ফিরে যাবার সময়

fire jabar somoyআমার ফিরে যাবার সময় ঘনিয়ে আসে। কবে আবার গ্রামে ফিরব জানি না। কিন্তু এটাও সত্য ঢাকা শহর আমাকে ঘাড় ধরে গ্রামে ফেরত পাঠাবে। আমি না শহরের না গ্রামের। আমার মধ্যের এ অস্থিরতা দেখে মলি ঠোঁট টিপে হাসে। আমি গ্রামের আকাশকে বিদায় দিতে পারি না, তেমনি শহরের আকাশকে গ্রহণ করতে পারি না। গুডবাই বলা আমার হয় না।
মলি জিজ্ঞেস করে, কিছু বলছ আমারে?
না তো।
আমি বলতে পারি না ‘গুডবাই’ শব্দটা, আমার জিভে ফরফর করা সত্ত্বেও, আমার মুখ থেকে কেন বার হয় না। আমি কখনো দেখি মরা মানুষের আতঙ্কিত চোখ, এই চোখকে ‘গুডবাই’ বলা হয় না। আমি কখনো দেখি ভাতের গায়ে জ্বলজ্বল করছে ফাঁসির লোকটার চামড়ার রঙ, এই লোকটাকে ‘গুডবাই’ বলা হয় না। আমি ভাত নাড়াচাড়া করে মলিকে একটা কিছু বলে, টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াই কেন খেতে বসলে, এসব মরা মানুষের মুখ আমার চোখে ভাসে, আমি জানি না। সব সময় এমন হয় তা কিন্তু না। যখন হয় তার
জের কয়েকদিন চলে। মলি সে সময় চুপচাপ চলাফেরা করে। শব্দ যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখে।
মলি এই সময়টায় চাকরকে পাঠায় বাজারে মৌসুমি ফল কিনতে, লন্ড্রিতে পাঠায় লিনেনগুলো। টেলিফোনটা ক্রেডল থেকে নামিয়ে রাখে। একটা শব্দহীন রাজ্যের ভেতর আমরা বাস করা শুরু করি কয়েকদিন। তারপর স্বাভাবিক দিন, স্বাভাবিক রাত। শব্দ ফিরে আসে, সফট ড্রিঙ্কের ক্যান খোলা শুরু হয়, খাবার টেবিলে টুং টুং শুরু হয়, চামচ প্লেট গ্লাসের কোলাহল। দূরে কোথাও র‌্যাবের গুলির আওয়াজ শুনি; কিন্তু উপেক্ষা করি।
মেহমানকে বলি, আজকের গোসটা কেমন হয়েছে?
মেহমান জবাব দেয়, গোসটা খুব নরম হয়েছে।
আলু মিহিন, মুখে গলে যায়।
মলি বলে, আগে র‌্যাবের গুলির আওয়াজ শোনা যেত মধ্যরাতে। এখন ভরসন্ধ্যায় কিংবা রাত দশটায়।
মেহমান ফের বলে, দুষ্কৃতিকারীরা কি শহর ঘিরে ফেলেছে?
