অস্তিত্ব

তবে তোমার ভালোবাসা তুমি ফিরিয়ে নেবে বলছ? যে ভালোবাসা তুমি এত দিন উৎসারিত করেছ, যে সম্পদ তুমি উন্মুক্ত করেছ…তোমার চুম্বন…আদর ও স্বপ্ন দেখিয়েছ সবই একে একে তুলে নাও। পারবে? চাও? তাহলে তুলে নাও, ফিরিয়ে নাও।…নিতে চাও? ছিন্নভিন্ন আমি পরোয়া করে বললাম।

পারবে সেই বোশেখের শিলাবৃষ্টির ভয়স্নিগ্ধ ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনের বৈকালিক স্মৃতি-চুম্বন মুছে নিতে? ভয় ও ভালোবাসার সম্পন্নতার মূল উত্পাটন করতে, আমার পরশ ধুয়ে ফেলতে, আমার ভালোবাসার আস্ফাালন যথাস্থানে ফিরিয়ে দিতে…? আমার কুমারিত্ব বহাল রাখতে? আমি তা চাই না, তাহলে তুমি এত দিনে আবার আমাকে অন্য কিছু কী বলতে চাইছ!

আমি চাই, আজও চাই, শুধু তোমাকেই চাই। তুমি তুমি, প্রবল তুমি।

—আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, যে কান্নার শব্দ নেই, ভাষা নেই, অশ্রু ও অনুশীলন নেই।

আমি তো এখন আমার নেই। আমি এখন শূন্য শূন্য শূন্য।

তাহলে সেই শূন্যতা কেন দিতে পারছ না! আমি তোমার শূন্যতার কাঙাল। তবে যে আমার আর কিছুই থাকবে না। কী নিয়ে আমি থাকব! তোমার অতীতকে এত অবজ্ঞা করো না।

ওই না-টুকুই আমি চাই। তোমার না-ও আমি চাই। তোমার হ্যাঁ যখন আমার মধ্যে ভরে নিতে পেরেছি, তেমনি না-ও নিতে প্রস্তুত। আমার এই মুহূর্তের সম্পন্নতাকে তুচ্ছ করো না।

তোমাকে আমার সব হ্যাঁ দিয়ে দিতে পারি। না-টুকু দিতে পারি না। আমার না, আমার অন্ধকার, আমার অতীত, আমার না-ভালোবাসা কী করে দিই তোমাকে! শূন্যতা ছাড়া কী করে কী নিয়ে থাকব আমি! শূন্যতাও যে আমার সম্পদ।

সব হ্যাঁ-টুকু তুমি নিয়ে লও, শুধু না-টুকুই আমি চাই আজ। না-এর অসীম শূন্যতায় থুবড়ে পড়ে থাকব।

না-টুকু কখনো কোনো মানুষ কাউকে চিরতরে দিতে পারে না। না-টুকু দিয়ে দিলে তার যে আর কিছুই থাকে না, শূন্য মানুষের। নাও, এখন আর তোমার অতীতকে তুচ্ছ কোরো না। নিজেকে আর নামিয়ে নিয়ো না। আমি তোমার নিচে নেমে যাওয়া দেখতে চাই না।

আমি এখন তোমার ওই না-টুকুই চাই। শুধু না-টুকু।

আমি পারব না। আমি তা দিতে পারি না। কিছু ছাড়া আমি তাহলে কী নিয়ে থাকব! না-হীন হলে আমার অস্তিত্বেরই যে অবশেষ থাকে না। ওইটুকু তুমি আর চেয়ো না। দোহাই তোমার অতীত ভালোবাসার। তোমার অতীতের সম্পন্নতাকে আর তুচ্ছ করো না।

