মুখোশ

রাহুল আর লোপিতা পার্কে বসে কথা বলছিল। লাঠির মাথায় একগাদা মুখোশ বেঁধে হেঁটে আসা মামুনকে ওরা দূর থেকে দেখতে পায়।

লোপিতা চেঁচিয়ে বলে, দেখো রাহুল, লোকটা কত সুন্দর সুন্দর মুখোশ নিয়ে যাচ্ছে। আমি দুটো মুখোশ নেব?
কোনটা নেবে? রানি?

উঁহু, রানি সাজার শখ আমার নেই। আমি ভালুকের মুখোশ নেব।

ভালুক?

লোপিতা হেসে গড়িয়ে পড়ে, আমি সেই ভালুকটি হব, যে জীবন্ত মানুষকে মরা ভেবে চুপ করে থাকে।

রাহুল গম্ভীর হয়ে ভুরু কুঁচকে বলে, একটি প্রশ্নের উত্তর দাও।

বলো।

সেই ভালুকটি কি বোকা ছিল, না দয়ালু?

নিঃসন্দেহে বোকা। লোকটার ফাঁকি ও ধরতেই পারেনি।

আমার জিজ্ঞাসা এখানে, তুমি বোকা ভালুক হতে চাও কেন?

যেন তোমার ফাঁকি ধরতে না পারি। বোকার মতো জীবনভর তোমাকে ভালোবেসে যেতে চাই।

রাহুল গম্ভীর হয়ে বলে, বোকাদের ভালোবাসা আমার একটুও ভালো লাগে না। আর যাঁরা বোকার ভান করে ভালোবাসতে চায়, সেটা আরো অসহ্য।

লোপিতা খিলখিল করে হেসে ওঠে, তুমি সিরিয়াস হয়ে গেলে দেখছি।

মামুন ওদের কাছে এসে দাঁড়ায়, মুখোশ নিবেন মাগো?

লোপিতা ঘাড় নাড়ে। মামুনের আগ্রহ বেড়ে যায, কোনটা পছন্দ হয় বলেন?

রাহুল দুই হাত ঝাঁকিয়ে বলে, ওর সব পছন্দ। সব নিতে চায়।

খুব ভালো। সবই নেন। সকালে বাঘ হবেন। দুপুরে সিংহ। রতে রানি সাজবেন।

দুজনে অবাক হয়ে তাকায়, একজন মানুষ কি এত কিছু হতে পারে?

খুব পারে। কেন পারবে না?

কেমন করে পারবে? বলুন না? লোপিতার ব্যগ্র কণ্ঠ। মামুন খানিকটা সম্মোহনী ভঙ্গিতে অন্য এক রকম কণ্ঠ ছড়িয়ে দেয়, যখন খুব সাহসী কাজ করবেন তখন বাঘ হবেন। যখন স্বপ্ন দেখবেন, তখন রানি হবেন। যখন আনন্দ করবেন, তখন পাখি হবেন, ফুল হবেন।

রাহুল চেঁচিয়ে ওঠে, দারুণ তো।

মামুনের অন্য রকম কণ্ঠ ছিন্নভিন্ন হয়, কয়টা নেবেন?

অনেকগুলো, বলে লোপিতা মুখোশ বাছতে থাকে। কিন্তু ও বুঝতে পারে, মুখ নিচু করে মুখোশ বাছলেও ওর সমগ্র ইন্দ্রিয় মামুনকেই দেখছে। কারণ মামুনের উপস্থিতি ওকে চঞ্চল করছে।

রাহুলও বেশ কিছুক্ষণ মামুনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মামুনের অস্বস্তি হয়, যেন রাহুলকে বলতে চায় তুমি কি কিছু বলবে? তার আগে রাহুল বলে, আপনি আমার জন্য একটা মুখোশ বানাতে পারবেন?

কেমন?

আপনার নিজের একটা মুখোশ আমাকে বানিয়ে দেবেন। আমি সেটা নেব।

আমার মুখোশ? কেন?

আপনি আমাকে স্বপ্ন দেখাতে পারছেন। দেবেন?

মামুন মৃদু হেসে অন্য প্রসঙ্গে যায়, আপনি বাঘ নিন, সিংহ নিন।

রাহুল মামুনের দিকে তাকিয়ে থাকে, সাহসী মানুষ হতে বলছেন?

দেখুন, এটা আপনাকে বেশ মানাবে। ভারি সুন্দর।

বাহ্, সুন্দর তো, দেখি, দেখি।

রাহুল বাঘের মুখোশটা হাতে নিয়ে বলে, আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না?

জবাব আপনাকে নিজেই বুঝে নিতে হবে। এবার আমি যাই, মাগো।

মামুন চলে যায়। লোপিতা মুখোশ পরে হাসতে থাকে। রাহুল দেখতে পায় লোপিতার হাসিতে মামুনের ছায়া। সে ছায়া দোলাতে দোলাতে লোপিতা বলে, একটা জিনিস খেয়াল করেছ রাহুল?

মানুষটি অন্য রকম।

হ্যাঁ।

ওকে আমরা যেটুকু দেখেছি, সেটা সব নয়। ওর ভেতর অন্য মানুষ আছে। আমার মনে হয়…।

দুই.

তখন রাহুল পাঁচ-ছয়টা মুখোশ হাতে বাড়িতে ঢোকে। মায়ের মুখোমুখি হলে রেহানা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী রে, এত মুখোশ কেন?

একজন অন্য রকম লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে মা। তিনি আমাকে সাহসী মানুষ হতে বলেছেন।

রেহানার ভুরু কুঁচকে যায়, সাহসী মানুষ? কে তিনি?

চিনি না। দেখলাম, মুখোশ নিয়ে ঘুরছেন।

দেখতে কেমন?

