আট কুঠুরি নয় দরজা –১৭

গতরাত্রে বিছানায় শুয়ে থাকতে পারেনি ভার্গিস। অন্ধকার থাকতেই উঠে এসে বসেছিল নিজের চেয়ারে। এখন ভোর। এখন এই বিশাল পুলিশ-হেডকোয়ার্টার্স শব্দহীন। এত বড় অফিস-ঘরে তিনি একা। জানলার বাইরে পৃথিবীটা ধীরে ধীরে রং পাল্টাল।
একটা দিন আসছে। হয়তো শেষ দিন তাঁর ক্ষেত্রে। এই দিনটার মোকাবেলা তিনি কিভাবে করবেন। সেটাই স্থির করতে হবে। আজ যদি আকাশলালকে ধরা সম্ভব না হয় তাহলে তাকে চলে যেতে হবে। এই চলে যাওয়া মানে সোমের যে কুঠুরিতে যাওয়ার কথা ছিল সেই মাটির তলায় নির্বাসিত হওয়া। ভার্গিস নড়েচড়ে বসলেন। পায়ের তলায় শিরশির করে উঠলেও তিনি চোয়াল শক্ত করলেন। না, চুপচাপ তিনি দুৰ্ভাগ্যকে মনে নেবেন না। এতকাল যে বিশ্বাস্থতার সঙ্গে কর্তব্য করে গেছেন তার মূল্য কেউ যদি এভাবে দেয় তা মানতে পারেন না তিনি।
গতরাত্রে দুটো ঘটনা ঘটেছে। সোমের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। যে সার্জেন্ট তাকে খবর দিয়েছিল সে তারই নির্দেশে গুলি করেছে সোমের মৃতদেহে। তিনি যে নির্দেশ দিয়েছেন তার কোনও রেকর্ড নেই। মৃতদেহ নিয়ে আসা মাত্র পোস্টমর্টেম করতে পাঠিয়েছেন তিনি। তার রিপোর্ট আজ সকাল ছটায় পাওয়ার কথা। এই পোস্টমটেম করার আদেশ ওই সার্জেন্ট জানেন না। জানে না তার কারণ প্রায় তখনই লোকটাকে ভ্যান সমেত পাঠিয়েছেন বাবু বসন্তলালের বাংলোয়। পোস্টমর্টেম যদি জানা যায় গুলি ছোড়া হয়েছিল অন্যকারণে, সোমের মৃত্যুর পরে, তাহলে সার্জেন্টিটির বারোটা চিরকালের জন্যে বেজে যাবে। মাঝে মাঝে তিনি যে কোন দৈবিক ক্ষমতার ভবিষ্যাৎ দেখতে পান তা নিজেই জানেন না। সোম বিপ্লবীদের গুলিতে নিহত হয়েছে, এমন একটা প্রচার করার কথা ভেবেছিলেন। এক্ষেত্রে পোস্টমর্টেম করানোর তেমন বাসনাই ছিল না। ঠিক তখনই খবরটা এল।
বাবু বসন্তলালের বাংলোর চৌকিদারকে পাওয়া গেছে। লোকটা নাকি স্বাভাবিক নেই ঘটনার পরেই সে ইন্ডিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিল নির্দেশমতো। কিন্তু বিবেকদংশনের কারণে সে আবার ফিরে এসেছে। শহরে ঢুকতে চেয়েছে ম্যাডামেরসঙ্গে দেখা করবে বলে। লোকটাকে চেক পোস্টোর আগেই বাস থেকে নামিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভার্গিস সোমের মৃতদেহের আবিষ্কারক সার্জেন্টিকে পাঠিয়েছেন লোকটাকে জেরা করার জন্যে। ওকে যেন বাবু বসন্তলালের বাংলোতে নিয়ে গিয়ে জেরা করা হয়, এমন নির্দেশ দিয়েছেন। লোকটা বাবু বসন্তলালের মৃত্যুর হদিশ দিতে পারবে। এই অবধি ঠিক ছিল। ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করার পাগলামো ভার্গিসকে সতর্ক করেছিল। খুব বড় একটা সাপ ঝোলা থেকে বেরিয়ে আসবে এবং তিনি যদি সেই সাপটািকে ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে তার বিরুদ্ধ এগিয়ে আসা অস্ত্রগুলোর মোকাবিলা করা সহজ হয়ে যাবে। ব্যাপারটাকে যথেষ্ট গোপনে রাখার চেষ্টা করেছেন ভার্গিস। মিনিস্টারকেও তিনি জানাননি। যদি কোনও সাপ সত্যি বের হয় তাহলে সেটা বের করার দায় চাপবে ওই সার্জেন্টের ওপর লোকটার নাম সহজেই খরচের খাতায় উঠে যাবে।
