কে তুমি মনের ভেতর?

আমাদের লোকসমাজে প্রচলিত একটি কথা আছে_ ‘আসল বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়’। এ কথাটি কিন্তু বর্ণে বর্ণে সত্য। একদিকে ভাবতে গেলে মনের রোগ এক ভয়ংকর ব্যাপার। একজন সুস্থ, স্বাস্থ্যবান, সবল পুরুষ দেখা যায় কোন কোন জায়গায় তার সাহসের অভাব, আত্মবিশ্বাসের অভাব। যে কারণে সে অনেক সময় দাম্পত্য জীবনে ব্যর্থ হয়ে অনেক সময় জীবনে ব্যর্থ হয়।
এই যে মনের রোগ, তা কী করে হয়, কেন হয়; সেটা যারা মনোরোগ চিকৎসক তারা খুব ভালো বলতে পারবেন। আমি আমার সাধারণ জ্ঞান থেকে এটুকু বলতে পারি_পরিপার্শ্ব এবং প্রতিকূলতা মানুষকে তৈরি করে। একটা মানুষ যদি অবহেলার ভেতর, কষ্টের ভেতর, দীনতার ভেতর, অসম্মানের ভেতর মানুষ হয়, যদি সে এগুলো কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হয়, প্রতিষ্ঠা পায় তাহলে দুটো পরিণতি হতে পারে সে মানুষের। একটা হচ্ছে_ তরতর করে সে আরও এগিয়ে যাবে , এভাবে যত এগিয়ে যাবে তত তার সাহস বাড়বে আত্মবিশ্বাস বাড়বে। আরেকটা হতে পারে। জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে সে লোকটি তার সাহস হারিয়ে ফেলবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন দরিদ্র মানুষের সঙ্গে এক শিক্ষিত ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ের বিয়ে হলো। এদের মধ্যে যে সামাজিতক এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্য আছে সে পার্থক্য কিন্তু তাদের মনের ভেতরও বিরাজ করছে। ফলে তার স্ত্রী তাকে অগ্রাহ্য করতে পারে বা স্বামী তার সাহস হারাতে পারে। এ সব সময় যে ঘটে তা নয় কিন্তু কখনো কখনো ঘটে। এবং আমিতো দেখি যে প্রায়ই ঘটে।
অনেক সময় আমরা দেখি, একটা মানুষ সময়ের, জীবনের এবং যৌবনের এত অপচয় করে সেটা যেন মোমবাতির দুদিকে জ্বালিয়ে রাখলে মোমবাতিটি যেমন দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায় এ মানুষটার জীবনের পরিণতিও একই রকম দাঁড়ায়। আমি এমনও লোক দেখেছি যারা যৌবন বয়সেই পৌঢ়ত্বের দেখা পায়। যৌবন থাকতেই তার যৌবন হারিয়ে ফেলে। এই মানুষগুলো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মতো চলা ফেরা করতে পারে না। এরা কিন্তু দৈহিক বা মানসিকভাবে পঙ্গু কিংবা বিকলও না। এরা দেখতে বাইরে দৃশ্যমান হচ্ছে সুস্থ লোক কিন্তু ভেতরে সে অসুস্থ।
মানুষের এসব কেন হয়? উত্তরে বলা যায়, মানুষটির অত্মবিশ্বাস যখন একেবারে তলানিতে গিয়ে পেঁৗছে তখন এসব ঘটে। আমার মতে, আত্মবিশ্বাস হচ্ছে এমন এক বিষয় যা একটা মানুষের গৌরববোধ, আত্মবোধ, সাহস, ক্যারিশমা, তার চলার গতি নিয়ন্ত্রণ করে। আমি একটা লোককে চিনতাম, তার সব ছিলো কিন্তু তার মতো অসুখি লোক আর ছিলো না। আগেই বলেছি এমন অনেক লোক আছে যাদের বাইরে থেকে দেখে বোঝা দায় সে আসলে সুস্থ কি না? কিন্তু লোকটি যখন বাড়িতে প্রবেশ করে সেই মুহূর্তে সে অসুখি হয়ে ওঠে। [এই কথা কিন্তু নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমি মানুষ বলতে পুরুষ মানুষ বোঝাতে চাইছি না] বাড়িতে ঢুকেই অন্যরকম হয়ে যায়। এই অবস্থা সৃষ্টির কারণ, হয়তো স্ত্রী একটা বিপরীত পরিবেশ তৈরি করেন বা স্বামী একটা বিপরীত পরিবেশ তৈরি করেন পরিবারের মধ্যে। অনেক স্বামীর বহুগামিতার অভ্যাস রয়েছে এবং স্ত্রীর কাছে সেটা প্রকাশ্য। সেই স্ত্রী অসুখী হয়ে পড়েন। হয়তো অসহায়ত্ব আছে তার। ধীরে ধীরে তার মধ্যে সংসার বিষয়ে বিরাগ জন্ম নেয়, ছেলে-মেয়েদের মানুষ করতে হিমশিম খেয়ে যায়। সে একটা ব্যর্থ মানুষে পরিণত হয়। আমার ধারণা, ব্যর্থ মানুষরাই বহুলাংশে মনোরোগের শিকার। আর এজন্য সে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থও হয়।
