সাড়ে তিন হাত ভূমি

১০

আমি কাইল চইলা যামু।
সন্ধ্যাবেলা পেছন দিককার বারান্দায় বসেছি আমরা। বারেক তার মসলা-মাসায়েল বলবে। মা, তুমি আছ আমার পাশের চেয়ারে, তোমার পাশে বকুল। আর সবাই মেঝেতে। কদম পারুল বুয়া, বুয়ার পায়ের কাছে বারেক। আজ আর মায়ের পায়ে হাত রাখেনি সে। বাবা তাঁর রুমে বসে স্কুলের কাজ করছেন। বিভিন্ন ঘর থেকে আসা হারিকেনের আলোয় কারো কারো মুখে আবছায়া, কারো কারো মুখ-শরীর একটুখানি পরিষ্কার।
বারেকের মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না। গলার স্বরে তার দুঃখ কিংবা অভিমান কিংবা বেদনাবোধ টের পাওয়া গেল।
পারুল বলল, কী কইলি, বারেক?
আমি কাইল চইলা যামু।
কই যাবি?
এগারো বছর যেইখানে আছিলাম, যার কাছে আছিলাম, তার কাছে চইলা যামু। বড় আশা কইরা ফিরত আইছিলাম। মায় আমারে মাপ করবো, মাইনা নিবো আমারে। বহুত দিন চেষ্টা করলাম। মায় আমারে মাপ তো করলোই না, মাইনা তো নিলোই না, আমার মুখের দিকে একপলকের লেইগা চাইয়াও দেখলো না। তয় আমি এখানে থাকুম ক্যান? কার লেইগা থাকুম? এই এতো দিনে আমি বুইঝা গেছি, মার কাছে আমি মরা। আমি জীবিত না। মন থেইকা মায় আমারে মুইছা ফালাইছে। আমার লেইগা কোনো টান মহব্বত, আদর সোহাগ মার আর নাই।
বুয়া দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। বারেক ফিরে আসার পর থেকে যেমন নির্বিকার, এখনো তেমন।
বারেকের চলে যাওয়ার কথা শুনে আমরা সবাই কমবেশি চমকেছি। পারুল তো বলেই ফেলল, কই যাবি?
বুয়া চমকাল কি না বা তার মুখে চিন্তার কোনো ছায়া পড়ল কি না বোঝা গেল না। বুয়ার মুখ পরিষ্কার দেখাও যাচ্ছে না। হারিকেনের ছিটকে আসা ওইটুকু আলোয় কারো চমকে ওঠা-না ওঠা মুখ দেখে বোঝাও সম্ভব না।
তোমার মনে আছে, মা! কথা শুরু করলে তারপর তুমি। এতো দিন হইল আইছস, এখন পর্যন্ত কইলি না তুই গেছিলি কই, আছিলি কার কাছে! এগারোটা বছর কাইটা গেল, ফিরলি না ক্যান?
বারেক কাতর গলায় বলল, আমি চাইছি মায় পয়লা আমারে মাপ করুক। খালি একবার কউক, হ, তরে আমি মাপ করলাম। আমারে যেই কষ্ট তুই দিছস, ওই কষ্ট আমি ভুইলা গেলাম। আমার মাথায় একটু হাত দিতো, আমারে একটু বুকে জড়াইয়া ধরতো। একবার খালি কইতো, আয়, আমার বুকে আয়, বাজান। আমি এইটা চাইছি, নানু। এইটা হওনের পর সব কথা আমি সবাইরে কইতাম। কী হইছিল সেদিন। মার হাতে মাইর খাইয়া একদৌড়ে কই চইলা গেলাম আমি। এগারো বছর কই রইলাম, কার কাছে রইলাম!
তয় আইজ ক।
হ কমু। চইলা যাওনের সিদ্ধান্ত যখন নিছি, তখন সব বইলাই যামু।
বারেক একটু থামল। আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি বারেকের এগারো বছর নিখোঁজ হয়ে থাকার ঘটনা শোনার জন্য।
বারেক বলতে লাগল, মায় আমারে মারলো, মাইর খাইয়া এমন জিদ হইলো আমার, দৌড়াইয়া গেলাম বাঁশঝাড়তলায়। একটুখানি দাঁড়াইলাম। তারপর বাঁশঝাড়ের ওই দিক দিয়া মাঠের দিকে নাইমা গেলাম। দিকপাশ কোনো দিকে তাকাই না। হনহন কইরা হাইটা গেলাম বাজারে।
আমি বললাম, কোন বাজারে গেলি, বারেক? আমাদের কাঞ্চনপুর বাজারে, নাকি পুরা বাজারে?
