তেঁতুল

tetul
চমৎকার একটি রাত নেমে এলো। আকাশভরা তারা। বাতাস বইছে যেন আঙুল দিয়ে আদর করার জন্য। কোনো চোঁয়া ঢেঁকুর বুকের ভেতর ঢলাঢলি করছে না। আরামের সঙ্গে শোওয়ার কামরার বড় জানালার পর্দা সরিয়ে পাশের দুলুনি চেয়ারটায বসলেন আসির রায়হান। রাতে খাবার টেবিলে যে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একটু লেগেছিল তা যেন দূর অতীত এখন। তার মন খুব শান্ত হয়ে পাশের বাড়ির আম গাছটার মতো চুপ হয়ে আছে। তিনি বাতি নিভিয়ে দিয়ে দুলুনি চেয়ারে দোল খেতে খেতে ঝিমোতে লাগলেন। আকাশে তারার সংখ্যা
কখনো বাড়তে লাগল, কখনো কমতে লাগল।
তার স্কুলজীবনের বন্ধু শরীফ খান। পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ লিখেছেন, ‘তরুণী মেয়েদের কেন বুড়ো প্রেমিক পছন্দ!’এ শিরোনামে। শরীফ বন্ধুবান্ধবদের কাছে বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী হিসেবে
পরিচিত। পাঠকও অনেক। তার তরুণ-তরুণী অনুসারীর সংখ্যা ঈর্ষণীয়, তা তার ফেসবুক খুললে বোঝা যায়। আসির রায়হানের ‘দিলে’ যে আজকে খুব শান্তি বইছে তার পেছনে এ প্রবন্ধের একটি ভূমিকা আছে। শরীফকে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, কিন্তু বোঝাতে পারেননি, কারণ শরীফ কারো কথা মেনে নেবেন সে ধাঁচের নন।
যা হোক, তিনি বলেছিলেন, ‘শরীফ, তুই প্রবন্ধটা লেখার আগে যাচাই করে দেখ, ফেসবুকে আমাদের মতো বুড়োদের কাছে যারা বিভিন্ন সম্পর্ক পাতাতে চায়, কেউ কেউ প্রেমিকাও হতে
চায় এরা সবাই হয়তো মেয়ে নয়, ছেলে হয়ে মেয়ের অভিনয় করছে।’
শরীফের সঙ্গে এ খুদে বার্তা আদান-প্রদানের কথা তিনি খাবার টেবিলে গল্পচ্ছলে বললে, মেজ মেয়ে রুমা ফুঁসে উঠে বলেছিল,
‘বাবা, তুমি বা শরীফ আংকেল যে ফেসবুকিং কর এটা আমার পছন্দ হয় না।’
‘কেন রে মা,’ তিনি আদরের ভঙ্গিতে বললেন।
“কারণ বাবা, এবারে কথা বলল তার বড় মেয়ে, যার সম্প্রতি একটা প্রেম ভেঙে গেছে, যাকে এরা বলে‘ব্রেক আপ’, ‘আল্লামা শফি বলেছেন মেয়েরা নাকি তেঁতুলের মতো, ওই তেঁতুলদের সঙ্গে সম্পর্ক করলে তোমারও জিভে জল আসবে, তখন তোমার আর মায়ের মধ্যে হবে ব্রেক আপ। আমি এমনি নিজের ব্রেক আপটার শোক কোথায় রাখব জানি না, তারপর মা-বাবার ব্রেক আপটার ভার বইব কী করে!”
তার দুই মেয়ে আর ছোট এক ছেলে, বশির। বন্ধুবান্ধবদের কাছে যে সে রোবট নামে পরিচিতÑ এ কথা যে তার বাবা-মা জানেন রোবটের তা অজানা নয়।
রোবট বলল,‘এগজ্যাক্টলি, দ্যাটস দ পয়েন্ট। হোয়াই শুড ঔল্ড মেন মেইক ফ্রেন্ডস উইথ ইয়াং উইমেন?’
