বিকেলের বেহাগ

এগার
অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না, টেলিফোন বই থেকে নাম্বার নিয়ে খুঁজে পেলেন পুরনো কয়েকজন বন্ধু আর পরিচিতজনকে, যারা ঢাকায় রয়েছে। ৪ জন, তাদের মধ্যে ২ জন সহপাঠী ছিল বিশ্ববিদ্যালয়, ২ জন চাকরিতে সহকর্মী। দাউদকে বলতে সে খুশি হয়ে বলেছে, বেশ তো ডাকেন না তাদের বাড়িতে।বিকালে চা-নাস্তা খাবেন সবাই মিলে। গল্প করবেন।
এরপর বলেছে, শুধু চা-নাস্তা কেন? তারা রাতে খেতেও পারেন।
এনায়েতুল্লা বলেছেন, ডিনার? বেশ ঝামেলা হবে জয়নাবের জন্য। সে বিরক্তও হতে পারে। চা নাস্তাতেই চলবে। আমার উদ্দেশ্য তো তাদের সঙ্গে একত্রিত হওয়া। পুরনো দিনের গল্প করা। সেসব চানা স্তা খেয়েও হতে পারে। এরপর একটু থেমে বলেন, যদি আমাদের মেলামেশাটা নিয়মিত হয়ে যায়, তখন ডিনারের কথা ভাবা যাবে। জানো আমাদের একটা নিয়ম হয়ে গিয়েছিল, এক একজন,কিংবা দু’জন মিলে কোনো হোটেলে কিংবা অফিসার্স ক্লাবে সতীর্থদের রি-ইউনিয়ন হতো। তখন খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকতো। সবাই আসতো সস্ত্রীক।
বেশ কয়েক বছর চলেছিল ওইভাবে আমাদের রি-ইউনিয়ন। এরপর আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল। মনে হয়, বয়স বেড়ে যাওয়ায়, অসুখ-বিসুখের জন্য উৎসাহে ভাটা পড়ে যায়। চমৎকার ছিল কিন্তু সেসব রি-ইউনিয়ন। আমাদের মধ্যে কথা হতো, হাসি-ঠাট্টা চলতো। কেউ কেউ গানও গাইতো।
শুনে দাউদ বলল, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাই অ্যাসোসিয়েশনের রি-ইউনিয়ন হয়। আপনি যাননি কোনোটায়?
এনায়েতুল্লা বললেন, একবার গিয়েছি। অতো লোকের ভিড়ে নিজেদের নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে পারিনি, ফুর্তি করা যায়নি। নিজেদের গ্রুপ ফিলিংটা হারিয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া এলামনাই রি-ইউনিয়নে একটা ব্যাপার হয়, যা আমার পছন্দের ছিল না। কর্মজীবনে যারা বড় পদমর্যাদার হয়েছেন,তাদের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, খেয়াল করা হয়।
এটা বেশ অগণতান্ত্রিক। অ্যালামনাইয়ের সদস্য যারা ছাত্রজীবনে সবাই সমান ছিল, পদমর্যাদার ভেদাভেদ ছিল না। এখন সেটা করলে চলবে কেন? আসরে দু-একজন অ্যালামনাই রি-ইউনিয়নকে নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করছে বলে আমার মনে হয়েছে। তাই ভিআইপিদের আনার, তাদের সম্মাননা দেয়ার দিকে বিশেষ নজর। এখানে একটা মোটিভ খুঁজে পাওয়া যায়। এটা খুব আপত্তিকর। এর জন্য আমি আর পরের দিকে যাইনি।
দাউদ বলল, বাড়িতে কয়জনকে ডাকবেন? তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে?
হ্যাঁ। টেলিফোন বই দেখে ফোন নাম্বার পেয়েছি। ৪ জনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। এরপর একটু অন্যমনস্ক হয়ে দুঃখের সঙ্গে বলেন, অনেকেই নেই।মানে পরলোকগমন করেছেন। টেলিফোন বইতে তাদের নাম আর টেলিফোন নাম্বার রয়েছে। অথচ তারা নেই। কেমন লাগে যেন। ক্রসচিহ্ন দিতে গিয়েও পারলাম না।
দাউদ বলল, থাকুক না নাম আর নাম্বারগুলো যেমন আছে বইতে। ক্রস করার দরকার কি?
এনায়েতউল্লা অন্যমনস্কের মতো বললেন, হ্যাঁ।
তাই। ক্রস করতে হবে কেন? থাকুক যেমন আছে বলে তিনি পুরনো হয়ে যাওয়া টেলিফোন বইটার দিকে তাকালেন। মলাট ছিড়ে গিয়েছে, রঙ চটা।
তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন।
প্রমে এলো জহির, তার সহকর্মী। প্রায় একসঙ্গেই তারা অবসর নিয়েছেন। জহির থাকে উত্তরায়, জমি ডেভেলপারকে দিয়ে ৫টা ফ্ল্যাট পেয়েছে।ছেলেমেয়েদের দিয়েছে তিনটে। একটায় সস্ত্রীক
থাকে নিজে। বাকিটা ভাড়া দিয়েছে। সে এসে বসবার ঘরে বসে বলল, করেছো কি ভায়া?
কেন, কি করলাম? এনায়েতুল্লা তাকান তার দিকে।
জহির অবাক হওয়ার মতো করে বলল, বাড়িটা আগের মতই রেখেছো। ডেভেলপারকে দাওনি।গোল্ডমাইনের ওপর বসে আছো। জানো তো?
