কেরানিও দৌড়ে ছিল

কেরানিও দৌড়ে ছিল
কেরানিও দৌড়ে ছিল
কেরানিও দৌড়ে ছিল

৫.
নান্না আর হাকিমদ্দি, কেরানির প্রাণের দুই বন্ধু। সেই কবে হস্তিবাড়ি প্রাইমারি ইশকুলে একসঙ্গে পড়তো তারা, ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় কেরানি যখন জলশ্বেরীর হাই ইশকুলে পড়তে যায়। নান্না আর হাকিমদ্দি তাই বলে কেরানিকে ভোলে নাই। যুবক হয়ে যাওয়ার পরেও যোগাযোগটা থেকে যায়। জলেশ্বরী আরো পরে ঢাকা চলে যাওয়ারও পরে কেরানি যখনই হস্তিবাড়ি আসতো তারা কোথা থেকে খবর পেয়ে আসতো তার কাছে।
তিন বন্ধু মিলে কত গল্প, কত কথার ফুলঝুরি। কেরানি বরাবরই মুখচোরা। গল্পটা বেশির ভাগই করতো নান্না আর হাকিমদ্দি। চোরাচালানের গল্প। কাছেই হরিষাল। হরিষালের ওপারেই ইন্ডিয়া। দুই বন্ধু অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছে বর্ডারের এপার ওপার চোরাচালান করে। কতবার তারা বলেছে, হা রে, কথা শোন্, জাহাজের চাকরিতে তোর উন্নতি হবার নয়। চলি আয় দ্যাশের বাড়ি, তিন বন্ধু একসাথে মিলিলে কারবার আরো জোরদার হইবে। কিন্তু প্রস্তাবটা শুনে প্রতিবারই কেরানি মৃদু হেসেছে মাত্র। তার সাহস হয় নাই। আইনকে বড় ডরায় সে। তবে এটাও তার একদিন কেটে যাবে, আমাদের গোচরেও তা আসবে।
এখন বিয়ের সুবাদে হরিষাল থেকে এসে হাজির নান্না আর হাকিমদ্দি। বিয়ের খবরটা তারা পেয়েছিলো কেরানির বড়বুবুর কাছ থেকে। তোমরা না আসিলে হবার নয়। বাপজান অকমন্য হয়া শয্যায় পড়ি আছে, বাড়িতে আর কোনো ব্যাটাছাওয়া নাই যে করিবে-ধরিবে। এমন অনুনয় কী ফেলা যায়! তাছাড়া বন্ধুর বিয়ে বলে কথা! কেরানি বাড়ি পৌঁছার ঘণ্টাখানেকের ভেতরে দুই বন্ধু বৃষ্টি মাথায় উপস্থিত। তারপর বিয়ের আগের তিনটা দিন তিন বন্ধুর এক মুহূর্তের জন্যে ছাড়াছাড়ি নাই। বিয়ের দিন শুক্রবারে তারাই তো কেরানিকে কী হুটোপাটি করে গোসল দেওয়ালো। গায়ে মাখালো হলুদ, মাথায় ঘষে দিলো সুবাস তেল, তারপর দুই বন্ধু কেরানিকে কোলপাঁজা করে তুলে নিলো।
আরে আরে করেন কি?
আরে বিয়াও বলিয়া কথা! নওশা কি আইজের দিন নিজে হাঁটি কুয়ার পাড়ে যাবার পারে! তাকে কোলে তুলি নেওয়ার কাম!
তারপর বালতি বালতি পানি তুলে ঝুপ ঝুপ করে কেরানিকে গোসল করালো নান্না আর হাকিমদ্দি। আর সেই সঙ্গে গান। গলায় সুর তাল কিচ্ছু নাই, কিন্তু গানের কথা বড় ভালোবাসার ভাবে ভরা। নতুন বৌয়ের সঙ্গে ফুলের শয্যায় মিলনের কথা। বড়বুবু ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছে নতুন পাঞ্জাবি-পায়জামা হাতে নিয়ে। কেরানির ছোটবোন চলে এসেছে কুয়ার পাড়ে। তার লাজলজ্জা নাই। ভাইয়ের গোসল দেখে সে হেসে উঠছে খলবল করে। তার ভারী মজা লেগেছে ভাইকে বাচ্চা ছেলের মতো গোসল করানো দেখে।
কেরানির শরম লাগে। পানির ধারায় নিঃশ্বাসে নাকাল হয়ে সে মুখ তুলে ছোটবোনকে বলে, আরে তুই কেনে হেথায়? তফাত, তফাত যা।
নান্না বলে, থাউক, দেখুক না কেনে! ভাইয়ের বিয়াতে বইনের খুশি, বাধা দেও কেনে?