আসির রায়হান কী করে ছেলেমেয়েদের বোঝাবেন যে বয়স হলেও প্রেমরোগ তো মরে যায় না।
তারিনা, তার স্ত্রী হাসতে হাসতে বললেন, রোবটের যা করার কথা তা এখন তোদের বাবা করছে।
রোবট ফুঁসে উঠে বলল, ‘তুমি মা আবার ওই কথাটা তুলতে চাইছ যে আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, অথচ আমার কেন কোনো মেয়েবন্ধু নেই!’
তারিনের স্বভাব হলো ছেলেমেয়েদের এবং স্বামীকে খোঁচানো। বললেন,‘তোর কল লিস্ট আমি চেক করে দেখেছি,সেখানে কোনো মেয়েবন্ধুর সঙ্গে তোর কথাবার্তা বা মেসেজ আদান-প্রদানের তথ্য নেই।’
রোবট এবার যেন তার ঝগড়া করার শক্তিশালী জায়গাটা খুঁজে পেল। বলল, ‘মা, তুমি আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করছ, এটা কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ। ফাদার, আই টেল ইউ টু, দিস ইজ ইন্টারফিয়ারেন্স। মা, তুমি এটা করতে পার না।’
তারিনা বললেন, ‘দুষ্টু ছেলে, তুই কোনো মেয়ের নাম ছেলেদের নামে সেইভ করিসনি তো,যাতে আমি ধরতে না পারি।’
বড় মেয়ে ইভা বলল, ‘আসলে তা-ই মা। রুমাও তাই করে, সে ছেলেদের নাম মেয়েদের নামে সেইভ করেছে।’
শরীফের প্রবন্ধে শরীফ বলতে চেয়েছেন,তরুণীরা যে ফেসবুকে ঝাঁকে ঝাঁকে ষাটোর্ধ্ব বুড়োদের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে, তার কারণ তিনটি-
এক. এটা তাদের জন্য একটা খেলা। তারা অনেক সময় গ্রুপ করে এটা করছে।
দুই. এটা হয়তো তারা নিরাপদ মনে করে। কারণ তাদের বয়সী যুবকদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করলে নানা ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। কারণ বুড়োদের নমনীয় ভাব তো তরুণদের মধ্যে নাও থাকতে পারে।
তিন. শরীফ বলছেন, অথবা এসব তরুণীরা প্রেমের পাঠের রিহার্সেল হিসেবে ফেসবুকে বুড়োদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে যাচ্ছে। শরীফ প্রবন্ধের শেষাংশে তার অর্থাৎ আসির রায়হানের একটা বক্তব্যও খন্ডন করার প্রয়াস নিয়েছেন। আসির রায়হানের বদ্ধমূল ধারণা হলো ওই তরুণীদের আড়ালে আসলে কিছু স্মার্ট ছেলেই এসব করছে মজা করার জন্য, অথবা সত্যি সত্যি মেয়েরা হলেও ওদের ওপর কেউ একজন অভিভাবক হিসেবে কাজ করছেন, যার হয়তো এটা গবেষণার বিষয় যে বুড়োরা বয়স হলেও কেন তেঁতুল-রোগে ভোগেন।রোজার আগের দিন দুপুরে আসির রায়হান,শরীফ খান, মেহেদী হোসাইন আর প্রদোষ সরকার বসেছিলেন আড্ডায়। একটি অভিজাত ক্লাবে। পানাহার চলছিল। এ কথা সে কথার পর বিষয় চলে গেল ভারচুয়াল রিয়েলিটি অর্থাৎ সাইবার জগৎ প্রসঙ্গে। মেহেদী হোসাইন যশস্বী অধ্যাপক, সম্প্রতি উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রদোষ সরকার সরকারি একটি সংস্থা থেকে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। শরীফ খান তার বিদগ্ধ পান্ডিত্যের পাশাপাশি একটি বেসরকারি সংস্থা চালান, ‘সবুজ জমি’।