জানি। বাড়িটা ভাঙতে চাই না। আমার জীবদ্দশায় না। এর সঙ্গে আমার স্ত্রীর স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
কিন্তু এক সঙ্গে অনেক টাকা পেতে। ক্যাশ দেবে কম করে হলেও ১০-১৫ কোটি। কিংবা তারও বেশি।আর এখন তো ৬ তলা না, ৯তলা করতে দিচ্ছে তার
থেকে কম করে হলেও ৮টা ফ্ল্যাট পাবে। রাজার হালে থাকবে।
এতো টাকা!এনায়েতুল্লা নির্বিকার হয়ে বললেন, ইউএন সিস্টেমে কাজ করে অনেক টাকা পেয়েছি। তাইই যথেষ্ট।
আমার আর টাকার দরকার নেই।
জহির বলল, এই প্রম শুনলাম কেউ বলছে টাকার দরকার নেই। ভেরি রেয়ার। একথা শোনা যায় না আজকাল। বলে সে চারদিকে দেখে। এরপর বলে,সোফাসেট, কার্পেট সব নতুন দেখা যাচ্ছে। রিটায়ার্ড লোকের বাড়ি বলে মনে হচ্ছে না। ফ্লাওয়ার ভাঁজে ফুলও দেখছি, কাট ফ্লাওয়ার। না, তুমি ঠিকই আছো মনে হচ্ছে। লাইফ এনজয় করছো।
এনায়েতুল্লা বললেন, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের কৃতিত্ব আমার নাতনির। সে ফেং সুই অনুযায়ী,আমার ঘর, বসবার ঘর সাজিয়েছে। নতুন ফার্নিচার আনিয়েছে দোকান থেকে অর্ডার দিয়ে। তার টেস্ট আছে। এরপর যোগ করেন আমার বউমারও টেস্ট ভালো। মায়ে-মেয়ে মিলেই করেছে সব।
তুমি বেশ লাকি। বউমা, নাতনি তোমার দেখাশোনা করছে। আমার কপাল অতো ভালো না। আমরা বাপ-ছেলেমেয়ে সব এক বিল্ডিংয়েই থাকছি। কিন্তু হলে হবে কী আমাদের মধ্যে খুব একটা দেখা হয় না,মানে নিয়মিতভাবে না। সপ্তাহে একবার কী দুইবার দেখা হয়।
এনায়েতুল্লা অবাক হয়ে বলেন, বলো কী ছেলেমেয়েরা এত ব্যস্ত থাকে? নাতি-নাতনি তাদেরও সময় হয় না?
জহির বলে, তারা আসে। বললাম না সপ্তাহে একদিন কী দুই দিন। বিশেষ করে ছুটির দিন। সবাই ব্যস্ত থাকে নিজের কাজে। তাই আমরাও মাথা ঘামাই না।চাকর-বাকর নিয়ে ভালোই আছি। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
সময় কাটাও কী করে ভায়া? এনায়েতুল্লা তাকান জহিরের দিকে।
আরে সময় কাটানো এখন কোনো সমস্যা নাকি? এক টিভি খুলেই তো সারাদিন-সারারাত কাটানো যায়।এরপর আছে ডিভিডির সিনেমা। সিডির গান।বুঝলে আমি অনেক ভিডিও কিনেছি।ছাত্রজীবন থেকেই সিনেমা দেখার নেশা। এখন চুটিয়ে সিনেমা দেখছি।সূচিত্রা-উত্তম? দিলীপ কুমার-নার্গিস?
দূর! এসব তো পুরনো। এখন মজা লাগে না। আমি দেখি হালফিল যেসব বই বেরুচ্ছে বলিউড থেকে।তিসমার খান। ক্যাটরিনা কাইফ যা নাচে না! তার আইটেম গান শিলা কি জওয়ানী দেখেছো, মানে শুনেছো? না দেখে থাকলে দেখবে। দারুণ এন্টারটেইনিং। মল্লিকা সেরাওয়াত, বিপাশা বসুকে হার মানিয়েছে। সে আর অক্ষয়কুমার দারুণ জুটি।কী সব নাচে তারা। নতুন নায়িকা দীপিকা পাড়–কোনও বেশ ভালো। দারুণ লেগ তার। লেগ?লেগ মানে পা। দীর্ঘ, সরু পা। মারলিং ডিএট্রিস আর বেটি গ্রেবলকে হার মানায়। ভেরি সুইট। হাসলে গারে টোল পড়ে। আমার খুব ফেভরিট। অবশ্য,বেমানান ভূমিকাতেও নামছে মেয়েটা। ‘খেলে হাম জি জান সে’ বইতে শাড়িপরা তাকে একটুও ভালো দেখায়নি। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ভূমিকায় তাকে
একটুও মানায়নি। প্রডিউসাররা যে কি করে!
এনায়েতুল্লা হা করে শোনেন। এরপর বলেন, তুমি তাহলে টিভিতে সিনেমা দেখেই সময় কাটাচ্ছো বেশিরভাগ।
জহির সোফায় আরাম করে বসে বলল, শুধু সিনেমা কেন, ফ্যাশন চ্যানেলে মডেলদের দেখি। ইন্ডিয়ান আইডল কমপিটিশন দেখি। এরপর প্রশংসার স্বরে বলে, যাই বলো ইন্ডিয়ান মেয়েরা খুব সুন্দরী হয়ে উঠেছে, আর রূপের পরিচর্যাও করে বেশ। দেখো না পরপর কয়েকজন মিস ওয়ার্ল্ড হলো। ইন্ডিয়ায় মেয়েদের বিউটিরচর্চা একটা বড় ইন্ডাস্ট্রি হয়ে উঠেছে। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী ব্যবহার করে কালো মেয়েরা সাদা হচ্ছে। বোটেক্স না কী যেন বলে সেসব অপারেশন করে মেদ কমিয়ে ফেলছে। এরপর স্বর নামিয়ে সে বলে, কসমেটিক সার্জারি করে স্তনও সোজা রাখছে। দারুণ।
এনায়েতুল্লা সচকিতে ভেতরের দরজার দিকে তাকালেন। কেউ শুনছে কিনা দেখলেন। না, কেউ নেই, দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে কি কেউ জহিরের এসব কথা শুনতে পাচ্ছে না? তিনি প্রসঙ্গ বদলাবার চেষ্টা করলেন; পারলেন না।
জহির বলতে থাকলো, টিভিতে ফ্যাশন চ্যানেলটা চমৎকার ছিল। কত সুন্দরী মেয়েদের দেখা যেতো। প্রায় নেকেড, স্তন উন্মুক্ত রেখে তারা ক্যাটওয়াক দিয়ে হেঁটে যেত। নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনারদের পোশাক পরে দেখাতো। অদ্ভূত সেসব পোশাক।কিন্তু আমি তো আর পোশাক দেখতাম না, দেখতাম টপলেস মেয়েদের। একজনের চেয়ে একজন সুন্দরী। কী সব ফিগার। বলে জহির মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, এরপর হতাশ স্বরে বলে, এমন চমৎকার চ্যানেলটা বন্ধ করে দিলো। সরকারের কি আর করার কিছু নেই? নির্মল আনন্দ পাচ্ছিলাম সেটাও বন্ধ হয়ে গেল।
এনায়েতুল্লা অবাক হয়ে শোনেন সহকর্মী জহিরের কথা। এরপর জিজ্ঞেস করেন, আপনার স্ত্রী কিছু বলেন না? এসব দেখেন যে।
জহির হেসে বলে, কি বলবে? কেন কিছু বলতে যাবে? দেখার জন্যই তো প্রোগ্রামটা হয়। হতো।
তবু। নেকেড মেয়েদের দেখা। পর্নোগ্রাফির মতো হয়ে যাচ্ছে না?
