সমন্বয়বাদী নজরুল

নজরুলের সমন্বয়বাদী দর্শন নির্দেশ করে যে, তিনি অসাম্প্রদায়িকতার চেয়েও বেশি কিছু ভাবতেন। তিনি সাম্প্রদায়িকতার ভেদাভেদ ভুলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধির জন্য তাঁর সাহিত্য ও গানকে ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর কবিতা, গল্প-উপন্যাস, নাটক যেমন ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’ আদর্শেরই কল্পিত রূপ, তেমনি তাঁর প্রবন্ধ ও কথিকাগুলো এমন কথাই বারবার বলে গেছে। তাঁর নিজের যাপিত জীবন ও সংসার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাড়ানোর একটি প্রবল প্রচেষ্টা। হিন্দু রমণী প্রমীলা দেবীকে তো ধর্মান্তরিত করা ছাড়া বিয়ে করেছিলেনই, উপরন্তু বড় ছেলে, যার শিশু বয়সে মৃত্যু হয়, তার নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ। নজরুলের সমন্বয়বাদী দর্শন আধুনিক বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য বিরাট পাথেয়।

তবে নজরুলের সমন্বয়বাদী দর্শনের কথা নিশ্চয় অনেক দিনের পুরনো, কিন্তু কথাটি আমি প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি যখন সম্প্রতি প্রয়াত বিদেশি রাজনৈতিক-সাংবাদিক, গবেষক এবং নজরুল বিশেষজ্ঞ পিটার কাস্টার্সের পিএইচডি অভিসন্দর্ভটি পড়ার আমার সুযোগ হয়। তাতে তিনি নজরুলকে সিনক্রেটিক কবি বা সমন্বয়বাদী কবি হিসেবে প্রমাণ করেছেন।

কাস্টার্সের সমন্বয়বাদী ব্যাখ্যাকে আরেকটু সম্প্রসারিত করে আমরা নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক মানবতা বা ধর্মীয় সমন্বয়বাদিতার আরেকটা সংযোজনের কথা বলব। সেটাতে নজরুলের রাজনৈতিক দর্শন অনেকখানি এসে পড়বে। এ আলোচনায় নজরুলের দর্শন আমরা তিনটি পরস্পর-নির্ভর পরিপ্রেক্ষিতে রেখে বিচার করব :১. অসাম্প্রদায়িক নজরুল, ২. নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা এবং ৩. বাংলাদেশে নজরুল কেন প্রাসঙ্গিক।

অসাম্প্রদায়িক নজরুল :ব্রিটিশদের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করার পরম আকাঙ্ক্ষা নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার চরম প্রকাশ হলেও, তাঁর আরেকটি গভীরপ্রোথিত যুদ্ধ ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। কারণ দারিদ্র্যের একটি কারণ যদি ছিল ঔপনিবেশিক শাসন, তেমনি আরেকটি কারণ ছিল সাম্প্রদায়িকতা- যা ধর্ম, বর্ণ ও জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ তুলে দারিদ্র্যের রজ্জুগুলোকে মোটা ও শক্ত করে। ‘মানুষ’ কবিতায় শুরুতে ‘গাহি সাম্যের গান- /মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’ বলার পর নজরুল বলছেন, ‘নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,/ সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’ তারপর ধর্মের নামে মানুষকে ইতরায়ন করার বিরুদ্ধে বলছেন, “মানুষেরে ঘৃণা করি’/ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’।”

‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে সহজ একটি প্রতিতুলনা দিয়ে মানুষ বা মানবতা যে ধর্মীয় ভেদাভেদের চেয়ে শ্রেয়তর অবস্থানে আছে, তার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন :

“নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ-প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু- তার জন্য ত তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ন হয় না। তার মন বলে, ‘আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি_ আমারই মতো একজন মানুষকে।”

এ চিরন্তন মানবতার পরিচয়টা তুলে ধরে তারপর তিনি সাম্প্রতিক সময়ে যা ঘটছে, বা মানবতা কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার কঠোর জঠরে পড়ে হারিয়ে গেছে বা উল্টে গেছে তার একটি চিত্রকল্পও তুলে ধরেছেন :

