লোকটি রাজাকার ছিল

চোখের বাঁধন খুলে দেওয়ার পর বোঝা গেল লোকটি খুবই নির্বোধ ধরনের। জগৎ সংসারের অনেক খবরই সে রাখে না।

চেহারায় অলস আয়েশি ভাব। মাথার চুল কদম ছাঁট দেওয়া, কিন্তু রুক্ষ নয়, তেল দিয়ে বেশ পরিপাটি করা। মুখের ঘন কালো দাড়িগোঁফ যতনে ছাঁটা। চোখের কোণে বুঝি সুরমা ছিল, চেপে চোখ বাঁধার ফলে মুছে গেছে। পরনে হাতাঅলা কোরা গেঞ্জি আর নীল ডোরাকাটা লুঙি। গেঞ্জি-লুঙি কোনোটাই খুব বেশি দিনের পুরনো নয়। হাত দুটো পিঠমোড়া করে বাঁধা। এ অবস্থায়ও সে যে বেশ দশাসই এবং তাগড়া জোয়ান, বুঝতে কারো অসুবিধা হচ্ছিল না।
লোকটার দুই পাশে দুজন মুক্তিযোদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। দুজনই অল্পবয়সী। বাইশ-তেইশ বছর বয়স হবে। মাথার রুক্ষ চুল ঘাড় ছাপিয়ে নেমেছে। ভাঙাচোরা মুখ অতিরিক্ত পরিশ্রমে চোয়াড়ে হয়ে গেছে। ভাইরাস আক্রান্ত চোখ লাল টকটকে। চোখের কোণে গাঢ় হয়ে জমেছে কালি। দেখে বোঝা যায়, একটা রাতও নিশ্চিন্তে ঘুমোয় না তারা। দুজনেরই কাঁধে রাইফেল। রাইফেল এবং তাদের শরীরের কাঠামো প্রায় একই ধরনের। একহারা, ঋজু। যদিও লোকটার দুই পাশে তাদের দুজনকে অতিরিক্ত রোগা এবং ক্লান্ত মনে হচ্ছিল, তবু কাঁধের রাইফেল ও শরীর মিলেমিশে এমন একটা রূপ নিয়েছে, কোনটা যে কখন গর্জে উঠবে বোঝা যাচ্ছিল না।

স্কুলঘরটার ভেতর অদ্ভুত এক নির্জনতা। বাইরে দ্রুত ফুরিয়ে আসছে নভেম্বরের বিকেল। মৃদু শীত এবং অন্ধকার একাকার হয়ে এমন এক আবহ তৈরি করেছে ঘরের ভেতর, এই অবস্থায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসার কথা মানুষের। বিশেষ করে অপরাধীদের। কিন্তু লোকটা নির্বিকার। হাত দুটো এখনো বাঁধা। দুই পাশে রাইফেল কাঁধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা, সামনে চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসা একজন, টেবিলের ওপর, তার হাতের কাছে রাখা স্টেনগান। এসব দেখে যতটা ভয় পাওয়ার কথা ততটা ভয় সে পেয়েছে কিংবা পাচ্ছে বলে মনে হয় না; বরং তার চোখে-মুখে চাপা একটা কৌতূহল। মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তিন মুক্তিযোদ্ধার দিকে তাকাচ্ছিল।

চেয়ারে বসা মুক্তিযোদ্ধার নাম রফিক। বয়স তিরিশের ওপর। রোদে পোড়া তামাটে মুখ। একদা যে ফর্সা ছিল, মুখ দেখে বোঝা যায়। তার চোখ এখনো ভাইরাস আক্রান্ত হয়নি। অন্য দুজন মুক্তিযোদ্ধার মতো তার চোখের কোণেও গাঢ় হয়ে জমেছে কালি। তবে চোখের কালি ছাপিয়েও তার তীক্ষ অন্তর্ভেদী চাহনি চোখে পড়ে। দৃষ্টিতে একসঙ্গে অনেক কিছু খেলা করে।

অন্য দুজন মুক্তিযোদ্ধার মতো রফিকের মুখেও অনেক দিনের দাড়িগোঁফ এবং সে বেশ লম্বা। স্কুলঘরের হাতলঅলা চেয়ার ছাপিয়ে অনেক দূর উঠেছে দেহ। রফিক খুুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লোকটাকে দেখছিল। কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই লোকটা খুব সরল গলায় বলল, আমারে বাইন্ধা আনছেন কেন? আপনেরা কারা?

