১৬
মনে হয় বিষয়টা বেশ জমে উঠেছে। ওই যে দৌড়ের কথা বলেছে খাম্বা সামাদ, কথাটা খুব মনে ধরে কেরানির। এভাবে সে আগে দ্যাখে নাই। জীবন একটা দৌড়। এই দৌড়ের রাস্তায় যে না উঠতে পারে সে হতভাগা। আর উঠেও যে আছাড় খেয়ে পড়ে সে সারা জীবনের মতো শেষ। অতএব দৌড় আর দৌড়। দৌড়ের ওপর দৌড়।
কেরানি গভীর রাতে হোটেলে ফিরে আসে। তার মাথার ভেতরে বুদ্বুদ ফোটে। স্বপ্নের বুদ্বুদ। বড়বুবুর বিয়ে হয়েছে। ছোট বোনটির বিয়ে না হয় আর একটু পরেই হলো, তার আগে শখ সাধ করুক, ঘুরুক ফিরুক। বাবার চিকিৎসা। মায়ের চিকিৎসা। চিকিৎসায় তারা ভালো হয়ে এখন দিব্য আছে। আহ, স্বপ্ন, স্বপ্ন।
কেরানি নিজের ভেতরে দারুণ একটা শক্তি বোধ করে। পৃথিবীর মাথার ওপরে এখন তার পা, এতটা না হলেও কেরানি অনুভব করে তার আয়ত্তে এখন সে যা চাইবে মুঠোর ভেতরে পাবে। আমরা হয়তো একটু অবাকই হবো কেরানির গলায় গান শুনতে পেয়ে। হ্যাঁ, সে গুনগুন করে ওঠে, সিঁড়ি ভাঙে, হোটেলে তার রুমের সমুখে দাঁড়ায়।
আরে, দরোজার বাইরে যেন কাপড়ের একটা পুঁটলি পড়ে আছে। পুঁটলি? না, না। কে যেন মাথা পর্যন্ত কাঁথা টেনে গা গুটিয়ে শুয়ে আছে। কে?_ এই কে? সাড়া না পেয়ে কেরানি তার নতুন মোকাসিনের চকচকে ডগা দিয়ে কাঁথার ওপর খোঁচা দেয়।
ধড়মড় করে উঠে বসে ময়না।
আরে, ময়না, তুই?
কেরানির বড় মায়া হয়। এই পিচ্চি মেয়েটা, কতই বা হবে বয়স, দশ কী এগারো, পেটের দায়ে হোটেলে মায়ের সঙ্গে উদয়াস্ত কাজ করছে। এখন দ্যাখো, ছোট্ট মানুষ, কেমন ঘুমভাঙা চোখে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
ময়না, তুই এখানে শুয়ে আছিস কেন?
আপনে কখন আসেন দ্যাখতে দ্যাখতে ঘুমায়া পড়ছিলাম।
কে তোকে দেখতে বলেছে? যা ঘুমো গে, যা।
আপনের কিছু লাগবো?
না রে, কিচ্ছু না।
ময়না চলে যায়। কেরানি ঘরে ঢুকে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমের ভেতরে ময়নাকে সে স্বপ্নে দ্যাখে। ময়না যেন হস্তিবাড়িরই কোনো কিশোরী। তাদেরই বাড়ির উঠানে তারই বড়বুবুর সঙ্গে শিমের জাংলা থেকে শিম ছিঁড়ছে।
পরদিন খাম্বা সামাদ যখন তাকে এসে ঘুম থেকে তোলে কেরানি তখন তাকে যে প্রথম কথাটাই বলে, আমার বাবা-মার চিকিৎসা আর আমার দুই বোন আর এই ময়না, এই যে কাজ করে ছেমড়িটা, এদের জন্য রাতে আমার ভালো ঘুম হয় নাই, খাম্ভাই।
খাম্বা সামাদ একটু অবাক হয় ময়নার উল্লেখে। হোটেলের এই পিচ্চি মেয়েটা একদিনের মধ্যেই এতটা মন জয় করে নিয়েছে লোকটার! খাম্বা সামাদ খুশিই হয়। না, কেরানি মালটা খাঁটি আছে। মনটা ভালো। মায়া-মহব্বত না থাকলে মানুষ আবার মানুষ নাকি।
হবে হবে সব হবে, মাই ডিয়ার কেরানি।
এটা শুধু মুখের কথা নয়, কাজেও প্রমাণ দেয় খাম্বা সামাদ। আমরাও কাহিনী কথনে এখন লাফ দিয়ে দিয়ে চলি। ঘটনার পর ঘটনা ডিঙিয়ে যাই। কী দেখতে পাই?
