আরজ আলীর ট্রলার

untitled-5_107526অনেক বছর অন্যের ট্রলার নিয়ে সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরতে ধরতে এক সময় আরজ আলীর মনে হয় তার নিজের একটা ট্রলার হলে আরও সুবিধে হতো। সুবিধে মানে ইচ্ছেমতো সমুদ্রে যাওয়া, পছন্দ করে মাছ ধরার লোকজন বেছে নেওয়া, জালে আটকে পড়া মাছ ট্রলারে তুলে বাজারে এসে বেপারীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে আরও বেশি আয় করা_ এসব। সুবিধেগুলো তার চোখের সামনে জোনাকির আলোর মতো জ্বলে আর নেভে। কিন্তু অসুবিধা একটাই এবং সেটা মস্তবড় এক চাঁই পাথরের মতো রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। টাকা। একটা ট্রলার তৈরি করতে বা পুরনো একটা ট্রলার কিনতে অনেক টাকা দরকার। কত টাকা? সে হিসাব তখনও করেনি আরজ আলী, তবে বিস্তর টাকা, যা তার কাছে কখনো ছিল না, এখনও নেই।
আরজ আলী দু’একজনের সঙ্গে আলাপ করেছে। তারা তার দিকে তাকিয়ে বলেছে, এই এতদিন পরে কথাডা মনে পড়িছে তুমার? এ্যাহন বয়স হয়িছে, পারবা সামাল দিতে? মনে করো টাকা পাইয়ে গেলে, কিন্তু লোকজন জোগাড়, তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করা এসবের কি বয়স আছে তোমার?
আরজ আলী বলেছে, ক্যান বয়স এত বেশি কী? পঞ্চাশ পার হই নাই এ্যাহনো। খেটে খাওয়া মাইনষের জন্যি কি এটা একটা বয়স হলো?
যে নিরুৎসাহিত করেছিল সে বলেছে, আগে ভাবলি পর ভালো হতো না? বিস্তর টাকা লাগবে ট্রলার বানাতে। পুরনো একটা কিনলেও টাকার হিসাবে কম না। এ্যাই এ্যাহন, এই বয়সে অত টাকা পাবা কোথায়?
আরজ আলী একটু দম নিয়ে বলেছে, ক্যান বয়স কম হলি কি টাকা পাওয়া যায় সহজে?
হ্যাঁ। পাওয়া সহজ হয়। কেননা যারা টাকা দেবে তারা দেখবে কতদিন বাঁচবা তুমি। টাকা শোধ করার আয়ু আছে কি-না তুমার। এইসব হিসাব করে টাকা দেবে মহাজন। এতদিনে এডাও বোঝতে পারলে না? বলে পাশে বসে থাকা লোকটা কাগজের তৈরি বিড়িতে আগুন দিয়ে লম্বা টান দিয়ে ধুঁয়ো ছাড়ে।
আরজ আলী বলে, ক্যান আমার পোলা মোহন আছে না? হ্যাঁ বড় হইলে দ্যাখবো ট্রলার। পাশের লোকটি সিগারেটের ধুঁয়ো ছেড়ে বলে, হ, তা পারে। কিন্তু তোমার এই পোলাডার বড় হইতে এ্যাহনো সময় নিবো।
একেবারে বাচ্চা পোলা। বড় পোলাডা থাকলে একটা কথা ছিল।
বড় ছেলে মানে জাহান। তার কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় আরজ আলীর। জাহান বেঁচে থাকলে এখন বিশ বছরের যুবক হতো। কলেরায় নিয়ে গেল তাকে। ভাবতে ভাবতে তার চোখ ভিজে আসে। নিজেকে বেশ দুর্বল মনে হয়। আহারে জাহান। তুই এমন কইরে চইলে গেলি ক্যান বাপ? তোরে নিয়া অনেক স্বপ্ন দেখছি আমি। তুই বড় হইবি, নিজের ট্রলার নিয়া সাগরে যাইবি। ট্রলার ভর্তি মাছ আইনে তাক লাগায়ে দিবি বাজারে। তোর ওপর অনেক ভরসা ছেলো আমার।
পাশের লোকটি আরজ আলীকে চুপচাপ থাকতে দেখে বলে, অহনে নতুন কিছু করবার কথা ভেইবা মাথা খারাপ করো না মিয়া। য্যামন চলতিছে সেইভাবে যাতি দাও। তোমার ছোট পোলা বড় হলি সেই ঠিক করবেনে কী হলি ভালো হয়। তারো তো বুদ্ধিশুদ্ধি বাড়বে। লোকটি একটু থেমে বলে, তাছাড়া সে বাপের পেশাতেই থাকবিনে তার ঠিক কী? দেহো না কত লোকে এ্যাহন চিংড়ি মাছের ঘেরের কামে জুটিছে। ম্যালা পয়সা সেই ব্যবসায়। যারে কয় কাঁচা টাহা। তোমার পোলা যে হেই দিকে যাবে না তা কী করে কতি পারো?