বলতে পারব না। এসব মানুষের চেহারার বর্ণনা দেওয়া যায় না, মা।

রাহুল সেই অন্য রকম মানুষের কথা মুখস্থ বলার মতো বলে যায়। তার কথা বলার ভঙ্গি, হেঁটে যাওয়া, হাসি এবং তার ভেতরের বুঝতে না পারা কষ্টের কথাও। রেহানা হেসে ফেলে, তুই দেখছি তার প্রতি অন্ধ হয়ে গেছিস।

তিন.

ঘরে ফিরে নিজের বিছানায় মুখোশগুলো ছড়িয়ে রাখে লোপিতা। আজও পরতে পারে না। একটু পর পর আনমনা হয়ে যায়। ভাবে, তিনি আমাদের সাহসী মানুষ হতে বলেছেন, কিন্তু তাঁকে তো বলা হলো না যে আমাদের পরিবারের একজন ভীষণ সাহসী মানুষ আছেন। তাঁকে আমি খুব ভালোবাসি। মুখোশগুলো জড়ো করে কোলের কাছে নিয়ে শুয়ে পড়ে ও। বাতি নেভানো, রাস্তার লাইটপোস্ট থেকে আলো এসে ঘরটার আঁধার কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ও ঘুমোতে পারে না। মনে হয়, দিনটা অন্য দিনের মতো নয়। এদিনে সন্ধ্যা হয়নি, রাত নামেনি।

চার.

ঘুম আসে না রেহানারও। ও জানে, রায়হানও ঘুমোতে পারছে না। দুজন দুই দিকে ফিরে বিছানায় শুয়ে তাকিয়ে আছে। একটু পর রেহানা ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলে, তুমি কি ভুলে গেছ যে আজ আমাদের বিয়ের তারিখ।

রায়হানের নিস্পৃহ কণ্ঠ, ভুলিনি।

একবার মনেও করলে না?

আমরা তো কখনো দিনটি উদ্‌যাপন করিনি। আজ এ প্রশ্ন উঠছে কেন?

কারণ এ বছর আমাদের বিয়ের পঁচিশ বছর পূর্ণ হলো।

রায়হান উত্তেজিত হয়ে উঠে বসে। তীক্ষ কণ্ঠে বলে, শুধু পঁচিশ? এক শ বছর হলেও কিছু যায় আসে না। কারণ আমার সঙ্গে বিয়েতে তুমি খুশি হতে পারোনি।

রেহানাও উত্তেজিত হয়ে উঠে বসে। ও নিজেও রায়হানের দিকে পিঠ ফিরিয়ে রাখে। ওর শরীরে শুধু রাগ নয়, প্রচণ্ড ক্ষোভও। চেঁচিয়ে বলে, তুমি এই একটি বিষয় নিয়ে পঁচিশ বছর ধরে আমাকে খুঁচিয়ে গেলে। সেদিন তো আমাকে তোমার ভালো লেগেছিল। ভালো লাগা থেকেই তুমি বিয়ে করেছিলে।

আর তুমি তোমার প্রেমিক যুদ্ধে চলে গেলে উপায় না দেখে আমাকে বিয়ে করেছিলে। তখন চারদিকে মিলিটারি ও রাজাকাররা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে অস্থির। কখন কী হয়—এ ভয়।

চুপ করো।

রেহানা চেঁচিয়ে ওঠে, বাজে কথা বোলো না। তুমিও একটা ভালুক। জীবন্ত মানুষকে মরা ভেবে দিন কাটালে, তাকে কোনো দিন বুঝতে চাইলে না।

অভিমানের কান্না ওকে ক্লান্ত করে দেয়। দুজনই বোঝে, পঁচিশ বছর ঘর করার পরও সম্পর্কের টানাপড়েন কাটল না। এক রকম মুখ বুজে দিন কাটিয়ে দেওয়া হলো শুধু।

পাঁচ.

পরদিন রাহুল ও লোপিতা হেঁটে যায় শহরের রাস্তায়। একটা নির্দিষ্ট রাস্তা বা জায়গা হলেও কখনো কখনো তা কী ভয়াবহভাবে অনির্দিষ্ট। সেই অনির্দিষ্ট শূন্যতায় ওরা দেখতে পায়, মামুন পার্কের বেঞ্চে শুয়ে আছে। এক হাতে মুখোশের লাঠিটা ধরে রেখেছে। গুনগুন করে গান গাইছে। বাতাসে মুখোশগুলো নড়ে উঠলে পরস্পরের সংঘর্ষে মৃদু একটা শব্দ ওঠে। মামুনের মনে হয়, এটাও এক রকম গানের সুর। ও নিজের ভেতর তন্ময় হয়ে থাকে, আজ আর ওর কাছে ছেলেমেয়েরা নেই, এই সুরটুকুই বুঝি ওর শূন্যতার পূরণ। দুজনে কাছে গিয়ে দাঁড়ালে মামুন উঠে বসে অবাক হয়ে বলে, আপনারা?

সেদিনের পর থেকে আপনাকে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি।

কেন? আমি একজন সাধারণ মানুষ, আপনারা কেন আমাকে খুঁজছেন?

লোপিতা মামুনের কাছে বসে, মোটেই সাধারণ নন। আমাদের কাছে আপনি অসাধারণ।

মামুন খানিকটা আতঙ্কিত হয়ে বলে, মাগো! এমন করে ভাববেন না।

রাহুল মামুনের হাত ধরে—কেন ভাবব না? আপনার সঙ্গে আমরা গল্প করব।

আমার কোনো গল্প নেই।

আপনার জীবনের সবটাই কি সত্য ঘটনা?