নিলাজ ছোটবোন। শুধু কি গোসলের সময়ে তার ঘুরঘুর? বাসরঘরেও কান পাতে সে। বেড়ার ফোকরে তার চোখ জুলজুল করে।
বাসর! গোসল শেষে দুই বন্ধু কেরানিকে আবার কোলে করে ঘরের দাওয়ায় এনে দাঁড় করায়। বড়বুবুকে বলে, দেন, জামা আমাদের হাতে দ্যান। আয়না কাঁকই কোনঠে? সেন্ট আছে কি নাই?
বড়বুবু কাঁচুমাচু হয়ে বলে, সেন্ট পামো কোনঠে?
তখন হাকিমদ্দি বলে, মোর ঘরে আছে। আগে খেয়াল হইলে আনি রাখিতোম।
নান্না বলে, যা, ছুটি যা না কেনে? ঘর হতে আনিতে কতক্ষণ!
হাকিমদ্দি সেন্টের শিশি আনতে দৌড় লাগায়। ইন্ডিয়া থেকে বর্ডার পার করে আনা জিনিশপত্রের ভেতরে ঐশ্বরিয়া রায়ের ছবি লাগানো সেন্টের একটা চালান আছে। তার পাইকারি বাকসোর ডালা ছিঁড়ে এক শিশি নিয়ে সে যখন আসে তখন কেরানির গা মুছে তাকে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিয়ে সেরেছে নান্না। পায়ের কাছে নতুন চপ্পল। চপ্পল জোড়াও ইন্ডিয়ার। কোলাপুরি। শক্ত চামড়া। পায়ে দিতেই ব্যথা করে ওঠে কেরানির। নান্না বলে, নউত্তন তো, একজল্লা হাঁটিলেই ঠিক হয়া যাইবে।
সেন্টের শিশি থেকে এক থাবড়া কেরানির ঘাড়ে গলায় জামায় মাখিয়ে দিয়ে হাকিমদ্দি শিশিটা দেখিয়ে বলে, লেবেলে ফটোখান কার চোখ মেলি দ্যাখো! তামাম ইন্ডিয়া ওশ্বরিয়ার উন্মাদ! ফটোখান ভাল্ করি দ্যাখেক না কেনে! তর কইন্যা ইয়ার চায়া কম না!
চপ্পল পায়ে একটু হাঁটতেই আবার শক্ত চামড়ার কামড় বসে পায়ে, আর্তনাদ করে ওঠে কেরানি। হাকিমদ্দি চোখে একটা টুসকি তুলে বলে, আরে! কেঁও করো কেনে? কেঁও তো করিবে তোর বৌ যখন তার ভিতরে যাইবেন! ফজর বিয়ানে সমুদয় কিন্তু হামাক কওয়া লাগিবে।
লজ্জায় মরে যায় কেরানি। হলেই বা প্রাণের বন্ধু_ বৌয়ের সঙ্গে সহবাসের গল্পও কি তাদের কাছে করা যায়! বিশেষ করে এদের তো এখন পর্যন্ত বিয়েই হয় নাই। বিয়ে এমন এক ঘটনা, বিয়ের পর বিবাহিত আর অবিবাহিত বন্ধুর ভেতরে পর্দা একটা তো পড়ে যায়ই। না, না, অতদূর পারবে না কেরানি। বাসরের ঘটনা বন্ধুদের সে বলতে পারবে না।
নাছোড় নান্না বলে, সমুদয়! সমুদয়! সমুদয় কওয়া চাই। কেমন করি শরম তার হরণ করিলে, কেমন করি বুকের উপর উঠিলে, কেমন করি বা তাঁই তোমাকে ভিতরে নিলে ছাড়াছাড়ি নাই।
হাকিমদ্দি প্রতিধ্বনি করে ওঠে, ছাড়াছাড়ি নাই।
মসজিদে বাদজুম্মা বিয়ে পড়ানোর পর বৌ নিয়ে আবার সেই ভ্যানে ওঠে কেরানি। আল্লার দয়া, এ যাত্রায় বৃষ্টি ধরে গেছে। আকাশে মেঘ, ঘন মেঘ, থেকে থেকে বিদ্যুতেরও ডাক চমক, কিন্তু বর্ষণ নাই।
বৌ বাড়িতে নামাবার সময় হাকিমদ্দি কেরানির কানে কানে বলে, রাইতের কালে জোর বিষ্টি হইবে। বাসর তোমার ভালো জমিবে হে!