আরজ আলী কিছু বলে না, চুপ করে থাকে। তার মাথার ভেতর এলোমেলো ভাবনা ঘুরপাক খায়, আকাশে ঝড়ো মেঘের মতো ছেঁড়া-খোঁড়া ছবি ছুটোছুটি করে। জাহানের চেহারা, তার শরীর, অঙ্গভঙ্গি, এমনকি কথাবার্তার ঢং তার সামনে দ্রুত আসে আর যায়, যেন ছেলেবেলায় গঞ্জে দেখা ম্যাজিক লণ্ঠনের ছবি দেখছে সে। জাহানরে, বলে অস্ফুটে সে একটা শব্দ তোলে, যা আর্তনাদ আর শোকের মাঝামাঝি একটা আর্তির মতো শোনায়। দক্ষিণ থেকে বাতাস ভেসে আসে উপকূলের ভেজা মাটি, সমুদ্রের লোনা গন্ধ, গঞ্জের নানা ধরনের শব্দ জড়ো করে।
পাশের লোকটি সিগারেটে টান দেওয়া বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে বলে, কিছু কইলে নাহি আরজ ভাই? ঠিক করি শুনতে পালাম না?
আরজ আলী সম্বিৎ ফিরে পেয়ে একটু বিব্রত হয়ে বলে, না, কিছু না।
লোকটি মনে করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলে, জাহানের কথাকলা মনি হতিছে।
আরজ আলী নড়েচড়ে বসে। গাছ-পালার ফাঁক দিয়ে অদূরে উপকূলের ঘাট, সেখানে গায়ে গায়ে জড়াজড়ি করে নোঙর করে রাখা ট্রলার আর সাম্পান নৌকা দেখতে দেখতে বলে, জাহান? হ, তার কথা প্রায়ই মনে হয়। সে থাকলি আজ আমার মনে কত বল হতো। সংসারের বৈঠা সেই তুলি নিতো হাতে। বড় কামেল ছেলে ছিল আমার। আল্লাহ তারে ক্যানো যে এত তাড়াতাড়ি ডাকি নিলো। বলতে বলতে তার গলার স্বর ভেঙে যায়, কান্নায় থমক উঠে আসে। লোকটি বলে, মন খরাপ কইরো না, ভাই। কী করবা আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়া গেছেন। কী তার মনে ছিল ক্যাডা কবে।
আরজ আলী লুঙ্গির খোটা তুলে চোখ মোছে। দূরে সমুদ্রের বুকে অশান্ত ঢেউ দেখতে দেখতে সে বলে, সিগন্যাল দেছে নাহি? সাইক্লোন হতি পারে? আকাশডা ক্যামুন দ্যাহো না। বাতাসও ঝিমমারি আছে। ভ্যাপসা গরম পড়িছে। সাইক্লোন হতি পারে।
লোকটি বলে, না, সিগন্যাল দেয় নাই। জাহাজ, ট্রলার, নৌকা ঘাটে নোঙর ফেলি রাখতে কয় নাই। তাদের হিসাব ঠিকই আছে। না বুইঝে-সুইজে সিগন্যাল দিলি পর লোকজনের হয়রানি হয়, সেকি তারা জানে না? জানে, জানে। তাদের ওপর ভরসা রাখলেই হবে নে। সাইক্লোন হবি কি হবি না, এ্যাই কথা নিয়ে আমরা ভাবনার কে? তারপর ওপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বলে, এ্যাহন কী আকাশ দেইখে, বাতাসে হাত লাগায়ে সরকারের লোকে কয় সাইক্লোন আসতিছে? সেই ব্যবস্থা কবেই উঠি গিয়েছে। শোনো নাই? এখন তারা ফটো দেখে ঠিক ঠিক কয়ে দিতে পারে মৌসুমের কী অবস্থা। তেলেসমাতি করবার আর কি। সাত আসমানের ওপর ফটো তুলে সে সব দেখে কয়ে দিতে পারে ঝড়-তুফানের কথা। একদিন, দুইদিন আগে না, অনেক আগে থেকেই কয় দিতে পারে।
আরজ আলী কিছু বলে না। সামনে দিয়ে মাছের ডোলা নিয়ে যাচ্ছিলো কয়েকজন মজুর। লোকটি হাঁক দিয়ে বললো, কী মাছ নিতেছো বাজারে?
