লুবনা

সহিংস এক লড়াই শেষে তিন তালাক মেনে নিয়ে যে স্বামীর সঙ্গে আপনার সম্পর্কের যবনিকাপাত ঘটল, সাতাশ বছর পর যখন তার সঙ্গে আবার দেখা, আপনি না দেখার ভান করে দ্রুত অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবেন?

তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তো পুরনো যন্ত্রণাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার কথা এ অমানুষটার সঙ্গে তিন বছর কেমন করে ঘর করলেন? আজ যখন সামনে পেয়েছেন, এতগুলো মানুষের সামনে প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগটা হাতছাড়া না করে দু’গালে না হোক অন্তত এক গালে, প্রবল শক্তিতে না হলেও মাঝারি মাপের একটা চড় কষিয়ে দিতে ইচ্ছে যদি করেই, দিন একটা চড়। এটা আপনার সাবেক স্বামীর পাওনাই। চিন্তা করবেন না, কেউ আপনাকে একটি কথাও বলবে না। তাছাড়া পুরুষ মানুষ কখনও পুরুষের পক্ষে দাঁড়ায় না। এটাই নিয়ম।

অবশ্য সংসারের এত ব্যস্ততার মধ্যে একজন পুরুষের বিরুদ্ধে ক্রোধ কি আর প্রতিদিন তা দিয়ে পুষে রাখা যায়? টানা সাতাশ বছর!

কেন যাবে না? আপনি তো কম নির্যাতিত হননি। আপনার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছে আপনি হয়ে উঠেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অচেনা মানুষ। আপনার স্বামীর ভয়ে এমনকি ছেলেবেলার বন্ধুদেরও ‘আপনি’ বলতে শুরু করেছেন। ঘুম থেকে উঠে দেখলেন সেতারের সব তার কাটা। আপনি জানেন, আপনার স্বামী ছাড়া এ কাজ আর কেউ করেনি। তবুও মুখ খোলেননি। সদ্য গর্ভধারণ করেছেন; কিন্তু তালাকের প্রস্তুতি হিসেবেই আপনাকে আনাড়ি ডাক্তারের হাতে গর্ভপাতে বাধ্য করেছে। অপটু হাতের খোঁচাখুঁচিতে আপনার জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং মেয়াদি রক্তপাত ও যখন তখন যন্ত্রণা আপনাকে বহুদিন কাতর করে রেখেছে; সেই সাবেক স্বামীর সঙ্গে দেখা হলে আপনি কী করবেন?

মিসেস লুৎফুল কবিরকে দেখে আমিই সতর্ক হয়ে যাই। গত সাতাশ বছরে একবারই দেখেছিলাম আমি; ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের রিসেপশনে। আমি এসেছিলাম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একজন মাননীয় মন্ত্রীকে তেল দিতে। তাকে দেখতে ব্যাংকক আসিনি। ব্যাংকক এসেছিই যখন, আর তিনিও যখন প্রোস্টেট ক্যান্সারের যন্ত্রণায় কাতর, অপারেশনের দিন গুনছেন, জ্যেষ্ঠতার গুণে যেহেতু এখনই তার বাদ পড়ার সম্ভাবনা নেই আমিও বিদেশি কায়দায় হলমার্কের গেটওয়েল কার্ড কিনে, সাদা রিবনে প্যাঁচানো থাই ফুল কিনে তাকে দেখতে কিংবা তেল দিতে এলাম।

লুবনার সঙ্গে লুৎফুল কবির ছিল, কার সমস্যা সারাতে এখানে এসেছেÑ নিজের, না স্বামীর বুঝতে পারিনি। অন্তত চেহারা দেখে কাউকে বিপদাপন্ন কিংবা অসুস্থ মনে হয়নি। অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক অসুখ এত গভীরে লুকোনো থাকে যে, চেহারা তার কোনো আভাসও দিতে পারে না।

