিকই বলেছিস, বাজারে না গিয়ে মাছের খবর তুই কিভাবে জানবি। মাহবুব ঘরে ঢোকে। কাপড় বদলায়। মানিব্যাগ পকেটে ঢোকায়। ছুটির দিনে দবির ওর জন্য রান্না করে। কোনো দিন আসতে না পারলে ও বাজারের হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসে। নইলে চিঁড়া-গুড় তো থাকেই। বাজারে যেতে যেতে দবির পেছন ফিরে তাকায়। মৃদু স্বরে ডাকে, স্যার। অন্যমনস্ক মাহবুব জবাব দেয় না। দবিরের চেয়ে তার উচ্চতা বেশি হওয়ায় দবিরের ডাক ওর কানে গিয়েছে কি না, সেটিও প্রশ্ন। দবির সাড়া না পেয়ে আগে আগে যেতে থাকে। মন খারাপ করে দবির অনেক দূরে গিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। দেখতে পায় মাহবুব মেহগনি গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয় কোনো পাখি দেখছে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে এমনই করে। বুনো ফুল দেখলেও দাঁড়িয়ে যায়। দবির মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়। রাগ হয় ওর। আজও দূরে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসতে থাকে। নিজেকে সামলাতে কষ্ট হয়। মাহবুব হাত তুলে ইশারায় ডাকে দবিরকে। চেঁচিয়েও বলে, দবির, কাছে আয়। মেহগনি গাছের ডাল থেকে পাখিটা উড়ে গেলে পাশের ঝোপের একটি সাদা-গোলাপি রঙের ফুলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে এসে ওর এমন অভ্যাস হয়েছে। ও মনে করে এটা ওর দারুণ অভ্যাস। যে জীবন আগে দেখা হয়নি সে জীবন এখন দেখা হচ্ছে। বেশ তো আছে ও। এসবের পাশে কিন্নরীকুহু ওর জীবনে জিরো। দবির কাছে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, এই ফুলটার নাম কী রে? জানিস? জানমু না ক্যান। মুই তো এই হানেরই পোয়া। জন্ম এইহানে, মরমুও এইহানে। শুনলাম, তোর জনম-মরণের কাহিনী। এখন বল ফুলটার নাম কী? বন-ওকরা। ছোট্টকালে এই ফুলের লইগ্যা মুই পাগল ছেলাম। এহন নাই। এখন নাই ক্যান? এহন তো বাঁশি মোর লগে ঘুরে না। ওর বুঝি বিয়ে হয়ে গেছে? হ। পোলাপানের মাও অইছে। বাপের বাড়ি আসলে ফুল খুঁজতে আসে না? না। ও অহন মোরে দুই চোক্কে দেখতে পারে না। হা হা করে হাসে মাহবুব। হাসতে হাসতে বসে পড়ে পথের ধারে। দবিরের হাত ধরে টেনে বলে, তুইও বস। বাজারে যেতে হবে না। রাঁধুম না? না। হোটেলে গিয়ে খাব। তুইও খাবি আমার সঙ্গে। মুইও খামু? মাথা নাড়িয়ে হাসতে থাকে দবির। দুই হাতে তালিও বাজায়। মাহবুব ভুরু কুঁচকে ওর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে রাখে। এই প্রথম দবিরের বাসন চেহারা ওর কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। ইচ্ছা করে ঠ্যাং ধরে ঝুলিয়ে সাগরের মোহনায় ছুড়ে ফেলতে। যেন সাগরের তলে গিয়ে পড়ে থাকে। আর কোনো দিন উঠতে পারবে না ডাঙায়। ওর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে মাহবুব ধমকের সুরে বলে, আজকে এত খুশি হওয়ার কী হলো? তোকে সঙ্গে নিয়েই তো আমি হোটেলে ভাত খাই, যখন তুই আমার