হাঁফাতে হাঁফাতে একজন মজুর বলে, ইলিশ। লোকটি আরজ আলীর দিকে তাকিয়ে বলে, এবারে ইলিশে ভইরে গেছে সাগর। জাল ফেললেই উঠে আসে। তুইলে শেষ করা যায় না।
আরজ আলী বলে, ঠিকই। এই যে ক’দিন ছেলাম সাগরে কত যে ইলিশ ধরিছি তার ঠিক নেই। কিন্তু তাতে লাভ কী?
লোকটি আরজ আলীর দিকে তাকিয়ে বলে, ক্যান, লাভ নেই কেন?
আরজ আলী বলে, ট্রলার যার সেই মালিকের লাভ। আমরা তো পাই শুধু মজুরি। ওই মজুরদের মতো। হ্যারা কাম করতিছে ডাঙ্গায়, আমরা পানিতে। এই তো মাত্র তফাত।

দুই.
আরজ আলীর বউ আমেরা ভাত বেড়ে দিতে দিতে বললো, এত টাকা হাওলাত করি ট্রলার কিনবা? শোধ দেতে পারবা শেষে?
আরজ আলী ভাতের সঙ্গে শুঁটকি মাছের ভর্তা মাখাতে মাখাতে বলে, নিজের মাছ বেইচে যে টাকা পাবো তাই দে শোধ দেবো। নিজের ট্রলার হলি আয় বেড়ে যাবে নে। এতদিন যে কেন কেনলাম না। তার স্বরে আফসোস গমগম করে।
লোকজন? লোকজন পাবানে ট্রলারে নেবার লাগি? আমেনা জিজ্ঞাসা করে।
লোকজনের কী অভাব? কত বেকার লোক ঘুরতিছে। তারপর একটু থেমে বলে, ট্রলার মালিকরা জেলে আর মাঝিদের বড় ঠকায়। কম টাকা দেয়। আমি বেশি মজুরি দিয়ে পুরনো জেলে আর মাঝিদের সঙ্গে নিয়ে নেবো নে। তাদের সব জানা আছে। কিছু শেখাতে পড়াতে হবে না নে।
আমেনা ইতস্তত করে বলে, ট্রলারের মালিকরা যদি খেইপে যায়?
ক্যান, খেপবে ক্যান? আরজ আলী একটা মাছের কাঁটা দাঁত থেকে বার করতে করতে বলে।
তাদের লোক ভাগাইয়ে নেবার জন্যি। তারা কী এটা সহ্য করতি পারবে? আমেনার স্বরে উদ্বেগ।
আরজ আলী ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, তা পেরথম পেরথম গরম কথা কবে, হুমকি-ধামকি দেবে নে। সে সব কথায় কান দিলে চলবি ক্যান? সবারই তো নিজের স্বার্থের কথা ভাবতি হয়। জেলে হয়ে অন্যের কাজ করেছি বলে কি সারা জেবনই দাস হয়ে থাকতি হবি? আমিও কি মালিক হতি পারি না? তারপর বলে, অসম্ভব কিছুর কথা কতিছি না। সামনেই তো দেখলাম গফুর, মান্নান এরা ট্রলার কিনে এ্যাহন মালিকদের মতো বসে বসে টাকা গুনতিছে। তাদের যহন অসুবিধা হয় নাই, আমার বেলায় হবি কেনে?
