চন্দ্রগ্রস্ত

সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয় চাঁদের উপর; সেই আলোর প্রতিফলন থেকে চাঁদ আলোকিত হয়। আলোকিত করে সমগ্র পৃথিবীকে। একটা কথা খুব প্রচলিত আছে_ ‘চাঁদে পাওয়া’। চাঁদের ঘোরগ্রস্ত মানুষকেই বলা হয়ে থাকে চাঁদে পাওয়া মানুষ। জোছনার কোমল আলো যখন পৃথিবীকে উদ্ভাসিত করে_ সকল মানুষই নিজের অজান্তে হলেও মোহাচ্ছন্নতার অতলে হারিয়ে যায়। আমাদের কবিরা তখন কবিতা লিখেন_
‘মাঝরাতে আকাশেতে ছোপ দিয়ে রাঙ্গা,
রাতকানা চাঁদ উঠে আধখানা ভাঙ্গা।’
চাঁদে পাওয়া মানুষের কথা যদি বলি তাহলে বলতে হয়, তারা কিন্তু পূর্ণিমা বা জোছনার সময়ই একটু ঘোরগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ ছাড়া বাদবাকি সময় তারা স্বাভাবিকই থাকেন বলে আমার ধারণা। সে যাই হোক, চাঁদকে যদি আমরা ব্যাখ্যা করি, তাহলে দেখতে পাবো_ চাঁদ হলো পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ। চাঁদকে বালুময়, নিষ্প্র্রাণ অঞ্চলবিশেষ বললেও ভুল হবে না। একটা সময় ছিল যখন চাঁদকে নিয়ে হাজারো গল্প-কাহিনী প্রচলিত ছিল। কিন্তু মানুষের সফল চন্দ্র অভিযানের পর থেকে চাঁদ নিয়ে মানুষের অলীক কল্পনায় কিছুটা হলেও ছেদ পড়েছে। মানুষ যেদিন চাঁদে সফল অবতরণ করেছিল, সেই দিনটির কথা আমি মনে রেখেছি। পৃথিবীর মানুষদের অপেক্ষা সফল অবতরণের জন্য এবং তারা সাথর্ক হয়েছিল। চন্দ্র বিজয়ের এই ঘটনাটি মানব সভ্যতার একটি বিশাল অর্জন বলে মনে করি।
চাঁদের টানে আমিও খানিকটা মোহগ্রস্ত হয়ে থাকি। একদা চাঁদকে নিয়ে কবিতা লিখতে গিয়ে উৎসাহ বোধ করেছি। নানা উপমায় চাঁদকে ব্যবহার করেছি ইচ্ছেমতো। কখনও তেলেভাজা পিঠার মতো, কখনও সাদা ডিমের মতো। চাঁদের মায়াবী সৌন্দর্যের টানে মুগ্ধ হয়ে প্রেমিকার মুখের সঙ্গে চাঁদকে তুলনা করতে ভুলি না। আমাদের বাবা-মায়েরা সুন্দরী মেয়েদের নাম রাখেন ‘চন্দ্রমুখী’। এ নিয়ে হাজারো কেচ্ছা-কাহিনী প্রচলিত আছে আমাদের দেশে। এ ছাড়াও নানা কেচ্ছা-কাহিনী চালু আছে বিদেশি সাহিত্যেও। প্রাচীন গ্রিসে এক ধরনের মিথ চালু ছিল। সেটা এমন_ মস্তিষ্ক হলো মানব শরীরের সবচেয়ে আর্দ্র অংশ এবং এ কারণে তা পূর্ণিমার সময় চাঁদ দ্বারা প্রভাবিত হয়; যেমন প্রভাবিত হয় জোয়ার-ভাটা। আর সে কারণে মানুষ পূর্ণিমার সময় ঘোরগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
যৌবনে এই জগৎ-সংসার ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ আমার হয়েছিল। আমি ঘুরেছি। অনেক ঘটনার বিবরণ আমি দিয়েছি। তবুও আমার মন ভরে আছে আরও কিছু খুচরো ঘটনার স্মৃতিতে। খুচরো বললাম এ কারণে যে, এসব ঘটনার বিবরণ সাধারণত লেখকরা দিতে চান না; কিন্তু ওই সব খুচরো ঘটনা এক সময় যে আনন্দ দিয়েছিল, সেটাও তো কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত।
