কালের অভিযাত্রী শান্তির পথে যাও

ফোনটা বেজে উঠতেই রিসিভার উঠিয়ে নেই। জানতে চাই। হ্যালো, কে বলছেন?
হুঁ, জুবাইদা, আমি বলছি। নয়ন। এ রকম সম্বোধনই আমাদের দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। কোনো জরুরি কথা মনে পড়লে যেমন, কোনো বিষয়ে জানতে হলে যেমন, তেমনি কোনো বিষয়ে মতামত বা সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজনে আমরা এভাবেই সম্বোধন করতাম পরস্পরকে। নয়ন যে কাজে হাত দিত, তার ভালোমন্দ, সত্য-মিথ্যা যাচাই করার সময় আমরা এ রকমভাবে, কোনো ভনিতা ছাড়াই বিষয়টির গুরুত্ব নিয়ে মতবিনিময় করেছি দীর্ঘ দিন ধরে।

ফোনটা বেজে উঠতেই রিসিভার উঠিয়ে নেই। জানতে চাই। হ্যালো, কে বলছেন?
হুঁ, জুবাইদা, আমি বলছি। নয়ন। এ রকম সম্বোধনই আমাদের দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। কোনো জরুরি কথা মনে পড়লে যেমন, কোনো বিষয়ে জানতে হলে যেমন, তেমনি কোনো বিষয়ে মতামত বা সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজনে আমরা এভাবেই সম্বোধন করতাম পরস্পরকে। নয়ন যে কাজে হাত দিত, তার ভালোমন্দ, সত্য-মিথ্যা যাচাই করার সময় আমরা এ রকমভাবে, কোনো ভনিতা ছাড়াই বিষয়টির গুরুত্ব নিয়ে মতবিনিময় করেছি দীর্ঘ দিন ধরে।

আমি আমার বন্ধু নয়ন রহমানের কথা বলছি। জীবন কত বৃহৎ বিষয়, তার গভীরতা আমাদের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণÑ এ ধরনের আলাপ আমরা বারবার করেছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কাজও করেছি। আজ যখন নয়ন আমাদের ছেড়ে সুদূর নক্ষত্রলোকে যাত্রা করেছে, তখন কেবল মনে হচ্ছে, কোথা থেকে এক নিষ্ঠুর শূন্যতা এসে সব জাগতিক অনুভবের বিরুদ্ধে শাসনের তর্জনী তুলে যোজন যোজন দূরে নিয়ে গেছে আমাদের।

নয়ন ছিল সহজ-সরল সুন্দরের প্রতীক। তাকে মোমের মতো নরম, স্পর্শকাতর একজন মানুষ হিসেবেই দেখে আসছি। চল্লিশ বছর বা তারও কিছু বেশি সময় ধরে আমরা পরস্পরের বন্ধু। তবে তার মূল শেকড় ছিল লেখিকা সঙ্ঘ নামে প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্র করে। ১৯৭২ সালে আমাদের দুই বিজ্ঞ গুরুজন অধ্যাপিকা খোদেজা খাতুন ও তার সাথে খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক শামস রশীদ মহিলা লেখকদের জন্য একটি নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমরা যারা অনেক দিন ধরে লেখালেখির সাথে যুক্ত, তাদের মধ্যে দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনার সঞ্চার ঘটল। তখন থেকে (১৯৭২-৭৩) শুরু হলো লেখিকা সঙ্ঘের যাত্রা। বিশেষ বিশেষ দিবস পালন, রোকেয়া দিবসকে মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি লেখিকাদের একটি নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ লেখিকা সঙ্ঘ। ওই সময় বেগম সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহিম, জোবেদা খানম, মনোয়ারা বেগম, জাহান আরা আরজু, খালেদা মনজুরে খোদা, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা, আখতার ইমাম ও অন্য অগ্রগণ্য ও সাহিত্যিকেরাও লেখিকা সঙ্ঘকে বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত। নিয়মিত সাহিত্যকেন্দ্রিক কার্যক্রমের পাশাপাশি আরো নতুন নতুন বিষয় নিয়ে লেখিকা সঙ্ঘের কাজ শুরু হয়। সাহিত্য আসর, নতুন বই প্রকাশ ও নানা রকম কাজে নিয়োজিত হয় লেখিকা সঙ্ঘ। আমি তখন কলেজ শিক্ষকতা ও নানা দায়দায়িত্ব নিয়ে জড়িয়ে পড়েছি। ১৯৭৪ সালে নয়ন রহমান সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে। সুদীর্ঘ ২৩ বছর দৃঢ় হাতে লেখিকা সঙ্ঘের হাল ধরে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে লেখিকা সঙ্ঘ পরিচালনা করেছেন নয়ন। শুধু পরিচালনা নয়, আমাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী প্রতি বছর জাঁকজমকের সাথে পালন করা হয়ে আসছে। জাতীয় দিবসগুলো যেমনÑ একুশে ফেব্রুয়ারি, কবি সাহিত্যিকদের জীবনী নিয়ে আলোচনা নির্ভুলভাবে পালন করতে কোনো ত্রুটি হয়নি। এর পেছনে নয়ন রহমানের উৎসাহী মন ও দায়িত্ববোধ ছিল প্রধান কারণ। পরবর্তীকালে লেখিকা সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট পদটি অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। প্রতি বছর প্রতিষ্ঠা দিবসে সঙ্ঘ দেশের বরেণ্য দুই কবি-সাহিত্যিককে পদক দিয়ে থাকে। আমার মনে আছে, আমরা সভা ডেকে সবার মতামত নিয়ে তবেই পুরস্কার বিষয়টি নিশ্চিত করে থাকি। অনেক সম্মানিত গুণীজনকে আমরা পুরস্কৃত করেছি।