কাছে থাকিস। আইজ মুই আমনেরে বাঁশির কতা কইছি, হেইর লইগ্যা খুশি লাগতাছে। তুই তো বাঁশিকে পাসনি। হে তে কিছু অয় নাই। মোর ছোট্টবেলার কথা মনে অইলে বাঁশির লগে জোরে দৌড়াইতে দেহি। মোর মন খুশিতে ভইরে ওডে। বড়কালে বাঁশির লগে মোর বিয়া অইলে এই ছোট্টকাল হারাইয়া যাইত। ঠিক বলেছিস। মাহবুব বিষণ্ন কণ্ঠে বলে। ওর ছোটবেলায় কোনো বাঁশি ছিল না। জঙ্গলের বুনোফুল ছিল না। কারো হাত ধরে দৌড়ানো হয়নি। ও দবিরকে হিংসা করে। চড়চড়িয়ে রাগ বাড়ে। দুমদাম পিঠের ওপর ঘুষি মেরে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। মর, মর শালা! রাস্তার ঢালুতে গড়িয়ে যায় দবিরের ছোট শরীর। খানিকটুকু গড়িয়ে ও গাছের ঝোপে আটকে যায়। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, স্যার, স্যার, মুই কি দোষ কইরল্যাম? তোর দোষ আমার জীবন-মরণ শয়তান। তোর দোষ আমার ছোট্টকাল না থাকা শয়তান। তোর দোষ আমার জীবন ক্ষুদ্র করে দেওয়া। আমার সময়কে নষ্ট করা বান্দর। তুই ওই ঝোপের মধ্য থেকে উঠে দাঁড়া। আমি তাকিয়ে দেখব তোকে। তুই কোনো দিন তোর ছোটবেলার গল্প আমাকে শুনাবি না। আমাকে তোর সুখী চেহারা দেখাবি না। মাহবুবের এসব কথা দবির শুনতে পায় না। ওর স্যার কিছু একটা বলছে, এটুকুই ও বুঝতে পারে মাত্র। ও কোনো রকমে উঠে বসে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। হাত-পায়ের বিভিন্ন জায়গায় চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে। জ্বালা করছে। মাথায় ঘূর্ণি। ভাগ্যিস চোখে কোনো খোঁচা লাগেনি। তাহলে ও হয়তো কানা হয়ে যেত, এমন ভাবনা ওকে কাতর করে ফেলে। বুঝতে পারে না, যে লোকটাকে ও মানুষের মতো মানুষ ভাবত, সে আজ কেন এমন ইবলিশ হয়ে গেল? ওর ঠোঁটের কোণে ঘাসের কুচো লেগে আছে। তার পরও বিড়বিড়িয়ে বলে, ইবলিশ একটা। সুযোগ পেলে এই গালি দিয়ে লোকটার সামনে থেকে পালাবে ও। ছাড়বে না। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, লোকটা ওর দিকে দুই হাত বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে। ও খানিকটুকু কাছে যেতে বলে, কতটা ব্যথা পেয়েছিস রে? তোকে বাজারের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ও বিড়বিড়িয়ে বলে, ডাক্তার, ঢং দেহায়। দবির রাস্তার ওপরে উঠলে মাহবুব ওর হাত ধরে বলে, ব্যথা পেয়েছিস? হ, ম্যালা ব্যতা পাইছি। মুই তো লোয়া দিয়া তৈয়ার না। দবির নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় মাহবুবের হাত থেকে। হনহন করে সামনে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে মাহবুব দেখতে পায়, ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে। সুতোর মতো রেখা হয়ে গড়াচ্ছে। ওর খারাপ লাগে না। উল্টো আনন্দ পায়। ফেলে দিয়েছি বেশ করেছি। কেন ওর এমন একটি শৈশব থাকবে, যে শৈশব ওর নেই। ওর আর বাজারে যাওয়া হয় না। ফিরে যায় নিজের ঘরে। কিন্তু ঘরে ঢুকতে ইচ্ছা করে না। ওই শূন্য ঘরে ও একা একা