নতুন পাখি চিতাবক

image_1058_298699ভালো একটি দিন। ২০১২ সালের ১৫ অক্টোবর সকাল ৯টার দিকে। আমার গ্রাম চট্টগ্রামের ইছামতীতে। আমাদের পানা ও কলমি দামে ভরা বড় একটি পুকুর আছে। ইছামতী ও কর্ণফুলীর ভাঙনে উদ্বাস্তু হয়ে আমার কাকা অধ্যক্ষ সুশান্ত বড়ুয়া বাড়ি করেছেন এই পুকুরের পশ্চিম পাড়ে। কাকিমা শিপ্রা বড়ুয়া রান্না করছেন। পাকা ঘরের উত্তর দিকে রান্নাঘর। ওখান থেকে কাকিমা শিরীষ, কাঁঠাল, বডাক ও বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে পাখিটা দেখলেন। অমনি ডাক দিলেন, ‘কাকা কাকা, এদিকে এসো, দেখে যাও। চিনতে পারছি না। নতুন একটা পাখি।’ ঘরের ভেতর দিয়ে তিন লাফে ওখানে হাজির।
উত্তর দিকে হেডমাস্টার রবীন্দ্র কাকার পুকুরের পুব পাড়ে। লম্বা জামগাছের খোলামেলা ডালে। কাকার মেয়ে সায়ন্তী এসে হাজির। ওর মাধ্যমিক নির্বাচনী পরীক্ষা চলছে। এক ঝলক দেখে সে টেবিলে চলে গেল। প্রথম দেখায় ওর ঠোঁট, শরীর ও পা দেখে মনে হলো বক জাতের পাখি। মাথা নিচু করতেই ঝুঁটির ওপর দেখি ছিট ছিট কালো ফোঁটা। চিতাবাঘের মতো ছোপ কেন? সারা গা বাদামি বা দারুচিনির মতো। শেষ পর্যন্ত ধূসর কালো। বাদামি ধরনের ঠোঁট, আগা প্রায় সাদা। লেজ প্রায় কালো। মাঝে মাঝে ঝুঁটি খুলছে। পাখা ওড়ার মতো ভঙ্গি করছে, অথবা পালকের নিচে কিছু দেখছে। ঠোঁটের চিরুনি চালাচ্ছে, অথবা তাতে কী বোঝাচ্ছে? বাচ্চা পাখি? পাখি-সংক্রান্ত আমার বিদ্যা হাবুডুবু। এরই মধ্যে আমার হাত থেমে নেই। চার-পাঁচটা ছবি যেমন-তেমন করে তুলে নিয়েছি। যদি সুযোগ আর না আসে? এসব ক্ষেত্রে অচেনা পাখি দ্রুত উড়ে চলে যায়। দূরত্ব একটু বেশি। ৬০-৭০ ফুট হবে। আমার পুঁচকে ক্যাননের লেন্স ৫.১৫। অতি সাধারণ। দূরত্ব বেশি বলে পাখিটা আমাকে আমলে নিচ্ছে না। আমার চারদিকেও গাছপালা। বকজাতের পাখিরা সাধারণত সতর্ক ও ভিতু স্বভাবের। অমনি উড়াল দেবে। সেটা তো হতে দেওয়া যায় না। ছবিতে গায়ের ছিট দাগ তেমন করে উঠল না।
ভিটের সীমানা পেরিয়ে মাস্টার কাকার ভিটেয় ঢুকলাম। গাছপালার জন্য জায়গা পাচ্ছি না। ক্যামেরা চলছে না। পশ্চিম পাড়ে যেতেই পাখিটা আমাকে আমলে নিল। সঙ্গে সঙ্গে উড়ে গেল। গাছপালার ফাঁক দিয়ে বুঝতে পারলাম না কোথায় গেল। হায় হায়! একি করলাম!