আমি বলি, দুষ্কৃতিকারী? হবে হয়তো।
মলি বলে, কে জানে।
খাবার টেবিলে কথাবার্তা আর এগোয় না। আমরা হাত ধোয়ার জন্য উঠে দাঁড়াই।
আমার হঠাৎ মনে হয় সেই স্তব্ধতা গ্রামে এসেছে, যেখানে সবার নীল চক্ষু (হারমাদরা কি আমাদের এলাকায় কখনো বসত করেছে), আর সবাই আরবি বলে (আরব বণিকরা এখানে এসেছে বলে কোনো হদিস আমার জানা নেই)। সেজন্য সবাই নিজেদের দরজা খুলে রেখেছে এবং স্বাগত জানাচ্ছে জাতীয় সরকারকে, ট্যুরিজমকে এবং কমার্সকে। গ্রাম কি
হয়ে উঠেছে বিদেশিদের কলোনি? সেজন্য কি এত নীল চক্ষু? এত আরবীয় পোশাক দেখা যায় রাস্তাঘাটে? আমি বুঝি কেন আমি খেতে পারি না।
আমি বলতে পারি না, মলিকেও বলতে পারি না,
আমার ভেতরকার নিনাদ।
হঠাৎ একটা কথা আমার মনে পড়ে। কথাটা
মলিকে বলা দরকার।
মলি।
বলো।
যাবার পথে একটা গ্রাম হয়ে যেতে চাই।
বেশ তো।
নানা গ্রাম ঘুরে ঘুরে ঢাকা ফেরা আমার একটা প্যাশন। এই ঝোঁকে কোনো গ্রামে যাওয়া বিচিত্র না। সেজন্য মলি বোধহয় কোনো কথা জিজ্ঞেস করে না। কিন্তু এবারকার গ্রামটা ভিন্ন। মলিকে কেন এতদিন বলিনি, জানি না। আমার দ্বিধা কেন,জানি না। আমি বেশ প্রস্তুতি নিয়ে, একটা আখ্যান তৈরি করে মলিকে কথাটার কাছে নিয়ে যাই।
মলি।
কি বলতে চাও, বলো।
এবার যে গ্রামটিতে তোমাকে নিয়ে যাব,তার নাম গৌরীপুর।
গৌরীপুর? সেখানে স্পেশাল কিছু আছে?
স্পেশাল না, তবে-কী?
সে বিশ দশকের কথা। এই এলাকায় ঐ সময় প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ হয়। মানুষ খেতে পায় না, মারা যায় বেশুমার। লোকজন, মা-বাপরা,বাচ্চাকাচ্চা সন্তানদের বিক্রি করা শুরু করে।আমার বাবা তখন এই এলাকার স্কুল সাব ইন্সপেক্টর। তিনি একজোড়া বোন কেনেন, বিশ টাকায় করুণা আর জরিনা। করুণাকে তিনি দেন তার শাশুড়ির সংসারে। আর জরিনাকে রাখেন নিজের
সংসারে। বলতে পারো জরিনার কাছে আমরা মানুষ হয়েছি। আমাদের কাছে জরিনা ছিল বড় বোনের মতো। বাড়িতে যে নতুন গোরস্তান দেখেছ, তার প্রথম কবর জরিনার।করুণা,আমার নানি মারা যাওয়ার পর, চাঁদপুর থেকে গৌরীপুরে, নিজের বাড়িতে পালিয়ে আসে। মা-বাপ তার অনেক আগেই মরে গেছে। করুণা তার শিশুসন্তান,একমাত্র মেয়েকে, খেয়ে না খেয়ে বড় করে।
মেয়েটির নাম সখিনা। সখিনার বাপকে করুণা কখনো বলেনি। আজ গৌরীপুর যেতে চাই,
সখিনার বাড়ি। একটু ডি-ট্যুর হবে, এই যা। যাবে?
মলি একটু চুপ থেকে বলে, বেশ তো।
আমি খুশি হই, খাবার দাবার কিছু সঙ্গে নেব, কী বলো?
ভালোই তো। কিন্তু এতদিন পর কেন?
জানি না। কোনো ব্যাখ্যা আমার নেই। হঠাৎ মনে হলো তাই।
গৌরীপুরে পৌঁছাই পাঁচটা নাগাদ। বাড়ি থেকে বের হতে দেরি হয়।লোকজন আসতেই থাকে। তাদের নানা দাবি, নানা আবদার। কারো সরাসরি টাকা দরকার। কারো অসুখ-বিসুখের নামে টাকা দরকার। কারো মেয়ের বিয়ে দেয়ার নামে টাকা দরকার। নানান বাহানায় আমার পকেট থেকে টাকা ওদের পিরহানের জেবে, মেয়েদের আঁচলের তলায় চলে যায়।
মলি তাড়া দেয়, শোন হাতেমতাই: তুমি ফতুর হবে।
আমি কিছু একটা বলতে চাই। গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। হাতেমতাইর ভূমিকায় আমাকে কি মানায়? জানি না। এ ধরনের চরিত্র ইতিহাসে বিরল। কোনো এক কালের ভারতের অশোক, কোনো এক কালের আরব্য দেশের হাতেমতাই। আমি কি তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছি? আমার তাদের মতো বিত্ত নাই।
গৌরীপুর নদীনালার দেশ। মধ্য আশ্বিনে নদী কোথাও জলা, কোথাও ধানক্ষেত। নদীর টান পশ্চিম দিকে, আমি এবং মলি মুগ্ধচক্ষে চেয়ে থাকি। নদীতে, জলায়-মধ্যে ইতস্তত নৌকা,
বাতাসে উদ্দাম হচ্ছে। মাঝে ট্রলার তীরবেগে ছুটছে, মানুষ এবং মাল বোঝাই হয়।
মলি আপন মনে বলে, জানো এম এ-তে আমি এনত্রোপলজি পড়েছি। তো। এসব দৃশ্য দেখে আমার ম্যালিনস্কির কুলার কথা মনে পড়ছে। কুলা?কুলা হচ্ছে ম্যালানৌশায়ার সবচেয়ে বড় উৎসব।
সেই উৎসবের সঙ্গে এসবের সম্পর্ক কী?
