ভুল অথবা জীবনের কথা

ভুল অথবা জীবনের কথা

ভুল অথবা জীবনের কথা
ভুল অথবা জীবনের কথা
যদি ভুল পথে এসে থাকি তবে জেনো ভ্রান্তিই আমার ধ্রুব। এখন/গাছ সাক্ষী আমি আর ফিরব না। নদী সাক্ষী আমি আর ফিরব না।/মেঘ, পাখি আর পাল তোলা নাওয়ের কসম, যে পায়ের ছাপ/আমার পেছনে রেখে এলাম তা মৃত্যুর দিগন্তে গিয়ে/একবার নিঃশ্বাস ফেলবে। ভুলের পুরস্কার যদি মৃত্যু, তবে তাই/হোক_ ভুলের দিগন্তে

ভুল-ভ্রান্তি হলো মানবজীবনের স্বাভাবিক ঘটনা। কাজ করতে গেলে_ সে কাজ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিই হোক না কেন, মানুষের ভুল হবেই। কবি কবিতা লিখবে। লেখার সময়ে ভুল-ভ্রান্তি হলে সেটা কেটে দেয়, আবার পুনরুদ্দমে লেখে। এভাবেই মানুষ ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।
ভুল তো ভুলই। সেটা প্রিয় ভুল হিসেবে ধরা দেয় না। জীবনের প্রথম বেলায় কবিতাকে আশ্রয় করে বাঁচতে চাওয়া ছিল আমার প্রিয় ভুল। এটা আমার কথা নয়, আমার চারপাশের লোকজনের কথা। স্মৃতি প্রতারক, তবুও সেই স্মৃতি হাতড়ে কবি-জীবনের, লেখক-জীবনের কিছু কথাই বলব।
লেখার কাজটা খুবই কঠিন পরিশ্রমের কাজ। যারা নিয়মিত লেখালেখি করেন তারা জানেন, এ কাজের উপযুক্ত পারিশ্রমিক কেউ দেয় না, তবু লেখা তো বন্ধ থাকে না। আমি জীবন-প্রান্তের এক জটিল মুহূর্তে এসে উপনীত হয়েছি। এ সময় সাধারণত মানুষ একই ধরনের কথা বারবার উত্থাপন করে কলাম ভরিয়ে দেয়, আমি পুনরুক্তি করি না। এটা আমার স্বভাবের মধ্যে নেই। আমি সব সময় নতুন কথা বলতে চেয়েছি। নতুন চিন্তার খোরাক জুগিয়েছি। এখনও মন কেবল নতুনত্ব খুঁজে বেড়ায়। কোনো কথাই এখন আর অনাবিষ্কৃৃত নয়। চিন্তা-ভাবনা তো নয়ই।
এখন এমন একটা সময় যখন প্রায় সবাই ভালো লিখছেন। সবাই যখন ভালো লেখেন তখন বুঝতে হবে আধুনিক বাংলা কবিতা এক অবক্ষয়ের মধ্যে আটকে গেছে। এর থেকে মুক্তির উপায় আমারও জানা নেই। শুধু এটুকু জানি, এর থেকে বেরোতে না পারলে আধুনিকতার সংজ্ঞাটি আর ব্যবহার করার উপযুক্ত থাকবে না। নতুন উদ্ভাবনা ও উদ্ভাবন কার হাতে ঘটবে তা আমার জানা নেই। আমি বিশ্বাস করি, এই অবস্থা একদিন সহসাই ভেঙে পড়বে। শত তরুণের একাগ্র চেষ্টা বিফলে যাবে এটা ভাবা যায় না। আবার তারুণ্যের হাতেই মুক্তি, এ কথায় আমার আস্থা নেই। এমনও তো হতে পারে_ কোনো তরুণ নয়, দেখা গেল একজন প্রবীণ কিংবা মধ্যবয়স্ক কোনো আন্তরিক অনুশীলনকারী সহসা সাহিত্যের পথ বদলে দিচ্ছেন। সাহিত্যের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত অনেক আছে।
আমার দু’একজন বন্ধু কষ্ট করে আমার বাসায় এসে বলতেন, অবস্থাটা ভাঙতে হবে। আমিও বুঝি যে, তারা কিছু একটা ভাঙতে চান। কিন্তু কেউ সাহসী হয়ে ভাঙার অস্ত্রটি হাতে নেন না, শেষে যদি কপাল ভেঙে যায়! সবাই তো ছাপোষা মানুষ, যা সামান্য কিছু অর্জন করেছেন সেটা ভাঙিয়ে খাচ্ছেন। নতুন কোনো উপদ্রবে তারা সাহসী হবেন কেন?