সময়ের সাথে সাথে প্রয়োজনের চাপ বেড়ে যায়। আমরা লেখিকা সঙ্ঘকে প্রকাশনায় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। ভাষা আমার বাংলা ভাষা, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, চিরকালের গল্প এই প্রকাশনা পর্যায়কে আরো মূল্যবান করেছে। ‘আমার বাবা’ আমার মা, এই প্রকাশনার বিরাট অর্জন। এ ছাড়া বিগত বছরগুলোয় রাজিয়া হোসাইন প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে সাহিত্যে অর্জন : বাংলাদেশের নারী ১ম ও ২য় খণ্ড লেখিকা প্রকাশনার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক বলে বিবেচিত হবে। মাঝে মধ্যে আমি বলতাম, এসব কাজ এত সময় দিয়ে করো কেমন করে? নয়ন একটু হেসে জবাব দিয়েছেনÑ ‘আমি তো একা নই, তোমরা সবাই মিলেই তো করছ।’ কথাটা ঠিক বললেও এত বিস্তৃত ও ব্যাপক কার্যক্রম চালানো এবং সফল হওয়া সহজ কথা নয়। কিন্তু নয়নের মধ্যে এমন গতিশীলতা ছিল, যা দিয়ে সে ঠিক কাজটি আদায় করে নিতে জানত। তার কথা কেউ অবহেলা করতে পারত না।

নয়নের কথা বলতে গেলে অবাক হয়ে ভাবি, এত শান্ত, ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে পারার ক্ষমতা শিগগিরই দেখা যায় না। বিগত ৪১ বছরে অনেক সঙ্কটের মোকাবেলা করেছে শান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে। প্রকৃতপক্ষে লেখিকা সঙ্ঘ তার কাছে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এ যেন একটি বৃহৎ পরিবার। নয়ন রহমান ধীরে ধীরে শান্ত ও ধৈর্যশীলতার সঙ্গে সবার মন জয় করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। আমাদের সবার সঙ্গে মতবিনিময় করে সিদ্ধান্ত নেয়া ও সবার মতামতকে গুরুত্ব দেয়া একটি বিশেষ গুণ ছিল। অন্য দিকে নিজের লেখালেখির জন্য তার গভীর মনোযোগ ছিল। শিশুসাহিত্যের বিশাল রাজ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বই প্রকাশিত হয়েছে তার। আমি যখন শিশু একাডেমিতে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলাম, তখন তার একটি বইয়ের প্রকাশনা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়। আমি বিষয়টি লক্ষ করে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশনার কাজটি এগিয়ে দেই। বইটি প্রকাশ করে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। কারণ সেটি একটি উৎকৃষ্টমানের বই। নয়নের লেখার মধ্যে তার সংবেদনশীল হৃদয়টি যেন হাসিমুখে বাড়িয়ে দিচ্ছে বন্ধুত্বের হাত।