আছে। আছে।
বলো।
কুলা উৎসবের সময় নৌকাগুলো সমুদ্রে রওনা হয়,
যেমন এখানে মেঘনার দিকে।
উৎসব এখানে কই?
একটা থেকে অন্যটা মনে পড়ে, তাই।
বলো।
বইটার মধ্যে অনেক গান আছে। একটা গান
শোনাই।
বলো।
মলি সুর করে বলতে থাকে : গ্রামের মেয়েদের বলে যাই,
আমরা যাবো দেশান্তরে, এই গ্রাম, এই মাটি তোমাদের কাছে রেখে গেলাম।
তোমরা সতী থাকো, জঙ্গলে কাঠ কুড়াতে গিয়ে পেছনে চেয়ো না;
চাষ বাগানে চাহনি সতর্ক রাখো,
তারপর আপন সহোদররা হাত ধরে গৃহে ফিরে
এসো।
আশ্চর্য সুন্দর।
হবে হয়তো।
কিন্তু একটা কথা।
কী?
তোমরা পুরুষরা, মেয়েদের দোষ ধরো কেন?
আমি মাথা চুলকাই। জুঁতসই জবাব খুঁজে পাই না। নদীটা একটু পেছনে পড়েছে রাস্তাটা পূর্ণদৈর্ঘ্য। একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি থামাই। সখিনাদের বাড়ির ঠিকানা জানতে হবে। গাড়ি দেখে ভিড় জমেছে। দোকানের সামনে একটা লম্বা টুল। তাতে কয়েকজন গ্রামবৃদ্ধ বসে আছে। কারো কপাল চিন্তাকুল কারো কপাল তেল চিটচিটে। দোকানদার মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, কই যাইবেন?
তখন আমি বুঝি প্রশ্নের জটিলতা।
সখিনারা তো বিত্তহীন। নাম বললে কি চিনবে। তাদের পুরুষ মুরব্বির কেউ আছে কিনা জানি না। আমি বিব্রত বোধ করে চুপ করে থাকি।
দোকানদার ফের বলে, কই যাইবেন?
