আমি আগামী গোধূলির সাক্ষী

প্রকৃতপক্ষে আমারই সাহস যে দুঃসাহস মাত্র, তা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। সবাই পথের পাশে দাঁড়িয়ে বলছে, কোথায় যাবে এই লোকটি কে জানে? আমিও বলি- না গো, আমিও জানি না। যদি পৌঁছতে পারি তাহলে চিৎকার করে বলব, আমি এসেছি আমার গন্তব্যে, আমাকে আশ্রয় দাও প্রভু

আমি লেখক হবো, এমন একটা স্বপ্ন থাকলেও আরো অনেক আকাক্সক্ষা আমার মনে গোপনে বাসা বেঁধেছিল। এই আশা কৈশোরের স্বপ্ন দিয়ে গঠিত এবং স্মৃতির সোনায় মোড়া ছিল। প্রকৃতপক্ষে আমি লেখক হয়েছি প্রকাশনার ব্যাপারে আমার সৌভাগ্যের জন্য। আমি অল্প বয়সেই পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠালে তা আশাতীত অল্প সময়ের মধ্যেই ছাপা হয়ে প্রকাশ পেত। এর ফলে আমার বুকের কোণে আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হয়ে একধরনের জমিন তৈরি করে দিয়েছিল- সেখানে আমি স্বপ্ন কল্পনার মায়াবৃক্ষ রোপণ করেছিলাম। হঠাৎ সেই গাছ তরতর করে ডালপালা মেলে দিয়ে পাতায় সবুজের ঝঙ্কার বাজিয়ে মহীরুহ হয়ে ওঠার ইচ্ছায় আমার দিকে দৃষ্টিপাত করে আশা-আকাক্সক্ষার দোলায় কাঁপতে লাগল। আমার মধ্যে কল্পনার মাটি উর্বর হয়ে সেই মায়াবৃক্ষকে আরো উপচে ডালপালা মেলে দেয়ার প্ররোচনা দিতে লাগল। হঠাৎ আমার মনে হলো, আমি কবি হবো। লিখব। লিখব এবং একই সাথে দু’টি চোখ মেলে দেখতে থাকব জগতের কোথায় কী ঘটছে। এই ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমি স্বপ্ন নির্মাণ করব। আর এখন আমি তো সেই স্বপ্নেরই রাজকুমার। ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার বটে। তবু আমার একটি বিষয় আছে, যার লক্ষ্য স্বপ্ন। যা প্রতিরোধ মানে না। প্রতিশোধ নিতে চায় না, শুধু দেখাতে চায় আর দেখতে চায়। ‘হায়গো পৃথিবী, জগৎ আমার, তুমি কত সুন্দর!’।
হাঁটতে হাঁটতে আমার এই ক্ষতবিক্ষত ক্লান্ত পা নিয়ে আশিটি বছরের একটি উন্নত ডাঙ্গায় উঠে দাঁড়িয়েছি। যদিও আমার নিজেরই ভাবতে অবাক লাগছে আমি আশিতে এসেছি? ভেতরটা এক সময় হাসিতে খলখল করে। কী কাণ্ড- আশির অনিবার্য উপত্যকায় আমি আমার কবিত্ব শক্তি এবং আনন্দময় পদচারণা নিয়ে এক চারণের মতো গেয়ে যাচ্ছি কবিতার জয়গান। কবিতা মানুষের হৃদয়নিঃসৃত আনন্দঘন রসায়ন মাত্র, যা ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে যাচ্ছে মহাকালের পাত্রে।
আমার গাত্রে শ্রমের গন্ধ, ভ্রমবিলাসের গন্ধ; কিন্তু ছন্দহীন নয়। মেজাজটা লিরিক্যালগীতিপ্রবণ।
আশি তো হলো। কিন্তু এখন কোন সুরে বাঁশি বাজাব? আমি তো সুরস্রষ্টা; স্বরস্রষ্টা। আসলে আমি যদি কবি না হতাম, তাহলে আমি সঙ্গীতজ্ঞ হতাম। ওস্তাদ বাহাদুর খানের মতো সেতারে আমার হাত বিদ্যুতের চমকের মতো ঝিলঝিলিয়ে-রিলরিলিয়ে বাজিয়ে চলতো।