রংপুরের সদর হাসপাতালে কেরানির বাবা সিঙ্গেল কেবিনে ভর্তি হয়ে আছে। বড় ডাক্তার তার চিকিৎসা করছে।
আর কী দেখতে পাই? কেরানির ছোট বোন, উড়ন্ত সেই প্রজাপতি, তাকে আমরা দেখতে পাই চেয়ারম্যানের ছেলের সঙ্গে, বর-বধূ বেশে।
আর? আর কে বাকি রইল? বড়বুবু? হ্যাঁ, কেরানির বড়বুবু। তাকে আমরা কেমন দেখি? দেখি সে চিঠি লিখছে। তার কেরানি ভাইটিকে চিঠি।
ভাই, আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগিয়াছে। তুমি হঠাৎ এত পয়সার মালিক হইয়াছো কী করিয়া আমার বোধে আসিতেছে না। বাবার চিকিৎসা করাইতেছো। বোনটির বিবাহ জাঁকজমক করিয়া দিয়াছো। আমাকে এই শীতের দিনে দামি আলোয়ান পাঠাইয়াছো। আবার বলিতেছো আমার চাকরি করিবার দরকার নাই। আমি যেন কলেজে ভর্তি হই। এ সকলই সুখের কথা। তবু সুখ আমি অন্তরে পাই না। এত টাকা তোমার হাতে আসিলো কী প্রকারে? লঞ্চের চাকরিতে কত আর বেতন? তুমি কি লটারি জিতিয়াছো? পথে টাকার থলি কুড়াইয়া পাইয়াছো? নাকি তুমি এমন পথে গিয়াছো যাহাতে আল্লা নারাজ হয়?
আমাদের কেরানি চিঠিটা পেয়ে বোনকে সংক্ষেপে লেখে, বুবু, তুমি খামোকাই চিন্তা করো। আমি অসৎ পথে যাই নাই। অনেক দিন অনেক কষ্ট ভোগের পর আল্লা মুখ তুলিয়া চাহিয়াছেন। আমি একটি ভালো লোকের সুনজরে পড়িয়াছি। লঞ্চের চাকরি ছাড়িয়া আমি তার সঙ্গে আছি। আমি তাহারই সঙ্গে কাজ করিতেছি।
বুবুকে যদিও সে লেখে_ কাজ করিতেছি, কিন্তু কাজটা যে কী, খাম্বা সামাদ তাকে কোন কাজে লাগাবে, কী তার প্ল্যান, এখনও কেরানি জানে না। দু’একবার জিগ্যেস সে করেছে কিন্তু উত্তর পায় নাই।
আরে, এত ব্যস্ত হন ক্যা? সবুরে সবুরে। এখন খান পরেন আরাম করেন কয়টা দিন।
কেরানি একটু ভড়কে যায় কয়টা দিন শুনে। কয়টা দিন মানে? ফাঁসির আসামির মতো নিজেকে মনে হয় তার। ফাঁসির আগে নাকি আসামি যা চায় তাই তাকে দেওয়া হয়। এ রকম কোনো ব্যাপার নয় তো?