আমি বলতে বাধ্য হই, সখিনাদের বাড়ি। কোন সখিনা? এই গেরামে পাঁচ ছ’জন সখিনা আছে।
এর মধ্যে যে গ্রাম্যবৃদ্ধের কপাল চিন্তাকুল তার চোখ বড় হয়ে ওঠে। যে গ্রামবৃদ্ধের কপাল তেল চিটচিটে তার চাহনিতে শৃগাল দেখা দেয়। কয়েকজন গেঞ্জি পরা, কয়েকজন শার্ট পরা যুবক
ভিড় জমায়।
আমি আমতা আমতা করে বলি,সখিনাকে আমি দেখি নাই। তার মা করুণা।করুণার বোন জরিনা আমাদের বাড়িতে থাকত।
যে গ্রামবৃদ্ধ চিতকুল, তিনি বলেন, বুঝছি। যারা বেইচা দিচ্ছিল অভাবের কালে তার বাপ-মা।
যে গ্রামবৃদ্ধের কপাল তৈলাক্ত, তিনি বলেন, তাও পুরা টাকা দেয় নাই। খাটাসের ঘরের খাটাস।
আমি বুঝে উঠতে পারি না গলাটা কার উদ্দেশ্যে :আমাকে বলা, না আমার জনককে বলা। আমি রেগে উঠতে যাচ্ছি বুঝতে পেরে মলি আমার হাত ধরে টানে।
দোকানদার বলে ওঠে, থামেন, থামেন মুরব্বিরা।
বুঝছি চোরাগো বাড়ি। চোরদের বাড়ি?হ চোরাগো বাড়ি। সামনের বাড়িটার পরের বাড়িটাই। ওই মহিলার লগে যান। পৌঁছাইয়া দিব।গাড়িটা এইখানে রাইখা যান। গাড়ির রাস্তা আর
নাই। আমি দেখুম।
গাড়ি থেকে নেমে আমি আর মলি হাঁটা ধরি। মহিলাদের মধ্যে কোনো জড়তা নেই। ঘোমটা খোলা মুখ, সুশ্রী, চলনে দৃঢ়তা।
মহিলা মুখ ফিরিয়ে বলে, আমার নাম জয়নাব।
আমি একটা এনজিওতে কাজ করি।
তার বলন স্পষ্ট। কথার মধ্যে একটা যুক্তির স্রোত আছে বোঝা যায়। কথা কাটা কাটা, শব্দ মেদহীন, সাধারণত গ্রামের মেয়েদের কথায় যে মেদ থাকে, তা নাই।
জয়নাব বলে, যখন শুনলাম চোরাদের বাড়ি তখন বুঝলাম সখিনাদের বাড়ি যাবেন। সখিনার মা করুণা খালা বহু কষ্ট করেছেন। অভাবে তার বাপ-মা খালাকে বিক্রি করে দিয়েছিল। খালা, কয়েক বছর পর, চাঁদপুর থেকে পালিয়ে আসে। ঘরবাড়ি জঙ্গল,সাফসুতরা করে বসত শুরু করে। একদিকে সাপকোপের ভয়, অন্যদিকে বদমাশদের ভয়,অপরদিকে ক্ষুধার ভয়। এই তিনভয়ের মধ্যে করুণা খালা বাঁচতে থাকে। তার বাড়িতে কোনো পুরুষ দেখি নাই। অল্প বয়সে আকালের ভয়, আকালের ভয় থেকে ক্ষুধার ভয়, আর ক্ষুধার ভয় থেকে বিক্রি হওয়ার ভয়, এসব ভয় থেকে করুণা খালা কখনো নিস্তার পাননি। সেই ভয় থেকে চুরি করে খাদ্য জোগাড় করা তার জীবনের সবচেয়ে বড় নেশা হয়ে ওঠে। খাদ্য পেতে হবে, খাদ্য জোগাড় করতে হবে। করুণা খালা যে বাড়িতে যেত সেই বাড়ি থেকে ভাত চুরি করত। শুধু কী ভাত। শুকনা ডালপালা জোগাড় করা, কচুর লতি জোগাড় করা।
বাঁশের কোর জোগাড় করা, কুঁচো মাছ জোগাড় করা: সব সব। সবই অন্যের। অন্যের মালিকান থেকে যা কিছু হাতানো যায়, সবই চুরি। তার ফলে করুণা খালার বাড়ির নাম বদলে গেল। হলো চোরের বাড়ি। করুণা খালা সঙ্গে নিয়ে ঘুরত সখিনাকে সখিনাও এক্সপার্ট হয়ে ওঠে। করুণা খালার বাড়ি মধ্যে মধ্যে গেছি দেখছি যেখানে সেখানে ভাত লুকানো, খাবার দাবার লুকানো। আকালের ভয়, না খেয়ে থাকার ভয়, তার জীবন থেকে কখনো সরে যায়নি। ওই তো সখিনা। যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, বাঁশ ঝাড়ের কাছে। আমি যাই। আপনারা
কি করুণা খালার কেউ হন?