কোনো কথাই হয়নি, সম্ভবত চোখাচোখিও না। তবে লুৎফুল কবির ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছিলেন। তিনি আমাকে কতটা চেনেন, আমার জানা নেই। আমি জানি, বিয়ের সময় লুৎফুল কবির ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার ছিলেন। মেধা ও দক্ষতা এবং রাজনৈতিক আঁতাতে অনেককে পেছনে ফেলে তিনি এখন ব্যাংকের ডেপুটি সিনিয়র অফিসার ছিলেন। মেধা ও দক্ষতা এবং রাজনৈতিক আঁতাতে অনেককে পেছনে ফেলে তিনি এখন ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আমার সঙ্গে কখনও পরিচয় ঘটেনি। তবে এক-দু’বার খবরের কাগজে ছবি দেখে এবং বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা নিয়ে টেলিভিশন আলোচনায় একাধিকবার দেখার কারণে চেহারাটা আমার পরিচিত।

লুবনা স্বামীর সঙ্গে থাকাতে আমি আশ্বস্ত থেকেছি যে, আমার ওপর চড়াও হয়ে পুরনো দিনের রাগ ঝাড়বে না।

তিনি মানে লুবনার স্বামী কি আমাকে চেনেন? আমার ছবিটবি কোথাও ছাপা হয়নি। ছাপাতে হলে কলাম ইঞ্চির দরে টাকা দিয়ে ছাপাতে হবে। আর লুবনা তার অ্যালবামে আমার কোনো ছবি রেখে লুৎফুল কবিরকে বলবে, এটা আমার ফার্স্ট হাজব্যান্ডÑ এমন সম্ভাবনা একেবারেই নেই।

ঘাড় ঘুরিয়ে লুৎফুল কবির হয়তো মিষ্টি চেহারার নার্সটাকে দেখছিলেন। আর নিজের গুরুত্ব বাড়াবার জন্য আমি ভেবেছি, আমাকে দেখেছেন।

ধানমন্ডি ৮ নম্বর ব্রিজের কাছে হোয়াইট প্যালেস কমিউনিটি সেন্টারে ঠেকায় পড়ে যাওয়া একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে সাতাশ বছর পর লুবনা ইয়াসমিনকে দেখে আমি সতর্ক হয়ে যাই। লবুনার সঙ্গে সংসার জীবনে আমার কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ এবং কিছু অকারণ রূঢ়তার জন্য কিছুটা বিব্রতবোধ করতে থাকি এবং খাওয়া শেষ হওয়ার পর লাইন ধরে বেসিনে হাত না ধুয়ে দুটো টিস্যুতে হাত মুছে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

মইদুল আহসান সাহেবের মেয়ের বিয়েতে এসেছি। আহসান সাহেব একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার। আমার আমদানি ব্যবসায় তার করুণা সৌভাগ্য বয়ে আনতে পারে। তিনি ঘুষ খান না। সুতরাং তার মেয়েকে ভিন্ন ধরনের উপহার দিয়ে তাকে মোহিত করার লক্ষ্যে নতুন দম্পতির জন্য থাই এয়ারলাইন্সের দুটো ঢাকা-ব্যাংকক-ঢাকা টিকিট দিয়েছি। তিনি তার খুশিটা চেহারায় উদ্ভাসিত হতে দেন না। তবে তার স্ত্রী পুলকিত হয়ে বললেন, ব্যাংককে আপনাদের কোনো থাকার জায়গা আছে? আমার কখনও যাওয়ার সুযোগ হয়নি। যেমন স্বামী আমারÑ হয়তো কোনো দিনও হবে না।

তার সামনেই বলেছি, নিয়ত করে ফেলুন। ইনশাল্লাহ ব্যবস্থা হবে।

আমার বন্ধুদের প্রায় অনেকেই রেড মিট ছেড়ে দিলেও আমি সুযোগ পেলেই বাড়তি খাসিসহ কাচ্চি ও বোরহানি মেরে চলছি। শরীর কিছুটা স্থূলকায় হলেও সুস্বাদু খাবার থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখে মৃত্যুবরণ করতে চাই না।

খেতে খেতে টিপাইমুখ বাঁধের আলোচনায় যোগ না দিয়ে আমি যখন আরও এক পিস খাসির টুকরো প্লেটে নিচ্ছি, পিঠের দিকে আলতো করে হাত রেখে তিনি বললেন, এখনও কাচ্চি চলছে!