এই নিয়ে আমাদের ভালোবাসার যুদ্ধ, যুদ্ধবিরতি ও

সংলাপ-আলোচনা চলতে থাকে।

এই ভালোবাসা নিয়ে ওর গায়ে তকমা আঁটা হয়ে গেল ‘না’। আমার নাম হয়ে গেল ‘হ্যাঁ’।

ওর অসম্মতি। আমার সম্মতি।

ওকে দেখতে হয় পরিবারের অনেক কিছু। বলতে গেলে আমাকে কিছুই দেখতে হয় না। খুব ছেলেবেলায় মাকে হারিয়েছি। অমন ছেলে বা মেয়েবেলায় মা বা বাবা কাউকে যেন কারুর হারাতে না হয়। ছেলে বা মেয়েবেলাটা মানুষের খুব দরকার। পশু-পাখিরও বোধ করি। খুব প্রয়োজন ও সময় ঘরভরা মানুষ ও ভালোবাসা। পাড়াপড়শি, গাঁও-গ্রাম। দেশ।

ওর ছিপছিপে মেয়েবেলা আছে। আমার মোষ, হরিণ, গণ্ডার ও গরুর শিং সংগ্রহে আছে। তাও বহু পুরনো, চার-পাঁচ পুরুষ আগের। ওর বাড়ির পাশে একটি নিজস্ব টলটলে পুকুর আছে। কিন্তু আমাকে সেখানে সাঁতার কাটতে দেয় না। কেউ কেউ বলে তাতে নাকি দখলি স্বত্ব হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। ওর অনেক কিছুর মধ্যে একটি অমূল্য নীলকান্ত মণি আছে। তার বিপরীতে আমার আছে স্মৃতির ভাঙা ঝিনুক একটি।

ও মৌসুমি নতুন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কবিতা ও গান খুব পছন্দ করে। আমি ভালোবাসি ভরা জোয়ার নদীতে ঘণ্টা ঘণ্টা ধরে সাঁতারের বদলে চিত্পাত ভেসে থাকা। তবে ওর মতো নদীর ধারের একটি পলতে মাদারগাছে অজস্র জোনাকি একই সঙ্গে জ্বলতে ও নিভতে দেখতে খুব ভালোবাসি। প্রথমে এলোমেলো হলেও একটু পরে ওরা একই সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেয়। ওর চমত্কার বর্ষাতি আছে, আমার ছাতা।

ওদের জমা অনেক অর্থবিত্ত আছে। আমাদের দশ একর দো-ফসলা জমি কর্ণফুলী নদীর আগ্রাসে নিশ্চিহ্ন। এমনকি দুই একরের ভিটেও বিলুপ্তির পথে। পাঁচ-সাত পুরুষ আগে আমাদের পূর্বপুরুষ ঠিক কোন গ্রামে ছিল, আমি জানি না। আমাদের এই মফস্বল শহরের নদীতে একবার একটি কুমির এসেছিল। সে নদীর চরের মাছের ঘেরে দুম করে আটকে পড়েছিল। ও দেখেছিল, আমি মামাবাড়িতে যাওয়ায় দেখতে পাইনি। এ রকম কিছু কিছু ছুটকো বিষয়ে আমাদের অমিল থাকতেই পারে। সেই অমিলের জন্য এই সকাতরতা নয়। ও খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে। খুব মিষ্টি করে হাসে। গান গায় নিখুঁত মূর্ছনায়। ওর বিশেষ বিশেষ চুমু অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য উদ্রেক ও সৃষ্টিকারী। ও খুব কুমারীরত্ন। ও আদুরে ও আদরের আবিষ্কারক।

প্রতি রাতের স্বপ্ন ও হুবহু মনে রাখতে পারে। বলতে পারে।

আমি মনে রাখতে পারি না, তাই বলতেও পারি না।

ও খুব টক পছন্দ করে। ঝাল এবং মিষ্টিও।

আমি ঝাল। অসময়ে মিষ্টি।

লুডু খেলায় কেবলই জেতে ও।

আমি শুধু হেরে যাই।

ও খুব গাইতে পারে।

ওর উৎসাহে আমি গান লিখতে পারি দীর্ঘ চেষ্টা না করেও।

ও নাচ জানে।

আমি ওর নাচের মুদ্রা রপ্ত করেছি বই পড়ে, ছবি দেখে।

ওর দুর্দান্ত এক অহং আছে। আমারও আছে।

ও পাকিস্তানি।

আমি বাঙালি।