বাসর! আর বাসর! শরীর হিম হয়ে গেছে কেরানির। কন্যার নাম শুনেই তার শরীর হিম। মদিনা! আল্লার রসুলের বাস ঝেই জাগাতে, রসুলের মজ্জিদের ছবি ঝেই মদিনার থাকে জায়নমাজে, সেই মদিনার নামে নাম কইন্যার শরীর হতে বস্ত্র খুলিয়া নেয় কেমনে? তারবাদে রক্ত গরম করি তার ভিতরে যাওয়া_ এতখান নষ্টামি কি সম্ভব! আল্লা, হামাক কোন্ পরীক্ষায় ফালাইলে তুমি হে তোমার বান্দাকে!
রুহিতনের সঙ্গে গভীর নিশীথে সেই রক্তচঞ্চল করা সাক্ষাত, তারপরে নদী পার হতে হতে কল্পনায় কত ছবি দেখা তার এই সে বৌয়ের মুখে চুমো দিচ্ছে, এই তার বুকের ওপর হাত রাখছে, এই মোচড়, এই বুকের থেকে কাপড় খসে পড়লো, এই সে বৌকে চিৎ করে ফেলে না! আর সে ভাবতে পারে না! বাসরঘরে সে চৌকির ওপর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। মদিনার দিকে তাকাতেও তার সাহস পর্যন্ত হয় না।
ঢাকা থেকে তারই কেনা লালশাড়িতে মদিনা। মাথার ওপর ঘন ঘোমটা। গায়ে তেল ঘাম হলুদের ঝিমঝিম ঘ্রাণ। ঈষৎ কটু আর তীব্র। কেরানির পকেটে হাকিমদ্দি সেন্টের শিশিটা গুঁজে দিয়েছিলো, বলেছিলো_ বৌকে এই বাসনা মাখাইবেন, আর মাখানের ছলে তার মুখে চুমা দিবেন। আহ, এত ওরা জানে কীভাবে? এখনো তো ঘরে তাদের বৌ আসে নাই। তবে কি বর্ডারের ওপারে পল্লীতে তারা যায়? নাকি হরিষাল বর্ডারে যে মাজার আছে, বন্ধ্যা নারীরা সেখানে যায় সন্তানের আশায় আর লোকেরা বলাবলি করে, তাবিজ কবজে নয়, নারী গর্ভবতী হয় পুরুষের কারণে, মাজারেই তার বন্দোবস্ত হয়, নান্না আর হাকিমদ্দি কি সেই বন্দোবস্তের যুবক দুইজন? আর সেই সূত্রেই তারা এত জানী মানী নারীর বিষয়ে?
চৌকির পায়ের কাছে রাখা লণ্ঠনের উর্ধমুখী আলোয় মদিনার মুখখানা নারীর নয় পরীর বলে মনে হয় কেরানির। চোরা চোখে একবার দেখেই ভয়টা ঘন হয়ে ওঠে। একে রসুলের মদিনা, তার ওপর আসমানের পরী! অনেকক্ষণ সে বাক্যহারা গতিহারা হয়ে বসে থাকে।
ঘরের বেড়ার বাইরে কী একটা শব্দ ওঠে। কে যেন বেড়ার ওপরে হঠাৎ হাত রাখলো। কার পিঠে যেন দুম করে কিল পড়লো। চমকে ওঠে কেরানি। তারপর বড়বুবুর চাপা গলায় শাসন নিলাজ নিশরম! সরি আয়!