চারজনই সমাজের ওপরের স্তরের বাসিন্দা। আসির রায়হান একমাত্র ব্যবসায়ী তাদের মধ্যে,খাদ্যশস্য আমদানি-রপ্তানির একজন বাঘা উদ্যমী লোক। খুব নগণ্য পারিবারিক অবস্থান থেকে তিনি নিজস্ব শ্রম আর মেধা বলে ক্রমে সফল ব্যবসায়ী ও উদ্যমী লোক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। বিয়ে করার সময় তিনি পঁয়ত্রিশ পার হয়েছিলেন, সে জন্য তার ছেলেমেয়েগুলো কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পার করছে, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছে। বাকি তিনজনের ছেলেমেয়েরা সবাই চাকরি জীবনে প্রবেশ করেছে এবং কেউ দেশে থাকে না।
চারজনেরই ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট আছে এবং চারজনেরই একাধিক তরুণী বান্ধবী আছে।
উপাচার্য মেহেদী হোসাইন বললেন, ‘এ ক্লাবে মাশরুমটা ভালো ভাজে না। অন্য কিছু বললে ভালো হতো।’
আসির রায়হান ইঙ্গিতে বয়কে ডাকলেন। ‘এ মাশরুমটা নিয়ে যাও, স্যারের পছন্দ হচ্ছে না। ইয়ে… মানে… চিজ অন টোস্ট নিয়ে এসো। ভালো করে ভাজবে, যাতে ক্রিমের স্বাদটা জিভে না লাগে।’
অন্যদিকে প্রদোষ সরকার পানীয় দেয় যে সে বেয়ারার দিকে ইঙ্গিত করে আঙুল ঘুরিয়ে দিলেন, অর্থাৎ আরেক রাউন্ড।
মেহদী বললেন, ‘এটা একটা ট্র্যাপের মতো মনে হচ্ছে আমার কাছে। তা না হলে কেউ টেলিফোনে কথা বলবে না কেন। আমি মাঝরাতেও টেলিফোন দিয়ে দেখেছি, অনেক সময় মানুষ
অসর্তকতার মধ্যে টেলিফোন ধরে ফেলে। কিন্তু আশ্চর্য ধরল না। তারা সবাই কণ্ঠস্বর না শোনানোর ব্যাপারে এতটা শৃঙ্খলা রক্ষা করছে কীভাবে?’
তখন শরীফ বললেন, ‘এটাই আশ্চর্য, কেউই টেলিফোন ধরে না। শক্তিশালী সিন্ডিকেট। আমার এক জুনিয়র কর্মীকে কয়েকটা নাম্বার দিয়েছিলাম কল সেন্টার থেকে সিমগুলোর মালিক কারা বের করার জন্য, কিন্তু সেখানে নানা আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।’
আসির রায়হান বললেন, ‘দূর, আমি ওই ধরনের ইনভেস্টিগেশনে যেতে চাই না। যদি ছেলেদের সিম হয়, তাহলে রোমান্সটাই মাটি হয়ে যাবে। খামাখা মজাটা মাটি করে লাভ কী? আমার কথা হলো কি শোনেন, ‘ভারচুয়াল রিয়েলিটি ইজ কাল্পনিক বাস্তবতা, তো সেখানে এ টেকনোলজির সাপোর্ট তো আমাদের নিতে হবে। মানে বিশ্বাস করতে হবে তাই, সাদা চোখে যা হয়তো বিশ্বাস করা যায় না। ছেলে হয়ে যদি কেউ মেয়ে হয়ে অ্যাকাউন্ট খোলে, বিশ্বাস করতে হবে যে ওইটা মেয়েই।’
প্রদোষ বললেন, ‘দাদা, আপনি বলতে চাইছেন, ওই প্রান্তে তরুণ হোক বা তরুণী হোক, আমাদের কিছু যায় আসে না, চ্যাট করে মজা পেলেই হলো। দাদা, আপনার কয়টা হলো!’ প্রদোষ আবার টিপ্পনী কেটে বললেন।