রফিক গম্ভীর গলায় বলল, চোপ। কোনো কথা বলবে না। যা জিজ্ঞেস করব শুধু তার জবাব দেবে। অতিরিক্ত একটা কথা বললে গুলি করে দেব। এটা কী, দেখেছ?

টেবিলের ওপর রাখা স্টেনগান দেখাল রফিক। আশ্চর্য ব্যাপার, লোকটা খুব একটা ভয় পেল বলে মনে হলো না। হাসি হাসি মুখ করে রফিকের দিকে তাকাল। আদুরে গলায় বলল, দেখছি। বন্দুক। কয়দিন পর আমিও এই রকম বন্দুক পামু। কমন্ডার সাবে কইছে।

সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল রফিক—চোপ। তোমাকে না বলেছি অতিরিক্ত কথা বলবে না।

তা বলছেন!

তবে?

কিন্তু দুই-একখান কথা তো না জিগাইয়া পারতাছি না। আমারে বাইন্ধা আনছেন কেন? আমার অপরাধ কী? আপনেরা কারা?

লোকটার দুই পাশে দাঁড়ানো দুজন মুক্তিযোদ্ধার একজনের নাম মজনু, আরেকজনের বাচ্চু। বাচ্চু আমুদে স্বভাবের। কথায় কথায় শব্দ করে হাসে। লোকটার কথা শুনে হেসে ফেলল সে। সঙ্গে সঙ্গে শীতল চোখে তার দিকে তাকাল রফিক। গম্ভীর গলায় বলল, বাচ্চু।

বাচ্চু বুঝে গেল, এরপর রফিক ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া শব্দ করা যাবে না। পাথর হয়ে থাকতে হবে।

বাচ্চু পাথর হয়ে গেল।

লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে রফিক বলল, নাম কী?

লোকটা আহ্লাদি শিশুর মতো ঠোঁট ফোলাল। কইতে পারুম না। হাতবান্ধা মানুষ কথা কইতে পারে?

নিজে খুবই গম্ভীর স্বভাবের মানুষ রফিক। সহজে হাসে না। কিন্তু এ রকম কথা শুনলে কে না হেসে পারে! রফিকও হাসল। কিন্তু বাচ্চু কিংবা মজনু হাসল না। রফিকের আদেশ ছাড়া হাসা যাবে না। তবে তাদের দুজনেরই হাসির চাপে বুক ফেটে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা বুঝল রফিক। সে একটু নরম হলো। হাসিমুখে বাচ্চু ও মজনুর দিকে তাকাল। হালকা কৌতুকের গলায় বলল, ভালো জিনিস ধরে এনেছিস। এটা নিয়ে মজা করা যাবে। যুদ্ধের ফাঁকে মজাও দরকার। তাতে এনার্জি বাড়ে। নাসিরদের ডাক। মজাটা সবাই মিলে করি। তারপর খালপাড় নিয়ে যাব।

বাচ্চু উচ্ছল গলায় বলল, ঠিক আছে।

মিনিটখানেকের মধ্যে দশ-বারোজন মুক্তিযোদ্ধা এসে ঢুকল ঘরে। লোকটার চারপাশে ছড়িয়েছিটিয়ে দাঁড়াল। রফিকের চেয়ে বয়সে সামান্য বড় হবে এমন একজন, নাম আজমত, লোকটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, নিয়ে যাব?

রফিক হাসিমুখে বলল, একটু পরে। তোমাদের ডেকেছি জিনিসটা দেখাবার জন্য। নাম জিজ্ঞেস করেছি, বলল, কইতে পারুম না। হাতবান্ধা মানুষ কথা কইতে পারে?

শুনে হো হো করে হেসে উঠল সবাই। আজমত হাসল না। বলল, এভাবে কথা বলা চালিয়াতিও হতে পারে। রাজাকারদের তো চেন না! শালাদের চালিয়াতির সীমা-পরিসীমা নেই।

রফিক কথা বলার আগেই লোকটা ভুরু কুঁচকে আজমতের দিকে তাকাল। খেঁকুড়ে গলায় বলল, ওই মিয়া, শালা কারে কইলেন? আমারে?

