নন্দিনী পাখিরা

আমি পাগল হয়ে যাব। আমি তো দেখতে পাচ্ছি কারা কী করেছে! সুবল ভট্ট এমন করে আজকাল আমার দিকে তাকাচ্ছে। ওই ভট্টই আমাকে কালাচাঁদের ব্যাপারে বলে।
কী বলে?
ভোরবেলা এল। তখন আলো ফোটেনি। প্রসাদ ডাক্তার আর আপনি পৌঁছনোর অনেক আগে। ভট্ট বলে গেল, যা সরমা দেখ গে যা, ভুড়িপুকুরে কালাচাঁদ ভাসছে। কেটে-মেরে ফেলে দিয়েছে। সারারাত রাস্তার কুকুরগুলো ছুটাছুটি করেছে। সাহেবপাড়া টু ভুড়িপুকুর, ভায়া নিশ্চিন্দিপুর।
অ।
আমার কে ছিল বাবু, কালাচাঁদ ছাড়া! নন্দু ডাকলে যেতাম। কালাচাঁদ মিঠুকে পাহারা দিয়ে পড়ে থাকত, বাবু! কামবায় চাগালে নন্দু ডাকত এই গায়েনকে। আমাকে রেপ করত নন্দু, নিয়ম করে। বলব না সে কথা?
না।
পুরুষ কেন জন্মায়?
কী বললে?
স্বামী বিবেকানন্দ হবে বলে জন্মায়? মোটেও না। মা-মাসি-মেয়েকে লুটবে বলে জন্মায়।
ছিঃ! এভাবে কথা বলতে নাই। মানুষ এত খারাপ না সরমা!
খারাপ। ততটাই খারাপ যতটা আমি বলছি। গেরুয়া-পরা এক মহারাজ দুইটা জিনিস কাগজে মুড়িয়ে আপনাকে দেবে বলে এনেছিল। আপনাকে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিল, আমি তখন কাজে এসে তলায় দাঁড়িয়ে। বললাম, মহারাজ আমাকে দিন। এখন আনব?
জানলার শিক ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াল নৈঋত। বিধবা পাখিটা তখনও খেলছে বাঁশবনের সবুজের কাছে; বনের উপরের আকাশ নীল।
সরমার দিকে দেখে নৈঋত বলল, আনো।
চেয়ার ছেড়ে ঘরের বাইরে গেল সরমা। একটি ফ্রেমে বাঁধানো ফোটো, যা খবরের পুরনো কাগজ দিয়ে মোড়া। আর দ্বিতীয়টি মনে হচ্ছে কোনও মূর্তি। সেটিও কাগজে মোড়ানো। দুটি বস্তুকেই টেবিলে রাখল সরমা গায়েন।
কী জিনিস, খুলে দেখেছ?
না বাবু, সাহস হয়নি খুলি। এখন খুলব?
খোলো। মনে হল মেসেজ ঢুকল; কোনও এসএমএস; ফোনটা মনে হয় চার্জড হয়ে গিয়েছে। চার্জারটা খুলে, নিয়ে এসো। আগে মোবাইলটা দাও। তার পর মোড়ক খুলবে।
মোড়ক খুলতে খুলতে সরমা বলে, কালাচাঁদ কেন জন্মায়, বাবু? কথাটা শুনে কেমন থতমত খেয়ে শ্লথ সুরে নৈঋত উচ্চারণ করে কুকুরের নাম, কালাচাঁদ!
হ্যাঁ বাবু। ওকে মেরে ফেলে মিঠুকে রেপ করল, কয়জনা, কে জানে! তার পর গলা টিপে মেরে দিল মেয়েকে। বাবু, আপনি ভাববেন এ ছবি আমি দেখেছি, তা কিন্তু না। অ্যাই দেখুন স্বামীজির ছবি! আগে খুলিনি। দেখুন বুকের উপর আড়াআড়ি হাত। চোখে জ্ঞানীর টলটলে দড় দৃষ্টি! নন্দুর ঘরে মা সারদার ছবি টাঙানো বাবু! রাখি কোথায়?
অ্যাঁ! বলে মুখে একটা বিস্ময়-দীর্ণ শব্দ করল নৈঋত। সে সেলফোনের স্ক্রিনে দেখছে ভেসে উঠেছে, আশ্চর্য ইংরেজি বাক্য একটি :
সরমা বলেই চলেছে, না বাবু। ভাববেন না আমি দেখেছি, না দেখি নাই। মোড়ক খুলি নাই। এটারও মোড়ক খুলি নাই বাবু। এটি কী জিনিস? ওমা! এ যে কিসা গৌতমীর কে যেন! ইনি গৌতম বুদ্ধ। জানি, নিমাই স্যার ঘন ঘন আউড়াতেন, অহিংসা পরম ধর্ম, সর্বজীবে সমদয়া। কিন্তু শোনে কোন শালা!
ছিঃ!
বরাবর ফার্স্ট হতাম, তার মুখে খিস্তি! কিন্তু সিক্সে উঠে পড়া বন্ধ হয়ে গেল। গাঁয়ে দুচার টাকার টিউশনি; তাইতে কি চলে বাবু। বহুড়–র মুস্তাফা চাচা, এই সাহেবপাড়া চেনালে। দর্জির কাজ করত। যে টালির কড়িটায় থাকি, ওটা চাচার। সোয়া কাঠা জমি। অবাক হবেন। চাচা হজে যাওয়ার সময় কী মনে করে আমার নামে লিখে দিয়ে গেল। ওই জমির লোভে সাহেবপাড়ায় পড়ে রইলাম বাবু। এখানে বিয়েও হল। তারপর…
জানি। তুমি তা হলে, ওই জমির লোভেই পড়ে আছ!
ভেবেছিলাম মিঠু বড়ো হবে। উচ্চশিক্ষা দিব। হজে গিয়ে মুস্তাফা চাচা এন্তেকাল করল। স্বামী অন্যের বউকে ফুসলে নিয়ে কোথায় পালাল আজও জানি না। ওই লোক মেয়ে ফুসলাতে ওস্তাদ ছিল বাবু। কিছু লোক এ রকম হয়। মেয়ে ফুসলাতে পেলে কিছু চায় না। জমিটা বেচে মিঠুর উচ্চশিক্ষা হবে।
এবার বিচিত্রমনা সরমা গায়েনের একটা অদ্ভুত বিচিত্র খেলা শুরু হয়। একবার সে স্বামীজিকে নিয়ে কোন দেওয়ালে টাঙাবে ভাবে, ছবিটা নিয়ে ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চলে যায়। তারপর সেটা টেবিলে এনে দেওয়ালে হেলান দিয়ে খাড়া করে রাখে। অতঃপর বুদ্ধের চিনা মূর্তিটা নিয়ে ঘরে জায়গা খুঁজতে থাকে। কোথায় রাখবে? এখানে? ছবিটি তাকে দেখছে। মূর্তিও ছবিকে দেখছে। দেখছে বুঝে নিয়ে সরমা অন্যত্র কোথাও রাখা যায় কিনা ভাবে। সেখানেও পছন্দ হয় না। না মূর্তি, না ছবিÑ কোথাও রাখবার উপযুক্ত জায়গা নির্বাচন করে উঠতে পারে না সরমা গায়েন।
সেলফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখে হাক্সলি-র কথাগুলো পড়তে থাকে নৈঋত। প্রথমে মনে মনে। তার পর শব্দ করেÑ
অ্যান ইনটেলেকচুয়াল ইজ আ পার্সন হু হ্যাজ ডিসকভার্ড সামথিং। বুঝলে?
ছবি দুহাতে ধরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়া সরমা বললে, কী করে বুঝব। অত বিদ্যে কি আর আছে! সিক্সে ফার্স্ট গার্ল ছিলাম। টিউশন করতাম সেভেন-এইট পর্যন্ত। কিন্তু তার বেশি সাধ্যে কুলোয়নি। গাঁয়ে মাইনে দিত দুটাকা পাঁচ টাকা। চলে? বিয়ের পর এখানে সেই টিউশনি বন্ধ হয়ে গেল। স্বামীই প্রচার করে দিলে আমি সিক্স পাস করিনি। লোকে মনে করলে আমি সিক্স ফেল। কেউ কি আর ছেলেমেয়ে পড়াতে পাঠাবে আমার কাছে? বিদ্যার অহঙ্কার স্বামীধন সহ্য করত না। আমাকে নন্দুর ওখানে বাড়ির বাসন ধোয়ার কাজ করতে পাঠালে। আমার ইজ্জত গেল বাবু! স্বামীকে সে কথা বললে, স্বামী আমাকে মারলে আর বললে, অত বড়ো মানী লোক নন্দবাবুর নামে এমন কথা মুখে আনতে আটকায় না তোর! ফলে নন্দুকে মেনে নিতে হল স্যার! আচ্ছা, ছবিটা তা হলে এই দেওয়ালে টানিয়ে দিই?
না থাক। এ বাড়িতে ওই সব ছবি বা মূর্তি আদৌ রাখা চলে কি না ভাবতে হবে সরমা। তুমি এখন রেখে দাও। আমি কলেজ বার হব। বুঝলে, ফোনে যে এসএমএস-টা ঢুকেছে ইংরেজিতে, সেটার সাদা বাংলা হতে পারে, এরকমÑ আমার মতো লোকের সেক্স-এর চেয়েও মন টানে এমন কিছু আবিষ্কার করা চাই। নন্দু শুধু সেক্স-এ ডুবে আছে। সেক্স ছাড়া আর কোনও জিনিসে আনন্দ পাওয়ার ব্যবস্থা সে করে উঠতে পারেনি।
আমার মিঠুতে আনন্দ ছিল বাবু! আপনি বাবু দুধরাজে আনন্দ করুন। জায়গা না হলে ছবি আর মূর্তি আমি নিয়ে যাব। আমাকে দিবেন। আচ্ছা বাবু, আমি এখন আসি। ভোজপুরের সয়া নীচে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে সইয়ের কাছে নিয়ে যাবে। কাল বাবু, আসব। দুধরাজে আনন্দ আছে বাবু। চলি।
এই বলে চলে গেল সরমা গায়েন। তার কথাগুলো ভেসে রইল ঘরের বাতাসে। কথাগুলো অন্তরমূল অবধি নাড়া দিয়ে গেল নৈঋতের। ভেতরটা কেমন তোলপাড় করছে তার। সে ফের ঘুরে দাঁড়াল জানলার দিকে মুখ করে। জানলা দিয়ে বাঁশবনের দিকে চাইল। ওখানে উড়ছে এখন দুটি দুধরাজ। বাতাসে ঢেউ তুলেছে সাদা লেজের আশ্চর্য শুভ্রতা। নৈঋত বুঝতে পারছে, একটি পাখি মানুষের মহৎ হৃদয়ের চেয়েও সুন্দর হতে পারে। তাকে সুতরাং পড়তে হবে জীবনানন্দের পাখির পরণকথা।
তিন
সাধারণ বাঙালি কাব্য-কবিতার ধার ধারে না। কিন্তু যারা বিশেষ গরিব, সমাজের তলাকার লোক তারা গানের ভিতর দিয়ে জীবনের হেঁয়ালি, যা কতক কবিতা ধরনের হাহাকার, তা পছন্দ করে। যেমন, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়।
তার মানে পাখি অচিন হলেও সেই পাখিকে নিয়ে রস উপভোগে তলার মানুষদের বাধে না। কিন্তু মেধাবী মধ্যবিত্তের রকম আলাদা। ফ্ল্যাটে থাকা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত একটি ধুল চড়াইকে পর্যন্ত দেখেও দেখে না। কাককে কখনও তার নবান্নের দেশের পাখি বলে মনে হয়নি। (জীবনানন্দের মনে হয়েছিল)।
যা হোক। যে দিন হলুদ ইষ্টিকুটুমের সঙ্গে দেখা হল, সে দিন রাজু বৈদ্যর সঙ্গে দেখা হয়, খোকার সঙ্গে হয় না। শুধু তার ঘরটা দেখেছিল নৈঋত। সেটা ওই টালির ঘরটার পাশে যে ছোট্ট কাঠের ঘর, সেখানে থাকে খোকা, সেটায় ঢুকেছিল শাহু। সেটাও এক ধরনের মাচা-বিশিষ্ট ঘর। একটা ছোট কাঠের সিঁড়ি ভেঙে উঠে কাঠের মাচা বা পাটাতনে শোয়ার ব্যবস্থা। টালির ঘরটা একটা বৈঠকখানা ধরনের।
সুস্থ থাকলে এখানে বসে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে খোকা, তার বক্স রয়েছে দেখা যায়। আর আছে কিছু কিছু পাখির নিরাময় সংক্রান্ত দুচারটি ওষুধ!