“কিন্তু আজ দেখছি কি? ছোরা খেয়ে যখন খায়রু মিয়া পড়ল, আর তাকে যখন তুলতে গেল হালিম, তখন ভদ্র সম্প্রদায় হিন্দুরাই ছুটে আসলেন, ‘মশাই করেন কি? মোচলমানকে তুলছেন! মরুক ব্যাটা!’ তারা ‘অজাতশ্মশ্রু’ হালিমকে দেখে চিনতে পারেনি যে, সে মুসলমান। খায়রু মিয়ার দাড়ি ছিল। ছোরা খেয়ে যখন ভুজালি সিং পড়ল পথের উপর তাকে তুলতে গিয়ে তুর্কিছাঁট-দাড়ি শশধরবাবুরও ঐ অবস্থা!”

এই প্রবন্ধের শুরুটাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চরম উৎকর্ষ উক্তি দিয়ে : “একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন : দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে?”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে নজরুল ছিলেন আটত্রিশ বছরের ছোট। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার সময়টি ১৯২১ সাল যদি নজরুলের কবি হিসেবে উন্মেষকাল ধরি, তখনই রবীন্দ্রনাথ ষাট বছরে পেঁৗছে গেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রকাব্যবলয় থেকে বের হবার প্রচেষ্টা যেমন কল্লোল যুগের কবিদের মধ্যে ছিল, সেটি নজরুলের মধ্যেও ছিল; কিন্তু সে প্রচেষ্টা কবিতার মাধ্যমে ছিল না। কারণ শুরু থেকেই নজরুল কখনও রবীন্দ্রনাথের মতো লেখেননি। তাঁর অবারিত ফার্সি-আরবি শব্দ মিশ্রিত কাব্যবচন সংস্কৃত-বাংলা শব্দের জন্য একটি আলাদা কাব্য-প্রকরণ তৈরি করে দেয়। তার পরও রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে নজরুলের জন্য একটি রক্ষণশীল বাতাবরণ তৈরি হয়, যেটি তাঁর বিদ্রোহী সত্তা অচিরেই আক্রমণ করতে প্রবৃত্ত হয়। এই রক্ষণশীলতা আপাতদৃষ্টিতে আবর্তিত হতে থাকে কবিতায় শব্দ ও শব্দের পরিভাষা নিয়ে, কিন্তু তলায় তলায় এর মধ্যে আছে সাম্প্রদায়িকতা-বিভাজিত সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব।

এই জটিল সম্পর্কটা স্পষ্ট হবে যদি আমরা নজরুলের ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’ শীর্ষক প্রবন্ধটির মূল বক্তব্য অনুসরণ করি। রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক তাঁকে ‘বসন্ত’ নাটিকাটি উৎসর্গ করার সুখস্মৃতিটি বর্ণনা করে নজরুল বলছেন :”বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা নয়, পূজা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্টদেবতাকে পূজা করে।” কিন্তু নজরুলের কানে এসেছে কবিগুরু না-কি তাঁকে নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে তাঁর কাব্যচর্চায় আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহার নিয়ে। নজরুল বিলক্ষণ বুঝতে পারলেন এ কাজটি আসলে করেছেন ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। তিনি কবিগুরুর মনকে চটিয়ে দিয়েছেন। নজরুলের আপত্তি এখানে যে, কবিগুরু কেন শেষ পর্যন্ত ভীষ্ম হয়ে অভিমন্যু বধে সায় দিলেন। কিন্তু ‘মহাভারতের ভীষ্ম এই অন্যায় যুদ্ধে সায় দেননি, বৃহত্তর ভারতের ভীষ্ম সায় দিয়েছেন_ এইটেই এ যুগের পক্ষে সবচেয়ে পীড়াদায়ক।’