আমি তো আমার জন্য বেছে নিয়েছিলাম কবিতার পথ। আমি ভেবেছিলাম, এ পথটি সহজ-সরল। আমি পা বাড়িয়ে হেঁটে চলে যাবো, কিন্তু হাঁটতে গিয়েই ঘটে গেল পথ হারানোর দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। একটি নয়, দু’টি নয়, পর্যায়ক্রমে কেবলই আশাহত হওয়ার কাহিনীসূত্র। এত কিচ্ছা আমার ভেতরে জমা হয়েছে, শোনার লোক নেই। কে শুনবে আমার দুঃখ। আমার কাহিনী। বিশ্বগোলকের গা বেয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক কবির দু’টি ক্ষতবিক্ষত পা। কোথায় যাচ্ছি, কেউ প্রশ্ন করলে আমি তো বলেছি, আমি না পৌঁছে বলতে পারব না। এখন ভাবছি, আমি কি পৌঁছতে পারব? প্রকৃতপক্ষে আমারই সাহস যে দুঃসাহস মাত্র, তা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। সবাই পথের পাশে দাঁড়িয়ে বলছে, কোথায় যাবে এই লোকটি কে জানে? আমিও বলি- না গো, আমিও জানি না। যদি পৌঁছতে পারি তাহলে চিৎকার করে বলব, আমি এসেছি আমার গন্তব্যে, আমাকে আশ্রয় দাও প্রভু। এই বলে মূর্ছাহত হয়ে সিজদায় পড়ে আছি। এই তো আমার জীবন। কর্মের কথা তুললে অবশ্যই ধর্মের কথা এসে যায়। আমি বিশ্বাসী মানুষ। একদিন না একদিন আমি আমার বিশ্বাসের উপকূলে গিয়ে পৌঁছব। এর আগ পর্যন্ত ফররুখের কবিতার মতো বলতে থাকব, ‘রাত পোহাবার কতো দেরী পাঞ্জেরী?’
আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করে, লোকে তো আপনাকে প্রেমের কবি বলে। আচ্ছা প্রেম কী?
আমি হেসে বলি, বাসনার পরিতৃপ্তি ঘটলে মানুষ নিজেই আগ্রহ করে বলে ওঠে- আমার তৃষ্ণা তো মিটেছে, কিন্তু যাকে বলে পিপাসা, যা মানুষকে দিশেহারা করে- ঘরছাড়া করে এবং সর্বাঙ্গ উদোম করে পথে নামিয়ে দিয়ে বলে- এই পাগল, এই মজনু- এই কবি। চারণের মতো গেয়ে ওঠ তোর ভেতরের কথা। তোর যত লতাপাতা আছে, তা প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দে, দুলুক, নড়–ক এবং বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে নিয়ে ঝরিয়ে দিক ক্লান্তি শ্রান্তি অবসন্নতার আর্তি। আমার জীবন কখনো স্ফূর্তিহীন ছিল না। জীবনের নাম দুর্দান্ত বেগ। এর সাথে যোগ করে দিয়েছি আবেগ। যাও এখন যেদিকে পারো ছুটে বেড়াও। নাচো-গাও কখনো বুক চাপড়িয়ে বিলাপ করো। কখনো বলো না কিছুই পাইনি; বরং পাওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। তোমার অস্তিত্বই তো গড়ে উঠেছে মানুষের পরিতৃপ্তির মাটিতে বৃক্ষের মতো। তুমিই তো সেই বৃক্ষের নাম দিয়েছ- মায়াবৃক্ষ। মায়াবৃক্ষের কি ছায়া পড়ে না? যদি ছায়া পড়ে তাহলে জগৎকে দেখাও সেই ছায়া-মায়ায় ভরা কায়াহীনের ছায়া হলেও দেখাও তুমি হে কবি, হে অশান্ত-অতৃপ্ত প্রাণের বেদনা। হা-হা করো, বুক চাপড়াও। এত সুখ বলো সইতে নারি। আমি বইতে পারি? এ আনন্দের ভার চতুর্দিকে ছন্দ দুলছে, গন্ধ লুটোচ্ছে। তুমি চারণের মতো গাও না কেন তোমার জীবনবৃত্তান্ত। বলো বেঁচে আছি এই তো সুখ। এর বেশি না হয় না-ই জানলাম। কী দরকার! আমি আলো, আবার আমিই অন্ধকার। আমার শেষ নেই। আমার কোনো দেশও নেই। আমি চির আন্তর্জাতিক- সকলের। সবার। সব জাতির। আমি কবি পুরুষ। কোথায় যেন পড়েছিলাম বাতাসে ফুলের গন্ধ। আর কিসের হাহাকার? এখনো ভাবি বাতাসে তো ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। তবু অদূরেÑ অনেক দূরে কে কাঁদছো তুমি নারী? তুমি কি নারী, না তুমি