এখানে রয়েছে, ফ্রেমে বাঁধানো জীবনানন্দের কবিতা।
ছোট্ট একটা কবিতা। তলায় রয়েছে খোকার এক লাইন সপ্রশ্ন মন্তব্য। কবিতাটা এই :
ফিরে এসো সমুদ্রের ধারে,
ফিরে এসো প্রান্তরের পথে;
যেইখানে ট্রেন এসে থামে
আম নিম ঝাউয়ের জগতে
ফিরে এসো; একদিন নীল ডিম করেছ বুনন;
আজও তারা শিশিরে নীরব;
পাখির ঝর্না হয়ে কবে
আমারে করিবে অনুভব।
খোকার মন্তব্য : এ কার গলা- পাখির না মানুষের?
আরও একটি ফ্রেমে হাতে-লেখা জীবনানন্দের লাইন ও মন্তব্য, যা বিশেষ অদ্ভুত। অবাক হয়ে চেয়ে দেখেছিল নৈঋত।
লাইনটা এ রকম :
হলুদ পেঁপের পাতাকে একটা আচমকা পাখি বলে ভুল হবে…
মন্তব্য : না হলে, এখানে এসো না। কী আশ্চর্য! নৈঋতের মনে হচ্ছিল, তাই তো বটে। হলুদ পেঁপের পাতার দিকে চেয়ে দেখার মতো ঘটনা এ জীবনে কি একেবারে অসম্ভব?
কলেজে এসে কলেজ লাইব্রেরি থেকে জীবনানন্দ দাশের ভারবি প্রকাশিত কাব্যসমগ্র নেয় নৈঋত। সেটা নিয়ে টিচার্স রুমে নিজের আসনে ফিরে এসে খুঁজতে থাকে খোকার ফ্রেমে বাঁধানো কবিতা ও হলুদ পেঁপের পাতা কোথায় মুদ্রিত আছে।
বাংলার এক স্যার মধুময় মোড়ক নৈঋতের কাণ্ড দেখে নিতান্ত অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার ভাই ঋত। ভূগোল ছেড়ে কাব্য।
এমনি সময়ে সেখানে এসে দাঁড়ালে নন্দিনী, সে কোনও ক্লাস থেকে এল। তার দিকে এক ঝলক আলতো দেখে নিয়ে বইয়ের খোলা পাতার দিকে চোখ নামালে নৈঋত।
তার পর বললে, এখানে স্যার, কাব্য ধরতে হলে ভূগোল ছাড়তে হয় নাকি। তা হলে শুনুন স্যার, কাব্যের ভূগোলে জীবনানন্দের জায়গাটা কোথায়, তাই খুঁজছি! সবটাই আমার এক্তিয়ারের বাইরের ব্যাপার স্যার।
মধুময় পাকা প্রৌঢ়-প্রবীণ, বললেন, তা হলে বিশেষ ব্যাপার কিছু চলছে। কী খুঁজছ, শুনতে পাই?
নৈঋত বলল, আচ্ছা স্যার, আপনি তো দক্ষিণের, মানে দোগনো মানুষ। ছেলেবেলা গাঁয়ে কেটেছে। বলুন তো, বাংলার কোন পাখি নীল ডিম পাড়ে? তাছাড়া আপনি তো স্যার বাংলা সাহিত্যের একজন খাঁটি পণ্ডিত, তাই না?
মধুময় তার মুখটা ঈষৎ বাঁকা করে বললেন, অদ্ভুত ধাঁধা তো!
না, স্যার। ভাববেন না, আমি আপনার কোনও পরীক্ষা নিচ্ছি!
নকল বিস্ময় গলায় খেলিয়ে মধুময় বললেন, তা হলে।
আমি নিজেই জানি না, কোন পাখির ডিম নীল।
মধুময় বললেন, এত সব তত্ত্বতলাশ করে তবে জীবনানন্দ পড়তে হবে নাকি!
নৈঋত বলল, আমি স্যার জীবনানন্দ চুস্ত করে পড়িনি, তাঁর কোনও তত্ত্বই ঠিকঠাক জানিনে।
অর্ধেক জীবন দিব্যি কেটে গেছে। কিন্তু হঠাৎ একটা বাতিক হয়েছে স্যার।
কী সেটা?
পাখি দেখা।
তাই নাকি!
আমার তো স্যার, মানুষ দেখতে, না মানুষ নয়, যৌবনবতী নারী দেখতে ভালো লাগে। আমি লুকিয়েও মেয়েদের দেখি। সেই আমার ধ্যানজ্ঞান। হঠাৎ কী যে হল স্যার! ইষ্টিটুকুম আর দুধরাজ দেখে আমি ফিদা হয়ে গেলাম। দুটিই দেখতে শেখালে দুটি আশ্চর্য নারী। যাক গে। আচ্ছা ঝুম, আজ সকাল নটা নাগাদ তুমি কি আমাকে কোনও এসএমএস করেছ?
একটা চেয়ার বসার জন্য যথাস্থানে আকর্ষণ করে নিতে নিতে ঝুম বলল, কই না তো! বলে চেয়ারে বসে পড়ল ঝুম।
তার পর বলল, কী এসএমএস?
নৈঋত বলল, কথাটা কী বলে, মুখস্থই করে ফেলেছি। আপনিও শুনবেন নাকি স্যার?
মোড়ক চেয়ারে নড়েচড়ে বসে বললেন, নিশ্চয়।
বলবার জন্য মুখ ঈষৎ হাঁ করে মুখের হাঁ বুজিয়ে ফেলে কী যেন কিছুক্ষণ চিন্তা করে নেয় নৈঋত।
তার পর বলে, আমার মনে হয়েছে কথাটা যিনি পাঠিয়েছেন, মানে এসএমএস, তিনি কথাটা বিশ্বাস করেন। ওটা ওঁর বিলিফ। এবং যিনি পাঠালেন, তিনি জানেন, আমার বিলিফ অন্য রকম। আমার যৌবরাজ্যে কামই প্রকৃত দেবতা। বাংলায় আমার প্রিয় লেখক সন্দীপন।
ঝুম বলল, বুঝলাম, বিলিফ ইত্যাদি আমার বলা কথা, আপনি এখন এ ভাবে আমার দিকে ফেরাচ্ছেন। আপনার সাহিত্য পাঠের রুচির ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। তবে মেয়েদের গোপন অঙ্গ নিয়ে সন্দীপনী চিত্রকল্প যেভাবে আচমকা তুলে আনলেন, তাতে এই প্রথম বোঝা গেল, আপনি ভালো পাঠক। জীবনানন্দ কিন্তু সন্দীপনেরও খুবই প্রিয় ছিলেন। অথচ দর্শন কত আলাদা। আবার সন্দীপনের প্রেরণাস্থল হওয়ার মতো জটিল আধুনিক মনস্তত্ত্ব জীবনানন্দেরও ছিল বা আছে বইকি। কিন্তু আমার বাবা বা হাসান যে-জীবনানন্দকে বিশ্বাস করত, সে হচ্ছে বার্ডার জীবনানন্দ। খোকাই যে অভিনব, যত দিন যাচ্ছে বুঝতে পারছি। পক্ষীশাবক খেতে চেয়ে যেভাবে মায়ের দিকে বা যে কারও দিকে ঠোঁট জোড়া হাঁ করে, দেখেছেন তো নৈঋত?
নৈঋত অত্যন্ত সাগ্রহে বলল, হ্যাঁ।
নন্দিনী বলল, জোড়া ঠোঁটের হাঁ এবং তার অভ্যন্তরে-উন্মুখ লালিমা দেখে অভিনবের স্নায়ু ভালো থাকে, অভিনব শান্ত থাকে, আহ্লাদ-সুখ হয়, আনন্দ হয় খোকার। আমাকে বলেছে, দেখো দেখো। যারা ওই বাগানে ছবি তুলতে যায়, তারা পাখির বাসাগুলো, যা মাটি ছাড়িয়ে কোমর প্রমাণ বা তার চেয়ে নীচু, সেই সব বাসা তছনছ করে দিয়ে আসে। ওই লালিমা ক্যামেরায় ধরবে বলে বাসাটাই ঘেঁটে দেয়।
মোড়ক বিশেষ আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলেন, তাই নাকি!
ঝুম বলল, হ্যাঁ স্যার। পত্রিকায় ওই ছবি ছাপা হবে। ওই সোকল্ড বার্ডার-ফোটোগ্রাফারের নাম হবে। তাই না। তাই ঘেঁটে দিয়ে পাখির বাচ্চাকে উসকে তুলে স্যাপশট নেয়। পাখির বাচ্চা পড়ে যায়। কাঁদে। আহার জোগাড়ে গিয়েছিল যে মা, সে ফিরে এসে দেখে, তার বাচ্চা মাটিতে পড়ে অসহায়ভাবে চেঁচাচ্ছে। ওই বাচ্চাটার কী হবে!
কী হবে! অসহায় গলায় বলে ওঠেন মধুময় মোড়ক।
ঝুম বলল, কী আর হবে। সন্ধ্যার পর সাপ এসে মুখে করে নিয়ে যাবে। বা বনবিড়াল বার হবে।
মোড়ক বললেন, মানে কী! মানুষ এরকম? মানে কী?
অদ্ভুত করে হেসে উঠে নৈঋতের মুখ নীচু করে জীবনানন্দে নিবদ্ধ দৃষ্টি নৈঋতকে একটা কেমন তীব্র দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে ঝুম বলে উঠল, মানুষের মানে চাইছেন মোড়ক স্যার! সে সব তো কবিরা কবে থেকে চেয়ে আসছেন। কিন্তু মানে খুব কঠিন। বাবার ঘাতকরা আজ দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রকাশ্যে কিন্তু তাদের শনাক্ত করবে কে? যে বউটির জন্য বাবা প্রাণ দিলেন, তাকে সাক্ষ্য দিতে টেনে আনা যায়নি। পুলিশের তরফ থেকে টিভিতে-কাগজে-পত্রে বিজ্ঞাপন-ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, বার হয়ে আসো, দেখা দাও। কথা বলো। এমনকি কলকাতা এবং তার উপকণ্ঠের বিভিন্ন জায়গায় মাইক ও চোখ প্রচার করা হয়, আসো, আসো। দেখা করো। কী ঘটেছিল বলো। দেখো তো, মণিমাধব এসআই-কে
যারা কোনও এক বেপাড়ার গলিতে আয় শালা বলে টেনে নিয়ে যায় এবং সেই গলিটা ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ; দুই জন মানুষ মুখোমুখি হয়ে গা-কাত করে পরস্পরকে ডিঙোতে হয়, সেই গলিটা তুমি কি দেখেছ? তোমাকে বাইক-বাহিনী ওই গলির কাছে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দেয়। বাইক থামিয়ে, খাড়া করে রেখে ওরা, ওই লোচ্চা-গুণ্ডার দল ওই গলিতে ঢুকে পড়ে, বলো, তোমার হাত ধরে টানতে-টানতে গলিতে ঢোকে এবং তোমাকেই টোপ হিসেবে ব্যবহার করে, নাকি…
এই পর্যন্ত বলে হাঁপাতে থাকে এবং তীক্ষ-চাপা কান্না তাকে ছিঁড়ছে। তা তার শরীরের কাঁপুনি থেকে ফুটে ওঠে; চোখ দুটি ছলছল করছে ঝুমের; সে ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চাপে, অর্থাৎ কান্না চাপে, পারে না।
চোখে জল দিয়ে দৃষ্টিকে ছাদের সিলিঙের দিকে রেখে ঝুম বললে, গলিটা দীর্ঘ। তার দুই প্রান্ত-মুখে দুটি পুজো-প্যান্ডেল। একটা পাড়ার পুজো। আর একটি বেপাড়ার। মুখ পুরো আটকে রেখেছে। কষ্টেসৃষ্টে গলে গিয়ে এ পাড়া থেকে ও পাড়ায় যাওয়া যায়। নিতান্ত যারা ওখানকার, তাদের ক্বচ্চিৎ কেউ যায় বা আসে। তা বাদে গলি পড়ে থাকে শূন্য। পুজোর সময়, বুঝলেন নৈঋত, ওই গলিটা আমি দেখতে যাই।
ওহ! বলে কেমন একটা কষ্টদীর্ণ শ্বাস ফেললে নৈঋত শাহু।
সে চেয়ে রয়েছে জীবনানন্দের, একদিন নীল ডিম করেছ বুনন, আজও তারা শিশিরে নীরব;… সেই নীল নীরবতার দিকে। তার মনে পড়ছে মিঠুকে।
যখনই মিঠুকে মনে পড়ছে তখনই আশ্চর্য এক কষ্ট বুকের মধ্যে শুরু হয়ে যাচ্ছে। সেই কষ্টের মধ্যে অদ্ভুত এক হাহাকার।
যাবেন?