না, না। তা হবে কেন? ইন্টারকোর্স তো দেখাচ্ছে না। শুধু মডেলরা তাদের বডি দেখাচ্ছে। একটু টিটিলেশন হচ্ছে, তার বেশি কিছু না। এরপর জহির হেসে বলে, আজকাল হলিউডের প্রায় বইতেই নায়ক-নায়িকা কথায় কথায় বিছানায় শুয়ে পড়ে।সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে। ইন্টারকোর্সের দৃশ্য দেখায়;অবশ্য সেটা দর্শকদের দেখানো, আসলেই না। তবু অবিকল তাই মনে হয়। দেখোনি তুমি এ ধরনের ছবি? ‘বেসিক ইনসটিঙ্কট’ সিনেমায় শ্যারন স্টোন আর মাইকেল ডগলেসের বেড সিন দেখে পর্নোগ্রাফি বলে মনে হবে। কিন্তু আমেরিকায় কিংবা কোথাও সেটা ব্যানড হয়নি। আর ফরাসি সিনেমার তো কথাই নেই, সেখানে অনেক আগেই ব্রিজিত বার্দো এ ধরনের খোলামেলা দৃশ্যে অভিনয় করেছে। সিনেমায় এখন এসব ডাল-ভাত হয়ে গিয়েছে।
এনায়েতুল্লা জহিরের দিকে তাকালেন। তার মনে হলো জহির মার্কেসের আর কাওয়াবাতার মতো রিপুতাড়িত হয়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে যাওয়ার মতো লোক। বেশ ওভারসেক্সড তার জেনেটিক কোড,
জেনোম আলাদা। বোঝা যাচ্ছে, বায়োলজিক্যালি তিনি তার থেকে অনেক দূরে। বৃদ্ধ বয়সেও যৌনতা জহিরকে আকর্ষণ করে, তার মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। হয়তো কামবোধও। এর পেছনে যে ব্যাখ্যা তা তার জানা আছে, জেনেটিক। তার জন্যই তিনি জহিরের নিন্দা করতে পারেন না। তিনি নিজে ভিন্ন স্বভাবের আর প্রবণতার বলে সবাই তেমন হবে এমন মনে করা যায় না। যা তার জন্য স্বাভাবিক জহির তাই করছে। এটা সমালোচনার বিষয় হতে পারে না যতক্ষণ না সে পাবলিক নুইসেন্স ক্রিয়েট করছে।তেমন হয়েছে বলে তার মনে হয় না।
জহির বলল, তুমি সময় কাটাও কি করে?
এনায়েতুল্লা বললেন, নাতনির সঙ্গে কথা বলে। সে আমাকে অনেক সময় দেয়। আমার ঘর, এই বসবার ঘর সে ফেং সুই অনুযায়ী, সাজিয়ে দিয়েছে। এখন ফেসবুকে অনেক পুরনো বন্ধুদের খুঁজে বের করতে সাহায্য করছে। এ ছাড়া বইপড়া আর গান শোনা তো আছেই। আমার সময় কেটে যায়, ভারি হয়ে ঝোলে না।
ফেসবুক! সে তো অল্প বয়সীদের জন্য। তুমি তারমধ্যে ঢুকে পড়লে কেন?
এনায়েতুল্লা বললেন, হ্যাঁ। আমিও প্রমে তাই ভেবেছি। এখন দেখছি এটা সব বয়সের মানুষের কাজে লাগতে পারে। সময় কাটানোর চমৎকার উপায়। ঘরের বাইরে না গিয়েও সামাজিক হওয়া
যায়।
জহির বলল, আমার নাতি-নাতনিরা ফেসবুক ব্যবহার করতে বলেনি। তারা হয়তো নিজেরা করে। আমার অবসর কাটানো নিয়ে তাদের কারো মাথা ব্যথা নেই। তারা জানে যে, আমি সিনেমা দেখার পোকা।
এনায়েতুল্লা বললেন, বই পড়তে পারো। গান শুনতে পারো।
জহির বলল, কি বই পড়বো এই বয়সে? তুমি কি বই পড়ো?
উপন্যাস। ইতিহাস। আত্মজীবনী। রাস্তায় ট্রাফিক আইল্যান্ডে লালবাতি জ্বললেই হকাররা বুকের ওপর পেপার ব্যাকের স্ট্যাক নিয়ে গাড়ির জানালার কাছে আসে। পাইরেটেড কপি, বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই। সুন্দর ছাপা, বাঁধাই। আর সস্তাও। ২০০ টাকা, বড়ো জোর ৩০০ টাকা নেয়।একটু দরাদরি করতে হয়। আমি রাস্তার হকারদের কাছ থেকেই বই কিনে পড়ি আজকাল। নিউমার্কেট কিংবা আজিজ সুপারমার্কেটে বই কেনার ঝামেলায় যাই না। এরপর বললেন, শুনলাম আজিজ
সুপারমার্কেট এখন আস্তে আস্তে ফ্যাশনের, কাপড়-চোপড়ের দোকানে ভরে গিয়েছে। বইয়ের দোকান প্রায় উঠেই যাচ্ছে। যাবে না কেন, শিক্ষিতরাও বইপড়া ছেড়ে দিচ্ছে। কয়েকজন পড়ে?
