শীতের শব্দগন্ধচিত্রমালা

1_173021কুয়াশার বাড়ির ভেতর এভাবে নিজেকে দিনরাতের সিংহ ভাগ সময় নিয়ে ডুবে থাকতে কবে দেখেছি আমি মনে করতে পারি না। ২৬ অক্টোবর ২০১৪ থেকে বাঘের মতো পিছু নিয়েছে কুয়াশার মায়াবী নাগপাশ, শীতের গল্প ও কবিতা। একবার ভাবি, তাকে ভালোবাসলে আর ছাড়াছাড়ি নেই। তাই কুয়াশা তরুণীকে ছাড়িনি। সেই কবেকার বালক বয়স থেকে দেখছি আমাদের উঠোনে খুব ভোরে কাজের মেয়েরা ধান মাড়াই শুরু করেছে তক্তায় পিটিয়ে! তার শব্দতরঙ্গ কুয়াশায় ঘেমে-নেয়ে হয়ে উঠত পিচ্ছিল লাস্যময় ও রজতাভ। কখনো বা মেজদি-সেজদিও যোগ দিত শলা করে। ফাঁকফোকর করে নিয়ে ছোট বোন ও আমিও সেই কুয়াশার বাড়িতে চুপিসারে ঢুকে পড়তাম। অল্প সময়ের মধ্যে গায়ের শীত পালিয়ে যেত শীতের ঘরে। খড় মাড়াইয়ের সময় হয়ে উঠতাম আরো বেপরোয়া। কারণ তাতে পরিশ্রম কম, প্রমোদ বেশি। খড় মাড়াইয়ের চাকের গরুর পিছু পিছু আল্লাবিদ্যা বা ডিগবাজি খাওয়ার বেপরোয়া মজার কি তুলনা আছে? খড়গুলো আঁটি থেকে সদ্য খুলে চাকে দেওয়া হচ্ছে বলে শুকনো ও মজাদার। কুয়াশার শব্দহীন শব্দ তখন হয়ে উঠত সবাক। ততক্ষণে কুয়াশা আমলকীর মতো পুষ্ট হয়ে গেছে, ভোরের প্রধান আলোয় রৌদ্রাভ হয়ে উঠবে। টুপ টুপ উঠোনের উত্তর পাশে সুপরি গাছের প্রতিবেশী শিউলির কমলা-সাদা পুষ্প। শরতের রাজকন্যা শিউলি অঘ্রানকে বধ করে পৌষে কৃষকায় হলেও সোমত্ত-সুন্দরী। উঠোনের ওপরে ফাঁকায় কুয়াশারা ওড়াওড়ি করছে বোশেখের মাছের রেণুর মতো। ওরা এসে জড়িয়ে যাচ্ছে চুলে ও ভুরুতে। গায়ের চাদর নকশিকাঁথা ছুড়ে ফেলে দিয়েছি ধানের আঁটির ওপর, ওখানে সে কুয়াশাভেজা হোক, ওর এখন শীত-গরম বোধকরি খুব একটা মালুম নেই। আমার গায়ে থাকলে টের পেত উষ্ণতা ও শীতের ব্যবধান দূরত্ব। সারা দেশে শীতের নয়-ছয় কাণ্ডের একটু খতিয়ান করা যাক এই সুবাদে। ২৮ ডিসেম্বরে রাজশাহীতে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭.৬ডিগ্রি সে., ঢাকায় ১২.৩ডিগ্রি সে.। পাকশীতে ৭ ডিগ্রিতে নেমেছে বলে জানা যায়। প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকার ‘দেওয়ানা মদিনা’তে দেখি পৌষ-মাঘের শীতে ধানচাষের খবর। মাঘ মাসে নায়িকা মদিনা গাইছে, ‘দারুণ মাঘ মাসের শীতে হাওয়ায় কাঁপয়ে পরাণি। পতাবরে উইঠ্যা খসম যায় ক্ষেতে দিতে পারি আগুন লয়্যা যাইরে আমি সেই না ক্ষেতের পানে। পরাব হইলে আগুন তাপাই বাতরে বইস্যা দুই জনে’ [টীকা : পতাবরে : প্রভাতে। খসম : স্বামী। পরাব : পরাভূত। তাপাই : পোহাই। বাতরে : আলে।] আধুনিককালে কার্তিকের কুয়াশার নিজস্ব নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশ। অনিবার্য কার্তিকের রেশ ধরে শীত এসেছে তাঁর কবিতায়। প্রকৃতি, ইতিহাস ও সমাজ-চেতনার বা নিশ্চেতনার কবি হয়তো তিনি অথবা সুররিয়ালিস্ট। ‘অন্ধকার’ কবিতায় তিনি দীর্ঘ এক পঙ্ক্তিতে লিখেছেন, ‘হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া,’ এবং তার পরের পঙ্ক্তিতে আছে, ‘আমাকে জাগাতে চাও কেন?’ কুয়াশার দিনগুলো পেরিয়ে মাঘরাত্রির কোকিল বা শীত থেকে কে আর সাধ করে বাঁচতে চায়? কিন্তু জীবনানন্দ দাশ আসলে এখানেও শীত থেকে রেহাই পেতে চাননি। তিনি স্বপ্নবাস্তবতা রচনা করেন মায়াবী কুয়াশা ও আত্মমগ্ন শীত নিয়ে, বনলতা সেন ও সুরঞ্জনাদের ও বাংলা নিয়ে, মহাপৃথিবীর মহাকুয়াশা ও শীত নিয়ে। এমন ঘোরগ্রস্ততা বাংলা সাহিত্যে নেই। আবার তাই শীত এসেছে বহু দেশ ঘুরে বহু পথ পেরিয়ে জাঁক দেখাতে। প্রতিবছর শীত আসে। কিন্তু এ বছর বর্ষা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় সে শরৎকে গোগ্রাসে গিলে হেমন্তকে করে দিয়েছে ক্ষণজীবী। তাই হেমন্ত থেকে শীত এসে পড়েছে। এখন শীত তার বিখ্যাত ভাণ্ড থেকে কুয়াশার জামদানি শাড়িকে করে তুলেছে নিবিড়-ঘন জলডুবি চাদর। সেই সঙ্গে তার একান্ত নিজস্ব শব্দগন্ধচিত্রমালার সাম্রাজ্য উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ আলিঙ্গন ও মর্দনরসে কাতর করে তুলেছে। সে কুয়াশার ও শিশিরের শব্দ হয়ে ঝরে, গন্ধ বিলায় খেজুর ও আখের রসের প্রাতর্স্নানে, তার চিত্রের দৃশ্যমালাও ফের কুয়াশা-রোদের নর্মখেলায় মেতে ওঠে। শীতের হাওয়ার নাচন যখন আমলকীর ডালে ঝাঁপ দিয়ে ডুব দিয়ে পড়ে, তখন তার পত্রপতনশীল শব্দসংগীতও সূক্ষ্ম তান ও তারানা-তেলেনা গাইতে রেয়াত রাখে না। তখন আমলকীগুলো আর লুকিয়ে থাকে না পাতার বক্ষোবাসে। পিঠেপুলি উৎসবের সুগন্ধ ও তা আড়াল করে রাখতে পারে না, আসন্ন বসন্তের উত্তাপের কথা ভেবে ঝলমল হয়ে বাজতে থাকে। শীতের এই শব্দগন্ধসুবাস রমিত হওয়ার যোগ্য কলাকার। সৃষ্টিশীল। এই কুয়াশার বাড়ির ভেতর দিয়ে ছেলেবেলায় সপ্তাহের একদিন বৃহস্পতিবার ছিল রাঙামাটি সরকারি হাই স্কুলে সকালের ক্লাস। শীতকালে কুয়াশার বাড়ির ভেতর দিয়ে আমরা প্রমত্ত আবেগে স্কুলে যেতাম। এগারোটার সময় ফিরে সাপ্তাহিক বাজার করতে যেতাম। তখনো কুয়াশা লেপ্টে থাকত। সে বছর আকাশে উঠেছিল জাপানি জ্যোতির্বিদের আবিষ্কৃত ইয়েকা সেকি ধূমকেতু। এ বছর যেমন এসেছিল আইসেন ও লাভজয়। সব স্মৃতি নিয়ে এ বছর শীত হবে দীর্ঘ, ফাল্গুনকেও তার আগ্রাসী শয্যায় বন্দি করে নেবে। শীতের শব্দগন্ধচিত্রমালায় ভূষিত করবে ভোগবাসনা চরিতার্থ করতে। আমি একটুও ভুলিনি শীতের প্রধান অহঙ্কার আম্রমুকুলের কথা, কাঁঠালের মুচি ও কুলের মুকুল থেকে কচি ফল হওয়ার কথা। শর্ষের ফুলে উত্তরবঙ্গের বিল স্বর্ণকরোজ্জ্বল হয়ে মৌমাছিদের বাসনা বিভোল করার দৃশ্যগন্ধ বিস্তারের মত্ততা। কুকুর পরিবারের শেয়ার এবং বেড়াল পরিবারের বাঘিনী এখন বাচ্চা যত্নে ব্যস্ত। বেড়ালি ও বাঘিনী আশপাশে ঘেঁষতে দেবে না বাঘ ও হুলো বেড়ালকে। গ্রামের বাড়ির বেড়া ও টিনের ফাঁকফোকর দিয়ে জমাট শীতের শিশিরের শব্দ আসবে। টুপটাপ টুবটুব শব্দসংগীতে। পিঁপড়ে, ব্যাঙ, বিলের কিছু জিয়ল মাছ, সাপ শীতঘুমে গিয়ে শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে। পিঁপড়েরা ঠিক ঘুমোয় না; কিন্তু নিরাপত্তার বেষ্টনীতে চলে গিয়ে শীত মোকাবিলা করছে। মজাপুকুর খোঁড়ার