অ্যাঁ।
আমার সঙ্গে যাবেন, গলিটা দেখতে?
হ্যাঁ যাব বইকি, কেন যাব না? আসলে আমি বেশ সমস্যায় রয়েছি। এ ব্যাপারে তোমার কাছে সাহায্য চাইব। গলিটা দেখব। নিশ্চয়। এসএমএসটা আসার পর কেমন সব হল। যা হোক। পুজো এসে গেছে।
মোড়ক বললেন, এসএমএসটা কী একবার শোনাও তো বাপু!
হ্যাঁ নিশ্চয়। যৌনতার চেয়েও আনন্দের উপকরণ জীবনে খুঁজে পেতে পারেন একজন প্রকৃত মননশীল, পান বলেই তিনি সাধারণ নন, তিনি ইনটেলেকচুয়াল; যেমন সরমা গায়েন বললে, আমার মিঠুতে আনন্দ ছিল বাবু। আপনি বাবু দুধরাজে আনন্দ করুন।
আবার তুমি বলো কথাটা। বললেন মোড়ক। বললেন, এসএমএসটা বলো। নৈঋত ফের বলল।
মোড়ক বললেন, এ কথাটা নানা রূপে সত্য নৈঋত।
আবার হাক্সলির বচন বলে ওঠে নৈঋত।
তখনই ঝুম বলে ওঠে, জীবনানন্দের প্রিয় করুণ পাখিটির নাম শালিক। তাকে দেশি ময়নাও বলা যায়।
তাই! মোড়কের বিস্ময়।
ঝুম বলল, দিশি ময়নার ডিম ঝকঝকে নীল। মানে, শালিকের ডিম নীল।
শুনে চমকে উঠল নৈঋত।
আপনি কী পড়ছেন, মনে মনে? আপনার শরীরটা জুৎ যাচ্ছে না। সাত দিন আনলিভ। ফোন করেছিলাম। ফোন বেজেই গেল।
বলে থামল ঝুম।
বই থেকে মুখ তুলল নৈঋত।
তার পর বলল, হয় কী, চার্জ ফুরিয়ে গেলে আর চার্জ দেওয়া হয়নি।
কী হয়েছিল?
বইয়ে ফের মুখ নামিয়ে নৈঋত বলল, বলব।
কী কবিতা ওটা?
খোকার ওখানে যেটা দেখেছি। ফিরে এসো।
ও। একদিন নীল ডিম করেছে বুনন; আজও তারা শিশিরে নীরব; পাখির ঝর্ণা হয়ে কবে আমারে করিবে অনুভব। পাখির ঝর্ণা, মানে অজস কলতান। তারই ভেতরে প্রেমকে এবং জীবনের উষ্ণতাকে; ডিমের ফুটে ওঠার মধ্যে তাকে ফিরে পাওয়া। সে যা হোক। আমি তো নীল ডিম রসুলপুরে ছেলেবেলায় প্রথম দেখি।
তাই? মোড়ক বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
ঝুম বলল, হ্যাঁ স্যার। সে কী বিস্ময়! কী বিশাল আনন্দ। তবে স্যার ছাতারে পাখির ডিমও নীল। কিন্তু জীবনানন্দের বেলায় এই নীল ডিম ছাতারের নয়। শালিকের বা গাঙশালিকের। দুলি নস্কর, আমার দিদিমা, আমাকে এই ডিম চেনালে একদিন। সেটা আশ্চর্য নীল, আকাশের নীলে যে আনন্দ, হাতে সেই ডিম নিয়ে আনন্দ তার চেয়ে বেশি। সেই নীলে অন্য কোনও দাগ নেই। একদিন অভিনব বলেছিল, জীবনানন্দ কেন যে কাকেদের এত গুরুত্ব দিলেন, কাক তো অন্য পাখির ডিম খেয়ে ফেলে। কাকেদের ফিঙেরা লড়াই করে ঠেকিয়ে রাখতে পারে। অন্য পাখিরা তাই ফিঙের বাসার কাছাকাছি বাসা বাঁধে। তবে হানাদারদের মধ্যে চিলও পড়ে। খোকা একদিন বললে, কে কাকে খায়, এ কথা আর ভাবব না। মন খারাপ করবে। মানুষ মানুষকে যেভাবে শেষ করে দেয়, সেই ঘাতককে নিয়ে কী করব? আশ্চর্য, চিল কাঁদলে আমার কষ্ট হয়।
ঠিক এই সময়ই বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল নৈঋত শাহু।
বলল, মাফ করবে ঝুম। আমার শরীরটা খারাপ করছে। আমি বাসায় ফিরব এখন। চলি স্যার। কাব্য-সমগ্র কাল ফেরত দেব। আসি।
মোড়ককে এ কথা বলে দরজার দিকে পা বাড়ালে নৈঋত।
কী মনে করে মোড়ককে উদ্দেশ করে ঝুম মাফ করবেন স্যার বলে দাঁড়িয়ে উঠে নৈঋতের পিছু নেয়।
পিছন থেকে গলা তুলে ডেকে ওঠে, নৈঋত দাঁড়াও।
হঠাৎ এভাবে ঝুম নৈঋতকে তুমি সম্বোধন করায় হালকা একটা খুশি অনুভব করে সিঁড়ির কাছে এসে ঘুরে দাঁড়ায় নৈঋত।
মাফ করবে স্যার। আমি একা ওই ভাবে বকবক করছিলাম বলে তোমার ভালো লাগেনি সরি!
না ম্যাডাম। এসেছিলাম। কিন্তু একটার বেশি ক্লাস নিতে পারলাম না। ঠিক আছে। চলি।
না, ঠিক নেই। তোমার কী হয়েছে, আমাকে বলতে হবে।
তা হলে, আমার সঙ্গে চলো। যেতে যেতে গাড়িতে কথা হবে। আমি তোমার ফ্ল্যাটে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরব। না, ভয় নেই। আমি খাদক হলেও তোমাকে খাব না। আমার সমস্যা কেউ বুঝবে না। তবে তোমার কাছে আমার একটা আবেদন আছে নন্দিনী।
আবেদন?
হ্যাঁ। অনেক ভেবে দেখলাম। তুমি অনুগ্রহ করলে হয়তো একজন বেঁচে যায়। এসো।
বলে সিঁড়ি ভেঙে নেমে গাড়ির দিকে এগোয় নৈঋত। ও নিজে নিজের গাড়ি চালাতে ভালোবাসে। একখানা জেন গাড়ি। তার ইচ্ছে, এরপর একখানা আরও অনেকটা দামি গাড়ি কেনে।
গাড়ি চলছে। পাশের সিটে রয়েছে ঝুম।
দেখো ঝুম। পাখিই শুধু পাখির ডিম খেয়ে ফেলে, তা নয়। একটা কাক তো মানুষের চেয়ে নিষ্ঠুর হতে পারে না। সে মুখ্যত ঝাড়–দার পাখি। পচা-গলা খায়। মা-বোনদের কাছে অন্ন চায়, এঁটোকাঁটা চায়। পেটের জ্বালায় অন্য পাখির ডিম খায়-টায়। সাপ পাখির ছানা খায়। ময়ূর সাপ খায়। সাপ-সরীসৃপই তো বিবর্তনের পথে পাখি হয়েছে।
মাথা নেড়ে নৈঋতকে সমর্থন করে ঝুম বলল, ঠিক কথা।
আমার প্রশ্ন, বিবর্তনের পথে মানুষ কতটা মানুষ হতে পেরেছে। এই যে পুরুষ বালিকা ধর্ষণ করে সেই ধর্ষিতা বালিকাকে মেরে ফেলছে, তার চেয়ে কাক বেনেবউয়ের ডিম খেয়ে ফেললে, সেটা কি বেশি নিষ্ঠুর ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়? আমরা মুরগির ডিম খাই, তাই নিয়ে কই কেউ তো কিছু বলছে না। আমার মনে হচ্ছে, আর যাই হোক, খোকাকে আমি আর যাই কেন বলি, ইনটেলেকচুয়াল বলতে পারি না, সে একজন সাধারণ আবেগ-বিহ্বল মানুষ; কবি-কবি ব্যাপার রয়েছে কিছু। যাক গে।
না। সে কিন্তু মানুষকেই নিষ্ঠুরতম শিকারি মনে করে। প্লিজ, ওর ব্যাপারটা থাক নৈঋত। সে পাখির বাসা ঘেঁটে গেলে, আঙুল দিয়ে যত্ন করে করে ঠিক করে। বাসা থেকে খসে পড়া পাখির ছানাকে বাসা মেরামত করে তুলে দেয়। শাবকের গলার ভিতরের লালিমা ওর কাছে মহাবিস্ময়। অত্যন্ত কাছ ঘেঁষে দেখেছি, ওর মধ্যে কোনও শিকারি-দৃষ্টি নেই।
অ।
শুধু অ বলে শিউরে উঠল, হতচকিত হয়ে, নৈঋত। তার হঠাৎ মনে হল, তার পাশে বসা অনিচ্ছুক নারীটিকে ইচ্ছুক করে তোলা অসাধ্য ব্যাপার; তার প্রতি এ নারীর কণামাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই। কোথাও তো কিছু শ্রদ্ধা দরকারই। বাস্তবত তারা উপজীবিকা মাফিক সমকক্ষ জীব। মেধার উচ্চতা দিয়ে একে বিধৌত করা যাবে না। এ শিকারি-দৃষ্টি ঘৃণা করে। কোথাও কি তা হলে, চাহনির মধ্যে শিকারি-দৃষ্টি ব্যক্ত হয়েছে?
আচ্ছা!
হ্যাঁ বলুন নৈঋত।
শিকারি-দৃষ্টি কথাটা অদ্ভুত তো!
পুরুষের স্বভাবের মধ্যে এটা একটা আদিম ব্যাপার। এই দৃষ্টি তার বহাল জিনিস। কিন্তু প্রেমের দৃষ্টিটা অনেক আধুনিক আত্তীকরণ, এটা আয়ত্ত করতে জিভ একেবারে বেরিয়ে যায় তার।
অ।
এ সব কথাও থাক। প্রেমের ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথ থেকে নিতে হবে। কিন্তু নারীকে শ্রদ্ধা জানানো আরও দুটি সত্তার স্তব করেও হতে পারে। নারীকে মা ডেকে বা স্বামীজির মতো কুমারী পূজা করে। এই দুটি মানুষের স্বভাবের বেশ অনুকূল। কিন্তু প্রেমের পথ বেশ দুরূহ। দেখুন স্যার, আমি পক্ষীবংশীয় নারী। তবে আমি বহুবল্লভা জলপিপি হতে পারব না। ব্যস।
এ সব কথা কি আমাকে বলছ, ঝুম।
মোটেও না।
কাকে বলছ?
যাকে বলছি, সে কি আর শোনে? আচ্ছা বলুন, আপনার আবেদনটা কী?