আ ছি ছি, ছোটবোনটা নিশ্চয় চোখকান পেতে ছিলো বেড়ায়। ভাগ্যিস বৌয়ের গায়ে সে হাত দেয় নাই, বোনটিও কিছু দেখে নাই। বেড়ার ওধারে ছোট্ট একটু হুটোপটির আওয়াজ হয়। তারপর সব শুনসান। না, এখন আর গায়ে হাত দিতে বাধা নাই। বড়বুবু বোনটিকে টেনে নিয়ে চলে গেছে।
ওই হুটোপটির শব্দে মদিনা সচকিত হয়ে কেরানির দিকে একবার চোখ তুলেছিলো। ভয়ার্ত চোখ। বড় বড় চোখ। নারীর চোখ। সে চোখের ভাষা যেন বলতে চায়, তুমিই আমার ভরসা, তুমিই আমাকে অভয় দেবার একমাত্র আপনজন। কিন্তু কোথায় কী! লোকটি মাথা নিচু করে বসেই আছে। একটিবারও তার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না।
তবে কি তাকেই উদ্যোগী হতে হবে? তবে কি এই মানুষটা নারীর বিষয়ে কিছুই জানে না,
বোঝে না, অতএব নারীকেই অগ্রসর হতে হবে? মদিনা শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে। জানান দেয় যে একটা জীবিত মানুষ সে পাশেই বসে আছে। চৌকির ওপর পাতা হাতখানি সে একটু তোলে, মানুষটাকে একটু কাছে ফিরে পেতে।
কিন্তু না। লোকটির লক্ষ নাই।
লক্ষ থাকবে কি, ততক্ষণে কেরানি নিশ্চিত হয়ে গেছে, মদিনা নামে এক নারীকে তার পক্ষে নারী হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তার ভীষণ রাগ হয় মদিনার পিতামাতার ওপর আর নাম তারা পায় নাই! মুসলমান কি নয় তারা! মদিনা কী জানে না তারা!
কেরানি ঘামতে থাকে। না, যৌবনের তাগিদ ব্যর্থ হয়ে যায় দেখে সে ঘামে না। সে ঘামে কারণ, কাল ভোরে যখন নান্না আর হাকিমদ্দি আসবে, বন্ধুর কাছে তারা জানতে চাইবে বাসরের বর্ণনা, কী বলবে সে! তাদের বোঝাতে পারবে সে তার ভয়ের কথা? রসুলের মদিনা স্মরণে তার মন থেকে রস উবে যাবার কথা! তারা তো বুঝবে না!
তাহলে তাকে বানিয়ে বানিয়ে ঘটনা বলতে হবে। কিন্তু নারী সংসর্গ তার জীবনে ঘটে নাই। সেই কোন্ ছেলেবেলায় রুপাইর সঙ্গে একবার, মাত্রই একবার, তাও অসম্পূর্ণ একবার সেই সামান্য মশলায় কি একটা গোটা গল্প তৈরী করা যায়!
তবু গল্প তাকে বানাতেই হবে। মিথ্যা তাকে রচনা করতেই হবে।
মিথ্যা! মিথ্যা!
রাত বাড়ে। লণ্ঠনের তেল ফুরিয়ে আসে। আলো স্তিমিত হতে হতে একসময় দপ করে নিভে যায়। মদিনাও ঘুম ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। মদিনা একসময় কাত হয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। তখন লাফ দিয়ে ওঠে কেরানি। বিস্টম্ফারিত চোখে মদিনাকে দেখে। তার ভয় হয়েছিলো, বুঝি মদিনা নিজেই তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে শুয়ে পড়ে। নইলে তার স্তনের ওপর থেকে কাপড় সরে যায় কেন?
স্তন কি দেখা যাচ্ছে? কিন্তু লণ্ঠন নিভে গেছে। এ ভালোই হয়েছে। আল্লাকে ধন্যবাদ দেয় কেরানি। আল্লা, তুমিই আমার রক্ষাকর্তা। পরক্ষণেই কেরানির মনে হতে থাকে, মিথ্যা বলে যদি রক্ষা পাওয়া যায়, তবে তাতে পাপ নাই। আল্লা সেটা বুঝবেন।
আর, মিথ্যার শুরু কি আগামী ভোর থেকে, যখন তাকে বাসরে স্ত্রী সম্ভোগের গল্প বানিয়ে বলতে হবে সেই থেকে? না। তার মিথ্যা বলার শুরু তো বিয়ের চিঠি পাওয়ার পর থেকেই। লঞ্চের মালিকের কাছে বাবার অসুখ বলে ছুটি নেয়া! ওটা কি মিথ্যার পর্যায়ে পড়ে? না সত্য গোপন করা ওকে বলে?