মোহন শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছে। আরজ আলীর গলা জড়িয়ে ধরে বলেছে, এইটা খুব ভালো বুদ্ধি করেছো বাপজান। নিজের ট্রলার দরকার। হাওলাত করি হলেও ট্রলার কিইনে ফ্যালোও। মাছ বিক্রি কইরেই শোধ হয়ে যাবে।
আরজ আলী তার দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ। দেরি হয়ে গ্যালো বটে। কিন্তু মনডা ভেঙে গেল তোর বড় ভাইডা মরে যাওয়ার পর। নতুন কিছু মাথায় ঢোকে নাই। তার ওপর ভরসা ছিল অনেক। তারপর মোহনের দিকে তাকিয়ে বলে, তুই তো ছোট। পনেরো-ষোলো বছর হবে বয়স। তোরে নিয়া এত বড় স্বপ্ন দেখতে সাহস পাই নাই।
মোহন বাপের কাছে ঘেঁষে বলে, আমি কি চিরকাল ছোট থেইকে যাবো? বড় হতিছি না? আরো বড় হবো। তারপর অদূরে উপকূলের ঘাটে নোঙর করা ট্রলার আর নৌকার ভিড় দেখতে দেখতে বলে, অহনই যাতি পারি সাগরে। তুমি যাতি দাও না। খালি কও আরো একটু বড় হয়ে নে। কি যে কও তুমি? সাগরে যাওয়ার জন্যি আর কত বড় হওয়া লাগে।
আরজ আলী হেসে বলে, আর একটু বড় হয়ে নে বাপ। ধর গে দু’বছর। আঠারো বছরে পা দিলে সাগরে ট্রলার নিয়ে যাবি তুই। আমার সঙ্গেই যাবি। সব দেখায়ে দেবো, বোঝায়ে দেবো। মোহন হেসে বলে, আমার অনেক কিছু শেখা হয়ি গিয়েছে। আরজ আলী বলে, শেখা হয়ি গিয়েছে মানে? ক্যাডা শেখালো? কোথায় শেখালো তোরে?
মোহন উপকূলে ঘাটের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে, ওই হানে। তুমি ট্রলার নিয়ে সাগরে যহন যাও, তোমারে বিদায় দিবার সময় মাঝি আর জেলেদের কাছ থে সব শুনে নিই, তাদের কাজ দেখি। ধরো গে আমার ট্রেনিং হয়ে গেছে। জিজ্ঞেসা করে দ্যাহো কোন মাছের জন্যি কোন জাল লাগবে, সেই কথা। সব কয়ে দিতে পারি, ঠিক ঠিক। বলে সে হাসতে থাকে।
আরজ আলী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, আমি ভাবিছি তুই বন্ধুদের নিয়ে খেলতে যাস। সাঁতার কাটিস এইসব। তলে তলে মাছ ধরার কলাকৌশল সব শিখে ফেলেছিস এইটা তো বুঝি নাই।
মোহন বলে, ট্রলার কিনি ফেলাও বাপজান। তারপর দেখবা কী কী শিখেছি, কোন কাম করতে পারি।
আরজ আলী মাথা নেড়ে বলে, না, তোরে এইটুকু বয়সে সাগরে নেবো না। আর একটু বড় হয়ে নে। এত ব্যস্ত হওয়ার কী আছে? সাগর শুকায়ে যাতিছে না। মাছও পলাবে না। আর ট্রলার কেনা হলে সেটা তো তোরই হবে একদিন।
রাতের বেলা সব শুনে আমেনা বলে, মোহনরে অন্য কোনো কামে লাগান যায় না? গুদামে, গঞ্জে, কাঠের গোলায়_ এইসব জাগায় কাজ আছে না? আর কিছু না হোক রিকশা তো চালাতি পারে। তুমি জেলে তার জন্যি তোমার ছেলেকেও জেলে হতি হবে কেন? সে অন্য পেশায় যাক। তারপর পাশ ফিরে বলেছে একবার যহন ট্রলার নিয়ে সাগরে যাও, যতক্ষণ যতদিন ফিরে না আসো কিছুতে মন বসে না। বড় অস্থির লাগে। সব সময় একটা ভয় জাগে ভেতরে ভেতরে। মেহনের বউও এমন ডর নিয়া জীবন কাটাক এই কথায় সায় দেয় না মন।
আরজ আলী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ইচ্ছা করলেই কী বাপ-দাদার পেশা বদলান যায়? রক্তের ভেতর ঢুইকে যায় সেই পেশার অভ্যাস। একটা নেশা হয়ে যায়। তুমি কী মনে করো সাগরে যাই শুধু মাছ ধরতি?