কী করবে? আঙুল সক্রিয় হবে না যে দুই কলম লিখবে। কল্পনা উদাস হবে না যে ভর করবে কলমের সিসে। ও কবিতা লিখতে ভালোবাসে। ছোট ছোট লাইন দিয়ে সাজায় একটি কবিতা। ভালোবাসে কবিতা পড়তে। কিশোর বয়সে মা ওকে কবিতা পড়ে শোনাত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শিশু ভোলানাথ’ বইয়ের কবিতা। তাহলে কি আমার অন্য রকম শৈশব আছে? যেটা দবিরের নেই। হ্যাঁ, তাই তো। এই শৈশব দবিরের নেই। হুররে, পেয়েছি! নিজের শৈশব পেয়েছি! মাহবুব আনন্দ অনুভব করে দ্রুত হাঁটতে থাকে। এখন ভাটির সময়। খালের পানি বেশ নিচু দিয়ে বইছে। পাড় কাদায় ভরে আছে। এসবই প্রতিদিনের দেখা দৃশ্য। কিন্তু মাহবুবের দেখায় প্রতিদিনই নতুন কিছু চিত্র যোগ হয়। কখনো দেখতে পায় কাদার ভেতরে ছোট সাপ মাথা উঁচু করে আছে। ম্যানগ্রোভে ডুবে থাকা পুরোটায় উঁচিয়ে আছে একটুখানি, যেন ছোট ছোট কুচো চিংড়ি বানিয়ে রেখেছে এক বিশাল ক্যানভাস। তারই মাঝে খালের পাড়ের বনভূমি আর একটি দৃশ্যপট গড়ে তুলবে হরিণঘাটায়। বলবে, দেখ আমার ভিন্ন রূপ। কখনো দেখতে পায় শুকনো পাতায় জমে থাকা। মনে হয়, ওটা মানুষেরই স্তূপ। প্রবল ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এখানে এসে ঠাঁই নিয়েছে। গুটিসুটি পড়ে থেকে নিজেরাই নিজেদের বলছে, জাগো। এভাবেই দেখা হয় প্রতিদিনের পুরনোর মাঝে নতুন পৃথিবী। হরিণঘাটা একটি ছোট্ট ভূখণ্ড হওয়ার পরও নতুনের সংযোজনে রূপ বদলায়। পৃথিবীর পথে হেঁটে যাওয়ার সময় নতুন দৃশ্য দেখার আনন্দ কখনো সিগালের উড়ে যাওয়া। কিংবা লাল কাঁকড়ার ছুটোছুটি। নিজেকে ভাগ্যবান ভেবে গাছের গুঁড়ির ওপর বসলে মনে হয় কিন্নরীকুহু বলছে, এই পৃথিবী কি তোমার একলার? না তো। মোটেই আমার একলার নয়। আমি আজ আছি কাল নেই। তাহলে এত মগ্ন হয়ে যাও কেন? আমার অভ্যাস। নিজেকে অনবরত খুঁজতে থাকা। নাকি তোমার ব্রেন ঠিকমতো কাজ করে না? কি জানি, কেউ তো আমাকে এ কথা বলেনি। তুমি চারপাশের সবাইকে দেখে বোঝ না? ওরা কি তোমার মতো? নাকি তুমি ওদেরই মতো? এত কিছু বুঝি না। বুঝতেও চাই না। কিন্নরীকুহু চোখ বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, তোমার নিউরোলজি প্রবলেম আছে। তুমি মাইল্ড অটিস্টিক। মানে? কী বললে? জানি, তুমি বুঝতে পারবে না। ঘুষি মেরে তোমার মাথা উড়িয়ে দেব। পারবে। পালাই। তবে তুমি করবে না। তুমি তো ডিফরেন্টাল এবল। মাহবুব ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে তাকায়। কোথাও কেউ নেই। শুধু ঢেউয়ের শব্দ কিংবা খুদে পোকার ভালোবাসাবাসির ডানা ঝাপটানো। ও গাছের কাণ্ড থেকে উঠে দাঁড়ায়। হাঁটতে হাঁটতে সাগরের মোহনার কাছে আসে। ছেলেরা মাছ ধরছে। মাছ ধরার দৃশ্য ওকে মুগ্ধ করে। এটাও জীবনের নতুন দেখা, যে দেখার সঙ্গে ওর কোনো পরিচয় ছিল না। হরিণঘাটায় এসে এটা ওর নতুন পাওয়া। অনেকক্ষণ দেখার পর টের পায় যে ওর খিদে পেয়েছে। আজ বাজারের হোটেলে যেতে হবে খাওয়ার জন্য। দবির তো বাজার করতে পারেনি ওর