আমি ঘাড় ফেরাই। মিসেস লুৎফুল কবিরের সঙ্গে সাতাশ বছর পর চোখাচোখি হয়। আমি হাতের মাংসের টুকরো মুখের কাছাকাছি এনে স্বয়ংক্রিয় উচ্চারণে বলে উঠি, ভালো আছেন?

তিনি বললেন, খাওয়া শেষ হলে কথা আছে।

এখনও কাচ্চি চলছে কিংবা খাওয়া শেষে হলে কথা বলবÑ এতে আমি কীভাবে সম্বোধিত হয়েছি বুঝতে পারিনি। আপনি, না তুমি? তাহলে আমি সরাসরি আপনি বলতে গেলাম কেন?

তার নিঃশ্বাস আমার ঘাড়ে না পড়লেও আমি বুঝতে পারছিÑ তিনি পেছনেই দাঁড়িয়ে। আমার খাবার ছন্দটা পড়ে গেছে। আমি তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শেষ করব, না ধীরলয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। আটজনের এই গোলটেবিলে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের চেয়ারম্যান তানভির আহমেদ আছেন। তিনি আমার বর্তমান স্ত্রীর বড় ফুফুর ছেলে। এ বিষয়টাও মাথায় আছে, যতটা সম্ভব সংযত থেকে এক গ্লাস বোরহানি খেয়ে, জর্দা মুখে না তুলে টিস্যুতে হাত মুছতে শুরু করলাম।

মিসেস লুৎফুল কবির বললেন, জর্দা চলবে না?

ওহ্্ আচ্ছা বলে আমি দু’চামচ মুখে দিই। আবারও আধ গ্লাস বোরহানি খাই।

আমি উঠে দাঁড়াই।

তিনি জিজ্ঞেস করেন, হাত ধোয়া লাগবে না?

আমি বললাম, চলবে।

– বউ আসেনি?

– কুহু বিয়ের খাবার পছন্দ করে না, সে জন্যই আসেনি।

– বউয়ের নাম কুহু! সুন্দর নাম তো।

– আসলে ওর নাম মোসাম্মৎ কোকিলা খাতুন। একটু গ্রাম্য ধাঁচের তো। তাই আমি পাল্টে দিয়েছি। বলে আমি নিজেই বিব্রত বোধ করলাম। আমার বর্তমান স্ত্রীর ছোটখাটো দুর্বলতার কথা সাবেক স্ত্রীকে বলার কোনো মানে নেই। আর বলব না।

তানভির আহমেদ বললেন, আনিস, কোকিলাকে বাসায় আসতে বলো।

– জি ভাইজান, বলব।

আমি এক পা-দু’পা করে সরে আসতে থাকি।

মিসেস লুৎফুল কবির বললেন, চেহারাটা তো আগের মতোই আছে।

আমি বললাম, চুল তো সাদা। কলপ লাগিয়েছি বলেই আর একবার বিব্রত বোধ করলাম।

নিজের একটা দুর্বলতার কথা লুৎফুল সাহেবের স্ত্রীকে বলার কী দরকার? তিনি বললেন, অবশ্য তখনই তো পাক ধরতে শুরু করেছিল। কারও কারও কম বয়সেই পেকে যায়। মাশআল্লাহ, লুৎফুলের চুল পাকেও না, পড়ে না।

মিসেস মইদুল হাসান দ্রুত এগিয়ে এসে বললেন, আনিস ভাই, যাবেন না শৈলী আপনাকে ডাকছে, আপনাকে পাশে নিয়ে ভিডিও করবে।

শৈলী?

হ্যাঁ, আমার মেয়ে। নিকিতা আহসান। আমরা শৈলী ডাকি। এত বড় একটা গিফট দিলেন। আমি বত্রিশ বছরে যা পাইনি, ও বিয়ের দিনই তা পেয়ে গেল, আপনার সঙ্গে ছবি তুলবে না, কথা হলো?

বিব্রত কণ্ঠেই বললাম, আচ্ছা আসছি।

মিসেস কবির জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার শৈলী ডাকে কেন? খুব পরিচিত নাকি?

আজকেই প্রথম দূর থেকে দেখেছি। এখন কাছে থেকে দেখা হবে।

নিজের দেওয়া এই উত্তরও আমাকে বিব্রত করলÑ আমি কি মিসেস কবিরের কাছে জবাবদিহি করছি। দূর থেকে দেখেছি এ কথা কেন বলতে গেলাম?