মামুন চুপ করে থাকে। শুনতে পায়, বুকের ভের কট করে শব্দ হলো। ওই শব্দ হলে ওর ঘাড়টা সোজা থাকে না, সেটা বুকের দিকে নেমে আসে।

রাহুল হাসতে হাসতে বলে, খুব ভালো হলো, আপনার সত্যি ঘটনা শুনব।

মামুন হো হো করে হেসে ওঠে, আপনারা আমার পিছু নিয়েছেন কেন বলুন তো?

আপনি কিন্তু আমাদের তুই করে বলবেন, নাম ধরে ডাকবেন। আমি লোপিতা, ও রাহুল। আপনাকে আমরা কী বলে ডাকব?

মামুন এক মুহূর্ত ভেবে বলে, মামা।

লোপিতা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, জানেন—আমার একজনই মামা। মুক্তিযোদ্ধা। পায়ে এখনো একটা বুলেট আছে। বের করা হয়নি। মামা নিজেও বের করতে চান না।

রাহুল বলে, আমার চার মামা। মামারা আমাকে খুব আদর করেন। ওরা কেউই দেখতে পায় না, মামুন কেমন বিষণ্ন হয়ে গেল। রোদে ঘোরার ফলে পুড়ে যাওয়া মুখে গাছের ছায়া লুটিয়ে আছে, তবু সে মুখ স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে না। ওরা এক রকম জোর করে মামুনের বাসায় আসে।

ছয়.

অপরিসর গলিতে ছোট টিনের ঘর। চারদিকে মুখোশ বানানোর সরঞ্জাম ছড়িয়ে আছে। রঙের গন্ধ নাকে লাগে। ঘরের এক কোণে বিছানা, অন্য কোণে রান্নার হাঁড়িকুড়ি, তবু ছিমছাম। দুজনই মুগ্ধ হয়।

আপনি একা থাকেন?

হ্যাঁ, একাই।

লোপিতা আবার একটু জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনার কেউ নেই?

সবই তো ছিল। বাবা, মা, ভাইবোন…। বাক্যটা শেষ হয় না। তার আগেই পুরো দৃশ্যটি মামুনের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দেখতে পায়, ওর বাবা একটি গাছের সঙ্গে বাঁধা। নির্যাতন করছে পাক-আর্মি। ব্রাশফায়ারের শব্দ। আগুন। আর্তনাদ। মুখ থুবড়ে পড়ে যায় মা ও ভাইবোন।

রাহুলের খানিকটা রাগ হয়। মানুষটি কিছুক্ষণ পর পরই আনমনা হয়ে যায়। তবু নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, আপনি কি কিছু ভাবছেন? প্রিয়জনের কথা মনে হচ্ছে?

মামুন জবাব দেয় না। একটা মুখোশ নিয়ে নাড়াচাড়া করে। লোপিতা বলে—জানি, আপনার বুকের ভেতর অনেক কথা।

মামুন হাসে, তোরা অনেক কিছু বুঝতে পারিস। জানিস, তোদের বয়সে আমি ভীষণ বোকা ছিলাম।

বিশ্বাস করতে পারলাম না।

ঠিক আছে, বিশ্বাস করতে হবে না। কী খাবি বল? চা আর মুড়ি?

দুজনেরই মনে হয় মুড়ি খাওয়ার মধ্যে মামুন নিজেকে গুটিয়ে ফেলল।

সাত.

রাহুল বাড়ি ফিরে বাবা-মাকে বৈঠকখানায় দেখে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে, মা আজ সেই লোকটির বাড়ি গিয়েছিলাম।

রায়হান ভুরু কোঁচকায়, কোন লোকটি?

সে এক দারুণ লোক বাবা।

রায়হান ওকে ধমক দেয়, বলবি তো কে? কোথায় পরিচয় হলো?

রাস্তায়।

রায়হান উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ে, রাস্তায়? রাস্তার লোক দারুণ হলো? চালচুলোহীন মানুষ দারুণ হয় কী করে আমি বুঝি না।

তুমি এমন করে বলছ কেন? হতেও তো পারে।

তোমরা মা-ছেলে হয়েছ এক রকম। কোথাকার কে ঠিক নেই! হুট করে দারুণ লোক হয়ে গেল? রাস্তার লোক মানেই চোর, ডাকাত, নইলে সন্ত্রাসী।

রাহুল হো হো করে হাসে, না, বাবা সন্ত্রাসীরা রাস্তায় থাকে না। ওরা বড় বড় বাড়িতে থাকে, গাড়িতে চড়ে।

রায়হান রাগে চিৎকার করে, চুপ করো।

তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?

রাগব না, ছেলেটি কার সঙ্গে মিশছে খোঁজ রাখো না। এভাবে ছেলেকে নিজের মতো করে ঘোরাফেরার জন্য ছেড়ে দিলে ও কি মানুষ হবে?

কী করতে হবে?

সারাক্ষণ পিছে লেগে থাকতে হবে।

অসম্ভব, প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে তার ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার সুযোগ দিতে হয়।

রায়হান ব্যঙ্গ করে বলে, তা হলেই হয়েছে, এই অ্যাটিচুড নিয়ে স্কুলে পড়াও! মানুষ গড়ার কারিগর হয়েছ?

রেহানাও রেগে যায়, আমি ডিটেকটিভ নই, আমি টিচার। আমার ছাত্রছাত্রীদের কপাল ভালো যে আমি তোমার মতো অ্যাটিচুড নিয়ে ওদের পড়াই না।

কী বললে?