জন্যই। মাঝে মাঝে ও জেলেদের কাছ থেকে মাছ কেনে। সেদিন ঘরে মাছ খাওয়ার উৎসব হয়। ফ্রিজ নেই। তাই মাছ রাখার উপায় নেই। একেক ধরনের মাছের একেক রকম রান্না করে। কিছু মাছ মাকে দিয়ে আসে। ওর মা রান্না করে রাখে। ভাটির সময় মাছ বেশি ওঠে। বিন্তি জালে নানা ধরনের মাছ ধরে জয়নুল মিয়া। মাঝে মাঝে বড় ট্যাংরা পেলে কয়েকটা মাহবুবকে দিয়ে যায়। টাকা দিতে চাইলে বলে, আজকে মাছ ধরা দেহেন। মোগরে ভালোবাসেন। দুই-চারডা মাছ আমনেরে খাইতে দিলে মুই না খাইয়া থাহুম না। মাহবুব হা হা করে হাসে। জেলেরা কান পেতে প্রাণঢালা হাসির শব্দ শোনে। আজ ওর কাছে-ধারে ওরা কেউ নেই। বেশ দূরে। ওদের আসতে আসতে হয়তো দুপুর গড়িয়ে যাবে। ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পায়, দবির আসছে। বেশ অনেকটা দূরে আছে এখনো। হাতে পলিথিনের ব্যাগ। মাহবুব দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়। বাসন লোকটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার জন্য ওর অনুতাপ হচ্ছে। কাছে গিয়ে বলে, তোর খিদে পেয়েছে রে দবির? ভাত খাবি? নূরালির হোটেলে কি আজ টাকি মাছের ভর্তা বানিয়েছে। মুই জানি না। হোডেলে যাই নাই। মুই কচ্ছুম ধরতে গেছলাম। এই লন। দবির পলিথিনের ব্যাগ এগিয়ে দেয়। ভেতরে নড়াচড়ার শব্দ। মাহবুব ব্যাগের মুখ ফাঁক করে দেখে। বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। শুঁড় ভেতরে টানা। মাহবুব ঘন ঘন শিস বাজায়। কিন্তু নিস্পন্দ কচ্ছপটির কোনো সাড়া নেই। ব্যাগটি নিজের হাতে নিয়ে ফুর্তিতে হাঁটতে হাঁটতে বলে, দবির রে, মা আমাকে ছোটবেলায় কচ্ছপ ডাকত। দবির একটু দূরে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ক্যান? কচ্ছপ ডাকত ক্যান? মায়ের খুশি। আমি কী করে জানব? কচ্ছপ মেলা বছর বাঁচে। আমনের মা আমনের হাজার বছরের আয়ু চাইছিল। তাই নাকি? বনের দিকে তাকিয়ে বলে, হতেও পারে। মায়েরাই তো সন্তানের আয়ু চায়। মায়েরাই তো বলে, বেঁচে থাকুক আমার সোনার ধন! ও দেখতে পায়, দবির ওর সামনে দিয়ে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই মনে হয় মাহবুবের, দবিরের মাও কি ছেলের হাজার বছরের আয়ু চেয়েছিল? এমন একটি ছেলে, যে শারীরিকভাবে বেড়ে উঠতে পারেনি? বয়স বেড়েছে, বুদ্ধি বেড়েছে—তারপর? মাহবুব ভেবে দেখে, হরিণঘাটায় এসে এটা ওর নতুন পাওয়া। ও এমন একজন বামন লোক আগে দেখেনি। তার কথা শোনেনি। অভিজ্ঞতার এমন পূর্ণতায় মাহবুবের বুক ভরে যায়। এমন অভিজ্ঞতা ওর পাওয়াই হবে—আরো অনেক অনেক অনেক। দবির ওর ঘর ছাড়িয়ে আরো সামনে চলে গেছে। ওর রাগ হয়তো ভাঙেনি। মাহবুব ঘরের বেড়ার সঙ্গে ব্যাগটা ঝুলিয়ে রেখে এগিয়ে যায়। মাটিতে রাখলে কচ্ছপটি বেরিয়ে যেতে পারে। একটি বাঁশের ঘের বানিয়ে ওটাকে রাখতে হবে। ও দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে দবিরের হাত ধরে। দবির ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নেয়। মাহবুব