কিংবা কাছে দেখা হবে, এ কথা বলারই বা মানে কি? শৈলী আমার খুব পরিচিত হলে অসুবিধে কি?

শৈলী কি উপহার পেল?

এই আর কি, বলে আমি প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে যেতে চাই। আমি মিসেস কবিরকে কেন আপনি সম্বোধন করছি? তিনি তো করছেন না। অবশ্য তিনি সরাসরি তুমিও বলছেন না। তিনি যেভাবে বলছেন, তাকে বলে ভাববাচ্যে কথা বলা। আমি পারি না। আমি জিজ্ঞেস করি, আপনি খেয়েছেন?

তিনি বললেন, কোকিলা খাতুন যদি বাজে খাবার না খায়, আমাকে কেন খেতে হবে? আমিও খাই না।

না এলেই পারতেন?

না এলে কি আর দেখা হতো? অবশ্য না এসে আমার উপায়ও ছিল না। শৈলীর বর কুদরত-ই-ইলাহী লুৎফুলের বড় বোনের ছেলে। একটু হাবাগোবা টাইপের। তবে ভালো ছেলে।

কবির সাহেব এলেন না?

ফরেন এক্সচেঞ্জ স্ট্যাবলাইজেশন নিয়ে সেমিনার করতে গেছে হাওয়াই। সঙ্গে নিয়ে গেছে হাওয়াই মিঠাই, মিনি চিশতি, ওদের জুনিয়র অফিসার। ওই যে ইংরেজি খবর পড়ে সেই মিনি।

এত মেয়ে থাকতে মিনি কেন?

কবির সাহেবের ব্যক্তিগত বিষয় জানতে আমি তেমন আগ্রহী নই। আমি শৈলীর মঞ্চের দিকে পা বাড়াতেই মিসেস কবির আমার হাত ধরে টানলেন। মুখ খিঁচিয়ে বললেন, সাতাশ বছর পর দেখা, আমার চেয়ে শৈলী বড় হয়ে গেল? আর তুমি আমার সঙ্গে এভাবে আপনি আপনি করে কথা বলছ কেন?

মিসেস কবির এবার আমাকে সরাসরি তুমি বলেছেন। অবশ্য এতে আমার আতঙ্ক কিছুটা কেটেছে।

শৈলীর কাছে পরে যাবে। আমার সঙ্গে চলো।

আমি সম্ভবত প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তাকে অনুসরণ করি। আমাকে বলে, গাড়ি ছেড়ে দাও।

আমি বলি, রিকশায় এসেছি।

তাহলে তো সমস্যা নেই।

মিসেস কবির ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন, খেয়েছ?

ড্রাইভার বলল, প্যাকেট দিয়েছে ম্যাডাম।

আনিস গাড়িতে ওঠো।

আমি বললাম, আমার তো কাছেই, রিকশায় চলে যাব।

ওঠো বলছি।

ড্রাইভারের সামনে অবলীলায় বললেন, তোমাকে কিডন্যাপ করলাম। ফোন করে কোকিলা খাতুনের কাছে মুক্তিপণ দাবি করব। এবার বলো, তোমার বাচ্চারা কী করছে?

ছেলেটা ফার্মেসিতে পাস করে চাকরি খুঁজছে। নাকউঁচু ছেলে। ভালো ইন্ডাস্ট্রি ভালো বেতন না হলে চাকরি করবে না। মেয়েটা একটা বাজে ছেলের সঙ্গে ভেগেছে।

তোমার চেয়েও বাজে?

আমি জবাব দিইনি।

আমার বাসায় এক কাপ চা খেয়ে যাও। ড্রাইভার বাসায় নামিয়ে দেবে।

আমি না বলার মতো শক্তি ভেতর থেকে পাইনি।

লুৎফুল কবির পৈতৃক সূত্রেই ধনী। ধানম-িতে বাবার এক বিঘার প্লটের অর্ধেকটায় লাল ইটের ছ’তলা উঠেছে, বাকি অর্ধেকে আরও উঁচু ভবন হবে।