আবেষ্টন করে রাখা প্রাকৃতিক উদ্যম। আশা ও আনন্দ। প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করলে কোনো আকৃতি পাওয়া যায় না। আশাহীনÑ প্রকারহীন আনন্দ ও বেদনার ঘনঘটা। বুকের কোন দিকে ব্যথা, সে তো হাতড়ে পাচ্ছি না। অথচ চিপতে গেলেই ছড়িয়ে পড়ে রক্তের ভেতর আঠালো শ্বেতকণিকার মধ্যেই বাসা বেঁধে আছে বেদনাঘন রহস্যের রসায়ন। ধরা যায় না। ছোঁয়া যায় না। তবু আছে জানি এক রোদনের উপকূল। বিলাপধ্বনি। অনেক দূরে কে যেন কাঁদছে। জানি না সে কেন কাঁদছে। শব্দ শুনে বুঝি এ তো নারী। কেন কাঁদছো মেয়ে তুমি। কে জিজ্ঞেস করবে? সে আছে অনেক দূরের উপকূল কিংবা কোনো উপত্যকায়।
আমি প্রার্থনায় আনন্দ পাই। আমার দেহের রক্তে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে প্রশান্তি। আল্লাহর স্তুতিতে প্রাণমন ভরপুর। আনন্দেও কাঁদি, দুঃখ-সুখেও কান্না থামে না।
আমি হাসলেও অশ্রুভরা চোখে হাসি গলতে থাকে। একই সাথে জ্বলতেও থাকে। সবই তো পৃথিবীর যত স্মৃতিস্তম্ভ মিনার গড়ে উঠেছে তার পেছনে আছে কারো না কারো এক ফোঁটা অশ্রুজল। গণ্ড বেয়ে চিবুকে গড়িয়ে হারিয়ে যাচ্ছে নারীত্বের উপকূলে নাভিতে কিংবা আরো নিচে। ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু মুক্ত বিন্দুর মতো ঝরছে অনাদিকাল থেকে। কে তুমি কাঁদো নারী? কেন কাঁদো? ওগো মেয়ে, তোমার চোখের জলে সবই যদি ভেসে যায় আমাদের সাধ্য কী? আমরা পাথরে বাঁধিয়ে রাখব তোমার অশ্রুজল। বাঁধতে গেলেই সে তো হয়ে যায় তাজমহল। প্রস্তুরীভূত এক বিন্দু নয়নের জল। এ তো তাজমহল।
আশিটি বছর এই দুর্বল পায়ে আমি কি হেঁটে আসিনি? এ কথা কানে শুনতে ও ক্লান্তিতে দেহ অবস হয়ে আসে। এসো আমরা পৃথিবীর এই উপকূলে কালের বারান্দায় মাথায় রেখে বিনা বালিশে জড়াজড়ি করে একটু কথা বলি। কথাই তো মানুষের অন্তরের বাসনার ক্ষতিপূরণ। সব দিকেই যখন ক্ষত-আহত এবং দুর্ঘটনার দৌরাত্ম্যে মুহ্যমান হয়ে দু’চোখ মেলে রেখেছি, তখন বলতে হবে- আমি তো দেখেছি, হ্যাঁ, আমি তো দেখেছি। যদি কেউ প্রশ্ন করে- কী দেখেছেন? কেন, আমি তো বলব- দেখেছি যে, কিছুই দেখিনি। শুধু চেয়ে আছি। ঘটনা গড়িয়ে যাচ্ছে দুর্ঘটনার থেকে। পড়ে আছে ক্লেদ, রক্ত আর দীর্ঘশ্বাস। হায়রে আর কিছু নেই। মানুষ আমার মানুষ। কোথায় গেছো তোমরা নর-নারী। একবার ফিরে তাকাও তোমাদের দেখি। আমি সাক্ষ্য দেবো আমি নারী পুরুষকে দেখেছিলাম। যুবা ও যুবতী। আমি কবি, কালের সাক্ষী। আমি সাক্ষ্য দেই যে, আমি দেখেছি আমার সামনে কেউ নেই। কিছু নেই। এক হা-হা করা শূন্যতার পেছনে আরো দূরে কে যেন বলছে, নেই কেন? আমি তো আছি, তখনো ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকব। আমি আগামী গোধূলির সাক্ষী। আমার মুখে হাজার হাজার বছরের প্রতিচ্ছবি। আমার চোখে অশ্রু চেহারায় হাসিতে তৃপ্তি। এই তো আমি। পরিতৃপ্তি।
আমার সাক্ষ্য গ্রহণ করো হে মহাকাল।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আল মাহমুদ- র আরো পোষ্ট দেখুন

One thought on “আমি আগামী গোধূলির সাক্ষী”

Comments are closed.