জহির বলল, বইপড়া ভালো অভ্যাস। সময় ভালোভাবে কাটে। কিছু শেখাও যায়। কিন্তু আমার বইপড়ার ধৈর্য্য নেই। কয়েক পাতা পড়ার পরই ক্লান্তি আসে। মলাট বন্ধ করে মুখে হাই তুলি।
এনায়েতুল্লা স্বর নামিয়ে বলেন, মাঝে মাঝে দুইএকটা বই বিক্রি করে হকাররা যা প্রায় পর্নোগ্রাফির মতো।
জহির কৌতূহলী হয়ে বলে, তাই? কামসূত্রও বিক্রি করে।
কামসূত্র বিক্রি করতে দেখিনি। বলেন এনায়েতুল্লা। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক মার্কেজের একটা বই কিনলাম তাদের একজনের কাছ থেকে। পড়ে দেখি প্রায় পর্নোগ্রাফির মতো। তবে সাহিত্যগুণও আছে বইটাতে। সেটা বোঝা যায়। বইটা আমি তোমাকে পড়তে দেবো। তোমার ভালো লাগতে পারে।
জহির বলে, ‘কামসূত্র’ সিনেমা করেছে। অভিনেত্রী রেখা আছে একটা চরিত্রে। না, না সে কোনো পোজ দেয়নি। তার ভূমিকা শিক্ষিকার। বেশ হয়েছে,বইটার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয়। পারলে দেখবে।
আমি প্রায়ই দেখি। তবে সেদিন একটা সিনেমা দিল ডিভিডি বিক্রেতা । ওরা বয়স্কো লোক দেখলেই ভাবে, ব্লুফিল্ম খজুঁছে। সিনেমাটা পসোলিনি না কি যেন এক ইটালিয়ান পরিচালকের তৈরি। জঘন্য।সমকামিতার ওপর এমন বাজে সিনেমা হতে পারে,তা জানা ছিল না। ইউরোপে এ ধরনের বই দেখানো হলো কেমন করে? আমি নীতিবাগিশ না, সেক্সসিন উপভোগ করি, কিন্তু ওই ব্যাপার বইটা দেখে ঘৃণায় আমার শরীর কুঁচকে যাচ্ছিল। শুনেছি ব্যাটাকে সমকামীরাই নাকি ছুরি মেরে হত্যা করেছে। আমি খুন-খারাপি পছন্দ করি না, তবে পাসোলিনি মিয়ার পরিণতিতে দুঃখিত হইনি।
এনায়েতুল্লা বললেন, তুমি তাহলে যাকে বলে হোমোফোব। সমকামী বিদ্বেষী। কাগজে মাঝে মাঝে পড়ি, বিদেশে উগ্র দক্ষিণপন্থীরা প্রায়ই হোমোফোব হয়। যারা হোমো বা গে তাদের পারলে মেরে
ফেলে।
জহির বলল, এই গে গুলো সেক্স ব্যাপারটাকে বিশ্রি আর জঘন্য করে ফেলেছে। আই হেট দেম। সেক্স মানেই পুরুষ আর মেয়ে। সেটাই ন্যাচারাল।
এনায়েতুল্লা হেসে বললেন, ঠিকই বলেছি। তুমি পুরোপুরি হোমোফোব। পলিটিকালী কারেক্ট বলতে যা বোঝায়, তা হতে পারবে না।
জহির কিছু বলতে যাচ্ছিল। এ সময় ঘরে ঢুকলো আজিজ জোয়ার্দার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এনায়েতুল্লার সহপাঠী। বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনা শেষে অবসর নিয়েছে। সে ঘরে ঢুকে কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, দেরি হয়ে গেল। আজও শেয়ার মার্কেটে ধস। আমার অনেক টাকা লস্।
এনায়েতুল্লা তার সঙ্গে জহিরের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
জহির বলল, কাগজে মাঝে মাঝে আপনার প্রবন্ধ পড়ি। আপনি তো মনে হয় স্টক মার্কেট বিশেষজ্ঞ। আপনার লস্ হবে কেন?
আজিজ জোয়ার্দার বলল, ওস্তাদদেরও হারাবার মতো সাগরেদ আছে। স্টক বাজারটা এখন বুঝলেন একটা র‌্যাকেট। কয়েকজন মিলে সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। তারাই শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। সবাই জানে তাদের কথা। কিন্তু কিছু বলছে না। কোনো স্টেপ নিচ্ছে না।
কেন, কোনো স্টেপ নিচ্ছে না কেন? জহির তাকায় তার দিকে।
হয়তো রাজনৈতিক বিবেচনায়। স্টক মার্কেটে যারা বড় প্লেয়ার, তারা রাজনীতিতেও অংশ নিচ্ছে,ফাইন্যান্স করছে পার্টিগুলোকে। তাই যখন যে দলই পাওয়ারে আসে, তাদের এসব সমর্থক
ফটকাবাজারিদের বিরুদ্ধে কিছু বলে না। বললেও কোনো অ্যাকশনে যায় না। মাঝখান থেকে নিরীহ মধ্যবিত্ত বিনিয়োগকারীরা মার খাচ্ছে।
জহির বলল, আপনি যাদের নিরীহ বললেন, দেখা যায়, সেসব বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই যুবক বয়সের।তারা শেয়ার মার্কেটে লস্ হলেই বেশ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে। দোকানপাট, গাড়ি ভাংচুর করে। কাগজেই দেখি, পড়ি। তাদের প্রতি আমার সহানুভূতি নেই।জেনেশুনে কেন আগুনে হাত দিতে যাও?
