গ্রিন বয়েজ ফুটবল ক্লাব

Humayun--Ahmedছোটবেলায় আমি একটা ফুটবল দল করি। দলের নাম গ্রিন বয়েজ ফুটবল ক্লাব। সে সময় বাংলা নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না। ক্লাবের নাম ইংরেজিতেই হতো। আমাদের ক্লাবের প্রধান পেট্রন ছিলেন আমার বড় মামা শেখ ফজলুল করিম। তিনি তখন সিলেট এম সি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়তেন। কখনো ফাইনাল পরীক্ষা দিতেন না বলে বছর ছয়েক ধরে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছিলেন। পড়াশোনা ছাড়া পৃথিবীর সমস্ত বিষয়ে তাঁর অসীম উত্সাহ ছিল।

কাজেই আমরা একটা ফুটবল ক্লাব করতে চাই শুনে তিনি তাঁর যাবতীয় প্রতিভা এই দিকে নিবদ্ধ করলেন। ক্লাবের নাম ঠিক করলেন। প্লেয়ারদের জার্সির ডিজাইন করলেন। সবুজ রঙের শার্ট, সাদা কলার, সাদা প্যান্ট এবং সাদা কেডস জুতা। জার্সি বা কেডস জুতা কেনার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। বড় মামা বললেন, একদিন হবে। তখন যে ডিজাইনের জন্যে বসে থাকতে না হয়। ক্লাবের নিয়মকানুন ঠিক করে সব ফুলস্ক্যাপ কাগজে লিখে ফেলা হলো। সদস্যদের জন্য চার আনা মাসিক চাদা নির্ধারিত হলো। ক্লাবের নিয়ম ভঙ্গ করলে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হলো।

সবই হলো, সমস্যা একটাই। আমাদের কোনো বল নেই। চাঁদা যা উঠেছে, তাতে বল হয় না। বড় মামা যে সাহায্য করবেন, সে উপায় নেই। বাড়ি থেকে তাঁকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমার নানাজান ঘোষণা করেছেন, দুষ্ট গরুর পেছনে আর অর্থ ব্যয় করবেন না। বড় মামাকে নানান ফন্দি-ফিকির করে নিজের চা-সিগারেটের খরচ জোগাড় করতে হয়।

আমরা ক্লাব করে বিষণ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করি। বল নেই। বল পাওয়া যাবে সে সম্ভাবনাও নেই। এদিকে বর্ষা নেমে গেছে। আমাদের পাশের পাড়ার ছেলেরা রয়েল বেঙ্গল টাইগার ক্লাব বানিয়ে ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে গেছে। বড় মামা আমাদের সান্ত্বনা দেন, ক্লাব তৈরি করাটাই আসল, বল কোনো ব্যাপার না। তোমরা প্র্যাকটিস করো।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, বল ছাড়া কীভাবে প্র্যাকটিস করব?

মামা বড়ই বিরক্ত হলেন, প্র্যাকটিস করতে বল লাগবে কেন? দৌড়ের প্র্যাকটিস লাগবে, দম রাখার প্র্যাকটিস লাগবে। ল্যাং মারা শিখতে হবে। কাচ্চি মারা শিখতে হবে। দৌড়ের সময় কনুই দিয়ে গুঁতা মেরে বিপক্ষের প্লেয়ার ফেলে দেওয়ার ট্রেনিং নিতে হবে। ফুটবল তো কোনো সহজ খেলা না। খুবই জটিল খেলা।

আমরা মামার নেতৃত্বে প্র্যাকটিস শুরু করে দিলাম। ল্যাং মারা শিখলাম, কাচ্চি মারা শিখলাম। কনুই দিয়ে গুঁতা মারা শিখলাম। তখনকার সময় ফিফার নিয়মকানুন ছিল না। ফুটবলের মাঠে ফাউল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হতো। রেফারি এসব ক্ষেত্রে বলতেন, ‘আরে এটা তো মেয়েছেলের লুডু খেলা না। একটু-আধটু লাগবেই। খেলায় যদি দু-একজনের হাত-পা না ভাঙল, তবে কিসের খেলা?’

মারামারি-বিষয়ক পুরোপুরি ট্রেনিংপ্রাপ্তির পর কে কোন পজিশনে খেলব, তাও মামা ঠিক করে দিলেন। গাট্টাগোট্টা চেহারার জন্য মজনুকে করা হলো ফুলব্যাক। মামা তার নাম বদলে দিয়ে নতুন নাম রাখলেন—জুম্মা খাঁ। মামা মজনুকে ডেকে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ভালোমতো বল আটকাবি। পেনাল্টি এরিয়ার ধারেকাছে যেন বল না আসতে পারে। ঠিকমতো খেলতে পারলে তো টাইটেল দিয়ে দেব চীনের প্রাচীর। গ্রেট ওয়াল অব চায়না।