আমি বললাম লুবনা আমি দুঃখিত। তোমার সেতারের তার কেটে ফেলেছিলাম।

লুবনা বলল, তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ। সেতার বাজাবার ধৈর্য আমার কোনোদিনও ছিল না। সেতার ছাড়ার সুযোগটা তুমিই করে দিয়েছ। সেদিন মুখে যাই বলে থাকি, মনে মনে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়েছি।

আমি বললাম, লুবনা আমি খুব দুঃখিত। তোমাকে ভালোমন্দ কিছুই ভাবার সুযোগ না দিয়ে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের গেট থেকে তুলে নিয়ে এসেছি। তারপর আমার সংসারে এসে তোমাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।

আমার তো মজাই হয়েছে। পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করছিল না। পড়ার হাত থেকে বাঁচতে আমিও কিডন্যাপ হওয়ার জন্য বসেছিলাম। তুমি না করলে অন্য কাউকে কিডন্যাপের প্ররোচনা দিতাম।

লুবনা ধীরে ধীরে আমার আরও কাছাকাছি যেভাবে ক্রন্দনরত শিশুদের থুতনিতে হাত রেখে বয়স্করা জিজ্ঞেস করেÑ কী হয়েছে বাবু, মা মেরেছে? এমনই ভঙ্গিতে আমার থুতনি উঁচিয়ে লুবনা জিজ্ঞেস করল, কোকিলা খাতুনের সঙ্গে কেমন চলছে?

কী চলছে?

লুবনা বলল, ধ্যাৎ বোকা ছেলে। বার্ধক্যে ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যায়। এটা অবশ্য প্রোস্টেট ক্যান্সারের লক্ষণ।

লুবনার কথা বুঝতে আর সমস্যা হচ্ছে না। লুবনা আমার স্ত্রীকে আর কুহু নামে বাঁচতে দেবে না।

সুঘ্রাণ চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, আই অ্যাম সো সরি। ছাড়াছাড়ির আগে বেবিটাকে অ্যাবর্ট করতে হলো, তোমাকে অনেক সাফার করতে হয়েছে।

লুবনা বলল, টাকা বাঁচাতে তুমি আমাকে হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে পাঠালে, ক্যানুলা নাকি নাম, এর খোঁচায় আমার জরায়ুর বারোটা বেজে গেল। তারপর রক্ত আর যন্ত্রণা। তারপর কতবার চেষ্টা করেছি; কিন্তু জরায়ু আর বাচ্চা ধরে রাখতে পারেনি। আমি মাথা নিচু করে বলি, আই অ্যাম সো সরি।

লুবনা আমার বলা ‘সরি’ নস্যাৎ করে দিয়ে বলল, আরে তুমি তো আমার উপকারই করলে, ছেলেমেয়ের চিন্তা থেকে জীবনের মতো বেঁচে গেলাম। মেয়েটা রেপড হলো কি-না কিংবা পুলিশ ছেলেটাকে গুম করেছিল কি-না এসব ভেবে যাদের ঘুম হারাম করতে হয়, আমি তাদের দলে নেই। তারপর একটা সময় যখন দেখলাম কনসিভই করছি না, স্বামীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলাম।

আমার অপরাধগুলো একে একে স্বীকার করে আমি সম্ভবত ক্ষমা প্রার্থনাই করছিলাম। কষ্ট হয়তো ভুলবে না; কিন্তু এখন তার যে বিত্তবৈভব ও আয়েশি জীবন, নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করে দেবে।

লুবনা সুইচ বোর্ডে একটা নব উল্টো ঘুরিয়ে আলোর তীব্রতা কমিয়ে শান্ত ডিমলাইটের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। আমি বললাম লুৎফুল কবীর সাহেব অনেক ভাগ্যবান।

লুবনা বলল, অবশ্যই। কোকিলা খাতুন তোমাকে ব্যবসা পাইয়ে দিতে কারও সঙ্গে শোবে? লুৎফুলের প্রমোশনের জন্য আমি এক সময় তিনবার তার জিএমের সঙ্গে শুয়েছি। এবার এমডি আর একজন বোর্ড মেম্বারের সঙ্গে। বোর্ড মেম্বার বলেছেন, জাস্ট ওয়েট এবারই লুৎফুলকে এমডি বানাব।