তারপর বিতর্কটা আসে ‘খুন’ শব্দটার রক্তের অর্থে ব্যবহার করা নিয়ে। তখন নজরুল বলেন, আরবি-ফার্সি শব্দের প্রয়োগ বাংলা ভাষায় ভারতচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ প্রমুখ করে গেছেন। নজরুলের মতে ‘খুন’সহ বিভিন্ন বিদেশি শব্দ বাংলা কাব্যলক্ষ্মীকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি আরও বলেছেন, “বিশ্বকাব্যলক্ষ্মীর একটা মুসলমানি ঢং আছে।” বলেছেন, “বাংলা কাব্য-লক্ষ্মীকে দুটো ইরানি ‘জেওর’ পরালে তার জাত যায় না, বরং তাঁকে আরো খুবসুরতই দেখায়।”

তাঁর একটি গান ‘উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পুনর্বার’ প্রসঙ্গে নজরুল বলছেন কবিগুরুর আপত্তি সত্ত্বেও ‘খুন’-এর বদলে রক্ত ব্যবহার তিনি করেননি কারণ তাতে কাব্যের আবেদন কমে যেত।

যুক্তিটা নজরুলের বয়ানে শোনা যাক :

“এই গানটি সেদিন কবি-গুরুকে দুর্ভাগ্যক্রমে শুনিয়ে ফেলেছিলাম এবং এতেই হয়তো তাঁর ও-কথার উল্লেখ। তিনি রক্তের পক্ষপাতী। অর্থাৎ ও লাইনটাকে_ ‘উদিবে সে রবি মোদেরই রক্তে রাঙিয়া পুনর্বার’ও করা চল্্ত। চল্্ত কিন্তু ওতে ওর অর্ধেক ফোর্স কমে যেত। আমি যেখানে ‘খুন’ শব্দ ব্যবহার করেছি, সে ঐ রকম ন্যাশনাল সঙ্গীতে বা রুদ্র রসের কবিতায়। যেখানে ‘রক্তধারা’ লিখবার সেখানে জোর করে ‘খুনধারা’ লিখি নাই। তাই বলে ‘রক্ত-খারাবি’ও লিখি নাই, হয় ‘রক্তারক্তি’ না হয় ‘খুন-খারাবি’ লিখেছি।

“কবি-গুরু মনে করেন, রক্তের মানেটা আরো ব্যাপক। ওটা প্রেমের কবিতাতেও চলে। চলে, কিন্তু ওটাতে ‘রাগ’ মেশাতে হয়। প্রিয়ার গালে যেমন ‘খুন’ ফোটে না, তেমনি ‘রক্ত’ও ফোটে না_ নেহাৎ দাঁত না ফুটালে। প্রিয়ার সাথে ‘খুন-খুনী’ খেলি না, কিন্তু ‘খুন-সুড়ি’ হয়ত করি।

“কবি-গুরু কেন, আজকালকার অনেক সাহিত্যিক ভুলে যান যে, বাংলা কাব্য-লক্ষ্মীর ভক্ত অর্ধেক মুসলমান। তারা তাঁদের কাছ থেকে টুপি আর চাপকান চায় না, চায় মাঝে মাঝে বেহালার সাথে সারেঙ্গীর সুর শুনতে, ফুলবনের কোকিলের গানের বিরতিতে বাগিচায় বুলবুলির সুর।”

… “আরো মনে হয়, আমার শত্রু সাহিত্যিকগণের অনেক দিনের অনেক মিথ্যা অভিযোগ জমে ও’র [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের] মনকে বিষিয়ে তুলেছে। নৈলে আরবি-ফার্সি শব্দের মোহ তো আমার আজকের নয় এবং কবিগুরুর সাথে আমার বা আমার কবিতার পরিচয়ও আজকের নয়। কই, এতদিন তো কোনো কথা উঠল না এ নিয়ে!”

ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারি মূলত এসেছে বাংলায় খুনের অর্থ- হত্যা বা হত্যাকাণ্ড এবং হিন্দিতে খুনের অর্থ রক্ত এই বিসংবাদ থেকে। প্রবন্ধের বাকি অংশটা উদ্ধৃত করা যেত, এতই শানিত যুক্তি তাঁর। বলাবাহুল্য বিদেশি শব্দ গ্রহণ-বর্জন, তাদের সংস্কৃতিগত পরিচয় নিয়ে কবিকুল ও লেখককুলের মধ্যে বিতর্ক একটি চলমান ব্যাপার। এখানে রবীন্দ্র-নজরুলের মধ্যে বিতর্কটি তাই বর্তমান সময়ে যে আরও নতুন নতুন পাখা গজাবে সেটি সত্য। জঙ্গম সমাজে গতিশীলতার একটি প্রধান উপাদান হলো বিতর্ক।

‘খুন’ বা এ রকম কিছু মুসলমানি বিদেশি শব্দের পরিভাষা, যেমন ‘দস্তরখানা’, ‘দাওয়াৎ’, নিয়ে লেখক আবুল ফজলের সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ হয়েছিল, যেখানে রবীন্দ্রনাথ বাংলা শব্দের শুদ্ধতা নিয়ে যৌক্তিক একটি অবস্থানে অবিচল ছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়।

এখানে একটা ঘটনার উল্লেখ করলে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের প্রমাণ পাওয়া যাবে। ১৯৩৩ সালে রাউজানে এক সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নজরুল আসেন, আরও ছিলেন কবি আবদুল কাদির, মাহবুব-উল আলম, আবুল ফজল, কামালুদ্দীন আহমদ খান (বেগম সুফিয়া কামালের স্বামী) এবং কবি ওহীদুল আলম।

সেখানে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার সম্পাদক নজির আহমদ চৌধুরী তাঁর বক্তৃতায় কবি নজরুল ইসলাম ও সাহিত্যিক মাহবুব-উল আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন যে, ব্রিটিশকে মুসলমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য এ দুই সাহিত্যিক ৪৯ সংখ্যক বাঙালি রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে মহাযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।

প্রত্যুত্তরে নজরুল বললেন, “আপনারা শুনেছেন, আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, আমরা নাকি বৃটিশকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাহায্য করতে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমি বলতে চাই, আমরা যখন যুদ্ধে যাই, আমাদের মধ্যে ছিল দারুণ তারুণ্য। তারুণ্যের তাগিদ সহ্য করতে না পেরে আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ হচ্ছে, কে জিতবে, কে হারবে, এসব তলিয়ে দেখার মন ও মেজাজ আমাদের ছিল না।” (ওহীদুল আলম, পৃথিবীর পথিক)

নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা :

নজরুলের বিদ্রোহী ব্যক্তিত্ববাদ রূপ লাভ করেছিল প্রধানত পরাধীনতার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। শিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর এক শিক্ষক নিবারণ চন্দ্র ঘটক তাঁকে ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করান। তখন থেকে নজরুলের রাজনৈতিক চেতনায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের তাড়িয়ে দেবার স্বপ্ন প্রোথিত হয়। মুজাফ্্ফর আহমদসহ কতিপয় বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মী ও নেতার সংস্পর্শে এসে নজরুল তাঁর বিপ্লবী চেতনাকে আরও শানিত করতে সংক্ষম হন। ‘নবযুগ’ পত্রিকায় ‘ম্যায় ভুঁখা হুঁ’ জাতীয় প্রবন্ধগুলো এবং এর কিছু পরে তিনি ও মুজাফ্্ফর আহমদের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় তাঁর ‘স্বরাজ টরাজ বুঝি না’ ধরনের সম্পাদকীয়গুলো এবং এরপর বামপন্থি পত্রিকা ‘লাঙ্গল’-এর ‘সাম্যবাদী’গুচ্ছের কবিতাগুলো প্রমাণ করে যে, নজরুলের ব্যক্তিত্ববাদ তাঁর বিদ্রোহী সত্তার সমষ্টিগত পরিচয়_ রাজনৈতিক পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদী ধর্মপরায়ণতা, নারীর অবদমন ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে সামগ্রিক প্রতিবাদই গঠন করেছে তাঁর বিদ্রোহী সত্তাকে।