আমি প্যারিসে ভ্রমণের সময় স্পেনে যাওয়ার খুব আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলাম; কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় স্পেনে প্রবেশ করতে পারিনি। যে ট্রেনটিতে আমার যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সে ট্রেনটি দেখতে আমি রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম, এই ট্রেনটি কত সৌভাগ্যের অধিকারী! অথচ আমি না যেতে পারার দুঃখ নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। স্পেনে যেতে না পারলেও যে বাসায় অবস্থান করছিলাম সেখানে ‘স্পিনাক’ নামে এক ধরনের শাক দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম। কথাটা কিন্তু আমি সারাজীবনেও ভুলতে পারিনি। স্মৃতির পেছনে লেগে থাকে কিছু খুচরো স্মৃতি। এই শাক স্পেন থেকে প্যারিসে আমদানি করা হয়। খুবই স্ব্বাদযুক্ত এই খাদ্য আমার রসনায় লেগে আছে। কত বিবরণ তো লিখেছি; কিন্তু এই শাকের আশ্চর্য স্বাদের কথা আমি কেন যে ভুলতে পারি না, তা ঠিক জানি না। প্যারিসের চাঁদও আমার বর্ণনার অংশ হিসেবে অনেক স্থানে বর্ণিত হয়েছে। প্যারিসের চাঁদকে আমাদের দেশের চাঁদের চাইতে খুব একটা আলাদা বলে মনে হয়নি।
ব্যক্তিগতভাবে কবি হওয়াকে আমি আমার সৌভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছি। কবি হতে হলে কবির একটা দেশ লাগে। একটা নদীর পাড়, খড়ের ঘর, উদার প্রকৃতির প্রশ্রয়, খোলা আকাশ, আকাশভরা মেঘ, মেঘের আড়াল চুইয়ে জোছনার আলো লাগে। আমি এর সবই পেয়েছি। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়_ আমার হৃদয় এতে তৃপ্ত হয়নি। এক অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে আমি সারাজীবন লিখে গেছি। আমাকে যারা ভালো বলেছেন, তারা উদার ছিলেন_ সন্দেহ নেই। আর আমাকে যারা সমালোচনা করেছেন, তাদের অনেকেই সঠিক সমালোচনা করেননি। তবুও আমি এ দেশে কবির দায়িত্ব পালন করে গেছি, মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছি। স্বপ্ন দেখিয়েছি সুখের। হোক মিথ্যা স্বপ্ন। কবির কর্তব্য যা, তা আমি করেছি। কোনো বিনিময় চাইনি। পাইওনি। তবে অনেক মানুষ পেয়েছি। নর-নারী সব মিলিয়ে অনেক মানুষ। আমি তাদের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ আয়ু অতিক্রম করে এসেছি। ভালো-মন্দ মিলিয়ে একটা আস্ত জীবন কেমন, তা আমি জানি।
এসব কাহিনী লিখে শেষ করা যায় না। মাঝে মাঝে শহর ছেড়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চারণের বেশে হেঁটে চলে গেছি। আহার-নিদ্রার কথা ভেবে দেখিনি। দুঃখ পেয়েছি প্রচুর। তবুও দু-একটা মুখের হাসি আমাকে চরম অধঃপতন থেকে রক্ষা করেছে। আমি মানুষের কাহিনী বর্ণনা করে মানুষের সমাজে ঠাঁই নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মানুষের কাহিনী মিথ্যা মিশিয়ে বলতে পারিনি বলে আমার দুর্গতির কোনো সীমা রইল না। এখনও তো আমি যা-ই লিখছি, সেটা মানুষেরই খোলনলচের কাহিনী। কত মানুষ দেখলাম! কত দ্রুত ভুলে গেছি আমার দেখা ওই সব মানুষের মর্মস্পর্শী ইতিহাসের বিষয়াদি! এখন বয়সের ভার আমাকে গ্রাস করেছে। প্রত্যেক মানুষকেই একটা অবসান মেনে নিতে হয়। আমার অবসান আমার ইচ্ছানুযায়ী হবে_ এটা ভাবি না।