নয়নের শরীর গত কয়েক বছরে অসুস্থতার কারণে খারাপ হতে শুরু করে। জীবনের একটি বড় অংশ সে পুরানা পল্টন গার্লস কলেজে অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিল। সেখান থেকে অবসর নেয়ার পরে সে নিজের আগ্রহ ও কর্মক্ষমতার সবটুকু দিয়ে কাজ করেছে লেখিকা সঙ্ঘের জন্য। রাজিয়া হোসাইন, সেলিনা খালেক সবাই পুরনো অভিজ্ঞতা ও প্রশাসনিক অবদানে ধন্য করেছেন আমাদের সঙ্ঘকে। তবে সব কাজে নয়নের আগ্রহ ও ভালোবাসা আমাদের এই প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে শক্তি ও মেধা।

নয়ন রহমান ডায়াবেটিস ও আরো বিভিন্ন রকম উপসর্গ নিয়ে পীড়িত হলেও কাজে কোনো দিন ভাটা পড়েনি। তাকে দেখে আমরাও বুঝতে পারি যে, রোগ বালাই যা-ই হোক, কর্মযোগ সবচেয়ে বড়।

লেখিকা সঙ্ঘ বিগত এক চল্লিশ বছরে আনন্দিত সাফল্যের সাথে কাজ করে চলেছে। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি বইমেলায় আমাদের লেখিকা সঙ্ঘের বইয়ের স্টল থাকে। সবাইকে উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা দিয়ে অনেক বাস্তবসম্মত কাজ করিয়ে নিতে সে সব সময় তৎপর ছিল। অন্য দিকে পুরস্কার ও সংবর্ধনায় ধন্য হয়েছে তার জীবন। অশ্বিনী কুমার দত্ত স্বর্ণপদক, সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার, কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার, কমর মুশতারী সাহিত্য পদক ছাড়াও বহুবার সংবর্ধনা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, কর্মে ধন্য। আমার বন্ধু নয়ন রহমান। বিগত কয়েক বছরে ক্রমাগত অসুস্থতা তাকে কাবু করলেও মনের দিক থেকে দেখেছি অদম্য, সাহসী, কর্ম অন্তপ্রাণ একটি মানুষ হিসেবে। তার বন্ধুত্ব নিয়ে আমার অনেক অহঙ্কার। তাই শত কর্মব্যস্ততা, স্বামীর অসুস্থতা, নিজের অসুস্থতা সত্ত্বেও তার আন্তরিক মমত্ববোধকে আমি সম্মান করি। মানুষমাত্রই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু নয়ন ছিল একেবারে অন্য রকম। সবার সঙ্গে নিজের সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতে জানত। এই তো গত সেপ্টেম্বরে আমরা আনন্দ করেছি ওর জন্মদিনে। কি সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা, কি দেশের এলোমেলো ঝড়ঝঞ্ঝায় বিষণœ বেদনায়, কি ঈদ বা পর্বের সামনে উপহার দেয়া-নেয়া, সব মিলিয়ে সে ছিল নিষ্কম্প প্রদীপ শিখার মতো উজ্জ্বল ও স্থির। তার সপ্রাণ উপস্থিতি আমাদের গর্বের বিষয়।

জানি, সে আজ সব কিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছে। তার এ আকস্মিক চলে যাওয়া আমাকে হতবিহ্বল করে দিয়েছে। চল্লিশ এক চল্লিশ বছরের বন্ধন এক অজানা পরিণামে সৃষ্টি করেছে এক অপূরণীয় শূন্যতার।

আমি অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা করছি কখন বেজে উঠবে টেলিফোন। আর চিরপরিচিত কণ্ঠস্বর বেজে উঠবে হ্যালো জুবাইদা, আমি নয়ন বলছি। এক অপ্রতিরোধ্য বেদনায় ভেতরটা কেঁপে উঠবে। জানি, এ এক মর্মান্তিক সত্য হৃদয়ে বহন করেও আমি শুধু বলবÑ কালের যাত্রার অভিযাত্রী তুমি, শান্তির পথে যাও।