জোয়ার্দার বলে, আমারও সহানুভূতি নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারি, তাদের রাগের কারণ। সামান্য পুঁজি জোগাড় করে তারা শেয়ারবাজারে নেমেছে কিছু আয় করতে। বেকার ছেলে সব, অন্য কোনো আয়ের পথ না পেয়েই শেয়ার মার্কেটে এসেছে।যখন সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, কষ্টের টাকা হারায় তখন তারা মাথা ঠিক রাখতে পারে না। সংযম থাকে না। উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে। এটাই ব্যাখ্যা। সমর্থন না করলেও তারা কেন এমন করছে তা বুঝতে হবে।আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দৃষ্টিতে ব্যাপারটা দেখলে চলবে না। এরপর একটু থেমে বলে, আমার ক্ষতি
আমি পুষিয়ে নিতে পারি। আমার পুঁজির হাত বড়।আমি অপেক্ষা করতে পারি। কিন্তু ওরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে না। যখন সর্বস্বান্ত হয় তখন রাস্তায় নামা ছাড়া উপায় থাকে না।
আপনার কত ক্ষতি হলো এ পর্যন্ত? জহির জানতে চায়। এনায়েতুল্লা দু’জনের আলাপ মনোযোগ দিয়ে শুনছেন।
আজিজ মনে মনে হিসাব করে বলে, ৭-৮ লাখ হবে।
৭-৮ লাখ অনেক টাকা। একজন ফিক্সড ইনকামওলার জন্য। আপনি এসব কেন করেন?সেভিংস সার্টিফিকেট কিংবা ফিক্সড ডিপোজিট কিনলেই পারেন।
আজিজ সোফায় হেলান দিয়ে বসে গায়ের হালকা কোটটার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, নেশা।বুঝলেন। শেয়ার মার্কেটে খেলা অনেকের মতো আমার কাছেও একটা নেশা। এখানে অনিশ্চয়তা
আছে, রিস্ক আছে। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মধ্যে এক ধরনের মাদকতা আছে। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলি ব্যাপারটা বেশ সেক্সি।
জহির কিছু বলার আগেই এনায়েতুল্লা হেসে বললেন,আমার বন্ধু জহির এ ব্যাপারে কিছু মনে করবে না।
এরপর পেছনের দিকে তাকিয়ে উঁচু গলায় ডাক দিয়ে বললেন, কই রে রাজু। কোল্ড ড্রিঙ্ক আনছিস না কেন? গেস্টরা কখন এসে গিয়েছে।
একটু পর রাজু এসে ঘরে ঢোকে। তার হাতের ট্রেতে সেভেনআপ, কোকাকোলা, টমাটো আর অরেঞ্জ জুসের গ্লাস। কাঠের রেকাবিতে চানাচুর আর বাদাম। গ্লাসের ভারে তার হাত কাঁপছে। দেখে
এনায়েতুল্লা বললেন, এত গ্লাস এক সঙ্গে এনেছিস কেন? রাখ, টেবিলের ওপর রাখ।
আজিজ জোয়ার্দার ট্রের ড্রিঙ্কগুলো দেখে বলল,এইই? এতদিন পর তোমার বাড়িতে ডাকলে বন্ধু,বললে রি-ইউনিয়ন হবে। এখন দেখছি শিশুদের ড্রিঙ্ক খাওয়াতে চাও। এভাবে রি-ইউনিয়ন হয়?
মুডই ক্রিয়েট হবে না।
এনায়েতুল্লা অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, আমি কোনোদিন হার্ড ড্রিঙ্ক টাচ করিনি।
আজিজ বলল, তুমি করোনি ঠিক আছে। কিন্তু আমি করি। হয়তো তোমার এই বন্ধুও করেন। আরো যারা আসবে সেসব বন্ধুদের মধ্যেও কেউ কেউ করতে পারেন। তাদের কথা ভাববে না? এটা কেমন হসপিটালিটি?
এনায়েতুল্লা বললেন, মনে হচ্ছে তুমি রেগুলার।একদিন না হয় নাই খেলে। নিশ্চয়ই অ্যাডিক্ট হয়ে যাওনি।
আজিজ টমাটো জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে বলল,থ্যাঙ্কস গড, হইনি। তবে একটা টায়ারিং দিনের শেষে আই লুক ফরওয়ার্ড টু এ গ্লাস অব হার্ড ড্রিঙ্কস। রিলাক্স করতে বেশ সাহায্য করে।
এনায়েতুল্লা জহির আর আজিজকে দেখেন মৃদু হাসি মুখে নিয়ে। আজিজের কথায় তিনি বিব্রত হননি,কিন্তু কিছুটা অপ্রস্তুত। আজিজ তাদের সময় ভালো ছাত্র হিসেবে খুব নাম করেছিল। কালি নারায়ণ স্কলারশিপ পেয়েছিল অল ফার্স্ট ক্লাস। বিদেশ গিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছে। অধ্যাপনায় নাম করেছে।কিন্তু কোনো বইটই লিখেছে বলে তিনি শোনেননি।কাগজে মাঝে মাঝে সাধারণভাবে কিছু লেখে। আর কনসালটেন্সি করে।
জহির বলল, আচ্ছা শেয়ার মার্কেটের এই টালমাটাল অবস্থা, ওঠাপড়া চলতেই থাকবে? সিকিউরিটিজ এক্সচেইজ কমিশন কি করছে?
আজিজ বলল, করছে। আবার করছেও না। এরপর বলল, রেগুলেটরি কমিশন থাকলেই হলো না, তার পেছনে পলিটিকাল কমিটমেন্ট থাকা দরকার।আপনি কী মনে করেন, আমেরিকায় রেগুলেটিং অথরিটি, আইন-কানুন ছিল না? অবশ্যই ছিল,এখনো আছে। কিন্তু তারা ২০০৮-এর ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস বন্ধ করতে পারেনি। অনুমানই করেনি।সাব-প্রাইম হাউসিং মর্টগেজ দিয়ে শুরু হলেও সমস্যা তো সৃষ্টি করেছে বন্ড আর শেয়ার বিক্রি করে যারা সেসব ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি। মেরিল লিঞ্চ,সলোমন ব্রাদার্স এসব। রেগুলেটররা কী জানতো না যে, এসব কোম্পানি কীভাবে হাউসিং লোনকে সিকিউরিটাইজ করে বন্ডের পর বন্ড বানাচ্ছে আর বাজারে বিক্রি করছে। জানতো, জেনেও না জানার ভান করেছে। তারাও এর সঙ্গে জড়িত। ভবিষ্যতে
চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ওই সব কোম্পানিতে যোগ দেবার সম্ভাবনা নষ্ট করতে চায়নি।
এনায়েতুল্লা বললেন, তুমি তো সারাজীবন এই নিয়েই লেখাপড়া করেছো। ক্লাসে পড়িয়েছো। অনেক কনসালটেন্সিও করেছো। শেয়ার মার্কেটের এই সমস্যা বন্ধের জন্য কর্তৃপক্ষকে কিছু বলোনি কেন?