মনের অসুখ থেকে নিরোগের জন্য আত্মবিশ্বাস অতি প্রয়োজনীয় একটি মাধ্যম হতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করা যাক। আমি একবার এক ইন্টারভিয়্যু বোর্ডের সম্মুখিন হলাম। আমাকে প্রশ্ন করা হলো ‘চিলড্রেন’ এর বাংলা অর্থ কী? এই উত্তর আমার ভালো করেই জানা ছিলো কিন্তু তৎক্ষনাত কোন উত্তর আমি দিতে পারিনি। আমি চুপ করে আছি দেখে চাকরির পরীক্ষক যারা ছিলেন তারা বললেন,’আপনি যেতে পারেন’। তাদের ধারণা হলো যে ব্যক্তি ‘চাইল্ড’ এবং ‘চিলড্রেন’ এর পার্থক্য বোঝে না এত দামী চাকরি অন্তত তার জন্য নয়। আমি মাথা নিচু করে রুম থেকে বের হয়ে এলাম। দরজার বাইরে আসতেই আমার মনে হলো, আরে এটাতো ‘চাইল্ড’ এর বহুবচন ‘চিলড্রেন’। আমি উত্তর দিতে পারিনি তখন কারণ আমার আত্মবিশ্বাস এবং সাহস ছিলো না সে সময়।
আমি নিজের ক্ষেত্রে দেখেছি, আমার যখন আত্মবিশ্বাস এবং সাহসের ঘাটতি দেখা দেয়, তখন আমি যে জিনিসটা অনায়সে করতে পারি সেটাও আর করতে পারি না। এমত অভিজ্ঞতা শুধু আমার একার নয়, এটা প্রায় সকল মানুষেরই অভিজ্ঞতা।
লেখার শুরুতে পরিপাশর্ি্বকতার কথা বলছিলাম। মনের গহীনে অসুখের বসবাসের ক্ষেত্রে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। অনেক পরিবেশ আছে যেখানে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে চেনে না। আমি যদি আমার প্রতিবেশীকে না চিনি কিংবা তিনি যদি আমাকে না চেনেন, তাহলে আমার দুঃসময়ে তিনি আমার পাশে দাঁড়াবেন না অনুরূপভাবে তার দুঃসময়ে আমিও তার পাশে দাঁড়াবো না। তাহলে ব্যপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? একটা নিঃসঙ্গতা, একটা উদাসীনবোধ, একটা বিষণ্নতা আমাদের ঘিরে ফেলে ধীরে ধীরে।
বিষণ্নতা নিজেও বিশাল এক রোগ। বিষণ্নতা দিন দিন বাড়ছে পৃথিবীতে। কেন বাড়ছে? ওপরে তার কিছু কারণ আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের যন্ত্র সভ্যতার যত দ্রুত উত্থান হচ্ছে, কিছু মানুষ তত পিছিয়ে পড়ছে। যন্ত্র সভ্যতার এই গতি তারা ধরতে পারছে না। তারা পিছিয়ে পড়ছে। তারা নিজেকে তখন ব্যর্থ মানুষ হিসেবে গণ্য করতে থাকে। এবং তখন সে খুব গুরুতর করে ভাবে, ‘আমি ব্যর্থ মানুষ’। এই অবস্থায় সে কী করতে পারে? আসলেই সে কিছু করতে পারে না। অনেকের চাকরি চলে যায় কারণ সে ঠিকমতো অফিস যেতে পারছে না, প্রায়ই অফিস কামাই হয়। অফিসের পক্ষ থেকে তাকে সাবধান করে দেয়া হয়। কিন্তু চেষ্টার পরও সে পারে না যখন কিছু করতে তখন তার চাকরিটা চলে যায়। আমাদের দেশের বাস্তবতায় পরিবারের উপার্জণক্ষম ব্যক্তিটির আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেলে তার ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীসহ পুরো পরিবার সিমাহীন কষ্টের মুখোমুখি হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে পরিপার্শ্ব মানুষের জন্য বড় একটা ব্যাপার।