তুমি যেভাবে মানুষকে বিচার করো, আমি সেভাবে করি না।

রায়হান রেহানার দিকে না তাকিয়ে রাহুলকে শাসায়, তুমি আর ওই লোকটির সঙ্গে মিশবে না রাহুল।

লোকটি অন্য রকম বাবা।

যে রকমই হোক। ও রাস্তার লোক। খুনিও হতে পারে, শেষে কোথায় একটা বিপদে পড়বে। পুলিশ থানা—উহ্, ভাবতেই পারি না।

তুমি ভীষণ ভীতু বাবা। অল্পতে ভয় পেয়ে যাও।

অচেনা, উটকো লোক সব সময় অ্যাভয়েড করবে। কাগজে দেখো না কত দুর্ঘটনা ঘটে। যাও, আর একটিও কথা বলবে না।

রাহুল কথা না বাড়িয়ে চলে যায়।

আট.

মামুন হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু ও জানে, ও যখন হাঁটে তখন কখনো ওর শরীর হাঁটে না, হাঁটে ওর অনুভব, হাঁটে স্মৃতি এবং একই সঙ্গে হাঁটে ওর মুক্তিযুদ্ধের সময়। এখনো ও যখন হাঁটছে, ও দেখতে পায়, ও রাইফেল নিয়ে দৌড়াচ্ছে। রাইফেল তাক করে উপুড় হয়ে আছে। হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে। প্রচণ্ড গুলির শব্দ। পড়ে গেল পাকিস্তানি সেনা। ওর বিজয়ের আনন্দ।

মামুনের এই অন্য রকম হাঁটা দেখতে পায় রাহুল ও লোপিতা। এই হাঁটার অনুভব নিয়ে ওরা মামুনের মুখোমুখি হয়।

রাহুল বলে, মামা আপনাকে দেখে মনে হচ্ছিল আপনি বুঝি স্বপ্ন দেখতে দেখতে হাঁটছেন।

মামুন মৃদু হেসে বলে, স্বপ্ন তো মানুষই দেখে। জেগে ও ঘুমিয়ে। তোমরা কেমন আছ সাহসী ছেলেমেয়েরা?

দুজনই একসঙ্গে বলে, ভালো।

মামুন বুকটান করে, আমিও ভালো। আমার কোনো অসুখ নেই। খাইদাই, ঘুমাই, কাজ করি। দিব্যি দিন কেটে যায়।

দিব্যি দিন কেটে যায়? কোনো কষ্ট নেই?

কষ্ট থাকলে দিন কাটতে চায় না মামা।

তোরা ভীষণ দুষ্টু। কেবল আমার বুকের ভেতর খামচে ধরিস।

আমরা আপনার সঙ্গে গল্প করতে চাই।

চল্, বসি।

তিনজন পার্কের মধ্যে গাছের নিচে বসে। তিনজনের অজস্র কথার সবটুকু ধরা যায় না। ধরা যায় সেটুকু, যে সংযোগে ওরা এক হয়। রাহুল জিজ্ঞেস করে, আপনি কেন মুখোশ নিয়ে ঘুরে বেড়ান মামা?

মামুন স্বচ্ছন্দে জাবাব দেয়, আনন্দ পাই।

লোপিতা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, শুধু আনন্দ না অন্য কিছু?

মামুন ওদের দিকে তাকায় না। খানিকটা উদাস হয়ে গাছের মাথা দেখে। ওখানে পাখি নেই। শুনতে পায় রাহুলের কণ্ঠ, মামা আপনি কোনো সাহসী কাজ করেছেন?

মামুন চুপ করে থাকে। লোপিতা উসখুস করে, এত চুপ করে থাকলে কি গল্প হয়?

মামুন হেসে ফেলে, তোদের কথা বল্।

আমাদের কিছু বলার নাই। যাদের অনেক কিছু বলার আছে কিন্তু বলে না, তাদের আমি সহ্য করতে পারি না।

যুদ্ধ করা যদি সাহসী কাজ হয়, তা হলে আমি সেই সাহসী কাজটি করেছি। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ।

দুজন উদগ্রীব হয়ে থাকে।

মামুন বলতে শুরু করে, সেদিন ছিল অমাবস্যা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আমরা ছয়জনের একটি দল এক গাঁয়ের মিলিটারি ক্যাম্প আক্রমণ করেছি। আগের দিন আমি আর কাদের গ্রামটি রেকি করেছি। এক বুড়ির সঙ্গে আলাপ হয়।

বোবা ও কালা একটি ছেলে ছাড়া বুড়ির কেউ ছিল না। সেদিন বুড়ি কী বুঝেছিল জানি না। আমাদের বাসি ডাল আর পান্তা ভাত খেতে দিয়েছিল। ফেরার সময় বলেছিল, দরকার হলে আমার কাছে আসিস। সেদিন মিলিটারি ক্যাম্প আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা খতম করি। কিন্তু ওদের অস্ত্রশস্ত্রের মুখে বেশিক্ষণ টিকতে পারলাম না। পিছু হটতে হলো আমাদের। ছুটতে লাগলাম। পেছনে সৈনিকরা তাড়া করছে। আমি আর কাদের মরিয়া হয়ে বুড়ির বাড়িতে ঢুকে বললাম, চাচি বাঁচান। চাচি আমাদের খালি ধানের গোলায় ঢুকিয়ে দিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে মিলিটারিরা এসে হাজির। চিৎকার করছে, মুকুত কিধার গিয়া, মুকুত নিকালো! আমরা প্রমাদ শুনলাম, এই বুঝি ঘরে ঢোকে। বুড়ি ক্ষিপ্রগতিতে আমার রাইফেলটা নিয়ে তার বোবা ছেলের হাতে তুলে দিয়ে ওকে দরজা খুলে বের করে দিলেন। মিলিটারিরা মুকুত মিল গিয়া বলে চেঁচামেচি করে বুড়ির ছেলেকে নিয়ে গেল। শুনতে পেলাম বাইরে গুলির শব্দ। ওকে মেরে ফেলেছে। ওরা চলে গেলে বুড়ি আমাদের বের করে দিয়ে বলল, পালা।

রাহুল চেঁচিয়ে বলে, এও কি সম্ভব!