এ বার কিছুক্ষণ কেমন চুপ করে রইল নৈঋত। চুপচাপ গাড়ি চালাতে চালাতে শিস দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত ধ্বনিত করতে থাকল। আশ্চর্য সুন্দর সেই শিস-সঙ্গীত।
একটা লরি ঘাড়ে এসে পড়বার মতো করছে, তাই শিস থামিয়ে সতর্ক হয় নৈঋত।
আপনি গাইতে পারেন না?
পারি।
করুন না!
নৈঋত গেয়ে উঠল :
এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর!/পুণ্য হল অঙ্গ মম, ধন্য হল অন্তর সুন্দর হে সুন্দর॥/আলোকে মোর চক্ষু দুটি মুগ্ধ হয়ে উঠিল ফুটি,/হৃদ্গগনে পবন হল সৌরভেতে মন্থর সুন্দর হে সুন্দর॥/এই তোমারি পরশরাগে চিত্ত হল রঞ্জিত/এই তোমারই মিলনসুধা রইল প্রাণে সঞ্চিত॥/তোমার মাঝে এমনি করে নবীন করি লও যে মোরে/এই জনমে ঘটালে মোর জন্ম-জন্মান্তর সুন্দর হে সুন্দর॥
গাওয়ার পর নৈঋত থেমে যেতেই ঝুম বলে ওঠে, থামলেন কেন। প্লিজ! আর একবার।
আবার?
প্লিজ। অসাধারণ কণ্ঠ আপনার। শিখেছেন কোথাও?
হ্যাঁ।
কোথায়?
অর্ঘ্য সেন।
ও, তাই?
চুপ করে অল্প মাথা নাড়ে নৈঋত।
নৈঋত বলল, শুনেছি, শিস দিলে পাখিরা খুশি হয়।
এর পর থেকে আমিও হব। প্লিজ, আর একবার।
কী হল শুনবে ঝুম।
নিশ্চয়। বলুন।
একটু থেমে চুপ করে থেকে নৈঋত একবার পাশে দৃষ্টিক্ষেপ করে ঝুমকে দেখে নিয়ে বাইরে তাকিয়ে, ডাইনে দিগন্ত দেখতে দেখতে বলে উঠল, বারবার কারও উদ্দেশে সুন্দর বলে ওঠায় হল কী, মনটা একেবারে আনন্দে ভরে গেল।
কার উদ্দেশে বললে?
বিশ্বাস করো আর নাই করো, আমি তো তোমাকেই নিবেদন করলাম নন্দিনী। তুমি আমাকে পাখি দেখতে শেখালে। ব্যাপারটা, এই ঘটনা, রবীন্দ্রগান দিয়ে সেলিব্রেট করলাম।
আর একটি মেয়েও করেছে। নাম কী তার?
ও, হ্যাঁ। নিশ্চয়। ওর নাম সরমা গায়েন। ওর ব্যাপারেই তোমাকে বলব নন্দিনী।
এ বার সিধে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে নৈঋত। চালাতে চালাতে বলল, সরমা আমাকে দুধরাজ চেনাল। বাড়ির কাছে বাঁশবনে পাখিটা উড়ছিল। মিঠু ওই পাখিটা দেখে হাততালি দিয়ে আনন্দ করত। সরমা গায়েনের মেয়ে মিঠু গায়েন। বয়স ৯ বছর। সরমার বয়েস ২৭-২৮ হবে। ওই বালিকাকে পাড়ারই কারা ধর্ষণ করে এবং খুন করে।
সে কী!
হ্যাঁ ঝুম। কুকুর কালাচাঁদের হিফাজতে নবছরের মেয়েকে রেখে ডাক পড়লে নন্দুর কামেচ্ছা চরিতার্থ করতে যেতে হত সরমাকে। নন্দু একজন ব্যবসায়ী এবং রুলিং পার্টির লোকাল মাথা। অথচ পার্টির সরাসরি কোনও মেম্বার না। এ লোক রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বদলে ফেলে। যে দল ক্ষমতায় এল তার খুব কাছের লোক হয়ে ওঠে। কী করে সেটা সম্ভব হয় বলতে পারব না। যাক গে।
ফের কিছুক্ষণ চুপ করে রইল নৈঋত।
বলো, থামলে কেন?
তাগিদ দেয় ঝুম।
ধর্ষকরা প্রথমে কালাচাঁদকে মেরে ফেলে ভুড়িপুকুরে ভাসিয়ে দেয়। মিঠুই ছিল সরমার প্রাণ। মিঠুকে আঁকড়েই সে বাঁচতে চেয়েছিল। স্বামী পলাতক। অন্য একজনের বউয়ের হাত ধরে সরমাকে ফেলে পালিয়েছে। মাঝে-মাঝে মৃত্যুর খবর আসে। সরমা গিয়ে দেখে যে লোকটা মরে পড়ে আছে, সে অন্য লোক। কতকটা সরমার স্বামী নাড়– নস্করের মতো দেখতে। এগুলো সব কিছুই না জীবনের কতকগুলো কুহক!
কুহক!
অল্প একটু দম নিয়ে নৈঋত বলল,
হ্যাঁ, কুহক।
কুহক কেন?
কুহক ছাড়া কী! ওই সব ছবি বা মূর্তি আমি কী করব! আমার ঘরে ও সব রাখা যায় না। আমি ভোগী মানুষ। আমার ঘরটা না দেখলে তুমি বুঝবে না।
তুমি আমাকে লুব্ধ করছ নাকি।
আমি তো আমার দিকেই টানব কাউকে!
ওমর খৈয়াম তোমার কেমন লাগে?
থাক। সরমার কথা বলো।
সরমাকে সাহেবপাড়া থেকে না সরালে, বেচারি খুন হয়ে যাবে। সরমার মাথাটা ক্রমে কেমন যেন হয়ে যেতে বসেছে। নন্দুর সঙ্গে ওর যে সেক্স, সেটা সে কী একটা বিকারে বলে বেড়াচ্ছে। নিয়মিত সরমাকে সাত বছর ধরে বলপূর্বক ভোগ করছে। এ বার নিস্তার চায় সরমা। আমার ভয় করছে এ কথা ভেবে যে, নন্দুর ভোগবাদ সরমার মতো হতভাগিনীর প্রচার করা উচিত নয় সত্ত্বেও মাথার দোষে রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে। আসলে কী, আমার ভোগবাদ সিডাক্টিভ। অনিচ্ছুককে ইচ্ছুক করে তোলা একটা আর্ট। সরি! কিছু মনে কোরো না নন্দিনী পাখিরা।
এ বার কিছুটা শব্দ করে হেসে সেই শব্দকে চেপে হাসিকে থামাতে চেয়ে চেষ্টা করে পারছিল না ঝুম। সে লক্ষ্য করেছিল সরমার কথা বলতে বলতে নৈঋতের চোখ দুটি ক্রমশ কেমন চিকিয়ে উঠে বিষণ হয়ে গেল। নৈঋত নামে পুরো মানুষটাকেই কেমন অদ্ভুত মজার ও সুন্দর ঠেকছিল ঝুমের।
কিন্তু যে সরমাকে নিয়ে এত কথা হচ্ছিল, তাকে নিয়ে তৈরি হল রহস্য। সরমা আর নৈঋতের বাসায় কাজে এল না। সে গিয়েছিল ভোজেরহাট। সয়া এসে তাকে নিয়ে গিয়েছিল।
রাখালের সঙ্গে নৈঋতের দেখা হল রাস্তায়। রাখাল বলতে পারল না কিছু। তা হলে সয়াই কি কিছু করল?
মনটা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেল নৈঋতের।
রাখালকে ভোজেরহাটে সরমার খোঁজ নিতে পাঠালে নৈঋত শাহু। রাখাল খোঁজ যা আনলে তা অধিকতর রহস্যজনক। সয়া সরমাকে সঙ্গে করে মুম্বাই নিয়ে গেছে। কোনও এক বিখ্যাত অভিনেতার বাড়ি কাজের মেয়ের কাজে ব্যবস্থা করে দিতে।
চার
রাখাল ট্রেনে আমলকী ও অন্যান্য মুখশুদ্ধি ফিরি করে। কখনও অন্য কিছু হকিং করে। সে সাদাসিধা মানুষ। রোগাপাতলা গড়নের মানুষ। সংসারে তার বিধবা মা আর স্বামী পরিত্যক্ত দিদি রয়েছে। রাখালের বাড়িটাও সরমার বাড়ির উল্টো দিকের বাঁকে খানিকটা উঁচু জমিতে। সরমার বাড়িটাও অন্য একটা বাঁকের মুখে। সোজা তাকালে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি দেখা যায়।
রাখাল, তোর কি মনে হয় সয়া লোকটার বউ ঠিক কথা বলছে?
শুধাল নৈঋত।
একটু ক্ষণ চুপ করে থেকে রাখাল ভদ্র বলল, না দাদা। ননা মাণিক্যর বউ ঠিক বলছে না। ননাকে সন্দেহ হয়। সরমাকে কাজ দেবার নাম করে মুম্বাই পাচার করে দিয়েছে। কিন্তু ননাকে কবজায় পাওয়া কঠিন। লোকটা নন্দুর ওখানে আসে। নন্দুই ননাকে দিয়ে সরমাকে হটিয়ে দিলে কিনা দেখুন!
কী বলছিস তুই রাখাল।
দক্ষিণে অনেক কয়টা পাচার চক্র চলছে। মেয়েরা সেই চক্রের সঙ্গে যুক্ত। শুধু পুরুষ না মেয়েরাও মেয়েদের পাচার করে। সয়া কীভাবে কী করেছে সবই অন্ধকারে স্যার।
কী কথা শোনাচ্ছিস ভাই রাখাল, সয়া তার বউয়ের সইকে পাচার করে দিয়েছে। সাহেবপাড়ার নিজের ওই খাপরার ঘরে একা থাকে কী করে, তাই সরমা ভোজেরহাটে সয়ার ওখানে গিয়ে রাত কাটাচ্ছিল। ননা মাণিক্যকে তুই দেখেছিস? দেখতে কেমন?
চোয়াড়ে। ডাকাত গোছের।
এই বলে এক লহমা থেমে রাখাল ভদ্র বলল, পুজোর আগে কোথাকার মানুষ কোথায় চলে গেল স্যার! ক্যানিঙের আড়াই বাঁকির নবমী দাসী বলে একজন মেয়েদের মুম্বাই নিয়ে গিয়ে কাজ দেয়, কী একটা মহিলা সমিতি করে; কাজের মেয়ের সমিতি। এই নবমীর নামেও বদনাম শুনেছি।
কী বদনাম?
বাঘিনীর চরের লায়লাকে ববি দেওল নাকি সানি দেওল নাকি আর কারও কারও বাড়ি বা কোথাও, সব সুপার স্টার, তাদের কারও বাড়িতে কাজ ধরাবে বলে নিয়ে গেল। পরে শুনলাম লায়লাকে খারাপ জায়গায় বেচে দিয়েছে। দুমাস আগে দেখলাম, লায়লা আড়াই বাঁকি ফিরেছে। ভালো করে বলছেই না, কী হয়েছে!
রাখালের মুখে একথা শোনার পর মন আরও খারাপ হয়ে যায় নৈঋতের। খুব কষ্ট হতে থাকে। কী করবে ভেবে না পেয়ে রাখালকে বলে, তুই একবার আড়াই বাঁকি যা, নবমীর সঙ্গে কথা বলে যদি কোনও সন্ধান পাস।
রাখাল পানসে করে হেসে বলল, এ ভাবে হলে ভালোই হত, অত সহজে কি হয়! ননার ব্যাপার হয়তো এক চক্র, নবমীর আর এক।
চ তা হলে! থানায় গিয়ে বলি, যদি কিছু হয়!