পানীয়ের প্রভাবের কারণে তারা সবাই উত্তেজনার প্রথম স্তর পার হয়ে দ্বিতীয় স্তরের মধ্যে আছেন।
শরীফ বললেন, ‘বন্ধু, তুই বেশি খাচ্ছিস না তো,ছেলে আর মেয়ের মধ্যে বর্ডারলাইন গুলিয়ে দিতে চাইছিস।’
আসির রায়হান উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত তুলে কথা বলতে যাবেন, তার হাতের ধাক্কা খেয়ে সামনে রাখা পানীয়ের গ্লাসটা উল্টে গেল। সঙ্গে সঙ্গে টেবিল ক্লথ রক্তিম তরলে ভিজে গেল। এটা যেন কোনো ব্যাপার নয়, সেভাবেই তা সবাই উপেক্ষা করলেন, কিন্তু প্রদোষ বেয়ারাকে আসির রায়হানের গ্লাসটা পূর্ণ করে দেয়ার ইঙ্গিত দিতে ভুললেন না। বেয়ারা যথারীতি টেবিল ক্লথটা
বদলে দিল এবং সঙ্গে আসির রায়হানের জন্য নতুন পানীয় নিয়ে এলো।
‘শোনেন, কেন এরা আসলে মেয়ের ভূমিকায় ছেলে হবে, তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা কী।’ মেহেদী বললেন।
‘ধরুন, আমার জানাশোনার মধ্যে অনেক মেয়ে এবং মহিলার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে, তো তাদের যারা চেনে না, তারা যদি তাদের ফেইক বা ভ- বা ছেলে মনে করে, তাহলে যে ভুলটা হবে, আমরাও হয়তো আমাদের তরুণী বান্ধবীদের ছেলে মনে করে সে একই ভুলই করছি।’
আসির রায়হান নতুন গ্লাসে চুমুক দিয়ে বেশ তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বললেন, ‘আমি বলছি কী,ছেলে কি মেয়ে কি না, চালিয়ে গেলেই তো হলো। ধরুন, পুলিশের গোয়েন্দা কয়েকজন
আমার বন্ধু আছেন, তাদের ওই তরুণীদের মোবাইল নাম্বার দিয়ে বলতে পারতাম-‘পাত্তা লাগাও, কিন্তু তা আমি করতে রাজি নই, কারণ ভারচুয়াল রিয়েলিটির রুলস অব দ্য গেইম আমি মেনে চলতে চাই।’
শরীফ পানীয় বেশিক্ষণ চালাতে পারেন না। ডাক্তার বলেছেন, তার লিভার অতটা আর শক্তিশালী নেই। তাই তিনি বেশ বিরতির পর পর গ্লাসে খানিকটা চুমুক দেন। বাবরি চুলের সাদা
গোছা নাড়িয়ে বললেন, ‘আমি আসিরের পয়েন্ট অব ভিউটা নিতে পারব না। আমি ওইভাবে নিজেকে ঠকাতে চাই না। আমি এ রহস্যটার ভেতরে ঢুকতে চাই। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
নিজের কাছে ঠকার চেয়ে বাজারে ঠকা ভালো। তরঙ্গিণী আর তার বন্ধুরা যদি আমাদের মেয়ে সেজে ঠকায়, ঠকাক, কিন্তু আমি প্রমাণ করতে চাই যে এরা আসলেই ছেলে, তার আগে আমার বিভ্রান্তি যাবে না। খেয়াল করে দেখুন, তাদের ই-মেইলের চিঠি, ফেসবুকের ইন-বক্সের মেসেজ কিংবা মোবাইলের এসএমএস এবং তাদের পাঠানো ছবি- এসব ডিলিংয়ের কোথাও মনে হয় না যে এরা নারী ছাড়া অন্য কিছু। এদের ভাষা,বর্ণনার ঢং, অনুভূতির প্রকাশ সবই একান্ত মেয়েলী। সবকিছুর মধ্যে একটা কোমলতা আছে,যা ছেলেদের সহজাত নয়।’
উপাচার্য মেহেদী হোসাইন বললেন, ‘যা-ই বলেন,শরীফ ভাই। একটা কথা কী জানেন, মেয়ে হলে এরা কথা বলবে না কেন? আমাদের মতো বয়স্ক লোকদের কাছে তো এদের ভয় পাওয়ার কথা নয়।’