আমি চায়ের কাপ রেখে তার দিকে তাকাই।

আমি প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলি, সরি। আসলে পাবনা থেকে তুলে আনার পর এত ব্যস্ত ছিলাম যে, তোমাকে নিয়ে একবার কাজী অফিসে গিয়ে কাবিনে সইটই করব সেটাও করা হয়নি।

বুদ্ধিমানের কাজ করেছ। সে কারণেই মোহরানা ও খোরপোশ দাবি করতে পারিনি। দাবি করলে আর ক’টাকা পেতাম। বরং তোমার বাচ্চা পেটে ধরে গর্ভপাত করে অবিবাহিত অবস্থায় যে ফিরে যেতে পেরেছি, লাভ তাতেই বেশি হয়েছে। লুৎফুল কবিরের সঙ্গেই আমার প্রথম বিয়ে। তোমার তিন তালাকের দরকারও ছিল না। বললেই হতো, যাও।

আমি আবার বলি, আই অ্যাম সো সরি।

লুবনা বলল, আরে ধ্যাৎ সরি-টরির কী আছে।

দোষগুলো স্বীকার করতে পারলে অপরাধবোধটা কমে।

লুবনা এসে দু’পা ছড়িয়ে আমার জোড় হাঁটুর ওপর বসে। যেন আমাদের মধ্যে কোনো ঘটনাই ঘটেনি। লুবনা কেমন অবলীলায় আমার অপরাধবোধটা বিলীন করে দিল। আমার শার্টের বোতাম খুলতে থাকে, সাতাশ বছর আগে যেমন করে খুলত।

আমার চাঞ্চল্যের কাছে হার মানতে মানতে লুবনার টানে তার বেডরুমে ঢুকে পড়ি। লুবনা শরীর ধরে রেখেছে। লুবনা ফল খায়, সবজি খায়, সিøমিং টি খায়, কোমরে সোয়ানা বেল্ট বাঁধে, জিমনেশিয়ামে যায়। আমি চর্বিওয়ালা মাংস খাই, নোনতা পনির খাই, টাঙ্গাইলের চমচম খাই, ডাক্তারের চোখে যা কিছু অখাদ্য-কুখাদ্য তার সবই খাই।

আমাদের লড়াই যখন তুঙ্গে তখন আচমকা একটা ঘটনা ঘটল: আমার হাতে দলিত-মথিত হতে হতে হঠাৎ লুবনার স্তনজোড়া স্থানচ্যুত হয়ে একটি আমার হাতে ও একটি বিছানায় ছিটকে পড়তেই কে যেন আমার ভেতর থেকে বলে উঠল, ওহ্্ মাই গড!

আমার শরীর একদম ঠা-া হয়ে গেল।

প্লিজ আনিস, প্লিজ আনিস বলে লুবনা চিৎকার না শীৎকার দিলÑ ধরতে পারলাম না। একটু খেপেই লুবনা বলল, বন্যজন্তুর মতো করো কেন? থাকগে ডন্ট ওরি, আবার লাগিয়ে নেব। বিশ বছর আগেই তো ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ায় দুটোই কেটে ফেলতে হয়েছিল। সিলিকন ব্রেস্ট ইমপ্লান্টও জুতমতো হয়নি। সে জন্য ডাক্তার বলেছে, এসব থাক, ফলস ব্রেস্ট লাগাও।

অসম্পূর্ণ রমণ, একটু অস্বস্তি, লুবনার জন্য অনেকটা কষ্ট নিয়ে আমি ওঠে পড়ি, শার্ট প্যান্ট পরে দ্রুত স্বাভাবিক মানুষের আচরণ শুরু করি। বলি, চা-টা ভালো হয়েছে। খোলা বাথরুম থেকে লুবনা চেঁচিয়ে ডাকে, আনিস, এদিকে এসো।

সাতাশ বছর আগে হলে ডাকতে হতো না। আমাকে কুহুর কাছে ফিরতে হবে। সাড়া না দিয়ে আবার বসার ঘরে চলে যাই। নব ঘুরিয়ে রুমটা আলোকিত করি। লুবনা ফিরল, চোখে-মুখে এক ধরনের যন্ত্রণা নিয়ে।

আমি বলি সরি।

কুহুর কথা ভাবি। কুহু বলে, আনিস তুমি কিচ্ছু পারো না।

লুবনা বলল, নেক্সটা কবে আসছো?

