বসন্তের অন্তর্বাস ও গ্রীষ্ম সুন্দর

image_1182_332622‘তোমার বাস কোথা যে পথিক ওগো, দেশে কি বিদেশে।/তুমি হৃদয় পূর্ণ করা ওগো, তুমিই সর্বনেশে।’ হৃদয় পূর্ণ করা ও সর্বনেশে বসন্ত কোথা থেকে আসে?
বসন্তের পর্যায়ক্রমিক নাম পুষ্পসময়, সুরভি, মধু, মাধব, ফল্গু, ঋতুরাজ, পুষ্পমাস, পিকানন্দ, কান্ত ও কামসখ। তাহলে সে কি বহরূপী, বহুবল্লভ!
‘গাছ গাছে ফুল, জলে পদ্ম, কামিনীরা কামাতুরা, বাতাস সুগন্ধি, সন্ধ্যাকাল সুখপ্রদ, দিনগুলো রমণীয়। বসন্তে সবই অত্যন্ত সুন্দর।’ শুধু কবি কালিদাসের কল্পনায় বা কবি-বর্ণনায় নয়, সত্যি সত্যিই বসন্তের খরমধুর মোহন-মহিমায় প্রকৃতির পরম রমণীয়তা দৃশ্যময় ও স্পর্শময় হয়ে ওঠে। চারদিকে ফাল্গুনের সবই সুন্দর, সবই রম্য ও প্রিয়দর্শন। এমন মানবী-মানব নেই, এমন কীটপতঙ্গ নেই, এমন স্থল-জল-চর জীব দেখা যায় না এ সময় পুলকিত হয়ে ওঠে না। এমন তরুলতা-গাছপালা চোখে পড়ে না কী যেন কী এক উন্মাদনায় রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে না। বসন্ত প্রকৃতির এই প্রমোদ আক্রমণ জীর্ণ বৃদ্ধা-বৃদ্ধকেও আপনহারা করে তোলে। তরুণী-তরুণ কোন ছাড়!
ফাল্গুনের প্রথম দূত অঘ্রাণ-পোষ মাসে আমের মঞ্জরি এসে এই বার্তা রাষ্ট্র করে দেয়। মাঘ মাসের মাঝামাঝি এসে যোগ দেয় মাধবী, পলাশ, শিমুল ও মাদার ফুল। তারপর একে একে যোগ দেয় বাংলার সব শ্রেষ্ঠ ফুল। এই প্রতিযোগিতা চলে গ্রীষ্ম পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে যাদের বর্ষার ফুল বলে এত দিন জেনে এসেছি, তারাও পুষ্পিত হয়ে যায়। হিজল, কেয়া, কদম, কামিনী, কনকচাঁপা, চাঁপা_সবই ফাল্গুন থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসে কুসুমিত হয়ে যায়। ফুটতে থাকে বর্ষা-শরৎ পর্যন্ত। তাই বলি, ওরা বর্ষার ফুল নয়।
আমার প্রতিদিনের চোখের সামনে এই ২৪ ফাল্গুন মহুয়ার পাতা ঝনঝন করে ঝরছে। একই সঙ্গে পাতাহীন ডালের মাথায় এসে যাচ্ছে মহুয়ার কলি। ওদিকে কামিনী গাছটিতে নতুন পাতার চকচকে নবীন সবুজ। চৈত্র মাসের জন্য অপেক্ষায় আছে ফুল ফোটাবে বলে। ওপাশে কালোজামে ফুল এসেছে। মাধবীলতায় এখন বীজ এসে গেছে। মধুমালতী নতুন পাতায় তরুণী। দু-চারটা ফুলও দেখেছি আগে। শাহবাগের ফুলের বিপণিতে দেখে আসুন বেলি ফুলের মালা এসেছে কি না। বসন্তের প্রথম পদ্মকলি আমি দেখে এসেছি ২ ফাল্গুন তারুণ্যের চত্বরে। ওই শাহবাগে। বসন্তের রক্তকাঞ্চন পাতাহীন বৃক্ষ হয়ে উন্মাদনা জোগায় ফাল্গুনে। প্রথম ফাল্গুনের ফুল নাগকেশরের কথা ভুলিনি।
ফাল্গুনী মঞ্জরি হলো গি্লরিসিডিয়া। ফাল্গুনে তার পাতাহীন গাছে ফুল আসে বন্যার মতো। রমনা পার্কে পাবেন। চৈতি মঞ্জরি হলো মিলেশিয়া। বসন্ত রঞ্জিনীর বাংলা নামটির বৈজ্ঞানিক নাম মিলেশিয়া। এসব বাংলা নাম আমার দেওয়া। এরা ফাল্গুন থেকে চৈত্রে ফুটবে ভালোবাসার পাগলির মতো। আর বাংলার নিজস্ব ফুল কুরচি ফুটতে শুরু করেছে। পাখিফুল ও বাঁশফুল ফুটে গেছে। গন্ধরাজ ফুটবে। কৃষ্ণচূড়া ফুটবে চৈত্রের শেষে। বকুল, শিরীষ, স্বর্ণচূড়া, জারুল, চালতা, গুলাচ, সোনালু, ভাট, ঝিন্টি, হাসনাহেনা, পলক জুঁই, জুঁই, টগর, স্থলপদ্ম_এরা সবাই বসন্ত থেকে গ্রীষ্মে ফুটবেই।