শুনেছি করুণা খালার এক বোন আছে। সেই বোনের তরফ থেকে আপনারা এসেছেন? যাই, সালাম নেবেন।
জয়নাব তার বাড়িতে চলে যায়। আমাদের সমস্ত চোখজুড়ে সখিনা দাঁড়ানো। তার ভঙ্গিতে তেজ। তার চোখে নিষ্ঠুরতা। শরীরে কোমলতা বলতে যা বোঝায়, তার একরত্তিও নেই। কালো একটা গাই গরু শিং উঁচিয়ে আছে। এক হাতে খাবারের পুঁটলি,অন্য হাতে মলিকে জড়িয়ে অগ্রসর হতে থাকি।
তুমি সখিনা?
হয়। কী দরকার আপনের?
আমি তোমার খালা জরিনা বুর ভাই।
দেইখা তো মনে হয় না।
তা ঠিক। জরিনা বু আমাদের বাড়িতে থাকত।
বান্দির মতো।
তা না। আমাদের মানুষ করেছে।
আমার মা তো অনেককে মানুষ কইরাছে। তাতে কী অইছে।
সখিনা।
কন।
তোমার সঙ্গে বিবাদ করতে আসিনি।
আমি কই বিবাদ করলাম।
কিছু খাবার তোমার জন্য।
দ্যান।
তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে?
দাসি বান্দি হইতে?
না। সে কথা বলিনি।
সানঝা ঘনাইতেছে। যান গিয়া।
কেন। আরো খাইনকক্ষন কথা বলি।
তরায় যান। জায়গাটা ভালো না।
ভালো থেকো সখিনা।
আপনেরা তত্ত্বতালাশ নিলেও ভালো থাকুম, না নিলেও ভালো থাকুম। যাই এখন।
সখিনা দাঁড়িয়ে থাকে।
আমরা ফিরে যাই গাড়ির দিকে। চায়ের দোকানে ভিড় আরো বেড়েছে।
দোকানদার বলে, দেখা অইলো? কথাবার্তা অইলো?
আমি সংক্ষেপে উত্তর দিই, হয়েছে।
মুরব্বি, আপনেরা কারা তা তো কইলেন না?
আমরা সখিনার আত্মীয়।
কেমন আত্মীয়?
সব বলতে হবে?
যুবকরা আমাদের ঘিরে ধরে। সূর্য ডুবছে তার ফুল রঙা আলোক ছড়ানো। বাতাস দূর থেকে দূরে ছুটে চলেছে। গ্রামাঞ্চলে আমাদের চোখ ঘুরছে। নদী থেকে স্রোতের গন্ধ উঠছে। মলি সিটে বসতেই আমি গাড়ি স্টার্ট দিই। আমি মনে মনে বলি, বিদায় গৌরীপুর, বিদায় সখিনা, বিদায় জয়নাব। আমরা আর আসব কিনা, জানি না। আমাদের হৃদয় ভারী,আমাদের চোখে গোপন অশ্রু।
মলি হাত বুলায় আমার হাতে, যেন সান্ত¡না দেয়। কী যেন খুঁজতে এসে আমি হেরে গেছি। জিতেছে তারা, যারা জেতে সব সময়, মলি আমরা কোন জঙ্গলের বাসিন্দা। সর্বত্র সন্দেহ, সর্বত্র অবিশ্বাস। মলি ফ্লাস্ক থেকে কালো এবং সুগন্ধি কফি বের করে দেয়।
আমি চুমুক দিতে থাকি, আর গাড়ি চালাতে থাকি।গৌরীপুর পেছনে মিলে যায়।
বড় রাস্তার ওপর উঠতেই লোকজন বলতে থাকে, কই যাবেন?