এটি এক গুরুতর প্রশ্ন পৃথিবীতে। মিথ্যা অথবা সত্য গোপন। একই বিষয়ের দুই ভিন্ন নাম? নাকি বস্তুত তারা আলাদা এবং ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা তাদের? আমরা ক্ষণকালের জন্যে আমাদের জীবন ফিরে দেখি না কেন এবং নির্ণয় করতে চেষ্টা করি মিথ্যা কথন ও সত্য গোপনের স্বরূপ। অচিরেই আমরা দেখতে পাবো মিথ্যা কথন মানেই উচ্চারণ; আর সত্য গোপন মানেই নীরবতা অবলম্বন! এবং এরও প্রকার ও মাত্রা অনেক আমরা দেখতে পাবো।
যেমন, বুলবুল মিয়ার কাছে কেরানি তার বিয়ের কথা গোপন করেছে। ঘুণাক্ষরে জানতে দেয় নাই যে সে বিয়ে করতে দেশের বাড়ি যাচ্ছে। বলেছে বাবার অসুখের জন্যে তাকে দেশে যেতে হচ্ছে। কেরানি যখন বুলবুল মিয়াকে বলে বাবার অসুখ, তখন কিন্তু এটা তার কাছে মিথ্যার উচ্চারণ বলে মনে হয় নাই। কারণ, এর আগে সে লঞ্চে সারেং সুখানিকে, পরে ম্যানেজারকে বাবার অসুখের কথাটা যে বলেছিলো, মিথ্যাটা বারবার উচ্চারণ করার ফলে তার মনে এটি সত্যের আকার ধারণ করে ওঠে। এবং যখন বুলবুল মিয়াকে সে বাবার অসুখের কথা বলে, সে সত্যবোধেই বলে!
যেমন, রুহিতন তার পকেট থেকে বিয়ের ফর্দ চুরি করেছিলো। ফর্দটা পড়ে রুহিতন ভেবেছিলো কেরানি তাকে বিয়ে করবে, তাই এ ফর্দ সে করে রেখেছে, যেন একটু একটু করে গোছাতে পারে। ভুল! রুহিতনের ভুল! ডাহা ভুল! কিন্তু তার সে ভুল কেন ভাঙালো না কেরানি? বরং সে যখন রুহিতনের মুখে মোবাইলে শুনলো, বাবা তাকে বিয়ে দিতে না চাইলে সে কেরানির সঙ্গে পালিয়ে যেতেও রাজী, তখন সে কেন ভুলটাকে আরো পোক্ত করে দিলো? কেন সে তখন গোপন করলো যে তার বিয়ে ঠিক করেছে বাবা মা, তাই সে দেশের বাড়ি যাচ্ছে?
গভীর রাতে, আকাশ ভরা তারার নিচে, নদীর বুকে লাল বিকন বাতির সংকেত ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে চলেছে লঞ্চ, যাত্রীরা সবাই অঘোর ঘুমে, ঠং ঠং শব্দ শুধু লঞ্চের হৃদপিণ্ড থেকে, তখন কেরানিকে ভূতে পায়। সে মোবাইল পকেট থেকে বের করে নম্বরটা দ্যাখে। হ্যাঁ, এই তো, এই নম্বর থেকে সন্ধ্যাকালে ফোন করেছিলো রুহিতন। আহ, রুহিতনের সেই শরীর ঝিম ধরানো কথা আমি তো পলায়া বিয়া বইতে পারুম না। তয় কি আমারে লয়া ভাগনের মতলব করছেন! আমি কলাম তাতেও রাজী।
কেরানির হাতটা যেন আর নিজের দখলে থাকে না। সে একটা ঘোরের মধ্যে পতিত হয়ে ওই নম্বরে কল করে। আহ, কী করো কেরানি! চোর ডাকাত বা মৃত্যুমুখী অসুখ ছাড়া এত রাতে কেউ কাউকে ফোন করে? আর তুমি কিনা যুবক হয়ে এক যুবতীকে ফোন করছো এত রাতে! মনের মধ্যে এইসব সংলাপ একদিকে, অন্যদিকে ফোনের ভেতরে অপর দিকে কল যাবার ট্রিং ট্রিং শব্দ। তারপর হঠাৎ রুহিতনের গলা, ক্যাঠা?