ঘড়ি দেখলেন তিনি। সকাল নটা বাজতে এখনও অনেক দেরি। সার্জেন্ট গভীর রাত্রে চলে যাওয়ার পর আর রিপোর্ট করেনি। এই রিপোর্ট পাওয়া খুব জরুরি।
ঠিক কাঁটায় ছটায় একটা প্ৰাথমিক পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেলেন তিনি। সোমের শরীরে ভয়ংকর একটা বিষ পাওয়া গিয়েছে যা তার শ্বাসযন্ত্র রুদ্ধ করেছিল। গুলি করা হয়েছিল তার কিছু পরেই। আরও বিস্তারিত রিপোর্ট পাওয়া যাবে পরের রিপোর্টে। এইটুকুই দরকার ছিল। বিশেষ টেলিফোন তুললেন ভার্গিস। সাড়া পেতেই তার কণ্ঠস্বর আপনা থেকেই নেমে গেল! স্যার কাল রাত্রে সোমের মৃত্যু গুলিতে হয়নি।
হোয়াট? মিনিস্টারের চিৎকার কানো এল।
পোস্টমর্টেম বলেছে, ওর শরীরে বিষ পাওয়া গেছে। গুলি পরে করা হয়েছে।
আশ্চর্য আপনারা আরম্ভ করছেন কী? সার্জেন্ট বলেছিল গুলিতে মারা গিয়েছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ! ওর রিভলভাব আর গুলি পেলেই বোঝা যাবে ও সেটা ব্যবহার করেছে কি না। হয়তো কৃতিত্ব নেবার নেশায় মৃতদেহে গুলি করে খবরটা দিয়েছে।
কিন্তু ও কি বলেছে। ওর গুলিতেই মারা গিয়েছে সোম?
না, তা বলেনি।
তাহলে কৃতিত্ব নিচ্ছে কি করে? লোকটাকে এখনই ডাকুন। যদি আপনার অনুমান সত্যি হয় তাহলে মিথ্যেবাদীটাকে চরম শাস্তি দিন।
ঠিক আছে স্যার। ও এনকোয়ারি থেকে ফিরে এলই ব্যবস্থা নিচ্ছি।
ভার্গিস। হঠাৎ মিনিস্টারের গলা বদলে গেল।
ইয়েস স্যার!
ইউ মাস্ট ড়ু সামথিং। আকাশলালকে আজ ধরতেই হবে। আমি তোমাকে বাঁচাতে পারব না ভার্গিস। আজকের দিনটাই তোমার শেষ সুযোগ। লাইনটা কেটে গেল।
ঠিক ছটায় ভার্গিস জানতে পারলেন সেই সার্জেন্ট তিন নম্বর চেকপোস্ট থেকে তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। এক মুহুর্তে দেরি করলেন না। তিনি। একটি ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে জিপ ছুটিয়ে বেরিয়ে গেলেন কাউকে কিছু না জানিয়ে।
ভোর থেকেই রাস্তায় ভিড়। শহর পেরোতে গাড়ির গতি শ্লথ করতে হচ্ছিল বলে ভার্গিসের মেজাজ খিচড়ে যাচ্ছিল। মিনিট কুড়ির মধ্যে তিনি তিন নম্বর চেকপোস্টে পৌঁছাতে পারলেন। সেখানে তখন শহরে ঢোকার জন্যে মানুষের বিশাল লাইন পড়ে গেছে। তারা ভার্গিসকে সভয়ে দেখছিল। চেকপোস্টের সেপাই স্যালুট করে তার পথ তৈরি করে দিতেই তিনি ভ্যানটাকে দেখতে পেলেন। ভ্যানের দরজা খুলে কালকের সেই সার্জেন্টটা নেমে এল। সারারাত না ঘুমোনো পুলিশদের অভ্যোস আছে কিন্তু লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছিল ভূত ভর করেছে। কোনও মতে হাত তুলে কপালে ঠেকাল সার্জেন্ট।
ভার্গিস ওর পাশে জিপ দাঁড় করাতে বলে সার্জেন্টিকে উঠে আসতে নির্দেশ দিল। সার্জেন্ট চুপচাপ নির্দেশ পালন করতে তিনি ড্রাইভারকে জিপ চালাতে বললেন। মিনিট তিনেকের মধ্যে পাহাড়ের ঢালু একটা নির্জন জায়গায় পৌঁছে গেলেন ওঁরা। সার্জেন্টিকে নিয়ে ভার্গিস নেমে এলেন জিপ থেকে। একটা খাদের ধারে দাঁড়িয়ে তিনি লোকটার দিকে তাকালেন, কি হয়েছে? স্যার। সার্জেন্টের গলা খুবই নিচুতে।
ইয়েস মাই বয়।
স্যার আমি কি করব বুঝতে পারছি না।
আমি বুঝিয়ে দেব। লোকটাকে পেয়েছ?
হ্যাঁ স্যার। প্রথমে মনে হয়েছিল ওর মাথা ঠিক নেই। কিছুতেই ওকে দিয়ে কথা বলতে পারছিলাম না। ভোরবেলায় ও বলে ফেলল। কোঁপে উঠল সার্জেন্ট।
কি বলল?
যা বলল তা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। স্যার। আর এই কথাটা যদি আমি রিপোর্ট করি তাহলে আমার কি হবে তাও ধারণা করতে পারছি না।
তুমি আমার কাছে রিপোর্ট করছ। আমি তোমাকে শেল্টার দেব। ইন ফ্যাক্ট তোমাকে আমি ইতিমধ্যে শেল্টার দিয়েছি। ভার্গিস হাসলেন।
কথাটা বুঝলাম না। স্যার।
সোমের বডি পোস্টমর্টেম করে বোঝা গেছে। ওর মৃত্যু কোনও একটা বিষে হয়েছিল। গুলি লেগেছে তার পরে। আর গুলিটা পুলিশের রিভলভারের। এবং তোমাকে গুলি ছুঁড়তে দেখেছে কয়েকজন সেপাই। একটা ডেডবডিকে তুমি কেন গুলি করবে তা মিনিস্টার বুঝতে পারছেন না। রহস্যটা উনি উদ্ধার করতে বলেছেন। ভার্গিস আবার হাসলেন।
সার্জেন্ট চিৎকার করে উঠল, স্যার! আপনি এ কি কথা বলছেন?
মিনিস্টার আমাকে বলেছে। কিন্তু তোমার নার্ভাস হবার দরকার নেই। ওঁকে যা বোঝাবার আমি বুঝিয়েছি? আমার কথা যারা শোনে তাদের আমি বিপদে ফেলি না। এখন বল, লোকটা কি বলেছে? ভার্গিস পকেট থেকে চুরুট বের করলেন।
বাবু বসন্তলালকে খুন করা হয়েছে। কাঁপা গলায় বলল সার্জেন্ট।
খবরটা তুমি কি আগে জানতে না? চুরুট ধরালেন ভার্গিস।
কিন্তু কে খুন করেছে জানেন?
কে?
ওই চৌকিদারটা।
স্বীকার করেছে?।
হ্যাঁ। বিবেকের কামড়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল লোকটা।
ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিল কেন?
স্যার, ও বলেছে, ম্যাডামই ওকে বাধ্য করেছেন বাবু বসন্তলালকে…।
সার্জেন্ট বাক্য শেষ করতে পারল না।
ভার্গিস অনুভব করলেন তার সারা শরীর মনে অজস্র কদমফুল ফুটে উঠল। এই রকম একটা অস্ত্রের কথা কল্পনা করছিলেন তিনি। চট করে সামলে নিয়ে বললেন, তুমি যা বলছি তা নিশ্চয়ই দায়িত্ব নিয়ে বলছা নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবছ?
স্যার! লোকটা ককিয়ে উঠল।
ঠিক আছে। আর কে কে জেনেছে ব্যাপারটা?