রাখাল বলল, ও হরি! থানা আপনার-আমার কথা শুনবে ভাবছেন? শুনুন! নন্দুবাবু করলে হবে। পারবেন করাতে? যান, পারলে সঙ্গে নিয়ে যান।
এই কথার পর দুজনই চুপ রইল অনেকক্ষণ। টেবিলের উপর সরমার রেখে যাওয়া বুদ্ধমূর্তির আধবোজা নতদৃষ্টি আর স্বামী বিবেকানন্দের সন্ন্যাসদৃপ্ত বীরত্ব উদ্ভাসিত চোখের দৃষ্টির দিকে তন্নয়-বিষণ-চোখে চেয়ে রইল। তার পর খাট ছেড়ে নেমে পুবের জানলার কাছে এল নৈঋত। দুধরাজ উড়ছে।
আজ রোববার। রাখাল দুপুরের পর মুখশুদ্ধি বেচতে ট্রেন ধরবে। এখন ১০টা। কারণ রোববারে বিক্রি কিছু কম হয়। মুখশুদ্ধি বাবুরা কেনে বেশি। কম মাইনের বাবুরাই রাখালের প্রধান খদ্দের।
ঠিক আছে। আমি নন্দুকে বলব, ফিরিয়ে দাও মিঠুর মাকে, মুম্বাই থেকে আনা করাও। ওকে আমি আর সাহেবপাড়ায় রাখব না। আমি এক জায়গায় কথা বলে রেখেছি নন্দুবাবু, মা সারদার দিব্যি, আমি সরমাকে গোপনে সরিয়ে দেব।
এই বলে বিধবা পাখির লেজের খেলানো ঢেউ দেখতে থাকে নৈঋত।
তার পর জানলার বাইরে থেকে চোখ টেনে এনে ঘরের ভিতরে খাটে বসে থাকা রাখালের চোখে রেখে নৈঋত বলল, নন্দুর টাটে যাব। কিন্তু তোর কাজটা তোকে করতে হবে রাখাল। আড়াই বাঁকি তোকে যেতে হবে। নবমীকে বলবি, ও যদি সরমাকে এনে দেয়, একটা মেয়ে বিক্রির, ওই রকম যুবতীর যা দাম, পুরাকে পুরা তাকে দেওয়া হবে।
রাখাল ফের পানসে করে হাসল।
তার পর বলল, এ ভাবে বলা যায় নাকি!
তা হলে কী ভাবে বলবি?
ভাবতে হবে।
ভেবে নে। দাঁড়া। আপাতত তোকে কিছু দিচ্ছি। বলবি, যদি মুম্বাই যেতে হয়, তুই সঙ্গে সঙ্গে যাবি। খচ্চা যা হবে, নবমী দাসী যেন চিন্তা না করে সুপার স্টার যত আছে, সেখানে-সেখানে যাবি সঙ্গে; দেখবি সরমা কাজ ধরেছে কিনা। যদি দেখিস বহাল হয়ে গিয়ে বেশ আছে, তা হলে সরমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ফিরে আসবি। আর যদি…
টাকা এখন থাক স্যার। পরে যখন লাগবে বলব। আগে আর একবার ভোজেরহাট যাই। ননা ফিরল কিনা দেখি। নন্দুর কাছে এলে, নন্দুর সামনে ধরতে হবে ননাকে, বল কী করেছিস!
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, নবমী আর ননা একই সমিতি। যা বুঝে আয়।
এই ভাবে শুরু হয় অন্বেষণ। নন্দুর সামনেও উপস্থিত হয় নৈঋত শাহু।
নন্দু বললে, সরমাকে পাওয়া যাচ্ছে না বলছ। দেখো ভাই, মাঝে-মাঝে উধাও হয়ে যাওয়া সরমার নতুন না। গেছে। আবার ফিরে আসবে। চিন্তা করো না। বাচ্চাটা ওই ভাবে মরল তো!
এই পর্যন্ত বলে দোকানের খদ্দেরের সঙ্গে সিমেন্টের দর নিয়ে কথা শুরু করলে নন্দু। কথা তাই ছিঁড়ে ছিঁড়ে যেতে থাকল।
যদি একটা থানায় ডায়েরি করা যেত। সাত দিন হয়ে গেল। সয়ার ওখানে নেই। এই সয়া আপনার এখানে আসে। শুনলাম কাজ দেবে বলে মুম্বাই নিয়ে গেছে।
কে আসে?
সয়া। ননা মাণিক্য।
না-না। ননা মাণিক্য না। ননা মানিক। হ্যাঁ আসে। বাঁশদ্রোণীতে আমার একটা কাঠের গোলা আছে ভাই। বিশ্বাসী লোকের অভাবে সেটা আর চালাতে পারছি না। ঠিক করেছি, ওটা বেচে দেব। বাঁশতলায় সরকারদের যে সিনেমা হলটা বন্ধ পড়ে আছে, ওটা আমি কিনেছি। সেটা নীচে লিকারওয়াইন, উপরে সিনেমাÑ এ ভাবে সাজাব।
ননাকে ডেকেছি। ট্রাস্ট করি বলে। গোলাটা ওকে দিয়ে বেচাব। খদ্দের জোগাড়ের দায়িত্ব ওর। ওরে মুকুট।…
আবার সিমেন্ট-বালি-ইটের মধ্যে ঢুকে গেল নন্দু।
বলছিলাম। ননা মানিক বেসিক্যালি দালাল।
বলে উঠল নৈঋত।
হ্যাঁ জমির দালালি করত। এখনও করে টরে। বলল নন্দু।
আর মেয়ের? এই বলে জিজ্ঞাসা শাণিত করে নৈঋত একটু থেমে শুধাল, করে না? পাচার-টাচারে যুক্ত নয় তো? একটু খোঁজ নিলে হয় না?
নন্দু নৈঋতের এ কথায় বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে শান্ত গলায় বলল, হতে পারে। আমি জানব কী করে! তবে সরমা আমাকে কখনও তার সয়া সম্পর্কে কিছু বলেনি। সরমা তোমাকে বলে থাকলে ভালো। ভালোই তো! কিন্তু আমি ননাকে এ কথা বলতে পারব না, হ্যাঁ রে ননা, তুই নাকি… হঠাৎ বলা যায় নাকি… দেখো ভাই, আন্দাজে কাউকে এ ভাবে বলতে যেও না। চাদ্দিকের পরিস্থিতি ভালো না। কখন কী ঘটে। কার ওপর কিসের কোপ পড়ে বলা কঠিন। এখন দেখছি, আমিই ভুল করেছি। তোমার জন্যে কাজের মেয়ে দেখে দেওয়া আমার ঠিক হয়নি।
না। আমি সরাসরি কাউকে দোষ দিচ্ছি না। ননার কাছ থেকেই সরমা উধাও হল, কোথায় গেল? পুলিশ তো ননাকেই সন্দেহ করবে নন্দুদা। যদি মুম্বাইতে কাজ দেয় তো ভালো।
সন্দেহ করলে পুলিশ করবে। তুমি কেন করছ! হঠাৎ যদি কালই সরমা ফিরে আসে, তখন তুমি ননা মানিককে কী বলবে! দেখা গেল, মুম্বাই যায়নি ননা, তখন?
আপনার কাছে এসে, ওকে ডাকবেন, আমি ক্ষমা চেয়ে নেব। কিন্তু ওই সয়াকে আমার ঘোরতর সন্দেহ হচ্ছে নন্দুদা।
ঠিক আছে। শুনলাম। ননা আমার আধচেনা দালাল। বছর খানিক ধরে আসছে। যদ্দুর জেনেছি, কেউ তো বলেনি, ও পাচার-টাচারে আছে। তা-ও বলছি। হতে পারে। কিন্তু তোমাকে বলছি, একটা সামান্য কাজের মেয়ের ব্যাপারে, এত উতলা হওয়া ঠিক নয়। বলা যায় না, সরমার মেয়ের ধর্ষণের ঘটনায় তোমার নাম না জড়িয়ে যায়!
হঠাৎ এ কথা! কী করে জড়াবে নন্দুদা! আপনি তো লোক দিয়ে শ্মশানে মিঠুকে ইলেকট্রিক চুল্লিতে পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থা করেছেন তড়িঘড়ি। সব পাপ তো ছাই হয়ে গেছে।
তুমি দেখছি, কথা বলতেই শেখনি হে! যাও, বাসায় যাও। পরে কথা হবে। যাও।
একবার থানায় গেলে হয় না?
যেতে পার। সরমার কোনও ছবি আছে? নেই। ওরে মুকুট!
অ। তা হলে তো…
পুলিশ আন্দাজে খুঁজবে কী ভাবে? বলি কী ননা তা হলে আসুক। এলে খবর পাবে।
ওর ছবি আপনার কাছে নেই? সরমার একখানা ফোটো। নেই?
ওরে মুকুট! ছবি থাকলেও তো আমি দেব না। কেন দেব? তুমি তো না জেনে, না বুঝে কাকে কী ভাবে ফাঁসাবে তার ঠিক কি আছে কিছু? দাঁড়াও, ননা আসুক, বলছি তো আসুক। এলে পরে শুধোচ্ছি, কত দূর পাচার করে এল।
মুম্বাই পাচার করেছে!
আগেই তো বললে সে কথা। আবার বলবে? বলো।
মুম্বাই।
বেশ।
আমি নিজে যাব। যদি বুঝি, খোঁজ ঠিক মিলেছে, যাব বইকি!
অ্যাই! এই ভাবে পাগলামি কোরো না তো। যদি তুমি এ রকম করো, আমাকে তা হলে ব্যবস্থা নিতে হবে। সাহেবপাড়ায় তুমি টিকতে পারবে না বলে দিচ্ছি!
আপনিই বা এ রকম ননার নামে সাফাই গাইছেন কেন? যে আপনার আধচেনা, তাকে আপনি আড়াল করতে চাইছেন কেন? ওর বাড়ি থেকে সরমা নিরুদ্দেশ হয়েছে। ফলে সে সন্দেহভাজনের তালিকায় প্রথমেই আসবে। এই কথা বলার মধ্যে অন্যায় কোথায়? দয়া করে আপনি সরমার ছবি আমাকে দিন। আমি চেষ্টা করি।
তুমি বাসায় যাও। মাথা ঠাণ্ডা করো। ছবি পাই কিনা দেখছি। তোমার সঙ্গে কথা হবে। যদি ননা সত্যিই কিছু করে থাকে আমি ছাড়ব না। থানায় যাব। সব করব। আর যদি ওর দোষ না থাকে বা দোষ প্রমাণিত না হয়, তোমাকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। আবার বলছি, সরমা আগেও নিরুদ্দেশ হয়েছে। শর্ট টাইম হয়েছে, কিন্তু হয়েছে। হয়নি বলছ?
ও ছুটি নিয়েছে। মিঠুকে ফেলে কোথাও যায়নি। গেলে মিঠুকে সঙ্গে নিয়ে গেছে। এটাকে নিরুদ্দেশ হওয়া বলে না নন্দুদা। বলছি তো। ননা ওকে কোথায় রাখতে নিয়ে গেছে, আপনি দেখুন কাল কথা হবে।
এই বলে নন্দুর দোকান থেকে বার হয়ে চলে আসে নৈঋত। রাস্তায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে নৈঋত ভাবে এ নির্ঘাত পাচারের ঘটনা। রাখালের কথা থেকেই ফুটে ওঠে এই সন্দেহের আভাস। ওই যে নামটা ববি দেওল। ননা মানিকের বউ ভাবনা মানিক বলেছে সইকে তার মরদ কাজ ধরাতে নিয়ে গেছে। ববি দেওলের বাড়ি।
নবমী দাসীও লায়লাকে নিয়ে গিয়েছিল ববির বাড়ির নাম করে। মানে কী? তা হলে কি ননা আর নবমী একই চক্রে নেই? ননা নন্দুর আধচেনা। কথাটা ধাপ্পা। নবমী ও ননা একই চক্রে শামিল। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে নন্দু পুরো আড়াল করছে ননাকে। করবেও।
থানার ব্যাপারে সাহায্য করবে না মোটে।
এখন উপায়?
মাথা নাড়তে নাড়তে কলেজে ঢোকে নৈঋত। আশ্চর্য বিষণতা তার সর্বাঙ্গে; চোখে মুখে আশ্চর্য কষ্ট। তার মনে হল, সরমাকে নিয়ে কথা বলতেও এখন আর উৎসাহ পাবে না সে।
জোর করে মন লাগিয়ে পরপর চারটে ক্লাস নেয় নৈঋত শাহু। তার ব্যস্ততা দেখে কেই কোনও কথা বলতে সাহসই পায় না। তার ব্যস্ততা লক্ষ্য করে ঝুমও চুপ করে রইল।
আপনার গাড়িতে আজও একটু লিফ্ট পেলে ভালো হয়। হবে?