বলেছি। কিন্তু কার গরু, কে দেয় ধুয়ো। অরণ্যে রোদন বলে আজিজ টমাটো জুসের গ্লাস ঠোঁটের কাছে তুলেছে। এরপর বলেছে, নো রিস্ক, নো গেইন। যারা প্লেয়ার, তাদের এটা ভালো করে
জানতে হবে। তবে হ্যাঁ, তাদের পক্ষে সিন্ডিকেটের কারচুপি ঠিক সময় বোঝা সম্ভব না।
জহির বুকের ওপর হাত রেখে বলল, আমারও কোট কিংবা গরম কিছু পড়ে আসা উচিৎ ছিল। হেমন্তেই শীত পড়ে গেল মনে হয়।
এনায়েতুল্লা বললেন, ক্লাইমেট চেঞ্জ। সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে।
একটু পর এলো খবিরউদ্দিন, এনায়েতুল্লার সহকর্মী। সে জহিরের পরিচিত, কিন্তু আজিজ তাকে আগে দেখেনি। তার সঙ্গে আজিজের পরিচয় করিয়ে দিলেন এনায়েতুল্লা। খবির উদ্দিন পড়েছেন সাদা পাজামা, খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি। কাঁধে ঝুলছে শান্তিনিকেতনি ঢঙের কাপড়ের ব্যাগ। তার মাথার চুল সব সাদা। লম্বা মুখ আর তীক্ষ চোখের জন্য তার বয়স বেশ কম দেখাচ্ছে। বয়স অনুযায়ী বেশ শক্ত-সমর্থও সে, এখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সে সামনে গিয়ে সোফায় বসে তার ব্যাগ থেকে একটা নোটবই বের করলো। সবাই তার দিকে তাকিয়ে।
এনায়েতুল্লা বললেন, টেলিফোনের বই মনে হচ্ছে ? আপডেট করতে চাও বুঝি?
খবিরউদ্দিন বলল, এটা কবিতার খাতা। আমি আজকাল কবিতা লিখছি। অজস্র কবিতা। বন্যার পানির মতো হুড়মুড় করে যাচ্ছে। রাতদুপুরেও ঘুম ভেঙে গেলে উঠে বসে কবিতা লিখি। ঘুমের মধ্যেই কবিতা এসে যায়।
এনায়েতুল্লা ডাক্তারের মতো ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করেন,কবে থেকে এমন হচ্ছে?
খবিরউদ্দিন নোটবইয়ের খাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল, ইদানীং। বলতে পারো অবসর নেয়ার পর।আগে কবিতা পড়ায় তেমন আগ্রহ ছিল না। লেখার তো প্রশড়বই ওঠে না। কিন্তু গত এক বছরে প্রচুর কবিতা পড়েছি। এরপর লেখা শুরু হয়েছে।অটোমেটিক্যালি।
ছাপাচ্ছো না কেথাও? কোনো কাগজে কিংবা ম্যাগাজিনে? এনায়েতুল্লা জিজ্ঞাসা করেন।
পাঠিয়েছি। কিন্তু কেউ ছাপায় না। আমার এক প্রতিবেশী বললেন, কাগজের অফিসে গিয়ে তদবির করতে হবে। আচ্ছা বলো, এই বয়সে তদবির করা যায়? তাও কবিতা ছাপানোর জন্য? হাসির ব্যাপার বটে বলে খবিরউদ্দিন হাসে।
জহির বলল, শুক্রবারের কাগজ খুললেই পাতাভর্তি কবিতা দেখি। বিশেষ সংখ্যা হলেও তো কথাই নেই। কয়েক পাতা জুড়ে থাকে। এরপর সে আজিজ জোয়ার্দারের দিকে তাকিয়ে বলে, আমাদের দেশে কয়জন কবি হবে? হিসাব করেছেন কখনো?
আজিজ হেসে বলে, না। করিনি। কবিদের নিয়ে কোনো কনসালটেন্সি হয়নি এ পর্যন্ত। মনে হচ্ছে,জিডিপিতে তাদের কনট্রিবিউশন নেই। থাকলেও সেটা হাউসওয়াইফদের মতো হিসাবের বাইরে
থেকে যাচ্ছে।
জহির বলে, তরুণ বয়সে সবাই কবিতা লেখে।এটাই আমার ধারণা। এরপর অনেকেই ঝরে পড়ে।কিন্তু যতক্ষণ তারা লেখালেখি করে, বেশ হৈ চৈ শোনা যায়, সভায়, কনফারেন্সে আবৃত্তি করে দল বেঁধে। কবিতা এখন একটা পারফরমেন্স আর্ট হয়ে গিয়েছে। মন্দ না। কালচারাল ডাইভারসিটি থাকা দরকার।
আজিজ বলে, কবিতা লেখা কি সহজ হয়ে গিয়েছে?মানে যে কেউ ইচ্ছা করলেই লিখতে পারে? না হলে এত কবি দেখা যায় কেন?
জহির বলে, জিজ্ঞাসা করেন কবিকে। শোনা যাক,ফ্রম দ্য হর্সেস মাউথ।
খবিরউদ্দিন বলে, মনে ভাব আসলেই কবিতা লেখা যায়। ভাবটাই আসল।ছন্দ, ভাষা? জহির তাকায় তার দিকে।
খবিরউদ্দিন বলে, যারা ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় তাদের কবিতায় সেসব গুরুত্ব পায়। আবার সহজ করেও লেখা যায়। না হলে আমি লিখছি কি করে?