আজমত একটু থতমত খেল। তারপর শীতল চোখে লোকটার দিকে তাকাল। হ্যাঁ, তবে ভুল বলেছি। তুমি কারো শালা হওয়ার উপযুক্ত নও। তুমি একটা শুয়োরের বাচ্চা।

পরিবেশ ভুলে ক্রোধে ফেটে পড়ল লোকটি। খবরদার, গাইল দেবেন না। হাতটা বান্ধা! নাইলে আপনেরে দেইখা লইতাম, কেমনে গাইল দেন। সাহস থাকলে হাত ছাইড়া দেন।

রফিকের দিকে তাকিয়ে হাসল আজমত। তোমার অনুমানই ঠিক। এটা একটা জিনিস।

রফিক বলল, তাহলে হাতের বাঁধনটা খুলে দাও। মজা করি।

লোকটার হাতের বাঁধন খুলে দিল আজমত।

রফিক বলল, পালাবার চেষ্টা করো না। তাহলে আর খালপাড় পর্যন্ত নেওয়া যাবে না।

লোকটা সে কথা শুনল কী শুনল না বোঝা গেল না। একবার ডান হাত একবার বাঁ হাত ডলছে আর মুখে চুক চুক শব্দ করছে। ইস্! মানুষ মানুষরে এমনে বাইন্ধা আনে? দেহেন তো হাত দুইডার কী করছেন? ও মিয়ারা, আমি কি চোর যে আমারে আপনেরা বাইন্ধা আনছেন?

মজনু বলল, তুমি চোর না, চোরের বাপ। রাজাকার।

রজাকার হইছে কী হইছে? মানুষ রজাকার হয় না?

শুনে আবার হো হো করে হেসে উঠল সবাই।

বাচ্চু বলল, শালা নিজেদের নাম পর্যন্ত ঠিকমতো বলতে পারে না। রাজাকারকে বলছে রজাকার।

রফিক গম্ভীর গলায় বলল, আস্তে। এখন আর হাসিঠাট্টা না। আমি কথা বলব।

সঙ্গে সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই।

লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে রফিক বলল, নাম কী?

লোকটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল। এইবার কওন যায়। তার আগে কন, আপনেরা কারা? বেবাকতের লগে বন্দুক, ডাকাইতের লাহান চেহারা! ডাকাইত হইলে আমারে ধরছেন কেন? মাইরা ফালাইলেও চাইর আনা পয়সা দিতে পারুম না। আমি পথের ফকির। ভাত জোটে না দেইখা রজাকার হইছি। সত্য কইরা কন, আপনেরা কারা?

রফিক কথা বলল না। আস্তে করে চেয়ার ঠেলে উঠল। নরম ভঙ্গিতে গিয়ে দাঁড়াল লোকটার সামনে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুহাতে প্রচণ্ড দুটো চড় মারল লোকটার দুই গালে। আমরা তোর যম শুয়োরের বাচ্চা। মুক্তিযোদ্ধা।

হঠাৎ এমন দুখানা চড় খেয়ে খুবই দিশাহারা হলো লোকটা। তবু মুক্তিযোদ্ধা কথাটা শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে রফিকের মুখের দিকে তাকাল। অবাক গলায় বলল, আপনেরা মুক্তিবাহিনী? দেখতে তো দেশগেরামের পোলাপানের লাহানই। আমি তো মনে করছিলাম মুক্তিবাহিনী না জানি কেমুন দেখতে!

এবার লোকটার তলপেট বরাবর প্রচণ্ড একটা লাথি মারল রফিক। আবার কথা!

লাথি খেয়ে কাবু হলো লোকটা। কাঁদো কাঁদো মুখে রফিকের দিকে তাকাল। ভয়ে আর কথা বলল না।

চেয়ারে বসে রফিক বলল, নাম কী?

নিজাম।

কত দিন হলো রাজাকার হয়েছ?

এক মাস বারো দিন।

কেন হয়েছ?

পেটের দায়ে।

পেটের দায়ে কথাটা শুনে ঘরের ভেতরকার প্রতিটা মুক্তিযোদ্ধা স্তব্ধ হয়ে গেল।

নিজাম ঢোক গিলে বলল, ছোড ছোড চাইরডা পোলাপান লইয়া না খাইয়া থাকি। দেশগেরামে কোনো কাম নাই। চাইর দিকে গণ্ডগোল।

রফিক বলল, আগে কী করতে?