কিন্তু দুশ্চিন্তা তার স্বভাবজাত নয়। অতএব এ দুশ্চিন্তাও কেরানির মনে দু’এক মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না। সে দিন পার করতে থাকে অলস আরামে। নদীর পাড়ে নিউ ঢাকা বোর্ডিংয়ে দোতলার কামরায় সে আছে। জানালা দিয়ে বুড়িগঙ্গা দেখা যায়। লঞ্চের পর লঞ্চের ভিড়। যাত্রী। কোলাহল। ভোঁ। এই তো সেদিনই সে যে লঞ্চের কেরানি ছিল, লঞ্চে করে যাত্রা করত দক্ষিণের দিকে, রাতের সেই নদী, সেই বিকন বাতি, সেই সার্চলাইটের আলো, সব এখন সে ভুলে গিয়েছে। এ তার জীবনের গল্পই আর নয়।
কিন্তু সমুখের গল্পটা যে কী তাও সে জানে না। জানবার জন্য আগ্রহটাও যেন তার আর নাই। বাবার চিকিৎসা হচ্ছে, চিকিৎসায় উন্নতি হচ্ছে, ফোনে সে প্রতিদিন খোঁজ নেয়। মায়ের কানে অপারেশন দরকার, তার কত দূর কী হলো, ডাক্তারের কাছে কেরানি জানতে চায়। বড়বুবু কলেজে ভর্তি হবে কী হবে না, এ উদ্বেগ তার হয়। আর এগুলোই তার কাছে এখন বড়। খাম্বা সামাদ যে তাকে কোন কাজে লাগাবে, সেটা সে নিজে যখন বলবে_ তখন! এ নিয়ে তার ভাবনা নাই।
ময়না তার খাটের পায়ার কাছে থেবড়ে বসে গল্প করে। হ্যাঁ, কেরানি তাকে হোটেলের ফাইফরমাশ খাটা থেকে ছাড়িয়ে এখন তার কাছে রেখেছে। আর বই কিনে দিয়েছে। ময়না এখন তারই রুমের দরোজার বাইরে বসে দু’বেলা অ-আ-ক-খ শিখছে।
কেরানির এসব কর্মকাণ্ড থেকে একটা জিনিস দেখতে পাবো যে তার ভেতরটা মায়া-মমতায় ভরা! সংসারের দিকে বড় টান তার। কিন্তু আমাদের দুঃখও হবে যে, দু’দুবার বিয়ে করেও তার নিজের সংসার একটাও টিকল না।
একদিন ফোন বেজে ওঠে তার। রুহিতন!
জজমিয়া, ভালা আছো?
কেরানির বুকটা ছমছম করে ওঠে। কথা বলা কি ঠিক হবে? তালাক হয়ে যাবার পর পুরানা বিবির সঙ্গে কথা বলা যায়? কেরানি চুপ করে থাকে।
জজমিয়া, কথা কও।
কেরানি তবু নিশ্চুপ।
জজমিয়া, তুমি খালি আমারে কও, দোষ তুমি করো নাই।
কেরানি ফোন কেটে দেয়। পরক্ষণেই তার খেয়াল হয়, কথার জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দেওয়া ঠিক হয় নাই। রুহিতন মনে করতে পারে কেরানি নিশ্চয় দোষী, তাই সে উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে।
উলটে ফোন করবে সে রুহিতনকে? বলবে, পাগলিকে গর্ভবতী আমি করি নাই? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বেলা বহে যায়। রুহিতনকে আর ফোন করা হয় না। কিন্তু কথাটা মাথায় রয়ে যায় তার। পাগলির ওই ঘটনাতেই তো তার চাকরি যায়।
খাম্বা সামাদকে সে ফোন করে।
ভাই, একবার আসেন, কথা আছে।
তার গলার স্বরে থমথমে মেঘ লক্ষ করে খাম্বা সামাদ প্রশ্ন করে, অ্যানিথিং রং?
আই ওয়ান্ট টু টক টু ইউ।
হোয়াট অ্যাবাউট?