মৃদু স্বরে বলে, রাগিস না বাপ। ভুল করেছি। স্যার! দবিরের বিষণ্ন কণ্ঠ শুনতে পায় মাহবুব। মুই আমনের লগে পিয়ন হইছি কইয়া কি এমুন কইরা মাইর দিলেন! না রে বোকা, তোকে আমার হিংসা হয়েছে। হিংসা? মুই একডা বামন লোক। তুই জানিস না, তোকে হিংসা করার মতো স্মৃতি আছে তোর। হেইডা আবার কী? ও বিস্ময়ে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে। এত কিছু তোকে বোঝানো যাবে না। চল, ভাত খেয়ে নিই। খিদে পেয়েছে। মোর খিদা লাগে নাই। আয় তো। বেশি কথা ভালো লাগছে না। খাওয়া শেষ হলে আমি তোর জন্য একটা কচ্ছপ ধরব। তুই যেখান থেকে ধরেছিস, সেখান থেকে। ক্যান, মোর লাগি কচ্ছপ ধইরবেন ক্যান? কচ্ছপটা তুই পুষবি, সে জন্য। ক্যান? কচ্ছপ পুষমু ক্যান? তুই যে আয়ুর কথা বললি, তাহলে তোর হাজার বছরের আয়ু হবে। মুই আয়ু চাই না স্যার। মুই মরণ চাই। বোকা, আয় ভাত খাবি। দুজনে হোটেলে ঢোকে। ভাত আসে, তরকারি আসে। শুঁটকির ভর্তা আসে। করল্লা ভাজিও। মাহবুব মাছের ঝোলের বাটিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয়, শিং মাছ দুটো ঝোলের ভেতর ঘুমিয়ে আছে। প্রায়ই ও এমনই ভাবে। হোটেলের লোকটি কাছে এসে বলে, স্যার, খান। আপনি তো এমনই তরকারি পছন্দ করেন। ঘুমিয়ে থাকা মাছ খাব কী করে? লোকটি অবাক হয়ে বলে, ঘুমিয়ে থাকা? দেখতে পাচ্ছ না? ঝোলের মধ্যে কেমন শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। আকস্মিক হা হা হাসিতে হোটেলের ছোট ঘরটি ভরিয়ে তোলে মাহবুব। হাসতে হাসতে বলে, হরিণঘাটা একটি দারুণ জায়গা। এখানে নতুন নতুন কিছু শেখা হয়। দেখা হয়। এক চামচ ভাত দবিরের প্লেটে দেয়। নিজের প্লেটে এক চামচ নেয়। ওকে বলে, মাছ তুই খাবি। আমি ঘুমিয়ে থাকা মাছ খাই না। হোটেলের লোকটি টেবিলের কাছ থেকে সরে যেতে যেতে বলে, পাগল একটা। এমন মানুষ দেখিনি। তখন বনের দিক থেকে ভেসে আসে বাতাস। গাছের মাথা দুলতে থাকলে বুকের ভেতর থেকে ক্রন্দনের ধ্বনি শুনতে পায় মাহবুব। দুই কিন্নরীকুহু অফিসে খুব ব্যস্ত। এর মাঝে হঠাৎ হঠাৎ মাহবুবের কথা মনে হচ্ছে। মাহবুব ওর কাছে আসত। প্রেমের শুরুতে নামটি ও নিজেই দিয়েছিল। ওর মা ওকে কচ্ছপ ডাকত। ওর সামনেও ডেকেছে। বলেছে, আমার কচ্ছপ ছেলেটাকে তোমার ভালো লাগে দেখে আমি খুব খুশি মাগো। দোয়া করি, তোমরা সুখী হও। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কিন্নরীর কখনো মনে হয়নি যে ওর মা ওকে কচ্ছপ ডাকছে কেন? ওর জানার ইচ্ছাও হয়নি। নিজে নিজে ভেবেছে, কচ্ছপ কেন? কারণ কী? দীর্ঘ আয়ুর জন্য? নাকি কচ্ছপের মতো গুটিয়ে থাকা স্বভাবের জন্য? এক মুহূর্ত ভেবে আবার কাজে হাত লাগায় কিন্নরী। অটিস্টিক ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে ও। সময় কেমন করে কেটে যায়, তা টের পায় না। বিকেলে বা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলে ক্লান্তি ওকে পেয়ে বসে না। বরং এক ধরনের ভালো লাগায় আবিষ্ট থাকে। ঘরে কেউ নেই। একজন