কামলা দিতাম। মাইনষের খেতখোলায় ধান কাটতাম, পাট কাটতাম, খেত চষতাম। ফসলের মাস না হইলেও গিরস্তবাড়িত নানানপদের কাম আছিল। খাইয়া-পইরা বাঁচতাম। অনেক দিন ধইরা দেশগেরামে কোনো কাম নাই। পেট চলে না। খিদায় পোলাপানডি রাইত-দিন কান্দে।

রাজাকার হওয়ার বুদ্ধি কে দিল?

চেরমেন সাবে।

তার কাছে গিয়েছিলে কেন?

কামের আশায়। বিপদে পড়লে দেশগেরামের মানুষ চেরমেনের কাছেই যায়। গিয়া কাম চাইলাম। কইল, ভালা কাম আছে, কর। তারবাদে রজাকারিতে লাগাইয়া দিল।

এ কাজে কি তোমার পেট চলছে?

হ, চলতাছে। নাম লেখানোর লগে লগে এক শ টেকা দিল কমন্ডর সাবে। দিয়া কইল বাড়িতে বাজার কইরা দে। তারবাদে টেরনিং হইব।

ট্রেনিং হয়েছে?

না, অহনতরি হয় নাই। লুঙ্গি-গেঞ্জি দিছে, শীতের কাপড় দিছে, জুতা দিছে, হেইডি পিন্দা বাঁশের একখান লাডি হাতে লইয়া বাজারে ঘুইরা বেড়াই, গুদারা ঘাডে যাই, মুক্তিবাহিনী আছেনি, সম্বাত লই। তয় মুক্তিবাহিনীর খালি নামই হুনছি, আইজ পয়লা দেখলাম।

মিলিটারি দেখেছ?

না, কমন্ডর সাবে দেখছে। তার লগে মেলেটারিগো বিরাট খাতির। আমরা হইলাম ছোড রজাকার, আমরা তাগো দেখুম কই থিকা?

নিজামের কথা বলার ধরন আন্তরিক। প্রিয়জনদের কাছে সুখ-দুঃখের গল্প করার ভঙ্গিতে কথা বলছে। মুক্তিযোদ্ধারা স্তব্ধ হয়ে তার কথা শুনছে। তারা বুঝে গেছে, এই সরল গ্রাম্য লোকটা মিথ্যে বলছে না।

তোমাকে রাইফেল দেয়নি কেন?

কমন্ডর সাবে কইছে আরো পরে দিব। আমি আর একটু চালু হইলে। আবার না-ও দিতে পারে। সব রজাকাররে রাইফেল-বন্দুক দেয় না। কিছু ফালতু রজাকারও আছে। আমি হইলাম ফালতু। তয় রজাকার হইয়া আমি বেদম সুখে আছি সাব। চাইল-আটা পাই, টেকা-পয়সা পাই। পোলাপানডি অহন আর খিদায় কান্দে না। এক-দেড় মাসে আমার চেহারাসুরত ভালো হইয়া গেছে।

একটু হেসে ভয়ে ভয়ে নিজাম বলল, আপনেগো কেউর কাছে বিড়ি হইব সাব? মাইর খাইয়া গলা শুকাইয়া গেছে। বিড়ি টানলে কথা কইতে সুবিধা।

রফিক তার বুকপকেট থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট বের করল। একটা সিগ্রেট ছুড়ে দিল নিজামের দিকে। ম্যাচ দিল। নিজাম সিগ্রেট ধরিয়ে ফুক ফুক করে দুটো টান দিল, মাটিতে আয়েশ করে বসল। একটু আরাম কইরা বহি সাব, বইয়া বিড়িডা খাই।

রফিক বলল, তাহলে তুমি পেটের দায়ে রাজাকার হয়েছ?

নিজাম সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ সাব, আর কোনো কারণ নাই।

রাজাকার হওয়ার আর কী কী কারণ থাকতে পারে, তুমি জানো?

না সাব।

মিলিটারি কাকে বলে, মুক্তিযোদ্ধা কাকে বলে জানো?