পুরা বাজার একটু দূরে। গেলাম কাঞ্চনপুর বাজারেই। দিনটা আমার মনে আছে। মঙ্গলবার আছিলো।
তাই নাকি!
হ, মামা।
আচ্ছা, তারপর বল।
মঙ্গলবার কাঞ্চনপুর বাজারে হাট বসে। দূর-দূরান্ত থিকা রজতরেখা নদী দিয়া নৌকা নিয়া পাইকার কারবারিরা আসে হাটে।
সেটা জানি।
হ, জানবেন না ক্যান, সবাই জানে। সেই হাটের দিনও আইছে। নদীর ঘাটে ম্যালা নৌকা। হাটবাজার মানুষে ভর্তি। গমগম করতাছে। একজন মুসল্লি মতন মানুষ হাটের এককোনায় পাটি বিছাইয়া পাটির ওপর বিছাইছে সাদা একখান চাদর, তার ওপরে ‘কাটা কাপড়’ অর্থাৎ পোলাপানের শার্ট প্যান্ট পায়জামা গেঞ্জি লুঙ্গি- এই সব নিয়া বইছে। লোকটা কাটা কাপড়ের কারবারি। তয় খুবই মুসল্লি ধরনের মানুষ। মুখে চাপদাড়ি, চোখে সুরমা, শরীলে আতরের গন্ধ, মাথায় টুপি। লম্বা সাদা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা। এই ধরনের কারবারিদের লগে অল্পবয়সী পোলাপান কর্মচারী থাকে। এইটা ওইটা আগাইয়া দ্যায়, কাস্টমারের লগে দামদস্তর করে। এই লোকটার লগে কেউ নাই। তিনায় একলা।
কিছু না ভাইবা আমি তার সামনে গিয়া খাড়াইছি। তিনায় হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, কী চাও, বাজান? কিনবা কিছু? শার্ট প্যান্ট পায়জামা গেঞ্জি? তোমার মাপের লুঙ্গিও আছে।
আমি কইলাম, না, কিছু কিনুম না।
তয়?
এমনেই খাড়াইয়া রইছি।
তিনায় খেয়াল কইরা আমারে দেখলেন- তোমার মুখখান শুকনা। মনটাও খারাপ মনে হইতাছে। বিয়ানবেলা নাস্তাপানি খাও নাই?
আমি চুপ কইরা খাড়াইয়া রইলাম, কথা কইলাম না।
তিনায় বহুত আদরের গলায় বললেন, বসো বাজান, আমার পাশে বসো। তোমার লগে কথা কই। বেচাকেনার ফাঁকে ফাঁকে কথা কইলে টাইমটা ভালো কাইটা যাইবো। বিকালের দিকে তো রওনাই দিমু।
তিনার কথাবার্তা এতো ভালো লাগলো আমার, কী কমু! মুখে য্যান মধুমাখা।
আমি তার পাশে বসলাম।
দুই-একজন কাস্টমার আসে, দামদস্তর করে। মানুষটার কথায় কাস্টমার দেখি তার কাছ থিকা ফিরতে পারে না। যে আসে সে-ই কিছু না কিছু কিনা ফালায়।
তিনায় যেখানে দোকান সাজাইয়া বসছেন, ঠিক তার পিছনে একটা চা-মিষ্টির দোকান। হাটবার দেইখা বিয়ানবেলাই জিলাপি ভাজা শুরু করছে ময়রা। কাস্টমারের ভিড়ও লাইগা আছে। চামচের খটাখট শব্দে চা বানাইতাছে। গরমাগরম জিলাপি চা আর বিস্কুট খাইতাছে কাস্টমাররা। ডাইলপুরি শিঙ্গাড়াও খাইতাছে। জিলাপি ভাজার গন্ধে আমার খিদাটা এমন বাড়া বাড়ছে, কী কমু!