লোপিতারও একই ভঙ্গি, এটা কি বানানো গল্প?

মামুন রেগে ওঠে, খবরদার! একটি শব্দও বানানো নয়। আমরা এভাবেই যুদ্ধ করেছিলাম।

লোপিতার চোখ ছলছল করে, তিনি কি এখনো বেঁচে আছেন?

মামুন মাথা নাড়ে, আছে।

আপনি দেখতে যান?

প্রতি মাসে যাই। বেচারার কেউ নেই। আমার পথ চেয়েই বসে থাকেন। উদাস হয়ে দাওয়ায় বসে থাকেন। আমার মুখোশগুলো যত্ন করে সাজিয়ে রাখেন। তাঁর কাছে ওগুলো এক অমূল্য ধন। তোদের আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না রে—।

দুজন লাফিয়ে ওঠে, আমরাও তাঁকে দেখতে যাব।

লোপিতা মামুনের হাত চেপে ধরে, আমার খুব ইচ্ছা যাঁরা যুদ্ধ করেছে এমন মানুষদের ছুঁয়ে দেখা। আমরা কি কখনো এমন মানুষ হতে পারব? আমি এঁদের সবার কাছ থেকে একটি করে স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহ করব।

মামুন হাঁটুতে মুখ গুঁজে চুপ করে থাকে।

রাহুল হাত ধরে ঝাঁকুনি দেয়, মামা কিছু বলছেন না যে?

মামুন চোখে জল নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, হ্যাঁ, তোদের নিয়ে যাব। তোদেরকেই যেতে হবে তাঁর কাছে।

নয়.

আজ দুপুরে রেহানারও বারবার চোখে জল আসে। কত কি যে মনে পড়ে—

এত কিছু মনে না পড়লে কী হয়? ক্যাসেটে মৃদু শব্দে গান বাজছে। রেহানা চোখ বুজে গান শুনছে। রায়হান ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ায়। রেহানার দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকায়। বিয়ের পঁচিশ বছর পরও স্ত্রীর সঙ্গে কেমন একটা দূরত্ব অনুভব করে। ব্যাপারটি ও তাড়াতেই পারল না। কখনো রেহানাকে এমন আত্মমগ্ন অবস্থায় দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ক্যাসেটটা বন্ধ করে দিয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, কী হলো, তোমার মন খারাপ নাকি রেহানা?

রেহানা চমকে তাকায়, না তো।

আমি ঢুকলাম, তুমি টেরই পেলে না।

টায়ার্ড লাগছিল।

তোমাকে কিন্তু টায়ার্ড দেখাচ্ছে না। মনে হচ্ছিল, তুমি মগ্ন হয়ে কিছু ভাবছিলে। রেহানা খেপে যায়, কী যে বলো না। কেবল আমার ত্রুটি ধরার চেষ্টা। বিয়ের পর থেকেই কিন্তু আমি দেখছি তুমি আমার পিছে লেগে থাকো।

রায়হান নিমেষে উদাসীন হয়ে ব্যথিত কণ্ঠে বলে, বিয়ের পর থেকে? হ্যাঁ, বলতে পারো বিয়ের পর থেকেই। বিয়ের মাত্র তিন দিন পর শুনেছিলাম, তুমি একজনকে ভালোবাসতে, যে যুদ্ধ করতে গিয়েছে। আচ্ছা রেহানা, তোমার সেই মুক্তিযোদ্ধা প্রেমিকের কথা কি মনে পড়ে?

রেহানা উদ্দীপিত হয়ে বলে, কোনো কোনো স্মৃতি আছে ভোলা যায় না। যুদ্ধের স্মৃতি আমার কাছে তেমন মর্যাদার।

যুদ্ধের নয়, ভালোবাসার স্মৃতি।

প্লিজ রায়হান—!

তোমার কি ধারণা যে তোমার সেই প্রেমিক বেঁচে আছে?

পঁচিশ বছর পর তুমি আমাকে এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারো না।

আহা, চটছ কেন? কলেজে পড়ার সময় এমন প্রেম তো হতেই পারে।

রেহানা কঠিন কণ্ঠে বলে, নিশ্চয়ই পারে।

রায়হান খানিকটা সহানুভূতি দেখায়, লোকটি বোধ হয় বেঁচে নেই রেহানা। থাকলে একদিন না একদিন তোমার সঙ্গে দেখা করত। আমি না হয় বিয়ের পর ওই শহর থেকে বদলি হয়ে এলাম। তাতে কী? দেশটা তো এতটুকু, খুঁজে বের করা তো অসম্ভব নয়।

উহ্, অসহ্য! তোমার নিষ্ঠুরতা সীমাহীন। তুমি প্রচণ্ড রকমের স্যাডিস্ট।

হা হা করে হাসে রায়হান। তারপর ভাবে, স্যাডিজমের খেলা। নিষ্ঠুরতা পার্ট অব লাইফ। ও রেহানাকে উপেক্ষা করে ফুল ভল্যুমে ক্যাসেট প্লেয়ার চালিয়ে দেয়।

মামুনের বাড়িতে রাহুল ও লোপিতা বেশ জমিয়ে বসেছে। একসময় মামুন তেড়ে ওঠে, তোরা আমাকে এত জেরা করছিস কেন বল তো? মানুষ কি একা থাকে না?