গৃহকর্মীও না। একলা জীবনযাপনে ওর এখনকার দিন কাটানো। পাশের ঘরে যারা থাকে, ওরা ওকে তেমন ডিস্টার্ব করে না। সে জন্য কিন্নরীর নিজস্ব আলয়ে বেড়া নেই। কাঁটাতার নেই। ফাঁকফোকর নেই। চোখ গলানোর কেউ নেই। বরিশাল শহর থেকে মাঝেমধ্যে ভাইবোন কেউ কেউ আসে। বেশি দিন থাকতে পারে না। এক ঘরের ভাড়া বাড়িতে অন্যদের স্বস্তিতে থাকার সুযোগ কম। আজ আর রান্নার দরকার নেই। ফ্রিজে গরুর মাংসের ভুনা আছে। ডাল আছে। চুলোয় ভাত বসিয়ে দিয়ে ফ্রিজ খুলে এক গ্লাস জুস খায় কিন্নরী। বড় করে শ্বাস টেনে বলে, এখন গান। পছন্দসই রবীন্দ্রসংগীতের সিডি প্লেয়ারে ঢোকায়। বেজে ওঠে গান—আমার মুক্তি আলোয় আলোয়— চুলের ভেতর দুহাত ঢুকিয়ে বলে, এবার স্নান। ওর দুবার স্নান চাই। দিনের শুরুতে একবার। দিনের শেষে একবার। ওর কাছে স্নান একটি হিসাব। এই হিসাবের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দিনযাপন। এই অ্যাকাউন্টের হিসাব-নিকাশ অপার্থিব। নিজেকেই প্রশ্ন করব, হিসাবে গরমিল নাই তো? তুমি নিজে ঠিক আছ তো? তোমার নৈতিক শুদ্ধতার ভুল হিসাব জমা হয়নি তো? কিন্নরী জোরে জোরেই বলে, সম্পর্কের টানাপড়েনে হিসাবের গরমিল হয়। আমি তো সম্পর্ক রাখিনি। অমিতকে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করে দিয়েছি। অমিতকে বুঝত ওর মা। মেডিক্যাল সায়েন্সের ব্যাখ্যায় বোঝা নয়। আচরণের কারণে বুঝেছিল ছেলেটির সমস্যার হিসাব। জানতেন, কচ্ছপ মানে সেই জীবন, যে জীবন শ্লথ। যে জীবনের দৌড় প্রতিযোগিতা নেই। কিন্নরী হাতের তালু ঘষতে ঘষতে রান্নাঘরে আসে। চুলো থেকে ভাতের হাঁড়ি নামায়। মাড় গালে। চুলো বন্ধ করে বাথরুমে আসে। শাওয়ার ছেড়ে জলের ধারার নিচে দাঁড়ায়। প্রতিদিনের জীবনযাপনের শর্ত তো এমনই। অ্যাকাউন্টের হিসাবে খুব কমই বড় ধরনের রদবদল হয়। তার পরও মনের কোণে জমে থাকে কালো মেঘ। তাহলে এই মেঘ কি হিসাবের বাইরে? কিন্নরীর ভাবনা এলোমেলো হয়। ঠাণ্ডা পানির রেশ শরীরকে শীতল করে না। বুঝতে পারে, এখন দমে যাওয়ার সময়। কিন্নরীর চুল শ্যাম্পু করা শেষ। শরীরে সাবান লাগায়। পায়ের নখ খুঁটতে খুঁটতে শুনতে পায় অমিতের কণ্ঠ। : নেইলপালিশ লাগাও কেন? নখের সাদা রংই তো সুন্দর। রোজ সাবান ঘষে পরিষ্কার রাখবে। : উপদেশ দিচ্ছ? : ধরো দিচ্ছি। মানতে চাইছ না? : না। অন্যের উপদেশ বিরক্তিকর। : ও, তাই। তোমার উপদেশ শুনতে আমার ভালো লাগে। বলতে পারো, মজা পাই। : আমার হাসি পাচ্ছে। : তুমি হাসতে ভালোবাসো। : আমার হাসি শুনতে তোমার ভালো লাগে না? : না। মন খারাপ হয়। কান্না আসে। : বলো তো কান্না কী? : মায়ের মুখ। : কেন, মায়ের মুখ কেন? : তাকালে চোখে পানি আসে। তোমার কাছে কান্না কী? : দুঃখ। কষ্ট পাওয়া। : বাচ্চারা কাঁদে কেন? ওদের দুঃখ কী? : বাচ্চাদের কান্না ওদের ভাষা। হা হা করে হেসেছিল মাহবুব। কিন্নরী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রেগেমেগে বলেছিল, এমন করে হাসছ কেন? : হাসতে ভালো