আর কেউ নয়। কাউকে বলিনি। ওকে আলাদা জেরা করেছিলাম।
লোকটা এখন কোথায়?
ভ্যানে বসে আছে।
ওই বাংলোয় কোনও পাহারা আছে?
তুমি লোকটাকে নিয়ে একা ওই বাংলোয় ফিরে যাও। আর কাউকে বলে যাওয়ার দরকার নেই। চৌকিদারটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তোমাকে যে করেই হোক, নইলে তোমাকে আমি বাঁচাতে পারব না। ও যেন না পালায় অথবা মারা না যায়। কেউ যেন তোমাদের না দেখে। ঠিক সময়ে আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব। গুড লাক। ভার্গিস জিপের দিকে এগিয়ে গেলেন।

ঠিক নটা বাজতে কয়েক মিনিট আগে ভার্গিস নিজের চেয়ারে আরাম করে বসে চুরুট খাচ্ছিলেন। একটু পরেই টেলিফোনটা বাজার কথা। আর এখন তার লোক শহরের সর্বত্র এই ফোনটা কোথেকে আসছে তা ধরার জন্যে উদগ্রীব।
সকাল সব সময় চমৎকার। ঝকঝকে একটা আস্ত রোদের দিনের শুরুটা যেমন সুন্দর তেমনি এটুলির মতো মেঘেদর দখলে থাকা আকাশ নিয়ে আসা সকালটাও আকাশলালের একই রকম লাগে। হাজার হোক সকাল মানে একটা গোটা রাতের শেষ।
জানলায় দাঁড়িয়ে নাক টেনে বুকে বাতাস ভরল আকাশলাল। এবং সেটা করতে একটু চিনচিনে ব্যথা তৈরি হয়ে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। টোক গিলিল সে। ডাক্তার বলেছে এখন কোনও রকম চাপ বুকে দেওয়া চলবে না। তার বুকের ভেতটায় অপারেশনের পরে প্রাকৃতিক নিয়মগুলোকে খর্ব করা হয়েছে। যা ছিল না, কারও থাকে না তা বসানো হয়েছে।
এই সকালেই আকাশলালের স্নান এবং দাড়ি কামানো শেষ। এখন শরীরটা আবার বেশ চাঙা লাগছে। অপারেশনের পরে এমনটা কখনও বোধ হয়নি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, অন্তত আজকের দিনে তিনি এইটুকু অনুগ্রহ করলেন। ঈশ্বরে অবিশ্বাস নেই আকাশলালের কিন্তু তাকে অবলম্বন সে করে না। এই কারণে বাল্যকালে গুরুজনদের সঙ্গে তার বিরোধ হত। গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা না করলে ঈশ্বর শুনতে পাবেন না বলে যারা মনে করেন। তারা ঈশ্বরের ক্ষমতাকে ছোট করে দেখেন। আমি একজন মুসল্যান অথবা খ্রিস্টান কিংবা হিন্দু হতে পারি জন্মসূত্রে, কিন্তু ঈশ্বরের কোনও জাত নেই। তিনি যদি সর্বশক্তিমান এবং পরমকরুণাময় হন তা হলে তাকে কোনও বাধনে বেঁধে রাখা যায় না। এসব কথার প্রতিবাদ কেউ করত না। কিন্তু শুনতে ভালও বাসত না। নিজেকে একটা মানুষ বলে ভাবাটাই আকাশলালের পছন্দ। আর এই কারণেই মুসলমান অথবা হিন্দুদের সঙ্গে মিশে যেতে কোনও কালেই তার অসুবিধে হত না।
এই রাজ্যে যে কোনও মানুষের পেছনে একটা কাহিনী আছে। হয় সেটা তোষামুদি করে আত্মরক্ষার, নয় অত্যাচারিত হয়ে প্রায় সর্বস্ব ক্ষয়ের। দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষেরাই যখন শতকরা নিরানব্বই তখন তাদের প্রত্যেকের বুকে আগুন চাপা আছে। আকাশলাল বারংবার চেষ্টা করেছে। সেই আগুনটাকে খুঁচিয়ে দাউ দাউ করে তুলতে। অনেকটা এগিয়েও সে এখনও সফর হয়নি, তার কারণ সাধারণ মানুষের ভয়জনিত মানসিক জড়তার জন্যে। তারা তাকে দেখলে উদ্ধৃদ্ধ হয়। তার কথা শুনতে চায়। এই মুহুর্তে যদি দেশে গোপন ব্যালটে ভোট নেওয়া হয় তা হলে আকাশলালের কাছাকাছি কেউ আসতে পারবে না। কথাটা শাসকশ্রেণী জানে বলেই তাকে ধরার জন্যে এত ব্যস্ততা। ওদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখা মানে আর এক ধরণের আত্মহনন। শেষ পর্যন্ত একটা ঝুঁকি নিতে চলেছে সে। প্রত্যেক মানুষকে একবার মরে যেতে হয়ই, দুর্ভাগ্য যদি আসে তা হলে সেই মৃত্যুটা না হয় এবারই হল। জানলা থেকে সরে আসতেই সে দেখল হায়দার ঘরে ঢুকছে।
সুপ্ৰভাত হায়দার, নতুন কোনও খবর?