কিন্তু আমি যখন বলতাম, আমি বিশ্বাসী মানুষ, তখন অনেকেই অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকাতেন। মনে মনে হয়তো ‘মৌলবাদী’ বলে গালিও দিতেন। মুখে তাদের কপট হাসি। যেন তারা বলতে চাইতেন_ তোমার কপালে দুঃখ আছে। আমি মনে মনে ভাবতাম, কত দুঃখ এই সঙ্কীর্ণ কপালে আমার প্রভু লিখে দিয়েছেন কে জানে। আমি একলা থাকি, একলা চলি, আমার দোসরও নেই, না থাকার জন্য হুতাশও নেই। আমার সৃজনপ্রক্রিয়া দুর্বোধ্যও নয়। আমি লিখি সহজ-স্বাভাবিক গতিতে। আমি কারও পরোয়াও করি না, কারও অনুগ্রহও ভিক্ষা করি না। আমি সারাজীবন এভাবেই কাটিয়ে এসেছি। এই তো আমার লেখক-জীবন।
জীবনের একটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি, যাকে বলে অভিজ্ঞতা, সেটা ঝোলায় ভরলেও উপচে পড়ে। মনের ভেতর রাখলেও দেহ কম্পিত হতে থাকে। এটা আমি শিশুকাল থেকেই জানি, পরিশ্রম ছাড়া কোনো প্রতিভাই জগতে টিকতে পারেনি। আমার লেখার ক্ষমতা আছে, কিন্তু যদি আলসেমি করে না লিখি তাহলে আমার প্রতিভা কোনো কাজে লাগবে? আমার জীবনে আমি বহু প্রতিভাবান নর-নারী দেখেছি, কিন্তু পরিশ্রমের অভাবে বিলীন হয়ে যেতেও দেখেছি। আর আমি সবচেয়ে ভয় পাই ঈর্ষাকাতর মানুষকে। তাদের কাছ থেকে আমি যতটা সম্ভব নিজকে সরিয়ে চলতে চেয়েছি। কিন্তু আমার ভাগ্যই এমন যে ঈর্ষাকাতর বন্ধুরা আমাকে খুঁজে-পেতে বের করে যন্ত্রণা দিয়েছে। ওই একটি শ্রেণীকে আমি কোনো দিন স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিনি।
তাদের আমি শত্রুই ভাবি। আমার যা বলার তা আমি আমার বিভিন্ন লেখায় অকপটে বর্ণনা করে এসেছি। এতে যেমন শত্রুতা বেড়েছে, তেমনি বন্ধুত্বের হাতও অনেকে মেলে দিয়েছেন। আমি সব সময় বলেছি যে, আমি কবি মানুষ। কবিদের কাজ হলো জাতিকে স্বপ্ন দেখানো। আমি এর ব্যতিক্রম কিছু করিনি। তবু ঈর্ষাকাতরতা আমার ওপর এসে হামলে পড়েছে।
এমনিতেই বয়স্ক লোকেরা অতীত আলোচনা করতে ভালোবাসে। আমি নিজেও এখন এই দলের মানুষে পরিণত হয়েছি। লেখালেখির কথা যদি বলি এবং ভাষা আন্দোলনের কথা যদি না বলি তাহলে সবটুকুই অপূর্ণ থেকে যাবে।
উনিশশ’ বায়ান্নর ভাষার জন্য আত্মদানের সংবাদটি সেই সুদূর মফস্বল এলাকায় বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি আমার নিজের শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমার বন্ধুদের নিয়ে উত্তেজনায় অস্থির হয়ে ছোটাছুটি করে বেড়িয়েছিলাম। সেই যে উত্তেজনা, যা আমার বাড়িতে পুলিশের আনাগোনার কারণ হয়েছিল, সেটা কি ভোলা যায়? আমি হয়তো ধরা পড়েই যেতাম। কিন্তু দৈবক্রমে পুতুল নামের আমার এক খালাতো বোন আমাকে বাড়ির গেট থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল_ পালাও, তোমাদের ঘরে পুলিশ সার্চ করছে। আমি পালিয়ে বাঁচলাম। তার পর থেকেই তো আমার আর বাড়ি যাওয়া হলো না।
স্মৃতি বড়ই দাহ সৃষ্টি করে। মানুষ ভাবে, সে এই হবে সেই হবে। কিন্তু নিয়তি তাকে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়তিরই নিয়মের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। অস্বীকার করতে চাই না, ফেব্রুয়ারি মাসটা আমি যা হতে চেয়েছিলাম তার বিপরীত দিকে ভাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমার কবিত্ব শক্তি আমাকে আমার ইচ্ছার দিকে এনে হাজির করে দিয়েছে। আমি কবি ছাড়া আর কি কিছু?