আমি কোন পরিবেশে বড় হচ্ছি সেটা আমার বাকী জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি কী পরিবেশে তৈরি হচ্ছি এটা আমার গোটা জীবনের জন্য একটা চরম এবং পরম বিষয়। অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, এসব কোন বিষয়ই নয়, সামন্য বিষয়ই মাত্র। হ্যাঁ, তারা আমাদের আশা দেয়ার ছলে হয়তো কথাগুলো বলেন। কিন্তু সামান্য এই বিষয়টি ওই ব্যক্তির জন্য অনেক বড় অনেক গুরুতর। তাকে চিকিৎসা করতে হয় আশা দিয়ে, ভরসা দিয়ে। আমরা অনেকেই পীর সাহেবের কাছে যাই। এদের মধ্যে কামেল লোক নিশ্চয়ই আছেন বলে বিশ্বাস করি। কিন্তু বেশিরভাগই তো সাধারণ মানুষ। কিন্তু একটা কাজ এঁরা ভালো করেন, সেটা ইতিবাচক। তারা বলেন,’বাবা/মা, আল্লাহ ভালো করবেন’। এই কথার দ্বারা মানুষটি কিন্তু সাহস পায়। পাশ্চাত্যের লোকেরা মনের সংকটকালে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যায়। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ যায় পীর-ফকিরের কাছে এবং তারা আত্মবিশ্বাস পায়। এই আত্মবিশ্বাসই তো সব। আত্মবিশ্বাস না থাকলে কেউ পাহাড়ে চড়বে কী করে কিংবা মাটিতেওবা অবস্থান করবে কী করে? একজন মানুষের ধন-সম্পদ, পরিবার, সুন্দরী স্ত্রী আছে কিন্তু তার আত্মবিশ্বাস নেই। তাহলে সে নিজেকে হতভাগা মনে করা ছাড়া আর কি-ই বা ভাবতে পারে।
সন্তানরা যখন বড় হয় তখন সচেতন অভিভাবক এবং শিক্ষকদের উচিত তাদের বাড়তে দেওয়া। এক কালে আমাদের স্কুলে বেত-ই ছিলো শিক্ষার অন্যতম উপকরণ। কিছু না পারলে বেতের দুটো ঘা। অথচ এই বাচ্চাটার মনে যে কী ঝড় বইছে, তার মনে যে কী আতঙ্ক হচ্ছে এটা কেউ ভাবে না। মানুষের জীবনে বয়সন্ধির কাল খুব স্পর্শকাতর সময়। এই বয়েসের ছেলে-মেয়েরা দেখা যায় অতি সামন্য কারণেই আত্মহত্যা করছে। অভিভাবকদের, শিক্ষকদের খেয়াল রাখা উচিত এই বয়সের ছেলে-মেয়েরা যেন আঘাত না পেয়ে শিক্ষা লাভ করে সেই অবস্থা সৃষ্টি করা। দূভার্গক্রমে আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরীদের ধমক এবং বকা ছাড়া কপালে আর কিছু জোটে না! কিছু একটা ভুল করলেই বড়রা বলে,’তোর দ্বারা কিস্সু হবে না’! এই কথার প্রতিক্রিয়ায় তাদের মনে যে অন্দোলন ঘটলো সেদিকে নজর দেয় কী কেউ, দেয় না। অথচ তাকে সাহস দিয়ে, অনুপ্রেরণা যুগিয়ে ভুল থেকে বিরত থাকার পথ বাতলে দেয়াই উচিত। সেটা করা গেলে তাদেরও বোধদয় ঘটবে, ‘আমাকেও পারতে হবে’ আর এইটুকু সাহস তাদের মনে আছে বলেই মনে করি।
মনো রোগের আকর এইগুলো বলেই আমি মনে করি। একটি ছেলে বা মেয়ে যখন বেড়ে উঠতে থাকে তখন তার পরিপার্শ্ব তাকে অনেক সাহায্য করে কিংবা অনেক ক্ষতি করে।
আমাদের সমাজে দুই প্রকার মানুষ আছেন। একপ্রকার মানুষ নেতিবাচক মনোভাব পোষন করেন, তাদের মুখে না ছাড়া আর কোন কথা নেই। আরেক প্রকার মানুষ আছে তারা ঘটনা যা-ই ঘটুক না কেন সেটার ভেতরও একটা ইতিবাচক কিছু খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তারা সাহস দেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, পরেরবার নিশ্চই হবে।
মনের অসুখ থেকে আগামী প্রজন্মকে সুস্থ রাখতে অবশ্যই আমাদের সন্তানদের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তাদের মানসিক গঠন এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে করে বিপদের মুখেও সব কিছু সামলে নিতে পারে। তাদের ভাবতে শেখাতে হবে_ এটাইতো জীবন, আমাকে জীবনের মধ্য দিয়েই যেতে হবে। ভুল, সংকট এসব জয় করেই আমাকে জীবনের আনন্দ উপভোগ করতে হবে।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
রাহাত খান- র আরো পোষ্ট দেখুন