মুখ ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া দোকানটার দিকে চাই।
তিনায় আমার অবস্থাটা বুঝলেন। মুখ ঘুরাইয়া দোকানের দিকে চাইলেন। দোকানের একটা যুবক কর্মচারীরে বললেন, ওই ফজলু, এক পোয়া জিলাপি দে আর দুই কাপ চা। দুই গেলাস পানিও দিস।
বুঝলাম তিনায় প্রতি মঙ্গলবার এই জায়গাটায় বসেন, এখানে বইসাই দোকানদারি করেন। ফজলু তার পরিচিত।
তিনার কথা মতন প্রথমে জিলাপি দিল ফজলু, দুই গেলাস পানি দিল। তিনায় আমার মাথায় পিঠে হাত বুলাইয়া বললেন, খাও বাজান, খাও। আমি নাস্তা করছি। তাও তোমার লগে এক দুইখান জিলাপি খামুনে। তুমি খাও, পেট ভইরা খাও।
আমি কথা না বইলা খাইতে শুরু করলাম।
খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তিনায় আমারে জিজ্ঞাসা করেন, তোমগো বাড়ি কোন গেরামে?
আমার ভিতরে তো তখন একটা শয়তান বাস করে! আমি তো তখন মানুষ আছিলাম না। মিছা কথা কইতে শুরু করলাম।
কদম বলল, এই গেরামের নাম কইলি না?
না।
কোন গেরামের নাম কইলি?
কইলাম আমার আসলে কোনো গেরাম নাই।
তিনায় অবাক, কী!
হ, কোনো গেরাম নাই, বাড়িঘর নাই।
কও কী!
হ।
তোমার মা-বাবা?
আমার মা বাবা ভাই বইন কেউ নাই।
কোনো আত্মীয়স্বজন?
তাও নাই।
তয় তুমি থাকো কই? খাও কী?
একেক গেরামের একেক বাড়িতে যাই, এতিম পোলা দেইখা তারা দুই চাইর দিন থাকতে খাইতে দেয়, বাড়ির কাম কাইজ করায়, তার বাদে খেদাইয়া দেয়।
তখন?
তখন অন্য গেরামে যাই, অন্য বাড়িতে থাকি ওই একই কায়দায়।
মানুষটা খুবই অবাক- তোমার মা-বাপের কথা তুমি কিছু জানোই না?
না।
কিছু শোনো নাই?
একটু একটু শুনছি।
কী শুনছ?
আমার জন্মের আগে বাপ মরছে, জন্মের দুই-তিন বছর পর মায়। সে এক বাড়িতে কাজ করতো। মায় মরণের পর ওই বাড়ির আরেকজন কাজের বুয়া আমারে কিছুদিন পালছে। তার পর থিকা আমি এই গেরাম ওই গেরাম ঘুরি। এই বাড়ি-ওই বাড়ি থাকি। আমার মতন এতিম দুনিয়ায় কেউ নাই।
আমার কথা শুইনা তিনার চোখ ছলছল করে। আমার মাথায় পিঠে হাত বুলাইয়া বললেন, আহা রে, আহা!
এরপর বললেন, তয় তুমি আইজ আইলা কোন গেরাম থিকা?
গেরামের নাম বানীখাড়া। আছিলাম এক বাড়িতে। সেই বাড়ির একজনে আমারে নাস্তাপানি তো দেয়ই নাই, মাইরা বাড়ি থিকা বাইর কইরা দিছে।
তিনায় আবার বললেন, আহা রে, আহা! এমুন মায়াভরা একটা পোলারে কেউ মারে! না খাওয়াইয়া রাখে! মানুষের কলিজায় মায়াদয়া নাই! তয়, তুমি অহন কী করবা, কই যাইবা?
জিলাপি খাইয়া আমার পেট ভইরা গেছে। কয়েক ঢোক পানিও খাইলাম। তার বাদে এক কাপ চা বড় মানুষের লাহান তিনার লগে ফুরুক ফুরুক কইরা খাইতে লাগলাম। চা খাইতে খাইতে কইলাম, আমার কিছু করনের নাই। কোনোখানে যাওনের জায়গা নাই।
আমার লগে যাইবা?
আপনেগো বাড়ি কই?
এখান থিকা বহুত দূর।
কোন গেরাম?
গেরামের নাম নারায়ণপুর।
সেইটা কোন জায়গায়?
চাঁদপুরের মতলব থানায়।
যাইতে হয় কেমনে?