উপাচার্যের টাক মাথাটার ওপর সাদা শান্ত ফ্লুরেসেন্ট টিউবের আলো চকচক করে উঠল। তার লোমশওয়ালা হাতের একটাতে ঘড়ি যেন কেশের জঙ্গলে হারিয়ে গেছে, আরেক হাতে তিনি
যে গত বছর হজব্রত পালন করেছিলেন তার সবুজ একখানি রিস্টব্যান্ড বা কল নাম্বার।
শরীফ তার বড় বড় শান্ত দার্শনিক ভেজা ভেজা চোখজোড়া চারদিকে হতাশার ভঙ্গিতে বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘সেটাই তো একমাত্র মিসিং লিংক। সেটার রহস্য ভেদ করতে পারছি না। এরা যদি কোনো ফ্রডগিরি করতে চাইত, সেটা এতদিনে আমরা বুঝে ফেলতাম। যেমন তরঙ্গিণীর কথা আপনাদের বলেছি, সে আমাকে বাবা ডাকছে, বা আসিরকে প্রেমিক বানিয়েছে, অথচ যখন তার মা মারা গেলেন বলল, তখনো টেলিফোনে কথা বলল না। অদ্ভুত নয় কি ব্যাপারটা! আর বলেন, যত ফেইক বা নকল হোক, কেউ কি মা মারা যাওয়ার মতো ঘটনা
এমন নিখুঁতভাবে সাজাতে পারে মিথ্যামিথ্যি! মারা যাওয়ার এক মাসের মধ্যে তার বাবাকে তার ফুফুরা পুনরায় বিয়ে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠা,এ নিয়ে তার এক ফুফুর সঙ্গে তার ঝগড়া-এ রকম বাস্তব সিচুয়েশন তৈরি করতে তো আইনস্টাইনের মগজ লাগবে।’
আসির রায়হান এখন আরো উত্তেজিত। যত উত্তেজিত হোন তিনি তত তার কথা শানিত হতে থাকে। তিনি যেন শরীফের যুক্তির তলায় যে আন্তরিকতা ছিল তাকে পানীয়ের ঢেউয়ে তলিয়ে
দিতে চাইলেন এবং সেভাবে বললেন, ‘শরীফ,কেন চিন্তা করতে পারছিস না যে তরঙ্গিণী না হয়ে তরঙ্গ নামের যে কোনো ছেলে বা যুবক বা পুরুষের মা-ও তো মারা যেতে পারেন, এবং মায়ের মৃত্যুর প্রভাব ছেলে বা মেয়ের ওপর তো একই রকমের হবে। বাবাকে পুনরায় বিয়ে করাতে মেয়ের ফুফুরা যেমন ব্যস্ত হতে পারেন,ছেলের ফুফুরাও পারেন। কাজেই এখানে মূল
সত্য- অর্থাৎ মায়ের মৃত্যুর ঘটনা ঠিক রেখেও ঠকানো যেতে পারে। মা মারা গেছেন তা সত্য,কিন্তু তরঙ্গিণীর মা নয়, তরঙ্গের মা।
শরীফ একটু উঠে দাঁড়ালেন। তার মাথা একটু ঘুরে গেল, এ রকম মনে হলো তার। তার কিডনিতে পাথরের আভাসের কথা সবাই জানেন।লম্বা একটা লোক, কিন্তু ভুঁড়িটা যেন হঠাৎ করে
কাউকে না জানিয়ে বের হয়ে পড়েছে। তিনি ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘আমি যদি আসির রায়হানের মতো কনফিডেন্স নিয়ে চলতে পারতাম, ভালো হতো। কিন্তু আমি এখনো আমাদের এ একগুচ্ছ ভারচুয়াল তরুণী বান্ধবীর লিঙ্গ পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছি না।’
তরঙ্গিণী মেয়েটা দেখতে অসামান্য রূপসী। যেন বলিউডের অভিনেত্রী। কত হবে বয়স! বিশ-একুশ। ওদের যত বন্ধু যেমন হেমা, বিভা, রীতি,জয়তু সবাই একই বয়সের এবং একজনের চেয়ে আরেকজন সুন্দরী আর লক্ষণীয় যে সবার বন্ধুর তালিকায় বুড়ো মানুষের সংখ্যা পর্যাপ্ত। শরীফ একে সামাজিক সমস্যা মনে করে প্রবন্ধ ফাঁদলেও,আসির রায়হানের পরিপূর্ণ ধারণা এগুলো একধরনের ফাঁদ। সামাজিক সমস্যার চেয়েও বেশি, সাইবার ক্রাইম।