সুপ্ৰভাত। না, নতুন খবর নয়। ভার্গিস ইতিমধ্যে ঘোষণা করে দিয়েছে আমাদের হাতেই সোম মারা গিয়েছে। তবে কীভাবে মরেছে তা বলেনি। তুমি তো তৈরি হয়ে গেছে।
হায়দার খুব স্বচ্ছন্দ হয়ে কথাগুলো বলল না।
হ্যাঁ। আমি তৈরি। ডাক্তার কোথায়?
আমাদের হাতে এখনও অনেক সময় আছে।
আকাশলাল ঘড়ি দেখল। সত্যি তাই। সে চেয়ারে বসল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ডেভিড এবং ত্ৰিভুবন কোথায়? আমার কিছু আলোচনা আছে।
বলতে না বলতেই ওই দুজনে ঘরে ঢুকল। আকাশলার ওদের দেখল। তারপর ত্ৰিভুবনকে জিজ্ঞাসা করল, হেনা কি গ্রামে ফিরে গেছে?
ত্ৰিভুবন মাথা নাড়ল, না। আজ ও এখানেই থেকে আপনাকে সাহায্য করবে।
ওকে আমার হয়ে ধন্যবাদ দিয়ো। নতুন কোনও খবর?
ডেভিড জবাব দিল, কাল যে সার্জেন্ট সোমের মৃতদেহে গুলি ছুঁড়েছিল তাকে রাত্রেই শহরের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে ভার্গিস। আজ সকাল পর্যন্ত সে ফিরে আসেনি। আর একটা ইন্টারেস্টিং খবর হল, ভার্গিসকে একটু আগে শুধু ড্রাইবারকে সঙ্গে নিয়ে শহরের বাইরে যেতে দেখা গেছে। আমাদের বন্ধুর নজর রাখছে।
শুধু ড্রাইভারকে নিয়ে? এত বড় ঝুঁকি নেওয়ার কারণ? আকাশলালকে চিন্তিত দেখাল।
সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।
খবর না। আজ ভার্গিস টেলিফোনের সামনে থেকে কিছুতেই নড়বে না। অন্তত ওর মত মানুষের নড়া উচিত নয়। সেটা না করে ও যখন শহরের বাইরে গিয়েছে তখন নিশ্চয়ই আরও জরুরি কোনও ঘটনা ঘটেছে।
আকাশলাল নিঃশ্বাস নিল, একটু তাড়াতাড়ি কথা বললে বুকে চাপ বোধ হয়। একটু সময় নিয়ে সে বলল, আমার চিন্তা হচ্ছে। নটার সময় ভার্গিস না থাকলে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। না, যেখানেই যাক লোকটা, নটার আগে ঠিক ফিরে আসবে। ওকে আসতেই হবে। কিন্তু কোথায় যেতে পারে আজকের দিনে।
তিনজন কথা বলল না। উত্তরটা তাদেরও অজানা। ডেভিড বলল, ওহো, আজ ভোরে আমি আপনার কাকার কাছে গিয়েছিলাম।
হুঁ। আকাশলালকে চিন্তিত দেখাল।
আমি ওঁকে ঘুম থেকে তুলে আপনার কথা জিজ্ঞাসা করলাম।
কী বললেন?