জানি। মেলিটারি হইল এই দেশের মালিক, আর মুক্তিবাহিনীরা হইল…

কথা শেষ না করে থেমে গেল নিজাম। ভয়ে ভয়ে রফিকের মুখের দিকে তাকাল। কমু না সাব। আপনেরা মুক্তিবাহিনী। কইলে আপনেরা আমারে মাইরা ফালাইবেন। তয় এত কিছু আমি বুজতাম না। আমি বুজতাম খালি পেডের খিদা। চেরমেন সাবে এই সব আমারে বুজাইছে।

তোমাকে ভুল বুঝিয়েছে।

হইতে পারে। চেরমেন সাবে বহুত মিছা কথা কয়। আমরা সাব গরিব মানুষ, কিন্তু মিছা কথা কই না।

আমরা মুক্তিযোদ্ধা, আমাদের দেখে তোমার কী মনে হচ্ছে?

আগেই তো কইলাম, দেশগেরামের পোলাপানের মতোনই মনে হইতাছে।

তার মানে কী? আমরা এ দেশের মানুষ। বাংলার মানুষ। বাংলায় কথা বলি।

জে।

আর মিলিটারিরা?

তারা তো হুনছি অন্য ভাষায় কথা কয়। অন্য দেশের মানুষ।

হ্যাঁ, তারা অন্য দেশের মানুষ। সেই থেকে এসে দখল করতে চাইছে এই দেশ।

জে?

হ্যাঁ। তবে এসবের ভেতর অনেক কথা আছে, অনেক প্যাঁচ আছে। অতসব তুমি বুঝবে না। খুব সহজ কথায় তোমাকে দুয়েকটি ব্যাপার বোঝাই। ধরো তুমি একটা জমির মালিক। চাষবাস করে তুমি তাতে ফসল ফলাও। ফসল পাকলে অন্য গ্রামের কিছু লোক এসে ফসলটা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তুমি তখন কী করবে?

নিজামের চোখ দুটো ধক করে জ্বলে উঠল। জান থাকতে ফসল নিতে দিমু মনে করেন? মইরা যামু, তাও ফসল নিতে দিমু না।

মিলিটারিরা হচ্ছে ওরকম কিছু শয়তান। অন্য দেশ থেকে এসে আমাদের দেশের সব সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের লোকজন মেরে শেষ করে দিচ্ছে। আমাদের মা-বোনদের সর্বনাশ করছে। এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি আমরা। এ দেশ থেকে ওই শয়তানদের তাড়াব আমরা। দেশ স্বাধীন করব।

চোখে পট পট করে কয়েকটা পলক ফেলল নিজাম। কন কী! মেলেটারিরা এই রকম? চেরমেন শালায় তো তাইলে আমারে উল্টাপাল্টা বুঝাইছে।

হ্যাঁ। এখন রজাকার জিনিসটা কী তোমাকে আমি বোঝাই। এ দেশের যেসব শয়তান টাকার লোভে, ক্ষমতা ও সম্পদের লোভে মিলিটারিদের পক্ষে কাজ করছে, তারা হলো রাজাকার।

তাইলে তো রজাকারও দেশের শত্রু। বেইমান। বদ।

হ্যাঁ।

হায় হায়, কিছু না বুইজা, পেটের দায়ে এইডা কী করছি আমি? রজাকার হইছি কেন? আমার মতোন বেইমান তো তাইলে কেউ নাই?

তুমি ভুল করেছ।

এমন ভুল মাইনষের করন উচিত না। দেশের লগে বেইমানি করন মানুষের কাম না।

বেইমানির শাস্তি কী হওয়া উচিত? রাজাকারদের শাস্তি কী হওয়া উচিত, এখন তুমিই বলো? তুমি মুক্তিযোদ্ধা হলে রাজাকারদের কী শাস্তি দিতে?

দাঁতে দাঁত চেপে নিজাম বলল, মাইরা ফালাইতাম। একদম মাইরা ফালাইতাম। এক শালা রাজাকাররেও বাঁচতে দিতাম না। দেশের মানুষ হইয়া দেশের লগে বেইমানি!

রফিক শীতল গম্ভীর গলায় বলল, তোমাকেও আমরা মেরে ফেলব। খালপাড় নিয়ে গুলি করে তোমার লাশ ফেলে দেব খালের জলে। তোমার লাশ দেখে অন্য রাজাকাররা যেন ভয় পায়। অন্য কেউ যেন রাজাকার হওয়ার সাহস না করে।

সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল নিজাম। দৃঢ় গলায় বলল, তয় আর দেরি কইরেন না। তাড়াতাড়ি আমারে খালপাড় লইয়া যান।