শরীফের অনুরোধে তার ডাকা মেয়ে তরঙ্গিণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে আসির রায়হান রাজি হোন,যদিও এর মধ্যে তার ফেসবুক নিয়ে বিরক্তি জন্মাতে শুরু করেছিল। কিন্তু তিনি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, তরঙ্গিণীর চিঠির ভাষা, চিন্তার স্বচ্ছতা এবং অভিব্যক্তির পবিত্রতা আসলেই দুর্দান্তরকমের পার্থক্য অন্য দশটা মেয়ের চেয়ে। অবশ্য মেয়ে বলার সঙ্গে সঙ্গে আসির রায়হান নিজেকে সংশোধনী দেন যে মেয়ে নয়, ছেলে বলা উচিত এবং যত তরঙ্গিণীর সঙ্গে তার ভারচুয়াল সম্পর্ক বাড়তে লাগল, ততই তিনি বোধ করতে লাগলেন যেন তার তপ্ত মরুময় জীবনের ওপর তরঙ্গিণী একপশলা ঠান্ডা বাতাস। একসময় তিনি তরঙ্গিণীর ই-মেইল, মেসেজ বা এসএমএস পেতে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলেন। ছোট্ট মেসেজ,‘কেমন আছ?’ বা ‘খেয়েছ?’- এ ধরনের। তাও ঘন ঘন নয়, প্রতিদিনও নয়, দু-এক দিন পর পর।
ফেসবুকে একবার লিখল, ‘তোমার সঙ্গে কবে ফেস টু ফেস দেখা হবে, কবে কথা বলব তার জন্য অধীর অপেক্ষায় আছি।’
আসির রায়হান রেগে গিয়ে এসএমএস দিলেন, ‘দেখার কথা পরে,টেলিফোনে কথা বলতে অসুবিধা কী?’ তার আর জবাব নেই।
তিন দিন পরে হয়তো এলো সেই একই এসএমএস, ‘কেমন আছ?’
আসির রায়হান রেগে গিয়ে মনে মনে বললেন, ‘ফাক ইট!’
এর মধ্যে আসির রায়হানের ব্যবসার কারণে হঠাৎ চট্টগ্রাম যেতে হলো। তরঙ্গিণীর বাড়ি চট্টগ্রামে না হলেও তাদের নিবাস চট্টগ্রামে। কিন্তু যথারীতি তাদের বাসার ঠিকানা তারা ডাকা বাবা শরীফকে যেমন দেওয়া হয়নি, তাকেও না। আসির রায়হান একটা নাইট কোচে উঠলেন, বর্ষার সময় আকাশের অবস্থার কোনো ঠিক নেই, তাই তিনি বিমানে গেলেন না। এবং তিনি যে চট্টগ্রাম যাচ্ছেন সে কথা গোপন রেখে তরঙ্গিণীর সঙ্গে এসএমএস আদান-প্রদান করে যেতে লাগলেন। উদ্দেশ্য ছিল,তার চলন্ত বাসে ঘুম না এলে সময়টা যেন কেটে যায়, আর তরঙ্গিণী হয়তো রাতের গভীরে কোনো না কোনোভাবে দুর্বল হয়ে তার আসল পরিচয় বলে ফেলবে। কোচের ভেতর সব বাতি নেভানো। মোবাইল ফোন সাইলেন্ট মুডে রাখলেও বার বার মেসেজ আদান-প্রদানের সময় আলো জ্বলে উঠছিল বিধায় আশপাশের যাত্রীদের অসুবিধা হচ্ছিল ঘুমোতে। ফলে আসির রায়হান মোবাইল ফোন অফ করে যেই মাত্র চোখ বন্ধ করলেন সঙ্গে সঙ্গে গভীর ঘুমে ঢলে পড়লেন।
জিইসি মোড়ের একটি হোটেলে রুম নিয়ে কাজে বেরোনোর আগে তিনি তরঙ্গিণীকে সারপ্রাইজ দেয়ার ভঙ্গিতে লিখলেন, আমি এখন চট্টগ্রামে,অমুক সময়ে কি তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারি
বা তুমি আমার সঙ্গে?’