বললেন গত তিন বছরে তিনশোবার পুলিশকে জবা দিয়ে দিয়ে তিনি ক্লান্ত তাই নতুন কিছু বলতে পারবেন না। আপনার সঙ্গে ভার পরিবারের কোনও সম্পর্ক নেই।
ভাল। তারপর?
তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম আজ যদি আকাশলাল মারা যায় তা হলে আপনাদের পারিবারিক জমিতে তাকে কবর দিতে আপত্তি হবে কি না। কথাটা শুনে উনি আমার উপর খুব খেপে গেলেন। বললেন, একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেলার কোনও অধিকার আমার নেই। আমি বললাম সাধারণ কৌতূহল থেকেই একথা জানতে চাইছি। তিনি একটু ভেবে মাথা নেড়ে বললেন তার বাবা যেহেতু তাকে খুব ভালবাসত তাই তার কাছে ওকে শুতে দিতেই হবে।
ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ। আকাশলাল হাসল। ত্ৰিভুবনের মুখেও হাসি ফুটিল, আপনার কাকা আর একটু পরিশ্রম বাঁচিয়ে দিলেন।
এবার আকাশলাল দুটো হাত এক করে ভাবল, শোন। তোমরা তিনজন এখানে আছ। আমি জানি সহযোদ্ধা হিসেবে তোমাদের তুলনা নেই এবং তোমাদের দেখা পেয়েছি বলে আমি গর্বিত। আজ যে ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে তাতে নিশ্চয়ই ঝুঁকি আছে। কেন এই ঝুঁকি নিচ্ছি তা অনেকবার তোমাদের বলেছি। এমন তো হতেই পারে বিজ্ঞান ব্যর্থ হল, ভার্গিসের তৎপরতা আরও বেড়ে যাওয়ায় তোমাদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব হল না এবং আমি আর ফিরে এলাম না। এসব হওয়া খুবই স্বাভাবিক। আকাশে মেঘ দেখে কেউ কেউ ছাতা না নিয়েও বের হয় এবং না। ভিজে গন্তব্যে পৌঁছে যায় কারণ বৃষ্টিটা তখন নামেনি। কিন্তু বৃষ্টি নামতে পারে ভেবে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আমি না থাকলে তোমরা কে কী করবে তা নিজেরা ভেবেছ? আকাশলাল পরিষ্কার তাকাল।
তিনজনকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল এমন অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে তারা চাইছে না। কিন্তু আজ আকাশলাল যখন খাদের ধারে পৌঁছে এক পা বাড়িয়ে দিয়েছে তখন তারা কথা বলতে বাধ্য। হায়দার বলল প্রথমে, তোমাকে ছাড়া কাজকর্ম চালানো কঠিন হবে।
ডেভিড বলল, আমি মনে করি কঠিন নয়, অসম্ভব হবে।
ত্ৰিভুবন কথা বলল না, মাথা নেড়ে সায় দিল ডেভিডের মন্তব্য।
সোজা উঠে দাঁড়াল আকাশলাল, আমি তোমাদের কাছে এরকম কথা আশা করিনি। আমার খুব খারাপ লাগছে। এই ভেবে যে এতদিন একসঙ্গে কাজ করে পারতে লড়াইটা ব্যক্তিগত নয়, জনসাধারণের। আমি যেভাবে অত্যাচারিত হয়েছি তোমরাও সেইভাবে অত্যাচার সহ্য করেছ। লড়াইটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব প্ৰত্যেকের।
ত্ৰিভুবন বলল, কিন্তু সাধারণ মানুষ আপনার মুখ চেয়ে-
মুখ্য এই মুখ যদি পাল্টে যায় তা হলে মানুষ আমার পাশে থাকবে না। না, আমি এই কথা বিশ্বাস করি না। পৃথিবীতে কোনও মানুষ অপরিহার্য নয়। একজন চলে গেলে যদি দেশব্যাপী আন্দোলন থেমে যায় তা হলে সেই আন্দোলন শুরু করাই অন্যায় হয়েছিল। আমি না থাকলে আমার জায়গা নেবে তোমরা। তোমাদের মধ্যে একজন নেতৃত্ব দেবে। একজন আকাশলাল মরে গেলে যে ওরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাবে এ যেন না হয়। তাহলে কফিনে শুয়েও আমি শান্তি পাব না। উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলেই হেসে ফেলল, আকাশলাল, অবশ্য মরে যাওয়ার পর শান্তির কী দরকার, যদি সারাজীবনটাই অশান্তিতে কাটে!