এরপর সে খাতা খুলে বলে, শোনো কী লিখেছি কাল গভীর রাতে। ঘুম ভেঙে গেল। মনে পড়লো, আজ বিকালে আমরা কয়েকজন পুরনো বন্ধু মিলিত হবো এখানে। অনেকদিন পর আমাদের দেখা হবে।এরপর হয়তো আর হবে না। হলেও অনেকদিন পর,এই বাড়িতে না, অন্য কোথাও। মনে হতেই কবিতাটা তৈরি হয়ে গেল, লাইনের পর লাইন।টেবিলে বসে একটানা লিখে গেলাম। দাঁড়াও পড়ে শুনাচ্ছি। এরপর সে কবিতাটা পড়ে শুনালো। পড়া শেষ হলে সবাই হাততালি দিল।
এনায়েতুল্লা খুশি হয়ে বললেন, আমার এই ক্ষুদ্র আয়োজন যে তোমার মনে কাব্যরস সৃষ্টি করেছে তার জন্য আমি খুবই আনন্দিত। তোমাকে ধন্যবাদ জানাই।
তার কথা শেষ হতে না হতেই খবিরউদ্দিন পাতা উল্টিয়ে আরেকটা কবিতা বের করে বলে, শোনা তোমাদের এই কবিতা পড়ে শুনাই। এটা আমার ছোট নাতির জন্মদিন উপলক্ষে লেখা। বলে সে কবিতাটা পড়ে শোনালো সবাইকে। এবারো কবিতা পড়া শেষ হলে হাততালি দিল সবাই। উৎসাহিত হয়ে খবিরউদ্দিন বলে, আমার একবার সর্দিকাশি হয়েছিল, বিছানায় শুয়ে শুয়ে লিখেছিলাম একটা কবিতা। পড়ে শোনাচ্ছি। বলে সে খাতার পাতা উল্টিয়ে আরেকটা কবিতা পড়ে শোনায়। তিনজন শুনতে শুনতে একে অন্যের মুখের দিকে তাকায়।
কবিতা পড়া শেষ হলে জহির বলে, সব একদিনে পড়লে হবে কেন? আমাদের এই রি-ইউনিয়ন তো চলতেই থাকবে, চক্রাকারে। পরবর্তী রি-ইউনিয়নের জন্য রেখে দাও ভায়া কবিতাগুলো। এখন অন্য বিষয়ে আলাপ করা যাক। তোমার পরিবার সম্পর্কে কিছু বলো। কয় ছেলেমেয়ে, তারা কোথায়, কী করছে। এসব বলো। আমাদেরটাও শোনো। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে থেকে আমাদের পরিবার সম্পর্কে কেউ কিছু জানি না। আমাদের ছেলেমেয়েরাও জানে না আমাদের কথা। এর জন্য আমরাই দায়ী।
খবিরউদ্দিন অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাতা বন্ধ করে। এরপর সবার দিকে তাকিয়ে বলে, দুই ছেলে এক মেয়ে।সবাই বিদেশে। মাঝে মাঝে দেশে আসে। ভালোই আছে তারা। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুই-তিনবার গিয়েছি বেড়াতে। এখন আর ভালো লাগে না। লং জার্নি।ওখানে গিয়ে এক সপ্তাহ পর সময় কাটানো কঠিন হয়ে পড়ে। টিভির সামনে কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়? আর সাবার্ব মানেই তো নির্বাসনে থাকার মতো,যদি না নিজে গাড়ি চালাতে পারো আর গাড়ি থাকে। যাই বলো, আমাদের দেশটা কিন্তু বয়স্কদের জন্য খুবই উপযোগী। মোটামুটি টাকা-পয়সা থাকলে খুব
ভালোভাবেই থাকা যায়। বিদেশ হলো ইয়ংম্যানদের জন্য। থাকুক তারা সেখানে, নিজেদের ভাগ্য গড়ে তুলুক। দেশে ফিরে আসলে ভালো, না আসলে কিছু বলার নেই। তাদের চয়েস।
খবিরউদ্দিন কথার মধ্যেই ঘরে এসে ঢুকলেই এক সৌম্য চেহারার মৌলভী। তার গায়ে আচকান, পড়নে চুড়িদার পায়জামা, মাথায় কিস্তি টুপি। সাদা দাড়ি উড়ছে বাতাসে, বাবড়ি চুল ঘাড় ছুয়েছে। চোখের নিচে সুরমার কালো দাগ। এনায়েতুল্লা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন আগন্তুকের দিকে।
মৌলভী সাহেব সোফায় বসে তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, কি চিনতে পারছো না? আনিছুল হক। তোমার সহপাঠী ছিলাম। এসএম হলে ওয়েস্ট হাউসে থাকতাম। তুমি থাকতে ইস্ট হাউসে। এরপর হেসে বলল, চেহারা কি খুব বদলে গিয়েছে?
এনায়েতুল্লা হেসে বললেন, চেহারা বদলায়নি খুব। তবে ভোল পাল্টিয়েছো ভাই। বেশভূষায় আর লম্বা দাড়িতে বুজরগ হয়ে গিয়েছো।
আনিছুল হক হেসে বলল, শেষ বয়সে ধর্ম-কর্ম না করলে চলবে কেন? আর ধর্ম-কর্ম করতে গেলে আনুষঙ্গিক লেবাসও পড়তে হয়। তাতেও সুন্নাত ।বলে সে তার হাতে ধরে রাখা একটা ব্যাগ খুলতে থাকে। সবাই তার দিকে খুব কৌতূহলী হয়ে তাকায়। সে একটু পর ব্যাগ থেকে প্রত্যেকের জন্য একটা বই বের করে তাদের দিয়ে বলে, পড়বে। বেহেশতে যাওয়ার জন্য কী কী করতে হবে, সব লেখা আছে। সব জার্নির জন্যই একটা প্রস্তুতি দরকার। লন্ডনে, ওয়াশিংটনে যাওয়ার আগে স্যুটকেসে দরকারি জামা-কাপড় ভরে নাও।অন্তিমযাত্রার জন্য প্রস্তুতি নেবে না? ওইটাই তো সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ জার্নি। এরপর সে সোফায় হেলান দিয়ে বলে, সারাজীবন ঘানি টেনে গেলাম। আক্ষরিক অর্থেই। খাঁটি সরিষার তেলের মিল দিয়ে আমার ব্যবসা শুরু। এরপর সয়াবিন-পামওয়েল আমদানিকারক হয়েছি। এখন এডিবল অয়েলের প্রধান সরবরাহকারী আমার প্রতিষ্ঠান।
ছেলেমেয়েদের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। তারা চালাচ্ছে।বললাম না, অনেক ঘানি টেনেছি। আর কত! এখন ধর্ম-কর্ম নিয়ে আছি। হজ করে এসেছি, তিনবার ওমরা করেছি। তাবলীগ করছি। চিল্লায় যাচ্ছি রমজান মাসে। এরপর তিনজনের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে আসার আগে ভাবলাম তোমাদের মধ্যেও তাবলীগি স্পিরিট আনার চেষ্টা করি। সবারই এখন তাবলীগ করা উচিত। বলে সে খুব স্নিগ্ধভাবে হাসে। তিনজন তার দেয়া বই নিয়ে বসে থাকে, তার দিকে তাকায় মাঝে মাঝে, যেন ভাবছে কী বলা যায় এখন।