তবু আমাদের বিষণ্ন ভাব কাটে না। অন্য দল আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করে। বল নেই, ফুটবল ক্লাব। হাসাহাসি করারই কথা। তার চেয়েও দুঃখের ঘটনা ঘটে গেল—শ্রাবণ মাসের গোড়ার দিকে আমাদের জুম্মা খাঁ রয়েল বেঙ্গল ক্লাবে চলে গেল। ওদের ব্যাক হয়ে ধুমসে খেলতে লাগল। অন্যরাও উসখুস করতে লাগল। বড় মামা মিটিং করে মজনুকে চিরজীবনের জন্যে দল থেকে বহিষ্কার করলেন। তাতে মজনুকে তেমন বিচলিত হতে দেখা গেল না; বরং মনে হলো খুশিই হলো। আমাদের সঙ্গে দেখা হলে দাঁত বের করে হাসে।

দলের মোরালের যখন এই অবস্থা, তখন মোরাল ঠিক করার জন্য বড় মামা ম্যাচ ডিক্লেয়ার করে দিলেন। সিলভার কাপের খেলা। কাপের নাম—‘শেখ ফজলুল করিম সিলভার কাপ’। লিগপদ্ধতিতে খেলা হবে। যে পারো কাপ জিতে নাও। উত্সাহ কিছুটা ফিরে এল, যদিও তখনো ফুটবলের দেখা নেই।

আমার বাবা তখন দিনাজপুরের জগদলে। তাঁর কাছে ফুটবল কেনার টাকা চেয়ে ছোট বোনকে দিয়ে একটা চিঠি লেখালাম। কারণ, বাবা তাঁর মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসেন। তিনি মেয়ের আবদার রাখবেন না, তা হতেই পারে না। বাবা সেই চিঠির উত্তরে লিখলেন—‘মা, মেয়েরা তো ফুটবল খেলে না। তুমি ফুটবল কেন কিনতে চাচ্ছ, তা বুঝলাম না।’

এদিকে ম্যাচের দিন ঘনিয়ে এসেছে। শুক্রবার খেলা। প্রথম দিনেই আমাদের খেলা পড়েছে রয়েল বেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে। আমাদের ফুটবল নেই। তাতে তেমন অসুবিধা হবে না, ওদের আছে। সেই ফুটবলে খেললেই হবে। প্রধান সমস্যা বড় মামার ঘোষণা করা সিলভার কাপেরও খোঁজ নেই। আমরা কিছু জিজ্ঞেস করলেই মামা রেগে যান। বিরক্ত গলায় বলেন, হবে হবে। এত অস্থির হচ্ছিস কেন? যথাসময়ে কাপ চলে আসবে। কাপ দেখে তোদের চোখ কপালে উঠে যাবে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কাপ চলে এল। সেই কাপ দেখে সত্যি আমাদের চোখ কপালে উঠে গেল। সেই চোখ আর কপাল থেকে নামতে চায় না। বিশাল কাপ। কাপের গায়ে ইংরেজিতে লেখা S. F. Karim Silver Cup 1955.

আমাদের আনন্দ কে দেখে। সন্ধ্যাবেলাতেই কাপ নিয়ে মিছিল। মিছিলের পুরোভাগে আছেন বড় মামা। কী ভয়ংকর উত্তেজনা। কী আনন্দ। রাতে এক ফোটা ঘুম হলো না।

প্রথম দিনের খেলায় রয়েল বেঙ্গল ক্লাব দুই গোলে হেরে গেল। বড় মামার দিকে তাকিয়ে দেখি, আনন্দে কাঁদছেন। রুমালে ঘন ঘন চোখ মুছতে মুছতে বলছেন, চোখে আবার কী পড়ল। কী যন্ত্রণা।
সিলেট শহরে ছোটদের মধ্যে এই কাপ দারুণ হইচই ফেলে দিল। ছোটদের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল বড়দের মধ্যে। ফাইনালের দিন রীতিমতো উত্সব। অনেক স্কুল ছুটি হয়ে গেল। খেলা দেখতে এলেন ডিসি, এসপি, গণ্যমান্য লোকজন। প্রধান অতিথি হয়ে এলেন এম সি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সাহেব।

সে বছর মামা আবারও আইএ পরীক্ষা দিলেন না। কারণ সিলভার কাপ কেনার জন্য তিনি তাঁর কলেজের যাবতীয় বই এবং তাঁর অতিপ্রিয় হারকিউলিস সাইকেল বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

কিছুদিন ধরেই রাত জেগে ওয়ার্ল্ড কাপ দেখছি। সোনার তৈরি কাপটি যতবার পর্দায় দেখায়, ততবারই আমার বড় মামার কাপটির কথা মনে হয়। আমার এই মামা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তার পরও টিভিপর্দায় সোনার কাপটি দেখলেই আমার মন বলে—না, পৃথিবী তাঁকে পুরোপুরি পরাজিত করতে পারেনি। বিশ্বকাপের আয়োজকদের দীর্ঘ তালিকায় অদৃশ্য অক্ষরে তাঁর নাম লিখতে হয়েছে। এই বা কম কি?

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
Alternative Textহুমায়ূন আহমেদ- র আরো পোষ্ট দেখুন