বাঁচা গেল। কাকিমা বললেন, আমাদের পুকুরের পশ্চিম দিকে লাগোয়া সুবোধদার ছোট পুকুর। চারদিকে নিবিড় গাছ। পুকুরের ওপর বোরাজাতের বড় একটা বাঁশ ঝুঁকে মাঝপুকুরে ঝুলে আছে। তাতে অজস্র ডাল। পাখিটা ওখানে বসে ঝুঁটির ছিট দেখাচ্ছে বারে বারে। ক্যামেরায় ভালো আসছে না। পুরো পরিবেশ নিবিড় ছায়াঘেরা। সোঁদা গন্ধেও ভরপুর। ডাহুক ও মাছরাঙাদের রাজ্য এটা। পরদিন কাকিমা আবার ডাক পাড়লেন। ওই পুকুরে। হায়, ৫.০-২৫.০ এমএম অবোধ ক্যামেরা! প্রকৃতিবিষয়ক আমার ১৬টি বইয়ের প্রায় সব ছবি আমার তোলা। সেসব ক্যামেরায় মৃণাল সেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আবসার আমেদ, কানাই কুণ্ডু, সুদর্শন সাহা, হায়াৎ মামুদ, হুমায়ুন আজাদ, পান্না কায়সার, ধ্রুব এষ, আলফ্রেড খোকনদের ছবি তুলেছি। সারা বাংলাদেশ তো আছেই। সুন্দরবন, কর্ণফুলীর উজান থেগা, বার্মা, জাপানও।
সালিম আলীর বই ঘেঁটে, শরীফ খান থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম বক মহাশয়ের নাম মালয় বা টাইগার বিটার্ন। বৈজ্ঞানিক নাম Gorsachius Melanoplohus Melanolophus পাখি। শরীফ খানের মতে, বাংলাদেশে কেউ শনাক্ত করতে পারেননি। অর্থাৎ কেউ দাবি করেননি যে তিনি এই পাখি দেখেছেন বা ছবি তুলেছেন। শরীফ খানকে ক্যামেরায় ছবি দেখিয়েছি, প্রিন্ট তখন করা হয়নি। তিনি বললেন, ‘এটি আপনার জন্য রেকর্ড।’ তিনি পক্ষীবিদ রেজা খানকে পাঠিয়ে রেকর্ডভুক্ত করে দেবেন। তাঁর জানামতে বাংলাদেশে দেখতে পাওয়া প্রথম পাখি।
আসাম ও বার্মার কিছু পাখি পথ ভুলে বা বেড়াতে চট্টগ্রামে চলে আসে। সালিম আলী ও ডিলন রিপ্লির বই ‘হ্যান্ড বুক অব দ্য বার্ডস অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান টুগেদার উইথ দোজ অব নেপাল, সিকিম, ভুটান অ্যান্ড সিলোন’ অনুযায়ী এটি ইন্দোমালয়ান ঘন বর্ষণ এলাকার পাখি। ভারতের কেরালা, পশ্চিম মহীশূর (নীলগিরিসহ) থেকে উত্তরে বেলগাউম এবং আসাম, মণিপুরেও আছে। এ ছাড়া মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোচীন, দক্ষিণ চীন, তাইওয়ান, বোর্নিও, সুমাত্রা, জাভা পর্যন্ত বিস্তৃত।
পরিযায়ী হওয়ার খবর পাওয়া যায় না। একমাত্র নিয়মিতভাবে শ্রীলঙ্কায় যায়। আসামের হাফলংয়ের জাতিঙ্গা পাহাড় অঞ্চলে অন্যান্য পাখির সঙ্গে এদের অদ্ভুত এক স্বভাব ধরা পড়ে। এখানকার মানুষেরা রাতে আগুন জ্বেলে দেখালে অন্যান্য পাখির সঙ্গে এরা-ওরা ওই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে এরা মারা যায়, মানুষের খাদ্য হয়।
স্বভাবে নিশাচর। নিশিবকের মতো। দিনে গাছপালায় বসে অন্য নিশাচরদের সঙ্গে বিশ্রাম নেয়। একলা অবস্থায় কাছাকাছি গিয়ে পর্যবেক্ষণ করা খুব কঠিন। আমি না জেনে এই ভুলের শিকার হয়েছি। কাছাকাছি গিয়ে ছবি তুলতে এবং পাখার রং, পা, ঠোঁট ইত্যাদি দেখতে গিয়ে পালিয়েছে। পাখা খুব ঘন ঘন আন্দোলন করে শব্দ না তুলে উড়ে যায়। ঘন কোনো গাছপালায় গিয়ে বসে। এক রকম খড়খড়ে ‘আর্ আর্ আর্’ শব্দ করে বলেছেন পক্ষীবিদ জি এম হেনরি।
খাদ্য মাছ, ব্যাঙ, গিরগিটি, শামুক, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি। ডিম দেওয়া ও বাচ্চা ফোটানোর সময় আসামে মে থেকে জুন। দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে মে থেকে আগস্টের প্রবল বৃষ্টির সময়। ডিম দেয় তিন থেকে পাঁচটি।
পাখিটি খুব সম্ভবত দলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা যাওয়ার সময় পথ হারিয়ে বিভোল ভোলা হয়ে পড়ে। অথবা আসাম থেকে নাগাল্যান্ড বা সিলেট হয়ে এখানে কোনো কারণে এসে পড়ে।
আসামে এর নাম রাজবক, মালয়ালাম থাভিত্তো কোক্কু, শ্রীলঙ্কায় রে কোক্কা। বাংলায় এর নাম চিতা বক হোক। কারণ ওর সারা গায়ে হালকা এবং পালকের নিচে ও ঝুঁটিতে চিতা বাঘের মতো গাঢ় ও হালকা ছিট ছিট দাগ আছে। ইংরেজিতেও এর নাম গধষধু ড়ৎ ঞরমবৎ ইরঃঃবৎহ।
বেঁচে থাকুক, বেঁচে থাকুক আমার গ্রামের অতিথি হয়ে। সুখে কাল হরণ করুক সঙ্গী বা সঙ্গিনী খুঁজে পেয়ে। আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকুক ওকে দেখার প্রথম দিনটি। ওই পুকুরের বাঁশবনের সুদুর্লভ চাক দোয়েলের কথা বলাই হলো না। জলপিপি, ডাহুক, মাছরাঙা, ফিঙ্গে ও পেঁচার দিনগুলোর কথা রয়েই গেল তপ্ত স্মৃতির বুকের স্ফীতিতে।