লাগছে। : বোগাস। থাম। চুপসে গিয়েছিল মাহবুব। কিন্নরীর মনে হয়েছিল, এসবও জীবনের হিসাব। অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স বাড়ে। কিংবা কমে। তাতে কী এসে যায়? না, এসে যায়, নইলে অমন চুপ করে গিয়েছিল কেন অমিত। কেমন বিষণ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল বাইরের দিকে। ভাবলেশহীন চেহারায় ওকে খুবই অচেনা মনে হয়েছিল কিন্নরীর। মায়া হয়েছিল। ওর হাত ধরতে গেলে ঝটকা মেরে কিন্নরীর হাত সরিয়ে দিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। যেন ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে ওকে। ভয়ে থমকে গিয়েছিল ও। কথা বলারও সাহস ছিল না। মাঝে মাঝে অমিত এভাবে পাল্টে যায়। তখন ওর ক্রোধের মাত্রা নিরূপণ করা যায় না। দৃষ্টির ভাষা আগুনের আভায় চকচক করে। চেনা ছেলেটির অচেনা হয়ে যাওয়ার মাত্রা ওকে আহত করে। সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রবল হয়ে উঠলে কিন্নরী নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে। নিজেকে বোঝায়, অমিত মাইল্ড অটিজমে আক্রান্ত। এর বেশি কিছু ভাববে না কিন্নরী। শাওয়ার বন্ধ করে। তোয়ালে টেনে নেয়। ভেসে ওঠে মাহবুবের মুখ। জেগে উঠেছে কানছোঁয়া হাসি। উজ্জ্বল সাদা দাঁত বেরিয়ে আছে। শুধু চোখে দীপ্তি নেই, সেখানে ভাটির টান, তার পরও বড় সরল দেখাচ্ছিল ওকে। দাঁত বের করা হাসি মুখে রেখেই বলেছিল, একদিন তুমি আর আমি একসঙ্গে গোসল করব কুহু। কী বললে? কিন্নরীর ভুরু কুঁচকানো চাউনি উপেক্ষা করেছিল ও। হাসতে হাসতে বলেছিল, শাওয়ারের নিচে পাশাপাশি দাঁড়াব। : খবরদার! : আমি তোমার গায়ে সাবান লাগিয়ে দেব। : চুপ করো। : চুলে শ্যাম্পু করে দেব। : চুপ করো। : গোসল শেষে তোয়ালে দিয়ে গা মুছিয়ে দেব। : আর একটি কথা বলবে না। : বলব। বলব। : ভালো হবে না বলছি। : গোসল শেষে ঘুম পাড়িয়ে দেব। : বেশি সাহস দেখাচ্ছ। : ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখাব। : তুমি কি থামবে? : থামব তো। স্বপ্নে তুমি আর আমি চাঁদে বেড়াতে যাব। চাঁদের বুড়িকে পাটিসাপটা পিঠে খাইয়ে পূর্ণিমার সুতা দিয়ে তৈরি শাড়িটা তোমার জন্য কিনব কুহু। কুহুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে গিয়েছিল ও। যাওয়ার আগে ভেংচি কেটেছিল। কুহু বুঝেছিল, ওই ভেংচি ফান না। ও ক্রুদ্ধ। ও দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে, কপাল কুঁচকে রেখেছিল। ওর আবেগ প্রকাশ স্পষ্ট নয়। ওর কথা বুকের ভেতর থেকে বের হয় ঠিকই, কিন্তু আবেগহীন। কোথায় যেন প্রবল শূন্যতা ওকে জড়িয়ে থাকে। ও সেই বলয় থেকে বের হতে পারে না। কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে নিজেকে হাতড়ায় কিন্নরী। উত্তর নেই। ও কী করে বুঝবে আরেকজনের সাইকোলজি। কিন্নরী বাথরুম থেকে বের হয়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে যায়। চুল আঁচড়ায়। মুখে লোশন লাগায়। বেশ ফ্রেশ লাগছে নিজেকে। রান্নাঘরে আসে। ভাত-তরকারি নিয়ে খাবার টেবিলে এসে বসে। গ্লাসে পানি ঢালে। প্লেটে ভাত নেওয়ার সময় দারুর চেহারা ভেসে ওঠে। হোম থেকে বের হওয়ার আগে ছেলেটি ওকে জড়িয়ে ধরেছিল। গোঁ গোঁ শব্দ করছিল। ও ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। গলা কাঁপিয়ে দু-চারটে বাক্য বলে মাত্র। স্পষ্ট উচ্চারণ নয় বলে ঠিকমতো বোঝা যায় না। এখন ছেলেটির কথা ভেবে ওর মন খারাপ হয়। ছেলেটি কাছে থাকলে ও ওকে গরুর মাংস দিয়ে ভাত খাইয়ে দিত। বলত, দারু রে, আর জনমে তুই একটা শালিক পাখি হয়ে জন্মাবি। : কেন? শালিক পাখি কেন? : তাহলে তুই আকাশে উড়তে পারবি। : আমি আকাশে উড়তে চাই না। মাটিতে থাকতে চাই। : তাহলে তুই হাঁস হবি। পানিতে থাকতে পারবি। : না, আমি হাঁসও হব না। আমি মানুষ। : তুই তো মানুষ হয়ে জন্মেছিস। দেখতে পাচ্ছি, এখন তোর অনেক কষ্ট। তোর কষ্ট আমার সহ্য হয় না দারু। : আর জনমে আমি তোমার কোলে জন্মাতে চাই। কথা বলতে চাই। গান গাইতে চাই। স্কুলে যেতে চাই। ক্রিকেট খেলতে চাই। সব চাই। সব। সব। স—ব। : ওহ্ আল্লাহ রে, দারু—। তুই এমন একটি বাচ্চা কবে হবি? আমি তোর জন্য বসে থাকব। কিন্নরী বাঁ হাতে চোখের পানি মুছে একমুঠি ভাত মুখে পোরে। মাংসের টুকরো চিবোয়। সালাদের প্লেট থেকে শসা আর কাঁচা মরিচ তুলে নেয়। আজ কোনো সবজি নেই। মাঝে মাঝে মাছ-মাংস বাদ দিয়ে শুধু সবজি রান্না করে। নিরামিষ অথবা ভাজি। ওর ধারণায় এভাবে খাবারের বৈচিত্র্য তৈরি হয়। একসঙ্গে অনেক কিছু জড়ো করলে সেটা স্তূপ হয়, বৈচিত্র্য হয় না। প্রথম দিন ওর এ কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়েছিল তন্বী। বলেছিল, ভোজনরসিকরা এ কথা শুনলে তোকে মারতে আসবে। মারতে আসবে কেন? আমি আমার পছন্দের কথা বলেছি। ওদের তো খেতে নিষেধ করিনি। তার পরও, এসব কথা চাউর হওয়া তো আপত্তির বিষয়। রাখ তোর বিষয়। তোর ভোজন-লালসা— কী বললি? লালসা? লালসাই তো। এই করেই তো— : থাম। থাম। জ্ঞান দিস না। সেদিন তন্বীর সঙ্গে বেশ অনেকক্ষণ তর্ক হয়েছিল। শেষে ও বলেছিল, আমি কোনো দিন তোর মতো হতে পারব না। আমার টেবিলে দশ-বিশ পদের খাবার চাই। অল্পতে হবে না। সর সর। খেয়ে মর। দুই হাত তুলে নাচতে নাচতে হা হা করে হেসেছিল তন্বী। টেনে টেনে বলেছিল, তুই মরবি ফকিরনির মতো। সর সর। না খেয়ে মর। শকুনের দোয়ায় গরু মরে না রে। আমি মরব রানির মতো। ফুঃ! তন্বী ওর মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে আরো বলেছিল, এভাবে খেলে মাহবুবের সঙ্গে প্রেম ঠুস হয়ে যাবে! মনে রাখিস। ওটা তো ঠুস হয়ে গেছেই। বাকি আছে নাকি? কবে হলো বলিসনি তো— সব কথা তোকে বলতে হবে নাকি? আমার কথা আমার মধ্যেই আছে। সেদিন চুপ করে গিয়েছিল তন্বী। আর কথা বাড়ায়নি। কিন্নরী হাসতে হাসতে বলেছিল, শুরু করলাম খাওয়া নিয়ে। শেষ হলো প্রেমের কথায়।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
সেলিনা হোসেন- র আরো পোষ্ট দেখুন