রাহুল নির্বিকার কণ্ঠে বলে, থাকে। কিন্তু তার পেছনে একটা কারণও থাকে।

লোপিতা যোগ করে, ঘরসংসার ইত্যাদি গত্বাঁধা জীবনের বাইরে গেলে মানুষ তো তাকে প্রশ্ন করবেই মামা।

মামুন আর রেগে থাকতে পারে না। হা হা হাসিতে ঘর মাতিয়ে দেয়, তোদের আমার এ জন্যই ভালো লাগে। তোরা কেমন আস্তে আস্তে আমার বুকের কাছাকাছি চলে আসিস।

রাহুল নাছোড়বান্দা। আবার প্রশ্ন করে, মামা বিয়ে করেননি মানলাম। কিন্তু ভালোওবাসেননি কাউকে?

মামুন চমকে তাকায়, ভালোবাসা? তারপর চোখ মুছে বলে, ভালোবাসার কুঁড়িটা ফুটে ওঠার আগেই যুদ্ধে চলে যাই।

রাহুল বিড়বিড় করে, তাহলে যুদ্ধ আপনার ভালোবাসা খেয়েছে?

মামুন অন্যদিকে তাকায়। মনে হয়, রাহুল ও লোপিতার দৃষ্টির ক্যামেরায় ওর মুখের বিভিন্ন প্রোফাইল উল্টেপাল্টে যাচ্ছে। ওদের চোখের সামনে সেটা একটা দীর্ঘ ফুটেজ হয়ে যাচ্ছে।

দশ.

রাহুল ও লোপিতা গ্রামে এলো মামুনের সঙ্গে। দেখল, মামুন যেভাবে বর্ণনা করেছে সেভাবেই বুড়ি বারান্দায় বসে আছে, উদাস ও বিষণ্ন হয়ে। ওদের দেখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মুখ। লোপিতা বুড়িকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমি আপনাকে একটু ধরে দেখার জন্য এসেছি নানি!

বুড়ি সরল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, কেন? আমার শরীলডা কি সোনার হইয়ে গেছে?

রাহুল বলে, আমাদের কাছে আপনি সোনার মানুষ নানি!

বুড়ি মামুনের দিকে তাকায়, ও মামুন, অরা কী কয়?

মামুন হেসে মাথা নাড়ে। ওরা বুড়ির সঙ্গে গল্প করে। শহর থেকে নিয়ে যাওয়া মিষ্টি-দই খেতে দেয়। বুড়ি ওদের চাল গুঁড়ো করে বানানো নাড়ু খেতে দেয়। বলে, আমার ভাঙা কুঁড়েতে আইজ উৎসব গো!

ওরা উঠোন, ঘরের চারদিক ঘুরে দেখে। বারান্দার এক কোণে কতগুলো বাবুই পাখির বাসা দেখে লোপিতা হাতে তুলে নেয়, ও মা, কী সুন্দর!

এগুলা আমার ফোলাডার শখের জিনিস ছিল। আমি বুকে ধইরা রাখছি।

আমাকে একটা দিবেন নানি?

তুমি নিবা? কী করবা?

কী করবা? এগুলোর মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের কথা বলব। মামা, ঠিক বলেছি?

রাহুল ও লোপিতাকে জড়িয়ে ধরে মামুন। লোপিতার হাত বুড়ির গলায়। বুড়ির বাড়ি থেকে ফিরে এসে ওরা দুজন অন্য রকম হয়ে যায়। ওদের অনুভব গাঢ় হয়।

রাতে ঘুমে আসে না লোপিতার। মুখোশ নিয়ে নাড়াচাড়া করে। ভাবে, রাহুল যদি আমার জীবন থেকে হারিয়ে যায়, তাহলে আমি কি মামার মতো রাহুলের অপেক্ষায় সারা জীবন কাটাতে পারব? অসম্ভব, আমি কিছুতেই একা কাটাতে পারব না। আমার মনে হবে, জীবনটা নষ্ট করে ফেললাম। আমি হয়তো পাখির মুখোশ পরতে ভুলে যাব, ফুলের মুখোশ পরতে ভুলে যাব। না, এটা হতে পারে না।

পরদিন দুজন মামুনের বাড়িতে আসে। মামুন কাগজ ও রং নিয়ে মুখোশ বানাচ্ছে। গুনগুন করে গান গাইছে। আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে। টিনের বাক্স খুলে রেহানার ছবি বের করে। দখে আবার রেখে দেয়। চোখ মোছে। আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখে রাহুল ও লোপিতা। এগিয়ে এসে রাহুল ডাকে—মামা?

আয়।

কার ছবি দেখছিলে?

মামার সব কথা কি জানতে চাইতে হয়?

রাহুল লজ্জা পেয়ে বলে, ও আচ্ছা। সরি মামা।

মামুন ওর দিকে খেয়াল না করেই বলে, আমার খুব দুঃখ হয় রে, আমার বাবা-মায়ের ছবি আমার কাছে নেই। আমি কৃষকের ছেলে, জমিই ছিল সম্বল। অনেক কষ্ট করে আমাকে কলেজ পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন বাবা। আমি যুদ্ধে গেলে পাকিস্তানি আর্মি বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। শুনেছি, খুব অত্যাচার করেছিল। গ্রামটা পুড়িয়ে দিলে ব্রাশফায়ারে মারা যায় মা আর ভাইবোনগুলো। এখন ভাবি কি জানিস, ছবি আঁকতে পারলে ওদের ছবি এঁকে রাখতাম।

যাঁকে ভালোবাসতেন তাঁকে আর খোঁজেননি?

যুদ্ধ থেকে ফিরে শুনেছি, ওর বিয়ে হয়ে গেছে। তাই আর খুঁজিনি। হেসে বলে, যে অন্যের সংসারে যায় তাঁকে আর খুঁজব কেন! দিন চলেই যায়।

রাহুল আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, দিন কি চলে যায়?