আনিছুল হক তাদের ইতস্তত ভাব দেখে বলে, রেখে দাও। এখন পড়ার দরকার নেই। বাড়িতে গিয়ে পড়বে। তোমাদের পরিবারকেও পড়তে দেবে। এই যে নাও আমার কার্ড। ধর্ম বিষয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকবে।আমি মিলাদ শরিফও পড়াই। কুলখানিতে আমাকে দোয়া-দরুদ পড়ার জন্য অনেক জায়গা থেকে ডাকে।টিভিতেও মাঝে মাঝে প্রোগ্রাম করি ধর্ম বিষয়ে।চোখে পড়েছে কিনা জানি না।
জহির আমতা আমতা করে বলল, দেখেছি। আপনি বেশ ভালো বলেন।
আনিছুল হক বলে, আল্লাহর মেহেরবানী, যা কিছু হয় তার ইচ্ছাতেই হয়। এই যে আমরা এখানে মিলিত হয়েছি, এটাও তার ইচ্ছা, বলে সে সবার দিকে তাকায়, গম্ভীর হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর একটা দোয়া পড়ে সে বলে, তোমরাও দাড়ি রাখতে পারো।সোয়াব হবে। মোছ না রাখলেও চলে। দাড়ি রাখা সুন্নাত । দেখবে অনেক সুন্দর দেখাবে, চেহারায় জেল্লা আসবে। রোজ সকালে সেভ করতে হবে না,সেভ করতে গিয়ে মুখ কেটে ফেলবে না। দাড়ি রাখার অনেক ফজিলত। এসো তোমাদের একটা হামদ্ শোনাই। এটা আমার খুব প্রিয়। টিভিতে মাঝে মাঝে গাই। কুলখানিতেও। বলে সে হামদ্ গাইতে থাকে।
হামদ্ শুনে দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো রাজু,আমেনা, আমেনার ছোটছেলে। মনে হলো তুলিও একবার এসে উঁকি দিয়ে গেল।মাগরিবের আগেই নাস্তার সঙ্গে চা দেয়া হলো। নাস্তা খেতে খেতে কেউ বলল, এবার আমার বাড়ি হবে রি-ইউনিয়ন। কেউ বলল, সবাই মিলে বড় করে হোটেলে কিংবা ক্লাবে রি-ইউনিয়ন হলে ভালো হয়।
মাগরিবের আজান শোনার পর আনিছুল হক বলল,কাছেই মসজিদ আছে মনে হয়। আমি সেখানেই নামাজ আদায় করতে যাবো। তোমরা ইচ্ছা করলে আসতে পারো।
সবাই চলে যাওয়ার পর তুলি বলল, দাদু এরা সবাই তোমার বন্ধু?
এনায়েতুল্লা বললেন, হ্যাঁ। দুইজন সহপাঠী আর দুইজন সহকর্মী। অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না।তাই ডাকলাম বাড়িতে। বেশ অনেকক্ষণ কথাবার্তায় কাটলো।
তুলি একটা সোফায় বসে পা দোলাতে দোলাতে বলল, দে আর ইন্টারেস্টিং। এক একজন একেকরকম। ফেসবুকের বন্ধুরা মনে হয় অন্যরকম। তারা দেশে থাকে তো আর বেশির ভাগই বিদেশি।
তাদের ব্যবহার আর কথাবার্তা অন্যরকম হবে।যাদের সঙ্গে ফেসবুক স্ট্যাটাসে আলাপ হলো তারা বেশ অন্যরকম, তোমার এসব বন্ধুদের মতো কেউ না ।
এনায়েতুল্লা বললেন, তাতো হবেই। ভিন্ন সমাজে বাস করছে। ভিন্ন কালচার। এরপর তিনি খুব কৌতূহল নিয়ে বললেন, কুমুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিস? তার ফেসবুক পেইজটা পাওয়া
গেল?
তুলি বলল, এখনো পাইনি। চেষ্টা করছি। সেই রাতে অনেক চেষ্টা করেও তুলি কুমুর ফেসবুক বের করতে পারলো না। তখন তার মনে পড়লো কুমুর ই-মেইলের কথা। সে ই-মেইলের ঠিকানায় কুমুকে এনায়েতুল্লার নামে একটা চিঠি লিখলো। কুমু আর তার স্বামী কেমন আছে, এটা জানতে চেয়ে আর নিজের বর্তমান অবস্থার কথা জানিয়ে। ই-মেইলটা যাওয়ার পর সে খুশি হলো, বোঝা গেল যে কুমুর ই-মেইল অ্যাকটিভ। তিনি এখনো ব্যবহার করেন।হয়তো দাদুর আলসেমি দেখে ই-মেইলে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এখন তার পাঠানো ই-মেইল
পেয়ে কুমু নিশ্চয়ই উত্তর দেবেন।
পরদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে মনে পড়তেই সে কম্পিউটার খুলে ই-মেইলগুলো দেখলো। হ্যাঁ,কুমুর উত্তর এসেছে। সে উত্তেজিত হয়ে তাড়াতাড়ি ই-মেইল বক্স থেকে কুমুর ই-মেইলটা বের করলো।
স্ক্রীনে চিঠির অক্ষরগুলো ভেসে উঠতেই সে ব্যগ্র হয়ে পড়তে থাকলো। প্রম লাইন পড়েই সে স্তব্ধ হয়ে গেল। নিশ্চল হয়ে বসে থাকলো কিছুক্ষণ, যেন বজ্রাহত। তার সামনে কম্পিউটারের মনিটরে লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে এসেছে। কুমু না, তার স্বামী উত্তর দিয়েছেন। জানিয়েছেন কুমু দুইবছর আগে মারা গিয়েছেন। কম্পিউটারের সামনে বসে তুলি ভাবলো কিছুক্ষণ।
দাদুকে খবরটা কি এখনি দেবে? নাকি পড়ে দেবে? দিলে কীভাবে দেয়া ঠিক হবে। চিন্তা করেও সে কোনো কুল-কিনারা পেলো না। এরপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে বইয়ের ব্যাক-প্যাক নিয়ে স্কুলে চলে গেল। সে ভেবে দেখবে কীভাবে খবরটা দাদুকে দেয়া যায়। সব মানুষের মধ্যে কুমুর সঙ্গেই যে দাদুর বেশি অন্তরঙ্গতা, সেটা সে জানে। খবরটা হঠাৎ করে দিলে তিনি আঘাত পাবেন, কেননা কুমু তো তার সাধারণ একজন বন্ধু নয়। বিশেষ বন্ধু, এটা সে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে এতদিনে। বেশ কৌশলে খবরটা দিতে হবে তাকে, অল্প অল্প করে।
দেখা যাক। ভাবলো সে স্কুলে পৌঁছে।