আমার নিজের নৌকা আছে। ছইঅলা নৌকা। দুইজন মাঝি আছে। আমি বাড়ি থিকা মাল নিয়া, নৌকা নিয়া বাইর হই। এক দেড় মাস দূর-দূরান্তের হাটে-বাজারে মাল বেচাকিনা কইরা বাড়িত যাই। কিছুদিন বাড়িতে থাইকা আবার রওনা দেই। বাড়িতে আমার দুইজন দর্জি আছে। আমগো গেরামেরই লোক। আমি কাপড় কিনা দেই, তারা শার্ট প্যান্ট পায়জামা- এই সব বানায়। লুঙ্গি গেঞ্জি আমি মতলব বাজার থিকা পাইকারি দরে কিনি। এইটাই আমার ব্যবসা। সংসারে আমার স্ত্রী আছেন আর একটা বিধবা বইন। বইনের একটা মাইয়া। তার বিয়া হইয়া গেছে। সে থাকে চাঁদপুরে। আমার কোনো সন্তানাদি নাই।
আমি কোনো কিছু না ভাইবা তিনারে কইলাম, আপনের লগে আমারে নিবেন?
তিনায় এককথায় রাজি। হ, নিতে পারি। তুমি যাইবা?
যামু দেইখাই তো কইলাম।
সব সময় থাকবা আমার কাছে?
থাকুম।
চিন্তাভাবনা কইরা কইতাছ তো?
হ, চিন্তা কইরাই কইতাছি। আমার তো দুনিয়াতে কেউ নাই। আপনের মতন একজন মানুষের লগে থাকুম, হাটে-বাজারে ঘুরুম, আপনের লগে দোকানদারি করুম…।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনায় বললেন, তয় আমার লগে থাকলে তোমার খারাপ হইব না, বাজান। ভালোই হইব।
দোফরে (দুপুরে) মোল্লার ভাতের হোইটালে তিনায় আমারে ভাত খাওয়াইলেন। পয়লা আমি খাইয়া আসলাম, আইসা তার জায়গায় বসলাম, তার বাদে তিনায় খাইয়া আসলেন।
বিকালের দিকে হাট যখন ভাঙতেছে, মালসামান গুছাইয়া তিনার লগে আমি তার নৌকায় চড়লাম। মাঝি দুইজন খাওয়াদাওয়া কইরা নৌকায় শুইয়া ঘুমাইতাছিল। আমরা নৌকায় উঠার পর নৌকা ছাড়ল তারা। তিনায় মাঝি দুইজনরে আমার কথা বললেন। এখন থিকা আমি তার লগে আছি, তার ছেলের মতন- এই সব বললেন।
আমার মনের মধ্যে তখন বিরাট এক আনন্দ। য্যান এক খাঁচা থিকা আমি মুক্তি পাইছি। এখন মুক্ত স্বাধীন পাখি আমি। তিনার সঙ্গে দেশের এইদিক ওইদিক ঘুইরা বেড়ামু। কারবার শিখুম। এক সময় হয়তো তার কারবারটা পুরাপুরি আমি দেখুম।
মনে আছে তোমার, মা? তুমি বললে, ওই বয়সেই এই সব ভাবলি তুই?
হ নানু, ভাবলাম।
বকুল বলল, ও তো ছোটবেলা থেকেই মহা পাকনা।
আমি বললাম, ট্যাটন। বিরাট ট্যাটন।
কদম বলল, তারপর কী হইল সেটা ক।
আমি বললাম, তার আগে বল, লোকটার নাম কী। তিনায় তিনায় করছিস, নাম বলছিস না কেন?
তিনার নাম মোসলেম মিয়া। নৌকায় চইড়াই টের পাইয়া গেলাম, বিরাট পরহেজগার মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। ভোরবেলা ফজরের নামাজ পড়ে কোরআন শরিফ পড়েন। অন্য সময় নৌকায় বসে হাদিস শরিফ পড়েন।
মা, তুমি বললে, কিন্তু তুই যে তোর মারে ছাইড়া অচেনা একজন মানুষের লগে রওনা দিলি, একবারও মার কথা মনে পড়ল না তোর? আমগো কারো কথা মনে পড়ল না?
পড়ছে। কিন্তু মায় আমারে মারছে, তার ওপরে বিরাট রাগ, বিরাট জিদ। মনে মনে খালি কই, তোমার কাছে আমি আর ফিরত আসুম না, মা। কোনো দিন ফিরত আসুম না।
[চলবে]