অ্যাবাউট এ কোশ্চেন অব মাই অনার।
আমরা হয়তো ইংরেজি এই কথোপকথনে অবাক হবো। কিন্তু অবাক হবার কারণ নাই। এক, খাম্বা সামাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের কৃতী ছাত্র। আর কিছুদিন থেকে আমাদের কেরানি করছে ব্রিটিশ কাউন্সিলে ইংরেজি কথোপকথনের ক্লাস। খাম্বা সামাদেরই পরামর্শে সে ভর্তি হয় এই কোর্স করতে।
খাম্বা সামাদ ফোন পেয়েই যে আসে তা নয়। একটু সময় নেয়। দিন দুই পরে উদিত হয় সে। এসেই কেরানির পিঠে আদরের কড়া একটা থাবড়া বসিয়ে বলে, লন, রেডি হয়া লন, চলেন কুনোখানে গিয়া বসি।
না। আমার কথাটা আগে ফয়সালা করেন। আপনি বলেছিলেন পাগলির গায়ে কে হাত দিয়েছিল, কার সন্তান, আপনি জানেন। আমি তার নামটা শুনতে চাই।
খাম্বা সামাদ কিছুক্ষণ থম ধরে থেকে বলে, ওটা আপনাকে সাময়িক ঠাণ্ডা করার জন্য কইছি। অ্যাকচুয়ালি আমি কিছুই জানি না। আর এত ছুটো জিনিস লিয়া আমার হেড একও নাই।
কেরানি বলে, তবে আরেকটা কথা।
খাম্বা বলে, তার আগে আমার একটা কথা। আপনে হঠাৎ অ্যাতদিন বাদে পুরান সেই ঘটনা লিয়া টান পাড়তাছেন ক্যান? আমি তো আপনেরে কইছিলামই, একটা দূরের হোটেলে কি একটা বাসায় আপনেরে জাগা কইরা দেই। আপনে কইলেন, না! আমার এই সদরঘাটেই ভালো। ভালো তো আমিও ভি আচ্ছা। তার বাদে আপনে এই ছেমড়ি ময়নারে ল্যাখাপড়া শিখানের লাইগা মাইতা উঠলেন, ছেমড়ির দিকে আপনের টান দেইখা আমি চুপ কইরা গেলাম। অ্যালা ঘটনা কী হইছে আমারে কন দেহি!
খাম্বা সামাদের কথার গতিকটা কেরানি ঠিক ধরতে পারে না। ময়নার কথা উত্থাপন করায় কেরানি একটু থমকে যায়। তবে কি ময়নার দিকে তার চোখ পড়েছে বলে সন্দেহ করছে খাম্বা সামাদ?
কেরানির ভেতরটা রি রি করে ওঠে। এ সন্দেহ যদি করেই থাকে তবে এরও একটা নিরসন হওয়া দরকার, আজই, এই মুহূর্তেই।
পূর্বাপর চিন্তা কেরানির ধাতে নাই। খাম্বা সামাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করার ফলে তার এই আরাম-আয়েসের জীবন যে মুহূর্তে শেষ হয়ে যেতে পারে, সে ভয় অতএব তার মনে আসে নাই। কেরানি প্রায় রুখে উঠে বলে, ময়নার কথা তুললেন কেন? আপনার মনে কী আছে পরিষ্কার বলেন তো?
খাম্বা সামাদ একই সঙ্গে কেরানির রোখ দেখে চ্যালেঞ্জ অনুভব করে, আবার তেজটাকেও সে তারিফ করে। বলে, পরিষ্কারই কমু তবে। আই উইল বি ভেরি ক্লিয়ার। ইংরাজিতেই কইতাছি, কারণ চাইরদিকে মানুষ, কথাটা রাষ্ট্র হউক আমি চাই না। ইয়েস, আই হ্যাভ এ ফিলিং ইউ ফাইন্ড দ্যাট বেবি গার্ল সেক্সচুয়ালি অ্যাট্রাকটিভ!
দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস টেনে তখন কেরানি বলে, আপনি কী বলছেন আপনি জানেন না, খাম্ভাই। আপনি আমার একটা বেদনার জায়গায় ঘা দিলেন। আমার একটা ছোট বোন ছিল, দশ বছর বয়সে সাপের কামড়ে মারা যায়। মুখখানা নীল হয়ে গেছিল। ঠোঁটে কালো বিষের গ্যাজলা। আহ, আহ, আমি ভুলতে পারি না।
অনেকক্ষণ পরে খাম্বা সামাদ বলে, ভাই, আমাকে মাফ করে দিয়েন।
না, মাফ কিসের। জগৎ এই রকমই ভুল বোঝে। মানুষ খারাপটাকেই চট করে বিশ্বাস করে, ভালোটা সন্দেহের বিষয় হয়ে পড়ে। কাউকে বলেন, অমুক লোকটা খুব ভালো, খুব দানশীল, সে বলবে হ্যাঁ হইতে পারে। কিন্তু যদি বলেন, লোকটা ঘুষখোর, লোকটা বৌ পিটায়, সঙ্গে সঙ্গে যে শুনবে সে বলবে, তাই নাকি! আরও একটু খুইলা বলেন তো! বুঝলেন খাম্ভাই, এই হইতাছে মানুষ।
খাম্বা সামাদ বলে, ঠিকই কইছেন। তারপর সে হাতে সারাক্ষণের ধরা সাথী মোবাইলটা বের করে ফোন করে, রহস্যময়ভাবে বলে, ওই পাঠা!
পাঠা মানে? কী পাঠাবার কথা হচ্ছে? কেরানির চোখেমুখে নীরব প্রশ্নটা অনুমান করে খাম্বা সামাদ বলে, লালপানি! আনতে কয়া দিলাম। আপনের কথাটা আমার মনে বড় ধাক্কা দিচ্ছে। ইয়েস, দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ লাইক দ্যাট। খারাপটা আগে মনে আসে, খারাপটা লাফ দিয়া বিশ্বাস করে। মানুষ নষ্ট! নষ্টের দিকে চইলা গ্যাছে মানুষ।
কেরানিরও মনে পড়ে গেছে সেই কতকাল পরে তার বোনটির কথা। লালপানির ধারায় সেই শোক কাগজের ছোট্ট নৌকার মতো টলমল করতে করতে অসীমের দিকে যাত্রা করে। একটা পুরো বোতলের অর্ধেকটা শেষ হয়ে যায়, তবু কাগজের নৌকার সেই যাত্রা শেষ হয় না। বিন্দু থেকে আরও ক্ষীণ বিন্দু হয়েও তা মিলিয়ে যায় না।
তারা বসে থাকে নদীর দিকে মুখ করে। সন্ধ্যা হয়ে যায়। অচিরে মাগরিবের আজান নদীর বেগুনি রঙধরা পানির ওপর দিয়ে দূরের ওপারে যায়। আবার ওপার থেকেও আজানের ক্ষীণধ্বনি এপারে আসতে থাকে। পাখিরা ঘরে ফেরে। তারা ফুটতে থাকে। একের পর এক লঞ্চ ছেড়ে যেতে থাকে। সদরঘাট ক্রমে নির্জন হয়ে পড়ে। বাঁধের ওপর কুকুরেরা টহল দিতে বেরোয়।
কেরানি বলে, একদিন লঞ্চে চাকরি করতাম।
হ, জানি তো। ভুইলা যান।
ভুইলা তো গেছিই, মগর_
কেরানির মুখে ঢাকাই জবানের ওই মগর শব্দটা শুনে খাম্বা সামাদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। লোকটা বেশ খাপে খাপ মানিয়ে উঠেছে দেখছি! বলে, মগর?
কেরানি ধীরকণ্ঠে বলে, মগর ওই লাত্থিটা ভুলি নাই।
দ্যাট আহমদউল্লাহ?