একুশ আমাকে কী দিয়েছে, এর জবাব নানাভাবে দেওয়ার চেষ্টা করছি। তা পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। কিছুই ছিলাম না আমি। কিন্তু মনের গোপনে একটা বাসনা ছিল, হয়তো কবিই হবো, আর এখন আমি কি কবি ছাড়া আর কিছু? একুশ আমাকে দিয়েছে নিজের জন্য একটি ভাষা তৈরি করে নেওয়ার সাহস।
যদি একুশ আমাকে ঘরছাড়া ফেরার কিশোরে পরিণত না করত, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের মানচিত্রের ভেতরে অসংখ্য গ্রাম ধাম গঞ্জ বাজার পথ ঘাট ও নর-নারী সম্পর্কে আমার পক্ষে জানাই সম্ভব হতো না। ভাগ্য আমাকে বিভ্রান্ত করেনি। নারীর প্রেম আমাকে প্রত্যাখ্যান করেনি। মায়ের আদর আমাকে আঁচলে বেঁধে রাখেনি। আমি চিরঘরছাড়া এবং চিরকালের পরিব্রাজক। দুটি পায়ের অধিকারী। আমি চারণ, বারণহীন মাতৃগর্ভ থেকে নির্গত হয়ে পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে অন্তরে বাহিরে বিচরণ করে চলেছি। আমি থামিনি। থামব না; যতক্ষণ মৃত্যু এসে আমাকে পথ আগলে না দাঁড়াবে।
যৌবনে মানুষকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। অনেক মিথ্যার পেছনে ছোটাছুটি করে বেড়িয়েছি। অনেক ভুলের মাঝে কালাতিপাত করেছি। একদিন দেখি আমি একা। আশপাশে কেউ নেই। এখন নৈসর্গের মধ্যে হাপিত্যেশ করে ঘুরছি। দেখছি লভ্য হলো না কিছুই। তবুও একটা জিনিস আমি পেয়েছি। তা হলো খোঁজার অভ্যাস। এই অভ্যাস আমাকে ভেতর থেকে প্রেরণা দেয়। অনেক দুরূহ কাজকে সহজ করে দেয়। পাইনি কিছুই! কিন্তু অতৃপ্তি নেই। মহা উৎসাহে আমি হারিয়ে যাওয়া চাবি খুঁজি। লোকজন জিজ্ঞেস করেছে কী হয়েছে। আমি বলেছি, জীবনের ভাণ্ডার খোলার জন্য তালাবদ্ধ ট্রাংকটির চাবি খুঁজে বেড়াচ্ছি। যেখানে আলোক পড়েছে তার পরিধির মধ্যেই খোঁজাটা সহজ। এখন এই পরিধি বাড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসী হয়েছি। চিৎকার করে বলছি, আলো দাও। আরও আলো। জবাব নেই; কিন্তু আলোর পরিধি বেড়ে যাচ্ছে, আমি টের পাচ্ছি, অনুভব করছি, হাতড়ে দেখছি, উষ্ণতায় আমার স্পর্শ-ইন্দ্রিয় কম্পিত হচ্ছে। আর আমি খুশিতে কম্পমান। নিশ্চয়ই আমি জীবনকে জানার উপযোগী একজন কষ্টসহিষ্ণু প্রার্থী। আমার বিশ্বাস আমি সঠিক পথেই সঠিক পদক্ষেপে পথ অতিক্রম করছি_ অজস্র ভুলের পরেও। এখানে সাহায্য করার কেউ নেই একমাত্র আমার প্রভু ছাড়া। আমি জানতে চাই, উদ্ঘাটন করতে চাই, উন্মোচন করতে চাই। জীবনরহস্যের অন্ধকার দিক আলোয় আনতে চাই। নিশ্চয়ই আমাকে সাহায্য করার জন্য কেউ না কেউ থাকবেন, যারা অনেক ত্যাগ স্বীকার করে অনেক অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার উন্মোচন করেছেন। মৃত্যুকে অতিক্রম করেছেন। যদিও মরণের গহ্বর থেকে তারা কেউ পরিত্রাণ পাননি; কিন্তু জীবনকে দিয়ে গেছেন এক আনন্দঘন আবিষ্কারের মর্যাদা।
যারা আগে গেছেন তারা সবই ছিলেন চরিত্রবলে বলীয়ান কষ্টসহিষ্ণু মহামানবের অংশবিশেষ। তাদের সঙ্গে আমার কোনো তুলনা হয় না। আমি দুর্বলচিত্ত, লোভী এবং আরামপ্রিয়; কিন্তু আমার ইচ্ছা কারও চেয়ে কম শক্তিশালী নয়। আমার ইচ্ছার সঙ্গে স্বপ্ন মিশ্রিত হয়েছে। কারণ আমি কবি। সম্পদ আমাকে পথভ্রষ্ট করেনি। আমি দরিদ্র। চিরকাল যেমন, তেমনি আছি। অন্যদিকে আমি সম্পদশালী। কারণ আমি স্বপ্ন নির্মাণ করি। এক নতুন মানবজীবনের স্বপ্ন আমি রচনা করেছি। কাব্যে গন্ধে স্পর্শে তা আমার রচনায় লাবণ্যময় হয়ে আছে। যারা আমাকে জানতে চায় আমি তাদের ভালোবাসা শিক্ষা করতে বলি। অন্যকে ভালোবাসার নামই হলো প্রেম, আবার নিজেকে ভালোবাসার নামও প্রেম।
এভাবেই আমি নানা ভুলের মাঝ দিয়ে আমার আরাধ্য স্থানে এসে পেঁৗছেছি। অনেক মানুষ আর স্মৃতির কোলাহল আমার জীবনের সঙ্গী। কানা চোখে একা বসে জীবনের কথা ভাবি। সবই তো শেষ হয়ে যাবে একদিন। আর সবশেষে মৃত্যুই আমার শেষ ঠিকানা।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আল মাহমুদ- র আরো পোষ্ট দেখুন