হবে।
কখন?
এখনই।
অল রাইট। আমি ব্যাগটা নিয়ে আসি।
টিচার্স রুমের লম্বা টেবিল থেকে ব্যাগটা তুলে কাঁধে গলিয়ে নেয় নন্দিনী। তার পর ছুটে আসে নৈঋতের গাড়ির কাছে। গাড়িতে ওঠে। গাড়ি ছেড়ে দেয়।
পূর্ব বালিয়ায় নামিয়ে দেব তো, ঝুম!
না। আজ খোকার সঙ্গে আপনার দেখা হতে পারে। অপর্ণা সরকারের ওখানে। যাবেন?
হেঁয়ালি করছেন?
সিরিয়াসলি বলছি। আমি তোমাকে একটুও বুঝে উঠতে পারিনি। আমার সম্বন্ধেও তোমার কোনও স্থির ধারণা নেই। আমরা কাছাকাছি আসি ঠিকই। দুজন দুজনকে পছন্দ করে উঠতে পারি না। কখনও করি, কখনও করি না। ভাবছি, তা হলে দাঁড়াল কী?
আমরা দুজন বড্ড বেশি আলাদা। আমার খুব ছেলেবেলায় বিয়ে হয়েছিল। সেটা দুলি নস্করের শখ। সোনাডিহির উত্তরে পরানবিল, বিলও বটে, গ্রামও বটে। সেই গ্রামের ছেলে জগদীশ দাস ওরফে বিলু। বিলু সদ্য সদ্য কলেজে। আমি ইলেভেনে। বিয়ে হয়ে গেল।
তার পর?
অষ্টমঙ্গলার রাতে একটা ঘটনা ঘটল। যেন সেটা একটা বাসরঘর। বেহুলা-লখিন্দরের যেমন হয়েছিল, কতক সেই ব্যাপার। চার দিকে খুব কথা চলছে। রাত বেড়ে যাচ্ছে। আমার শরীরটা অত্যন্ত খারাপ। কিছুটা জ্বর মতন, বমি করেছি। কী হল কে জানে, নীচু খাটে মাথা রেখে মেঝেয় লেটিয়ে বসে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম।
তার পর?
বিলু ছিল লাজুক আর ভীরু প্রকৃতির। ঘুমিয়ে পড়েছি দেখে, আমাকে না জাগিয়ে খাটে এসে শুয়ে পড়ে। তারপর ঘুমিয়েও পড়ে। উত্তরের একটা জানলা খোলাও ছিল ঘরের। ঢুকে আসে কালসাপ। আমার ঘুমন্ত শরীরও হয়তো কিছু একটা সংকেত বা সাড় পেয়ে চটকা খেয়ে জেগে ওঠে। দেখি স্বামীর বুকের উপর কালনাগ। গলা তুলে, ফণা ফলিয়ে-তুলে ফুঁসছে। ভাগ্য ভালো। আমি স্বামীর পায়ের দিকে ছিলাম। সাপটাকে তার পিছন থেকে মাথার নীচটায়, গলার কাছে, খপ করে ধরলাম।
তার পর?
বিলুর ঘুম ভেঙে গেছে। সে ঘুম ভেঙে দেখছে তার স্ত্রীর হাতে ঝুলছে কালসাপ। সে তো ভয়ে আর্তনাদ করবার চেষ্টা করে, আমি তাকে ধমক দিয়ে বলি, চুপ, ভয় নেই, এ সাপে কামড়ালে কেউ মরে না। এই বলে øেকনেটে ভরে সাপটাকে রেখে দিই।
তার পর?
ভয়ে বিলু সারা রাত, মানে বাকি রাত খাটে জেগে বসে রইল। অদ্ভুত ব্যাপার, সে আমাকে ঘৃণা করছিল, সাপকে যে রকম আমরা ভয়বশত ঘৃণা করি। সেই রকম। তাকে আমি বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম।
হ্যাঁ, কী বলেছিলে?
কালনাগিনী, বেহুলার সাপটা কিন্তু ক্ষীণ বিষধর। তার কামড়ে লখিন্দরের মরার কথা নয়। সে বুঝছিল আবার বুঝছিল না। ভয় তার কিছুতে যাচ্ছিল না। বলছিল, সাপটাকে মেরে ফেলো ঝুম।
বললাম, এ সাপ আমি মারতে পারব না বিলু! ও বললে, আমি বলছি, মেরে ফেলো। আমার ভয় করছে। আমি শুনলাম না। ভোররাতে সাপটাকে তার নিরাপদ জায়গায় ছেড়ে দিয়ে এলাম। ভোরেই আমাকে আমার বাপের বাড়ি ফেলে বিলু পরানবিল চলে গেল।
বুঝলাম। সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল।
বিলু পরে বুঝেছিল, দাম্পত্য ভেঙে দেওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু ওর বাড়ি সে কথা শোনেনি। বলেছিল, সাপ ধরা বউ আমরা নেব না। বেহুলা তার লখিন্দরকে নিজের জীবনে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল, আমি পারিনি। বাবা পরে বলেছিল, সাপ ব্যাপারটাই ছেড়ে দে মা। পাখিতে আয়।
কী আশ্চর্য, তাই না!
তবে অভিনব হাসানই পাখিজীবনের দিকে ঠেলেছে বেশি করে। যা হোক, অবাক হবে না, যদি বলি, খোকা একজন অন্য লোক। সে আমাকে চিনতে চায় না।
কেন?
সামান্য থেমে ঝুম বলল, সিরিয়াসলি বলছি। আজ পর্যন্ত যা বুঝলাম, তা হচ্ছে, অভিনবকে একটুও বুঝে উঠতে পারিনি আমি। তারপর ভাবি, কেন পারলাম না।
কেন?
মানুষের মন শেষ পর্যন্ত সব প্রশ্নের উত্তর দেয় না। দিতে পারে না।
এই কথার পর দুপক্ষই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপর নন্দিনীই কথা বলে ওঠে, অভিনবই পাখিজীবনের দিকে এবং জীবনানন্দের দিকে আমাকে বেশি বেশি করে ঠেলে দিয়েছিল। সহজ করে একটা কথা বলি, জীবনানন্দ একজন গ্রেট বার্ডার। বিরাট বার্ড-লাভার। পাখিকে বুঝতে হয় তার প্রজনন-ঋতুর দেখায়, মানে পর্যবেক্ষণে। ওই ঋতুতেই পাখির বিস্ময়কর ব্যাপার-স্যাপার। গলা খোলে, রং ধরে। কর্কশ গলা মাধুর্যে ভরে যায়। বিশেষ করে পুরুষ পাখির সৌন্দর্যের সীমা থাকে না। এবার ফিরে এসো কবিতাটা দেখুন। একদিন নীল ডিম করেছ বুনন। তারপর কী? আজ তারা শিশিরে নীরব সবই তো প্রজনন-ঋতুর কথা। ডিম ফুটে উঠবে, তবে তো! পাখির ঝরনা হওয়াটাও প্রজননকাল, তাই দিয়ে, সেই পূর্ণতা দিয়ে অনুভব করলে তবেই তো জীবন পূর্ণ হয়। কিন্তু হয় কই।
আবার চুপ করে থাকে ওরা।
আবার কথা বলে উঠল নন্দিনী পাখিরা।
ঘোরতর সমস্যা।
হ্যাঁ নৈঋত। সমস্যা অভিনবর। একথা ঠিক। কিন্তু আমি নেশাগ্রস্তের দ্বারা গ্রস্ত। আমি পরোক্ষ নেশাড়ি। এই গ্রস্ততা, এটা গোটা দুনিয়াজুড়ে নেশাড়ির প্রিয়জনের এক সাংঘাতিক সংকট। আমাকে না চেনার ভান করে অভিনব ওর পিছনে-পিছনে আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াতে চায়। এই একটা ফাঁস থেকে বার হয়ে আসতে হবে নৈঋত।
আশ্চর্য!
ওর হল বাতিকগ্রস্ত পাগলামি, পাগলামিই ওর নেশা, ও পাগল থাকতে ভালোবাসে। ফের আরোগ্যের জন্য সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে চায় না। যা জেনেসিসের মৌলিক নীতির বিরোধী।
নেশাগ্রস্তকে ভালোবাসলে মানুষ স্নায়ুবিকভাবে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নেশাড়ি কেমন আছে, কত কষ্টে আছে, রিহ্যাবে তার কেমন দিন কাটছে এই উদ্বেগ, সর্বক্ষণ এই চিন্তা নেশারই শামিল। খোকা যদি নেশাড়ি হয়, তাহলে ঝুম একজন কো-অ্যাডিক্ট। কিন্তু গল্পটা এই যে, খোকা একজন বার্ডার; পাখি ও প্রকৃতির মধ্যে থাকলে সে অপেক্ষাকৃত সুস্থ থাকে। তবু সে কখনও পুরোপুরি নিরাময় হয় না। নেশাকে ছেড়ে আবার সে নেশাকে ধরে।
এ কথাগুলি নানাভাবে বলে গেল নন্দিনী।
তার পর বলল, আজকাল ভাবি, হাসানের কোথাও আÍসমর্পণ তাই কি সে পুরোপুরি সেরে উঠছে না! যাবে? দেখবে ওকে। অপুদির সঙ্গেও তোমার কথা হতে পারবে।
না ঝুম! আমি তোমাকে পাটুলির ওখানে নামিয়ে দিয়ে সাহেবপাড়া ফিরব।
পাটুলিতে এসে অপর্ণা সরকারের বাড়ির থেকে কিছু দূরে ঝুমকে নামিয়ে দিলে নৈঋত।
তার পর বললে, হাসানের পূর্ণ সুস্থতা কামনা করি ঝুম। হাসানকে বেঁধে রেখে তারই চোখের সামনে নিরীহ বাবা-মাকে জবাই করেছে রাজনৈতিক কর্মীরা। তবু বলছি তোমাদের ভালো হোক। তোমার সঙ্গে স্বপ্নে ভালো ব্যবহার করিনি নন্দিনী; আমাকে ক্ষমা কোরো।
পাঁচ
এক বছর পর আবার পুজো-পুজো গন্ধ।
মণিমাধব এসআই যে গলির মধ্যে খুন হয়েছিলেন, সেখানে এসেছে ওরা।
সেই গলি সুদীর্ঘ-সংকীর্ণ। সেই গলিতে দুটি মানুষ মুখোমুখি হলে দেওয়ালে ঘেঁষে কাত হয়ে পরস্পরকে ডিঙোয় বা পেরিয়ে যায়। তার এক মুখে পাড়া, অন্য মুখে বেপাড়া।
ওরা স্বামী-স্ত্রী একটি মোটরবাইকে সিনেমা দেখে ফিরছিল, চারজনের একটা দল ওদের ফলো করে। ওদের ছিল দুখানা বাইক। এক বাইকে দুজন। আর এক বাইকে দুজন। সিনেমা হলের ওখান থেকেই টার্গেট করে ওরা। তারপর শুরু হয় বিচিত্র রকমের ধূর্ত এক খেলা।
রাস্তার লালবাতি ওদের থামতে বাধ্য করে। একটি বড়ো ব্রিজের কাছের ট্রাফিকে এই সব ঘটনা ঘটছে। এই ব্রিজের পরই রূপপুরের এলাকা শুরু। মণিমাধব ওই রেড সিগন্যালে থেমেছেন। তাঁর বাইকে। তাঁর পরনে সাদা নয়, খাকি পোশাক।
হঠাৎ তার চোখ যায় ঘটনাটার উপর।
একটি বাইকের পিছনে লোকটি দ্রুত নেমে স্বামী-স্ত্রীর বাইরের কাছে গিয়ে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে হাত দিয়ে টেনে স্ত্রীটিকে নামিয়ে নিয়ে নিজের বাইকের কাছে টেনে আনে; বলে, ওঠ!