আমি বললাম, আর আসছি না।

স্তনহীন বক্ষ যে আমাকে কিছুটা আতঙ্কিত করেছে তা এড়িয়ে যাই।

আনিস তোমাকে অবশ্যই আসতে হবে। আমি যখন ডাকি তখনই।

আমি ওঠে দাঁড়াই। লুবনা রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে টিপাটিপি করতে করতে বলে, মনিটরে দেখো।

আমি আতঙ্কিত হয়ে দেখি লুৎফুল কবির সাহেবের বেডরুমে আমি দিগম্বর অবস্থায়, পাশে একই অবস্থায় মিসেস কবির। পুরো দৃশ্যটাই ভিডিও করা, এমন কি কৃত্রিম ব্রেস্ট ছিটকে পড়ার দৃশ্যটাও।

লুবনা আমার দিকে তাকায়। বলে এটার নাম লুবনাজ কালেকশন। শেষ যোগ হলে তুমি। লুৎফুল কবিরের এমডি, চেয়ারম্যানও আছে আমার কালেকশনে। বাট ইউ আর ভেরি স্পেশাল। তুমি চাইলে একটা সিডি বানিয়ে কোকিলা খাতুনের কাছে পাঠিয়ে দিই।

আমি আতঙ্কিত হই।

প্লিজ লুবনা, প্লিজ।

সাতাশ বছর আগে কিছুকাল তোমার দাসত্ব মেনে নিয়েছি। আমার দাসত্ব কিছুকাল করো।

লুবনা, তুমি…।

কী বলবে আমি জানি। ওসব থাক। কাল আসছো তো?

কাল?

হ্যাঁ, সন্ধ্যার পরই।

মিসেস কবির কী আমার এসব ছবি ইন্টারনেটে আপলোড করবেন? তারপর তা চলে যাবে ব্লুটুথযুক্ত মোবাইল ফোনে।

আমার ছেলে পাবে, আমার মেয়ে পাবে। কুহু চিৎকার করে জিজ্ঞেস করবে, এসব কী? আমি কামতপ্ত ক্লিওপেট্রার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ক্রীতদাসদের একজন হয়ে বললাম, আচ্ছা।

লুবনা দ্রুত একটা দামি পারফিউম আমার হাতে দিয়ে বলল, কুহুকে দিও। মেয়েরা পারফিউম পছন্দ করে। আমারও ভালো লাগল, লুবনা আমার স্ত্রীকে কুহু বলেছে।

লুবনার কালেকশনে আমার বেঢপ নগ্ন শরীর আর কারও চোখে পড়–ক আমি চাই না। লুবনা কাজটি যখন করতে পেরেছে ইউটিউবে ছড়িয়ে দিতে পারে পাঁচ মিনিটের একটি ভিডিও ক্লিপ। আমার আতঙ্ক বাড়তে থাকে, শরীর আরও শীতল হয়ে আসতে থাকে। কিন্তু আমি জানি শীতল দেহ ক্রীতদাসকে চাবুকে রক্তাক্ত করা হতো। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। লুবনা বলল, ঘাবড়ে গেলে যে! কুহুকে কোন দুঃখে আমার ফ্লাট ব্রেস্ট দেখাতে যাব?

আমি আশ্বস্ত বোধ করি। লুবনা নিশ্চয়ই এমনটা করবে না। লুবনা আবারও জিজ্ঞেস করে কাল আসছো তো?

আমি হাঁ ও না-এর মাঝামাঝি অদ্ভুত একটা ধ্বনি উচ্চারণ করে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকি।

নিচে নেমে যখন হাঁপাচ্ছি, মনে হলো লিফটে নামলেই পারতাম। লিফট যে ছিল মনেও পড়েনি।

চেঁচিয়ে বলতে চাইলাম, আর আসব না।

বাক্যটি আমার কণ্ঠমুক্ত হলো না।

আমি টের পেলাম লুবনার সঙ্গে আমার জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে গেছে। কাল সন্ধ্যায় অনুগত ক্রীতদাস আবার ফিরে আসবে। লুবনার সমতল বক্ষের একঝলক কেবল দেখেছি, দেখার আরও অনেক বাকি।