যায় রে যায়।

মামুনের হাত জড়িয়ে রাহুল বলে, আপনি কবে আমাকে আপনার মুখোশ দেবেন? আমি আপনার মতো হতে চাই মামা।

মামুন হো হো করে হাসে, আমার মতো!

লোপিতা চোখ বড় করে বলে, আমারও দাবি আছে আপনার কাছে।

নির্ভয়ে বলে ফেল্।

আপনার একটি স্মৃতিচিহ্ন আমাকে দিতে হবে। যেটা আমাকে যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেবে।

স্মৃতিচিহ্ন? ভাবতে ভাবতে মামুন টিনের বাক্স খুঁজে একটি ধান কাটার কাঁচি ও একটি কুপি বের করে। এটি আমার বাবার ধান কাটার কাঁচি। আর এই কুপিটি আমার মায়ের। দুটোই আমার খুব প্রিয় জিনিস। যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর জিনিস দুটো আমার দূরসম্পর্কের চাচি আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, তোর বাবা-মায়ের এই জিনিস দুটি আমি তোর জন্য রেখেছি। মায়ের কুপিটা আমি তোকে দিলাম লোপিতা। তুই এটা জ্বালিয়ে রাখিস।

মামুন ওটার মধ্যে বাকিটুকু কেরোসিন দিয়ে কুপিটা জ্বালিয়ে দেয়।

বারো.

ছেলেমেয়েদের পড়ানোর সময় এমন একটি প্রজ্বলিত কুপির কথা মনে হচ্ছিল রেহানার। ছোট মফস্বল শহরের কলেজটা, যেখানে—। না, রেহানা মুহূর্তে স্মৃতির দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলে, কাল তোমাদের ছুটি। তোমরা তো জানো, কিসের জন্য ছুটি?

ছেলেমেয়েরা হইচই করে, কাল আমাদের স্বাধীনতা দিবস। রেহানা ওদের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই বলে, হ্যাঁ, কাল আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ওদের দৃষ্টি অদ্ভুত। রেহানা দেখতে পায়, মামুন রাইফেল উঁচিয়ে দৌড়ে আসছে। রাইফেলের মাথায় পতাকা বাঁধা। রেহানা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে। মামুনকে দেখে ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মামুন কাছে এসে ওকে রাইফেলটা দেয়।

কে যেন ডাকল, আপা?

রেহানা চমকে তাকায়, কাল তোমাদের আনন্দের দিন। তোমরা সবাই আনন্দ করবে। আমি জানি, তখন যদি তোমাদের বয়স কুড়ি থাকত, তোমরা সবাই যুদ্ধে যেতে।

সমবেত কণ্ঠে ঘরের ভেতর প্রতিধ্বনিত হয়, আমরা সবাই? যুদ্ধে? ঘণ্টা পড়ে। ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলতে থাকে, যুদ্ধ, যুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ।

রেহানা ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর দৃষ্টির সামনে কোনো আড়াল নেই, কোনো ছায়া পড়ে না, যেন ও চাইলেই যত দূর খুশি তত দূর দেখতে পাবে।

এই দেখাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে রাহুল ও লোপিতার কাছে। ওরা দেখে, স্মৃতিসৌধে দাঁড়িয়ে আছে মামুন। রাহুল কাছে গিয়ে ডাকে, মামা?

লোপিতা মৃদু স্বরে জানতে চায়, তোমার কি মন খারাপ মামা?

আজ আমার আনন্দের দিন রে। মনে হচ্ছে, সবাইকে ডেকে বলি—তোরা সব জয়ধ্বনি কর।

রাহুল ও লোপিতা সঙ্গে সঙ্গে বলে, তোরা সব জয়ধ্বনি কর।

মামুন ওদের আদর করে বলে, আমি জানি তোদের বয়স সেই সময় কুড়ি থাকলে তোরা সবাই যুদ্ধ করতি।

দুজন চেঁচিয়ে ওঠে, ঠিক বলেছেন। আমরা কেউ ঘরে থাকতাম না।

তোরা বাঘ হ, সিংহ হ। বলতে বলতে মামুন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ওদের আর কিছু না বলে এই চলে যাওয়া দেখে দুজন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

তেরো.

স্মৃতিসৌধ থেকে ফিরে রাহুল বাবার মুখোমুখি হয়। রায়হান ভুরু কোঁচকালে ও বলে, স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলাম বাবা।

স্মৃতিসৌধে তো কতবারই গিয়েছিস।

কতবার গিয়েছি বলে আর যাব না?

রায়হান রেগে যায়, কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি আমার পছন্দ হয় না।

তুই আর তোর মা অতীত নিয়ে টানাটানি করতে ভালোবাসিস।

কী বলছ তুমি? শুধুই আমাদের অতীত?

চুপ করে গেলে যে বাবা?

রায়হান কাগজ থেকে মুখ তোলে না।

আমি তোমাকে বলতে চাই যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অতীত নয়, আমাদের জীবন—বেঁচে থাকা এবং মরে যাওয়া। কাগজটা সরাও বাবা।

যে সময়টা চলে গেছে…।

সময়টা চলে যায়নি। সময়টা বর্তমান, প্রতি মুহূর্তের। তুমি তো যুদ্ধ করোনি বাবা।

করিনি।

কী করেছিলে সে সময়?