১৯২০ সালে শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হকের অর্থানুকূল্যে ‘নবযুগ’ সান্ধ্য দৈনিক প্রকাশিত হয় কাজী নজরুল ইসলাম এবং মুজাফ্ফর আহমদের যৌথ সম্পাদনায়। নজরুলের রাজনৈতিক কলাম লেখা শুরু হলো এবং অচিরেই ‘ডায়ারের স্মৃতিস্তম্ভ’ এবং ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে’ শীর্ষক দুটি রচনা প্রকাশ করার দায়ে পত্রিকাটি সরকারের কোপানলে পড়ে। প্রথম রচনাটি প্রহসনমূলক যেখানে নজরুল বলছেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মতো ‘বীরত্বসূচক’ কর্মের জন্য জেনারেল ডায়ারের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হওয়া উচিত। আর দ্বিতীয় রচনাটি ছিল- যেসব মুসলমান স্বেচ্ছাসেবক গ্রিসের বিরুদ্ধে তুরস্ককে সাহায্য করার জন্য আফগানিস্তান হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছিল, তাদের ওপর ব্রিটিশ সীমান্ত সৈন্যদের গুলি ছোড়ার বিষয়টি।

‘নবযুগ’ বন্ধ হয়ে গেলে নজরুল কিছুদিন মওলানা আকরম খাঁ কর্তৃক প্রকাশিত ‘সেবক’ পত্রিকায় চাকরি করেন। কিন্তু পত্রিকাটির সাম্প্রদায়িক চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে তিনি নিজেই ‘ধূমকেতু’ নামক একটি অর্ধসাপ্তাহিকী প্রকাশ করেন। ১৯২২। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পত্রিকাটিকে আবাহন জানালেন “আয় চলে আয় রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগি্নসেতু” চতুর্পদী কবিতাটি দিয়ে। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে নজরুলের বিদ্রোহকে সর্বাত্মক প্রকাশে সাহায্য করে। এর পঞ্চম সংখ্যায় ‘আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে তিনি বাংলার বিপ্লবী শহীদ যুবাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন। বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, কানাই লাল দত্ত, সত্যেন বসু, প্রফুল্ল চাকী এবং বাঘা যতীনসহ সবার ছবি ছাপিয়ে ‘ধূমকেতু’ নিয়মিত বের হতো।

এই ‘ধূমকেতু’র ১২তম সংখ্যায় (২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২) প্রকাশিত হয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে তাঁর কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ যেটি ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করল শুধু নয়, কবিকে করল গ্রেফতার কুমিল্লা থেকে, যেখানে প্রেয়সী প্রমীলা দেবীর পাণিগ্রহণ তিনি করেছেন মাত্র। এ কবিতাটিতে তিনি ব্রিটিশ শাসকদের লক্ষ্য করে বললেন তারা ‘বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি’ আর তাদের অত্যাচারে ‘ভূ-ভারত আজ কসাইখানা’ হয়েছে। ইংরেজ বিচারক সুইনহো নজরুলকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অপরাধে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিলেন। কিন্তু নজরুল নিজের সমর্থনে একটি জবানবন্দি জমা দেন আদালতে, যেটি “রাজবন্দীর জবানবন্দী” নামে বিখ্যাত এবং যেটি তিনি রচনা করেন কারাবাসের সময়, ৭ জানুয়ারি ১৯২৩। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার গদ্যরূপ যেন এটি। কবি বললেন, ‘একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড; আর জন সত্য, হাতে ন্যায়দণ্ড।’

আরো বললেন,

“আমি কবি, অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তি দানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী সত্যের প্রবেশিকা, ভগবানের বাণী। সে-বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে-বাণী ন্যায়_দ্রোহী নয়, সত্য-দ্রোহী নয়। সে-বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে, কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ সত্য-স্বরূপ।”

নজরুলের রাজনৈতিক লেখার ধরন হলো উৎকৃষ্ট প্রতিতুলনা তৈরি করে বক্তব্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। এই ‘জবানবন্দী’তেও তাই করলেন।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
মোহিত উল আলম- র আরো পোষ্ট দেখুন