ইয়েস, ওই আহমদউল্লাহ! দুনিয়ার সামনে আমাকে লাথি মেরেছে। আমাকে চ্যাংদোলা করে নদীর পাড়ে কাদায় ফেলে দিয়েছে। চাকরি গেছে আমার দুঃখ নাই, ইজ্জত গেলে তার আর ফেরত পাওয়ার নাই। দুনিয়ার সামনে আমার ইজ্জত সে নাশ করছে। আমি যে এই সদরঘাটের হোটেলেই আছি, রইয়া গেছি, ক্যান আছি? আমি এইখানে বইয়াই আমার হারানো ইজ্জত উদ্ধার করতে চাই।
মুগ্ধ হয়ে যায় খাম্বা সামাদ। কেরানি এই যুবকটিকে যতই সে দেখছে ততই তার আকর্ষণ বাড়ছে। নিজেকেও প্রশংসা করতে ইচ্ছে করছে তার। লোক চিনতে সে ভুল করে নাই। আর, সম্মান যার কাছে এত মূল্যবান, ক্রোধ যার কাছে মুহূর্তে নিরসনের নয়, বরং রয়ে সয়ে, সময়ে, সুযোগ বুঝে, পাল্টা আঘাত!_ হাঁ, এই তো ব্যাটার মতো ব্যাটা একখান। গালে চুমা দিতে হয়!
খাম্বা সামাদ বলে, সাবাস মিয়া, সাব্বাস! আহমদউল্লাহরে যদি আপনের পায়ের উপ্রে আইনা ফালতে যদি না পারি তয় আমি মুল্লুক ছাইড়া দিমু। কান কাইটা কুত্তার গলায় আমার কাটা কান ঝুলায়া দেবেন। কুত্তার নামে আমার নাম রাখবেন।
রাখবো। অফ কোর্স রাখবো! কুত্তার গলায়!
খাম্বা সামাদ মিটমিট করে হাসে। না, হুইস্কিটা ভালোই ধরেছে কেরানিকে।
কেরানি বলে, আমারে মাতাল মনে কইরেন না, খাম্ভাই। আপনি কিন্তু কথা দিছেন।
দিছি!
আমার অপমানের শোধ!
আপনের অপমানের শোধ!
নিবেন!
নেবো! না, না, আমি ক্যান নিবো? আপনে নিবেন। আপনে তার হোগায় লাত্থি দিয়া শোধ তুলবেন। আপনের অপমান আমার অপমান। আপনে আমার ভাই। আপনে আগে লাত্থি মাইরা লন, তারপরে আমি অরে খতম করুম! শালার শালা তুই আমার ভাইয়েরে দুনিয়ার ছামনে লাত্থি মারছস!
একই কথা বারবার দু’জনে উচ্চারণ করতে থাকে_ হোগা! লাত্থি! অপমান! অপমান! শ্যাষ! এক্কেরে শ্যাষ!
গেলাশে গেলাশে ঠোকাঠুকি চলে ক্রমাগত। বোতল নিঃশেষ হয়ে যায়।
খাম্বা সামাদ নকল কান্নার ভান করে বলে ওঠে, অ্যাঁ! শ্যাষ! খতম! ফিনিছ!
ময়না চোখ ডলতে ডলতে এসে কেরানির ওপর মহা কর্তৃত্ব ফলিয়ে বলে ওঠে, কী! খাওনদাওন লাগবো না! তারপর খালি বোতলটা টুক করে হাতে তুলে নিয়ে বলে, এইগুলা খরাব মাইনষে খায়! আপনেরা কি খরাব?
সঙ্গে সঙ্গে খাম্বা সামাদ আর কেরানি পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে, তারপর ময়নার দিকে ফিরে খাম্বা বলে, না, বেটি না! আমরা খরাব না, দুনিয়া খরাব! মগর ময়না তুই আচ্ছা! বহুৎ আচ্ছা লেড়কি, কী কহিছ!
[চলবে]