কেরানি তৎক্ষণাৎ ফোনটা কেটে দেয়।
অচিরে কেরানির ফোন বেজে ওঠে।
ফোন করলেন, কাটলেন ক্যালা?
না, মানে হঠাৎ হাত পড়ে গিয়েছিলো।
কন না কী কইতে চাইছিলেন?
রুহিতনের ঘুমভাঙা গাঢ় গলা শুনে মাথার ভেতরে পাখির কলরব হতে থাকে কেরানির। সে বলে, তুমি যে বললে পালাবে এটা বলা ঠিক হয়েছে?
আব্বায় যুদি কয় না বিয়া দিমু না, আর আপনে যদি কন রুইতন তুমারে ছাড়া বাঁচুম না, তাইলে তো পলাইতেই হইবো, নাকি?
কেরানি চুপ।
কথা শুইনা ডরাইছেন?
কেরানি তখনো চুপ।
বাড়ি থিকা ফিরা আব্বার কাছে পরস্তাব দিয়েন। আম্মারে আমি বুঝায়া রেডি রাখুম নে!
কিছুক্ষণ চুপ থেকে, শেষে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কেরনি বলে, আচ্ছা, আমি রাখি।
সে আচ্ছা বলেছিলো কথা শেষ করবার মাত্রাবোধক উচ্চারণ হিসেবে, কিন্তু রুহিতনের কাছে যে সেটা প্রস্তাব উত্থাপনের বিষয়ে তার সম্মতিজ্ঞাপক হতে পারে সেটা বোঝে নাই। জগতে এই রকম কথার ভুল কত যে হয় তার গণনা কে করে? যখন মাশুল দিতে হয়, তখন মাথা কুটতে হয়। এটাও আমরা অতি শিগগিরই দেখতে পাবো।
এখন এই বাসরের রাতে মদিনা যখন ঘুমিয়ে কাদা, আর কেরানি জেগে আছে জন্তুর মতো হামা দিয়ে চৌকিতে, তখন সে মিথ্যা রচনা কিংবা সত্য গোপন, এর ভেতরে কোনটি অবলম্বন করবে ভাবতে থাকে। প্রথমত, নান্না আর হাকিমদ্দিকে বলবে কি, বাসরের রাতে মদিনার সঙ্গে তার কিছুই হয় নাই, নাকি মদিনার কৌমার্য হরণের কাল্পনিক একটা বিবরণ সে খাড়া করবে। দ্বিতীয়ত, যখন সে ঢাকা ফিরে যাবে, রুহিতনকে সে কী বলবে মেয়েটা যখন জানতে চাইবে তার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব সে কবে দেবে? তখন কি সে বলবে, অসুখে বাবার এন্তেকাল হয়ে গেছে, এখন পিতৃদশা আঠারো মাস পার না হলে বিয়ের কথা সে ভাবতে পারছে না। নাকি, একটা মিথ্যে একটা অজুহাত তুলে ঝগড়া বাধিয়ে রুহিতনদের বাড়ি থেকে কেটে পড়বে সে!
ভাবতে ভাবতে কেরানি হঠাৎ এক সত্যের সমুখে পড়ে চমকে যায়। আরে, সহজ পথটাই সে চোখে দেখছে না যে? ঢাকা ফিরে সরাসরি বললেই তো হয়, বাবার অসুখ-টসুখ কিছু না, তাকে মিথ্যে খবর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, আসলে তার বিয়ে ঠিক করা হয়েছিলো, বিয়ে করে ফিরতে হয়। হ্যাঁ, যাবার সময় বিয়ের কথাটা সে গোপন করেছিলো বটে, সেটা ছুটি পাওয়া না-পাওয়ার দোলায় করতে হয়েছিলো, একটু লজ্জা বা সংকোচও করছিলো তার সোজাসুজি বললেই তো ঝামেলা চুকে যেতে পারে!
কিন্তু সোজা কথাটা বলতেই সে বাধা পাচ্ছে মনের ভেতরে। তবে কি সে রুহিতনকে ভালোবেসে ফেলেছে? আর ভালো যদি বেসেইছে তাহলে এখানে এসে বিয়ের কলমা পড়লো কেন? আর কলমা যদি পড়লোই তবে রুহিতনকে নিয়ে এত ভাবছেই বা সে কেন? কে সে? রুহিতন এমন কোন্  রাণী মহারাণী তাঁর জীবনে?
[চলবে]