চাকরি করেছি। যুদ্ধের কয়েক মাস আগে চাকরিতে জয়েন করেছিলাম। নতুন চাকরি, বুঝলি।

যুদ্ধের সময় তো তুমি শুধু চাকরি করোনি, সে সময় আমাদের বিয়েও হয়েছিল।

হ্যাঁ, হয়েছিল। কিন্তু ওকে আমি বলিনি, কারণ সে বিয়েতে তুমি খুশি হওনি। শুধু নিজের ইজ্জত বাঁচানোর জন্য তুমি ওই বিয়েতে রাজি হয়েছিলে।

রেহানা রায়হানের অভিযোগের জবাব না দিয়ে বলতে থাকে, বিয়ের পর যেদিন আমরা ঢাকা চলে আসি, তার পরদিন ওই পাড়ায় মিলিটারি ঢুকেছিল। বাবার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। বাবা-মা, ভাইবোনরা পালিয়ে বেঁচেছিল।

রায়হান হা হা করে হেসে ওঠে।

হাসছ কেন? আজ মনে হয়, সেদিন তুমি একটি প্রচণ্ড সাহসী কাজ করেছিলে। ব্যক্তিগতভাবে তো আমরা সে সময়টাকে আমাদের জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় বলেই চিহ্নিত করতে পারি।

সাহসী কাজ?

সেদিন তুমি তো আমাকে বিয়ে করে তোমার জীবনের একটি বড় ঝুঁকি নিয়েছিলে। সেদিন আমাদের কত ধরনের বিপদ হতে পারত। আমাদের জীবনটা অন্য রকম হয়ে যেতে পারত।

কিন্তু বিয়েতে তুমি খুশি হওনি।

এত বছর পর তোমার যদি এই মনে হয়, তাহলে তুমি বিয়েটা ভেঙে দিলে না কে? রায়হান কিছুক্ষণ পর বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি রেহানা।

আমিও তোমাকে ভালোবাসি। শুধু একটি স্মৃতি কেন আমাদের আড়াল করে রাখবে? জীবনটা তো আমাদের দুজনেরই।

হ্যাঁ, আমাদের দুজনেরই।

রায়হান ব্যাকুল দৃষ্টিতে রেহানার দিকে তাকায়।

চৌদ্দ.

দুই দিন পর রাহুল লোপিতাকে বলে, আমি তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যেতে চাই।

মায়ের কাছে! এত তাড়াতাড়ি? প্লিজ! রাহুল এখন না। আমার ভীষণ ভয় করছে।

ভয় করলে হবে না। আমি ভালোবাসার ঠাঁই চাই লোপিতা। মামুন মামার মতো ভালোবাসা হারিয়ে আমি ভবঘুরে হয়ে যেতে পারব না। মা আমার সেই ঠাঁই। মায়ের কাছেই আমাদের যেতে হবে। তুমি তো জানো, বাবা আমাকে হায়ার স্টাডির জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিতে চান। কি, যাবে না?

লোপিতা ঘাড় নেড়ে বলে, মামুন মামাকে নিয়ে চলো।

দুজন মামুনকে এসে ধরে। মামুন হাসতে হাসতে বলে, ভয় পাচ্ছিস কেন?

মা যদি আমাকে ফিরিয়ে দেন। যদি বকেন।

বকা খেতে পারবি না?

পারব। কিন্তু আমার বিশ্বাস, আপনি থাকলে বকা খেতে হবে না। মা হয়তো কিছুই বলবেন না। লোপিতার আবদারে কণ্ঠ, যাবেন তো মামা?

যাব। ও হ্যাঁ, রাহুল তুই না আমার মুখোশ চেয়েছিলি, এই নে, তোর জন্য বানিয়েছি।

আমারটা কই মামা?

তোরটা? আরেকদিন হবে।

আপনি যাকে ভালোবাসতেন, তার মতো একটি মুখোশ চাই। দেবেন তো?

কেমন করে বানাব? তাকে তো আমি বুকের বাইরে আনতে পারি না। ওই মুখোশ বানানো ভীষণ কঠিন।

ওদের নিয়ে রাহুলের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালে মামুনের মনে হয়, অপরিচিত ফুলের গন্ধ আসছে। শরীরের ভেতরটা বুঝি স্নিগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। খুলে যাচ্ছে জীবনের হাজার হাজার দরজা। ও রাহুলকে বলে, বাড়িটা ভারি সুন্দর রে রাহুল।

তখন দরজা খোলে রেহানা।

মামুনের স্তম্ভিত দৃষ্টির সামনে রেহানা মুক্তিযুদ্ধের এক দীর্ঘ ফুটেজ। তখন দুজনের দৃষ্টি ক্যামেরা হয়ে গেলে ধরা পড়তে থাকে এক বিশাল সময়।

রেহানা চেঁচিয়ে বলে, কী বললে, যুদ্ধ করতে যাচ্ছ?

মামুনের দৃঢ় কণ্ঠ, যেতেই হবে রেহানা। দেশের এত বড় একটা সময়ে আমি কিছুতেই ঘরে বসে থাকতে পারব না।

আর যদি আমাদের দেখা না হয়? বাবা যদি এখান থেকে বদলি হয়ে যান?

তোমাকে আমি খুঁজে বের করব। এই ছোট দেশে তোমাকে খুঁজে বের করা কোনো কঠিন কাজ নয়।

আর যদি…।

মামুন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে, কি? যদি ফিরে না আসি? যদি শহীদ হয়ে যাই? এমন সম্ভাবনা তো এক শ ভাগ। শুধু মনে রেখো আমাকে। আর কিছু চাই না।

দৃশ্য শেষ হলে মামুন দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে রেহানাকে বলে, ও লোপিতা। রাহুল ওকে ভালোবাসে।

মামুন লোপিতার হাত রেহানার হাতে দেয়।

আমি চাই না, আমাদের ছেলেমেয়েদের ভালোবাসা অন্য কোনো যুদ্ধ খেয়ে ফেলুক। আসি।

রাহুল ওর পথ আটকায়, মামা বসবেন না?

মামুন মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ে, বসব। অন্য কোনো সময়ে আবার যদি দেখা হয়।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
সেলিনা হোসেন- র আরো পোষ্ট দেখুন