চুপচাপ ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ হাটল আকাশলাল। তারপর ঘুরে দাঁড়াল, কে নেতৃত্ব দেবে তা ঠিক করবে। সময় পরিস্থিতির ওপর যে বেশি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে তার ওপর। কিন্তু তোমাদের তৈরি থাকা উচিত এখন থেকেই। আজই আমার শেষ দিন যে হবে না। তার নিশ্চয়তা নেই।
এবার হায়দার কথা বলল, তুমি এ ব্যাপারে দুশ্চিন্তা কোরো না। আকাশলাল হাসল, গুড়। আমি এই কথাটাই শুনতে চেয়েছি। এখন কটা বাজে? ওঃ, সময় কাটতেই চাইছে না। অন্যদিন লাফিয়ে লাফিয়ে ঘড়ির কাটা চলে। ডেভিড, সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো?
ডেভিড এতক্ষণে সহজ হল, হ্যাঁ। পরিকল্পনামাফিক এখনও পর্যন্ত চমৎকার কাজ হয়েছে। শেষ বার আমি মিলিয়ে নিয়েছি।
ত্ৰিভুবন, ঠিক দশটায় মিছিল শুরু হচ্ছে?
হ্যাঁ। কিন্তু এর মধ্যেই মেলার মাঠে পর রাখা যাচ্ছে না।
খবরটা জনসাধারণকে জানাচ্ছি। কীভাবে?
প্রথমে ভেবেছিলাম মাইক ব্যবহার করব। কিন্তু পুলিশের পক্ষে অ্যাকশন নেওয়া সহজ হবে তাতে। গোটা পনেরো গ্যাসবেলুন রেডি রাখা হয়েছে। খবরটা তার গায়ে লিখে উড়িয়ে দেওয়া হবে। লক্ষ লক্ষ লোক একসঙ্গে দেখতে পাবে।
পুলিশ যদি গুলি করে বেলুন চুপসে দেয়?
আমার বিশ্বাস পেট্রলের চেয়ে দ্রুত জ্বলবে খবরটা। মুহুর্তে মধ্যে সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে। ত্ৰিভুবন সহযোদ্ধাদের দিকে তাকাল, অন্য কোনও উপায় মনে এলে বলতে পারেন।
হায়দার মাথা নাড়ল, বেলুন ঠিক আছে। কিন্তু বেলুন ওড়াবার আগে মাইকে যদি ঘোষণা করা হয় তা হলে মন্দ কী! পুলিশ মাইক দখল করে নিয়ে যাবে। নিক না। পুলিশ আসছে দেখলে মাইকম্যান ভিড়ের মধ্যে মিশে যাবে।
আকাশলালকে এখন অনেকটা নিশ্চিত্ত দেখাচ্ছিল। সে এগিয়ে গোল টেবিলের কাছে। ড্রয়ার টেনে একটা মোটা ডায়েরি বের করল। সেটাকে হাতে তুলে সে বলল যদি আমি সত্যি মারা যাই তা হলে এই ডায়েরিতে যা লেখা আছে তা তোমরা অনুগ্রহ করে পড়ে দেখো। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই যেন এই ডায়েরি পুলিশের হাতে না পৌঁছায়। পড়ার পর মনে রাখবে আমি যে রকম শান্ত আছি সেই রকম তোমাদের থাকতে হবে। আবার ডায়েরিটাকে ড্রায়ারে রেখে দিল সে।
আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে মেলার মাঠে আকাশলালকে যদি যেতে হয় তা হলে ওর সঙ্গে হায়দার যাবে। সঙ্গে কিন্তু পাশে নয়। বাকি দুজন তাদের জন্যে নির্দিষ্ট কাজের জায়গায় থাকবে। কোনও রকম গোলমাল হলে হায়দার তাদের খবর দেবে। সঙ্গে সঙ্গে গা ঢাকা দেবে সবাই। সেই সব গোপন আস্তানা এখন থেকেই ঠিক করা আছে।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
সমরেশ মজুমদার- র আরো পোষ্ট দেখুন