সুদূর অতীতে আমি যখন নেহাতই বালক, তখন আমার একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন। তার নাম ছিল সফিউদ্দিন আহমদ। তিনি আমাকে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। বইটির নাম ছিল ঠাকুমার ঝুলি। এই থেকেই আমার সর্বনাশের শুরু। জগৎকে দেখার একটি অন্যতর দৃষ্টিভঙ্গি আমি পেয়ে গিয়েছিলাম। আজ মনে হচ্ছে, পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি। জগৎকে জানতে হলে যে পড়েই জানতে হবে_ এটা যদি একজন কিশোর একবার বুঝে ফেলে, তবে তার চেয়ে হতভাগ্য মানুষ আর হয় না। আমি শিশুকালেই জেনে গিয়েছিলাম পাঠ্যবই ছাড়াও পড়ার একটি জগৎ রয়েছে। সেখানে বিশ্রাম নেই, বিরাম নেই। অবিশ্রান্ত এক অদৃষ্টের জগৎ। আমি সেই জগতের অলিগলিতে, পথে-প্রান্তরে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়িয়েছি। এখন ক্লান্ত-অবসন্ন হলেও আমি তেপান্তরে শয্যা বিছিয়েছি। তারায় ভরা আকাশ আমার ছাদ। সেই ছাদের বিশাল অংশ জুড়ে গোলাকার এক চাঁদ। যেন আমার দিকে চেয়ে হাসছে। ওই তো কালপুরুষ আমাকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করতে চাইছে। আকাশে কী মজার দৃশ্য! সবকিছুরই একটা সমাপ্তিতে পেঁৗছতে হয়। আমার সমাপ্তি আমার ইচ্ছাধীন নয়। আগেই বলেছি, তা নিয়তি-নির্ধারিত। তবে আমার কর্মের পরিধির যে ব্যাপকতা আমি পূর্ণ করে তুলেছিলাম, তার একটা প্রতিফলন কি আমার প্রাপ্য নয়? আমি যদি এখন সেই প্রাপ্যটা হাত পেতে নিতে চাই, তাহলে কি আমাকে লোভী বলা ন্যায়সঙ্গত হবে? যাক, ছেড়ে দিলাম এসব দেনা-পাওনার কথা। কেবল একটাই বক্তব্য রেখে যেতে চাই। আর সেটা হলো, আমি দেখেছি প্রচুর, লিখেছি প্রচুর। কে আমাকে আমার পরিশ্রমের মূল্য চুকাবে?
প্যারিসে আমি জোয়ান অব আর্ক-এর একটি যুদ্ধংদেহী ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। এই কৃষককন্যা ফরাসিদের এক সময়কার মৃত আত্মাকে জাগিয়েছিল। সে বলেছিল, সে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ফরাসিদের রক্ষার জন্য আবির্ভূত হয়েছে এবং ফ্রান্স আক্রমণকারী বিদেশিদের প্রতিহত করার জন্য আদিষ্ট হয়েছে। এই কথায় ফরাসিরা যুদ্ধের জন্য তার পেছনে এসে সমবেত হয়েছিল এবং যুদ্ধে বহিরাক্রমণকারীদের পরাস্ত করে ভাগিয়ে দিয়েছিল। পরে অবশ্য তার নিজের লোকেরাই বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছিল। শত্রুরা তাকে ডাইনি বলে পুড়িয়ে মেরেছিল। কিন্তু এই কৃষককন্যার গৌরব আজও ম্লান হয়নি। এখনও তার মর্মর মূর্তি শোভা পাচ্ছে। তার কাজ এবং আহ্বান এখনও মানুষের মনে উদ্দীপনা জাগায়। পরে তাকে কীভাবে মারা হয়েছিল সেটা নয়। আমার কাজও আমাকে মনে করিয়ে দেবে আগামীর দিনগুলোতে।
চাঁদকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এতক্ষণ অনেক কথাই বলা হলো। বর্তমানের একাকিত্ব আমাকে চাঁদের সাথেই তুলনায় দাঁড় করিয়ে দেয়। নিঃসঙ্গ চাঁদের কেন্দ্রবিন্দুতে আমি ও আমার একাকিত্ব মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। যেন আমাদের কেউ নেই। আমাদের কেউ ছিলও না কখনও। চাঁদ তবু তার একাকিত্ব নিয়েও আলো বিলিয়ে যায়। আমি আমার একাকিত্বকে সাথী করে পুরনো দিনের কথাই স্মরণ করে যাই। আর আমার রচনা, যা আমি লিখেছিলাম একদা, সে সবের কথা মনে করে সান্ত্বস্ননা পাই। তাই মনে হয়, মানুষ চাঁদকে পায় না; চাঁদই মানুষকে পায়।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আল মাহমুদ- র আরো পোষ্ট দেখুন