স্বর্ণঅশোক হেমন্তে ফোটা শুরু করে। পরপর আসে রাজঅশোক ও অশোক। রমনা পার্কে ১৬টি গাছের অশোক বীথি দেখেছেন? অপরিকল্পিতভাবে ওদের গোড়া বাঁধিয়ে দিয়ে এবং মাঝখানে ইট-সিমেন্টের পাত বসিয়ে তিনটি গাছ মেরে ফেলেছে। বসন্তে অগ্রদূত প্রথম ফাল্গুনে ওরা প্রফুল্ল হবে। ব্যতিক্রম দুটি প্রধান ফুল শিউলি ও ছাতিম।
পৃথিবীতে কবে প্রথম ফুল ফুটেছিল? পৃথিবী সৃষ্টির পরে জলে প্রথম প্রাণের আবির্ভাব ও স্থলে ঘাস ও বৃক্ষের আবির্ভাব ও ফুল ফোটা শেকলের মতো একসূত্রে গাঁথা। প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগে আদিম সমুদ্রে প্রথম অঙ্কুর সৃষ্টি হয়। লাল, বাদামি ও সবুজ শৈবাল আর প্রাণিজগতের স্পঞ্জ। তার ১০ কোটি বছর পরে পৃথিবীতে জন্মে সবুজ ফার্ন। ফুলের তখনো দেখা নেই। সবীজ ফার্ন থেকে জন্মে পাইন জাতীয় গাছ। সেই আদিম পাইন অরণ্য ছিল ডাইনোসরদের বাসভূমি। প্রায় ১৩ কোটি বছর আগে সবীজ ফার্ন বা আদিম কোনো পাইন জাতীয় উদ্ভিদ থেকেই প্রথম পুষ্পতরুর জন্ম। তখন পাঁচটি মহাদেশ মিলে ছিল একটি স্থলভূমি। তার নাম গন্ডোয়ানা ভূমি। তারপর এলো কীটপতঙ্গ, পাখি, জীবজন্তু ও মানুষ।
গাছপালা, ফুল, কীটপতঙ্গ, জীবজন্তু ও মানুষ নিয়ে এই পৃথিবী একটি বৃহৎ শৃঙ্খল। ছড়ানো জাল। বসন্ত-বর্ষাও তার অংশ। দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে বর্ষার দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বঙ্গোপসাগর-আরব সাগর হয়ে বাংলা-ভারত উপমহাদেশে ঢোকে। সাধারণত ১ থেকে ৫ জুন ভারতের কেরল রাজ্যে ঢুকে উত্তর-পুব দিকে বাংলাদেশে আসে। মোট সাতটি পথে মৌসুমি বায়ু উপমহাদেশে ঢোকে। তার থেকে বর্ষা ঋতু, আমাদর জীবন। আবহবিদরা এর নাড়িনক্ষত্র জানেন। বসন্ত কোন পথে আসে?
ও ফাল্গুন, ও বসন্ত, তোমার নিবাস কোথায়? বসন্ত বলছে, ‘আমার বাস কোথা যে জান না কি,/শুধাতে হয় সে কথা কি/ও মাধবী, ও মালতি!’ উত্তরে মাধবী ও মালতি গাইছে, ‘হয়তো জানি, হয়তো জানি, হয়তো জানি নে,/মোদের বলে দেবে কে সে’ এই বাণীগুলো রবীন্দ্রনাথের গীতবিতানের বসন্ত ঋতু পর্যায়ের ২২৫ নম্বর গান থেকে নেওয়া। তাহলে কি দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে মলয় হাওয়ার সঙ্গে ফাল্গুন বা বসন্ত আসে! প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আসে বলেই কি ফাল্গুন হাওয়া এত প্রশান্তিদায়ী! এত ভালোবাসা উদ্রেককারী! ওর আসার সময় হলেই আম্রমুকুল ও কাঁঠালের কুঁড়ি জানিয়ে দেয় এক মাস আগে থেকে! ফুল ও পাখির এবং উতল হাওয়ার এত সখাসখি-কানাকানি-ভালোবাসাবাসি! ফুল থেকে মানুষ শিখেছে রঙিলা হতে, সুগন্ধি ব্যবহার, সৌন্দর্য চেতনা। পাখি থেকে শিখেছে গান গাওয়া। জীবজন্তু থেকে শিখেছে ভয়, সংকেত, অভয়। পরিপূর্ণ হলো মানুষের ভাষা, ভাব, ভালোবাসা, মেধার সম্পদ। ভালোবাসার ব্যাপারটা সব সময়ই গোলমেলে। ও ফাল্গুন, ও ভালোবাসা, ও ফুল-পাখির উসকানি-ইঙ্গিত, তোমরা আর আমাদের সন্তাপিত করো না, যৌবন ধনকে বেহেড বুভুক্ষু করো না! নাকি ‘এত দিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে/দেখা পেলেম ফাল্গুনের’ গান গাইব!