অর্থাৎ যে বাইকের ব্যাকে সে নিজে বসেছিল, সেখানে ওই বউটিকে উঠে বসবার জন্য ওঠ বলে। ভয়ে স্ত্রীলোকটি উঠে বসে। তখন ধমকদার লোকটি বউটির পিছনে বসে। সামনে যে বাইক চালাচ্ছে সে। মাঝে বউ। তার পিছনে ধমকদার। আর একটি বাইক তার পাশেই। স্বামী তার বাইক রেখে ছুটে আসতে গিয়ে দেখতে পায় মানুষ ও যানবাহনের সোত চলতে শুরু করেছে। সে কী করবে ভেবে না পেয়ে শেষে নিজের বাইকের কাছে যায়।
মণিমাধব কিন্তু আর দেরি করেননি। ধমকদারদের বউ-তুলে-নেওয়া বাইককে ফলো করেন। ধমকদার বাইক প্রথমে রূপপুরের দিকে যেতে শুরু করে। পিছনে পুলিশ বাইক নিয়ে ফলো করছে বুঝে, বাঁ দিকে কেটে অন্য রাস্তা ধরে। অর্থাৎ ধমকদার বাইক গহন কলকাতার দিকেই ফিরে যাওয়ার জন্য বাইপাস ধরে।
অন্য যে বাইক, ধরা যাক, তার নাম চমকদার, সে বাইক লেগে রয়েছে স্বামীর পিছনে। স্বামী ছুটছে পুলিশের থেকে অনেকটাই পিছনে।
বাইপাসের নির্জনতম একটি জায়গায় চমকদার বাইকের দ্বারা ঘটনা ঘটে যায়। বাইক-আরোহী স্বামীটিকে বাইকসুদ্দো হঠাৎ কাত হয়ে পড়ে সড়কের উপর পিছলে চলে যেতে দেখা যায়, কারণ চমকদার বাইক তাকে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। স্বামীর একটি পা সাংঘাতিক, অতি সাংঘাতিক ছড়ে যায় এবং সেই পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াবার শক্তিও থাকে না স্বামীর। সে একলা পড়ে কোঁকাতে থাকে।
ঝড়ের বেগে ছুটছে ধমকদার ও চমকদার বাইক।
চলমান-ধাবমান দুই বাইকের মধ্যবর্তী ধাবমানতায় মণিমাধব। তিনি তার পিছনের ঘটনা দেখে নিয়েছেন। তিনি ইচ্ছে করেই হঠাৎ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েন বাইক নিয়ে।
চমকদার বাইক তাকে ছাড়িয়ে চলে যায়।
তার পর দেখা যায়, ধমকদার বাইকটা থেমে গিয়ে স্ত্রীটিকে রাস্তার পাশে নামিয়ে দিয়ে ফের ছুটে যেতে থাকে। মেয়েটিকে বাইকের ব্যাকে তুলে নেন মণিমাধব।
এ বার সামনের বাইক দুটি বাইপাস ছেড়ে বাঁ দিকের একটি রাস্তায় নেমে যায়। মণিমাধব এ বার বাইক দুটিকে ছেড়ে দিলেই ভালো করতেন। তিনি কিন্তু ফলো করতেই থাকেন।
এখানে বলবার কথা এই যে, স্ত্রীটি ধমক খেয়ে ভয়ে থেমে গিয়েছিল, ভয়ে চিৎকার করেনি এতক্ষণ। পুলিশের বাইকের ব্যাকে বসে সে আশ্বস্ত হয়ে কেঁদে ফেলল।
এটি গল্পের ভাষা। আসলে কী হয়েছিল সব সাক্ষ্য কোথাও নেই। শুধু এইটুকু জানা যায়, দুঃশাসনীয় দুটি বাইক একটি অদ্ভুত মৃত্যুফাঁদের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল রূপপুর থানার মেজোবাবুকে।
দুঃশাসনীয় বাইক দুটি যথাসম্ভব থানা এলাকা এড়িয়ে, যথাসম্ভব রাস্তার পুলিশকে এড়িয়ে তাদের জায়গায় পৌঁছে যেতে চাইছিল। এদিকে মণিমাধবের জেদ চেপে গিয়েছিল।
তিনি ভেবেছিলেন একাই তিনি যথেষ্ট। তাছাড়া প্রয়োজন হলে কলকাতার পুলিশের তিনি সাহায্য পাবেন। বস্তুত তেমনটি ঘটেনি।
গলিঘুঁজি থেকে প্রধান রাস্তা। প্রধান রাস্তা থেকে গলিঘুঁজি। এভাবে দুঃশাসনীয় বাইক দুটি পাড়া ও বেপাড়ার গলির মধ্যে লুব্ধ করে টেনে আনে মণিমাধব পাখিরাকে।
তারপর শোনা যায় ঢাকের আওয়াজ। সঙ্গে কাঁসির ঠাঁই ঠাঁই।
আয়। পাড়ায় আয়। বলে ডেকেছিল ওরা।
তারপর বাইক পাড়ার পুজো-প্যান্ডেলের সামনে ফেলে ওরা ওই সংকীর্ণ গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে। ওরা তাদের মুখের উপরে কালো কাপড় বেঁধে নিয়েছে। তখন দুপুর।
প্যান্ডেলের সামনে বাইক রেখে এবং বউটিকে দাঁড় করিয়ে রেখে মণিমাধব ওই গলির মধ্যে ঢুকলেন কষ্টেসৃষ্টে গলে।
দাঁড়াও! বলে হেঁকে উঠলেন মণি পাখিরা।
ভেবেছিলেন অন্তত একজনকে জ্যান্ত পাকড়াও করবেন। হল না। তার আগেই ওর উপর পড়ল চাদর। তিনি তারই ভিতরে খুন হয়ে গেলেন।
তিনি খুন হয়ে গিয়েছিলেন, সম্ভবত বউটাকে বাঁচাতে গিয়ে। কারণ ওদের একজন বউটার হাত ধরে টেনে নিয়ে ওই সংকীর্ণ গলিতে ঢুকে গিয়েছিল। আচমকা।
এখানে। ঠিক এখানে। বাবাকে ওরা চাদরে জড়িয়ে বসিয়ে রেখে চলে যায়। বাবার মাথাটা বুকের উপর ভেঙে ঝুলে থাকে। দেখো, মাথার উপরে চারতলার ছাদের দেওয়াল থেকে বার হওয়া আশ্চর্য তাজা বট। পাতা কী সবুজ। তখনও তাই-ই ছিল। এর আগে দুবছর এসেছি। এ বার নিয়ে তিনবার হল।
তপা দাসী বলে এক রূপাজীবা ঝুমকে বলেছিল সংকীর্ণ গলির ওই ঘটনা। বউটি চাপা আর্তনাদ করে ছুটে গিয়েছিল গলির ওই খান থেকে, যেখানে মৃত মেজোবাবু বুকে ঘাড় গুঁজে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রয়েছেন, ছুটে গিয়েছিল উল্টো দিকের মুখটায়, ঠিক বেপাড়ার প্রধান গলিতে। তখন দুচারটি রূপাজীবা গলির দরজার মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তাদেরই একজন তপতী বা তপা দাসী।
ভয়ে তপার গা ঘেঁষে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে বউটা।
আই, কে র্যা তুই!
আমি! বলে ভয়ে থরথর করে কাঁদতে কাঁদতে বউ বলে, আমাকে বাঁচাও দিদি!
কী হয় তারপর?
তপা বউটাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে সব শোনে।
তারপর বউটার মুখে গণিকার রং মাখিয়ে দেয়। সন্ধ্যা নামলে বউটাকে গলির রাস্তায় বার করে আনে। ছেড়ে দিয়ে বলে, পালা।
এই ঘটনার ছমাস বাদে তপা তার নিজের ঘরে খুন হয়ে পড়ে থাকে। কারণ তপা ঝুমকে আঙুল তুলে তুলে কী সব বোঝাচ্ছিল এই ছফুটেরও কম প্রস্থের গলিটার মধ্যে।
শুনতে শুনতে আকাশে চোখ তুলল নৈঋত। আকাশ ফিরোজা নীল।
কী ভাবছ নৈঋত?
কিছু না।
ওই দিকটায় নিষিদ্ধ পল্লীর গলিপথ। ওই দিকেই গিয়েছিল বউটা। যাবে?
ঝুম ত্রিপল ঠেলে নৈঋতকে নিয়ে গলে কোনও প্রকারে বেপাড়ার গলিপথে পড়ল। প্রায় উবু হয়ে এসে খাড়া হয়ে দাঁড়াল ওরা। দাঁড়িয়েই নৈঋতের চোখ গেল মেয়েটার ওপর। সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল তার। সে পুরোপুরি বিস্ময়ে-বেদনায় কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে মূর্তিবৎ পুঁতে গেল যেন।
কী দেখছ অমন করে নৈঋত?
কিছু না ঝুম। চলো।
শরতের বিকেল। রূপাজীবার ভিড়ে সরমা গায়েন। নৈঋতকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলে। অন্য এক গণিকার সঙ্গে কথা বলাতে ব্যস্ত হল। এ দিকে আর তাকাল না।
ছয়
একটি সবুজ-রঙা টিয়া তার ঠোঁটে ধরে রেখেছে একটি হলুদ-রঙা পেঁপে পাতা। এটি একটি বিয়ের কার্ড। নন্দিনী পাখিরা বিয়ে করছে অভিনব হাসানকে। এই বিয়ের তত্ত্বাবধান করছে জেনেসিস ফাউন্ডেশন; এই প্রতিষ্ঠানের তরফে এই বিবাহের কনে ও বর পক্ষের হয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে; আমন্ত্রণকারীর নাম রয়েছে নীচে অপর্ণা সরকার।
কার্ডে আমন্ত্রণপ্রাপ্তকে বন্ধু বলে সম্বোধন করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে এটি কোনও নিমন্ত্রণপত্র নয় মোটে।
বন্ধু,
আমরা তোমাকে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমন্ত্রণ জানাই হাসান ও নন্দিনীর বিয়েতে। নন্দিনী পাখিরা আগামী ৩ অক্টোবর ২০১৩ বিয়ে করছে অভিনব হাসানকে। জেনেসিস ফাউন্ডেশন এই বিয়ের তত্ত্বাবধায়ক। কারণ অভিনব ছিল এই সংস্থার অধীনে চিকিৎসাধীন একজন নেশাগ্রস্ত মনোরোগী। তাকে সুস্থ করে তোলা জেনেসিসের পক্ষে সহজ ছিল না। আমরা একটি অভিনব উপায়ে হাসানের চিকিৎসা করে সফল হয়েছি।
পক্ষী পর্যবেক্ষণ ও কবি জীবনানন্দের কবিতা আর এই মহাকবির জীবনোপলব্ধি ও দর্শনকে কাজে লাগিয়েছি। কবি জীবনানন্দের বিচারে স্নায়বিক শুশ্রুষার জন্য মহাপ্রকৃতি, তার গাছপালা-পাখি ইত্যাদি এক সুন্দর ক্ষেত্র কারও কারও ক্ষেত্রে সুন্দরতম মনোভূমি। আমরা এ কাজ করতে পেরেছি হাসানের মনোজগতের শিল্পপ্রবণ গঠন ও জীবনানন্দের প্রতি নিবিড় অনুরাগ লক্ষ্য করে। হাসানকেই ঠিক করতে হয়েছে সে কতটা সুস্থ হয়ে উঠল তা ঠিক করা। নন্দিনী ওরফে ঝুমকে সে চিনতে চাইত না তত দিন পর্যন্ত যতদিন সে নেশা না ছাড়তে পেরেছে। অভিনবর পিতৃদত্ত নাম খোকা হাসান। অভিনব ওর ছোট মামার দেওয়া। বাপ-মা রাজনৈতিক দুষ্কৃতির হাতে হাসানেরই চোখের সামনে খুন হয়েছেন। তবু সে সুস্থ হতে পেরেছেন। ৩ তারিখ এস। এই ঠিকানায়। হাসান আর ঝুমকে শুভেচ্ছা জানাতে। সন্ধ্যা ৬টায় চায়ের নেমন্তন্ন রইল।
তোমাদের আপনার
অপর্ণা সরকার
ঠিকানা :
অপর্ণা সরকারের আমন্ত্রণপত্র বা বিয়ে ব্যাপারের (হাসান ও ঝুমের) নিমন্ত্রণপত্র তিনবার পাঠ করল নৈঋত শাহু।
তিনবারই পাগলের মতো করে নিঃশব্দে হাসল শ্রীশাহু।
তারপর মোবাইল ফোনে ফোন করল নন্দিনীকে।
বলল, কনগ্র্যাচুলেশন ঝুম। মহালয়ার আগের দিন বিয়েটা হবে। বিরাট অভিনন্দন জানাচ্ছি। তুমি হাসানের মোবাইল নম্বরটা দাও তো!