তারপর খাতুনগঞ্জে গিয়ে তার ব্যবসা-সংক্রান্ত কাজে জড়িয়ে যাওয়ায় তিনি সম্পূর্ণভাবে তরঙ্গিণীর কথা ভুলে রইলেন। দুপুরের পরে যখন তার মনে পড়ল, তিনি ফোন
বের করে দেখলেন তরঙ্গিণীর কোনো রিপ্লাই নেই। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলেন, ফোন যাচ্ছে- প্রতিবার ফোন দিলে যা হয়- কিন্তু রিসিভ হলো না। তিনি এবার এসএমএস দিলেন আবার
এবং জরুরিভাবে দেখা করার কথা বললেন।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো, ‘তোমাকে আমি সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমিই আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছ।’
সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবার লিখলেন, ‘দেখা করার ব্যাপারে কিছু বললে না যে!’
উত্তরে জানানো হলো, ‘আমি এখানে অক্সিজেন-এ এক আত্মীয়ের বাসায় দুপুরে খেতে এসেছিলাম, ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে।’
আসির রায়হান একটু চমকে গেলেন! যে মেয়ে তার জন্য এত উথালপাথাল, সে মেয়ে সকাল বেলায় জানল যে তিনি চট্টগ্রাম শহরে এসেছেন,অথচ তা জেনেও সে আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত খেতে গেল! কেন? ঘটনা মিলছে না।
তবুও তিনি অশান্ত মনোভাব চেপে রেখে লিখলেন, ‘সন্ধ্যার পরে তো আমি ব্যস্ত থাকব, তাহলে কালকে অমুক সময়ে।’
উত্তর এলো, ‘অল রাইট’।
তার পরদিন ছিল বৃহস্পতিবার। সপ্তাহের শেষ দিন। খাতুনগঞ্জ ব্যস্ততম এলাকা। কোরবানিগঞ্জ থেকেই ট্রাকের লাইন পড়েছে। আসির রায়হানের এক জাহাজ ছোলার চালান এসেছে। তার দরকার শখানেক ট্রাক ভাড়া করার। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা। ট্রাক ভাড়া করাসহ রোড ক্লিয়ারেন্স ইত্যাদি কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে তার বিকাল ৫টার ওপরে হয়ে গেল। হোটেলে ফিরে তিনি একটা গোসল নিলেন। টিভি অন করে খেলার একটা চ্যানেল খুলে বসলেন। তখনই মাত্র তার তরঙ্গিণীর কথা মনে পড়ল। মোবাইলটা বের করে দেখলেন, সেখানে তরঙ্গিণীর দিক থেকে কোনো খুদে বার্তা নেই। যদিও তা হওয়ার কথা না যে তরঙ্গিণী তাকে কখনো কল দেবে, তবুও কল লিস্ট চেক করলেন। না, সেখানেও কোনো টেলিফোন নেই। তার অন্য একটা মোবাইল ছিল। তার নাম্বার কখনো তরঙ্গিণীকে দেয়া হয়েছিল কি না তার মনে পড়ল না। তার পরও তা বের করে মেসেজ অপশনে গিয়ে চেক করে দেখলেন, না, সেখানেও কোনো খুদে বার্তা তার জন্য অপেক্ষা করছে না। হতাশার সঙ্গে সঙ্গে তার খুব রাগও এলো। তিনি আর কিছুই করলেন না। হেঁটে সিঁড়ি ভেঙে নিচে দোতলার ডাইনিং হলে বসে রাতের খাবারের অর্ডার দিলেন। পুরো কামরাটা কাচের দেয়াল দিয়ে আটকানো। চট্টগ্রাম শহরের আলোকোজ্জ্বল সিডিএ এভিনিউ যেন ভেসে উঠছে কাচের দেয়ালের ওপারে। যান চলাচল বিপুল। গাড়ির হেডলাইটের আলোর রেখায় যেন কালো কালো উড়ন্ত মশার বিন্দু দেখতে পেলেন তিনি।