সময় শীতঘরে মাছদের দেখা যাবে। কাক এখন যৌবনমদে মত্ত হচ্ছে। শীতে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনের নামে ধ্বংসখেলায় মেতে উঠবে। বাংলার প্রকাশনা জগৎ দিনে ষোলো ঘণ্টা কাজে ঢেলে দিয়েছে অমর একুশের উৎসর্জন তিতিক্ষায়। রবীন্দ্রনাথের ঋতুপর্যায়ের শীতের গানগুলো সৌন্দর্যবেদনার বৈভব হয়ে আছে বাঙালির হৃদয়ে। গুন গুন গেয়ে একটু শুনুন তবে, ‘এ কী মায়া লুকাও কায়া জীর্ণ শীতের সাজে।/আমার সয় না, সয় না, সয় না প্রাণে, কিছু সয় না যে’ অথবা সেই বিখ্যাত শীতরত্ন-‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে। ‘ অথবা, ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে চলে আয়।’ শীত পর্বের ১০টি গান আছে গীতবিতানে। এই সঙ্গে নজরুলের ‘পৌষ এল গো আজি, পৌষ এল গো-মনে করুন নৃত্যগীতবাদ্য যোগে। আমার কাছে এখন রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘গীতবিতান’। পড়তে ও গান শুনতে দুই-ই। প্রকৃতির এত কাছে যাওয়ার আহ্বান গানে-গানে আর কে দিয়েছেন বিশ্বসাহিত্যে! বিষয়-বৈচিত্র্যে, সুরবৈচিত্র্যে ও গভীরতায় গীতবিতান অমূল্য। শীতের শরীর যাতনার ও সুখের গোপন মর্মবাণী প্রকাশ করার প্রাচীন কবি কালিদাসের কথা না বললে ঋতুবিষয়ক কোনো রচনাই সম্পূর্ণ হওয়ার নয়। বলা হয়, কাব্যে উপমা যতক্ষণ অলঙ্কার-মাত্র ততক্ষণ তার মূল্য খুব বেশি নয়, যখন তা রসসৃষ্টির সহায়ক তখনই তার মূল্য। কালিদাসের উপমা এই রসসৃষ্টির সহায়ক বলেই তার এত দাম। কালিদাস ঋতুসংহারে শীত ঋতু শুরু করেছেন এভাবে, ‘হে সুন্দরী! শীত ঋতুর কথা শ্রবণ করো। এই ঋতু শালিধান ও আখের প্রাচুর্যে মনোহর, এখানে-ওখানে উপবিষ্ট ক্রৌঞ্চের [কোঁচবক] নিনাদ এখন সুন্দর, কাম প্রবল, এ ঋতু রমণীদের প্রিয়।’ [টীকা : বকদের মিলন ও বাচ্চা ফোটার দিন এখন। কালিদাসের আশপাশে খেজুর গাছ ছিল নাকি!] ‘চাঁদের কিরণের মতো শীতল চন্দন, শরতের চাঁদের মতো স্বচ্ছ প্রাসাদ তল, এবং ঘন তুষারপাতে শীতল বাতাস এখন লোকের চিত্তকে আনন্দিত করে না।’ ‘যাদের মুখপদ্ম সুখপ্রদ সুরাপানে আমোদিত সেই রমণীরা পান, চন্দন ও ফুলের মালা নিয়ে আবেগ ভরে পর্যাপ্ত অগুরুচন্দনের ধূপে সুবাসিত শয়নকক্ষে প্রবেশ করে।’ ‘মত্তযৌবনা কামিনীরা অপরাধী পতিদের বারবার ভর্ৎসনা করায় তারা ভয়ে জ্ঞানহারা হয়ে কাঁপে। রতিক্রিয়ায় তাদের অভিলাষ আছে দেখে কামিনীরা সব দোষ ভুলে যায়।’ ‘নবযৌবনা রমণীরা সারা রাত্রি বহুক্ষণ যাবৎ অত্যন্ত কামাতুর যুবা প্রণয়ীদের সঙ্গে নিষ্ঠুরভাবে রমণক্রিয়ায় মত্ত থাকায় রাত্রিশেষে বক্ষদেশে শ্রান্তিবোধে অলসভাবে বিচরণ করে।’ ঋতুসংহার কাব্যের শেষ স্তবক শুধু দেখুন এবার-‘এখন গুড়জাত মিষ্টদ্রব্যের প্রাচুর্য, সুস্বাদু শালিধান ও আখে এই ঋতু রমণীয়। রতিক্রিয়া এখন প্রবল। কামদেব এখন গর্বিত। যাদের প্রিয়জন বিচ্ছিন্ন সেই রমণীদের কাছে এই ঋতু মনোবেদনার কারণ। এই শীতকাল সর্বক্ষণ তোমাদের কল্যাণময় হয়ে উঠুক।’ আরো কিছু বাকি রয়ে গেল ঋতুসংহারের। বাকি কথা পরে হোক।