খুশি হয়ে নন্দিনী বলল, দিই।
নম্বর নিয়ে হাসানকে ফোনে ধরল নৈঋত।
হ্যালো বার্ডার অভিনব। বিয়ের আগাম অভিনন্দন। তুমি এখন কোথায়?
হাসান বলল, আপাতত অপুদির পাটুলির বাড়িতে। বিয়ের পর পূর্ব বালিয়ায় ঝুমের যে ফ্ল্যাট, ওখানে।
বেশ। আচ্ছা বলো তো ভাই। আজ থেকে ঠিক বছর খানেক আগে তুমি আমাকে হাক্সলির যে বাণী এসএমএস করেছিলে, সেটা কী?
হ্যাঁ, করেছিলাম।
মনে আছে কথাগুলো? হঠাৎ মনে পড়ল, রাজু বৈদ্য আমার কাছ থেকে আমার মোবাইল নম্বর চেয়ে নিয়েছিল। অদ্ভুত। এক বছর বাদে মনে পড়ে গেল। হয়তো ওর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে তুমি আমাকে হাক্সলির কথাগুলো এসএমএস করছিলে।
হয়তো!
আচ্ছা, বলো তো কথাগুলো। আমার দরকার।
একটু থেমে থেকে হয়তো একটা ঢোক গিলে অভিনব কথাগুলো আউড়ে ওঠে; অ্যান ইনটেলেকচুয়াল ইজ আ পার্সন হু হ্যাজ ডিসকভার্ড সামথিং মোর ইন্টারেস্টিং দ্যান সেক্স।
চমৎকার। কিন্তু আমাকে এ কথা এসএমএস করলে কেন? বিয়ে করছ। আনন্দে আছ। সত্য কথা বলো হাসান।
ফের কিছুক্ষণ চুপ করে রইল অভিনব।
তারপর বলল, রাজুর কাছে শুনেটুনে, ঝুম আর আপনি পাখিরালয়ে এসেছিলেন, কেমন করে শিস দিচ্ছিলেন, ইত্যাদি শোনার পর ঝুমকে হারিয়ে ফেলার ভয় পেয়েছিলাম স্যার। তাই হাক্সলির ওই কথাটা পাঠাই!
বড়োই অদ্ভুত হাসান, বড়োই অদ্ভুত।
হ্যাঁ স্যার। দক্ষিণের এই পাখিরালয়ে ঘুঘুর ডাকে শান্তি আছে, তাই আপনি এসেছেন। ঝুম যেন আমারই থাকে। পাখির ঝরনার ভেতর দিয়ে অন্যভাবে পেতে চাই স্যার ঝুমকে।
এই পাখিরালয়ে এসে তাকে ইয়ে করবেন না। এই আর কী?
এর মানে কী?
স্যার, কিছু মনে করবেন না। শুনেছিলাম, আপনি একজন উইম্যানাইজার, ইওর ইনটেলেক্ট ইজ সিডাকটিভ। ভয় ছিল, ঝুম আপনার দ্বারা সম্মোহিত হবে, সে ফ ভয় স্যার। কিচ্ছু না।
বলো, তুমি মহারাজ সেজে বুদ্ধমূর্তি আর স্বামীজির ফোটো নিয়ে সাহেবপাড়া এসেছিলে? সরমার হাতে ওই মূর্তি আর ফোটো অর্পণ করে ফিরে গেছ?
না স্যার! আমি সরমা নামে কাউকে চিনি না স্যার।
অ।
দুই তরফই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপর হাসান বলল, আপনাকে কথাটা নিশ্চয় পথ দেখাবে স্যার। স্যার, মার্ক টোয়েনের একটা মারাÍক কথা আছে। অতবড় থিংকার কী বলেছেন, শুনবেন স্যার। বলি?
বলো।
Of the delights of the world, Man cares most for sexual intercourse.
He will go to any length for in-risk fortune, character, reputation, life itself.
অ।
হ্যাঁ স্যার! একদিকে হাক্সলি আর একদিকে মার্ক টোয়েন। এই দোটানায় আমরা জীবন কাটাই স্যার। ভয় হয়েছিল, আমি তো নেশাড়ি, যদি ঝুমকে হারিয়ে ফেলি। ঝুমই তো আমার জীবনে পক্ষীবংশীয় নারী। যেমন স্যার, কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বনলতা সেন পক্ষীবংশীয়, তাই তার চোখ পাখির নীড়ের মতো- একটা আশ্রয়। ওই চোখে শান্তি আছে নৈঋত স্যার! পাখির ঝরনা আছে। তাই ভয় পেয়ে আপনাকে ও রকম এসএমএস করেছিলাম। ওই বাণী আমার মতো লোকের একটা অস্ত্র। হয়তো…
থাক। আমার সময় হয়েছে। বুঝলে, আমার সময় হয়েছে। কথার মাদকে আমি পুড়ে যাচ্ছি খোকা! এ বার যেতে হবে।
কোথায় স্যার?
জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দেয় নৈঋত। তার পর টাকার পার্স সঙ্গে নিয়ে বাসায় তালা লাগিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। এখন দুপুর। কীসের একটা ছুটি রয়েছে কলেজে।
রাস্তার কোথাও, বড় রেস্তোরাঁয় ঢুকে পানাহার করে নেয় নৈঋত। আজ গাড়ি সঙ্গে নেয়নি। মেট্রো রেলে এসেছে। পানাহার সাঙ্গ হলে কিছুটা টলতে টলতে রেস্তোরাঁ থেকে বার হয়ে আসে। তার এখন কেন যেন একটা কেমন একটা আÍহননের ইচ্ছে জাগে।
হে মৃত্যু-বিলাসী টলায়মান রঙিন মহাপুরুষ, হে কলেজের ভূগোলের টিচার, মনে রেখো সরমা গায়েন অবশেষে বেশ্যা হয়ে গেছে। তাকে বেশ্যা করে দেওয়া হয়েছে। সে স্কুলে ফার্স্ট গার্ল ছিল। তার কাছে চলো। দেখতে হবে, গায়েন কী পক্ষীবংশীয়? বলব, চলো, ফিরে চলো।
ওই রকমই ঢাক আর কাঁসি বাজছে। পাড়া ও বেপাড়ায়। আর গলিটাও তেমনি সংকীর্ণ, উপরে বটপাতা তেমনই সবুজ। সে দিকে একবার দেখে নিয়ে বেপাড়ার মুখটায় এসে সিধে দরজাটার দিকে তাকাল নৈঋত। দরজাটার কাছে যেতে অল্প গলিপথ যেতে হয়। দরজাটা বন্ধ।
দরজার কড়া নেড়ে ঘাড় নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে নৈঋত।
মিনিট তিন বাদে দরজাটা খুলে যায় এবং প্রশ্ন হয়, কে?
ঘড়িতে এখন বিকেল ৪টে।
আমি সরমা। শাহু মাস্টার।
চিনি না।
কী বললে?
আমি তোমাকে চিনি না বাবু।
এই বলে ভেতরের একটি উঠোনে নেমে গেল সরমা। উঠোন ছোট। তার একস্থানে একটি সিঁড়ি উঠছে, তা দিয়ে একটি মেজনাইন ফ্লোরে যাওয়া যায়, অবশ্য সে সিঁড়ি মেজনাইনের ওখান থেকে বাঁক নিয়ে দোতলায় উঠেছে।
সরমা এগিয়ে গেল। তার গা শাড়ি ঢাকা। ব্লাউজ নেই। তার পিঠের অর্ধাংশ এবং বাহুমূলের কাছাকাছি অংশ চকিতে চোখে পড়ে।
এ কী কথা সরমা!
কী কথা?
আমাকে চেনো না!
আমি সরমা নই বাবু! আমি মরণী মাসোহারা, মুম্বাই। এই দ্যাখেন, আমার ছিমছাম ঘর।
মেজনাইনে ঢুকে পড়ে একটি সাজানো-গোছানো, সুন্দর চাদর পাতা, দুটি-তিনটি নানা সাইজের তাকিয়া-বালিশ এবং ঘরটায় মিষ্টি ধুপের ঘ্রাণ। দেখতে পায় শাহু।
আমি বসব, খাটটায়?
না।
সে কী, কেন?
আমি আজ লোক নিব না শাহু মাস্টার। অত্যন্ত বিস্ময়ে নৈঋত বলল, কেন?
আজ আমার মিঠুর জন্মদিন স্যার। মিঠু আমার মেয়ে।
জানি।
জানি বলাতেই মরণীর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বাবুকে দেখবার জন্য ঘুরল মরণী মাসোহারা। তার পর খাটের উপর আস্তে করে নিতম্ব রেখে দুই পা মেঝেয় রেখে অল্প চিতিয়ে বসল।
তাছাড়া তোমাকে নেওয়া যায় না। নেওয়া যায় না শাহু!
কেন?
না, যায় না।
কোথাও আমার আর জায়গা নেই সরমা।
আমি মরণী মাসোহারা, মুম্বাই। আমার রেট খুব চড়া।
দিব।
শালা বলে কী দিব!
এমন করে বলছ তুমি সরমা!
বলছি, কারণ তুমি আমার মেয়ের…। ব্যস। চলো, তোমাকে বার করে দিই। মদ খেয়ে মাগিবাড়ি এসেছ। গায়ে বিদেশি সেন্ট। চলো, চলো।
আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিলাম সরমা।
আমি কোথাও ফিরব না শাহু।
আমি আসব।
না। তুমি আসবে না। দুধরাজটা আছে নাকি স্যার।
আর কোনও কথা বলে না নৈঋত। মেজনাইন থেকে সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে শোনে, দাঁড়াও! পিছন থেকে ডেকে ওঠে সরমা।
তার পর হাত ধরে নিয়ে আসে সেই সংকীর্ণ গলিতে। উপরের চারা বটগাছটাকে দেখায়। তার ডালে বসে রয়েছে সোনার হলুদ পাখি একটি।
দেখলে, এ বারে সন্তুষ্ট?
হ্যাঁ, মরণী মাসোহারা। আসি, আমার সময় হয়েছে। পাখি আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে। হাঃ! হাঃ! হাঃ!
সরমার চোখের সামনে হেসে উঠল নৈঋত। এবং পাগল হয়ে গেল। তারপর পাখি তাকে নিয়ে চলল দক্ষিণের পাখিরালয়ে। রাজু বৈদ্যর কাছে। সে শিস দিয়ে গাইছে রবীন্দ্রনাথের গান। শ্বেত চন্দনের বিদ্যুৎ-জালের কাছে। ডোবায় ঝরছে নির্জন ভাড়–ল।
শ্বেত চন্দনের দিকে চোখে জল আসে পাগল নৈঋতের। তার শিস শুনে একটি হরবোলা ডেকে উঠছে, ইজের! ইজের!
সেই ডাক কেবলই শুনতে পায় নৈঋত শাহু।
সে হেসে ওঠে।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আবুল বাশার- র আরো পোষ্ট দেখুন

One thought on “নন্দিনী পাখিরা”

  1. কিছু মানুষ ভালোবাসে , কিছু মানুষ স্বপ্ন বাধে । কিছু মানুষ আধার রাতে , চাঁদের সাথে কথা বলে । কিছু মানুষ দুঃখ পোষে, কিছু মানুষ কষ্ট খোঁজে । কিছু মানুষ জোছনা রাতে, একাকী হয়ে চোখের জল ফেলে ।GooD Night

Comments are closed.