খাবার সেরে তিনি রুমে ফিরলেন। ব্যাগ গুছিয়ে হোটেল থেকে চেক আউট করে গেলেন তার চট্টগ্রামের বন্ধুদের সঙ্গে চিটাগাং ক্লাবে আড্ডা দিতে। পানীয় খেতে খেতে তার মাথাটা আস্তে
আস্তে যেন পরিষ্কার হতে লাগল। নিজেকে নিজে বললেন, ‘নাউ আই আন্ডারস্ট্যান্ড, হোয়াট ইজ হোয়াট!’ যা হোক, রাতে কোচে উঠে দিলেন এক রামঘুম।
সকালে বাসায় পৌঁছে তিনি গোসল করে, নাশতা সেরে একটা ঘুম দিলেন। দুপুরের খানিকটা আগে উঠে এবার ল্যাপটপ খুলে দেখলেন ফেসবুকের মেসেজ বক্সে অনেক বার্তা, কিন্তু
একটাও তরঙ্গিণীর নয়, কিন্তু তরঙ্গিণীর বন্ধুদের। বিষয় হলো, গতকাল রাতে হঠাৎ করে তার মায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়। তিনি অবশ্য হার্টের রোগী ছিলেন, এটা তরঙ্গিণী তাকে আগেও
বলেছিল। হাসপাতালে নেয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে তার মৃত্যু হয়। অর্থাৎ, গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে যখন তিনি ফিরে আসার জন্য কোচে উঠছিলেন তখনই কোনো একসময় তরঙ্গিণীর
মায়ের মৃত্যু হয়। এবং তরঙ্গিণীর বন্ধুরা সবাই তাকে লিখেছে, তিনি যেন তরঙ্গিণী যে গতরাতে চুপচাপ ছিল সে ব্যাপারে কিছু মনে না করেন।
তরঙ্গিণী একটু স্বাভাবিক হয়ে উঠলে সে-ই তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। সে তো হলো। কিন্তু তার ব্যবসায়ী মন একটা হিসাব কষল,বৃহস্পতিবার না হয় বোঝা গেল তার মায়ের
অসুস্থতার জন্য তরঙ্গিণী ব্যস্ত ছিল। কিন্তু বুধবার সারাদিন তো সে ফ্রি ছিল। তখন কেন দেখা করল না, কিংবা কল করল না। এ প্রতীতি থেকে আসির রায়হান নিশ্চিত হলেন যে তরঙ্গিণী আসলে ছেলেই হবে এবং তার বন্ধুরাও সবাই তাই। তার মনে পরাজয়ের কটু স্বাদ ছড়িয়ে গেল। তার মতো একজন বাঘা ব্যবসায়ী এভাবে একটা সাইবার ফাঁদে পা দিলেন! অপমানবোধ থেকে তিনি তার চট্টগ্রাম যাওয়ার ঘটনা এবং তরঙ্গিণীর সঙ্গে দেখা না হওয়ার সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বন্ধুদের কাছ থেকে, বিশেষ করে শরীফের কাছ থেকে গোপন রাখলেন।
তাই আজকে যখন বন্ধু শরীফের উপরোক্ত প্রবন্ধটি তিনি পত্রিকায় দেখতে পেলেন, তখন খুব শান্তি পেলেন এই ভেবে যে তিনি যে তেঁতুলের পেছনে মরীচিকার দেখা পেয়েছেন, সে মরীচিকার সন্ধান তার বন্ধু এখনো পাননি। রহস্য বাকি আছে বলে তিনি এখনো লিখে চলেছেন বিষয়টি নিয়ে।
তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বন্ধুর উদ্দেশে বললেন, ‘লিখে যাও, বন্ধু।’

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
মোহিত উল আলম- র আরো পোষ্ট দেখুন