ঢাকা? ঢকায় ভীষণ গ-গোল। বেশুমার লোক মারা গেছে। বেপরোয়া লোকজন ইলেকট্রিক অফিসে আগুন দিচ্ছে। সরকারি অফিসে আগুন দিচ্ছে। দমকলের গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। মুরব্বি দম ধরেন এখানে। পরে রওনা দেন।
আমি জিজ্ঞেস করি, মলি কী করব? থামব এখানে।
মলি অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে না, সামনে চলো।
আমি স্পিডে গাড়ি চালাই। সন্ধ্যা হয়েছে, কিন্তু বাতি নেই কোথাও। একটা অন্ধকার নিয়ে,নদীগুলোর প্রবাহে জেগে আছে। লঞ্চ আর নৌকো মাড়াই করছে চাঁদের আলো। চাঁদের আলো ছাড়া
আর কোনো আগুন কোথাও নেই।
মলি চাঁদের দিকে মুখ তুলে বলে, তোমাকে একটা কথা বলি।
আমার অতীত জীবন থেকে একটা কথা। লন্ডনে থাকতে আমি প্রায় সব ডেমোনেস্ট্রেশনে যেতাম।ট্রাফালগার স্কোয়ার ভর্তি লোক আমর শিরায় শিরায় আগুন ধরিয়ে দিত। সে সময় আমার সর্বক্ষণের বন্ধু স্টিভ জোনস। স্টিভ আমার বন্ধু। একদিন ডেমো ভয়ঙ্কর ভায়োলেন্ট হলো। পুলিশ গোড়া দিয়ে চার্জ করল। স্টিভ আমাকে গুডবাই চুমো খেল, একটা সেন্টিমেন্টাল চুমো। সাবধানে থেকো। তুমিও। জা বাসায় চলে যাও। চিন্তা করো না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কখন আমাদের ফের দেখা হবে?কিছুদিন আমাকে পালিয়ে থাকতে হবে। আর একটা চুমো। আমি তার গলায় হাত জড়িয়ে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করলাম, আমার বিশ্বাস স্টিভও একই কথা ফিসফিসিয়ে বলেছে। আমরা দুজন ভালো বন্ধু,স্নেহ বৎসল, ভাই এবং বোন। সাবধানে থেকো।
তুমিও, তুমিও। স্টিভ সেই যে চলে গেল, তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।
শনিরআখড়া যখন পৌঁছাই, রাস্তায় একটি মানুষ নেই। মনে হয় পরিত্যক্ত শহর। পরে দেখি কিছু লোক বিদ্যুৎ অফিসের সামনে জটলা পাকাচ্ছে। মনে হয় একটি লাশ অফিসের সামনে পড়ে আছে।
চোখ তুলতে দেখি বাড়ির ছাদে ছাদে মানুষ। পুলিশ এবং র‌্যাবের কিছু সদস্য একটা গাছের গুঁড়িতে বসে আছে চুপচাপ।
মলিকে বললাম চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকবে।
আমি যেসব লোকজন ভিড় করেছে তাদের বললাম,একটা যেমন তেমন স্ট্রেচার বানাতে। লাশকে শোয়ালাম তার ওপর। ভিড় ঠেলে মা জননী সামনে এলেন। তিনি চেয়ে থাকলেন তার আত্মজের মুখের দিকে। তিনি বোধহয় কিছু বুঝতে পারছেন না।
দুজন পুলিশ দুজন র‌্যাব বারবার বলতে লাগল নিজেদের হাতে জাস্টিজ যেন না তোলা হয়।
কথাগুলো তারা নামতা পড়ার মতো বলতে লাগল। কোনো উৎসাহ নেই নামতার মধ্যে। তারা নিজেরা জানে, যে গুলি চালিয়েছে সে সরকারি গুন্ডা, তার কোনো বিচার হবে না। আমি লাশটা স্ট্রেচার থেকে দুহাতে তুলে নিলাম, মনে হচ্ছে আমার নিয়তি,হাঁটতে লাগলাম, লোকজন জায়গা ছেড়ে দিল।
আমি হাঁটতে লাগলাম ছেলেটির বাড়ির দিকে,আমার পাশে হাঁটতে লাগলেন তার মা, তার জননী। একটা ক্রোধে আমি কাঁপতে লাগলাম,তারপর আমার চোখজুড়ে পানির স্রোত এলো।
ক্রোধ আর কান্নায় একাকার হলো আমার সঙ্গের লোকজন।
আমি ফিরে এলাম মলির কাছে। গাড়িতে। হঠাৎ চোখ পড়ল দেয়ালে, লেখা: প্রধানমন্ত্রী চোর। কে বড় চোর? যে ভাত চুরি করে? না যে দেশ চুরি করে? মলি তুমি কি এর জবাব জানো?
মলি বলে,স্টিভ থাকলে এর জবাব দিতে পারত।
আমি মলির হাত ধরে থাকলাম আর গাড়ি চালাতে থাকলাম ঢাকার দিকে।